ত্রয়ী উপন্যাস -প্ৰথম পৰ্ব
ত্রয়ী উপন্যাস - দ্বিতীয় পৰ্ব
ত্রয়ী উপন্যাস - তৃতীয় পৰ্ব

কুলায় কালস্রোত – ১১

এগারো

প্রথমে শিবপুর তারপর ডেমরা অঞ্চলের ঘটনাটা ঘটে যাওয়ার পর যে হামলা আসতই তা যে-কোনো হিশেবেই বোঝা যাচ্ছিল। সেজান গা-ঢাকা দিয়ে আরো মাসখানেক ঢাকাতেই কাটাল। ওপরের দিকে নেতারা কী সিদ্ধান্ত নেন, সেদিকে সে তাকিয়ে ছিল। বোঝা যাচ্ছিল, নেতৃত্ব দুভাগ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তবু আশা ছিল, একটা কিছু সিদ্ধান্ত না নিয়ে আর উপায় নেই। আওয়ামী লীগের ছয়-দফা যে কোণঠাসা করে ফেলবে- এ বিষয়ে কারো দ্বিমত ছিল না। পার্টি কি এই মুহূর্তেই আন্দোলনে নামবে, নাকি আন্তর্জাতিক রাজনীতির দিকে তাকিয়ে এখন সরাসরি আন্দোলন থেকে দূরে সরে থাকবে- এইরকম একটা দ্বিধা— ‘৬৬ থেকে সবার মনে কাজ করে যাচ্ছিল। তবে ছয়-দফা রাজনীতিতে এসে যাবার পর আর সেই দ্বিধার আর অবকাশ ছিল না। কিন্তু তবু পার্টি সেই দ্বিধার জের কাটাতে পারে না। এই সময়ই ফের কর্মীদের মধ্যে অসন্তোষ বাড়ছিল, ছাত্রফ্রন্ট আন্দোলনের জন্যে অসহিষ্ণু হয়ে উঠছিল। এই অসহিষ্ণুতাই ছাত্রফ্রন্টকে শেষে ভাগাভাগির মধ্যে ফেলে দিল।

আর এ কারণেই সম্ভবত নতুন নতুন গ্রুপ তৈরি হল এবং নতুন নতুন তত্ত্ব সামনে এসে গেল। তরুণ কর্মীদের মনে স্বাধীন পূর্ববাংলার চিন্তা ততদিনে জাঁকিয়ে বসে।

সেজান নিজে গোটা জিনিসটা প্রথম থেকেই লক্ষ করছিল। জেল থেকে বেরুবার পর থেকেই নেতৃত্বের দ্বিধা এবং সংশয় কেন, সেটা সে ভালোভাবে বুঝতে চেষ্টা করছিল। তার মনে হচ্ছিল- এ এক বিপজ্জনক মোড়। যদি আন্দোলনের পথে যাও, তাহলে আওয়ামী লীগের মতো জাতীয়তাবাদী স্লোগান সামনে আনতে হবে- যাতে শেষপর্যন্ত তোমারই ক্ষতি, আর যদি সরাসরি আন্দোলনের পথে না যাও, সংগঠনের দিকে ঝোঁকো, শ্রেণী সংগ্রামের লাইনে থাকো- তাহলেও তোমার ক্ষতি

সেজান ক্রমে ক্রমে আন্দোলনের দিকেই ঝুঁকে পড়েছিল। আওয়ামী লীগের স্লোগান সে দিতে পারছিল না, আবার নিষ্ক্রিয় হয়ে বসেও থাকতে পারছিল না। তার ফলে হল ভুখা মিছিল, গুলি এবং হামলা।

এক নেতা বলে ফেললেন, ভুল হয়েছে তোমার। এ হঠকারী লাইন- কার নির্দেশে তুমি ওভাবে আন্দোলনে গেলে? কে বলেছিল তোমাকে আন্দোলনে যেতে? জানো না, এখন আন্দোলন করা মানেই সাম্রাজ্যবাদীদের হাত শক্ত করা? কোনো সেনসিবল লোক তোমাকে সাপোর্ট করবে না।

অন্য আর একজন বললেন, এ কি গোলমেলে ব্যাপার করেছ তুমি- তোমার আন্দোলনের লক্ষ্য কী? তুমি কি সরকার বদলাতে চাও- না কিছু সুযোগ-সুবিধা চাও পিপলের জন্যে? কিছুই স্পষ্ট বোঝা যায় না। তোমার মিছিলে শ্রমিক ছিল, কৃষাণ ছিল, মধ্যবিত্ত ছিল— কিন্তু সামনের কাতারে কারা ছিল বলতে পারবে?

সেজান এইরকম আরো কয়েকজনের সঙ্গে দেখা করল। কিন্তু মনে হল না, কারো সঙ্গে তার চিন্তার মিল হবে। শেষে তার ঘনিষ্ঠ কর্মীরাই এসে তাকে জানিয়ে দিল— এভাবে আর নয়- চিন্তাভাবনায় এরকম জটিলতার মধ্যে আমরা নেই। আন্দোলনও আমরা আর করতে যাচ্ছি না।

আসলে সে নিজে অনুভব করছিল— নিষ্ক্রিয়তা বামপন্থী রাজনীতির জন্যে বিপর্যয় ডেকে আনবে। সেইসঙ্গে এ-ও তার মনে হচ্ছিল- পূর্ববাংলার জন্যে স্বাধীনতার স্লোগানটাই সামনে নিয়ে আসা উচিত। ‘৪৭-এ স্বাধীন হয়নি বাঘা জাতি। তাই জাতীয় মুক্তির পর্যায় এদেশে শেষ হয়ে যায়নি- সেইটি শেষ না করে অন্যকিছু করা সম্ভব নয়। সুতরাং সক্রিয়তা দরকার, আন্দোলন দরকার— এবং সেই আন্দোলনকে জাতীয় মুক্তির দিকে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন— এইটিই ছিল তার চিন্তার ছক। সে এই ছকের সঙ্গে অন্য কারো চিন্তাকে কোনোভাবেই মেলাতে পারল না।

দেশ তো জনগণ ছাড়া আর কিছু নয়। নেতারা তত্ত্ব আনতে পারেন, বিচার-বিশ্লেষণ তৈরি করতে পারেন- সংগঠনও গড়তে পারেন- কিন্তু জনগণকে বুঝতে না পারলে কোনোকিছুই কাজে আসে না। সেই অবস্থায় জনগণের বন্ধুরা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়,”আর যারা জনগণকে প্রতারণা করে, জনগণ তাদেরকেই সামনে তুলে ধরে। এদেশে বারবার এই ঘটনাই ঘটেছে। ১৯৫৬-৫৭ সালে যারা স্বাধিকারের ঘোর বিরোধিতা করেছিল, বলেছিল, এ বৈদেশিক চক্রান্ত, ১৯৬৬-৬৭-তে তারাই আবার স্বাধিকারের দাবি তুলল। ১৯৫২-তে এবং ১৯৫৪-তে এই একই ব্যাপার ঘটেছিল। আন্দোলনের যারা সূচনা করেছিল, তারা নেতৃত্বে থাকতে পারেনি।

কেন হয়েছে এমন? এর একটাই সম্ভবত উত্তর। আর তা হল দুর্বলতা। আর এই দুর্বলতা আসে পার্টির কাঠামোগত গঠন থেকে। জনগণের কথা বলেও পার্টি জনগণের সঙ্গে একাত্ম হতে পারেনি। সেজান এইভাবেই চিন্তা করেছিল ব্যাপারটা।

সে তর্ক করল নেতাদের সঙ্গে। দাবি করল, শুধু সরকার বদলের আন্দোলন নয়, শ্রেণীসংগ্রামের জন্যে পার্টির সাংগঠনিক কাঠামো ঠিক রাখতে হবে।

উত্তর হল— সেটা না। সে লাইন ভুল, দুটো আলাদা আন্দোলন— দুটো আন্দোলন দুভাবে করতে হবে।

না ভুল নয়, দেখবেন দুটো আন্দোলন একসঙ্গে মেলাতে না পারলে সেটাই হবে সবচাইতে বড় ভুল। দেশের সর্বনাশ হয়ে যাবে তাহলে।

এইরকম যখন তর্কবিতর্ক চলছে সেই সময়ই খবর এল, সেজানের কাগজপত্র পুলিশের হাতে পড়েছে। জাফর, বাবর, নীলু, কামালউদ্দিন সবাইকে খবরটা জানিয়ে ঢাকা ছাড়ল সেজান।

এমনিতেই তার খারাপ লাগছিল। কেবলই দিশেহারা হয়ে হাতড়ে বেড়াতে মানুষ কতদিন পারে? আন্দোলনের জন্যে ডাক দাও, পোস্টার লেখো, স্লোগান দাও, মিছিল করো। তারপর সরকারের সঙ্গে সংঘর্ষ হোক। ব্যস্- তারপর চুপচাপ থাকো জেলের ভেতরে এবং বাইরে। তারপর আবার হয়তো একটা ইস্যু তৈরি হবে, তখন আবার আন্দোলনের জন্যে ডাক দাও। এইভাবে বছরের পর বছর, দিনের পর দিন। এক পা এগুনো তো তিন পা পিছিয়ে আসা- এর কোনো মানে হয় না।

এর চাইতে তার নিজের এলাকাই ভালো। গ্রামই তার জন্যে ভালো। পুরনো কমরেড আছে কয়েকজন, তেভাগা আন্দোলন এলাকা- তার জন্যে, নতুন কিছুর জন্যে, একেবারে গড়ে তোলার জন্যে, সেটাই যথার্থ জায়গা।

সে এক শীতের রাতে ট্রেনের থার্ড ক্লাস কামরায় চেপে ঢাকা ছেড়ে চলে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *