ত্রয়ী উপন্যাস -প্ৰথম পৰ্ব
ত্রয়ী উপন্যাস - দ্বিতীয় পৰ্ব
ত্রয়ী উপন্যাস - তৃতীয় পৰ্ব

কুলায় কালস্রোত – ১৪

চৌদ্দ

একাকী থাকার একটা মস্ত সুবিধা যে- কোনো দায় থাকে না, বাইরে বেরুবার নয়, ঘরে ফেরাও নয়। রহিমের মাকে ছুটি দিয়ে দিল, যাও দেশে ঘুরে এসো। বাবুর্চি বিদায় হয়েছিল আগেই। হাসান ভাই চলে যাওয়ার পরপরই। বুবু হাসপাতালে যাওয়ার আগের দিকে এমনিতেই হাসান ভাই অফিসে রাত কাটাত, পরে অবশ্যি জানা গিয়েছিল যে ধানমণ্ডিতেও তার

বাড়ি হয়েছে। হাসান ভাই ঐ বাড়িতেই চলে গেল। ফলে সবদিক থেকেই রাখী ভয়ানক মুক্তবোধ করল নিজেকে।

কোনো-কোনোদিন রাখী বাড়ি থেকে একেবারেই বেরোয় না। শুয়ে থাকে চুপচাপ- না-খেয়ে, স্নান না-করে- শুধু গড়াগড়ি দেয় বিছানায়। একবার এপাশ, একবার ওপাশ। ঘরের মেঝেময় কাপড়, বই, জুতো ইতস্তত ছড়ানো থাকে। রাখী গা করে না ওসব গোছানোর জন্যে। একেক দিন উত্তরের জানালা দিয়ে ঠাণ্ডা বাতাস বয়ে আসতে থাকে, রাখীর ইচ্ছে করে না জানালাটা বন্ধ করে দিতে। একেক দিন রাখী জানালা দিয়ে চৌধুরীদের য়ুক্যালিপটাস গাছটার ডালপালা গুনতে আরম্ভ করে দেয়। ছোট-বড় মিলিয়ে তেষট্টিটি ডাল গুনে দেখেছে সে। আর একদিন সাত ঘণ্টায় সাঁইত্রিশটা পাখি উড়ে এসে বসেছিল ঐ গাছে।

বইয়ের শেফের দিকে একেক দিন তাকিয়ে থাকে- ওহ্ পেপারব্যাকের পাহাড় যেন। রুশ, ইটালিয়ান, স্প্যানিশ, জার্মান, ফ্রেন্স- খুঁজে খুঁজে কিনে এনে সাজিয়ে রেখেছিল। ভেবেছিল, পৃথিবীর সব ভাষার বিখ্যাত উপন্যাসগুলো সে পড়ে ফেলবে। কিন্তু আর হয়নি, পারভিন দুটো একটা পড়েছে— সে নিজেও নাড়াচাড়া করে দেখেছে দু-একখানা— কিন্তু পড়া হয়নি। তখন সময় ছিল না। এখন সময় আর অবসর প্রচুর কিন্তু পড়াটা আর হয়ে ওঠে না। একেক দিন হাসি পায় রাখীর বইগুলোর দিকে তাকিয়ে- আগে সে বইগুলোকে দেখত, এখন বইগুলো তাকে দেখছে।

রাখী একেক দিন ছোট ঘরে তার ছোট্ট পড়ার টেবিলের কাছে গিয়ে বসে। পরিচিত প্রিয় টেবিলটি তার। ম্যাট্রিক পাস করার পর আব্বা কিনে দিয়েছিলেন। ছোট সাইজে, চেয়ারটিও ছোট্ট একেবারে, কিন্তু কুশন দেয়া। রাখী ঐ চেয়ারে বসে তার ছোট্ট ড্রয়ারটা খোলে। দেখে নিচের দিকটা এখনো ভর্তি- কত কী জিনিস যে ওর মধ্যে ঢুকিয়ে রেখেছে। বুবুর বিয়ের ফটো, বোতাম, চুলের কাঁটা, একটা ছোট্ট জরির ওড়না— অনেককাল আগে একটা পুতুল ছিল রাখীর, সেই পুতুলের ওড়না। একটা ছোট সাইজের প্যাড- চিঠি লিখবার মতো কেউ ছিল না তার। মনে-মনে বন্ধু কল্পনা করে চিঠি লিখত সে— ঐরকম কোনো চিঠি হবে। রাখী নিজের হাতের লেখা দেখে অবাক হয়ে যায়— মানুষের হাতের লেখা কত যে বদলে যায়!

এইভাবে রাখী একাকী বাড়িতে ঘুরে ঘুরে বেড়ায়।

এই নিঃসঙ্গতার ভেতর থেকে সুমিতাই জোর করে টেনে নিয়ে যায়। রেস্তরাঁয় খায়, সিনেমা দেখে, পার্কে গিয়ে সারাটা দুপুর গাছতলায় কাটিয়ে দেয়। আর বিদায় নেয়ার সময় বলে, দ্যাখ্ আর পাগলামি করবি না- এবার একটা কিছু আরম্ভ কর, আমি তোর জন্যে চাকরি খুঁজছি।

রাখী কিছু বলে না। সুমির বুকে মুখ গুঁজে থাকে। সুমিতাকে ছাড়তে চায় না।

রাখী একেক দিন আবার খুব সকালবেলা বেরিয়ে পড়ে। ঢাকা শহরের বেসরকারি স্কুল-কলেজগুলোয় খোঁজখবর করে। কেউ আশা দেয় না। মুখের ওপর বলে দেয় কেউ কেউ, ইসলামের ইতিহাস পড়তে পারেননি? জেনারেল হিস্ট্রি কেউ পড়তে চায় না, আর দু-চারটি ছেলেমেয়ের জন্য অত খরচ আমাদের পোষাবে না। রাখীকে আবার ফিরে আসতে হয়।

একদিন পথে নাসিমার সঙ্গে দেখা। সে সুমিতার কাছে যাচ্ছিল, আর নাসিমা বেরুচ্ছিল হাসপাতাল থেকে, মাঝপথে গেটে রাখী নাসিমার হাত চেপে ধরল। অনেক বদলেছে নাসিমা- মুখ-চোখ ফ্যাকাশে, কানের কাছে নীল রগ দেখা যায়। রাখী বলল, পালাচ্ছিলি যে বড়?

নাসিমা ম্লান হাসল, কই না— আমি দেখিনি, সত্যি।

রাখী লক্ষ করে নাসিমার চোখে-মুখে খুশির আলো এসে পড়েছে। শুধায়, তুই এখন কোথায়? তোর আব্বা রিটায়ার করার পর— কোথায় যে বাসা বদলালেন— আমি একদিন তো গিয়ে দেখি কে একজন অন্য লোক সেখানে।

আব্বা তো রামপুরায় বাড়ি করেছেন, তুই নিচের দোতলায় খোঁজ করলেই জানতে পারতিস। তুই কী করছিস? নাসিমা রাখীর চোখে চোখে তাকায়।

রাখী হাসে, আমার কথা পরে হবে, আগে তোর কথা বল্। রাখী নাসিমাকে লনে টেনে আনে। বলে, এবার বল্ শুনি।

আমার আবার কী কথা, দেখতেই তো পাচ্ছিস, নাসিমা মুখ নিচু করে জানায়।

হ্যাঁ, দেখতে পাচ্ছে রাখী। দেখতে পাচ্ছে নাসিমার পেটে বাচ্চা। শুধাল, ক’মাস?

পাঁচ।

ক’টি হয়েছে?

মানে? নাসিমার গলা ঈষৎ ধারালো শোনায়।

না, ওসব কথা নয়, রাখী অন্য কথা শুনতে চায়। ইউসুফ কোথায় কী করছে এখন?

এবার নাসিমার স্বর বদলাল। মুখে কিসের যেন ছায়া পড়ল কেমন। গম্ভীর হয়ে বলল, রাখী আমার জন্যে একটা চাকরি জুটিয়ে দিতে পারিস?

রাখী একটু কাঁপল বুকের ভেতরে। নাসিমারও কি বিপর্যয় ঘটেছে কিছু! সে দুহাতে নাসিমার ঘাড় ধরে শুধাল, কী হয়েছে নাসিমা?

নাসিমা রাগ চাপল, না কান্না, ঠিক বোঝা গেল না। বলল, ইউসুফ জেলখানায়।

ওমা, সে কী! রাখীকে তুলে ধরে কেউ আছাড় দিলেও সে এর চাইতে কম আশ্চর্য হত। সে সহসা কিছু বলতে পারল না। নাসিমাই জানাল, একটু ঝোঁক ছিল রাজনীতির দিকে সে তো জানতিস?

তা জানতাম, রাখীর মনে পড়ে ছাত্র থাকার সময় ইউসুফ য়ুনিয়ন করত। বলল, কিন্তু কোনো পার্টি করত কি?

না, তা করত না, কিন্তু ছাত্রদের আন্দোলন, ওদিকে আবার লোকাল ক্লিক- এইসব মিলিয়ে, সে অনেক কথা।

রাখী বুঝল, ব্যাপারটা জানাতে নাসিমার আপত্তি আছে। সে আবার সহজ হতে চাইল। বলল, কই তোর বাচ্চা কয়টি তা বললি না? তুই কি ঢাকায় থাকবি এখন?

ঢাকায় নয়তো কোন্ চুলোয় যাব- বাচ্চা একটি।

রাখী নাসিমার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখল। সেই নাসিমা-

শান্ত, ধীর, সুন্দর। ইউসুফকে ভালোবেসেছিল। বলত, ওর ওপর আমার কীরকম বিশ্বাস তুই বুঝবি না, দেখিস, আমি সুখী হতে পারব। বলত, আমার ক্যারিয়ারের ব্যাপারে বড় কোনো অ্যাম্বিশান নেই— আমি শুধু সুখের সংসার পাততে চাই।

রাখী কিছু বলতে পারল না। কী বলবে সে? অ্যাম্বিশান না-থাকলেও পার পাওয়া যায় না। কথাটা কি নাসিমাকে বলা যায়?

নাসিমা শেষে একটুকরো কাগজে ঠিকানা লিখে দিয়ে বলল, আমি এবার যাই রাখী, বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে পরে কষ্ট হবে। তুই একদিন বাসায় আয়।

রাখী নাসিমাকে রিকশয় তুলে দিয়ে ফিরে চলল। না, সুমির কাছে আর যাবে না সে আজ। নাসিমা তার মেজাজ খারাপ করে দিয়েছে।

সারাপথে বারবার প্রশ্ন করল নিজেকে- জীবনের কি এই একটাই চেহারা- সহজভাবে কোনোরকমেই দাঁড়ানো যাবে না? শুধুই ধাক্কা মেরে ফেলে দেবে, বারবার করে শুধু টেনে নিচে নামাবে, শুধুই অসহায় করে দেবে।

রাখী বাসায় ফিরে গিয়ে দেখে একটি ছেলে বসে আছে। বসে বসে চা খাচ্ছে।

রাখী অবাক হল। অপরিচিত লোক কিন্তু চা খাচ্ছে কেমন দ্যাখো, তারিয়ে তারিয়ে আরাম করে এমন ভঙ্গিতে চুমুক দিচ্ছে চায়ে— মনে হচ্ছে, যেন নিজের বাড়িতে বসে আছে।

রাখীকে দেখে উঠে দাঁড়াল। বলল, আমার মনে হচ্ছে, আপনি রোকেয়া রাশেদ।

হ্যাঁ, কিন্তু আপনি?

আমি? ছেলেটি হাসল। বলল, আমার পরিচয় পরে হবে, আগে আপনার কথা বলি। আপনার যা ডেসক্রিপশান শুনেছি, আপনি একেবারে হুবহু তাইই। আমার নাম দেবু, দেবতোষ রায়, আপাতত নর্থ বেঙ্গল থেকে আসছি।

রাখীর হাসি পেল দেবুর আচরণ দেখে। বলল, বসুন, বসে বসে চা-টা

শেষ করুন আগে।

ও হ্যাঁ, চা- দেবুর যেন খেয়াল হল। বসে চায়ে চুমুক দিয়ে বলে, আমি তো ঘাবড়েই গিয়েছিলাম, আপনার নাকি কিছুই ঠিক নেই, কখন ফিরবেন। প্রথম আসছি ঢাকায়, অন্য কারো ঠিকানা দেয়নি— কী যে দুশ্চিন্তা হয়েছিল না! তা আপনাদের কাজের ছেলেটা কিন্তু বেশ ভালো। বললাম যখন এটা আমার খালুর বাসা- দিব্যি বিশ্বাস করল, কেমন চা খেতে দিয়েছে দেখছেন না, আপনাদের চা-ও কিন্তু বেশ!

দেবু আসল কথা পাড়ে না- শুধু একথা ওকথায় চলে যায়। শেষে রাখী প্রায় বিরক্ত হয়েই বলল, আমার কাছে কী দরকারে এসেছেন তা কিন্তু বলেননি।

হবে, দেবু আশ্বস্ত করতে চেষ্টা করে। বলে, পরে হবে, আপনি আমাকে চোর ডাকাত ভাবছেন না তো, তাহলেই হল। আমি হাসান ভাইয়ের কাছ থেকে আসছি।

হাসান ভাই? রাখী বুঝতে পারে না।

মানে সেজান সাহেব, হাসান ভাই নামে আমাদের কাছে পরিচিত। হাসান ভাই আমাকে পাঠিয়েছেন। এই বলে সে একটুকরো চিঠি এগিয়ে দিল। চিঠিটা হাতে তুলে দিয়ে বলল, আমি সাদেক সাহেবের সঙ্গেও দেখা করতে গিয়েছিলাম, উনি ঢাকায় নেই। তাই আপনার এখানে চলে আসা, এই আর কী!

রাখী ততক্ষণে চিঠিটা খুলে ফেলেছে। ছোট চিঠি, দু’তিন লাইন মাত্র লেখা— এই ছেলেটিকে সাহায্য করো- ও ঢাকায় প্রথম যাচ্ছে।

রাখীর রাগ হল। বলল, তা আমাকে কেন লিখেছেন এই চিঠি?

বাহ্, নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে।

কী কারণ? রাখী ঘুরে দাঁড়ায়।

তা আমি কেমন করে বলব, আপনাকে লেখা চিঠি, কারণটাও আপনারই জানবার কথা।

রাখী ভয়ানক রেগে যায় ঐ কথার পরে। বলে, আমি আপনাদের পার্টি- ফার্টি করি না- আমি কেন এসব ঝামেলা পোয়াতে যাব।

আমি কিন্তু দিন তিনেক থাকব, দেবু ঠিক সেই মুহূর্তে বলে।

একদিনও নয়, রাখী যেন জ্বলে উঠল। বলল, অনেক ঝামেলা হয়েছে এমনিতেই, আপনি এক্ষুনি চলে যান।

দেবু কাঁচা ছেলে নয় একেবারে। বলল, আপনি থাকতে দেবেন না, ঠিক আছে, কিন্তু এরকম রাগারাগি করছেন কেন! আমি কী করব, সেটা বলে দিন অন্তত।

আমার কি গরজ পড়েছে যে সেকথা বলতে হবে। আপনি বেরোন এখন এ বাড়ি থেকে, ভালোয় ভালোয় বলছি।

বাহ্, আমি কোথাও থাকবার জায়গা পাব না? ভারি মজা তো! দেবু তখনো অবিচলিত।

আর একটি কথাও নয়, এরপরও যদি ওভাবে আপনি বসে থাকেন, তাহলে আমি লোক ডাকব।

দেবু ঘোর অনিচ্ছায় উঠে দাঁড়ায়, ঝোলাঝুলি ঘাড়ে তোলে, তারপর বলে, আপনি কিন্তু ঠিক ব্যবহার করলেন না আমার সঙ্গে, অথচ আপনার সম্পর্কে আমার অন্য ধারণা হয়েছিল। মহিলাদের বেশি রাগ থাকা ভালো নয়, জানেন তো।

ঐ কথায় রাখীর হাসি আটকে রাখা দায় হয়ে উঠল কিন্তু হাসল না সে। মুখের কঠিন ভাবটা জাগিয়ে রাখল।

দেবু দরজা পার হয়ে গেলে পেছন থেকে ডাকল হঠাৎ, শুনুন। দেবু কাছে এলে শুধাল, কোথায় আছেন সেজান সাহেব, সেকথা তো বললেন না। দেবু রাখীর কথা শুনে হেসে ফেলল। চোখ নাচিয়ে বলল, এতই সোজা- আপনি জিজ্ঞেস করলেই আমি বলে দেব?

রাখীর মাথায় রক্ত চড়ে গেল। বলল, ঠিক আছে, যান আপনি।

ছেলেটি চলে যাওয়ার পর রাখী অনেকক্ষণ বসবার ঘরে বসে রইল। গোটা ব্যাপারটা কী হল, বুঝতে চেষ্টা করল। শেষে মনে হল, সে অহেতুক রাগ করেছে ছেলেটির ওপর, ওভাবে মেজাজ খারাপ না করলেও পারত।

ঘর অন্ধকার হয়ে যাবার পরও রাখী বসেছিল একইভাবে। একটু পর পায়ের শব্দ শুনে মুখ তুলে দেখল সুমিতা এসেছে। সুমিতা ঘরে ঢুকেই শুধাল, কী রে এভাবে অন্ধকারে বসে কেন? শরীর খারাপ?

সুমিতা টেবিলের ওপর পড়ে-থাকা কাগজটা হাতে তুলে নিয়ে দেখল।

তারপর ডাকল, রাখী!

কী।

তুই কি সত্যিই পলিটিক্সে জড়িয়েছিস?

রাখী জবাব দিল না। বলল, বাদ দে ওসব, অন্য কথা বল্।

বাদ দেব কী রে, এ যে সেজানের নিজের নাম সই করা চিঠি- এ চিঠি পুলিশের হাতে পড়লে কী হবে জানিস?

রাখী বিরক্ত হয় ঐ একই বিষয় নিয়ে কথা বলতে। বলে, বাদ দে সুমি- একটা ছেলেকে পাঠিয়েছিল— এইমাত্র আমি তাড়িয়ে দিলাম।

তাড়িয়ে দিলি?

হ্যাঁ, প্রায় ঘাড় ধাক্কা দেয়ার মতো করে। আর কোনোদিন এ-মুখো হবে না।

সুমিতা কিছু বলল না খবরটা শুনে। বলল, চল্ বাইরে বেরুবি নাকি?

রাখী জানতে চাইল, সুমি, কাজটা ঠিক করিনি?

সুমিতার কষ্ট হল রাখীর জন্যে। বলল, তুই কি ওই নিয়ে এখনো ভাবছিস? হ্যাঁ, আমার বিশ্রী লাগছে গোটা ব্যাপারটা।

সুমিতা রাখীর হাত ধরে তখন। বলে, রাখী, ও নিয়ে আর ভাবিস না। ওসব ব্যাপার নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করে লাভ নেই।

লাভ আর ক্ষতি— কথাটা মনে হলে রাখীর হাসি পায়। নিজের দিকে তাকায় তখন। নিজেকেই শুধায়, রাখী এখন কিসে তোর লাভ? আর কোন্ জিনিসে ক্ষতি? সে উত্তর খুঁজে পায় না।

রাতগুলো ভয়ানক দীর্ঘ হয়ে ওঠে। রাখীর ঘুম আসতে চায় না। না, স্মৃতির কথা ভাবে না সে। স্মৃতি কেবলি দুঃস্বপ্নের মতো হয়ে ওঠে আজকাল। যে-কোনো একটা সূত্র থেকে শুরু হলেই চলে আসে নিজের কথায়, বর্তমানে। বুবুর, আব্বার, মনি ভাইয়ের কথা ভাবতে হয় তখন। একেক সময় মাজহারের কথা মনে পড়ে— সেইসঙ্গে জামানের কথাও, হ্যাঁ তার স্বামী জামানের কথাও— আর শেষে মনে পড়ে নিজের নষ্ট হয়ে যাওয়া বাচ্চার কথা।

নিঃসঙ্গ রাতে একেক দিন রাখী পাগলের মতো ভয়ানক কাঁদে। উদ্দেশ্যহীন, কারণবিহীন, শুধু দমকে দমকে কান্না উঠে আসে বুকের ভেতর থেকে।

রাখী ঐরকম সময় ছাদে যায়। প্যারাপিট থেকে ঝুঁকে নিচে তাকায়। আর কীরকম একটা প্রবল ইচ্ছে জাগে নিচে ঝাঁপিয়ে পড়তে। মনে হয়, একটা কিছু করা দরকার তার। যে-কোনোরকমের একটা কিছু। কিন্তু পারে না। রাতের পাখির ডাক, কিংবা রেলস্টেশনের হুইসিলের শব্দ তাকে ফিরিয়ে আনে। তখন আবার সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে নিচে নামতে হয়। আর নামতে নামতেই বুকের ভেতরকার জট পাকানো কান্নাটা যেন আটকে যায় কোথায়।

এইরকম সময়ে একদিন সুমিতা একটা কাগজ সামনে ধরে বলল, নে সই কর্ একটা।

মানে? রাখী বিমূঢ় হয়ে তাকায়।

মানে আবার কী, একটা চাকরির দরখাস্ত, দেখতে পাচ্ছিস না?

তা দেখছি, রাখী দরখাস্তটা দেখতে দেখতে বলে— কিন্তু হঠাৎ তুই কীভাবে—

বুঝবি না, নিজের ভালো যদি বুঝতিস, তাহলে তোর এই দশা হয়?

রাখীর অবাক লাগল। সুমি এমন করছে যেন চাকরিটা ওর হয়েই আছে। কিসে অমন নিশ্চিন্ত হতে পারল তা-ই বুঝে উঠতে পারে না সে। বলল, মনে হচ্ছে, তোর কাছে অ্যাপয়ন্টমেন্ট লেটারটাসুদ্ধ আছে?

শুধু অ্যাপয়ন্টমেন্ট লেটার নয় মুখপুড়ি— একেবারে অ্যাপয়ন্টমেন্ট লেটারের বাবা সুদ্ধ আছে। কবে যেতে পারবি বল্।

রাখী একটু দিশেহারা হয়, যাবে সে! কবে যেতে পারবে? তাইতো, কথাটা তার ভাবা হয়নি কখনো। বলল, একটু ভাবতে দিবি তো।

না রাখী, ভাবাভাবির কিছু নেই এতে। আমি বহু তোয়াজ করে ম্যানেজ করেছি এটা। তোর ঢাকায় থাকা আর চলে না। এখানে থাকলে তুই মারা পড়বি। এবার বাইরে যা— বাইরে কাজ কর্ কিছুদিন। কাজের মধ্যে থাকলে তুই বাঁচবি— এভাবে একাকী থাকার কোনো অর্থ হয় না। ওখানে তোর কোনো অসুবিধা হবে না।

না, অসুবিধা হওয়ার সুযোগ কোথায়? সাদেক সাহেব, সেই-যে জার্নালিস্ট ভদ্রলোক, তাঁর এক আত্মীয়কে হাসপাতালে রেখে গিয়েছিলেন— তিনিই প্রিন্সিপ্যাল। সুমিতার যত্ন আর চিকিৎসায় বেশ তরতাজা হয়ে উঠেছেন অল্পদিনেই। আর তাই সুমিকে এখন উঠতে-বসতে মা ডাকছেন। সেই লোকের কলেজে চাকরি, রাখীর কষ্ট কেন হবে?

সুমি কিছু বলেনি আর। শুধু জানিয়েছে, আমি বললাম, তুই গোছগাছ করে নে- তিনদিন সময়, করিম সাহেব সাত তারিখে রওনা হচ্ছেন।

রাখীর নিজের কোনো চিন্তা নেই, নিজের কোনো ইচ্ছে নেই, সে যেন গা ভাসিয়ে দিয়েছে। শহরের রাস্তায় রাস্তায় দুদিন ঘুরল সে এলোমেলো। কিছু জিনিস কিনল অহেতুক।

একদিন নার্গিসদের বাসায় গেল। গিয়ে শোনে, নার্গিস কক্সবাজার না রাঙামাটি কোথায় গেছে। নাসিমাদের বাসায় গিয়ে নাসিমাকে দেখল ভারি বিষণ্ন। নাসিমার শরীর আরো খারাপ হয়েছে। বলল, রাখী আমি বোধহয় বাঁচব না রে। রাখী বাচ্চাটাকে আদর করে নাসিমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এল। হ্যাঁ চলে যাবে সে- ঢাকা শহর ছেড়ে চলে যাবে এবার। আলোকিত এই শহর, ক্ষতবিক্ষত এই শহর, বিলাসী এই শহর ছেড়ে সে চলে যাবে। তার শৈশবের-কৈশোরের এই শহরে সে আর থাকবে না।

বিদায় নিল সে সবার কাছ থেকে। আব্বা ফিরে এসে শুনলেন রাখীর যাবার কথা। কিছু বললেন না। মনে হল, কথাটা যেন স্পর্শ করেনি তাঁকে। রাখী একবার শুধু বলেছিল, আপনার একা খুব কষ্ট হবে আব্বা। বিরক্ত হয়েছেন তাতে। বলেছেন, আর তুমি এখানে থাকলে আমার সুখের সাগর উথলে উঠবে একেবারে।

আব্বার দিকে তাকানো যায় না। ভয়ানক বুড়ো লাগে দেখতে। যখন- তখন রাগ করে ওঠেন। অশ্লীল ভাষায় কাজের ছেলেটাকে গালাগাল করেন। তাঁর গলায় আর গান গুনগুন করে ওঠে না। কিন্তু তবু ঐ বিধ্বস্ত, প্রায় ভেঙে-পড়া আব্বার কাছ থেকেও বিদায় নিল রাখী। সবার কাছ থেকে এবার তার বিদায়। মনে-মনে খুঁজল সে, আর কেউ বাকি থাকল কি না, যার কাছ থেকে বিদায় নেয়া হয়নি। মনে-মনে খুঁজে কাউকে পেল না। কিন্তু তবু মনে হল, বারবার করে মনে হল, কার কাছ থেকে যেন বিদায় নেয়া হয়নি। সুমিতা শুনে বলল, করেছিস কী মুখপুড়ি, তোর বরকে জানাবি না?

আমার বর? একটু অবাক হয়ে তাকায় রাখী। তারপর মনে পড়ে, ও জামান, তার স্বামী— হ্যাঁ জামানের কাছ থেকেও তো বিদায় নেয়া দরকার। হ্যাঁ, একশোবার দরকার, এখনো তো তুই তার আইনসঙ্গত বউ।

রাখী জামানের সঙ্গে দেখা করতে গেল। কিন্তু গিয়ে শুনল, জামান নেই, করাচি না লাহোর গেছে কী একটা কনফারেন্সে।

সুতরাং? সুতরাং বিদায়। বিদায় আমার ছেলেবেলার ইস্কুলে যাওয়ার দিন, বিদায় আমার চৈত্রের হাওয়ায় ওড়না ওড়ানো কিশোরকাল, বিদায় আমার স্বপ্ন-দেখার রাতের, বিদায় শীতরাতের ক্যাসিওপিয়া আর আরশি- বিদায় আমার ব্যর্থ ভালোবাসা।

সবার কাছ থেকে বিদায় নিল রাখী। যেন চলে যাচ্ছে একেবারে সারাজীবনের জন্যে। নতুন কোনো জীবনে যেন চলে যাবে, আর ফিরবে না কোনোদিন।

স্টেশনে সুমিতা এসেছিল। হাত চেপে ধরে বলল, চিঠি লিখব তোকে – রাখী আমার দিব্যি রইল, আর খেয়ালি হোস না, নিজেকে সামলে রাখিস- ভালো-মন্দ ভেবে দেখিস, আর ফিরে আসবার চেষ্টা করিস।

রাখী বুঝতে পারে না। ফিরে আসব, কোথায়?

কেন তোর নিজের জায়গায়, তোর নিজের সংসারে। এই জটিলতা সাময়িক, নিজের মনকে খুঁজে দেখিস— তুই ফিরে আসবার পথ খুঁজে পাবি।

রাখী সুমিতার দিকে তাকাতে পারে না, চোখে পানি এসে যায়- সুমিতা তার জন্যে এত ভাবে- এত আপন সুমি- ঠিক যেন বুবু। সুমিতার হাত চেপে ধরে রাখী। বলে, সুমি আমার জন্যে ভাবিস না ভাই, আমি যদি ফিরে আসি, শুধু তোর কাছেই ফিরে আসব।

ট্রেন ছেড়ে দিল। সুমিতার শাড়ির রঙ সকালবেলার রোদে হালকা হতে হতে শাদা হল, তারপর অনেক দূরে একসময় মিলিয়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *