আট
কিন্তু তবু গানের সেই কলিগুলো ফিরে আসে না। না সকালে, না সন্ধ্যায়। রাশেদ সাহেব চারদিকে দেখেন আর ভেতরে ভেতরে অস্বস্তি লাগে তার। একদিন বুলু এসে জানাল, হাসান চাকরি ছেড়ে দিচ্ছে, তার নতুন ফার্ম খোলার ব্যবস্থা সব ঠিক।
রাশেদ সাহেব শুধু শোনেন। শোনেন আর দেখেন। হাসান ব্যবসার জন্য কীরকম অস্থির হয়ে উঠেছে তা বুঝতে পারেন। বুলুকে কিছু বলতে পারেন না। কেমন মনে হয়, বুলুর কিছুই করার নেই। কেমন অস্পষ্ট ভয় হয় তার। কেমন যেন মনে হয়, একটা ভয়ঙ্কর সময় আসছে, প্রকাণ্ড একটা প্রলয় ঘটে যাবে আর জীবনের সেই বিধ্বস্ত চেহারাটা তাঁকে দেখতে হবে। কোন্দিক থেকে, কেমন করে, সেই আঘাত আসবে তা বলতে পারে না। কিন্তু অনুভব করেন, আসবে সেই আঘাত, কেউ ঠেকাতে পারবে না। একাকী থাকার সময় একেকবার চিন্তাটা চেপে বসে। ভুলে থাকতে চান, চোখ বুজে থাকতে চান, কিন্তু পারেন না। পুরনো কথা ভাবতে গেলেই সেইসব কথা ভাবনায় এসে যায় আর বুকের ভেতরে এসে তীরের মতো বেঁধে। মনির কথা মনে পড়ে তখন। মনি অসুস্থ অবস্থায় একদিন তার কাছে বলেছিল, আব্বা, বিশ্বাস বলে কোনো বস্তু আর আমার মধ্যে নেই, আমি ভীষণরকম শূন্য। সেই শূন্যতা কি এখন তাঁকেও গ্রাস করছে?
বড় কষ্টে সন্তানদের তিনি বুক দিয়ে আগলে রেখেছিলেন। রাতের পর রাত গেছে, দিনের পর দিন কেটেছে, বাইরের দুনিয়ার দিকে তাকাননি কখনো। কতদিন মধ্যরাতে ঘুমন্ত দুই মেয়ে আর ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকেছেন। না, অন্যকিছু ভাবেননি-শুধু সন্তানদের কথা ভেবেছেন। আবিদা ইসলাম আসত তখন, একটি মেয়ে নিয়ে-বিধবা, ইস্কুলের মিস্ট্রেস। হামিদ উদ্দিন মুন্সেফ বলতেন, আর দেরি কেন, একটা কিছু হয়ে যাক-ছেলেমেয়েদের জন্যে ভালোই হবে। আবিদার শরীর দেখে পুরুষমানুষের লোভ হওয়ার কথা, আর তার ব্যবহারের তো তুলনা হয় না। সেই আবিদা ইসলামের সঙ্গে অমানুষের মতো ব্যবহার করেছেন। কথাটা মনে হলে এখনো খারাপ লাগে তার। বড় ভালো মেয়ে ছিল আবিদা।
কিংবা শেফালি ঘোষ। ভারি সুন্দর রবীন্দ্রসংগীত গাইত। বিনয়বাবুর বিধবা ভাগ্নী, বুলুকে গান শেখাত তখন। কতদিন শেফালির গলায় শুনেছেন—এসো এসো, আমার ঘরে। শেফালি চালাক মেয়ে, মাইনে নিতে চায়নি। বলত, বুলুকে গান শিখিয়ে আমি টাকা নিতে পারব না দাদা। হ্যাঁ, ইঙ্গিত ছিল। যেন শেফালি ঐ কথার পর চটুল প্রশ্ন আশা করত, তাহলে কী নেবে?
আর সেজন্যই রাশেদ সাহেবকে বুলুর গান শেখানো বন্ধ করে দিতে হয়েছে। ঐসময় কিছুদিন মৌলভী আসত বুলুকে কোরান পাঠ শেখানোর জন্য।
এইভাবে দিনের পর দিন সজাগ থাকতে হয়েছে। শুধুই সন্তানরা সুখী হোক, মানুষ হোক এই কামনায়।
মনি ছোটবেলা থেকেই গম্ভীর। বাইরে স্থির গম্ভীর, কিন্তু ভেতরে প্রখর সজাগ। ইস্কুলে পড়ার সময়ই, লক্ষ করলেন একদিন রাজনীতির বই পড়তে আরম্ভ করেছে ছেলে। একদিন ডেকে বলেছিলেন, মনি, এখন ওসব বই পড়িস না।
মনি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, কেন আব্বা?
রাশেদ সাহেব ছেলের প্রশ্নের উত্তরে সরাসরি জবাব দিতে পারেননি। অহেতুক গম্ভীর হয়ে বলেছিলেন—এই বয়সে ওসব পড়া তোর উচিত নয়। তোর টেবিলে ওসব বই যেন আর না দেখি।
মনি কিছু বলেনি। প্রতিবাদ করেনি, তর্ক করেনি, চুপ করে থেকেছে। কিন্তু দুদিন পরই লক্ষ করলেন, যে-সময়টা মনি বই পড়ত ঐসময়টা সে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। এমনিতেই চুপচাপ ধরনের ছেলে-তখন একেবারেই চুপ হয়ে যায় ছেলেটা। অফিসফেরতা একদিন দেখলেন, মনি চুপচাপ নিজের টেবিলে বসে রয়েছে। ইস্কুলের কাপড় পর্যন্ত ছাড়েনি।
তার মন হাহাকার করে উঠেছিল সেদিন। ঐদিনই সন্ধেবেলাতে তিনি মনিকে নিয়ে আবার বেরিয়েছিলেন। বইয়ের দোকানে নিয়ে গিয়েছিলেন। কিনুক সে নিজের পছন্দমতো যা-খুশি।
বুলু কলেজে পড়বার সময় ছেলেদের সঙ্গে মেলামেশা করত, বন্ধুদের বাসায় যেত। তখনও ঢাকা শহরে ছেলেমেয়েদের মেলামেশার সুযোগ হয়নি, কিন্তু তবু হাসানের সঙ্গে ওর অন্তরঙ্গতা বাড়ছিল। হাসান তার পরলোকগত বন্ধু কেরামত আলীর ছেলে। প্রথম-প্রথম উপেক্ষা করেছিলেন। একদিন একজন কলিগ কথাটা তুললেন। কথাটা শোনার পর তার খারাপ লেগেছিল। বুলু কলেজ ফাঁকি দিয়ে হাসানের সঙ্গে তেজগাঁর দিকে বেড়াতে যায়। খবরটা শোনার পর বুলুকে ডেকে বলেছিলেন, হাসানের সঙ্গে মেলামেশা যেন বন্ধ করে।
বুলু নাওয়া-খাওয়া প্রায় ছেড়ে দিয়েছিল। সব সময় কী যেন ভাবত। শেষে লম্বা চিঠি লিখেছিল তার কাছে। বুঝতে পেরেছিলেন, এটা খারাপ, বুলু অল্পবয়সেই জীবনের কথা বড় বেশি ভাবতে আরম্ভ করেছে। বুলুর সৌন্দর্যের খ্যাতি ছিল। বিয়ের জন্য চাইলে ভালো ছেলের অভাব হত না। কিন্তু বাসায় ফিরে বুলুর শুকনো মুখ দেখে তার মনের ভেতরে কেউ যেন কেঁদে উঠত। শেষে একদিন হাসানকে ডেকে পাঠালেন। সোজাসুজি জিজ্ঞেস করলেন সে বুলুকে বিয়ে করতে রাজি কি না। বুলুর বিয়ে দিলেন, হাসান তখনও ইঞ্জিনিয়ারিং-এর থার্ড ইয়ারের ছাত্র—তবু দিলেন।
জানতেন, জীবনকে সহজভাবে গ্রহণ করাটাই হল আসল কথা। শান্তির প্রশ্নটাই বড় প্রশ্ন।
সবাই দেখতে দেখতে বড় হয়ে গেল, আর সেইসঙ্গে কেমন ছাড়া-ছাড়া আলগাও হয়ে গেল। মনি রাজনীতি নিয়ে মেতে উঠল। অনার্স ফাইনাল দেয়ার আগেই চলে গেল আন্ডারগ্রাউন্ডে। হুলিয়া বাতিল হলে বেরুল এক বছর পর। পরের বার পরীক্ষার আগে আগে ফের ধরা পড়ল। কাটাল দেড় বছর। মনি তারপর বেরিয়ে এসে হঠাৎ রাজনীতি ছেড়ে দিল। তার ব্যস্ততা আর দেখা যায় না। ব্যাপারটা আশ্চর্য লাগলেও কিছু বলেননি রাশেদ সাহেব। ঐসময় কেমন যেন নিঃসঙ্গ আর একাকী হয়ে পড়েছিল মনি। তখন বারবার করে ছেলের কাছে এসেছেন। বারবার করে জানতে চেয়েছেন, সে কেন লেখাপড়া করছে না, কেন কোনো কাজে হাত দিচ্ছে না। মনির কাছ থেকে কোনো উত্তর পাননি। মনি তখন ঘুমোত না। সকালবেলা লাল লাল চোখ নিয়ে চায়ের টেবিলে আসত। ওর দিকে তাকিয়ে দেখতেন আর বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠত। একেক দিন বলতেন, যা, বাইরে কোথাও ঘুরে আয় কিছুদিন।
মনি নিঃশব্দে হাসত। আর সে হাসি তার বুকের ভেতরে এসে বিধত। বলত, আব্বা, বিশ্বাস কেমন করে ফিরে পাওয়া যায় জানেন? আমি কোনোকিছুতে বিশ্বাস রাখতে পারছি না কেন-সবকিছু আমার কাছে কেন এত হাস্যকর মনে হয়?
ঐসময় সেজান আসত। এসে ওকে কী কী যেন বোঝাত। মনি তখন ভীষণ ঝগড়া করত। রাশেদ সাহেব তখন কেমন দিশেহারা হয়ে উঠেছিলেন। মনির বন্ধুদের কাছে জিজ্ঞেস করেছেন, ও কোনো মেয়েকে ভালোবাসে কি না, কেউ তাকে আঘাত দিয়েছে কি না। কারো কাছ থেকে কোনো সদুত্তর পাননি।
একদিন মনি হঠাৎ বাড়ি ছেড়ে চলে গেল। একটুকরো কাগজে লিখে রেখে গেল—আব্বা, আমি আবার ফিরে আসব। বিশ্বাসকে খুঁজে আনতে যাচ্ছি।
রাশেদ সাহেব বুঝতে পারেননি। অস্পষ্ট অনুমান করেছেন, মনির মনের ভেতরে অস্থির কোনো যন্ত্রণা দাপাদাপি করছে-তার বিশ্বাসের মূল সম্ভবত উপড়ে গিয়েছে কোনো কারণে। এ ব্যাপারে কেউ কিছু করতে পারে না। তার মনে হত, মনি নিজেই ফিরে পাবে তার বিশ্বাস করার শক্তিকে। অপেক্ষা করা ছাড়া তার অন্যকিছু করার নেই। একটা নিষ্ফল অসহায়তা তার মনের ভেতরে মাথা কুটে মরত ঐসময়।
জানতেন, মনি রংপুরের কোনো একটা এলাকায় আছে। কিন্তু নির্দিষ্ট কোনো ঠিকানা পাননি। খোঁজ করেছিলেন, কিন্তু কেউ দিতে পারেনি। চার মাস পর টেলিগ্রাম পেলেন। ছুটে গিয়ে রংপুরের এক গ্রাম থেকে ছেলেকে নিয়ে এলেন। কিন্তু বাঁচাতে পারলেন না। দুটো কিডনিই নষ্ট হয়ে গেলে আর মানুষকে বাঁচানো যায় না।
কিন্তু রাশেদ সাহেব আবার উঠে দাঁড়িয়েছেন। বুলুর দিকে তাকিয়ে, রাখীর দিকে তাকিয়ে, কাঁদেননি। জীবন আসলে নিষ্ঠুর। তার মতো সুখী কেউ হয়নি—আবার তার মতো সর্বস্ব কেউ হারায়নি। জীবনকে ইচ্ছেমতো গড়ে তুলছিলেন, মনমতো সাজাচ্ছিলেন-আর সেজন্যেই হয়তোবা শেষপর্বে এসে জীবন তার ওপর দারুণ প্রতিশোধ নিতে আরম্ভ করেছে। রাশেদ সাহেব তারপর থেকে আরো সজাগ হয়েছেন। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয়নি। যাদের জন্য সজাগ হবেন, যাদের জন্য সাবধান হবেন, তারা তো সবাই তার আয়ত্তের বাইরে। আর সেজন্যেই তার দুই মেয়ের সকল কাজের পেছনে পেছনে ছায়ার মতো থেকেছেন।
জীবনের সংকটকে তিনি বারবার মুখোমুখি দেখতে চান। আঘাতকে বুক পেতে নেবার মতো শক্তি আর সাহস তার দুইই আছে। কিন্তু যে আঘাত বোঝা যায় না, যে সংকট দেখা যায় না, তাকে তিনি কীভাবে রুখবেন- কীভাবে মুখোমুখি দাঁড়াবেন? সে আঘাত কখন আসবে জানেন না। আর জানেন না বলেই কাউকে বলতেও পারেন না। এখন শুধু অসহায় দৃষ্টিতে দেখবার পালা তার। শুধু উদ্বেগের সঙ্গে অপেক্ষা করা। একেকবার ভাবেন, সাবধান করে দেবেন সবাইকে। কিন্তু সাবধান করবেন কোন্ বিষয়ে? কাকে সাবধান করবেন? বুলুকে, নাকি হাসানকে, নাকি রাখীকে? আর কোন্ কথা বলে সাবধান করবেন? সেই কথা তো তার জানা নেই।
রাশেদ সাহেব লক্ষ করছেন, বেশ কিছুদিন ধরেই হাসান কন্ট্রাক্টরদের সঙ্গে বেশি মাখামাখি করছে। প্রায়ই দেখতে পান বসবার ঘরে কন্ট্রাক্টরদের ভিড়। প্রায়ই শুনতে পান হাসান জায়গা কিনছে। অনুমান করতে কষ্ট হয় না যে হাসান প্রচুর ঘুষ খাচ্ছে। কিন্তু কিছু বলার নেই তার। বুঝতে পারেন, এখন হাসানের টাকা বানানোর ঝোঁক হয়েছে।
হাসানের দিক থেকে বুলুর দিকে চোখ ফেরালে দেখতে পান, বুলুর চোখেমুখে অস্বস্তির ভাব। তবু মনে হয় সে মানিয়ে নিতে চাইছে। বুলু অনেক কিছু গোপন করে যাচ্ছে। তার আচরণ হয়ে উঠেছে সন্তৰ্পণ, কথা আরো কমে যাচ্ছে তার। গলা আজকাল প্রায় শোনাই যায় না। আগে হাসান অফিস থেকে সোজা বাড়ি ফিরত। আজকাল রাত হয়। কোনো কোনোদিন চোখে পড়ে, বুলু অনেক রাত পর্যন্ত বারান্দায় রেলিঙে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তিনিও বাতি নিভিয়ে জেগে থাকেন। একসময় শুনতে পান, নিচের তলায় কড়া নাড়ার আওয়াজ হচ্ছে। বুলুর ত্রস্ত পায়ের শব্দ বারান্দা হয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে যায়। তারপর হাসান ভারী পায়ের শব্দের সঙ্গে সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে ওপরে ওঠে
শেষে গতকাল বুলু জানিয়ে দিল, হাসান চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। তার নিজের অফিস হয়েছে মতিঝিলে, ডেল্টা কর্পোরেশন- তিনজন মিলে মালিক— কনস্ট্রাকশন আর ক্যারিয়িং-এর কাজ হবে শুধু।
হাসান আগেই তার মত চেয়েছিল। তখন যেমন তার মতামত দেয়ার কিছু ছিল না, এখনও নেই। শুধু বললেন, বেশ তো, যা ভালো মনে করে, করতে দাও।
দুদিন পরেই শুনলেন হাসান ঠাকুরগাঁ যাচ্ছে। কী একটা বড় কাজের তদ্বিরের জন্য। বেশ কয়েকদিন থাকতে হবে সেখানে। খবরটা শোনার পর থেকেই কেমন অস্থিরবোধ করতে লাগলেন। কোনো মানে হয় না, তবু হাসানের মুখোমুখি হলেন। রাতে ডাকলেন হাসানকে। বললেন, তুমি ঠাকুরগাঁ যাচ্ছ শুনলাম?
জী।
হঠাৎ?
একটা কন্ট্রাক্ট-এর জন্য তদ্বির দরকার- খুব ভালো কন্ট্রাক্ট, ইনভেস্টমেন্ট অতি সামান্য কিছু, কাজ প্রায় দুলাখ টাকার— যদি পেয়ে যাই, তাহলে ফার্ম দাঁড়িয়ে যাবে।
কদিন থাকবে?
হাসান বাইরের দিকে তাকায়। কিছু বলা যাচ্ছে না- তবে সপ্তাহ দুয়েক তো বটেই! মাসখানেকও লেগে যেতে পারে।
একলা যাচ্ছ? এবার প্রশ্নটা আরো গভীর আর শীতল শোনায় তার নিজেরই কানে।
হাসান মুখ ফিরিয়ে সোজাসুজি তাকায় শ্বশুরের দিকে। তারপর বলে, জী হ্যাঁ। রাশেদ সাহেব কিছু বললেন না। আর কিছু বলার প্রয়োজন নেই তার।
হাসান উঠে দাঁড়ায়। তারপর মুখ নিচু করে বলে, ব্যবসা করতে নেমেছি, এখন কি আর হিসেব করে চলতে পারব?
তার মানে হাসান এবার নিজের নিয়মকানুনগুলোও বদলাতে আরম্ভ করল। আগে এক সপ্তাহের জন্যে ট্যুর-এ গেলেও বুলুকে সঙ্গে নিয়ে যেত। আর এবার সে বুলুকে সঙ্গে নেয়ার প্রয়োজনীয়তা বোধ করছে না।
হাসান একা নয়। আরো কয়েকজন যাচ্ছে। সবাই ওর ফার্মেরই লোক। টাইপিস্ট পর্যন্ত সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে। রাশেদ সাহেব এও শুনলেন গ্লামার বাড়াবার জন্যে অ্যাংলো মেয়ে টাইপিস্ট এবং কনসাল্টেন্ট রাখা হয়েছে ফার্মে।
আগে কখনো যাননি। কিন্তু এবার গেলেন বুলুকে নিয়ে স্টেশনে। বুলু গোছগাছ করছিল আগের দিন, আর তখন কর্মব্যস্ত বুলুকে দেখে সালমার কথা মনে পড়েছিল। বুলুর জন্য তখন কষ্ট হয়েছিল তার। স্টেশনে পৌঁছে দেখলেন, শুধু দেখলেন নয়, পরিচিতও হলেন— কলিমউল্লা খান আর আখতার আজাদ— দুই পার্টনারের সঙ্গে। এমনকি টাইপিস্ট মেয়েটির পরিচয়ও জানলেন, কেটি ইভ্যন্স। সুশ্রী, তবে কেমন যেন উগ্র রূপ মেয়েটির। বুলুর সঙ্গে কথা বলতে বলতে মাঝে মাঝেই গম্ভীর হয়ে পড়ছিল আর আড়চোখে ডাইনে বাঁয়ে তাকাচ্ছিল।
রাশেদ সাহেব জানতেন, কেমন যেন বিশ্বাস ছিল তার- আর যাই হোক, হাসান অন্তত বুলুকে কোনো সময় অপমান করবে না। কিন্তু স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কেমন যেন অনুভব করলেন, তার সেই বিশ্বাসটা দুর্বল হয়ে পড়ছে। প্ল্যাটফর্মে লোকজনের মাঝখানে হাসানকে ভারি অপরিচিত মনে হল তার। বাড়াতে ফেরার সময় লক্ষ করলেন, সারাটা পথ বুলু চুপ করে আছে, কোনো কথা বলছে না।
রাশেদ সাহেবও চুপ করে থাকলেন, যেন দূরের দর্শক, কিছুই করবার নেই, কিছুই বলবার নেই তার।
বাড়িতে ফেরার পরও তাঁকে চুপ করে থাকতে হল। একবার ভাবলেন, রাখীকে ডেকে বলবেন সবকিছু। ওর কাছ থেকে কিছু জানতে চেষ্টা করবেন। কিন্তু আবার মত বদলালেন। কেমন যেন মনে হলো, রাখী নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত, ওকে আর এইসব জটিল খবর জানিয়ে লাভ নেই। শুধু দেখে গেলেন, বুলু হাসানের চিঠির জন্য কীরকম উদগ্রীব থাকে, যেদিন চিঠি আসে সেদিন বুলু কী খুশি। যেদিন বুলুকে এইরকম খুশি দেখলেন, সেদিন দুমেয়েকেই ডাকলেন, চল্, কাল সকালের শো সিনেমা দেখে আসি।
বুলু নিমেষে বাচ্চামেয়ের মতো খুশিতে হাততালি দিয়ে উঠলো। রাখীও যেন ফিরে গেল তার কৈশোরে। আব্বার গলা জড়িয়ে ধরতে চাইল। সারাটা বাড়িতে সেদিন রাতে হৈচৈ। পরের দিন সকালবেলা সিনেমা, দুপুরে চিনে রেস্তরাঁ এবং সেখান থেকে বেরুতে বেরুতে প্রায় বিকেল। বিকেলবেলা সদরঘাটে এসে নৌকায় চেপে ভেসে বেড়ানো অনেকক্ষণ। শেষে দিন পার করে দিয়ে তবে বাসায় ফেরা।
গেল প্রথম সপ্তাহ। পরের সপ্তাহেই বুলুকে আবার মনমরা দেখলেন। বিকেলের ডাক আসে চারটার দিকে। ঐসময় বুলু ঘুরেফিরে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়, কখনো ওপর-নিচে করে আর অহেতুক গেটের দরজাটা খুলে রাখার জন্যে মরিয়মের মাকে চিৎকার করে ডাকে।
হাসান তিন সপ্তাহ পরেও ফিরল না। অগত্যা একদিন টেলিফোন করলেন, ধরল হাসান নিজেই। জানাল, আরো থাকতে হচ্ছে কিছুদিন, চিন্তার কোনো কারণ নেই, আমি কাজটা শেষ করেই ফিরব, একদিনও দেরি করব না। আর একটা কথা, হাসানের গলা কিছুটা ক্ষুব্ধ শোনাল। বলল, বুলুকে এত ঘন ঘন চিঠি লিখতে বারণ করে দেবেন। প্রায়ই বাইরে বাইরে থাকতে হয়, অনেক সময় হাতেই পড়ে না ওর চিঠি। ওকে বুঝিয়ে লিখেছি কিন্তু শুনতে চায় না। আপনি একটু বুঝিয়ে বলবেন।
আরো অনেক সমস্যার কথা বলল হাসান। রাশেদ সাহেব চুপচাপ শুনলেন সব। মনে হল, অনেক দূরে ঠাকুরগাঁয়ে হাসান ভারি ব্যস্ত রয়েছে, ঢাকার খবর এখন মিছিমিছি বিরক্তিকর উৎপাত শুধু। কথা শেষ হয়ে গেলে একসময় রিসিভারটা আস্তে নামিয়ে রাখলেন।