ত্রয়ী উপন্যাস -প্ৰথম পৰ্ব
ত্রয়ী উপন্যাস - দ্বিতীয় পৰ্ব
ত্রয়ী উপন্যাস - তৃতীয় পৰ্ব

দক্ষিণায়নের দিন – ১

এক

আকাশে ইতস্তত মেঘ ছিল। দুপুরবেলা হঠাৎ মেঘের ডাক শোনা গেল। রাখী হাঁটছিল, হঠাৎ দেখে, সামনে টুকরো কাগজ, ধুলো, খড়কুটো সব যেন কেউ শূন্যে উড়িয়ে দিয়েছে। ওদিকে তোপখানা রোডের ওপর মানুষজনের ছোটাছুটি লেগে গেল। দূরে গাছগুলো মাথা দোলাচ্ছে প্রবল বেগে। রাখী রিকশর জন্য ডাইনে বাঁয়ে তাকাল। কিন্তু কোথায় রিকশ? রাস্তাটা কেমন যেন ফাঁকা হয়ে গেল নিমেষে। শাড়ির আঁচল উড়ে উঠেছিল, অবাধ্য আঁচল শাসন করে পিঠের ওপর দিয়ে ঘুরিয়ে বাঁ হাতে টেনে ধরল। কোথাও মাথা গোঁজা দরকার, কিন্তু কাছাকাছি কোনো জায়গা নেই যে মাথা গুঁজবে। বাঁ-দিকে সেক্রেটারিয়েটের পাঁচিল আর ডাইনে রাস্তার ওপারে তারস্বরে গান বাজানো রেস্তরাঁগুলো। রাখীকে সামনের দিকেই পা চালাতে হল।

রাস্তার ওপার থেকে কে যেন তীব্রস্বরে শিস দিয়ে ওঠে। ঐসময় রাখীর নজরে পড়ে। বাতাসের দাপটে শরীরের সঙ্গে কাপড় সেঁটে যাওয়ায় কোনো ছোকরার এইরকম উল্লাস। সে বইগুলো ডান হাতে নিয়ে নিজেকে আড়াল করে।

দেখতে দেখতে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। বড় বড় কয়েকটা ফোঁটা পড়ল প্রথমে। কংক্রিটের ফুটপাতে ফট ফট শব্দ হল কয়েকটা। তারপরই কেমন আকাশময় গম গম আওয়াজ শোনা গেল এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপিয়ে নামল বৃষ্টি। রাখী এবার অসহায় বোধ করে। প্রেসক্লাব কিংবা ইপিআরটিসি-র প্যাসেঞ্জার শেড এখনো বেশ কিছুটা দূরে।

প্রেসক্লাবে ঢুকল না। গেটের কাছ থেকে একবার বাঁয়ে তাকিয়ে দেখেছিল বারান্দা ভর্তি লোক। সে কয়েক পা এগিয়ে ইপিআরটিসি-র শেডের কাছে গেল। এখানেও ভিড়, কিন্তু তাকে দেখে কয়েকজন সরে দাঁড়াল। একজন বুড়োমতো ভদ্রলোক স্নেহার্দ্রস্বরে কী যেন বললেন। রাখী শেডের ভেতরে ঢুকে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়াল।

দেয়ালে এখনো প্লাস্টার হয়নি, মেঝেতে নোংরা আবর্জনা। রাস্তার পানি গড়িয়ে আসছে। একটু পরই মেঝেতে পানি জমতে শুরু করবে। রাখী নিজের মনে হাসে একটুখানি। কপালে তোর দুঃখ আছে দেখিস, নিজেকে বলে সে মনে-মনে। তারপর রাস্তার দিকে চোখ ফেরায়—যদি কোনো বাহন পাওয়া যায়।

সামনে একজন মোটামতো লোকের ঘাড় এবং নোংরা গেঞ্জি দেখতে পাচ্ছিল, এদিকে বাঁ-দিক থেকে আর এক মাঝবয়সী লোক কেবলি তার দিকে চেপে আসছে। লোকটার নজর কিন্তু রাস্তার দিকে। রাখীর খুব ইচ্ছে লোকটার চেহারাটা একবার দেখে। কিন্তু লোকটা ঘাড় শক্ত করে রয়েছে, মাথা ডাইনেও হেলে না বাঁয়ে না। রাখী ভাবল, ডেকে বলে, কষ্ট করে একবার মাথাটা ঘুরিয়ে দেখুন, আপনার পাশে কী জিনিস দাঁড়িয়ে। কথাটা ভাবল, কিন্তু বলল না শেষপর্যন্ত। কী লাভ!

অন্যদিকে মন ফেরায় সে।

গোটা ব্যাপারটাই বিরক্তিকর লাগছে এখন। সেই সকালবেলা বাড়ি থেকে বেরুবার পর থেকে এই এখন পর্যন্ত। কোন্ দুর্বুদ্ধিতে যে সে নার্গিসের কথা শুনতে গিয়েছিল। নার্গিসের সঙ্গে এইভাবে সময় কাটানোর প্ল্যানটাই তার করা উচিত হয়নি। বাড়ির সবাই ভাবছে, আহা রাখীর আজ কী মজা। সিনেমা, বন্ধুদের সঙ্গে চীনে রেস্তরাঁয় বসে দুপুরের খাওয়া, তারপর আবার এখানে সেখানে যাওয়া—কত ফুর্তি রাখীর। আর এদিকে দ্যাখো তার কীরকম কাকভেজা অবস্থা। কপালে গালভেজা চুলে মাখামাখি, চিবুক বেয়ে পানি ঝরছে, ভেজা শাড়িতে শরীরের আব্রু রাখা দায়।

যত হেনস্থা সব ঐ নার্গিসটার জন্য। কথা ছিল য়ুনিভার্সিটিতে এসে সবার সঙ্গে দেখা করবে। দেখাসাক্ষাৎ শেষ করে বেরুবে দুজনে, সাড়ে দশটায় ম্যাটিনি—অ্যান অ্যাফেয়ার টু রিমেম্বার—তারপর চীনে রেস্তরাঁ এবং সবার শেষে এলোমেলো ঘুরে বেড়ানো। চাই কি, কোথাও না গিয়ে সোজা পার্কে গিয়ে বসে বসে সময়টা কাটিয়ে দেবে, যদি ইচ্ছে করে।

নার্গিসই প্ল্যানটা করে। রাখী প্রথমে আমল দেয়নি। নার্গিসের প্ল্যান তো—শেষপর্যন্ত কী থেকে কী দাঁড়াবে কে জানে। কিন্তু নার্গিস চলে যাবার পর ব্যাপারটা যতবারই মনে হয়েছে, ততবারই নতুন করে ভাবতে হয়েছে তাকে। ছাত্রজীবন শেষ হয়ে যাচ্ছে, চিরদিনের জন্য এইসব দিন হারিয়ে যাবে। য়ুনিভার্সিটির পথে আর হাঁটবে না কোনোদিন। ছায়াময় লম্বা রাস্তাটা, বারান্দায় হৈ-হুল্লোড়, সবকিছু থেকে বিদায়। ব্যাপারটা ভাবতে গিয়ে ভারি বিষণ্ণ লাগছিল নিজেকে। আর সম্ভবত সেজন্যেই সে পরশুদিন সন্ধেবেলা টেলিফোন করে জানায়, নার্গিস আমি রাজি।

সত্যি? অপ্রত্যাশিত খুশির স্বর বেজে উঠেছিল নার্গিসের গলায়, সত্যি বলছিস তো?

হ্যাঁ, সত্যি। আর শোন্, পারলে নাসিমাকে আসতে বল্ না?

ও কি আসবে? দ্বিধা জেগে উঠেছিল নার্গিসের গলায়।

কেন আসবে না? বলে দ্যাখ্ তুই, সাকিনার নাহয় বর আছে, ওর তো এখনো হয়নি, রাখী জানিয়েছিল।

ক্লাসে চারজন মেয়ে, সাকিনার বিয়ে হয়েছে, বাকি থাকল তিনজন। বিদায়ের দিনে ঐ তিনজন একসাথে হতে না পারলে ক্ষোভ থেকে যাবে মনে। কিন্তু শোনা গেল, নাসিমা ঐদিনই চাটগাঁ চলে গেছে। খবরটা পেয়ে খারাপ লেগেছিল রাখীর। নার্গিসের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব এমনকিছু গাঢ় নয়। নাসিমার সঙ্গেই তার মেলে ভালো কিন্তু শেষদিনের কথা ভেবে সে আর কথা বাড়ায়নি। ব্যাপারটা মেনে নিয়েছে। হোক দুজন, তবু কাছাকাছি হতে পারবে। আবার কোথায় কখন দেখা হবে তার কোনো ঠিক নেই। আসলে ব্যাপারটা শুধু নার্গিসের তো নয়। তার নিজেরও ভালো লাগার একটা ব্যাপার আছে।

কিন্তু কী হল? রাখী নিজের ভেজা শরীরের দিকে তাকায়। শীত-শীত লাগছে এখন। ওদিকে বৃষ্টির দাপটে চারদিক অন্ধকার। মনে হয় না বৃষ্টিটা আর কোনোদিন থামবে। তাকে এইভাবে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হবে কে জানে। হায় রে কোন্ কুক্ষণে যে সে বেরিয়েছিল আজ!

নার্গিস ডিপার্টমেন্টে ঠিকই এসেছিল, কথামতো ঠিক ন’টার সময়ই। বরং রাখীরই দেরি হয় কয়েক মিনিট। গিয়ে দেখে টিচাররা কেউ আসেননি। নার্গিস একাকী বারান্দায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। আর ঠিক ওই সময় সেকেন্ড ইয়ারের ক’টি মেয়ে এল, আর রাখীকে দেখেই হৈ হৈ করে উঠল, আরে রাখী আপা, আপনি? আমরা কিন্তু আপনার কাছ থেকে আরো ভালো রেজাল্ট আশা করেছিলাম।

রেজাল্টের প্রসঙ্গ রাখীর খারাপ লাগে। বলে, বাদ দাও ও-কথা।

বাদ দেব মানে? রোগামতো একটা মেয়ে ফোঁস করে উঠল। বলল, মিষ্টিটা ফাঁকি দিতে চান?

রাখী মেয়েটার রকম-সকম দেখে হেসে ওঠে। বলে, তোমাদের ক্লাস নেই এখন?

আমাদের ক্লাস? বিশ্ববিদ্যালয় মানে জানেন না? বিশ্বময় বিদ্যালয়, ক্লাস বোধহয় হচ্ছে, কিন্তু সেটা এই বিল্ডিং-এ নয়, সম্ভবত হামিদ স্যারের বাড়িতে। হামিদ স্যারের পারিবারিক অশান্তির কথাটা সবাই জানে। তাই ঠাট্টাটা রাখীর ভালো লাগল না। বলল, ওভাবে বলাটা কিন্তু ঠিক নয়—

আরো কিছু বলত হয়তো রাখী। কিন্তু মাঝখান থেকে আয়েশা নামের মেয়েটি বাধা দিল— বাদ দিন রাখী আপা, আসল কথাটা হোক। মিষ্টির কথাটা কিন্তু-

রাখী ব্যাগ হাতড়াল। দশ টাকার একখানা নোট বার করে। এতে হবে? হবে না মানে? রহিমা নামে মোটাসোটা মেয়েটি ছোঁ মেরে তুলে নেয় নোটখানা।

নার্গিস ততক্ষণে এগিয়ে এসেছে কাছে। বলল, রাখী তোর জন্যে বসে আছি। জানিস এদিকে এক কাণ্ড হয়েছে।

রাখী নার্গিসের চোখের দিকে তাকায়, একটু বিব্রত ভাব সেখানে। বলে, মানে ঐ যে কায়সার-ইউসিসে চাকরি করে। আজ হঠাৎ সক্কালবেলা টেলিফোন। কী ব্যাপার? না জরুরি আলাপ আছে। বললাম, আজ হবে না। কিন্তু শুনতে চায় না, এক্ষুনি এসে পাকড়াও করবে।

রাখীর হাসি পায় নার্গিসের বলবার ধরন দেখে। বলে, বেশ তো, তোর পরীক্ষা পাসের খবর শুনে হয়তো অভিনন্দন জানাতে চাইছে, বেচারার দোষ কী। এলে ওর সঙ্গে তোর চলে যাওয়া উচিত।

না, অত সোজা নয়। নার্গিস মুখে বিচিত্র ভঙ্গি করে। বলে, অত লাই দেয়া ভালো নয়। চল্, শিগির বেরোই। ও তো ছিনে জোঁকের মতো লেগে থাকবেই। কিন্তু তোর সঙ্গে কবে দেখা হবে তার ঠিক কী, তা ছাড়া তোর সঙ্গে আমার কত কথা আছে।

রাখী নার্গিসের কথা শুনতে ওর চোখের দিকে তাকাল। সেখানে কেমন এলোমেলো একটা ক্ষিপ্রতার ভাব। ইচ্ছে হচ্ছিল বলে, দ্যাখ্ দুজনেই ঢাকা শহরে থাকি, দেখাশোনা সবসময়ই হবে। কিন্তু বলল না। তার আগেই নার্গিস ডাইনে তাকিয়ে বলল, একটু দাঁড়া, এক মিনিট। বলেই সে ছুটল কমনরুমের দিকে।

রাখী এদিক-ওদিক তাকায়। পরিচিত মেয়েদের খোঁজে। ভারি বিষণ্ণ লাগছে চারদিকটা। সুরকি-ঢাকা পথ, বেল-গাছটা, পেছনের পুকুরে সবুজ রঙের পানি, ডাল-বাঁকানো বিখ্যাত আমগাছটা—কত পরিচিত। অথচ সবকিছুর সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ হয়ে যাবে। এখানে আসবার আর কোনো প্রয়োজন হবে না।

রাখী আপা, এবার কী করবে?

কে? রাখী কেমন চমকায়।

পেছনে তাকিয়ে দেখে টুটু, সেকেন্ড ইয়ারের টুটু তার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসছে। ওর ফর্সা মুখ, সুন্দর দাঁত, হাসলে এত ভালো লাগে! রাখীর নিজেরও মনের ভেতর কেউ যেন প্রসন্ন হাসি হাসল ঐ মুহূর্তে। ভারি ছেলেমানুষ টুটু, ভয়ানক চঞ্চল। রাখী শুধায়, ভালো আছ টুটু?

টুটু ঘাড় কাত করে। তারপর আবার শুধায়, কই বললে না, কী করবে এবার?

রাখীর সব ভাবনা যেন হঠাৎ থেমে যায়। ওর নজর তখন সামনের রাস্তার সারবাঁধা গাছগুলোর মাথায় গিয়ে পড়েছে, সেখানে এক্ষুনি একঝাঁক বনটিয়া উড়ে উঠল। তাই তো, কী করবে সে এবার? কথাটা তো ভেবে দেখেনি কখনো।

কিন্তু ঠিক এইরকম কথা যেন আরো কেউ বলেছিল। রাখী মনে-মনে খোঁজে-কে বলেছিল? কবে যেন বলেছিল, রাখী এবার কী করবে? সে কিছুতেই মনে করতে পারে না।

টুটুর বন্ধু আরো কয়েকটি মেয়ে এসে পড়াতে প্রসঙ্গটা চাপা পড়ে গেল। ইতিমধ্যে বারান্দায় কায়সারকে দেখা গেছে, নার্গিস কাছে এসে বলল, দেখলি তো আজকের প্রোগ্রামটাই মাটি! তোর জন্যে-নার্গিসের গলায় অভিযোগ, শুধু তোর জন্যে এরকম হল, তখন অত করে বললাম, চল্ কেটে পড়ি।

রাখী হাসে, কায়সারের সঙ্গে প্রেম করার দায়টা যেন তার নিজের। কিন্তু কিছু বলে না। কায়সারের দিকে তাকিয়ে দেখে নেয় একপলক। তারপর নার্গিসকে বলে, যা, গিয়ে কথা বল্।

রাখী দেখে নার্গিস কেমন বিচিত্র একটা ভঙ্গিতে এগিয়ে যাচ্ছে। খানিক মজাই লাগে তার দুজনকে মুখোমুখি দেখে। প্রেমে পড়লে মানুষ কি সত্যিই অন্যরকম হয়ে যায়? কায়সারকে মনে হচ্ছে খুব রাগী আর গম্ভীর। দুজনে বারান্দা থেকে নেমে বেলগাছতলায় গিয়ে দাঁড়ায়। দেখা গেল, নার্গিস তখনও কী যেন বোঝাচ্ছে কায়সারকে।

টুটুর বন্ধুরা টুটুকে ঘিরে ধরেছিল, কিসের একটা তর্কাতর্কি ব্যাপার। ওদিকে ঘণ্টা বেজে গেল। টুটুরা চলে গেল। যাবার আগে টুটু বলল, একদিন বাসায় যাব রাখী আপা-এখন যাই, সাবসিডিয়ারিতে এবার ভীষণ কড়াকড়ি।

টুটু চলে গেলে রাখী আবার একাকী হয়ে পড়ে। ডাইনে বাঁয়ে তাকায়, চেনাজানা কেউ আছে কি না। একবার ভাবে রুমে যায়। কিন্তু ইচ্ছে করল না। ইতিমধ্যে কায়সার এগিয়ে এসেছে। বলল, কিছু মনে করবেন না, নার্গিস আমার সঙ্গে যাচ্ছে-খুব জরুরি আলাপ আছে একটা, ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ফিরে আসবে।

বেশ তো যাক না, রাখী হালকা ভঙ্গিতে বলতে চেষ্টা করে। বলে, জরুরি আলাপ যখন, নিশ্চয়ই যেতে হবে—

কায়সার রাখীর কথা শুনেছে বলে মনে হয় না। নিজের মনে বলতে থাকে, যাবে আর আসবে, আপনার প্রোগ্রাম ঠিকই থাকছে। ততক্ষণে আপনি এখানকার কাজ সারুন। যদি একটু দেরি-

কায়সারের ঐরকম দ্রুত কথা বলার ধরন দেখে রাখী হেসে ফেলে বলে, এত কথা বলার কী হয়েছে, ও যাক না!

কায়সার রাখীর মুখের দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বলে, আপনি চটেছেন বুঝতে পারছি-কিন্তু আমারও একেবারে প্রাণের দায়, তা কোথায় পৌঁছব বলুন?

কী? রাখী ঠিক বুঝে উঠতে পারে না।

মানে আপনার বন্ধুকে, এক ঘণ্টা পর কোথায় পৌঁছে দেব যেখানে বলবেন-এখানে বললে এখানে, বাসায় বললে বাসায়, পথে বললে পথে-বলুন কোথায়?

রাখী লক্ষ করে-কায়সারের চেহারায় যে গম্ভীর ভাবটা দেখা গিয়েছিল সেটা এখন আর নেই। সে কিছুটা স্বস্তি বোধ করে বলে, ঠিক আছে, আপনি যান না-আমি এখানেই রয়েছি।

নার্গিস এসে নতুন প্রস্তাব দেয়। বলে রাখী, তার চাইতে বরং এক কাজ করি—আমি সিনেমাহলে চলে যাই সোজা, তুই এদিকে সবার সঙ্গে দেখা- টেখা করে সাড়ে দশটা নাগাদ চলে আয়।

রাখী মাথা নাড়ায়, ঠিক আছে।

কয়েক পা এগিয়ে নার্গিস আবার ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে, আসবি কিন্তু নইলে বুঝব তুই রাগ করেছিস।

রাখী হাসে। কী যে বলে নার্গিস, মিছিমিছি রাগ করবে কেন সে।

কায়সারও বলে, সত্যিই যদি না আসেন, তাহলে আমাকে অপরাধী করে রাখবেন মাঝখান থেকে।

রাখী উত্তরে এবারও শুধু হাসে।

ওরা চলে যাবার পর রাখী আবার কিছুক্ষণের জন্য একাকী। একটু পর ডিপার্টমেন্টের বেয়ারা রমজান আলীকে দেখতে পায়। দ্যাখে। ডাকে, রমজান ভাই, ভালো আছ?

রমজান আলী রাখীকে দেখে খুশি। বলে, আপনার রেজাল্ট শুনছি, ভাবছিলাম আরো ভালো করবেন-তা যাউক, আল্লায় যা দিছে, সেইটা লইয়া খুশি থাকন ভালো।

রমজান আলীকে হঠাৎ ভারি আপন মনে হয় রাখীর। জিজ্ঞেস করে, সালেহা কি এখনো তোমার কাছে থাকে?

হ আপা, আর কই যাইব কন, জামাইডা তো আর মানুষ না।

রমজান আলী মুহূর্তের জন্য অন্যমনস্ক হয়। তারপরই ডাকে রাখীকে, আপনে তার কতক্ষণ খাড়াইয়া থাকবেন-ভিতরে গিয়া বসেন।

রাখী হঠাৎ দেখে কমনরুমের বারান্দা থেকে শাহজাদী আর কুলসুম তাকে হাত নেড়ে ডাকছে। বারান্দা থেকে নামতে যাবে আর ঠিক ঐ সময়ে শুনল, এই যে রোকেয়া কী খবর তোমার?

রাখী ফিরে তাকায়। খায়ের সাহেব কখন এসে বারান্দায় দাঁড়িয়েছেন, লক্ষ করেনি। সে কপালে হাত তুলল, স্যার রেজাল্ট বেরিয়েছে।

হ্যাঁ জানি, তুমি বোধহয় থার্ড হয়েছ।

জি।

বেশ ভালো, খুশি হয়েছি।

একটু থেমে আবার বললেন, থার্ড পেপারটা বোধহয় তুমি সুবিধে করে উঠতে পারোনি।

রাখী স্মরণ করতে চেষ্টা করে থার্ড পেপার কেমন লিখেছিল। তারপর বলে, থার্ড পেপার ভালো হলেও স্যার রেজাল্ট এরকমই তো হত।

খায়ের সাহেব হেসে ফেললেন। চশমা খুলে কাচ মুছতে মুছতে বললেন, সেকথা কেমন করে বলো। থার্ড পেপার আর সবারই ভালো হয়েছে শুধু তুমিই এক্সেপশন। এই পেপারটা ভালো করলে তোমার পজিশন ওপরে উঠত এবং তখন হয়তো একটা কনসিডারেশন হত। সে যাক, এবার কী করবে, কিছু ভেবেছ?

রাখী খায়ের সাহেবের মুখের দিকে তাকায়। কিছু বলতে পারে না। মনের ভেতরে গিয়ে ধাক্কা দিয়েছে তখন প্রশ্নটা। সত্যিই কি সে ভেবেছে, এরপর কী করবে?

খায়ের সাহেব তারপর ডাকেন, ডিপার্টমেন্টে এসো, ওখানে বসে কথা বলা যাবে।

ডিপার্টমেন্টে আশফাক সাহেব, তারপর নলিনীবাবু, এক এক করে সবার সঙ্গে কথা হল। শুধু জামান সাহেব নেই, তাঁর ক্লাস বিকেলবেলা। রাখী সবার সঙ্গে দেখা করে তবে বেরুল। তখন এগারোটা বাজতে মিনিট দশেক বাকি। কিন্তু তবু যেন তাড়া বোধ করছে না সে। ভারি ধীরপায়ে ডিপার্টমেন্টের বারান্দা থেকে নামে। ডাইনে বাঁয়ে তাকায়, সুরকি-ঢাকা পথ ছেড়ে ঘাসের ওপর দিয়ে হাঁটে কয়েক পা, ঘাসগুলো ভারি নরম। হাঁটতে হাঁটতে অনুভব করে, সে বিদায় নিয়ে চলে যাচ্ছে। তার চেনা অল্পচেনা বহু সঙ্গী, তার অন্যমনে আকাশ-দেখা মুহূর্ত, কৌতুকে আলোকিত টুটুর মুখ, বিকেলের হেলে পড়া আলো—সবকিছু থেকে বিদায়।

গেটের কাছে এসে দাঁড়িয়ে আবার পেছনে তাকায় রাখী। য়ুনিভার্সিটি ঠিক তেমনি আছে, যেমন সে দেখেছিল প্রথম দিন। দোতলার বারান্দায় নানান রঙের শাড়ির আঁচল, মধুর ক্যান্টিনে তেমনি জোর ভল্যুমে রেডিও বাজছে, পুকুরে সবুজ পানি স্থির-সব ঠিক তেমনি। বদলায়নি কিছুই। সব স্থির রয়ে গেছে—শুধু সে-ই আলগা আর আলাদা হয়ে যাচ্ছে।

সারা মনে বিষাদ নিয়ে রাখী সেদিন য়ুনিভার্সিটি থেকে বেরিয়ে আসে। তারপর হেঁটেছে রাখী। পথের ধারে ছোট্ট দোকানে দড়িতে ঝোলানো হলুদ রঙের কলা, রিকশ মেরামতের দোকানে একটি ছোট ছেলের ঝুঁকে ঝুঁকে রিকশর চাকায় পাম্প দেওয়া, কাঠবাদামের লম্বা গাছের মাথায় গোছা গোছা পাতা, সকালবেলার ঝকঝকে রোদ চারদিকে-সেই রোদ, আকাশ আর দুপাশের নানান ছবি দেখতে দেখতে রাখী চলে আসে।

কিন্তু তারপর সিনেমাহলে গিয়ে দেখে নার্গিস নেই। তখন এগারোটা দশ। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। লোকজনের ভিড়ে ভীষণ বিরক্ত লাগছিল। ঘড়ির কাঁটা সোয়া এগারোটা ছুঁতে সে বেরিয়ে পড়ল। দরকার নেই তার সিনেমা দেখে।

তখন গুলিস্তান এলাকা ভয়ানক কর্মব্যস্ত। ফুটপাতের দোকানঅলারা দোকান সাজিয়ে বসেছে। একটা অন্ধ মেয়ে, মুখে বসন্তের দাগ, গলার রগ ফুলিয়ে গান গেয়ে ভিক্ষে চাইছে। কিছুদূর এগোতেই দেখে কায়সারকে। কায়সার অন্যমনস্কভাবে সামনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। রাখী কাছাকাছি হতেই শুধাল, আরে আপনি! সিনেমায় যাননি?

রাখীর ভীষণ রাগ হচ্ছিল তখন। বলল, কেমন করে যাব, নার্গিস কোথায়? কেন, ও সিনেমায় যায়নি? কায়সার যেন আকাশ থেকে পড়ে একেবারে। কব্জি উল্টে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে, আমিই তো ওকে সিনেমাহলে দিয়ে এলাম, আধঘণ্টাও হয়নি।

একটু থেমে আবার বলে, আমার ওখানে পনেরো মিনিটও বসেনি। কী একটা সামান্য কথায় রেগে উঠল, তারপর রাগ দেখিয়ে বেরিয়ে এল। কায়সারের অবস্থা দেখে রাখীর রাগ বিরক্তি সব উবে যায়। বরং উল্টো কেমন মায়া হয়। বেচারা! প্রেমে আঘাত পেলে পুরুষমানুষ ভারি অসহায় হয়ে পড়ে। একটু হাসিও পাচ্ছিল, কিন্তু হাসল না। বলল, নার্গিসের রাগ তো–ও কিছু নয়। দেখবেন সব ঠিক হয়ে যাবে।

কায়সার কেমন গম্ভীর মুখে বলে, জানেন, ও যে কী চায়-আমি একদম বুঝতে পারি না। এত জেদ থাকা কি ভালো?

রাখী চুপ করে দাঁড়ায়। ভাবে, এবার সে কেটে পড়বে। নার্গিস-প্রসঙ্গ আর ভালো লাগছে না। এমনিতেই যথেষ্ট হেনস্থা হয়েছে তার। বলল, আমি এবার চলি, নার্গিসকে বলবেন—যেন বাসায় যায়।

যাচ্ছেন-কায়সার ঘুরে দাঁড়ায়। তারপর অল্প হেসে বলে, পরীক্ষা, পাস, সব তো গেল-এবার কী করবেন, ভেবেছেন কিছু?

রাখী আবার চমকায় মনের ভেতরে। ঐ একই প্রশ্ন। নতুন নয়। এখন মনে হচ্ছে কবেকার পুরনো। কেউ যেন অনন্তকাল ধরে ঐ প্রশ্ন করে যাচ্ছে তার সামনে দাঁড়িয়ে।

কী করবেন ঠিক করেছেন কিছু? কায়সার আবার শুধায়।

দেখি, রাখী মাথা নিচু করে বলে, এখনো ভাবিনি কিছু।

ঐ পথ থেকেই কায়সারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসা। এবং প্রশ্নটার মুখোমুখি হয়ে পথ-হাঁটা। রোদ লাগছিল গায়ে। মাঝপথে বইয়ের দোকানে ঢুকে দুখানা বই কেনে সে-শামসুর রাহমান আর হেমিংওয়ে। তারপর আবার হাঁটে তোপখানা রোড ধরে। কিছুটা এগোতেই মাঝখানে এই আচমকা ঝড় বৃষ্টির পানি রাস্তা থেকে গড়িয়ে পায়ের কাছে জমছে, ইতিমধ্যে স্যান্ডেলসুদ্ধ গোড়ালি পানির নিচে। রাস্তায় একটা রিকশ নেই। হুস হুস করে গাড়ি যাচ্ছে ফগলাইট জ্বালিয়ে। বাইরেটা ঝাপসা-প্রকাণ্ড একটা বাস এসে দাঁড়াল প্রায় নিঃশব্দে। স্বপ্ন-দেখা দৃশ্যের মতো আবছা মুখের ছায়া দেখা গেল কতগুলো তারপর আবার বাসটা চলে গেল। কেউ নামেনি, ওঠেওনি কেউ। তবু কেন যে বাসটা থামল, রাখী ভেবে পায় না। তারপর রাখী একসময় দেখে, আপাদমস্তক প্লাস্টিক জড়িয়ে এক রিকশঅলা রিকশ নিয়ে এসে থামল। শাদা প্লাস্টিকে মোড়া লোকটাকে জিনের মতো দেখতে লাগে তার।

হ্যাঁ, জিনের মতো। ঐরকম ঝাপসা-শাদা, ঘোলাটে একটা অবয়ব এমনভাবে এসে দাঁড়ায় যে রাখীর মনে হয়, জিন বোধহয় এইরকমই হবে দেখতে। রাখী উপমাটা আবিষ্কার করতে পেরে খুশি হয়। লক্ষ করে রিকশঅলাটা কী করে। দ্যাখে, ঐ এসে দাঁড়ানো পর্যন্তই। সেও মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজছে।

পেছন থেকে চেপে এসেছে দুটি অবাঙালি মেয়েমানুষ। ভেজা বোরখা, বোরখার ভেতর থেকে ঘামের গন্ধ বেরুচ্ছে। গন্ধটা কয়েকবার নাকে এসে লাগলে রাখীর গা গুলিয়ে ওঠে। একবার ভাবল, বৃষ্টির মধ্যেই বেরিয়ে পড়ে। কিন্তু পা সামনে এগোতে চায় না। জানে, বৃষ্টিতে ভেজাটা কিছু নয়—কিন্তু বৃষ্টিতে ভিজে এত লম্বা রাস্তাটা পাড়ি দিতে পারবে বলে তার মনে হয় না। শান্তিনগর কি এখানে?

দুপা এগিয়েও রাখী পিছিয়ে এল। কিন্তু ঐ দুপা-ই কি আর পিছিয়ে আসা যায়। দেখে পাশের সেই মাঝবয়সী লোকটা তার জায়গায় দাঁড়িয়ে গেছে। নিজের অবস্থা দেখে নিজেরই হাসি পায় রাখীর। কীরকম সব অবাস্তব ধরনের ঘটনা ঘটতে আরম্ভ করেছে তার চারদিকে। হিশেব করছে একরকম আর হয়ে যাচ্ছে আরেক রকম। পা বাড়াচ্ছে একদিকে যাবে বলে, আসলে চলে যাচ্ছে আরেক দিকে। নাকি নিজের গায়ে চিমটি কেটে দেখবে, সত্যি সত্যি কি সে জেগে আছে, নাকি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছে? কাণ্ডটা দেখে, রাখী নিজেকেই বলে, কোথায় বাড়ির সবাই ভাবছে তুই এখন বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছিস, নইলে সিনেমা দেখছিস, নয়তো চীনা হোটেলে ফ্রাইড স্প্রিংবন খাচ্ছিস-আর কোথায় তোর এই অবস্থা। মাথাগোঁজার ঠাঁই থেকেও তোকে বার হয়ে এসে বৃষ্টিতে ভিজতে হচ্ছে, কতক্ষণে বাসায় ফিরতে পারবি, তার কিছু ঠিক নেই।

অথচ আজ তার জীবনের একটা স্মরণীয় দিন। আজ থেকে তার নিয়ম ধরে পড়াশোনার পাট চুকল। জীবনের একটা ধাপ পার হয়ে এল সে।

কিন্তু ব্যাপারটা নিয়ে যে একটুখানি একাকী হবে, একটুখানি আপন মনে ভাববে, তার উপায় পর্যন্ত নেই।

সে নিজে ভাবছে না, কিন্তু অন্য সবাই নিশ্চয়ই ভাবছে, রাখীর মনে হয়। বুলু, আব্বা, হাসান ভাই সবাই ভাবছে-রাখীর পড়াশোনা শেষ হল-রাখী কী করবে এবার।

না, আব্বা কিছু জিজ্ঞেস করেননি। খবরের কাগজ দেখে একটুখানি নিশ্বাস ফেলেছিলেন শুধু। বলেছিলেন, রাখী শেষপর্যন্ত সেকেন্ড ক্লাস?

আব্বার কথা শুনে রাগ হয়েছিল তখন। আব্বাটা যেন কী! ভাবেন, তাঁর মেয়ে বিদ্যেধরী একেবারে। এদিকে ঐ সেকেন্ড ক্লাসের জন্যে তার মুখ দিয়ে ফেনা উঠে আসার জোগাড়।

তবে ঐ পর্যন্তই। ভবিষ্যতের কথা জিজ্ঞেস করেনি বাড়ির কেউ। তখন করেনি কিন্তু এখন তো করবে। সে এখন ঐ একটা প্রশ্ন হয়ে সবার চোখের সামনে দুলতে থাকবে।

সত্যি তো, কী করব আমি? রাখী এবার নিজেকে শুধায়।

কিন্তু জবাব আসে না মনের ভেতর থেকে। মনে হয়, আর সবাই যা করছে, তাকেও তা-ই করতে হবে। কিন্তু কী সেটা-চাকরি? বিয়ে? নাকি রিসার্চ? কোটা?

বৃষ্টির ছাট এখন আর সামনের দিকে থেকে আসছে না। হাওয়াটা বোধহয় দিক বদল করল। পেছনে ভিড়ের মধ্যে কে যেন গুনগুন করছে উর্দু গজলের কলি। রাখীর মনে হল এবার বোধহয় রাস্তায় নামা চলে। রাস্তায় নেমে এসেছে আর ঠিক ঐসময় চারপাশে ঢাকা একখানা স্কুটার এসে দাঁড়াল কিছুদূর এগিয়ে। আর দেখা গেল, সেই স্কুটারের ঢাকনা সরিয়ে মুখ বাড়িয়েছেন জামান সাহেব। ডাকছেন, চলে এসো, ভিজছ কেন?

রাখী ইতস্তত করল দুমুহূর্ত। আর ঠিক সেই সময় বিদুৎ চমকে আকাশ গড়গড় করে ডেকে উঠল। রাখী আর দাঁড়াল না, ভাবল না কিছু।

স্কুটারে উঠে বসতেই শুনল, কোথায় যাবে, বাসায় তো?

রাখী আঁচল দিয়ে শরীর ঢেকেঢুকে বসে, জি হ্যাঁ, বাসায়।

ইশ্, ভীষণ ভিজেছ দেখছি, জামান সাহেব অন্তরঙ্গ হতে চেষ্টা করেন।

ইতিমধ্যে স্কুটারঅলাকে হুকুম করেছেন শান্তিনগর যাবার জন্য।

রেজাল্ট তো দেখলাম, জামান সাহেব নিজের থেকেই বলতে শুরু করেন, আমি কিন্তু ভেবেছিলাম তুমি ফার্স্ট ক্লাস পাবে, সে যাক, কিছু ভেবেছ, এবার কী করবে?

আবার সেই প্রশ্ন- রাখী, কী করবে এবার? এম. এ. পাস তো হল।

ঘুরেফিরে ঐ এক প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। এখন মনে হচ্ছে, প্রশ্নটা ছিল তারই অস্তিত্বের ভেতরে, অনেককাল ধরে ছিল। ধীরে ধীরে সেটা বড় হয়েছে, এখন যেন চারদিক থেকে ফেটে পড়ছে। রাখী ভেবে পায় না প্রশ্নটার শুরু কবে থেকে। একবার মনে হয়, বোধহয় সেই ম্যাট্রিক পাসের পর, আবার মনে হয়, আই.এ. পাসের পরও হতে পারে। নাকি গত বছর, অনার্স পাস করার পর? রাখী ঠিক স্মরণ করতে পারে না।

প্রশ্নটা যেন কার মুখে প্রথম শুনেছে সে? রাখী মনে-মনে হাতড়ায়। মনি ভাই, নাকি আব্বা, নাকি আরো কেউ?

না, মনে পড়ে না স্পষ্ট করে। এখন মনে হচ্ছে, সবাই সোচ্চারে হোক, নিরুচ্চারে হোক, ঐ প্রশ্নটাই তাকে করে আসছে। হ্যাঁ ঐ একটাই কথা-রাখী, কী করবে এবার?

জামান সাহেব তখনও বলে চলেছেন, তুমি বোধহয় আর য়ুনিভার্সিটিতে যাবে না। কথাটা ভাবতেও আমার খারাপ লাগছে। তোমরাই আমার য়ুনিভার্সিটি জীবনে প্রথম ছাত্রছাত্রী। চারটা বছর গেল, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, বড় তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল সময়টা। সবকিছু বড় তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়, তাই না? তোমার খারাপ লাগে না?

জামান সাহেবের এইরকম বিষণ্ণ আন্তরিকতায় রাখীর কেমন বিব্রত বোধহয। কথা বলতে চেয়েও খুঁজে পায় না। একবার মনে হয়, জামান সাহেব বরাবরই তার সঙ্গে একটু গায়ে পড়ে আন্তরিক হতে চেষ্টা করেন। এমন ভাব করেন, যেন কত চেনা। আবার মনে হয়, এভাবে হুট করে জামান সাহেবের স্কুটারে না উঠলেও সে পারত। জামান সাহেবের উপস্থিতিতে এমনিতেই তার শরীর মন কেমন গুটিয়ে আসতে চায়। মনে হয়, জামান সাহেব বোধহয় তার শরীরের দিকে নজর দিচ্ছেন। কেন হয় এমন? নিজের ওপরই রাগ হয় রাখীর কথাটা মনে হওয়াতে। নিজেকেই দোষী করে সে ঐ মুহূর্তে। মনে হয়, যত সব বাজে চিন্তা তার নিজেরই মনে। শিক্ষকের প্রিয় ছাত্রছাত্রী কি থাকে না?

স্কুটার হঠাৎ থেমে পড়ল। স্কুটারঅলা মুখ ফিরিয়ে জানাল, গাড়ি আর যাবে না। দেখা যায় সামনের রাস্তা পানিতে পানিতে সয়লাব। প্রায় হাঁটুসমান পানির ওপর দিয়ে লোকজন কাপড় তুলে হেঁটে যাচ্ছে। রাখী মনে-মনে ভয় পেয়ে যায়। ঐরকম হাঁটুর ওপর কাপড় তুলে তাকেও পানি পেরুতে হবে নাকি?

জামান সাহেব স্কুটারঅলাকে বিদায় করে দাঁড়ালেন। রাখীর দিকে তাকিয়ে হাসলেন, এখন উপায়!

রাখী একবার বলতে চেষ্টা করল, আপনি যান, আমি এটুকু একলাই যেতে পারব। কিন্তু জামান সাহেব রাখীর কথায় আমল দিলেন না। বললেন, একখানা রিকশ দেখি।

রাখী তখন মনে-মনে ভাবছে, না জানি কপালে আরো কী দুর্ভোগ আছে। যত রাজ্যের ঝামেলা বেছে বেছে সব আজকেই পোহাতে হবে? জামান সাহেব চিৎকার করে রিকশ ডাকছেন তখন।

বৃষ্টিটা অবশ্যি এখন আর জোরে পড়ছে না। তবে আকাশ এখনো কালো, যে-কোনো মুহূর্তে আবার ঝাঁপিয়ে নামতে পারে। রাখী বলে, আপনি যান, এক্ষুনি আবার বৃষ্টি নামলে মুশকিলে পড়ে যাবেন।

না, না, সে কী করে হয়। জামান সাহেব বলেন, আমার খুব জরুরি কোনো কাজ নেই।

রাস্তায় তখন খালি রিকশ দেখা যাচ্ছে না একটাও। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি নামল আবার। রাখীর কেবলি মনে হচ্ছে, সে নিজে তো ভিজছেই, মাঝখান থেকে জামান সাহেবকেও ভেজাচ্ছে। সে না কিছু বলতে পারে, না কিছু করতে পারে। এমনি সময় পাশ দিয়ে একটা রিকশ যেতে দেখে সে চিৎকার করে ডেকে উঠল।

রিকশটা খানিক দূরে ছিল। ঐসময় জামান সাহেব একটা সীন তৈরি করে ফেলেন, পানি কাদা ছিটিয়ে প্রায় ছুটে গেলেন রিকশটার দিকে। গিয়ে রিশর হুড চেপে ধরলেন। দৃশ্যটা হাসির। জামান সাহেবের মতো লোক পানি কাদা ছিটিয়ে ছুটে গিয়ে রিকশর হুড চেপে ধরেছেন। কিন্তু রাখী হাসবে কী, লজ্জায় সে মরে যাচ্ছে তখন। ছি, ছি, সব তার জন্যে হচ্ছে।

রিকশয় চেপে পানি পার হতে হতে রাখী আল্লা আল্লা করে। ঐ হাঁটুসমান পানির মধ্যে রিকশটা উল্টে না যায়-আজ তার যে রকম কপাল যাচ্ছে-অমন কিছু একটা ঘটনা ঘটে যাওয়া বিচিত্র কিছু নয়। জামান সাহেব তখন ঢাকা শহরের মিউনিসিপালিটি, রাস্তা-ঘাট ইত্যাদি বিষয় নিয়ে কী কী সব বলে যাচ্ছিলেন। রাখীর কানে একটা কথাও যদি ঢোকে।

রিকশটা পানি পার হয়ে আসার পর রাখী স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। যাক বাবা, বাঁচা গেল। তার আশা হয়, এবার বাড়ি পৌঁছতে পারবে সে।

বাড়িতে পৌঁছেছে আর অমনি তুমুল বৃষ্টি আরম্ভ হয়ে গেল। বসবার ঘরে জামান সাহেবকে বসিয়ে সে ওপরে গেল। ওপরে গিয়ে দেখে আব্বা নেই, হাসান ভাই নেই। সুতরাং চায়ের কথা বলে কাপড় পাল্টে তাকেই এসে বসতে হল জামান সাহেবের কাছে।

জামান সাহেব দেয়ালের ছবি দেখছিলেন। রবীন্দ্রনাথের একখানা পোর্ট্রেট। রাখীকে জিজ্ঞেস করলেন-কার আঁকা?

রাখীই কি জানে কার আঁকা? রাখী বলতে পারে না। জানায়, বলতে পারব না, ছেলেবেলা থেকে ছবিটি দেখছি বাড়িতে। শুনেছি আমার মা কোথা থেকে যেন জোগাড় করেছিলেন।

জামান সাহেব বইয়ের শেফের কাছে গিয়ে ঝুঁকে ঝুঁকে বই দেখেন। অস্পষ্ট মন্তব্য করেন—তোমাদের বাড়িতে দেখি শুধুই রবীন্দ্রনাথ। তুমি যে এমন রবীন্দ্রভক্ত তা তো মনে হয়নি কখনো।

আমি না, রাখী হাসে, বলে আমার বোনের বই ওসব। আব্বাও রবীন্দ্রনাথের গান ভালোবাসেন।

জামান সাহেব ফিরে এসে সোফায় বসে বলেন, আচ্ছা তুমি হেডকে বলে দ্যাখো না। বলা যায় না, ইচ্ছে হলে তোমাকে ডিপার্টমেন্টে নিয়ে নিতে পারেন, নিদেনপক্ষে একটা ফেলোশিপও হয়তো-

এই পর্যন্ত বলেই জামান সাহেব থেমে যান। শেষে বলেন, নাকি তোমার ইচ্ছে নেই?

রাখী চোখে চোখে তাকায়, না তা নয়।

তাহলে কী? জামান সাহেবের দুচোখে ভারি করুণ একটা বিষাদের ভাব ফোটে। জিজ্ঞেস করেন, য়ুনিভার্সিটি তোমার ভালো লাগে না?

রাখী মাথা নাড়ে, না তা নয়, আসলে ও ব্যাপারে আমি এখনো কিছু ভাবিনি।

ও! জামান সাহেব যেন-বা আহত হন। বলেন, তা অবশ্যি ঠিক, সবে তো রেজাল্ট বেরুল। তবে ভেবে দ্যাখো—আমার মনে হয়, আমি হেডকে রাজি করাতে পারব।

রাখীর অবাক লাগে। ভদ্রলোককে এত কাছাকাছি কখনো দেখেনি। এমনিতেই একটু দূরের মানুষ বলে মনে হত-এত ছিমছাম আর পরিপাটি পোশাক, টাই পিনটি পর্যন্ত যথাস্থানে জ্বলজ্বল করে। আর তাঁর ইংরেজি উচ্চারণ, সবই একেবারে এমন নিভাঁজ যে একেক সময় তাঁকে ভীষণ কৃত্রিম লাগে। গুজব শুনেছে, ছাত্র অবস্থায় নাকি খুব সোশ্যাল ছিলেন। নাটক-ফাটক করতেন। এখন কিন্তু দেখে বিশ্বাস হয় না। যে লোক অমন নিখুঁত আর নিভাঁজ থাকে, তার পক্ষে কি সাধারণ হওয়া সম্ভব? তার দিকে একটু বেশি মনোযোগী হওয়া সত্ত্বেও রাখীর কখনোই জামান সাহেবকে কাছের মানুষ বলে মনে হয়নি।

কিন্তু সেই লোকের আসল চেহারাটা কী দ্যাখো। কেমন সহজ স্বরে কথা বললেন এতক্ষণ। এখন দেয়ালের ছবি দেখছেন, ঝুঁকে ঝুঁকে শেফের বই নাড়ছেন, রাখীর সঙ্গে ব্যক্তিগত কথা বলছেন। মানুষের যে কত চেহারা হতে পারে! রাখীর অবাক ভাবটা কাটতে চায় না।

জানো রোকেয়া, জামান সাহেবের গলা একসময় অদ্ভুত বিষাদাচ্ছন্ন হয়ে যায়। বাইরে তখনও একটানা বৃষ্টি, মাথার ওপরে পাখাটা ধীর লয়ে ঘুরছে। বৃষ্টিভেজা বাতাস ঘরের ভেতরে একবার এ দেয়ালে আরেকবার ও দেয়ালে লুটোচ্ছে। বিস্ময় আর অপরিচয়ের ওপার থেকে ভেসে আসা জামান সাহেবের গলার স্বর রাখীর কানে ভারি করুণ শোনায়।

তোমরা অনেকে আমাকে ভণ্ড ভাবো তা আমি জানি। আমি কিন্তু ঠিক তা নই। আমার সম্বন্ধে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে কতগুলো মিথ তৈরি হয়ে গেছে। কীজন্য হয়েছে, কারা তৈরি করেছে, তা বলতে পারব না। তবে হয়েছে, তা জানি। আর সেজন্যই সহজ হতে চাইলেও পারি না। আমাকে তো লোকে সন্দেহের চোখে দ্যাখে। এটা আমার দুর্ভাগ্য বলতে পারো।

রাখী মাথা নাড়ায়, না না আমি কখনো ওরকম-

জামান সাহেবের সম্ভবত ঘোর লেগেছে তখন। তাঁর বলবার কথা না বলে যেন থামবেন না। বলেন, তুমি কেন বিব্রত বোধ করছ? এতে তোমার দোষ কী, কারো দোষ নেই এ ব্যাপারে। যদি কারো সম্বন্ধে একটা ধারণা তৈরি হয়ে যায়, তাহলে কার কী করার আছে বলো?

কারো কিছু করার নেই। জামান সাহেব ফের বলেন, আমার নিজেরও মনে হয়েছে, ভুলটা আমারই। আর যখন থেকে মনে হয়েছে, তখন থেকেই আমি নিজেকে বদলে চলেছি। যাদের আমার ভালো লাগে, আমি তাদের কাছাকাছি পৌঁছতে চাই, তাদের আপনজন হতে চাই।

আরও কিছু হয়তো বলতেন জামান সাহেব। ঠিক ঐসময় দরজার কাছে এসে দাঁড়াল বুবু, রাখী তোর টেলিফোন।

জামান সাহেব অপ্রস্তুত হয়ে মাথা নিচু করে ফেলেছেন তখন। এক্ষুনি আসছি, বলে রাখী উঠল।

ফিরে এসে দ্যাখে জামান সাহেব শেল্ফ থেকে দুখানা বই বার করে নিয়েছেন। রাখীকে দেখে বলেন, বই দুখানা নিতে চাই।

বাহ্ বেশ তো, নিন।

জামান সাহেব বই দুখানা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, আমি এবার চলি, তুমি সময় করে একদিন ডিপার্টমেন্টে এসো।

রাখী ঘাড় কাত করে, জি যাব।

দরজার কাছে গিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়ালেন, শোনো।

জি, রাখী দুপা এগিয়ে গেল।

আমি অনেক কথা বলে ফেলেছি-কিছু মনে কোরো না।

কথাটা বলেই ভদ্রলোক আর দাঁড়ালেন না। ঘর থেকে বারান্দা, বারান্দা থেকে লন পার হয়ে গেট, সেখান থেকে খুব দ্রুত একেবারে রাস্তায়। রাখী জামান সাহেবের এইরকম হঠাৎ এবং দ্রুত চলে যাওয়া দেখল। মনে হল, অস্থির একটা কিশোর যেন লজ্জা পেয়ে ছুটে পালাচ্ছে। তার হাসি পেয়ে গেল তখন। বাইরে ওদিকে বৃষ্টি থেমেছে, আকাশে মেঘ কাটছে। রাখী দরজা ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গোটা দিনটার কথা ভাবল-কী দিনই না তার কাটল আজ! তার জীবনের স্মরণীয় একটা দিন। স্মরণীয় তো বটেই— নিজের কাছে স্বীকার করে রাখী। এমন দিনের কথা কি সে কখনো ভুলতে পারবে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *