ত্রয়ী উপন্যাস -প্ৰথম পৰ্ব
ত্রয়ী উপন্যাস - দ্বিতীয় পৰ্ব
ত্রয়ী উপন্যাস - তৃতীয় পৰ্ব

কুলায় কালস্রোত – ১৩

তেরো

হাসান বাইরে তাকিয়ে বসেছিল। ভয়ানক ক্লান্ত আর অবসন্ন লাগছে তখন। একেকবার মনে হচ্ছে, ডাকে মাজহারকে, ডেকে জিজ্ঞেস করে সোজাসুজি, তুমি টাকা দেবে কি না? পরক্ষণে মনে পড়ছে, মাজহার ইতিমধ্যে বেশ কয়েকবার তাকে এড়িয়ে যেতে চেয়েছে। এখন যদি মুখের ওপর ‘না’ বলে দেয় তা ব্যাপারটা বিশ্রী হয়ে উঠবে। অথচ কোনো রাস্তাও সে দেখছে না। সকাল থেকে টেলিফোন করল কতবার— জাহাঙ্গীর নেই, হায়দার নেই, আতাহার নেই। ফোনে কাউকে পাওয়া যায় না। অথচ টাকা না-পাওয়া গেলে তার অবস্থাটা যে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সে নিজেই বলতে পারে না। কাপ্তাই থেকে রোজ রাতে ওভারশিয়ার কাসেম ভূঁইয়া টেলিফোন করছে, স্যার সিমেন্ট পাঠান শিগগির, নইলে কাজ বন্ধ হয়ে যাবে, আর টাকা পাঠান কিছু, ব্যাংক আর ও.ডি. দিচ্ছে না— এদিকে দুসপ্তাহ ধরে লেবার পেমেন্ট হচ্ছে না, পাহাড়ি লোক, ওরা খেপে গেলে জানে মারা পড়ব— শিগির একটা কিছু করুন।

হ্যাঁ, এই এক ব্যাপার হয়েছে তার। সবকিছু শিগগিরই চাই। বৃষ্টি হতে পারে, মাটি কাটো শিগির। কাজ আরম্ভ করো, নইলে পানির সুবিধেটুকু পাবে না, শিগির ছুটো এঞ্জিনিয়ারের কাছে। সবই তাকে শিগির করতে হবে। না করে উপায় নেই। নিজের সবকিছু সে ঢেলেছে ঐ কাজে। শুধু কি নিজের? অন্যান্য পার্টনারদের টাকাও সে চালাকি করে ঢেলেছে এই একই জায়গায়। তার হিশেব হচ্ছে, কাজটায় মোটামুটি এগোতে পারলে আর চিন্তা থাকবে না। কিন্তু মাঝখান থেকে এই বাগড়া কে যে দিল, সে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না। কথা নেই, বার্তা নেই, য্যাকব্‌স অ্যান্ড ওয়াল্টার নতুন বায়না ধরে বসবে, এ হতে পারে? সেদিন কথা হল, সে লাখখানেক ইনভেস্ট করছে, সেটুকু হয়ে গেলেই য্যাকব্‌স-এর লোকজন আর টাকাপয়সা আসতে আরম্ভ করে দেবে। কিন্তু হঠাৎ নতুন কথা ওদের। জানাল, তোমাদের অংশের ৫০% ইনভেস্টমেন্ট দেখাও। তার মানে আরো দুলাখ— কোথায় পাবে সে দুলাখ টাকা? দুদিন ধরে ঘুরছে, আজ সকাল থেকে টেলিফোনের পর টেলিফোন করছে। কিন্তু একচুল সে এগোতে পারেনি টাকা যোগাড়ের ব্যাপারে। তাই ভয়ানক ক্লান্ত আর অবসন্ন হয়ে সে বাইরের দিকে তাকিয়ে বসেছিল।

দেয়ালে ক্যালেন্ডারের পাতা উড়ছে। ১৯৬৭ সালটা দেখল একবার নজর করে। ১৯৬২ থেকে শুরু, তার মানে পাঁচ বছর। পাঁচ বছর থেকে তার এই নিজেকে গড়ে তোলা। একটু একটু করে এগিয়েছে। আগে লোকজনের সঙ্গে চেনাজানা হওয়া, তারপর টাকাপয়সা ইত্যাদির ব্যবস্থা করা, শেষে চাকরি ছেড়ে পুরোপুরি কাজে লেগে যাওয়া। ভাবতে অবাক লাগে, দুবছর আগে কী ছিল সে আর এখন তার অবস্থা কোথায়? দুবছরে সে অনেক দূর আর অনেক ওপরে চলে এসেছে। এখন আর ফেরা সম্ভব নয় তার পক্ষে। ফেরা যেমন সম্ভব নয়, তেমনি সম্ভব নয় থেমে থাকাও।

সে জানে, এই সংকটও সে পার হয়ে যাবে। কিন্তু তবু ক্লান্ত লাগে। কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগতে আরম্ভ করেছে তার। আসলে পারভিন তাকে এই অবস্থায় এনেছে। পারভিন এভাবে চলে যাবে, সে ভাবতেও পারেনি। যাক, সে নিজের ভালো যদি না বুঝতে চায় তো কার কী করার আছে।

ঐ একটা ব্যাপারে তার নিজেকে খারাপ লাগে। জীবনে ঐ একটাই ব্যর্থতা। নইলে তার জীবনভরই তো সাফল্য। অবশ্যি আরেকটা ব্যাপারে তার মনের ভেতরে একটুখানি লুকানো ক্ষত আছে। কিন্তু সেটা সে আর কাউকে জানতে দিতে চায় না। কী দরকার! যদি বুলু সুস্থ হয়, তাহলে হয়তো ব্যাপারটা প্রকাশ পাবে। নইলে যেমন আছে গোপনে, তেমনি গোপনেই থেকে যাবে।

একেক সময় মনে হয়— এ ভালোই হয়েছে, অন্তত একটা বাজে মেয়ের উপস্থিতির হাত থেকে বাঁচা গেছে। যে পুরনোকে সে পার হয়ে এসেছে— তাকে একেবারেই পার হয়ে আসা কি ভালো নয়? না, কোনোদিক সে আর ফিরে যেতে পারে না- এগিয়ে না চলে তার এখন আর উপায় নেই।

অবসাদ ছিল, ক্লান্তি ছিল, সেইসঙ্গে আবার টাকার চিন্তাটাও ছিল। য্যাকব্‌স অ্যান্ড ওয়াল্টারের কাজটা সে এইভাবে ঝুলিয়ে রাখতে পারে না।

সে আবার টেলিফোন তুলল।

তার ভাগ্য ভালো, হায়দারের গলা। শুধাল, কেয়া ইয়ার, কেয়া খবর?

তোমার খবর কী তাই বলো।

আচ্ছা, হঠাৎ হায়দারের গলা যেন সন্তর্পণ হল। বলল, তুমি শেখ মুজিব সম্পর্কে খবর দিতে পারবে?

কেন হঠাৎ শেখ মুজিবের খবর, তুমি কি পলিটিক্স করবে নাকি?

নেহি ইয়ার, বড়ি গজব কি বাত হায়।

কীরকম? হাসানকে কৌতুহলী হতে হয়।

হি ওয়াজ মেকিং এ গ্রেট কন্সপিরেন্সি।

কী বলছ তুমি?

হ্যাঁ, আউর কুছ, টেলিফোনে বলা যায় না।

বিকেল হতে হতেই হাসান জেনে গেল যে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করে ‘বাংলাদেশ’ নাম দিয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা করার ষড়যন্ত্র হয়েছিল, এবং সেই ষড়যন্ত্রে আর্মি নেভি এবং এয়ারফোর্সের লোকজনও ছিল। ব্যাপারটা তার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছিল। রাজনীতি সে ভালো বোঝে না, কিন্তু ইতিমধ্যে ছয়-দফার ব্যাপারটা তাকে জানতে হয়েছিল। অবাঙালি বন্ধুরা তাকে ব্যাপারটা নিয়ে প্রায় জিজ্ঞেস করত বলেই তাকে জানতে হয়েছিল। মুখে যাই বলুক, ছয়-দফার ব্যাপারটা তার ভালোই লেগেছে। কিন্তু তাই বলে এই কাণ্ড! অসম্ভব! তার বিশ্বাস হতে চায় না।

বিকেলবেলা হায়দার এসে যখন জিজ্ঞেস করল, তখন সে পাল্টা জিজ্ঞেস করল, ব্যাপারটা তোমার বিশ্বাস হয়?

কেন, বিশ্বাস না হবার কী হয়েছে? হায়দার অবাক হয়।

আয়ুব খান, মোনেম খানের এটা ষড়যন্ত্রও তো হতে পারে। আর শেখ মুজিব কেমন লোক জানো না, সে কি ষড়যন্ত্র করার লোক?

দ্যাখো, ওসব বোলো না, ইস্ট পাকিস্তান আস্সালামো আলাইকুম জানাবে বলে ভাসানী হুমকি দিয়েছিল সেই ১৯৫৭-তেই। কিন্তু আমরা ওতে কিছু মনে করিনি, ভেবেছিলাম বাঙালিরা বেশি শেয়ার চাইছে, তাছাড়া কম্যুনিস্টদের আমরা বুঝি, ওদের কীভাবে ঠেকাতে হবে, তাও আমরা জানি। সেজন্যে তোমাদের ছাত্রদের মধ্যে থেকে যখন ঐসব কথা ওঠে, তখন আমরা কানে নিই না- কারণ আমরা জানি, এখানকার ডিটারমাইনিং ফ্যাক্টর হল এখনকার বিচ পিল, যারা আমাদের সঙ্গে সহযোগিতা করে বড় হয়েছে। শেখ মুজিব বা আওয়ামী লীগ, এ তো ডেমোক্র্যাসিরই ব্যাপার— এদের সঙ্গে আমাদের অমিল হবার কথা নয়। কিন্তু শেখ মুজিব যখন অটোনমির কথা বলে, তখন দ্যাট ইজ সামথিং। ব্যাপারটা আমরা আর হালকা করে দেখতে পারি না। নিশ্চয়ই কিছু একটা হয়েছে কোথাও— নইলে তোমরা কম্পিটিশন করতে চাইবে কেন?

এই কম্পিটিশন, আর ছয়-দফা যদি হিশেবে মেলে, তাহলে এই ষড়যন্ত্রও মিলবে দেখে নিও তুমি। আমাদের জন্যে আর কোনো ভবিষ্যৎ এখানে নেই।

হাসান বারবার বোঝাতে চেষ্টা করে। কিন্তু হায়দার বোঝে না। বলে, আমার শেয়ারটা ভাই তুমি বিক্রি করে দাও। আমি এখানে আর ব্যবসা রাখব না, এবার ব্যবসা গোটাব।

কী বলছ পাগলের মতো, খবরটা কী দেখা যাক আগে। না মরে ভূত হয়ে কোনো লাভ আছে? তাছাড়া শেখ মুজিব অতবড় লিডার নয় যে দেশের সব লোক তাকে সমর্থন দেবে।

হায়দার শেষ কথা বলে চলে গেল। বলল, তুমি যাই বলো, আয়েন্দা টাইম বহুত খতরনাখ্ হোগী।

মাজহারও এসেছিল বিকেলে। সে রাজনীতির কিছু বলল না। তবে জানিয়ে দিল, কোনো টাকা তার পক্ষে আর দেয়া সম্ভব নয়।

টাকা না দিলে কাজ সাফার করবে, হাসান স্মরণ করিয়ে দেয়।

করুক সাফার, আমি আর ব্যবসায়ে ইন্টারেস্টেড নই।

হাসান দিশেহারা বোধ করে। এ কোন্ সর্বনাশ অবস্থার মুখোমুখি হতে যাচ্ছে সে? তাহলে কি তারও শেষ ঘণ্টা বাজবে শিগগির। তার এত সাফল্য, এত সমৃদ্ধি, সব কাপ্তাই-এর উতরাই আর খাদে খাদে ছড়িয়ে রেখে আসতে হবে?

হাসান অনেক রাত পর্যন্ত অফিসে থাকে। ইভা কাগজপত্র টাইপ শেষ করে হাসানের সঙ্গে দেখা করে যায়। সেদিনও সন্ধ্যার সময় দেখা করতে এলে হাসান ডাকল, ইভা, আজ আমার সঙ্গে থাকবে একটু?

কেন বস্, কী হয়েছে তোমার? ইভা লক্ষ করে দেখে হাসানের মুখের দিকে।

এমনি, থাকো কিছুক্ষণ, গল্প করি।

ইভা আবার জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে বস্, এনিথিং রঙ?

না, কিছু না, বললাম তো।

শুধু গল্প করবে, নাকি বাসায় যাবে, আমার মনে হয় তোমার বাসায় ফেরা উচিত— য়ু লুক টায়ার্ড

নতুন নয়— আজকাল এরকম হচ্ছে। বলা যায় ডেল্টায় জয়েন্ট করার পর থেকেই ইভাকে হাসান তার ধানমণ্ডির বাসায় নিয়ে যায় একেক দিন। ইভাকে কোনো-কোনোদিন রাত কাটাতে হয় সেখানে। আজ হাসানকে দেখে ইভার মায়া হল কেমন। বলল, এভাবে আর নয়, তোমার একটা কিছু করা উচিত, পুরুষমানুষের এভাবে থাকতে নেই।

মানে? হাসান ইভার কথা বুঝতে পারে না।

ইভা শান্ত হাসে। বলে, তোমার এরকম হোমলেস রুটলেস অবস্থা চলবে না— গেট ম্যারেড।

তুমি বিয়ে করবে আমাকে? বলো?

মাথা খারাপ, ইভা সন্ত্রস্ত হবার ভান করে। বলে, তোমাকে বিয়ে করে শেষে আমিও পাগল হয়ে যাই আর কী।

তাহলে বলো, বিয়ের কী দরকার?

মানে?

বিয়ে করলে যদি পাগলামিতে পায়। তাহলে বিয়ে করার কী দরকার!

তোমার লোনসাম লাগে না?

কেন, লোনসাম লাগবে কেন— যদি লাগে, তাহলে তোমার মতো বন্ধু আছে।

আমার কথা বাদ দাও, ইভা এবার হাসে না। বলে, আর ক’দিন, আমার মতো হাতফেরতা জিনিস দিয়ে আর ক’দিন চলবে তোমার।

হাসান এত কথার পরও সহজ হতে পারে না। ইভাকে বাসায় এনেছে, এত গোছানো কথা বলছে, তবু হাসান যেন তার নিজের ভেতরে নেই। সে কেবলই নিজেকে শোনাচ্ছে— হাসান আহমদ, তোমার তাহলে এই পরিণতি দাঁড়াল!

ইভা হাসানকে বাসার ভিতরে এনে মুখ-হাত ধোয়াল, হাত-মুখ মুছিয়ে দিল, কফি বানিয়ে খাওয়াল- বারবার চেষ্টা করল হাসানের দুশ্চিন্তাটাকে ঝেড়ে ফেলতে। কিন্তু হাসান মন ফেরাতে পারে না। সুতরাং ইভাকে বিছানায় যেতে হল। আর বিছানাতেই ভুলতে পারল হাসান। না শরীর নয়— বিছানায় গেলেই ইভা তার স্মৃতির কথা বলে। বলে, আমি কী ভাবতাম জানো, আমার বিয়ে হবে খুব সুন্দর পুরুষমানুষের সঙ্গে— আর আমি তাকে খাইয়ে দেব, কাপড়-জামা পরিয়ে দেব, টাই বেঁধে দেব। আমি খুব পাগল ছিলাম ছেলেবেলাতে, তাই না? পাগলামি, কিন্তু কী সুন্দর পাগলামি আমার, বলো, সুন্দর না? সেই আমাকে এখন তোমার বিছানার সঙ্গী হতে হচ্ছে— অদ্ভুত কাণ্ড!

হাসান এই মেয়েটাকে একদম বুঝতে পারে না। এক বিছানায় শুয়ে-শুয়ে সে ঐ ধরনের মন-খারাপ-করা কথা একনাগাড়ে বলে যেতে পারে। একেক দিন বুলুর কথা এনে ফেলে। বলে, তুমি ওকে সুস্থ করে তোলো। দ্যাখো, ওই তোমাকে শান্তি দেবে।

আজ সেকথা না বলে শুধু শুধাল, বৌকে দেখতে যাও না কেন? তোমার যাওয়া উচিত, তুমি ছাড়া ওর আর কে আছে বলো?

হাসানের বিরক্তি লাগে এই গায়ে-পড়া উপদেশে। রাগ হয় হঠাৎ আর সেজন্যেই সম্ভবত ধাক্কা মেরে বিছানা থেকে নামিয়ে দেয়। বলে, এবার বাড়ি যাও, রাত খুব বেশি হয়নি।

হাসান ঠিক বুঝে উঠতে পারে না তবু। আসলে চারদিক থেকে কি কিছু ঘটনার আয়োজন শুরু হয়ে গেছে? আর সে আয়োজনের খবর সে পায়নি? নাকি ঘটনাটার আরম্ভ শুরু হয়ে গেছে। পায়ের তলার মাটি আলগা হয়ে যাচ্ছে, নিজেকে এখন আর ধরে রাখা যাবে না- দ্যাখো, কী নিদারুণ অবস্থা হচ্ছে তার। সে বুকের ভেতরে কোথায় একটুখানি কাঁপতে থাকে আজকাল। কায়সার আর মনসুর, জামান আর নার্গিস, কারো সঙ্গে দেখা হয় না। তার জীবনও কি তাহলে আলগা হয়ে যাচ্ছে মূল থেকে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *