দুই
রাখী, এবার কী করবে?
এই এক নিদারুণ প্রশ্ন। কেবলি ঘুরেফিরে আসছে। একাকী থাকলেও মনে হচ্ছে কে যেন পাশ থেকে বলে উঠল। আব্বা, বুবু, হাসান ভাই এঁরাও দুএকবার প্রশ্নটা তুলেছেন—কিন্তু ঐ প্রশ্ন পর্যন্ত—প্রসঙ্গটা আর বেশিদূর এগোয়নি। কেমন করে এগোবে, উত্তরটা কারো জানা থাকলে তো। রাখী একবার নিজেকেই শুধায়, রাখী কী করবি তুই এবার?
তখন ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে যায়। মুখচোখের সামনে মনি ভাইয়ের ভাসতে দেখে। মনি ভাই বলেছিল, রাখী কী করবি? ভেবেছিস কিছু?
সেই ম্যাট্রিক পাসের সময়। সেই সময়, যখন রাখী সদ্য শাড়ি পরতে শিখেছে-একটুতেই দুমদুম করে পা আছড়ে আবদার করত, ছুটে ছুটে বারান্দায় এসে দাঁড়াত-সেই তখন। মনি ভাই জিজ্ঞেস করেছিল, রাখী সায়েন্স পড়বি, না আর্টস?
না, মনি ভাই একা নয়-সঙ্গে ওর বন্ধু সেজান ছিল। হ্যাঁ, সেজানই বোধহয় প্রশ্নটা করেছিল প্রথম, কী পড়বে এখন? আর সেজানের প্রশ্নটাই ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল মনি ভাই। হ্যাঁ, সেই প্রথম। রাখী সেদিনই দিশেহারা হয়েছিল প্রশ্নটা শুনে। উহ্ কী ভয়ঙ্কর প্রশ্ন। সারাজীবন ধরে পাশে পাশে ফেরে।
ইন্টারমিডিয়েট পাস করার পরও উঠেছিল প্রশ্নটা। তখন মনি ভাইদের দারুণ খারাপ সময় যাচ্ছে। মার্শল ল’-এর খুব জোর, রাজনীতির প্রচণ্ড ঝড় বাইরে। প্রায়ই মনি ভাইকে বাইরে রাত কাটাতে হয়, বাসায় ফেরে না কতদিন। সেই সময়, সেই উত্তাল অস্থির দিনেও একফাঁকে মনি ভাই জিজ্ঞেস করেছিল, রাখী, কী পড়বি এবার ইতিহাস না সাহিত্য?
রাখী অত কিছু ভাবত না তখন। সাহিত্য পড়তে খারাপ লাগত না তার, তাছাড়া পড়া নিয়ে কথা, মোটামুটি পছন্দসই একটা বিষয় হলই হল। সে সাহিত্য নিতে পারত অনার্সে, ইংরেজি অথবা বাংলা। কিন্তু হঠাৎ একদিন কেমন যেন মনে হয়েছিল, ইতিহাস পড়াটাই বোধহয় সঙ্গত হবে ওর জন্য। আর শেষপর্যন্ত গত চার বছর ধরে ঐ ইতিহাসই পড়তে হল তাকে।
কিন্তু এখন? পড়াশোনা যখন শেষ হয়ে গেল, ডিগ্রি নেওয়া যখন শেষ, তখন? রাখী নিজেকেই শুধায় বারবার। আর যতবার শুধায় ততবারই মনি ভাইকে মনে পড়ে যায়। মনি ভাইকে মনে পড়লেই সেজানের কথা এসে যায়। রাখী তখন টেবিলটার কাছে এসে চুপ করে দাঁড়ায়। মনি ভাইয়ের টেবিল, ড্রয়ার খুললে হয়তো এখনো মনি ভাইয়ের লেখা ডায়েরির পাতা, নয়তো কবিতার টুকরো কাগজ খুঁজে পাওয়া যাবে-কিংবা হয়তো কোনো ছেঁড়া ইশতাহার। অনেকবার ড্রয়ারের কাগজ ঘেঁটেছে সে। মনি ভাই এই টেবিলের পাশে বসে বসে একেক দিন বাইরের দিকে তাকাত। বাইরের অন্ধকার নয়তো আকাশ দেখত। রাতে ঘুম হত না তখন ওর।
একেক দিন ঘুম ভেঙে গেলে পাশের ঘর থেকে রাখীর কানে আসত মনি ভাই বিড়বিড় করে বলে চলেছে, কী করব আমি? কী করা উচিত আমার? মনে হত মনি ভাই অস্থির কোনো যন্ত্রণায় ছটফট করছে। সে তখন বুঝত না, কোনোদিন বোঝেনি, কেন মনি ভাই অমন অস্থির হয়ে উঠত, রাজনীতি করে কী হয়-কিচ্ছু বুঝত না সে।
এখনো কি জানি আমি? কিছু বুঝি রাজনীতির? রাখী নিজেকে জিজ্ঞেস করে জবাব পায় না। এখনও সে জানে না কেন মনি ভাই মরে গেল। আব্বাকে একদিন জিজ্ঞেস করেছিল মনি ভাই। তখন ওর অসুখের বাড়াবাড়ি, সারারাতে ঘুম আসত না। তখন জিজ্ঞেস করেছিল, আবা বিশ্বাস কেমন করে জন্মায়, কেন আমি বিশ্বাস করতে পারি না?
তার বন্ধুরা সবাই জেলে, কেউ কেউ আন্ডারগ্রাউন্ডে, শুধু সে-ই তখন বাইরে। কিন্তু ঐ বাইরে থাকাই যেন ওর কাল হয়ে উঠেছিল। অসুস্থতার ঘোরে কেবলি বলত-বিশ্বাস না হলে আমি কী করব বলো?
ঐ সময়ের কথা কি সবই প্রলাপ? কে জানে, হয়তো প্রলাপই। রাখী এখনো ঠিক জানে না। শুধু মনি ভাইয়ের দিশেহারা বিভ্রান্ত চোখদুটি মনে পড়ে।
রাখী ঐ ঘরে বেশিক্ষণ থাকতে পারে না আজকাল। টেবিলে রাখা ছবিটার দিকে তাকালেই মনে হয়, যেন এক্ষুনি বলে উঠবে, রাখী, কী করবি এবার?
কী যে বিদ্ঘুটে অবস্থায় পড়েছে সে। কাউকে কিছু বলতে পারে না। আব্বা বলেছেন, রাখীবাঈ তুমি রিসার্চ করো-অন্যকিছুতে তোমাকে মানাবে না।
রাখীর হাসি পেয়ে যায় আব্বার কথা শুনে। আব্বা তো জানেন না, রিসার্চ ফেলোশিপ পাওয়া কী কঠিন ব্যাপার। নানারকম ধরাধরির কাণ্ড আছে সেখানে। কিন্তু আব্বাকে কে বোঝাবে অত কথা। সে শুধু জানিয়েছে-ও আমাকে দিয়ে হবে না আব্বা।
কেন? আব্বা রাখীর দিকে তাকান।
রাখীর কী মুশকিল তখন। কেন পারবে না সেটাও তো ছাই তার জানা নেই। তবু জানায়, আমার জানাশোনার ভেতরকার সব সাবজেক্টেই কাজ হয়ে আছে আগে। নতুন সাবজেক্ট, হয়তো কেউ গাইডই হতে চাইবেন না।
রাশেদ সাহেব মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে হাসেন, এই তো সেদিনও বাচ্চামেয়ে, বেণী দুলিয়ে ইস্কুলে যাচ্ছিল, আর আজ দ্যাখো সেই মেয়ে, এম. এ. পাস করে ভাবনায় পড়েছে, কী করবে। শেষে বলেন, আহা একটু খোঁজ-খবর করে দেখবি তো, আগে থেকেই হাত-পা ছেড়ে দিয়ে বসলে কি চলে?
মেয়েকে উৎসাহ দেয়ার জন্য বারবার বলেছেন, যা না একদিন তোর টিচারদের সঙ্গে আলাপ-টালাপ কর্। সেই যে বলতিস প্রাচীন বাংলায় নাকি গণতন্ত্র ছিল-মাৎস্যন্যায় বলে যে যুগটাকে চিহ্নিত করা হয়, সেটা নাকি আসলে গণতন্ত্রেরই যুগ?
নিজের ছেলেমানুষির কথা মনে পড়ে যায় রাখীর, হাসিও পায়। সেই কবে, বোধহয় তখন সবে অনার্সে ভর্তি হয়েছে। কী একটা বই পড়ে প্রশ্নটা মনে জেগেছিল। বাংলাদেশে মাৎস্যন্যায়ের একশো বছর সম্পর্কে। মহারাজ শশাঙ্কের পতনের পর আর কেউ রাজা নেই বাংলাদেশে। একশো বছর পরে রাজা হচ্ছেন গোপাল দেব এবং গোপাল দেবকে রাজা বানাচ্ছে কে? না, অনন্ত সামন্তচক্র। তাহলে কি অনন্ত সামন্তচক্রই দেশ শাসন করেছেন তখন, সেই একশো বছর? এই অনন্ত শব্দটি কি সংখ্যাবাচক না নামবাচক?
রাখীর মনে প্রশ্নটা এসেছিল সেই ফার্স্ট ইয়ারে পড়বার সময়। গোপা বিশ্বাস, মানে নলিনীবাবুর মেয়ে, তখন ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রী। রাখীর সঙ্গে তখন ওর আলাপ হয়েছে। গোপা বিশ্বাসকেও রাখী জিজ্ঞেস করেছিল। গোপা বিশ্বাস দারুণ হেসেছিল প্রশ্ন শুনে, বলেছিল, বাহ্ ইতিহাসে বেশি কথা লেখা থাকবে কেন! যার কোনো নিদর্শন পাওয়া যায়নি, যার কোনো প্রমাণ নেই-সেকথা ইতিহাসে লেখা থাকে না।
রাখী আর কাকে জিজ্ঞেস করবে সেকথা। সে আব্বাকে জিজ্ঞেস করেছিল। আর আব্বা আজ সেই কথাটা তুললেন। রাখী আব্বার চোখের দিকে তাকিয়ে দ্যাখে, আব্বা কি তার ছেলেমানুষের কথা মনে করিয়ে দিয়ে ঠাট্টা করছেন?
রাশেদ সাহেব কিন্তু ঠাট্টা করার কথা ভাবেননি। শুধু কথাটা মনে পড়েছে বলেই স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন। রাখী আব্বার মুখ দেখে আশ্বস্ত হয় তখন। না, আব্বা ঠাট্টা করছেন না।
ঠাট্টা করেননি, কিন্তু কৌতুক ঠিকই ছিল রাশেদ সাহেবের স্বরে। কারণ রাখীকে সেই ছোটবেলার মতো মনে হচ্ছিল তাঁর। একটুবা হতচকিত,
কিছুটা বা দিশেহারা। মনে হচ্ছিল, রাখী যেন মহাভাবনায় পড়েছে। তখন বলেন, ডক্টরেট পেলে তোমাকে দেখতে কেমন লাগবে রাখীবাঈ। মুখটা ভারিক্কি হবে নিশ্চয়ই। একখানা মোটা ফ্রেমের চশমা এখনই দেখে রাখব নাকি?
রাখীকে তারপর কয়েকদিন সত্যি সত্যিই য়ুনিভার্সিটি এলাকায় দেখা গেল। পরিচিত অধ্যাপকদের সঙ্গে দেখা করল। খায়ের সাহেব বলেন, এবার কোনো কলেজে ঢুকে পড়ো। টিচিং-এ তুমি ভালো করবে, লেখাপড়া নিয়ে থাকাটাই ভালো। নলিনীবাবু কিছুই বলেন না। ঘুরেফিরে কেগোপাদি’র বিয়ে হচ্ছে কলকাতায় কোনো এক বড়লোক ব্যবসায়ীর সঙ্গে, সেই গল্প শোনালেন। হামিদ সাহেবকে যদিবা মুখ ফুটে নিজের আবেদনের কথাটা জানাল, তো শুনে বললেন, দ্যাখো দরখাস্ত করে, কিন্তু সেরকম কোনো জায়গা খালি রয়েছে এখানে বলে আমার মনে হয় না- ওপরের কর্তাদের যদি ধরতে পারো কাউকে, তাহলে হয়তো হয়েও যেতে পারে। গভর্নর হাউসে জানাশোনা কেউ নেই তোমার?
অবস্থাটা দেখে মনে রাখী দমে যাচ্ছিল। শুধু জামান সাহেবকেই ভীষণ উৎসাহিত দেখল। হেড-এর কাছে গিয়ে তিনি নিজেই কথাটা পাড়লেন, নিজেই দরখাস্তের ফরম ফিলাপ করলেন। শুধু একবার জিজ্ঞেস করেছিলেন, কী সাবজেক্ট অফার করবে?
রাখী কখনো ভাবেনি কী নিয়ে রিসার্চ করবে।
তুমি বরং এক কাজ করো, জামান সাহেব একটুপর নিজের থেকেই বলেন, একটা সোশ্যিও-কালচারাল সাবজেক্ট নাও-পলিটিক্যাল অ্যায়েকেনিং অফ দি নাইনটিন্থ সেঞ্চুরি ইন্ডিয়ান মুসলিমস, দেয়ার ইকোনোমিক অ্যান্ড সোশ্যাল চেঞ্জেস।
জামান সাহেবের দিকে তাকিয়ে রাখী কিছু বলতে পারে না। তাঁর উৎসাহ ক্রমেই যেন বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে যাচ্ছে।
রাখীর কাছ থেকে সাড়া না পেয়ে আবার শুধালেন, নাকি মোগল পিরিয়ড থেকে কোনো সাবজেক্টের কথা লিখব?
রাখী কিন্তু অতশত ভাবছিল না। জামান সাহেবকে দেখছিল শুধু। ঘনিষ্ঠ হয়ে ঝুঁকে পড়েছেন। তাঁর স্যুটের ছাইরঙ ভারি কোমল, হাতের কাছে একটুখানি চকের দাগ লেগেছে, কপালে অস্পষ্ট ঘাম, মাথার কোঁকড়ানো চুলে, ফর্সা রঙে, উজ্জ্বল একটা পালিশ। থুতনির কাছে একটা লাল তিল—কী একটা যেন সেন্ট মেখেছেন—মৃদু সুবাস নাকে এসে লাগছে। রাখী জামান সাহেবের প্রশ্নের উত্তরে কিছুই বলে না। গোটা ব্যাপারটা তখন তার কাছে ঘোরতর অবাস্তব লাগছে।
জামান সাহেবকে ঐদিন বিকেল নাগাদ কেমন হতাশ দেখতে লাগল। রাখী জানত এরকম কিছু একটা হবে। জামান সাহেবের বাড়াবাড়িটা সবারই চোখে লাগছিল। রাখীর ব্যাপারে অন্যান্য টিচাররা হঠাৎ যেন কীরকম নিস্পৃহ হয়ে গেলেন। তার ধারণা ছিল, টিচাররা কেউ তাকে সুনজরে না দেখুন, অন্তত খারাপ নজরে কখনো দেখেননি। কিন্তু দ্যাখে, গোটা ব্যাপারটা গোলমেলে হয়ে যাচ্ছে। জামান সাহেবের অতি-উৎসাহেই কি না কে জানে-সবাই কেমন যেন শীতল ভাব দেখাতে শুরু করে দিয়েছেন।
রাখী, তুমি কিছু চিন্তা কোরো না। ঘোরাফেরা করে একসময় কেমন যেন জেদি হয়ে উঠলেন জামান সাহেব। বললেন, তোমার ফেলোশিপ হবেই, দেখে নিও। দরকার হলে আমি ভাইস-চ্যান্সেলরকে পর্যন্ত ধরব।
রাখী শুধু বলল, কেন?
কেন মানে? জামান সাহেব একটুখানি হকচকিয়ে গেলেন। তবু বললেন, তুমি একটা ভালো কাজ করতে চাইছ, তো ওঁরা বাধা দেবার কে? আইন দেখাচ্ছেন ওঁরা। যেন আইন-কানুন ওঁরা নিজেরাই সবসময় মেনে চলেন। রাখী তখন সিঁড়িতে পা দিয়েছে-আমি স্যার চলি।
তুমি ডিসহার্টেন্ড হোয়ো না প্লিজ। কিছু একটা হবেই।
তারপর গেটের কাছে এসে শুধালেন। হ্যাঁ, রাখীকে শুধালেন, কিন্তু গলার স্বর অমন কোমল হয়ে নিচুতে নামল কেন, রাখী বুঝল না। রাখী শুনল, কাল আসছ তো আবার, আগামী কাল?
রাখী কি জানে, পরের দিন আসবে কি না। কিন্তু তবু বলল। জি আসব। সেই মুহূর্তে জামান সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে অস্বস্তিবোধ করল রাখী। জামান সাহেবের চোখের ভেতর ভারি করুণ বিষাদ। কেমন যেন জড়িয়ে ধরতে চায় ঐ বিষাদময় দৃষ্টি।
রাখী পরের দিন আর যায়নি।