আঠারো
ভয় কে না পায়। এমন প্রখর স্রোত চারদিকে, ভয় কার নেই? বুলু নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে, তবু তার মনে কি ভয় নেই? পারভিন কি ভয়ে ভয়ে চারদিকে তাকায় না? আব্বা কি একটা আসন্ন সর্বনাশের ভয়ে অপেক্ষা করছেন না? ভয় কি হাসান ভাইয়ের নেই? আর তার নিজের? রাখী নিজেকে প্রশ্ন করে, ভয় কি আমার নেই?
সবচাইতে বেশি ভয় পাচ্ছেন রাশেদ সাহেব। কিন্তু কিছুই করার নেই তার।
বিকেলে ছোটমেয়েকে দেখছেন মাজহারের সঙ্গে, যে মাজহার রাখীর অফিসের বস, হাসানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, যার কথা হাসান তার কাছে বলেছে- সেই লোককে রাখীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ আলাপে ব্যস্ত দেখলেন। সেই দেখা অবধি একটা বিশ্রী অস্বস্তির সঙ্গে সময় গুনছেন তিনি। তার কেমন যেন মনে হচ্ছে, একটা বিপর্যয়ের মুখে পড়তে যাচ্ছে রাখী। একবার ভাবলেন, রাখীকে ডেকে বলবেন, রাখী সাবধান হও। কিন্তু পরক্ষণে মনে হল, রাখী যদি পাল্টা জানতে চায়, কিসের থেকে সাবধান হব আব্বা? যদি বুলুর মতোই সে তার ভালোবাসা নিয়ে মুখোমুখি দাঁড়াতে চায়, তাহলে? রাশেদ সাহেবকে তাই অপেক্ষা করতে হবে। হ্যাঁ, শুধুই অপেক্ষা, বিপর্যয় এসে কখন তাঁকে আঘাত করবে, তারই জন্য অপেক্ষা।
হ্যাঁ শুধুই অপেক্ষা, ১৯৬৭ সালে এসেও শুধুই অপেক্ষা। কিছুই করার নেই তোমার, শুধুই সংশয় আর অবিশ্বাস। গোঁজামিলের ফাঁকে ফাঁকে সন্দেহ আর সংশয় শিকড় ঢুকিয়ে দিয়েছিল, সেই ১৯৬২ সাল থেকেই, ১৯৬৬ সাল থেকে ধসে ধসে পড়তে লাগল স্তম্ভ আর দেয়াল। যারা ঐক্যের ডাক দিয়ে রাজনীতিতে নেমেছিল, একসময় দেখা গেল তারা মত পাল্টাচ্ছে, দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাচ্ছে। পার্লামেন্টারি রাজনীতি ছাড়া অন্যকিছু করণীয় নেই, ক্ষমতায় না গেলে কিছুই করা যাবে না— এইসব তত্ত্ব তারা সামনে আনল। যারা বিপ্লবের জন্যে রাজনীতিতে এসেছিল- তারা সশস্ত্র সংগ্রামের পথে নামতে চাইল। তাদের মধ্যে আবার নানা দৃষ্টিভঙ্গি। প্রশ্ন উঠল শত্রু কে, কারা শাসন করছে দেশ? সামন্তবাদী না উপনিবেশবাদী শক্তি? নাকি দুই শক্তি একসঙ্গে? এই মুহূর্তেই সশস্ত্র সংগ্রাম, নাকি তার জন্যে প্রস্তুতি প্রয়োজন— এইসব তত্ত্ব সামনে আসতে লাগল। সুতরাং অপেক্ষা— ১৯৬৬ সাল থেকে অপেক্ষা শুধু। অথচ ওদিকে চীন-ভারত যুদ্ধ হয়ে গেছে, এদিকে পাকিস্তান-ভারতের যুদ্ধের ঘটনাও ঘটে গেছে ১৯৬৫তে। সামরিক শাসনের গণতন্ত্র উঠতি দালাল বুর্জোয়াদের ফুলেফেঁপে ওঠার সুযোগ করে দিয়েছে। যারা ছিল পাকিস্তান আর মার্কিনীদের বন্ধু, যারা ৯৮ ভাগ স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হয়ে গেছে বলত, বলত সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা করা যাবে না তাদের মুখে স্বায়ত্তশাসনের দাবি শোনা গেল। আর তাদের দিকেই ঘেঁষতে লাগল অনেক মানুষ।
কিন্তু একজন সহকর্মী এই মত ও পথের জটিল বিতর্কে কোথায় দাঁড়াবে? তার কী করণীয়? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চাইল অনেকে। তারা বিপ্লবের প্রস্তুতিপর্বের কথাও যেমন ভুলতে পারে না, তেমনি আবার সশস্ত্র সংগ্রাম শুরুর কথাও অস্বীকার করতে পারে না। তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে লাগল একে একে। ১৯৫৪/৫৫ সালে যারা এক পার্টিতে কাজ করত, দশ বছরের মধ্যে তারা নানান দলে ভাগ হয়ে পড়ল।
তাত্ত্বিক বিতর্ক চলতে লাগল, পার্টির ভেতরে এবং বাইরে- সাধারণ কর্মীরা কখনো এ-দলকে সমর্থন করতে চায়, কখনো ও-দলকে – কিন্তু সাধারণভাবে সুস্পষ্ট কোনো বক্তব্যের ওপর কিংবা নেতৃত্বের ওপর সংহত হতে পারে না।
কিন্তু জনগণ?
জনগণ শব্দটা রাজনীতিতে মানুষকে বোঝানোর জন্যে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। জনগণ তাই একেবারেই রাম রহিম যদু জালালকে যেমন বোঝায়, তেমনি সেই শক্তিকেও বোঝায় যা ইতিহাসের গতিধারাকে সম্মুখের দিকে প্রবাহিত রাখে। জনগণ শব্দের এই গভীরতার ও ব্যাপকতার দিকটা রাজনীতির লোকেরা হিসেবের মধ্যে রাখে না। যারা রাখে, তারা জনগণের সামনে আসে প্রতারণা করবার জন্যে। তাদের মুখে রাজনৈতিক অধিকার, গণতন্ত্র, স্বায়ত্তশাসন ইত্যাদি কথা শোনা যেতে থাকে। এবং অতীতে যেমন হয়েছিল, তেমনি নির্বাচন এবং ভোট আদায়ের আয়োজনটাই বড় হয়ে ওঠে।
কিন্তু জনগণ তার নিজের নিয়মে চলে, তার গতিধারা নিয়ন্ত্রণ করে তার নিজেরই জীবন। কখনো আঘাত আসে, কখনো প্রত্যাঘাত হয়, কখনো স্তব্ধ করে দেওয়া হয়, আবার কখনোবা বিস্ফোরণ ঘটে। এই হল ১৯৬৭ সালের জনগণ। বিক্ষুব্ধ, আহত, গুমরানো এবং জাগ্রত। এই জনগণ ইঙ্গিত দিতে লাগল যে বিপর্যয়ের আর দেরি নেই। প্রবল ঘণ্টা এবার বেজে উঠবে।
সেজান কারো সঙ্গে নিজেকে মেলাতে পারে না। কারো সঙ্গে মানে নেতাদের কারো সঙ্গে। যারা পার্লামেন্টারি রাজনীতির দিকে ঝুঁকে ছিল তারা তাকে সন্দেহের চোখে দেখতে লাগল, আর যারা বিপ্লবী রাজনীতিতে ছিল তারা তাকে বুর্জোয়া মনোভাবের শিকার বলে ধিক্কার দিল।
কিন্তু এক জায়গায় সেজানের জোর ছিল। সে হল তার সহকর্মীরা। আর সেজন্যই তার অপেক্ষা মানে হাত গুটিয়ে বসে থাকা নয়। সে প্রতিটি আন্দোলনের সঙ্গে থাকতে চেষ্টা করল আর অপেক্ষা করল, কখন একটা সমাধানে পৌঁছনো যায়। যদিও কর্মীদের প্রশ্নের জবাব দিতে পারত না, দিলেও তারা সেই জবাব গ্রহণ করত না- এবং তার ফলে কেউ কেউ তাকে ছেড়েও যাচ্ছিল। তবু সেজানকে তার ঘনিষ্ঠ সহকর্মীরা বিশ্বাস করত এবং আস্থায় রেখেছিল। একটা বিষয়ে তারা নিশ্চিত ছিল যে সেজান আর যা-ই করুক, সুযোগসন্ধানী হবে না, বা প্রতারণা কখনো করবে না। সুবিধাবাদের সঙ্গে আপোষ করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। ফলে মত ও পথের বিরোধে বামরাজনীতি বিভ্রান্ত দিশেহারা এবং খণ্ড-বিখণ্ড হওয়ার উপক্রম হলেও সেজানের সমর্থনের এলাকাগুলো অটুটই থেকে যাচ্ছিল। একই সঙ্গে সে আন্দোলন এবং অপেক্ষা করে যাচ্ছিল।
রাখী অফিসে নিজের চেয়ারে সবে বসেছে এমনি সময় ফোন। ফোনে সেজানের গলা।
কী খবর? রাখী শুধাল।
এক্ষুনি আসতে চাই, সেজান যেন ভয়ানক ব্যস্ত।
কেন, হঠাৎ?
হ্যাঁ দরকার পড়েছে ভীষণ, আমি এক্ষুনি আসছি।
মতামত দেওয়ার আগেই লাইন কেটে গেল, সেজান ফোন রেখে দিয়েছে। রাখী তারপর আর কাজে মন দিতে পারল না। মিছিমিছি অস্থির হল। বারবার করে মনে প্রশ্ন জাগল, কেন আসতে চাইছে সেজান? আবার কি টাকার দরকার? নাকি অন্য কোনো বিপদ, যে বিপদে আর কারো কাছে সে সাহায্য পাচ্ছে না।
পনেরো মিনিট পার না হতেই সেজান তার কামরায় এসে ঢুকল। কিন্তু একী চেহারা ওর! ময়লা জামাকাপড়, যেন কতকাল গা থেকে খোলেনি। পায়ের জুতো মাটি কাদায় একাকার। কতদিন শেভ করেনি, চোখদুটি কোটরের ভেতরে। গালের হাড় উঁচু হয়ে উঠেছে। কপালের শিরাগুলো স্পষ্ট দেখা যায়। আর কী কালো হয়েছে দেখতে— মা গো!
অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে দেখল রাখী। তারপর কথা বলল। বলল, কী ব্যাপার, হঠাৎ এভাবে?
সেজান বসে পড়ে সোজাসুজি বলল, আমাকে কিছু টাকা দাও রাখী।
টাকা? টাকা কী হবে? রাখীর যেন হাসি চেপে রাখা দায়।
সে তুমি পরে শুনো! এখন যা পারো দাও। গেটে লোক দাঁড় করিয়ে রেখে এসেছি।
রাখী চেক বই বার করে, কত?
সেজান রাখীর চোখে চোখ রাখে একমুহূর্ত। বলে, যা পারো, সেদিন পঞ্চাশ টাকা দিতে চেয়েছিল, আজ সেইসঙ্গে আরো পঞ্চাশ দাও।
রাখী চেক সই করে এগিয়ে দেয়। কোনোরকম প্রশ্ন করে না।
সেজান চেক নিয়ে বেরিয়ে যায় এবং এক মিনিট পরেই ফেরে। ফিরে এসে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে চোখ বুজে বলে, বাঁচালে, সামান্য ক’টা টাকা- কিন্তু কোথাও পাচ্ছিলাম না। ঐ ক’টা টাকার জন্যে মিছিমিছি ক’টা ছেলে হাজত খাটত, উকিল-মোক্তারগুলোও হয়েছে এমন! তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।
রাখীর বিরক্তি লাগছিল। সেজানের এই লোকদেখানো বিনয় আর ভদ্রতা একেক সময় অসহ্য লাগে— তার ওপর আবার উকিল-মোক্তার প্রসঙ্গ। সে বলতে চাইল, আমার জরুরি কাজ আছে এখন, পরে দেখা হবে। কিন্তু কথাটা বলতে গিয়ে থেমে গেল। লক্ষ করল, সেজান চোখ বুজে বসে রয়েছে। তাকে এত ক্লান্ত সে কখনো দেখেনি। রাখী বসে বসে দেখল সেজানকে। তার মনে বিস্মিত একটা অনুভূতি জাগছে তখন। না ক্ষোভ, না বিরক্তি, না সহানুভূতি। একসঙ্গে জামান আর মাজহারের কথা পনে পড়ছে। আব্বার কথাও মনে হল ঐ মুহূর্তে। সব একসঙ্গে, মেশামিশি হয়ে।
একসময় মনে হল সেজান হয়তোবা অসুস্থ। সেজন্যেই ভয়ানক কাহিল দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে, এক্ষুনি টেবিলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়বে। আর কী খবর বলো, সেজান একসময় চোখ মেলল, তোমরা ভালো ছিলে?
হ্যাঁ, আপনি?
আমি ভালোই আছি, সেজান থেমে থেমে হাসল একটুখানি। হেসে বলল, শরীরটা মাঝে মাঝে ট্রাবল দিচ্ছে অবশ্যি, কিন্তু ও কিছু না।
মনে হচ্ছে অসুখ হয়েছিল?
না রাখী, অসুখ নয় তেমন কিছু— এমনিতেই তো গ্যাসট্রিকের অসুবিধা ছিলই, তার ওপর আবার কয়েকদিন জ্বর গেল— ওতেই এরকম দেখাচ্ছে। রাখী কিছু বলে না আর। সে কী বলবে, সেজানের সে কতটুকু জানে? ব্যক্তিগত প্রশ্ন করতে সঙ্কোচ হয় তার।
ও হ্যাঁ, হঠাৎ যেন মনে পড়ে সেজানের। বলে, মনসুর যেদিন মারা যায় সেদিন তুমি গিয়েছিলে শুনেছিলাম, তখন কীরকম ব্যস্ত বোঝোই তো। একদম সময় করে উঠতে পারিনি তারপর।
আজ এলেন যে! রাখীর কথায় কি অভিমান ফুটল? রাখী শুধায়, টাকার দরকার হয়েছিল বলে এলেন?
ব্রিত হওয়ার কথা, কিন্তু সেজান হাসে। রাখী এরকম ম্লান হাসি কখনো দেখেনি।
তুমি যেদিন তোমার বিয়ের খবর জানিয়ে এলে, সেজান বলে, আমি জানি না ব্যাপারটা কতদূর এগিয়েছে। তবে আমার সেদিনই মনে হয়েছিল, তুমি ভয়ানক রেগে গিয়েছ। কারো ওপর, আর ঐ রাগের বশেই যেন খবরটা চারদিকে জানিয়ে বেড়াচ্ছ।
রাখী জোর করে হাসল। বাহ্, রাগ করব কেন, কী মুশকিল, এতবড় একটা খবর আপনাকে না জানালে পরে আপনি দোষ দিতেন না? সেজান বাইরের দিকে তাকিয়ে চুপ হয়ে গিয়েছে তখন। বোধহয় কিছু ভাবছিল। শেষে ধীরে ধীরে বলল, রাখী আজো আমার সময় নেই, গ্রামে গ্রামে ঘুরতে হচ্ছে, পুরনো বেসগুলো ঠিক করা যায় কি না, তাই চেষ্টা করে দেখছি, কোথাও কোথাও কিষাণরা প্রতিরোধ করছে, চারদিকে কেমন চাপা অস্থিরতা। শুনেছ বোধহয়, ভুখা মিছিলের ওপর লাঠিচার্জের খবর, ঢাকা জেলারই ঘটনা, রায়পুরায় মিছিলের ওপর গুলি পর্যন্ত চলল সেদিন- এইসবের মধ্যে আমাকে ডুবে থাকতে হচ্ছে। কিন্তু তবু তোমার সেদিনকার কথাটা কখনো ভুলতে পারিনি। কাজকর্মের ফাঁকে কেবলি মনে হয়েছে, তোমার সঙ্গে আমার দেখা হওয়া দরকার। তোমার সেদিনের ঐসব কথা কেমন অস্বাভাবিক আর অবাস্তব মনে হয়েছিল আমার কাছে। ভেবেছিলাম চিঠি লিখব- কিন্তু তাও আর হয়ে ওঠেনি।
রাখী চুপচাপ শোনে। অফিসে কাজের তাড়া, কিন্তু রাখীর কামরায় সময় যেন স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। রাখী তার কাজকর্মের কথা সব ভুলে গেছে তখন।
আমি যতবার তোমার বিয়ের কথা ভেবেছি, ততবারই মনে হয়েছে, কোথায় যেন একটা ফাঁক থেকে যাচ্ছে। কেবলি মনে হয়েছে, তুমি এখনো নিঃসংশয় হতে পারছ না। কী একটা সত্যকে পাশ কাটাতে চেয়ে তুমি গা বাঁচাতে চাইছ। আর জানো, সেজান এবার ঝুঁকে পড়ে রাখীর মুখের দিকে তাকায়। তারপর বলে, তোমাকে আমারও কিছু বলবার আছে বলে মনে হয়েছে, কিন্তু বলতে পারিনি কখনো। একেক সময় দারুণ ইচ্ছে হত, তোমাকে কথাটা জানাই- কিন্তু মুশকিল, কথাটা যে কীভাবে বলব তা-ই বুঝে উঠতে পারিনি কখনো। আর সেজন্যই তোমার কাছে এলে আমার মনের ভেতরে নানান কথা উঠতে থাকে, কিন্তু কোন্টা যে বলা যায়, বুঝে উঠতে পারি না। তুমি ভেবো না এসব আমার চালাকির কথা। লোকের তাই মনে হতে পারে, কিন্তু আমার বিশ্বাস, তুমি আমার এসব কথার ভুল ব্যাখ্যা করবে না। তবে আমার শেষ কথা, তুমি একটা ফাঁক রেখে যাচ্ছ। রাখী, আর যাই করো, আমার মতো হয়ো না। জীবন বড় নিষ্ঠুর, সে ঠিকই শোধ তুলে নেবে একদিন।
সেজান কখনো এত কথা বলে না। রাখীর মনে হল, সেজান সত্যিই অসুস্থ। এই মুহূর্তে অন্তত সে স্বাভাবিক অবস্থায় নেই।
হাতে হাত রাখল রাখী আর সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, একী! আপনার গায়ে যে রীতিমতো জ্বর!
সেজান উঠল তখন। হাসল কি না বোঝা গেল না। শুধু মনে হল, সত্যিই বাইরে ওর অনেক কাজ।
সেজান চলে গেল কিন্তু রাখীর কেবলি মনে হতে লাগল, যায়নি, আছে, সামনেই সে বসে আছে আর ভারী গলায় মৃদুস্বরে কথা বলে যাচ্ছে। অনেক কাল আগে বাড়িতে মনি ভাইয়ের ঘরে যে স্বর শুনত, সেই স্বরটাই যেন দেয়ালে দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। কী ভয়ানক কথা বলে সেজান, কীরকম অস্ফুট অথচ কী তীব্র তার কথা। বলে গেল, জীবন বড় নিষ্ঠুর রাখী।
জীবন নিষ্ঠুর তা কে না জানে। রাখীর চাইতে আর কে বেশি জানে সেকথা। তবু সেজানের গলায় সেকথা যেন আরো তীব্র শোনাল। যন্ত্রণা যেন ওকেও রেহাই দেয়নি। কথাটা একবার জিজ্ঞেস করবে, রাখী ভাবে। জিজ্ঞেস করবে, আপনারও কি যন্ত্রণা আছে? নিজের কোনো যন্ত্রণা? রাজনৈতিক মতভেদ কিংবা আদর্শচ্যুতির জন্য গ্লানি নয়- নেহাত ব্যক্তিগত কোনো যন্ত্রণা নেই আপনার?
সেজানকে ঐরকম প্রশ্ন করা অবশ্যি রাখীর সাজে না। নিজের ভাইয়ের জীবন থেকেই প্রশ্নের উত্তরটা জানে রাখী। মনি রাজনীতি করত, কিন্তু তারও তো যন্ত্রণার অবধি ছিল না। তবু প্রশ্নটা একদিন রাখী জিজ্ঞেস করবে বলে মনে-মনে ঠিক করল।
তারপর রাখী কাজে মনোযোগ দিল।
আর ঠিক ঐসময় ঝড়ের মতো ঘরে এসে ঢুকল ইভা মরিস। একটা কাগজ ছুড়ে দিল রাখীর দিকে। তারপর হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, নাউ সি- আই’ম চাকভ্ অফ্, য়ু বীচ, য়ু হোর!
রাখী কিছু বুঝে ওঠার আগেই অশ্লীল গালাগাল করতে লাগল ফিরিঙ্গি মেয়েটা। এলোমেলো চুল কপালে এসে পড়েছে, চোখের কোণে পানি।
তীব্র আক্রোশে বলে চলল, নাউ আই’ল স্পিল আউট এভরিথিং য়ু ডিড। তুমি মাজহারকে ছিনিয়ে নিয়েছ, ওর কাছে আমার নামে নালিশ করেছ, আর তাতেই আমার চাকরিটা চলে গেল। আই কেয়ার এ ড্রাম ফর দিস জব। কিন্তু মাজহার এমন ছিল না। হি ওয়াজ ইন লাভ উয়িথ মি, গত সেপ্টেম্বরে আমরা বিয়ে করতাম, বাট য়ু- বাট ফর য়ু-
রাখী বিমূঢ় তখন। কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। শুধু উঠে দাঁড়িয়ে বলল, উইল্যু স্টপ মিস মরিস?
হোয়াই শ্যূড আই স্টপ, নো, নেভার। কক্ষনো থামব না। ওকে নিয়ে রেস্তরাঁয় যাও, দুপুর কাটাও হোটেলের বিছানায়।
মিস মরিস! রাখীর গলা ছিঁড়েখুঁড়ে চিৎকার বেরিয়ে এল।
ততক্ষণে দরজার কাছে ভিড় জমে গেছে। মাজহার এসে ঢুকেছে ঘরের মধ্যে। ধাক্কা দিয়ে বার করছে ফিরিঙ্গি মেয়েটাকে। অন্য কে একজন বেয়ারা ডাকছে চিৎকার করে। মিস মরিসের মুখ দিয়ে অশ্লীল গালাগাল ছুটছে তখনো।
রাখী দাঁড়িয়েই থাকল। যেন কোনো বোধশক্তি নেই তার। ছায়াবাজির মতো মনে হচ্ছে সব। কেমন অস্বাভাবিক অচেনা ঘর, ঘরের আসবাবপত্র, ফাইলের কাগজ, মানুষগুলো— সব একাকার, একটার পর একটা ছায়া। কতক্ষণ জানে না। মাজহার ফিরে এসেছে ইতিমধ্যে এবং এসে বলছে, আমি দুঃখিত মিস রাশেদ।
রাখী জানে না কী বলবে। কী করবে তাও বুঝতে পারছে না। সে আচ্ছন্নের মতো তার কামরা থেকে বেরুল।
কোথায় যাবে এখন? অফিস থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নেমে সে ডাইনে বাঁয়ে তাকায়। কোথায় যাবে এখন, কার কাছে?
একবার মনে হল, কোথাও যাবার জায়গা নেই তার। কারো কাছে যেতে পারে না সে। জামানের কথা মনে হল। স্কুটার ডেকে চেপে বসবার পর মনে পড়ল, জামান আজ চাটগাঁ চলে গেছে। একবার সেজানের কথা মনে এল- আর সঙ্গে সঙ্গে ভয়ানক রাগ হল তার। স্কুটারকে এপথ সেপথ ঘুরিয়ে একসময় ফিরল সে।
রাখী, তুই কি তাই? এ বীচ, এ হোর? ঘুরেফিরে প্রশ্নটা মুখিয়ে উঠল মনের ভেতরে। রাখী দেখল না তখন বিকেল না সন্ধ্যা, আকাশের মেঘে রঙ লেগেছে কি না, দেখল না রাস্তায় কীরকম ভিড়। বাসার কাছে স্কুটারঅল র হাতে একখানা নোট গুঁজে দিয়ে ছুটতে ছুটতে ওপরে এলে চোখের সামনে দেখল আব্বার ঘর, দরজা খোলা। তার আধাবোজা গলার ভেতর থেকে একটা বিপন্ন আর কাতর স্বর বেরুল শুধু। ভাঙা গলায় তার শৈশব আর কৈশোরের সমস্ত অসহায়তা নিয়ে সে ডেকে উঠল, আব্বা!
রাশেদ সাহেব দেখলেন। দেখলেন রাখীর দুচোখের সর্বস্ব হারানো অসহায়তা। মনে হচ্ছে, রাখী ঝড়ে তাড়া-খাওয়া পাখির মতো এসে পড়েছে তার কাছে। দুপা এগিয়ে গেলেন আর তক্ষুনি রাখী সেই ছেলেবেলার মতো রাশেদ সাহেবের বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে কান্নায় ভেঙে পড়ল। কী হয়েছে রাখী, রাখীবাঈ, কী হয়েছে!
রাখী তখন কেবলি ডাকছে, আব্বা, আব্বা গো!
রাশেদ সাহেব মেয়ের মাথায় হাত বোলাতে লাগলেন, আর বারবার করে শুধালেন, কী হয়েছে রাখী মা, মামণি, কী হয়েছে বল্ আমাকে?
রাখী কী বলবে? তার নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বুকের ভেতরে কান্না দমকে দমকে ফুলে উঠছে, ফেঁপে উঠছে, আর আব্বার কোলে আছড়ে পড়ছে। রাশেদ সাহেব আর জিজ্ঞেস করলেন না কী হয়েছে। অনুমান করলেন, কোথাও মস্তবড় আঘাত পেয়ে এসেছে রাখী। কাঁদতে দিলেন। ঘরে তখন কেউ নেই। বুলু পারভিনকে নিয়ে বাজারে গেছে। বাড়ির ভেতরে কোনো শব্দ নেই। বাইরের নানান শব্দ বাড়ির দেয়ালে দেয়ালে শুধু প্রতিহত হয়ে চলেছে।