ত্রয়ী উপন্যাস -প্ৰথম পৰ্ব
ত্রয়ী উপন্যাস - দ্বিতীয় পৰ্ব
ত্রয়ী উপন্যাস - তৃতীয় পৰ্ব

পূর্বরাত্রি পূর্বদিন – ১২

বারো

দিন চারেক পরেই ফিরল সুমিতা। ফিরে এসে দেখে সেজান নেই। রাখী ছিল, জানাল, সেজান চলে গেছে।

চলে গেছে? রাখীর দুচোখের দিকে তাকাল সুমিতা, কী দেখল কে জানে, একটা নিশ্বাস বেরুল শুধু। বলল, বেচারার বোধহয় খুবই অসুবিধা হচ্ছিল, মেয়েমানুষের খবরদারি কি পুরুষের সয় বল্? কোথায় গেল, জানিয়েছে কিছু?

হ্যাঁ, ওর পুরনো জায়গাতেই।

তুই যেতে দিলি!

বাহ্, কেমন করে আটকাব, রাখী এতক্ষণে হাসে।

বুঝেছি, সুমিতা বলল, মুখ তো পুড়েছিল, এবার কপালটাও পুড়ল।

একটু থেমে আবার জানতে চাইল, তুই কী করবি, বলে গেছে কিছু?

বাহ্, রাখীর যেন অবাক লাগে। বলে, আমি কী করব না করব, সেকথা ও বলতে যাবে কেন?

কী জানি বাপু, তোদের ব্যাপার আমার মাথায় ঢোকে না।

রাখীর দিন কাটল ভারি শান্ত। কলেজে একবার চিঠি লিখেছিল। উত্তরে জাহানারা জানিয়েছে, এখন এসে লাভ নেই— কলেজের এখন ভীষণ বিতিকিচ্ছি অবস্থা। প্রিন্সিপ্যালকে সরিয়ে নতুন লোক নেয়া হয়েছিল। প্রিন্সিপ্যাল সাহেব মামলা করায় ফান্ডের ওপর ইনজাংশন জারি হয়ে গেছে। মাইনেপত্র সব বন্ধ। এখনো অটামের ছুটি চলছে। খুললে বোঝা যাবে, কী হয়।

সুতরাং কলেজে ফিরে যাওয়া আপাতত বন্ধ। রাখীর সময় কাটে কখনো ঘরে, কখনো বাইরে। কিছু করার নেই- এমন অবস্থায় রাখীর আগে ভীষণ খারাপ লাগত। কিন্তু এখন সেরকম লাগছে না। ঘরে শুয়ে শুয়ে বই পড়ে অনায়াসে সময় কাটিয়ে দেয় কোনো-কোনোদিন। শরীরময় কেমন ঘুম-ঘুম একটা নিবিড় ভাব। আব্বা কোনো-কোনোদিন কাছে এসে বসেন। পুরনো কথা হয় তখন। আব্বা আজকাল ছেলেবেলার গল্প করেন। রাখী মনোযোগ দিয়ে শোনে আর আব্বাকে দেখে। কী হয়েছেন দেখতে। চামড়া কুঁচকে ঝুলে পড়েছে গলার কাছে। চশমা ঢিলে হয়ে নিচে নেমে আসে। রাখী চশমার ফ্রেমটা বদলাবার কথা বলে। রাশেদ সাহেব শোনেন। তারপর আবার অন্যকথায় চলে যান।

হ্যাঁ অন্য কথায়। জীবনের গোড়ার কথায়। অন্য কেউ তোঁ নয়, শুধু রাখী আছে। তাই রাখীকেই শোনান। তাঁর সংসার পাতার প্রথম দিনগুলোর কথা। সালমা কেমন করে সংসার গুছিয়েছেন একটু একটু করে সেই হিশেবটা দেন। তখন প্রতিটি খুঁটিনাটি জিনিসের কথা মনে পড়ে তাঁর।

একটা আলমারি কেনা হয়েছিল কেমন করে জানিস? মাটির ব্যাঙ্কে টাকা জমিয়ে। আর প্রথম রেডিও কিনেছিলাম ট্যুরের পয়সা বাঁচিয়ে। বুলু হবার আগে কী জেদ তোর মায়ের- পালঙ্ক কেনো একটা। প্রথম সন্তান, চৌকিতে শোয়াতে পারব না আমি। ঈদের শাড়ি বাদ দিয়ে খাট কেনা হল ইন্‌স্টলমেন্ট-এ। এইরকম একটু একটু করে সংসার গুছিয়েছিল তোর মা।

কেন ঐ গল্প করেন, কেন ঐসব কথাই বারে বারে মনে পড়ে, রাশেদ সাহেব বুঝে উঠতে পারেন না। একেকবার মনে হয়, বিশ্বাস আর ভালোবাসার কথা বোঝাতে চান বোধহয় রাখীকে। রাখীর যে সংসার ভেঙে গেল-সেজন্যেই সম্ভবত তাঁর মনের কোথাও ক্ষোভ আছে। রাখীকে বোধহয় ফেরাতে চান তিনি। আবার মনে হয়- না, ওসব কিছু নয়, বুড়ো হবার জন্যেই ঐসব পুরনো কথা এত স্পষ্ট করে মনে পড়ছে তাঁর।

না, বিচলিত বোধ করেন না আর। সালমার কথা ভেবে না, মনির কথা ভেবে না, বুলুর কথা ভেবেও না। বিচলিত আর কত হবেন। সময় চলে গেলে, কারো কারো জীবনে বোধহয় এরকমই হয়। কিছু থাকে না, সবকিছুই চলে যায়। তবু তো এখনো রাখী আছে তাঁর।

কিন্তু রাখীর চোখের দিকে তাকিয়ে কেমন বিভ্রান্ত বোধ করেন। রাখীকে ধরা যায় না আজকাল। অনেক দূরে থাকে মেয়ে- কাছে আসে কিন্তু মেশে না একেবারে। তার মনের ভেতরে কী, তার কিছুই টের পাওয়া যায় না। সেজানের সঙ্গে রাখীর একটা সম্পর্ক হয়েছে তা বুঝতে পারেন। কিন্তু সে- সম্পর্ক যে কীরকম, তা কিছুতেই ধরতে পারেন না।

অবশ্যি ধরার জন্যে খুব যে তাঁর ইচ্ছে এমনও নয়। তবে রাখীকে যে অচেনা লাগে এইজন্যেই কষ্ট হয়— মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাস পড়ে তাঁর। সবই যাবে— জীবনই চলে যায়- তবু তো কিছুটা হলেও তাঁর কাছে রাখী আছে। দুটি মাস কাটল দেখতে দেখতে। ঢাকা শহর ঝিপঝিপে বৃষ্টির মধ্যে জবুথবু হয়ে দিন কাটিয়ে দিল। শরৎ এল দেরিতে, তবু এল। হালকা শাদা মেঘ আর নীল আকাশ মাথার ওপর ভেসে উঠতেই যেন নড়ে চড়ে উঠল শহর। ছাত্ররা থেকে-থেকেই রাস্তায় নামছিল। রাজবন্দি মুক্তির দাবিটা সামনে আসছিল জোরেশোরে। ইতিমধ্যে মনি সিং সহ অন্যান্য নেতাদের মুক্তির দাবিতে স্বাক্ষর সংগ্রহ শেষ হয়েছে। কী হল, মওলানা ভাসানী এসে গেলেন মাঝখানে। শহরে ছিলেন না, এসে গেলেন প্ৰায় হঠাৎই।

খবরের কাগজে ছবি বেরুল, মওলানা পুলিশ-বেষ্টনীর মুখোমুখি দাঁড়িয়েছেন। রাশেদ সাহেব মেয়েকে দেখালেন ছবিটা। বললেন, মনে হচ্ছে এবার কিছু একটা হবে রে— বুড়ো যখন বার হয়, তখন কিছু-না-কিছু হয়ই।

হ্যাঁ, জানত না কেউ, ভাবেওনি সম্ভবত- কিন্তু কিছু-না-কিছু সত্যিই আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল। ছাত্রদলগুলো যখন থেকে একটা প্রোগ্রামে শামিল হবার প্রস্তাব করছিল তখন থেকে, নাকি রাজনৈতিক নেতারা কমন প্রোগ্রামের বিষয়টা আলোচনায় আনছিলেন তখন থেকে, নাকি কোনো কোনো গ্রুপ সশস্ত্র সংগ্রামের জন্যে গা ঢাকা দিয়ে প্রস্তুতির পথে পা বাড়াচ্ছিল তখন থেকে— ঠিক করে বলা মুশকিল। তবে এটা ঠিক যে শেষ ঘণ্টা বাজতে আরম্ভ করে দিয়েছিল অনেক গভীর নিচে কোথাও।

রাখী জানত, আর জানত বলেই অপেক্ষা করছিল মনে-মনে। শরীরের আলস্যবোধের মধ্যে নিবিড় হচ্ছিল ঐ অপেক্ষা, উদ্দেশ্যহীনতার শূন্যতা ভরাট করছিল ঐ অপেক্ষা, ঐ অপেক্ষা অস্তিত্বের মর্মমূলে অঙ্কুরিত বীজের মতোই একটু একটু করে বাড়ছিল। এতই অনিবার্যভাবে যে, অপেক্ষার বোধহয় দরকারও ছিল না। কিন্তু তবু রাখী অপেক্ষায় ছিল। সুমি যেদিন বলল, কী রে, তুই কি খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দিয়েছিস? শরীর এত খারাপ দেখাচ্ছে কেন? রাখী সেইদিন যেন সচকিত হল। তারপরই টের পাওয়া গেল একে একে। শুধু রাখী একা নয়, বাইরের লোকেরাও দুএকজন জেনে ফেলল। বমি করতে দেখে কাজের মেয়েমানুষটি ছুটে এল রাখীকে ধরার জন্যে, সে দেখে বুঝল। সুমিকে হাসপাতালে খুঁজতে গিয়ে মাথা ঘুরে বসে পড়েছিল রাখী, তখন তাকে সামলাতে গিয়ে সুমির বন্ধু— একজন ডাক্তার, সে বুঝল; কিন্তু সুমি বুঝল তার দুতিন দিন পরে। সঙ্গে সঙ্গে ভয়ে কেঁপে উঠল তার বুক। বলল, ওরে রাক্ষুসি, এ তুই কী করেছিস?

কেন সুমি, রাখীর চোখে ভারি কোমল হাসি, আমি কি মা হব না কোনোদিন?

তোর কি এতটুকু ভয় নেই মুখপুড়ি? তোর না আরেকজনের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল?

রাখীর কী যে হয়েছে— তার মুখে দুশ্চিন্তার কোনো ছায়া পড়ে না- শুধু হাসে। বলে, সংসারের কতই তো নিয়মকানুন আছে, তাতে আমার কী? তুই কি সংসারের পরোয়া করিস না?

রাখী মুখ ফিরিয়ে নেয়। বলে, সুমি, আমার ছেলে খুব সুন্দর হবে, দেখিস। এ আমার ভালোবাসার ফুল, তুই দেখিস, কেমন সুন্দর হয় আমার ছেলে।

সুমি বোঝায়, রাখী চল্ একটা অ্যাবরশনের ব্যবস্থা করে দিই।

রাখীর চোখেমুখে ভয় চমকায়। সুমির দিকে সন্দেহের চোখে তাকায়। কিছু বলে না। কিন্তু তারপর সুমির ওখানে যায়ই না হয়তো সারাটা সপ্তাহ।

আব্বাকেও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত দেখতে পায়। কেমন কান্না ভেঙে পড়ে তাঁর গলায়। বলে, রাখী তুই এভাবে আমাকে ডোবাস না। কিন্তু রাখীর মনের ভেতর আব্বার বিপন্ন গলার ঐ স্বর কোনোই প্রতিক্রিয়া তৈরি করে না। সুমি সেদিন খুব ভোরবেলা এসে রাখীকে পাকড়াও করল। জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে তোর, যাস না কেন?

তোকে আমার বিশ্বাস হয় না আজকাল।

কী বললি তুই, সুমি প্রায় খেপে উঠল। গালাগাল দিতে আরম্ভ করল- নেমকহারাম তুই, নইলে বলতে পারলি ওকথা! তোর ছেলের পায়ের তলায় মাটি থাকবে না, বুক ফুলিয়ে দাঁড়াতে পারবে না, মাথা উঁচু করে চলতে পারবে না— এই কি তুই চাস?

রাখী সুমিতার কথা শুনে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। বুকের ভেতরে কোথায় যেন টান লাগে। বলে, সুমি, ওভাবে বলিস না- আমি তো কারো কোনো ক্ষতি করিনি। তার চোখে দিশেহারা ভাব ফোটে। হাত ধরে বলে, সুমি শোন্, তুই কি সত্যি আমার ছেলের জন্ম হোক তা চাস না?

সুমি রাখীর মুখের দিকে তাকিয়ে আর কথা বলতে পারে না। সেখানে আশা দেখতে পায়, মিনতি দেখতে পায়, বেদনা দেখতে পায়। মনে হয় জীবন যেন ভরে উঠতে চাইছে। রাখীকে তখন কাছে টানে, একেবারে বুকের মধ্যে। হাত দিয়ে কপালের চুল সরিয়ে দেয়। রাখীকে নিয়ে যায় চীনে রেস্তরাঁয়— স্যুপ খাওয়ায়। বলে অরুচি হলে মাঝে মাঝে এসব খাস। ঘরে তোদের আচার আছে? রাখীর মনে হয়, ঠিক যেন বুবু। নিজের আগ্রহেই সে সুমিতার কথা শোনে, ওষুধ কিনে নিয়ে যায় আর কথায় কথায় সুমিকে শুধায়, হ্যাঁ রে এসব খাওয়া ভালো তো? অরুচি আর কতদিন চলবে বল্ তো? শরীরটা যে আমার গেল।

সুমিতার মনে হয় রাখীর এসব বাড়াবাড়ি।

সুমিতা একদিন সাদেক সাহেবকে খুঁজে বার করল। বলল, সেজান সাহেবের ঠিকানাটা দিন

সাদেক সেজানের চলে যাওয়ার খবরটা জানত। বললেন, দেখি খোঁজ করে। কিন্তু কেন?

সুমিতা খুলে বলল না। শুধু জানাল যে খুব জরুরি দরকার।

সাদেক আশ্বাস দিলেন যে দুএকদিনের মধ্যেই ঠিকানাটা জানতে পারবেন।

রাশেদ সাহেব ওদিকে জামানের ঠিকানা খুঁজছিলেন। য়ুনিভার্সিটিতে খোঁজ করে পাননি। শুনলেন জামান স্কলারশিপ নিয়ে গেলেও ওখানে যাওয়ার পর সেটা বাতিল হয়ে গেছে— এখন কোন্ জায়গায় আছে বলা মুশকিল। কে একজন কায়সারের নাম বলল। কায়সারকে খুঁজে বের করলে সে ফরেন অফিসে চিঠি লেখার পরামর্শ দিয়ে ইভার খোঁজ দিল। ইভার চাকরি এখনো হাসানেরই অফিসে। ঐ অফিসে যেতে একটু ইতস্তত ভাব হচ্ছিল তাঁর। কিন্তু তবু গেলেন। ইভা তাঁকে দেখে ভয়ানক ব্যস্ত হয়ে উঠল 1 বারবার বলতে লাগল, আপনি কেন এলেন। টেলিফোনে খবর দিলেই তো আমি চলে যেতাম।

রাশেদ বসে রইলেন মুখোমুখি আর ইভা হাতের সব কাজ ফেলে রেখে ড্রয়ার, ডায়েরি, চিঠির ফাইল এসব ঘাঁটল অনেকক্ষণ ধরে। তারপর একসময় হতাশ হয়ে বলল, আই’ম এফ্রেড ইটস্ সামহোয়ার ইন মাই বেডরুম- কাল ঠিক দিতে পারব।

তাহলে কাল আসি আমি?

ইভা হাসানের কামরার দিকে দ্রুত একনজর তাকিয়ে নিয়ে বলল, আবার আসবেন?

হ্যাঁ আসব, খুব দরকার। ইভা রাশেদ সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, মে আই কাম টু ইয়োর প্লেস? আমার এক কাজিনকে দেখতে যাওয়ার কথা আছে ওদিকে।

রাশেদ সাহেব মেয়েটির আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়ে গেলেন। বুঝলেন, জামানের ঠিকানাটা পেতে অসুবিধা হবে না।

ঠিকানা পাওয়া যাবে কিন্তু সমস্যার সমাধানটা? রাশেদ সাহেবের সন্দেহ হয়— জামান হয়তো তালাকনামা পাঠাবে না। বেকায়দায় পেলে কে কাকে ছাড়ে?

সন্দেহটা হল তাঁর, কিন্তু তাই বলে কি নিশ্চিন্ত থাকবেন। পারে কোনো মেয়ের বাবা? উকিল ধরলেন, তারপর উকিলের পরামর্শমতো তালাকনামায় সই নিলেন রাখীর। শেষে লন্ডনের ঠিকানায় পাঠিয়ে দিলেন সেই কাগজ।

এদিকে সাদেক সাহেব শুধু ঠিকানা নয়, লোকসুদ্ধ জোগাড় করে নিয়ে এলেন। মঞ্জুর, রাজশাহী য়ুনিভার্সিটির এম.এসসি. এখন গ্রামাঞ্চলে থাকে। সে জানাল সেজান নাকি পাবনা গিয়েছিল। তারপর গিয়েছে গাইবান্ধা এলাকায়। এখন সম্ভবত নিজের এলাকায়। বলল, চিঠি দিতে চান দিন, কিন্তু কতদিন হাতে পৌঁছবে তার ঠিক নেই— দেরি হবে।

সুমিতা বলেছিল, হোক দেরি, তবু চিঠিটা পৌঁছনো দরকার।

পরের দিন মঞ্জুরের হাতে চিঠিটা দিতে গেলে সে জানাল- আমি তো আরো ক’দিন ঢাকায় থাকব। সাত তারিখ পার না করে আমি ঢাকা ছেড়ে নড়ছি না। তারিখটা দেখে যাই।

কেন সাত তারিখ কী হবে?

মঞ্জুর হেসেছিল। বলেছিল, দেখা যাক না কী হয়।

তো দেখা গেল কী হল সাত তারিখে। সকালবেলা বেরিয়ে দেখে রিকশ নেই, বাস নেই, দোকানপাট খোলা নেই— সবকিছু খাঁ খাঁ করছে। রাজবন্দি মুক্তির দাবিতে মওলানা ভাসানীর ডাকে একটা হরতাল হওয়ার কথা অবশ্যি শুনেছিল সে, কিন্তু সেটা যে সাত তারিখেই তার খেয়াল ছিল না। আয়োজন নেই, পিকেটিং নেই, প্রচার নেই, হঠাৎ এইরকম হরতাল। সুমিতা অন্যান্য লোকের মতোই অবাক হল। এমার্জেন্সিতে ক’টি পলিটিক্যাল ছেলে জড়ো হয়েছিল। ওদের ধারণা ছিল, কোথাও গোলমাল হবে। কিন্তু কিছুই হল না শেষপর্যন্ত। একটা জখম রোগীও পাওয়া গেল না।

তাহলে সাত তারিখের রহস্যটা এই।

মঞ্জুর চিঠিটা হাতে নিয়ে বলল, দারুণ সময় আসছে আপা, দেখবেন কী হয়। হাসান ভাইদের হিশেব ঠিক। সময় দারুণ কম, আমরা তৈরিই বোধহয় হয়ে উঠতে পারব না।

অক্টোবরে এনএসএফ-এর এক গুণ্ডা মারা পড়ল। আর তাতে আতঙ্কজনক যে একটা মিথ তৈরি হয়েছিল সেটা গেল ভেঙে। মোনেম খানের শাসনের খুঁটিও যে নড়বড়ে, মানুষ তা বুঝে নিল। ছাত্ররা ঐক্যফ্রন্টের আলোচনা প্রায় শেষ করে এনেছে। ফরিদপুরে কৃষক সমাবেশ হয়ে গেল। পাবনা, রাজশাহী অঞ্চলে জোর তৎপরতার খবর আসছে। শাহপুরে কৃষক সম্মেলনের আয়োজন। ছাত্রদের মধ্যে রোজই বক্তৃতা হচ্ছে, রোজই মিছিল বেরুচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়।

সুমিতা রাখীকে নিজের কাছে এনে রাখতে চায়। রাশেদ সাহেব বিশ্রীরকম বিরক্ত হয়ে থাকেন সর্বক্ষণ। অহেতুক ধমক দেন চাকরবাকরদের। জামানের চিঠির জন্যে অপেক্ষা করে আছেন— প্রায় রোজই পোস্টাপিস ঘুরে আসেন একবার। তাঁকে আরো বেশি উদ্‌ভ্রান্ত দেখায় আজকাল।

সুমিতা রাখীর দিকে তাকিয়ে দেখে। এখন আর লুকোনোর কিছু নেই। লুকোতে চেষ্টাও করে না। সুমিতার তাকানোর ভঙ্গি দেখে শুধায়, কী দেখছিস, প্রেগনেন্ট মেয়ে দেখিসনি কখনো?

সুমিতা হাসে না। বলে, না প্রথম দেখছি তোকে। তার বিশ্বাস হতে চায় না রাখীর মতো মেয়ে এমন একরোখা জেদি হয়ে উঠবে। যুক্তি শোনে না, বিচার বোঝে না, ভবিষ্যৎ মানে না। তার একেক দিন সন্দেহ হয়, রাখীর মাথা ঠিক আছে তো?

রাখী শুনে বিচিত্র হাসে। বলে, সুমি আমাকে তুই ওসব কী বোঝাস বল্‌? আমার ছেলের পরিচয় কী হবে জানিস না তুই? কী মনে করিস, আমি কিছু লুকোব? নিজের রক্তের কাছে কি কিছু লুকোনো যায়? বিশ্বাসের কাছে কি ছলনা চলে? দেখিস, আমি এখন যেমন লুকোই না, তখনও লুকোব না। তোদের সংসারের নিয়মকানুন কী হল না হল, তাতে আমার ভারি বয়ে গেল।

সুমিতা রাখীকে আর ঘাঁটায় না। রাখী যখন বলে, সুমি, যা করেছি নিজের ইচ্ছেয় করেছি। বহুদিন অপেক্ষায় থেকে-থেকে তারপর করেছি। ভালোবাসা চিনতে আমার এত দেরি হল বলেই এত অসুবিধা তোদের। আমার দোষ ছিল কোথায় জানিস? দোষ ছিল নিজেকে চিনতে না-পারায়- দোষ ছিল শক্তপায়ে না-দাঁড়ানোয়, দোষ ছিল আমার নিজের কাছে যা সত্য তা দুহাত বাড়িয়ে আঁকড়ে না-ধরায়।

রাখীর এইসব কথা সুমিতার দুর্বোধ্য লাগে। কিন্তু তবু মনে হয়, কথাগুলো যেন একেবারে ভেতরে থেকে বলছে রাখী।

আসলেই রাখী এখন অনেক ভেতরের মানুষ। নিজেকে নিয়েই তার চিন্তা, নিজের সঙ্গেই তার আলাপ। সেজানকে সে সবসময় কাছাকাছি অনুভব করে। একেক দিন অদ্ভুত সব কল্পনায় তাকে পেয়ে বসে। মনে হয় সেই সময়, আই.এ. পাস করার পর যখন প্রথম জিজ্ঞেস করেছিল, রাখী এবার কী করবে? তখন যদি বলত, তুমি বলো, কী করব— তাহলে হয়তো সেদিনই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। যেদিন জেল থেকে ছাড়া পাবার পর প্রেসক্লাবে দেখা হয়েছিল সেদিন সে হাত ধরে নিয়ে যেতে পারত বাসায়। কিংবা যেদিন চিনা রেস্তরাঁয় একসঙ্গে বসে বিকেলবেলা খেয়েছিল, সেদিনও সে বলতে পারত, তুমি এখন আর কোথাও যেতে পারবে না, আমার সঙ্গে যাবে।

রাখীর ঈষদোন্নত পেটের দিকে যখন কেউ তাকায় রাখীর সঙ্কোচ হয় না। ভারি কোমল হাসি খেলে যায় তখন তার মুখে। গর্ব এসে বুকের ভেতরটা ভরে দেয়। কেউ যেন বলতে চায়— দ্যাখো, আমি ফুরিয়ে যাইনি, হারিয়ে যাইনি, আমি এবার আর ভুল করিনি।

সেজান ইতিমধ্যে দুখানা চিঠি লিখেছে। কাউকে সে জানায়নি চিঠিদুটোর কথা। শুধু দুতিনটি করে লাইন— আমি জানুয়ারিতে ফিরব, ভালো থেকো। সেজান এখনো জানে না যে, সে মা হতে যাচ্ছে। কথাটা মনে হলে সে নিজের মনে হাসে। জানতে পেলে সেজান নিশ্চয়ই খুব অস্থির হবে। না, সেজানকে সে এখন অস্থির হতে দিতে চায় না। তার সন্তান তো শুধু তারই একার।

একার নয়, বলো? রাখী নিজেকে বলে। বলে আর অনুভব করে- ভারি ধীর স্পন্দন কাঁপছে তার অস্তিত্বের গোপন মর্মে। সেই স্পন্দন হৃৎপিণ্ডের সঙ্গে দোল খাচ্ছে খুশিতে, তারপর বয়ে যাচ্ছে স্রোতের মতো রক্তধারায়, সেখান থেকে আবার শরীরের প্রতিটি কণায় কণায় ঐ স্পন্দনের স্রোত অনবরত বয়ে আসছে। নিরন্তর উৎস থেকে বয়ে আসার মতো। কান পাতলে হৃদপিণ্ডে যেন বলে, আসছে, আসছে। ঘরের অন্ধকারটা যেন বাঁধানো চাতাল আর সেখানে ছোট ছোট পায়ের ছোটাছুটি আরম্ভ হয়েছে। কোথায় কে যেন খিলখিল করে হাসতে হাসতে আড়াল হল— কেউ যেন কেঁদে উঠল কোথায়। রাখী হঠাৎ এই শব্দ শুনতে পায়।

এসব কথা বলা যায় না কাউকে। তেমনি কেউ থাকলে সে কখনো বলত না।

আব্বা সেদিন একটা টেলিগ্রাম মেলে ধরলেন সামনে। ভারি বিধ্বস্ত দেখাচ্ছিল তাঁকে। বললেন, এই বোধহয় শেষ, যাবি দেখতে?

রাখীর বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। বলল, যাব আব্বা। সুমিতাকে টেলিফোনে ডাকল। ডেকে খবরটা জানিয়ে শুধাল, সুমি তুই যাবি আমাদের সঙ্গে?

সুমি বারণ করল, রাখী, তুই না গেলে হয় না?

কেন সুমি?

সুমি জবাব না দিয়ে বলল, ঠিক আছে, আমিও যাব তোর সঙ্গে। হ্যাঁ, শেষই বটে। কঙ্কালসার, কালো ছাইয়ের মতো, চুল ছেঁটে ফেলা হয়েছে, হাত পা অসম্ভব ফোলা, পানি নেমেছে। মরছে, কিন্তু তখনও হাসি। রাখীর মাথা ঝিমঝিম করে উঠেছিল দেখে। সে ডেকে উঠেছিল একবার বুবু বলে। কিন্তু বুলু ফিরে তাকায়নি। রাখীর কেবলি মনে হচ্ছিল-এ বুবু নয়। নিশ্চয়ই অন্য কেউ। কিন্তু আবার একসময় ঠিকই মনে হল— এ বুবুই, অন্য কেউ নয়। শুধু বুবু কেন, এ যেন সে নিজেও।

লিভারটা পুরো বিকল হয়ে গিয়েছিল। এখন শেষ অবস্থায়। রাখী যখন আবার বলল, বুবু চিনতে পারছ? আমি রাখী। তখন যেন একটুখানি আলো খেলল মুখে। হ্যাঁ, শুধুই মুখে, চোখে নয়। ডাক্তার জানালেন, উনি এখন বোধহয় দেখতে পাচ্ছেন না।

না, দেরি হয়নি। দুদিন সময় নিয়েছে মাত্র। রাখীর জেদে লাশ ঢাকায় আনা হল। ঢাকাতেই দাফন হল। যা যা করতে হয়, সবই আব্বা করলেন। ক’দিন বাড়িটা আগরবাতি লোবানের গন্ধ, কোরান তেলাওয়াতের উচ্চারণ আর লোকজনের চাপা কথাবার্তায় ভরে থাকল। তারপর আবার চুপ।

হাসান ভাইকে কেউ খবর দিয়েছিল কি না জানা নেই, অন্তত রাখী জানে না। কিন্তু লক্ষ করেছে, হাসান ভাই আসেনি। পারভিন কেঁদে উঠেছিল চাপা গলায়, বুবু আমাকে মাফ করে দিয়ে গেল না রাখী আপা।

সবচাইতে আশ্চর্য, ক’দিন পর ইভা এসেছিল। এসে আব্বার কাছে গিয়ে বসেছিল। রাখী ভাবতেই পারেনি। এর আগেও একদিন এসেছিল শুনেছে সে, সেদিন দেখা হয়নি। রাখী কাছে যেতেই বলেছিল, আমি খুব দুঃখিত রোকেয়া। আব্বাকে বলল, আমি ফিল করলাম আমার আসা উচিত, তাই না-এসে পারলাম না। যদি অন্যায় করে থাকি, মাফ করে দেবেন।

রাখীর সেদিন খুব আপন মনে হয়েছিল ইভাকে। বলেছিল, তুমি আবার এসো। তোমার মতো বন্ধু পাওয়া সৌভাগ্যের ব্যাপার।

ভারি অদ্ভুত সংসারটা, রাখীর একেক দিন মনে হয়। নইলে এমন সব ঘটনা ঘটে? নইলে পারভিন এমন করে বদলায়? ইভার মতো মেয়ে এমন করে বন্ধুর মতো কাছে আসে? অথচ হাসান ভাই একবারের জন্যও এল না।

কিন্তু এ সবই রাখীর বাইরের হিশেব। বুবুর মরণ তাকে কাঁদিয়েছে ক’দিন। কিন্তু তবু মনে হয়, কান্নাটা যেন রাখীর ভেতরটা স্পর্শ করতে পারেনি। বুবুর মরণের কান্না যেন অনেক আগেই সে কেঁদে রেখেছিল। তাই বুবুর মরণটা তার কাছে শোকস্মৃতির মতো মনে হল, ঠিক পুরো শোক নয়। মৃত্যুর সঙ্গে সম্পর্কিত ঘটনাগুলো শেষ হতে হতে আবার সহজেই নিজের ভেতরে ফিরে এল রাখী।

রাখীর অবাক লাগে ব্যাপারটা। একেক দিন একাকী অন্ধকারে নিজেকেই শুধায়— রাখী তাহলে কি তুই এই হতে চেয়েছিলি? শুধু মা। বোন নয়, মেয়ে নয়, স্ত্রী নয়— শুধুই মা হবার সাধ ছিল তোর? জন্ম জন্ম ধরে শুধুই মা হতে চেয়েছিলি?

কথাটা শুধায় নিজেকে আর সমস্ত শরীর তার কাঁটা দিয়ে ওঠে। হৃৎপিণ্ডটা বুকের ভেতরে দোল খায়। বারান্দায় দাঁড়ালে আকাশ যেন কাছে এসে যায়।

নভেম্বর চলে যাওয়ায় শিশির থাকে আজকাল। বাইরে শিউলি ঝরে, জোছনায় চরাচর ভেসে যেতে থাকে। রাখী ছাদে যায় ঐরকম জোছনার রাতে। ছাদে শানের ওপর বসে থাকতে একসময় অনুভব করে জোছনায় সে ভিজে যাচ্ছে। দূরে কোথায় যেন কারা স্লোগান দিচ্ছে— রাখী কান পাতে- কিন্তু শোনা যায় না স্পষ্ট করে। তখন হাওয়ার দিকে কান পাতে। ভারি মৃদু হাওয়া বইছে। হাওয়ার ঐ শব্দের সঙ্গে যেন সে নিজের রক্তধারার সাড়া পায়। তার রক্তস্রোত, তার শরীরের প্রতিটি রক্তকণা যেন হাওয়ার সঙ্গে সাড়া দিয়ে উঠছে। সেই সাড়া সে হাত দিয়ে ছুঁতে চায়। নিজেকে তখন সে শোয়ায়- জোছনায়, শিশিরে, মৃদু হাওয়ায়, সে নিজেকে নিবারণ করে। নিজের স্ফীত উদরের ওপর ভারি ধীরে হাত বোলায় সে। জোছনা ঝরুক এইখানে- মনে-মনে জোছনাকে সে ডাকে। তার মনে হয়, তার উদর আলোকিত হচ্ছে জোছনাধারায়— চুঁইয়ে চুঁইয়ে ঢুকছে ত্বকের ভেতরে দিয়ে, পেশির ভেতরে দিয়ে একেবারে জরায়ুতে- সেখানে তার ছেলের মুখ ধুইয়ে দিচ্ছে জোছনার আলো। সে একবার বুকের ওপর হাত রাখে, স্তন স্পর্শ করে শিশিরকে ডাকে- শিশির ঝরুক এইখানে- শিশির পান করে স্তন আরো আরো পরিপূর্ণ হোক, কারণ তার ছেলে এই স্তন চুষবে। সে দুবাহুর দিকে তাকায়- এই বাহুতে হাওয়া লাগুক – হাওয়ার সজীবতা বাহুতে শক্তি দিক- কারণ বাহুদুটি তার ছেলেকে ধারণ করবে।

এইরকম হাওয়ায়, শিশিরে, জোছনায় রাখী অনেকক্ষণ ধরে মেশে- তারপর মন ভ’রে গেলে, যখন আর কিছু বলার থাকে না, তখন ছাদ থেকে নিচে নেমে আসে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *