ত্রয়ী উপন্যাস -প্ৰথম পৰ্ব
ত্রয়ী উপন্যাস - দ্বিতীয় পৰ্ব
ত্রয়ী উপন্যাস - তৃতীয় পৰ্ব

দক্ষিণায়নের দিন – ১৭

সতেরো

পারভিন বাইরের কথা বলে, কেননা বাইরের জগতে সে প্রায় ঝাঁপ দিয়ে পড়েছে। একেক দিন সকালে বার হয়, ফেরে সেই সন্ধ্যাবেলা। কোনোদিন শোনে, আজ কোথায় ফাংশন ছিল— শোনে, কোনোদিন কোথায় নাকি নাটকের রিহার্সাল ছিল, কোনোদিন আবার শোনে, কোথায় পার্টি ছিল।

বুলু প্রথম থেকেই পারভিনের এই পরিবর্তন লক্ষ করে আসছে। ওর মধ্যেকার সেই হালকা ছেলেমানুষি ভাবটা আর দেখা যায় না। পোশাকে আশাকে, কথায় বার্তায় পারভিন এখন একেবারেই অন্য মেয়ে।

একদিন দেখা গেল, পারভিন হাসানের গাড়িতে বাসায় ফিরছে। বুলু বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল।

হাসান পরের দিন সকালে জানাল, আজ বিকেলে চায়ের দাওয়াত, তৈরি থেকো, যেতে হবে।

বিকেলে যখন বুলু গাড়িতে উঠতে যাবে, দেখল পারভিন সঙ্গে যাচ্ছে।

কিছু বলেনি। বলতে ইচ্ছে হয়নি। পারভিন পেছনের আসনে বসেছিল। তবু বুলু স্বচ্ছন্দ হতে পারেনি। বাইরের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ বসে থাকল সারাটা পথ।

গ্রিয়ার্সন কোম্পানির বড়কর্তা এসেছেন। কোম্পানি তাই চায়ের আয়োজন করেছে। শাহবাগের লনে সবুজ ঘাসের ওপর টেবিল পাতা হয়েছে। স্থানীয় ঠিকাদাররা সবাই উপস্থিত। ডেল্টা কোম্পানির মাতব্বর কয়েকজনকে দেখা গেল হেসে হেসে কথা বলছে। মিস ইভান্সের পরনে আজ শাড়ি। মেয়েটা পোশাকে, স্বাস্থ্যে আর গয়নায় ঝলমল করছে। আরো কয়েকটি মেয়েকে দেখা গেল। সবাই পারভিনের পরিচিত, পারভিনের সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলতে লাগল তারা। একবার এদিক ফিরে পারভিন বলল, আসুন পরিচয় করিয়ে দিই, ইনি আমার বোন, মিসেস বিলকিস হাসান।

বুলু সবার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল। দুএকজনের সঙ্গে কথাবার্তাও হল। ওদের আলাপের বিষয় মূলত ব্যবসা। তবে থেকে-থেকেই ঐ আলাপ কখনো রাজনীতি, কখনো ফিলিম, কখনো পরচর্চার মধ্যেও গিয়ে পড়ছিল। এমনি সময় হাসান পারভিনকে ডেকে নিয়ে গেল একপাশে, তারপর কী যেন কানে কানে বলল। আর তারপরই দেখা গেল পারভিন আরো দুটি মেয়েকে জুটিয়ে মিস ইভান্সের সঙ্গে আলাপ করছে। কী আলাপ হল কে জানে, তারপর ক’জনা আবার মেয়েদের জটলার মধ্যেই ফিরে এল।

একজন অবাঙালি ভদ্রলোককে বেশ কাছাকাছি দেখল বুলু। ভদ্রলোক ভারী ভাবী বলে সম্বোধন করলেন। বাংলা ইংরেজি উর্দু মিশিয়ে আলাপ করতে চাইলেন। বুলু মোটে চিনতেই পারে না। পরে রাখীর নাম করাতে বুঝল, ইনি সেই মাজহার সাহেব, রাখীর অফিসের বস। মাজহার বেশ লোক। বলেন, আমি ঠিক যেমনটি আপনার চেহারা কল্পনা করেছিলাম, ঠিক তেমনি আপনি। যদি আমার ভাষা জানতেন তাহলে আমি একটা ‘শের’ আবৃত্তি করতাম। আপনাকে কিন্তু বাঙালি মেয়ে বলে মনেই হয় না। বাহ্ কেন? বুলু না হেসে পারেনি।

না মানে, বাঙালি মেয়েরা তো আজকাল বাইরে বেরুচ্ছে, ওরা ঠিক নিজেদের ব্যক্তিত্বকে ধরে রাখতে পারে না। আপনার মতো রিজার্ভড নয় কেউ, দেখুন না ওদিকে।

মাজহার মেয়েদের জটলাটার দিকে ইঙ্গিত করল।

আমি কিন্তু একদিন আপনার বাড়িতে যাব, হাসান কোনোদিন ডাকল না আর রোকেয়া তো অফিসিয়াল কথাবার্তা ছাড়া অন্য কথা বলেই না, তাই নিজেই বলছি।

বুলু বিব্রত বোধ করে, ছি ছি হাসানের এ ভীষণ অন্যায়। কিন্তু মুখে কিছু বলল না। বলল, আসবেন আপনি, আমি আপনাকে দাওয়াত দিচ্ছি।

ডিসেম্বরের হাওয়া বইছে, দেখতে দেখতে বেলা শেষ। বাইরে কেমন বিষণ্ণ সন্ধ্যা! হাসান এইসময় বুলুর কাছে উঠে এল, চলো এবার ফিরি, আমাকে আবার এক্ষুনি বেরুতে হবে।

সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠল দুজনে। বুলুর একবার ইচ্ছে হয়েছিল জিজ্ঞেস করে, পারভিন কখন ফিরবে? কিন্তু কথাটা তখন কেমন শোনাবে ভেবে গেল না, তাই জিজ্ঞেসও করা হল না।

বুলুকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়েই আবার বেরিয়ে গেল হাসান। খাওয়াদাওয়া শেষ হবার পর বুলু চুপচাপ বারান্দায় দাঁড়াল। রাখী না-খেয়ে শুয়ে পড়েছে। রাখী আজ অদ্ভুত গম্ভীর। আব্বা খাওয়ার টেবিলে বসেছিলেন শুধু। রাখীকে দেরিতে ফিরতে দেখে মুখের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, এত রাত করিস কেন? শুধু এই একটি মাত্ৰ কথা।

রাখীর যে কী হয়েছে, কোনো কথাই বলেনি সে। একটু পর ঘরের বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়েছে।

নিঃশব্দ তারা-জ্বলা আকাশের দিকে তাকিয়ে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল জানে না, একসময় নিচে গাড়ি থামার শব্দ শুনল। তারপরই পারভিনের গলা শোনা গেল। হ্যাঁ-হ্যাঁ-ম্যাকফার্সন রাজি হয়েছে, চন্দনাই শেষপর্যন্ত ম্যানেজ করল।

মেয়েটা বেশ কাজের।

গাড়িটা গ্যারেজে তুলে গেট বন্ধ করতে করতে কথা হচ্ছিল, ওদের কথা বারান্দায় দাঁড়িয়ে বুলু শুনতে পাচ্ছিল। একসময় পারভিন বলল, চন্দনার গান শুনে তো সাহেব মহাখুশি। কিন্তু মুশকিলে ফেলল কোথায় জানেন? আমাকে ধরে বসল, এখানে সে নাকি একা, টেরিলি লোনসাম, ট্যাগোর পড়তে চায়— আমি যদি সাহায্য করি।

তারপর?

শেষে সামনে পরীক্ষা বলে পাশ কাটালাম অতিকষ্টে। কিন্তু তবু কি ছাড়ে? শেষে চন্দনার সঙ্গে কথা হবার পর তবে ছাড়ল। চন্দনা নিশ্চয়ই ফ্যালনা নয়। আপনার কিন্তু ওদের দুবোনকে খুশি করে দেওয়া উচিত।

বাহ্, তোমাদের ক্লাবের জন্য টাকা পাওনি? তাছাড়া চন্দনা যে গত মাসে এক হাজার টাকার একটা নেকলেস নিয়ে গেল।

কথা বলতে বলতে ওরা বারান্দা পার হল, তারপর সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠল।

বুলু দেখতে পেল না। বারান্দায় এ কোণ থেকে সিঁড়ির মুখ দেখা যায় না। তবুও বোঝা গেল, হাসান অন্ধকার ঘরের মধ্যে গিয়ে ঢুকছে। পারভিন চলে গেছে নিজের ঘরে। হাসানের ভারী নিশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে, সম্ভবত কাপড় পাল্টাচ্ছে। এবার হাতমুখ ধুয়ে বিছানায় শোবে।

বুলু ঘরে ঢুকতেই হাসান শুধাল, সে কী, এখনো তুমি ঘুমোওনি?

না ঘুম আসছে না।

একটু থেমে আবার বলল বুলু, তোমাদের গোলমাল মিটল?

কিসের গোলমাল? হাসান একদম বুঝতে পারে না। ভাবতেও পারে না বুলু তার ব্যবসার বিষয়ে কোনো কথা বলবে কখনো। শুধাল, কোন্ গোলমালের কথা বলছ?

কেন, সেই যে গ্রিয়ার্সনের বড়কর্তাকে তুষ্ট করার ব্যাপারটা?

অন্ধকারে হাসানের ভ্রূ কুঁচকে উঠল। বুলুর গলায় কি বিদ্রূপ শোনা যাচ্ছে? সে শান্তস্বরে বলল, হ্যাঁ মোটামুটি একটা চেষ্টা হয়েছে, দেখা যাক কী হয়। যদি গ্রিয়ার্সন কোম্পানি ডেল্টার সঙ্গে কাজ করতে চায়, তাহলে তো যশোরের নতুন টেক্সটাইল মিলের যাবতীয় কাজ আমরাই নিতে পারি। তারপর যদি হায়দার সন্স দলে আসে, তাহলে ইসলামাবাদের নতুন রাজধানীর কাজগুলোও কিছু কিছু পাব। জোর পাঁচ বছর-তারপরই দেখো—

হাসান স্বপ্ন দেখছে যেন, উৎসাহভরে নিজের স্বপ্নের কথা বলে যাচ্ছে। কার কাছে বলছে, সে খেয়ালটুকু পর্যন্ত নেই। বুলু স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে শুনল কিছুক্ষণ, তারপর আবার বাইরের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল।

শেষে পায়ে পায়ে হেঁটে গেল পারভিনের ঘরের দিকে। পারভিন কাপড় বদলে হাতমুখ ধুয়ে খাটে বসেছে সবে। পাশের খাটে রাখী শুয়ে ঘুমোচ্ছে। ঘরে নীল আলোয় মুখ স্পষ্ট দেখা যায় না। তবু রাখীর দিকে তাকিয়ে খারাপ লাগল পারভিনের। রাখী আপা কীরকম ম্লান হয়ে যাচ্ছে দিনে দিনে। কীরকম অসহায়ের মতন দেখায় আজকাল। সবাই বলে রাখী আপা নাকি ভারি শক্ত মেয়ে। কিন্তু এই কি শক্ত মেয়ের চেহারা? হাসান ভাই বলে, রাখী আপা নাকি নিজের ভালো বোঝে না, অযথা বাজে সেন্টিমেন্ট নিয়ে মাথা খারাপ করে। বুবু নাকি অমনি। পারভিন বুঝতে পারে না এদের। কে জানে, কী ভাবে এরা। ভালো পয়সাওয়ালা পাত্রকে কোনো মেয়ের কেন পছন্দ হবে না- ভেবে পায় না সে। মানুষকে নিশ্চিন্ত হতে হবে তো। জীবনে সুখে থাকতে কে না চায়?

মাজহার না হোক, অমন কোনো মানুষ যদি পারভিনের কাছে এসে দাঁড়াত, তাহলে সে ফেরাত না। অমন বোকামির সত্যিই কোনো মানে হয় না। সে যাবে একদিন রাখী আপার অফিসে, তাদের ফ্রি রোলার ক্লাসের জন্য চাঁদা চাইতে। হাসান ভাই নাদভীর কথা বলেছে, এবার করাচি থেকে এলে নাকি আলাপ করিয়ে দেবে। কিন্তু তার আগেই সে একাকী গিয়ে আলাপ করতে চায়। দরকার হলে রাখী আপাকে লুকিয়ে যাবে। হাসান ভাইয়ের দিক থেকে তো অফার রয়েছেই- নাদভীকে যদি পার্টনার করে নিতে পারে কেউ, তাহলে তার জন্যে বড় প্রাইজ দিতে ডেল্টা তৈরি।

ঘড়ির দিকে তাকাল। বাতির আলোয় কেমন ঝিমুনি ভাব। রাত একটা, নাহ্ এবার ঘুমোনো দরকার। ঠিক সেই সময় বাইরে বুবুর গলা, পারভিন ঘুমোলি?

দরজা খুলতেই বুলু ডাকল, এদিকে আয়।

পারভিন বারান্দায় এসে রেলিঙের ধার ঘেঁষে হেলান দিয়ে মুখোমুখি দাঁড়াল। কিছু বলবে? শান্তস্বরে জিজ্ঞেস করে পারভিন।

হ্যাঁ, ভাবছি একটা কথা বলা দরকার তোকে।

পারভিন মুখোমুখি তাকাল। অন্ধকারে মুখ দেখা যায় না। তবু বুঝল, কোনোদিন যা বলেনি, আজ বুবু তাই বলতে চায়।

শোন্, বুবু আরম্ভ করে, কিছুদিন ধরেই দেখছি, তুই বড্ড বাইরে বাইরে ঘুরছিস। পড়াশোনা কেমন হচ্ছে তুইই জানিস। কিন্তু ভবিষ্যতের কথাটা ভাবা দরকার। মামানি বড় কষ্টে তোদের মানুষ করেছেন। তার কথা একটু ভাবিস। মেয়েদের জীবন নিয়ে এমনিতেই বড় জ্বালা।

পারভিন অনুমান করতে চেষ্টা করে, কিন্তু পারে না— কোন্ কথা বলতে চাইছে বুবু। এত রাতে বিছানা থেকে তুলে এনে বলবার কথা কি এইসব? কিছু বুঝতে না পেরে বলে, বুবু কী হয়েছে খুলে বলো, আমার সম্বন্ধে কী শুনেছ তুমি?

বুলু বলতে গিয়েও থামল। না, বলতে পারে না সে কী বলবে? যে কথা বলতে চায়, সে যে বড় লজ্জার। কেমন করে বলবে, তুমি আমার স্বামীর কাছ থেকে দূরে থেকো- কেমন করে বলবে, টাকার লোভ কোরো না, টাকার লোভ বড় সর্বনেশে। বুলুর মুখ দিয়ে আর কথা বার হয় না। কেবলি মনে হয়- আসলেই ঈর্ষা কাজ করছে তার মনের ভেতরে। এসব এ কথা বলে কি সে পারভিনের কাছে ভিক্ষে চাইতে এসেছে?

বলতে হল তবু। বলল, বাইরে হৈচৈ নিয়ে বড়বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছিস। আগে পড়াশোনা শেষ কর্, তারপর যা হয় করিস, এখন বাইরে ঘোরাঘুরিটা কমা। মামানি কত আশা করে আছেন।

কিছুক্ষণ পর বুলু চলে গেলে পারভিন আবার নিজের বিছানায় ফিরে এল। মনে হল, কেমন অস্পষ্ট, একটা জটিলতার দিকে পা বাড়িয়েছে সে। আর তাই বোধহয় বুবু তাকে সাবধান করে দিতে এসেছিল। নাকি বুবুর অন্যকিছু ধারণা ছিল? সেই ধারণার বশে ঈর্ষায় অস্থির হয়ে তাকে আঘাত করতে এসেছিল? কে জানে, তার বুঝে দরকার নেই অতসব। কিন্তু সে যে বাইরে ঘুরছে, এতে খারাপের কী হল? তার মনে প্রশ্ন জাগে। অনেক মেয়েই তো আজকাল বাইরে বাইরে ঘোরে। রাখী আপাই বা কতক্ষণ বাসায় থাকে? পারভিন মনে-মনে ঠিক করল- না, সে অত লক্ষ্মী মেয়েটি হতে পারবে না। তাকে নিজের ভবিষ্যৎ তৈরি করে নিতে হবে। পরীক্ষা পাস হলে হবে, না হলেও খুব কিছু এসে যায় না। শুধু পরীক্ষা পাস করে কেউ ভালো ক্যারিয়ার বানাতে পারে না কখনো। তাছাড়া সে নিজেই তো জানে, জীবনের শত ঐশ্বর্য যে বাইরেই ছড়ানো থাকে— তা খুঁজে আনতে হয়, আহরণ করতে হয়। সে বারবার নিজেকে শোনাল, বুবু যা-ই বলুক, লক্ষ্মী মেয়েটি হলে তার চলবে না।

বুবু কিচ্ছু বোঝে না, হাসান ভাইয়ের কথাই ঠিক, বুবু একেবারেই সেকেলে মানুষ। জীবন যে বদলে যাচ্ছে, মানুষ যে বদলে যাচ্ছে— সেই পরিবর্তনটা সহজভাবে মেনে নিতে পারছে না এরা। পারভিনের মনে নানা চিন্তা হয়।

.

পরিবর্তন কি এইভাবেই আসে? কই বাইরে তো কিছু বদলায়নি? মানুষ তো তেমনি আছে। পোশাক-আশাক, চলনে-বলনে সেই তেমনি রয়েছে। কিছু ইস্কুল-কলেজ বেড়েছে, নতুন দালান-কোঠা উঠেছে, কিন্তু মানুষের জীবন? সে তো সেই তেমনি। আগের মতোই সাংসারিক অভ্যাসের শিকলে বাঁধা, আগের মতোই ভবিষ্যতের কথা ভেবে স্বপ্ন দেখছে, ছেলেমেয়ে জন্ম দিচ্ছে, মানুষ করছে এবং মরে যাচ্ছে।

তবু মনে হয়, আসছে সেই পরিবর্তনটা। নদীর স্রোতের মধ্যে যেমন বন্যার পানি ধীরে ধীরে এসে মিশতে থাকে, তেমনি। ধীরে ধীরে এসে মিশতে মিশতে একসময় সমস্ত পানির স্রোতকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে একাকার করে দেবে। মনি বিশ্বাসের কথা বলত, তখন বুঝতে পারেননি। এখন মনে হয়, কিছুটা যেন বুঝতে পারছেন। আসলে মনি তার ধারণাগুলো মেলাতে পারছিল না। তার চিন্তা-ভাবনা, ভালো লাগা, মন্দ লাগা সবকিছুর সঙ্গে একটু একটু করে গরমিল শুরু হয়েছিল, ঐ গরমিলের ফাঁকে ফাঁকে এসে ঢুকছিল অবিশ্বাস আর সন্দেহ। শেষে একদিন ঐ অবিশ্বাস আর সন্দেহই প্রবল হয় আর সবকিছু উপরে ফেলে দিল। ঠিক ঐ ব্যাপারটাই যেন হতে চলেছে।

অনেক নিগূঢ়ে ভান শুরু হয়েছে, একটু একটু করে ক্ষয়ে যাচ্ছে, ভেঙে যাচ্ছে, যা একদা দেখেছিলেন তা থাকছে না। ভেবেছিলেন ছেলেমেয়েদের সুখী করবেন, কিন্তু অন্যরকম ঘটনা ঘটে গেল। মনি চলে গেল, বুলু তো থেকেও নেই, রাখীকেও একেক দিন দেখে যেন চিনতে পারেন না। তার রাগ হয় তখন। নিজের উপর, বুলুর ওপর, রাখীর ওপর। ভাবেন, সবাই সহ্য করছে কেন? কেন সবাই মিলে চিৎকার করে উঠছে না। যা একটু একটু করে বেড়াজালের মতো গুটিয়ে আছে, তা ছিঁড়ে বেরুবার জন্যে কেন উদ্যোগ নেয় না কেউ, কেন চিৎকার করে প্রতিবাদ করে না?

রাশেদ সাহেব এইসব ভাবনায় মাঝে মাঝে অস্থির হয়ে পড়েন। ঘরে থাকতে পারেন না একেক দিন। পরে আবার ঐসব চিন্তার কথা ভেবে হাসি পায় তার। কী লাভ এসব ভাবনায়, কেউ তো শুনতে আসছে না তার এইসব ভাবনাচিন্তার কথা। এলোমেলো ঘুরতে ঘুরতে মন থিতিয়ে আসে একসময়। আর তখন দারুণ নিঃসঙ্গ বোধ করেন।

তবে রাখীর জন্যে চিন্তাটা ঘুরেফিরেই আসে। কেবলি মনে হয়, রাখীও কি তাহলে এই সর্বনাশা স্রোতের মাঝখানে গিয়ে পড়েছে। সেও কি মনির মতো দিশেহারা হয়ে যাচ্ছে, তারও কি বিশ্বাস হারাতে বসেছে?

সেদিন বড় ক্লান্ত হয়ে রেস্তরাঁতে বসেছেন, এক কাপ চা খাবেন। কোণের একেবারে এককোণে তার টেবিল। পাশেই জানালা। বাইরে তখন সবে বিকেল। একসময় হঠাৎ দেখলেন রাখী এক ভদ্রলোকের সঙ্গে রেস্তরাঁতে ঢুকল। রাশেদ সাহেব ভালো করে দেখলেন ভদ্রলোককে। অনুমান করলেন, এ-ই হয়তোবা মাজহার সাহেব। রাখীর অফিসের ম্যানেজার। হাসান এরই নাম বলেছিল সেদিন।

দেখলেন, মাজহার রাখীর দিকে ঝুঁকে কিছু বলছে। রাখীর মুখ দেয়ালের দিকে আড়াল করা।

রাশেদ সাহেব তাড়াতাড়ি চা খেয়ে বেরিয়ে পড়লেন। রাখী তাঁকে দেখলে নিশ্চয়ই বিব্রতবোধ করবে। রাস্তার ফুটপাত ধরে হাঁটলেন কিছুক্ষণ। তারপর একবার দাঁড়ালেন, একটু অপেক্ষা করতে ইচ্ছে হল, রাখীর অফিস ছুটি হয়েছে— একসঙ্গে দুজনে বাড়ি ফিরবেন।

কিন্তু এক ঘণ্টা পার হবার পরও রাখী বেরুল না দেখে ফিরলেন। ফিরলেন মনের মধ্যে বিশ্রী একটা ভাব নিয়ে। একটা বাজে আশঙ্কায় তার মনে ছেয়ে গেল। রাখীও কি তাহলে একই স্রোতে গা ভাসিয়েছে? হাসানের মতো সে-ও লোভ আর উৎক্ষিপ্ততার ঘূর্ণিতে গিয়ে পড়েছে। ভাবলেন, একবার জিজ্ঞেস করবেন, রাখী কী ভাবছে নিজের সম্বন্ধে আজকাল। রাখীকে বলবেন, একটা কিছু করুক ও। যদি বিয়ে করার ইচ্ছে থাকে, তবে তা-ই করুক। আর না, অনেক হেরেছেন তিনি। জিততে না পারুন, আর হারতে চান না।

কিন্তু হারবে কে, রাখী না অন্য কেউ?

রেস্তরাঁ থেকে বেরিয়ে মাজহারের কাছ থেকে বিদায় নিল, বিদায় নেবার পর হেঁটে আসতে আসতে রাখী ভাবল। অনেকক্ষণ আজ আটকে রেখেছিল মাজহার। মিস মরিসের কথা, হাসান ভাইয়ের কথা, ব্যবসার কথা— এইসব অনেকক্ষণ ধরে চলেছে। আর সবার শেষে বলেছে— রোকেয়া, তুমি হ্যাঁ অথবা না একটা কিছু বলো। আমি হাসানের কাছে কিছু শুনেছি। আমি হয়তো হেরে যাব, কিন্তু কার কাছে হারছি সেটা খোলাখুলিভাবে জানতে চাই।

রাখীর খারাপ লাগছিল তখন। অপমানে নয়, রাগে নয়, ব্রিতও হচ্ছিল না রাখী। তার শুধু শুধু খারাপ লাগছিল ঐসময়।

মাজহারের কথায় ভারি মাকদতা। তার দুচোখে সাউথ সি আইল্যান্ডের নারিকেল বীথির ছায়া, গলার স্বরে বালুবেলায় আছড়ানো ঢেউয়ের আঘাত, আর আবেগে ফসফরাস জ্বলা অন্ধকারে মারমেইডদের লীলাবিলাসের ভারী নিশ্বাস। রাখী ভেবে পায় না, মানুষ অমন সাজানো কথা কেমন করে বলতে পারে, যে কথা শুনলে শরীর শিরশির করে ওঠে।

কথা তো নয়, যেন কবিতা। মাজহার কবিতার মতো করে কথা বলছিল। আর রাখীকে মাথা নিচু করে তাই শুনতে হচ্ছিল অনেকক্ষণ। সে কিছু বলতে পারেনি। কী বলবে সে? তাকে নিয়ে কী করতে চায় মাজহার? কিসের জন্য এমন করে কাছে পেতে চায়, কেন এমন অস্থির হয়ে ওঠে? বিবাহেই কি পরম শান্তি, তার শরীরটাই কি একমাত্র লোভনীয় বস্তু?

রাখী বোঝে না, তারও চোখে স্বপ্ন ঘনায় না কেন। সবার জীবনে তাই কি হয় না? সম্পদ আর সুখের আশ্বাসে সব মেয়ের চোখেই কি স্বপ্ন ঘনায় না? কিন্তু তার বেলাতে এমন হয় কেন? এরকম অবিশ্বাস আর সংশয়? কোনোকিছু পাওয়ার ব্যাপার হলেই কেন এরকম হয়ে যাচ্ছে তার মন? অথচ জানে, সবল সমৃদ্ধ পুরুষমানুষকে ভালোবাসা, তাকে বিয়ে করা, তার কাছে দেহমন নিঃশেষে সমর্পণ করা— এর চাইতে অন্যকিছু মেয়েদের চাওয়ার থাকে না। সুখে সম্পদে প্রাচুর্যে দেহের যৌবনকে উপভোগ্য করে তুলতে চাওয়া ছাড়া মেয়েদের অন্যকিছু কি সত্যিকারভাবে চাইবার আছে? এ ছাড়া অন্যকিছুর জন্যে তো কেউ স্বামী খোঁজে না, কারো সংসার দরকার হয় না।

জামানও কি ঐভাবেই তাকে টানে না? ঐ সম্ভোগ এবং সমৃদ্ধির হাতছানি ছাড়া জামানের আর অন্যকিছু কী দেবার আছে? তার দুচোখের মিনতিতে তো ঐ একই কথা। বরং মাজহার বলিষ্ঠ, তার দুচোখের ভেতরে তৃষ্ণা হা হা করে। ঐ দৃষ্টির সামনে দাঁড়ালে বুকের ভেতরে ভয় শিউরে ওঠে। রিশাল শক্তিমান পৌরুষের এইরকম সর্বগ্রাসী আকর্ষণ রাখীকে বিচলিত করে দেয়।

জামানকে মনে পড়ে তখন, আহা কেউ নেই তার, এত একা সে— কেমন অসহায় শিশুর মতো। তার পয়সার ঝনৎকার নেই, তার দুচোখে সাউথ সি আইল্যান্ডের কোকোনাট গ্রোভের সবুজ হাতছানি নেই, সমুদ্রের নীলপানির নিচে রক্তিম কোরালের আমন্ত্রণ সেখানে দেখা যায় না। জামানকে তুলনায় অনেক কাছের, অনেক বেশি চেনা মানুষ মনে হয়।

রাখী বোঝে না এমন নয়। বোঝে, জামানও বড়বেশি স্বপ্ন দেখে। ওর পোশাকের জাঁকজমক, ভবিষ্যতে বড় হবার অ্যাম্বিশন, ওর ভালোবাসা- সবই কেমন ছেলেমানুষিতে ভর্তি। বাচ্চাছেলেদের যেমন দিশেহারা ভাব থাকে, জামানেরও তেমনি একটা ভাব আছে। তাই জামান মাজহারের মতো নয়, মাজহার জামানের মতো নয়।

রাখী সারাটা পথ মনের ভেতরে একটা তোলপাড় অনুভব করল। কেবলি মনে হচ্ছিল, কেন আজ মাজহারের সঙ্গে রেস্তরাঁয় বসতে গেলাম আমি? না গেলে কী হত?

একসময় রাখী রিকশয় চেপে জামানের বাসার দিকে চলল। এই যাওয়া অপরাধবোধ থেকে, না অন্য কোনো আকর্ষণের জন্যে, বলতে পারে না। শহীদ মিনারের কাছাকাছি পৌঁছে তার খারাপ লাগল। না, জামানের কাছে যাবে না সে। নিজেকে জিজ্ঞেস করল, তুই কি নার্গিসের মতো হয়ে যাচ্ছিস রাখী? পুরুষমানুষের সঙ্গ না হলে কি তোর একবারেই চলছে না? রাখী মেডিক্যাল কলেজের পেছনের গেটের কাছে নেমে পড়ল। এখন বরং সুমির কাছে যেতে পারে সে। কিন্তু দেখা গেল, সুমি নেই। তখন ভীষণ ক্লান্ত হয়ে সে বাসায় ফিরল। বাসায় ফিরে দেখে, জামান বসবার ঘরে বসে আছে।

ক্লান্তির মধ্যেই রাখী হাসল। জিজ্ঞেস করল, কখন এসেছ?

অনেকক্ষণ, জামান হাসতে চেষ্টা করে। বলে, তোমার অফিসে কাজ বেড়েছে বোধ হয়।

হ্যাঁ, ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে আজকাল, তুমি বসো।

রাখী ভেতরের দিকে যাচ্ছিল, জামান ডাকল, শোনো, একটা কথা ছিল। জামানের দুচোখে দিশেহারা ভাব। রাখীর মুখের দিকে পরম আশায় তাকিয়ে আছে তখন সে। রাখী, চাকরি বাঁচাতে গিয়ে একটা খারাপ কাজ করে ফেলেছি আমি।

রাখী মনোযোগ দিল জামানের কথায়!

য়ুনিভার্সিটির কর্তাদের সঙ্গে টিচারদের একটা গোলমাল ছিল তা তো জানো। ক’দিন আগে সিনিয়র টিচার মাহমুদ সাহেবকে মারধোর করানো হয় কয়েকটি গুণ্ডা টাইপের ছাত্রকে দিয়ে। সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ হয়েছিল টিচারদের। বিবৃতিতে আমিও সই করেছিলাম। সরকারপক্ষের মাতব্বররা আজ ডেকে ভয় দেখাল আর তাতে আমরা ক’জনা পাল্টা বিবৃতিতে সই দিয়ে ফেললাম। আমি দিতাম না হয়তো, কিন্তু যারা ছিল সবাই সাইন করাতে আমি ভাববার আর অবসর পেলাম না- সাইন করে ফেললাম। তারপর থেকেই আমার ভীষণ খারাপ লাগছে।

রাখী কথা বলল না। সে শুনছে তখনো।

জামান অনেকক্ষণ ধরে নানান কথা বলে তার কথা শেষ করল। বলল, এইরকম ভয় আর অপমান, এর সঙ্গে আপোষ করা, এ যে কী অসহায় লাগে, যদি জানতে! ভাবছি, চাকরিটা ছেড়ে দেব।

রাখী তখনো জামানকে দেখছে। লোকটা ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে আছে। রাখীর কাছে জানতে চায় যে এখন তার কী করা উচিত। তার পাপবোধ তাকে রাখীর কাছে তাড়িয়ে নিয়ে এসেছে।

রাখীকে শেষপর্যন্ত হাসতে হল। বলল, যা হবার হয়ে গেছে, ও নিয়ে এখন আর ভেবে লাভ কী? আজকাল সব চাকরিতেই ঐরকম আপোষ করতে হয়। এসব ভেবে মাথা খারাপ না করে- দ্যাখো, কী হয় শেষপর্যন্ত। আমার খুব খারাপ লাগছে রাখী, ইচ্ছে হচ্ছে, সব ছেড়ে দিয়ে চলে যাই কোথাও।

রাখী যেন ভাবল দুমুহূর্ত। তারপর বলল, বেশ তো যাও না, ছুটি নিয়ে কোথাও ঘুরে এসো দুদিন- তোমার ছুটি পাওনা নেই?

রাখী উঠছিল, এমন সময় বুবু ঘরে এসে বসল মোড়া টেনে। জামানকে দেখে বিচিত্র হাসল একটুখানি। তারপর বলল, কত দিন পর এলেন, আসেন না কেন? এলেই তো পারেন।

জামানকে বিদায় দিতে গেল রাখী। গেট পার হবার আগে জামান ঘুরে দাঁড়ায়, তাহলে আমাকে বাইরে যেতে বলছ তুমি?

হ্যাঁ নিশ্চয়ই, রাখী সহজ ভঙ্গিতে বলে, এখানে এত ঝামেলা চারদিকে। বাইরে গেলে নিশ্চয়ই ভালো লাগবে তোমার।

কিন্তু, আমি কী ভেবেছিলাম জানো? রাখী দেখে, জামানের মুখের ভাব বদলে গেছে তখন, ভারি করুণ দেখাচ্ছে। সে শুনল, আমি ভেবেছিলাম, তুমি আমাকে ঢাকার বাইরে যেতে দেবে না, তুমি যেখানে নেই সেখানে — রাখী ভয়ানক বিব্রত বোধ করে। কী বলবে ভেবে পায় না। সে কিছু বলার আগেই জামান বলে ওঠে, ঠিক আছে, এখন চলি, দেখি যদি প্লেনের টিকিট পাই।

একটু থেমে আবার বলে, তুমি আমার ওখানে কাল একবার আসবে? অনেক কথা বলার আছে, আসবে তো কাল সকালে?

সন্ধ্যার অন্ধকার, তবু মনে হয়, জামানের দুচোখে আকুতি করুণ আর ম্লান হয়ে আছে।

ঘরে এসে হাঁফ ছাড়ে রাখী। জামান আসলে ভারি দুর্বল। চাকরি খোয়াবার আশঙ্কায় মাথা ঠিক রাখতে পারছে না। এ লোককে নিয়ে কিন্তু কপালে তোর দুঃখ আছে রাখী- একবার নিজেকে সে শোনায়। হারিয়ে-যাওয়া বাচ্চার মতো মুখের ভাব হয়েছিল জামানের, রাখী জামানের ঐ মুখ স্মরণ করে হাসে আপন মনে। এইরকম একটা লোক- অথচ কত কিছুই না মনে হত। তবু শেষপর্যন্ত রাখীর মনে হয়, চাকরি হারাবার ভয়ে জামান যা করেছে তা অতি সামান্য ব্যাপার- লোকে এর চাইতে কত বেশি খারাপ কাজ করে। জামানের সত্যি তো কোনো দোষ নেই। মানুষ ভয় পেয়ে গেলে আর কিছু কি করার থাকে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *