ত্রয়ী উপন্যাস -প্ৰথম পৰ্ব
ত্রয়ী উপন্যাস - দ্বিতীয় পৰ্ব
ত্রয়ী উপন্যাস - তৃতীয় পৰ্ব

পূর্বরাত্রি পূর্বদিন – ১০

দশ

তাহলে ফিরলি তুই? সুমি, ঘুরেফিরে ঐ এক কথা বলে। আমি তোর চিন্তায় এমন অস্থির হয়ে উঠেছিলাম না, যে বলার কথা নয়। ভয় হচ্ছিল, এবারও তুই একটা ধাক্কা খাবি। যাক, বাঁচালি, এখন বাপু ঘরের মেয়ে ঘরে গিয়ে থাকো।

ওখানে কিন্তু আমি খুব ভালো ছিলাম।

হুঁ, তার নমুনা তো দেখতেই পাচ্ছি- যা এক ঘাটের মড়া বয়ে নিয়ে এলি। আচ্ছা, তোর শিক্ষা হয়নি এখনো?

রাখী জবাব দিতে পারে না। বলে, সুমি অন্য কথা বল্। আমার যে কী হয়েছে, আমি এখনো তো নিজেই জানি না।

কেন, কিছু হয়নি তোর? সুমি ঘুরে দাঁড়ায়।

রাখী সোজাসুজি তাকাতে পারে না। বলে, সেজানকে সেজান বলে ডাকি, তুমি বলি, এতেই যদি কিছু হওয়া বলে তো হয়েছে— ঐ ডাকাডাকিতে কিছু প্রমাণ হয়, বল্?

সুমির বোধহয় রাগ হয়। বলে, রাখী তুই অমন উকিলি কথা বকিস না আমার কাছে। তোর কী হয়েছে সেটা কি মুখে বললে তবে বুঝব? আমি মেয়ে না?

রাখী ধরা পড়ে হেসে পাশ কাটাতে চায়। বলে, তুই মেয়ে বুঝি? আমি তো জানতাম তুই শুধুই ডাক্তার।

আব্বা ছিলেন না, সন্ধ্যাবেলা রাখী যখন বাড়িতে ঢোকে। একটি মেয়েছেলে, সম্ভবত বাড়ির ঝি, তার মেয়ের চুল বেঁধে দিচ্ছিল। বাচ্চা মেয়েটা ছুটে গিয়ে আব্বাকে ডেকে আনল। কোথায়, রাখী মা কোথায়, বলতে বলতে আব্বা সিঁড়ি দিয়ে উঠে এলেন। উঠে এসেই মেয়েকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরলেন। আর তারপর তাঁর কী কান্না।

হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগলেন।

রাখী জানে না এ কোন্ চেহারা দেখছে জীবনের। আব্বার চুল একেবারেই শাদা। মুখের চেহারা ভাঙাচোরা। রাখী একবার আব্বার দিকে তাকায়। একবার বাড়িটার দিকে। বাড়িটা কী নির্জন! ওপরের ঘরগুলো অন্ধকার, নিচের ঘরগুলো অন্ধকার, লনটা অন্ধকার। রাখী তক্ষুনি বাল্‌ব কিনে আনাল। তারপর বাড়ির সবগুলো বাতি জ্বালিয়ে দিল।

ইতিমধ্যে রাশেদ সাহেব বেরিয়ে গেছেন আবার। একটু পরেই ফিরলেন। হাতে খাবারের প্যাকেট। রাখীর হাতমুখ ধোয়া হয়ে গিয়েছিল। খেতে বসে রাখীর চোখ কপালে ওঠে— এত কে খাবে? আব্বা বললেন, তুই খা মা, আমি দেখি।

ঐ কথায় রাখীর যে কী হল। আব্বার কোলে মুখ গুঁজে পড়ল সে। আর ফুলে ফুলে কাঁদল।

রাশেদ সাহেবের চোখের সামনে তখন সব যেন ভাসছে। তাঁর জীবনের যত সুখের ছবি, শান্তির ছবি। সব চলে গেছে তাঁর। সালমার জন্যে কান্না, মনির জন্যে কান্না, বুলুর জন্যে কান্না- সব কান্না তাঁকে ঘিরে রয়েছে— আর মাঝখানে তিনি আর তাঁর কোলে মুখ গুঁজে রাখী। রাশেদ সাহেব কাঁদলেন, হাসলেন, তারপর মেয়েকে দুহাতে তুলে ধরে বসালেন, খা মা, খেয়ে নে, কতদিন তুই আমার সামনে বসে খাসনি।

রাখী খাবে কী, তার বুকের ভেতর তখন গান বাজছে। বিষাদে কান্নায় হতাশায় করুণ— তবু গান। সে একটু কাবাব খেল, একটু মিষ্টি মুখে দিল, দুটো বিস্কুট কামড় দিল— তারপরই উঠে পড়ল।

রাখী তুই ছুটিতে এলি? এখন কিসের ছুটি?

আব্বার প্রশ্নের উত্তর সহসা দিতে পারে না, দু-মুহূর্ত ইতস্তত করে। তারপর বলে, না আব্বা- আমি চলে এসেছি একেবারে।

সে কী, কেন? রাশেদ সাহেবের গলায় ঈষৎ উদ্বেগ প্রকাশ পায়।

না, তেমন কিছু নয়- সেজানের খুব অসুখ, তাই ওর চিকিৎসার জন্যে আসতে হল— এখন হাসপাতালে থাকবে কিছুদিন।

রাশেদ সাহেব গম্ভীর হয়ে গেলেন মেয়ের কথা শুনে। রাখীর মুখে দিকে তাকিয়ে দেখছেন, আর ভাবছেন- এ কোন্ রাখী, রাখী তো এমন ছিল না। ঐ কথা সুমিতারও। সেও অবাক হয়, রাজনীতির আলোচনা হলে রাখী মনোযোগ দিয়ে শুনছে।

সুমিতার ঘরে রাজনীতির ছেলেমেয়েরা আসে, প্রায় সব গ্রুপের সঙ্গেই সুমিতার ভালো সম্পর্ক। সেদিন দুটি ছেলেতে তর্ক হচ্ছিল ছয়-দফা সমর্থন করা যায় কি যায় না, এই হল তর্কের বিষয়। মীজান বলে ছেলেটি বলছিল— এই প্রথম বাঙালিরা জাতীয় সত্তার ভিত্তিতে আন্দোলনে যাচ্ছে— এখন যদি সবাই এই আন্দোলনে শরিক না হয় তাহলে জাতির সঙ্গেই বিশ্বাসঘাতকতা করা হবে। আর অন্য ছেলেটি রঞ্জু বলছিল, জাতীয় সত্তা কথাটার মানে কী বল্? পাকিস্তানে অনেকগুলো জাতি আছে, তাদের বিকাশ দরকার এই তো? এইজন্যেই তো জাতিগুলোর, মানে পূর্ববাংলার বাঙালিদের সুদ্ধ আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রয়োজন। এই স্বায়ত্তশাসনের দাবি কি নতুন? ‘৫৭ সালে মওলানা ভাসানীর দাবিটা কী ছিল, স্বায়ত্তশাসন না? কিন্তু সেই দাবির বিরোধিতা কে করেছিল? তারপর আবার দ্যাখ্- জাতিসত্তার বিকাশের অপরিহার্য শর্ত কী? সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতা, ঠিক কি না বল? তো যারা ছয়-দফার আন্দোলনের ডাক দিচ্ছে, তাদের সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী কোনো ঐতিহ্য আছে? বরং সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতার বিরোধী হওয়াই তাদের বরাবরের চরিত্র।

মীজান মানতে চায় না। বলে, মওলানার ডাক অসময়ের ডাক- শেখ মুজিব ঠিক সময়ে ঠিক ডাক দিয়েছেন।

রঞ্জু মাথা নাড়ায়। বলে, দেখিস, নেতৃত্বের মধ্যে গোঁজামিল থাকলে কোনো লাভ হবে না।

রাখী এই সময় মন্তব্য করে- কোনোটাইতে কোনো লাভ হবে না। বলে, দেখে নিও ধরে নিলাম ছয়-দফা হল, এমনকি পুরো স্বাধীনতাই পেয়ে গেলাম— তাতে সাধারণ মানুষের কী লাভ হবে বলো? পাঞ্জাবি প্রভুর বদলে বাঙালি প্রভু হবে। তখন বাঙালি জমির মালিক আর বাঙালি পুঁজি মালিক এই দুই মালিক মিলে সাধারণ মানুষকে শোষণ করবে।

আমরা সমাজতন্ত্র করব, মীজান জানায়।

কেমন করে? ভদ্দরলকেরা সব ক্ষমতায় গিয়ে নিজেদের ঘরবাড়ি জোতজমি কলকারখানা মানুষকে বিলিয়ে দেবে বলে মনে করো?

না, তা কেন, সাধারণ মানুষ জোর করে আদায় করে নেবে।

তো সাধারণ মানুষের সংগঠন কোথায়? তাদের নেতৃত্ব কোথায়?

না, আপা আপনি বুঝছেন না, জাতীয় মুক্তি পর্যায়টা তো আগে পার হতে হবে। রঞ্জু এবার বলে, আমরাই আমাদের দেশকে গড়ে তুলছি একি কম কথা হল?

সুমিতা তর্কটা মনোযোগ দিয়ে সেদিন শুনেছিল। ছেলে দুটি চলে গেলে রাখীর মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, রাখী তুই কি পার্টি করিস?

রাখী অবাক, বাহ্, আমি কেন পার্টি করতে যাব। পার্টি না করলে বুঝি রাজনীতির কথা বলতে নেই।

না, তা নয়, সুমি ধীরে ধীরে বলেছিল, তোর তো কখনো রাজনীতির ব্যাপারে আগ্রহ দেখিনি।

রাজনীতির ব্যাপারে রাখীর এখনো যে খুব একটা আগ্রহ হয়েছে এমন নয়। আসলে চোখ-কান খোলা রাখার ব্যাপার আর কী। যেমন সাংবাদিকদের আন্দোলনে যাবার ব্যাপারটা। সাদেক সাহেব বলতে পারলেন না— কিন্তু রাখী বলে দিল, দেখবেন আপনাদের আন্দোলন হচ্ছে। আবার যেমন এনএসএফ গুণ্ডাদের ব্যাপারটা। সুমির সঙ্গে বেরুচ্ছিল। ফুলার রোডে পড়তেই মনে হল রাস্তাটা একটু বেশি অন্ধকার। সে বলল, সুমি, এ পথে যাস না। কথাটা শেষ হয়েছে মাত্র, অমনি সামনের দিক থেকে চিৎকার- বাঁচাও বাঁচাও।

এছাড়াও আরেকটা বাড়তি তাগিদ ছিল। সেজানের কাছে গেলেই সে খবর জানতে চাইত।

সেজান এখন মোটামুটি সুস্থ। চেহারায় সেই ছাই-ছাই ভাবটা নেই। রাখী কাছে গিয়ে হাতটা হাতে টেনে নিলে উঠে বসে। বলে, খবর বলো।

সুমি তখন আরম্ভ করে- শিউলিতলায় আজ প্রথম ফুল দেখলাম। সকাল থেকে বেলা এগারোটা পর্যন্ত তেত্রিশটা কাক আর সাতটা চড়াই বারান্দার রেলিঙে এসে বসেছিল। মোমেনার মা তার বোনঝির বিয়ে দিচ্ছে— পাত্রের সব ভালো শুধু কানেই একটুখানি খাটো—

সেজান হাসে- না, ঠাট্টা নয়, বলো।

বাহ্, আমি যখন অসুস্থ ছিলাম তুমি তখন আমাকে ঐ ধরনের খবর শোনাতে না, বলো? কালো বেড়ালটা পো-এর গল্পের বেড়ালের মতো লাগে। হাতকাটা ছেলেটা আসে কি না, ফোয়ারাটা বন্ধ ছিল— এখন আবার ছুটছে— এসব খবর তুমি বলতে না? আর সেই যে তোমার ছেলেবেলার বন্ধু তুলসীরাম না তুলসীদাস, যে তার মাস্টার মশাইয়ের টিকি কেটে নিয়ে পালিয়েছিল, তার গল্প বলোনি?

সেজান হাসে চোখের দিকে তাকিয়ে। তারপর অবশ্যি একটি দুটি করে খবর সেজানকে জানাতে হয়। যদি খবর থাকে তো জানায়— নইলে অন্যরকম এলোমেলো কথা হয় সব।

একেক দিন আবার গম্ভীর থাকে। যেমন সেদিন যখন জানল যে হাসপাতাল থেকে তাকে ছেড়ে দেবে- সেদিনই সে গম্ভীর হয়ে গেল। অথচ সে নিজেই ছাড়া পাবার জন্যে অস্থির হয়ে উঠেছিল। রাখী গেলে জানালম আমি ঠাকুরগাঁয়ে ফিরে যেতে চাই।

কেন, জেলখানার ভাত খাবার সাধ হয়েছে আবার?

না, তা নয়। এখানে কোথায় থাকব বলো?

বোকার মতো কথা বোলো না, রাখী ধমক দিয়েছে। বলেছে, তোমার থাকার জায়গার অভাব হবে না সে যেমন তুমি জানো, তেমন আমিও জানি। তাছাড়া এখন ফিরে গিয়ে তুমি কী করবে? মিন্টু লুকিয়ে আছে- কোথায় আছে, কেউ জানে না। শিবনাথবাবু ধরা পড়েছে। শফিউদ্দিন সাহেবের ওপরও নিশ্চয়ই কড়া নজর রাখা হয়েছে। লোকজন নেই— কাকে নিয়ে তুমি কাজ করবে?

রাখীর কোনোই কাজ নেই। এ ভারি মজার হয়েছে তার। খাও দাও আর ঘুরে বেড়াও। আগে এমনি এমনি ঘুরে বেড়ালে নিজেকে ক্লান্ত আর একঘেয়ে লাগত। এখন উদ্দেশ্যহীনতাই তার মধ্যে একটা হালকাভাব এনে দিয়েছে। একদিন নাসিমার সঙ্গে দেখা হল-সে একটা মেয়ে-কলেজে চাকরি পেয়েছে। ইউসুফ এখন ঢাকায়- খবরের কাগজে কাজ করছে। নাসিমার ছোট বাচ্চাটা বেজায় মোটা। রাখী কিছুক্ষণ কোলে নিয়ে রাখার পর হাঁপাতে হাঁপাতে নামিয়ে দিল। নাসিমা রাখীর অবস্থা দেখে বলল, ওটা মানুষের না, হাতির বাচ্চা। নাসিমা পরামর্শ দিল, মফস্বলে একা কতদিন থাকবি— ঢাকায় ফিরে আয়— এখানেই খুঁজে পেতে নে একটা কাজ।

নার্গিস নাকি এখন লাহোরে। কীভাবে গেছে, কার সঙ্গে গেছে, সেসব খবর বলতে পারব না। ‘ওভারসিজ’-এর কর্তা এখন অন্য লোক। মাজহার নেই, কেউ বলে লন্ডনে, কেউ বলে করাচিতে। সবচাইতে বড় হল হাসান ভাইয়ের ঘটনা। হাসান ভাই নাকি রাজনীতি করছে, আওয়ামী লীগের ওপরদিককার নেতা। একদিন স্টেডিয়ামের কাছে দেখল, পাজামা পাঞ্জাবি পরনে, তাঁর ছাইরঙা মার্সিডিসের দরজা খুলে নামছে।

রাখী একেকদিন রাস্তার মাঝখানেই দাঁড়িয়ে যায়। ভারি অদ্ভুত লাগে তার। মাত্র তো ক’টা বছর-সেই লোকজনও আছে, জায়গাও সেই পুরনোই আছে-কিন্তু দ্যাখো, কেমন সবকিছু বদলে গেল। কোথায় গেল সেই হাসান ভাই— সে বুবুকে নিয়ে বেড়াতে বার হয়েছে, স্টেডিয়ামের চাতাল ধরে হেঁটে যাচ্ছে। কোথায় গেল সেই মাজহার, রাস্তার ধারে দাঁড়ানো রাখীকে লিফ্ট দেয়ার জন্যে তার ফিয়াটের দরজা খুলে দিয়ে ডাকছে। পারভিন কোথায়? আর ইভা, সেই যে ফিরিঙ্গি মেয়েটা?

না রাখীর কষ্ট হয় না, দীর্ঘশ্বাসও পড়ে না। তবে অদ্ভুত লাগে। কী সহজে সবকিছুই নিঃশেষে বদলে যায়। পুরনো দিনকে ধরে রাখা যায় না কোনোমতেই।

জাহানারা চিঠি লেখে— তুই চলে গিয়ে খুব ভালো করেছিস। প্রিন্সিপ্যাল সাহেব অসুস্থ। নিজামউদ্দিন এস.ডি.ও এখন চুটিয়ে বদমাইশি করার সুযোগ পেয়েছে। ডোনারস কমিটি যে কীরকম দরকারি ছিল আমার কর্তাটি এখন বুঝছেন। আরো বুঝছেন হাসান ভাইয়ের মতো লোকদের গুরুত্বটা আসলে কতখানি। এদিকের খবর তো জানিস, তুই যেদিন যাস দুএকদিন আগে-পরে দূরের হাটগুলোতে তুমুল গণ্ডগোল হয়। আর সেই গণ্ডগোলের ছুতোয় শহরেও ধরপাকড় আরম্ভ হয়ে যায়। দুতিনটি কলেজের ছেলে ধরা পড়েছে। আর একটা খবর শুনবি? শুনে তো আমি থ’- পুলিশ নাকি রোকেয়া নামে একটা বাচ্চামেয়েকে খুঁজছিল। আমরা ভাবলাম, বুঝি তুই। কিন্তু শুনলাম, না তুই নয়- এ ছাত্র রোকেয়া। হ্যাঁ, তোর খোঁজও হয়েছিল- কলেজ থেকে ঠিকানা নিয়ে গেছে। কী করবে জানি না। তুই কিন্তু ভুলে যাস না— আসিস এখানে, এখন নয়, পরে, কিন্তু আসবি ঠিক ঠিক। তুই না থাকলে এ কলেজ চলবে না।

রাখী গোলমাল এবং ধরপাকড়ের খবরগুলো মোটামুটি জানত। কিন্তু কলেজের যে বেহাল অবস্থা হয়েছে, তা জানত না। জেনে খারাপ লাগল। কিন্তু কিছু করার নেই কারো।

আসলে সে কি আবার বদলেছে? রাখী নিজের মনের হদিশ করতে পারে না। নইলে কাজের সঙ্গে নয়, বাড়ির সঙ্গে নয়, পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে নয়- কোথাও নিজেকে সংলগ্ন মনে করতে পারে না কেন? তার নিজেরই কাছে অবাক লাগে। এত সবকিছুর সঙ্গে থেকেও শেষপর্যন্ত সে কোথাও নেই-

এ কেমন অদ্ভুত কথা।

সেদিন নিউমার্কেটে হঠাৎ পেছন থেকে ডাক। রাখী ঘুরে দেখে অবাক, আরে পারভিন তুই!

পারভিন একেবারে বাচ্চামেয়ের মতো রাখীকে দুহাতে জড়িয়ে ধরল, রাখী আপা, ইশ্ কতদিন পরে দেখা।

রাখী পারভিনের চুল দেখে, শাড়ি দেখে আর অবাক হয়। এ কোন্ পারভিন? গলায় ঝলমলে হার নেই, হাতভর্তি চুড়ি দেখছে না। পায়ে ঝকঝকে জুতো নেই, পরনে ঝলমলে শাড়ি নেই। পারভিন তুই! রাখীর বিশ্বাস হতে চায় না, তুই ঢাকায় কী করছিস?

বাহ্, আমি তো ঢাকাতেই রয়েছি— সে অনেক দিন হল— আমি বিয়ে করেছি রাখী আপা।

সত্যি! রাখীর খুব ভালো লাগে খবরটা শুনে। জিজ্ঞেস করে, কই তোর বর কোথায়?

এখন সঙ্গে নেই, কিন্তু একেবারে আঁচল-ধরা রাখী আপা, পারভিনের মুখ যেন ঝলমল করে খুশিতে। বলে, চলো, আমার বাসায় যেতে হবে তোমাকে।

না আজ না, পরে একদিন— তো বললি না, তোর বর কী করে?

ও কী শুনবে তুমি, শুনো না, তোমার পছন্দ হবে না।

বা রে বোকা মেয়ে, আমার অপছন্দ হলে তোর কী? তোর বর তো তোরই কাছে থাকছে।

খবরের কাগজে চাকরি করে, পারভিন জানাল। তোমাকে চেনে, তোমাদের সময়ে য়ুনিভার্সিটিতে ছিল।

তা জোটালে কে? মামানি?

পাগল হয়েছ তুমি, আম্মা তো দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন।

ও প্রেমের বিয়ে তাহলে।

না, রাখী আপা, প্রেমও হয়নি তেমন- পারভিন একেবারেই শিশুর মতো হাসে। বলে, প্রেম করার সময় তো পাওয়া গেল না। সেই-যে তোমাদের ওখান থেকে পালালাম, বাড়ি যাওয়ার পথে ট্রেনে আলাপ, পাবনাতেই বাড়ি ওদের। কিছুদিন চিঠি-লেখালেখি। দেখাসাক্ষাৎ কিন্তু নেই। চিঠিতে ও প্রস্তাব দিল, আমি রাজি হলাম। কিন্তু আমার কাছে প্রস্তাব দিতে এলে আম্মা দূর দূর করে তাড়িয়ে দিলেন।

বাহ্, কেন?

শুনবে কেন? পারভিন মুখে আঁচল চেপে হাসি থামায়, রাখীকে নিয়ে রাস্তায় একপাশে সরে আসে। বলে, শুনলে কিন্তু হাসতে হাসতে মরে যাবে। হয়েছিল কি, কথা বলবার সময় ঘামছিল, এমনিতেই খুব ঘামার অভ্যেস। একটু খেয়ালি টাইপের আর কি, চুলে চিরুনি পড়ে না- থাকে না এক টাইপের মানুষ— ঐরকম আর কী। তো ঘেমেছে খুব, তাই হাতটা তুলে জামার হাতায় মুখটা ঘষে নিয়েছিল- এও ওর বদ অভ্যেস। ব্যস্, ঐতেই বেজে গেল বারোটা। প্রস্তাব শুনে আম্মা বললেন, এবার আপনি আসতে পারেন। একেবারে ইংরেজিতে বলে দিলেন, অ্যান্ড নেভার ট্রাই টু কাম এগেন। তখন আমার উপায়! আমিও স্যুটকেস গুছিয়ে পরের দিন ওদের বাড়িতে গেলাম সন্ধেবেলা। তারপর দুজনে ঢাকায় এসে কাজির বাড়ি হয়ে ওর মেস-এ উঠে গেলাম।

রাখী তাকিয়ে দেখে অবাক হয়। যদি আমূল কেউ বদলে গিয়ে থাকে তো সে পারভিন। শুধাল, তা এই যোগিনী বেশ কেন তোর?

পারভিন নিজের দিকে তাকায়। বলে, বাহ্, খারাপ কী, বলো, খুব খারাপ লাগছে আমাকে দেখতে?

রাখীর বুকের ভেতরটা দুলে উঠল পারভিনের ঐ কথায়। দুহাতে জড়িয়ে ধরল সে বোনকে। বলল, না রে না- এমনি বললাম- খুব সুন্দর হয়েছিস তুই- খুব সুন্দর।

শেষ কথা শুধাল রাখী, হ্যাঁ রে, তোর বরও তোর মতো সুন্দর তো, ফর্সা তো?

না রাখী আপা, পারভিন মাথা নাড়াল, ফর্সা নয়, খুব কালো, কিন্তু- পারভিন চোখ তুলল আকাশের দিকে, রাখী আপা সুন্দর, দেখো তুমি- তুমিও সুন্দর বলবে।

রাখী বুঝল, সত্যিই সুন্দর পারভিনের বর, কেননা কথা ক’টি বলবার সময় রাখী ওর চোখে ভারি কোমল আলো ফুটতে দেখল।

কোথাও কোথাও তাহলে সত্যিই আশা আর আশ্বাস থেকে যায়। সবকিছু একবারে নিঃশেষ হয়ে যেতে পারে না। কে যেন একদিন তাকে বলেছিল, কে বলেছিল রাখী স্মরণ করতে পারে না। তবে কথাটা বেশ মনে পড়ল। তার মনে পড়ল প্রথমে নাসিমাকে দেখে, তারপর মনে পড়ল পারভিনকে দেখে।

কিন্তু নিজের মনের দিকে তাকিয়ে যখন শুধায়— তোর কী হবে? তোর কি এখনো আশা আছে? এখনো কি আশ্বাস পাস? তখন কিন্তু জবাব খুঁজে পায় না সে। কেমন বিচিত্র হাসি জেগে উঠতে চায় মনের ভেতরে। নিজের ব্যাপারে কোনো জোরই পায় না সে।

সেজানের কাছে গেলে দেখে, সে আজকাল লেখাপড়ায় ভীষণ ব্যস্ত। কী লিখছে, কে জানে। একদিন লক্ষ করে দেখল, সব রাজনীতির বিষয়ে লেখা। কিন্তু লেখা হয়েছে যতখানি, কাটাকুটি হয়েছে তার চাইতে অনেক বেশি। বিছানার পাশে থাক-থাক বই। রাখী জানে, এসব বই পাচ্ছে সুমিতার কাছে যারা আসে তাদের কাছ থেকে। রাখীকে তার মুখের দিকে বিচিত্র চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে সেজান কেমন সচকিত হয়। হাতের খাতা গুটিয়ে রেখে হাসে।

রাখীর খারাপ লাগে। বলে, ও কী, কাজ হয়ে গেল?

না, এখন থাক্, পরে হবে, সেজান পাশে এসে বসে। বলে, বরং কথা বলি তোমার সঙ্গে।

কিন্তু কথা হয় না। নতুন আর কোন্ কথা হবে? রোজই তো কথা হচ্ছে। রাখী জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। সেজানকে দূরের মানুষ মনে হয়, আগের মতোই।

সেজান ডাকে, রাখী।

কী।

কী দেখছ তুমি?

রাখী চোখের ওপর থেকে চোখ না সরিয়ে মাথা নাড়ায়- কিছু না এমনি। সেজান রাখীর একটা হাত ধরে। বলে, আমার ওপর তোমার রাগ হয় না? রাখীর ভালো লাগে না এসব কথা শুনতে। কেমন বানানো বানানো মনে হয়। বলে, এসব কথা বোলো না।

কেন রাখী?

আমার ভালো লাগে না।

সেজান সম্ভবত আহত হয়। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর বলে, আমি জানি আমার কাজ তোমার ভালো লাগে না।

রাখীর বিরক্তি তখন চূড়ান্ত হয়ে ওঠে। বলে, অন্য কথা বলো সেজান।

সেজান চুপ করে যায়। আর কথা এগোয় না। একসময় দরজার কাছে এসে দাঁড়ায় সুমি। ডেকে বলে, রাখী আমি গেলাম।

বিকেলের আলো মুছে যেতে থাকে ঘরের দেয়াল থেকে। জানালার ওদিকে একটি সবজি বাগান— সেখানে এক মোটামতো মহিলাকে হেঁটে হেঁটে বাগান তদারক করতে দেখা যায়। রিকশর ঘণ্টি বাজে রাস্তায়। সেজান উঠে বাতিটা জ্বালায় একসময়। রাখী তখন ওঠে, আমি যাই তাহলে।

সেজান কিছু বলে না। চোখ তুলে রাখীর দিকে তাকায় শুধু। ঠিক ঐরকম—একই রকম একেবারে, তিন বছর আগে যেমন দেখত, রাখীর মনে পড়ে— জেদ করে না, জোর করে না, বোঝাতে চায় না। শুধু চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

রাখী সেদিন আর দাঁড়াল না।

সুমিতাও সেজানের চুপচাপ ভাবটা লক্ষ করে। দেখে খুব বই ঘাঁটাঘাঁটি করছে আর লিখে যাচ্ছে। সে একবার জিজ্ঞেস করেছিল, বই লিখেছেন বুঝি? সেজান উত্তরে হেসেছিল। বলেছিল, না তেমন কিছু নয়।

তেমন কিছু নয় মানে? এত বই ঘাঁটাঘাঁটি করছেন, এত লিখছেন- একি শুধুশুধু?

একেবারেই কি আর শুধু? সেজান শেষপর্যন্ত জানিয়েছে। বলেছে, আমি আমাদের দেশের অবস্থাটা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছি। হাতে কোনো কাজ নেই তাই। যদি এই ব্যাখ্যার ভেতর থেকে কোনো সূত্র বেরিয়ে আসে। সুমিতা বোঝে, অকাজের কাজ হলে মানুষ এত মনোযোগী হয় না। সে বলে, যা-ই করুন, দয়া করে দুশ্চিন্তা করবেন না- আর রাত জাগাটা বাদ দিন।

আমি কি রাত জাগি?

হ্যাঁ জাগেন। গত ক’দিন ধরে দেখছি, রাত একটার পরও আপনার ঘরে বাতি জ্বলছে।

সেজান তখন মুখোমুখি তাকায়। বলে, ডক্টর, আমি জানি, আপনি খুব ভালোমানুষ, সবসময় আমাদের ভালো চান। প্রগ্রেসিভ আন্দোলনের ব্যাপারে আপনার সাহায্য আমাদের কারো ভোলা উচিত নয়। আর আমার জন্যে আপনি অনেক করেছেন-

সুমি উঠেছিল, সেজান বাধা দিল। বলল, উঠবেন না। আপনার প্রশংসা করা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমার কিছু কথা আপনার জানা প্রয়োজন— তাই বলছি, দয়া করে শুনুন।

তো সুমিতা শুনল।

দেখুন, আমি ছেলেবেলা থেকে রাজনীতি করছি। আপনি জানেন, আমাদের দেশে প্রগ্রেসিভ রাজনীতিতে এখন কীরকম বন্ধ্যা সময় যাচ্ছে। একদিকে পলিটিক্স আর অন্যদিকে গ্রুপিং-এ অবস্থাটা টেবিলে বসে তর্কাতকি করে কাটবে না। ফিল্ডে কাজ করে সমাধান খুঁজে বার করতে হবে। যত তাড়াতাড়ি এই পর্যায়টা পার হওয়া যায় ততই মঙ্গল। এ অবস্থায় আমার মতো লোকের পক্ষে চুপচাপ হাত গুটিয়ে থাকা অনুচিত এবং অন্যায়। আমি কোনো-না-কোনোরকম কাজ করবই। এটা আপনাদের বুঝতে হবে- না বুঝলে আমার ওপর অবিচার করবেন আপনারা।

সেজানের ঐ বক্তৃতা শুনে সুমিতার ভয়ানক হাসি পাচ্ছিল। কেবলি মনে হচ্ছিল— কেন অহেতুক এই বাগাড়ম্বর— এইরকম বক্তৃতা না করে কি কথাগুলো বলা যেত না। সেজানের কথা শেষ হলে বলল, আপনার কথা বুঝেছি— আপনি ইচ্ছেমতো চলতে ফিরতে চান। ঠিক আছে, আপনি যা ভালো বুঝবেন করবেন। কিন্তু একটা কথা বোধহয় আপনারও বোঝা প্রয়োজন যে, কাজ শুধু আপনাকেই একাকী করতে হবে, এটা ঠিক নয়। সবাই যদি না করে, তাহলে আপনার কাজেরও কিন্তু কোনো দাম নেই।

সুমিতা কথাটা বলতে চায়নি। কিন্তু বলল, এবং বলেই ঘর থেকে উঠে চলে এল।

আর পরদিনই বিকেলবেলা রাখী এসে দেখল— সেজান নেই।

সুলতানের মাকে জিজ্ঞেস করে জানল, সেজান সকালবেলার দিকে বেরিয়ে গেছে আর ফেরেনি।

সুমিতা এল একটু পরই। বলল, কোথাও ধরতে পারলাম না। রাখীকে তারপর গতদিনে যা যা কথা হয়েছিল, সংক্ষেপে সব বলল সুমিতা। রাখী শুনল, তারপর একসময় উঠল- এবার যাই সুমি।

রাখীর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল সুমিতা। দেখে কী বুঝল সে-ই জানে। বলল, রাখী, তোর কি চিন্তা হচ্ছে?

রাখী মাথা নাড়াল–না।

খারাপ লাগছে নিশ্চয়ই?

না। তাহলে চলে যাচ্ছিস কেন? বোস।

রাখী বসল।

মনে হচ্ছিল, সুমি আরো কিছু বলবে। কিন্তু সুমি কিছুই বলল না। একবার শুধু জানতে চাইল, আব্বা কেমন আছেন আর মন্তব্য করল, তোর আব্বা খুব খুশি তোকে পেয়ে, তাই না?

রাখী জবাবে হাসল একটুখানি।

তুই একটা চাকরিবাকরি খোঁজ করলি না?

কেন? রাখী জানতে চাইল।

কিছু একটা করবি তো, নাকি আবার সেই কলেজে ফিরে যাবার কথা ভাবছিস।

রাখী উঠল, দেখি সুমি, কী করা যায়।

দিনকয় পর একদিন সুমিতা সেজানের টেবিল গোছাবার সময় বেশ ক’খানা চিঠি পেল। দুএকখানা পড়ল ও। রাজনীতি ছাড়া অন্য কথা নেই। দুএকজন লোকের নাম-ঠিকানা এবং ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ অবশ্যি আছে, কিন্তু সে প্রসঙ্গ খুবই অল্প। লেখা কাগজগুলোও উল্টেপাল্টে দেখল— সেখানেও রাজনীতির কথাই।

সুমিতা কিছু বলতে চায় না। জানে, বলে কোনো লাভ নেই। সেজান ঐরকমই করবে। নিজের ভাইকে তো জানে। এইরকমই করত। সম্ভবত এখনো করে। জলপাইগুড়ি না শিলিগুড়ির চা-বাগান এলাকায় থাকে এখন। বোনের কাছে চিঠি পর্যন্ত লেখে না। মা লিখেছেন নকশালবাড়ি নামে কোন্ জায়গায় নাকি ভয়ানক ব্যাপার ঘটেছে। কে জানে, ছোটদা বোধহয় সেখানেও ছিল।

সেজানকে তার বলার কিছু নেই। শুধু রাখীর দিকে তাকিয়ে খারাপ লাগে। রাখীর কত কিছু গুণ ছিল— কিন্তু কোনো কাজে লাগল না। ঐরকম একটা সুখের সংসার ওদের কীরকম ধসে পড়ে গেল। রাখীর যে কী হবে সে ভেবে কূল পায় না। তার নিজের সঙ্গে রাখীর তুলনা করে না সে। সুবিনয়ের ব্যাপারটা গোড়া থেকেই আলাদা। সেখানে তার নিজের কোনো ভুলত্রুটির ব্যাপার ছিল না। বাবার পছন্দ করা ছেলে- বিয়ের রাতেই বলে দিয়েছিল ইন্টারমিডিয়েট পাস করেছ, তাই যথেষ্ট, আর না। সুবিনয়ের ঢাকায় থাকার মন ছিল না আদৌ। কথায় কথায় বিবৃতি প্রকাশ করত। দুমাসে চারমাসে কলকাতা যেত। তারপর একবার যে গেল আর এল না। সুবিনয়ের পক্ষে সবই সম্ভব। সে জানত শেষপর্যন্ত সুবিনয়ের সঙ্গে তার পোষাবে না। যে লোক কলকাতার ক্যাবারের গল্প করতে ভালোবাসে, পর্ণ অ্যালবাম রাখে বালিশের তলায়, যেতে আসতে সোনা ঘড়ি ওষুধ এসব পাচার করে, তার সঙ্গে সুমিতার পোষাবার কথা নয়। তারপর তাকে ডাক্তারি পড়তে হয়েছে, তাই সুবিনয়ের ব্যাপারটা নিয়ে সে ভাবে না- ব্যাপারটা এতই দূরের এখন, যে কল্পনা করতেও কষ্ট হয়।

রাখী যেদিন এসে বলল, সুমি আমার বড় বিপদ, সেদিন সুমিতার বুকের ভেতরে কেঁপে উঠেছিল। মনে হয়েছিল, রাখীর সমস্তটা জীবন বোধহয় ভেঙে গুঁড়িয়ে যেতে বসেছে। সরাসরি কিছুই জিজ্ঞেস করেনি, কিন্তু রাখীর মনে তখন যে কী হচ্ছিল তা বুঝতে তার এতটুকু কষ্ট হয়নি। কিন্তু এও মনে হয়, রাখীর মনের আশা বড়বেশি। যা সে চায়, তা-যে কোনোদিনই পাওয়া সম্ভব নয়- একথা তাকে কে বোঝাবে?

সেদিন ফিরল সেজান অনেক রাতে। সুমিতা তখনো জেগেছিল। বলল, হাতমুখ ধুয়ে আসুন- খাবেন। সেজান খাওয়ার টেবিলে বসলে সুমি নিজের হাতে খাবার এগিয়ে দিলে সেজান মৃদু সঙ্কোচ করল। বলল, থাক না- আমি নিজেই নেব।

খাওয়া শেষ হলে সুমিতা জানাল, সারা বিকেল রাখী এখানে বসেছিল।

সুমিতার অনুমান হচ্ছিল, কিছু একটা হয়েছে সেজানের। সে সেজানের ঘরে গিয়ে ঢুকল। বলল, শুয়ে পড়েন, রাত হয়েছে।

সেজান সুমির মুখের দিকে তাকায়। তারপর বলল, ডক্টর একটা কথা বলবেন?

বলুন, সুমিতা ঘুরে দাঁড়ায়।

আমাকে কি খুব কল্পনাপ্রবণ লোক বলে মনে হয়?

কল্পনাপ্রবণ? সুমিতার অবাক হওয়ার অবস্থা হয়, কে কল্পনাপ্রবণ, আপনি? আর একথাও কি মনে হয়, আমি খুব আরামপ্রিয়?

দেখুন, রাত হয়েছে, সুমি প্রায় ধমক দিয়ে উঠল। বলল, কোন্ গাঁজাখোর কী বলেছে, তাই নিয়ে মাথা গরম করবেন না।

কিন্তু, সেজান হাসল, আমাদের পার্টির এক কর্তা আমাকে আজ তাই বললেন।

বেশি খোঁজ করতে হল না। সাদেক সাহেবকে টেলিফোন করতেই সব জানা গেল। সেজান তার অভিজ্ঞতা আর চিন্তাভাবনা ব্যাখ্যা করে বিচ্ছিন্ন গ্রুপগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে। কিন্তু কেউ তার কথা তখন শুনছে না। সেজন্যে সে একটুখানি কেমন মরিয়াও হয়ে উঠেছে।

সুমিতারও তাই মনে হচ্ছিল। সেজানকে মরিয়া হয়ে উঠতে দেখেছে সেও। একদিন দুপুরের দিকে বাসায় এসে দেখে, সেজান বেরুচ্ছে।

বেরুচ্ছেন? সে জিজ্ঞেস করে।

হ্যাঁ, বিকেলেই ফিরব।

আচ্ছা, সুমিতা মুখোমুখি তাকায়, আপনি এমন মরিয়া হয়ে উঠেছেন কেন, বলুন তো?

সে আপনি বুঝবেন না। সেজান হাসে। বলে, পুরনো সব ঝানু ঝানু কমরেডরাই বুঝছেন না।

বেশ তো, দেখুন, বুঝি কি না।

এখন না, ফিরে আসি- সেজান ব্যস্ততার কথা জানায়।

কিন্তু সুমিতাও নাছোড়। বলে, আপনাকে বলতে হবে।

শুনুন তাহলে, খুব সংক্ষেপে বলছি, সেজান বলে- আমার ধারণা, সামনে একটা খুব বড় আন্দোলন আসছে- এমন আন্দোলন এদেশে আর কখনো হয়নি। এই আন্দোলনে বামপন্থীদের নেতৃত্ব দিতে হবে— কেননা, এর পরই বাঙালির স্বাধীনতার প্রশ্নটা বড় হয়ে উঠবে। আন্দোলন হবেই— কেউ ঠেকাতে পারবে না। অথচ মুশকিল কি জানেন, আন্দোলনের নেতৃত্ব ভুলপথে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে পুরো মাত্রায়- তার মানে আন্দোলন ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে, যদি প্রগ্রেসিভ ফোর্স নিজেদের সংগঠিত করতে না পারে। বুঝেছেন কিছু?

কথা শেষ করে সেজান পাল্টা জিজ্ঞেস করে।

সুমিতার হাসি সামলানো দায় হয়ে ওঠে। বলে, এ বুঝতে হলে বুদ্ধি লাগে নাকি? এ তো কলেজের বাচ্চাছেলেরাই অহরহ বলছে।

তাহলেই বুঝুন, কলেজের ছেলেরা যা বোঝে, নেতারা তা বুঝতে পারেন না।

মরণ! কুঁদুলে মেয়েদের মতো সুমিতা ছোট মন্তব্য করে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *