ত্রয়ী উপন্যাস -প্ৰথম পৰ্ব
ত্রয়ী উপন্যাস - দ্বিতীয় পৰ্ব
ত্রয়ী উপন্যাস - তৃতীয় পৰ্ব

দক্ষিণায়নের দিন – ৭

সাত

পদে পদে নিজেরই সঙ্গে বোঝাপড়া। বারবার নিজের কথাই ভাবা—এমন তো ছিল না আগে। এমন আগে কখনো হয়নি। নিজের মনের মুখোমুখি সব মেয়েকেই একসময় হতে হয়। কলেজে পড়ার সময় থেকেই তাকে নানা কথা ভাবতে হয়েছে। বাড়ির মানুষদের কথা, কি সহপাঠী ছাত্র-ছাত্রী কিংবা অধ্যাপকদের কথাই ভেবেছে সে এতকাল। বুবুর পেটের বাচ্চাটা নষ্ট হয়ে যাবার পর যখন ডাক্তার জানিয়ে দিল বুবুর আর কোনোদিন বাচ্চা হবে না-রাখীর তখন কী কষ্ট-কেবলি মনে হত-হায় বুবুর কী হবে। কেমন করে কাটবে বুবুর জীবন। যেবার সুমিতার দাদা সুবিমলকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেল, রাখীর কী দুশ্চিন্তা তখন! কিংবা হামিদ সাহেবের সংসারের ব্যাপারটা—এসবই একসময় রাখীর ভাবনার বিষয় ছিল। নিজেকে নিয়ে কোনো সমস্যা ছিল না, নিজেকে মানিয়ে নিতে পারত সহজেই। কিন্তু আজ, যখন সে বাইরের দিকে পা বাড়িয়েছে, তখন অন্যের চিন্তা আর তাকে বিচলিত করে না। এখন নিজেই নিজের কাছে জটিল ব্যাপার হয়ে উঠছে। প্রতি পদক্ষেপেই এখন চিন্তা-ভুল করলাম, না ঠিক? যদি ভুল করলাম, তাহলে কী করলে ঠিক হত?

ঘুরেফিরে ঐ চাকরির ব্যাপারটাই রাখীকে ভাবাচ্ছে। আসলে মনস্থির করতে না-পারাটাই যত গোলমালের কারণ। একেকবার মনে হয়, জামান সাহেব কিংবা আব্বা নেহাতই পুরনো সংস্কারের বশে ওর চাকরি নেওয়াটা পছন্দ করতে পারছেন না! কে জানে, হয়তো ভাবছেন, এবার রাখীর জীবন বয়ে যাবে, আপস্টার্ট সমাজের মেয়েদের মতোই রাখী এবার উচ্ছৃঙ্খল হবার পথে পা বাড়িয়ে দেবে।

আবার সন্দেহ হয়। জামান সাহেব হয়তো তার চাকরি সম্বন্ধে আব্বাকে কিছু বলেছেন। কিন্তু তাই বা কেমন করে হয়? তার নিজেরই বিশ্বাস হতে চায় না। কারণ তা হলে আব্বা নিশ্চয়ই তাকে কিছু বলতেন। নাহ্, মিছিমিছি সে ভাবছে যে আব্বা তার চাকরি নেওয়াটা পছন্দ করেননি। কিন্তু এই ধারণাটাও সত্য বলে মনে হয় না একসময় তার কাছে।

তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। রাখী একসময় উঠল, না আর এভাবে অস্বস্তির মধ্যে থাকার কোনো মানে হয় না। প্রশ্নটার মুখোমুখি দাঁড়াতে চায় সে।

রাশেদ সাহেব বসেছিলেন। ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে। দুচোখ বুজে কিছু বোধহয় ভাবছিলেন। পায়ের শব্দে চোখ মেলে তাকালেন একবার। তারপর আবার চোখ বুঝলেন। রাখী কাছে গিয়ে ডাকে, আব্বা!

এসো, কী খবর তোমার? রাশেদ সাহেব চোখ বোজা অবস্থাতেই সাড়া দিলেন। রাখী থমকায়, আহত বোধ করে, কান্না পায় তার। এমন দূর থেকে কথা বলছেন কেন আব্বা? গলার স্বর এমন ঠাণ্ডা কেন তার?

সে আবার ডাকে। বলে, আব্বা আমি কি ভুল করলাম?

মেয়ের গলার স্বরে কী শুনতে পান তিনিই জানেন, রাশেদ সাহেব উঠে বসেন। কাছে ডাকেন মেয়েকে। বললেন, এখানে বসো— কী হয়েছে তোমার।

রাখীর ঐ মুহূর্তে ইচ্ছে হয়, ছেলেবেলার মতো আব্বার কোলে মুখ গুঁজে থাকে, আব্বা তার পিঠে হাত বুলিয়ে দেন আর একটু একটু করে সে নিজের কথা বলে যায়। কিন্তু পারে না সে-কারণ আব্বা যেন বহুদূরে শীতল ঠাণ্ডা একটা নিস্পৃহতার ওপারে তখনও বসে রয়েছেন। তখনও যেন কী ভাবছেন।

মেয়েকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রাশেদ সাহেব ফের বললেন, কী হয়েছে রাখীবাঈ-মন খারাপ?

এবার যেন গলায় স্নেহের উষ্ণ ছোঁয়া লাগে। রাখী আব্বার চেনা গলার স্বর শুনতে পায়। এবং সে তখন বলতে পারে।

বলে, আব্বা আমি ঠিক বুঝতে পারছি না, চাকরিটা কি আমার নেওয়া উচিত হয়নি? এ-ধরনের চাকরি কি আমার করা উচিত নয়?

রাশেদ সাহেব বোধহয় হাসেন, অন্ধকারে দেখা যায় না। বললেন, আগে শান্ত হয়ে বসো, এত ইমেশনাল হওয়া কি ভালো?

আব্বার কথায় রাখী বসে, কিন্তু তখন বুক ফেটে কান্না আসছে। কেন যে, সে নিজেই জানে না।

একসময় আব্বা বললেন, রাখীবাঈ, তুমি এমন দুর্বল তা তো জানতাম না। চাকরি নেয়ার মতো একটা ব্যাপার তোমাকে এমন অস্থির করে দিল, আশ্চর্য!

রাখী বুঝতে পারছে না তিরস্কার না উপদেশ, সে কান পেতে রাখে আব্বার কথা শোনার জন্য।

দ্যাখো রাখীবাঈ, ভালোমন্দ বিচারটা শেষপর্যন্ত তোমারই ওপর নির্ভর করছে। কে কী বলল না বলল, তাতে কিছুই যায় আসে না। তুমি নিজে যদি পছন্দ করে থাকো, তাহলেই হল-আর কারো কথা তোমার ভাবা উচিত নয়।

আসল কথাটা কী জানো, আব্বা ব্যাখ্যা করতে চাইলেন। বললেন, আমরা মস্ত মস্ত মালঅ্যাডজাস্টমেন্ট-এর মধ্যে বাস করি, সেটাই আমাদের জীবনের সবচাইতে বড় ট্রাজেডি। আর সেজন্যই আমাদের সব জায়গায় ভুল হয়। যেমন ধরো, আমার ধারণা ছিল তুমি প্রফেসার হবে। আমি তোমার ভবিষ্যৎ ঐভাবে কল্পনা করে রেখেছিলাম। তাই সেদিন যখন খবর পেলাম অফিসের চাকরি নিতে যাচ্ছ, তখন আমার খারাপ লেগেছিল। আমি তারপর খুব ভেবেছি ঐ নিয়ে! তুমি অত সহজে ঐ ধরনের একটা চাকরি নিয়ে নিতে পারলে-ভাবতেই আমার কষ্ট হচ্ছিল। অথচ দ্যাখো, আমি নিজেই ভালো করে জানি, সবরকম চাকরিই সমান। সব কাজই মানুষের উপকারের জন্য এবং সব চাকরিতেই টাকা দেয় পরিশ্রম করিয়ে। আসলে, জানো, আমার খারাপ লেগেছিল অন্য কারণে- রাশেদ সাহেব বলতে থাকেন, তুমি লেখাপড়া শিখলে, ইতিহাস জানলে, কিন্তু তোমার সেই লেখাপড়াটা কোনো কাজে লাগাতে পারলে না—এটাই আমার কাছে সবচাইতে খারাপ লেগেছিল। তবে এও বুঝেছিলাম, কোনো ব্যাপারেই আমার কিছু করার নেই-তাই কিছু বলতে চাইনি। কাউকে বলে কোনো লাভও ছিল না। বুলুকে বলে লাভ হত না, আর হাসান আমার কথা বুঝবে না জানতামই। তাই আমি চুপ করে ছিলাম। আমি তোমার ওপর ভরসা করে রয়েছি। আমার এখনো বিশ্বাস আছে যে, খারাপ লাগলে এ চাকরি তুমি ছেড়ে দেবে।

রাখী শুনতে এসেছিল। নিজের সংশয় থেকে মুক্ত হতে এসেছিল। কিন্তু শেষপর্যন্ত শুনল না। শোনবার দরকারই পড়ল না। আব্বার স্বরে ধীরে ধীরে স্নেহ ফুটল, ক্রমে ক্রমে আব্বাকে আবার সে কাছাকাছি অনুভব করল। যদিও আব্বা তখনও তাকে তুমি বলছিলেন, তবু রাখীর যা জানবার ছিল তা জানা হয়ে গিয়েছিল। আব্বা কী বলছিলেন, সেদিকে তার খেয়াল ছিল না। সে শুনছিল। সে শুনছিল সারা ঘর জুড়ে আব্বার স্বর কেমন প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, বাইরের আলোকিত রাত্রি এখন কোলাহলে মুখর। একটা রিকশ কোনো বাড়ির দরজায় অসহিষ্ণু বেল বাজিয়ে যাচ্ছে। রাখী আব্বার কথা নয়, ঐসব শুনল অনেকক্ষণ ধরে!

রাশেদ সাহেব যখন বললেন, রাখীবাঈ, তোর যা ভালো লাগে তাই কর্, নিজের সঙ্গে কখনো প্রতারণা করিস না, তাহলেই আমার বেশি কষ্ট হবে। তখন রাখী আব্বার কাছে গিয়ে বসল। তারপর অনেক দিন আগের মতো অন্তরঙ্গ করে জানাল, জানো আব্বা, আজ সেজানের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। রাশেদ সাহেব আগ্রহী হলেন, তাই নাকি, কোথায়?

পথে, রেস্তরাঁয় খেতে যাচ্ছিল, আমিই সঙ্গে নিয়ে গেলাম। অনেক কথা বলল। সব রাজনীতির কথা-নিজের কথা একদম ভাবে না।

রাশেদ সাহেব একটু অন্যমনস্ক হলেন। রাস্তার আলো জানালা দিয়ে ঘরের ভেতরে আভা ফেলে গেল একবার। রাখী শুনল, হ্যাঁ ঐ মনির মতোই আর কী!

কথাটার শেষে বোধহয় একটা দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শুনতে পাওয়া গেল!

কিছুক্ষণ পর জিজ্ঞেস করলেন, কিছু করবে-টরবে বলল?

হ্যাঁ, কোনো কাগজের সঙ্গে নাকি আছে।

রাশেদ সাহেব আরো কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে শেষে বললেন, যাক ওসব কথা, তোর চাকরি কেমন লাগছে?

রাখী কী বলবে ভেবে পায় না। সে কি জানে, কেমন লাগছে চাকরিটা? ভালো লাগেনি? রাশেদ সাহেব ফের জিজ্ঞেস করেন।

আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না আব্বা, রাখী জানায়, একেক সময় বেশ লাগে-আবার একেক সময় এত বাজে লাগে!

রাশেদ সাহেব মেয়ের দিকে তাকালেন এবার। জানতে চাইলেন, খুব বেশি খাটুনি?

না, খাটুনি নয়, কিছু চিঠিপত্র লেখা, হিসাব মেলানো আর মানুষের সঙ্গে বাছা বাছা মাপা মাপা একইরকম কথা বলা। মাঝে মাঝে ভীষণ বিরক্ত লাগে।

রাশেদ সাহেব হাসেন। বললেন, সব চাকরিতেই প্রথম-প্রথম অমন লাগে। ও কিছু নয়, আরো কিছুদিন যাক, তখন দেখবি, সব ঠিক হয়ে গেছে। রাশেদ সাহেব চুপ করলেন। রাখী চুপ করল। বাইরের আলোকিত রাত্রি তেমনি কোলাহলে মুখর। দূরে বোধহয় একটা ট্রেন চলে গেল। কাছের কোনো লেভেল ক্রসিঙে বাস আর মোটরের হর্ন বাজছে, কার বাচ্চা চেঁচিয়ে কাঁদছে কোথায়। রাখী আস্তে আস্তে অনুভব করে, সে যেন ঘরময় ছড়িয়ে যাচ্ছে।

ঘরের আসবাবপত্র, আব্বা, খবরের কাগজ, শেফের বইগুলো, বাইরের অজস্র শব্দ, সবকিছুর সঙ্গে যেন সে একটু একটু করে মিশে যাচ্ছে। তারপর এইরকম ছড়িয়ে যাওয়া অনুভূতির মধ্যে থেকে সে একসময় জেগে

উঠল। শেষে, আব্বা যখন আবার ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে চোখ বুজেছেন, গুনগুন করছেন-আমার ব্যথার পূজা হয়নি সমাপন—, তখন নিঃশব্দে, পায়ে পায়ে হেঁটে সে নিজের ঘরে চলে এল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *