ত্রয়ী উপন্যাস -প্ৰথম পৰ্ব
ত্রয়ী উপন্যাস - দ্বিতীয় পৰ্ব
ত্রয়ী উপন্যাস - তৃতীয় পৰ্ব

পূর্বরাত্রি পূর্বদিন – ৬

ছয়

কোনো-কোনোদিন এসে দেখে, সেজান বালিশে হেলান নিয়ে বই পড়ছে। সেদিন কথা হয়— কলেজের কোনো ব্যাপার নিয়ে, কিংবা চেনাজানা মানুষের সম্পর্কে। শুরু হয় ঐভাবেই- তারপর কথা গড়িয়ে চলে নানান প্রসঙ্গে। যেমন, তোমাদের বাড়ির গেটে মাধবীলতার ঝাড়টা অনেকদিন ধরে আছে তাই না? প্রথম যেদিন তোমাদের বাড়ি গিয়েছিলাম, সেদিন যেমন দেখেছিলাম, শেষ যেদিন গেলাম, সেদিনও তেমনি দেখলাম। একই রকম থাকে কী করে? আমার ভারি অবাক লাগে। সেজানের ঐ কথায় রাখীরও মনে হয় ব্যাপারটা অবাক লাগবারই মতো। আগে কখনো মনে হয়নি— কিন্তু এখন ভাবলে তারও কাছে আশ্চর্য মনে হয়। প্রত্যেক বছরই ডালপালা কাটছাঁট হত কিন্তু তবু কেমন করে যেন চেহারার আদলটা একই রকম থেকে যেত।

লনটা কিন্তু সেরকম নয়, রাখী জানায়। বলে, আগে রজনীগন্ধা থাকত, ছেলেবেলায় দেখেছি, রজনীগন্ধা ছিল অনেক, পরে অবশ্যি আর ছিল না। তোমার আব্বার বোধহয় খুব ফুলের শখ ছিল?

না আব্বার নয়, রাখী হাসে। বলে, আসলে মা খুব ফুল ভালোবাসতেন। আব্বা মায়ের শখটা বাঁচিয়ে রাখবার জন্যে ফুলগাছের ওপর নজর রাখতেন। তাছাড়া ফুল বুবুরও খুব প্রিয় ছিল।

হ্যাঁ, মনিও দেখতাম রজনীগন্ধার পাগল ছিল, সেজানের মনে পড়ে তখন। রজনীগন্ধার প্রসঙ্গ শেষ হতে দেরি হত— কিন্তু শেষ হয়ে যেত একসময় আপনা থেকেই। তারপর আরম্ভ হত রাস্তার মোড়ের পানের দোকানঅলার কথা। লোকটা কিন্তু মনির খুব বন্ধু ছিল, তোমরা জানো না, দু দুবার ও মনিকে পুলিশের হাত থেকে বাঁচিয়েছে। একবার পাঁচিল ডিঙিয়ে মনিকে ঘুম থেকে জাগিয়ে খবর দিয়ে যায়- আর একবার মনিকে রাস্তা থেকেই খবর দেয় যে, বাড়ির কাছাকাছি পুলিশ ওঁৎ পেতে আছে— লোকটা মনিকে খুব ভালোবাসত।

সেজানের কথা শুনে রাখীরও মনে পড়ে লোকটাকে। মাঝবয়সী হালকা গড়নের মানুষ। খুব ব্যস্ত হয়ে কাঁচি দিয়ে পানের বোঁটা কাটত ঝুঁকে ঝুঁকে। ছেলেবেলায় রাখী ওর দোকান থেকে পেন্সিল কিনত। পেন্সিল কিনলে একটা লজেন্স ফাউ পাওয়া যেত। কোনো-কোনোদিন সুন্দর করে পেন্সিল কেটেও দিত। শুধু ঐ দোকানঅলা নয়— মনি ভাইকে আরো অনেকে ভালোবাসত।

মনির মতো ছেলেকে ভালোবাসবে না, বলো? ওর মতো ছেলে কি হয়? রাখীকে চুপ হয়ে যেতে হয় ঐ কথার পর। সেজান পুরনো গল্পের মতো মনি ভাইয়ের কথা বলে যেতে থাকে।

তোমরা জানো না, আসলে কেউই জানে না- মনি আসলে কী ছিল, মনিই হল উদাহরণ, যে মানুষকে নিঃশেষে ভালোবাসতে গেলে এদেশে মরতে হয়। ওর লেখা কবিতাগুলো কোথায় কোথায় যে হারিয়ে গেল— খোঁজ পাওয়া গেল না। তোমরাও কেউ খোঁজ করলে না। আমার কাছে একটা খাতা ছিল। জেলে যাবার আগে সুধাময় বাবু নামে পার্টির এক কর্মীর কাছে রাখতে দিয়েছিলাম। পরে খোঁজ পেলাম, ভদ্রলোক ইন্ডিয়ায় চলে গেছেন। কীরকম অদ্ভুত কাণ্ড দ্যাখো— ওর কবি হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু ও এসে গেল রাজনীতিতে। তখন বুঝতাম না, মনে হত, অমন ভালো কর্মী আর হয় না। যা করতে বলা হত, তা সম্পূর্ণ না-করা পর্যন্ত স্বস্তি পেত না সে। এখন বুঝি, রাজনীতিতে থাকলেও ওর প্রধান কাজ ছিল কবিতা লেখা।

এ পর্যন্ত বলে সে থামে। হাত বাড়িয়ে গ্লাস নিয়ে পানি খায়। তারপর আবার আরম্ভ করে, মনির মৃত্যুটা আমার কাছে মস্তবড় একটা প্রশ্ন হয়ে রয়েছে। ভাবো তো, একটা ছেলে লেখাপড়া ছেড়ে দিল শুধু রাজনীতি করবে বলে? মানুষ কবে মুক্ত হবে, সেই আশায় অধীর হয়ে থাকত সর্বক্ষণ। সবসময় মুখে ওর ঐ এক কথা— দেখিস, মানুষের কষ্টের এই শেষ হল বলে— শেকল ছেঁড়ার আর দেরি নেই। একটা আন্দোলনের খবর শুনলে ও উৎসাহে একেবারে ফেটে পড়ত।

‘৫৭ সালের দিকে সন্দেহটা প্রথম জাগে। তার আগে দুএকজন পার্টির গোপন কর্মীদের সঙ্গে মোটামুটি যোগাযোগ হয়েছে। ধারণা দেওয়া হয়েছিল, অসাধারণ পার্টির ক্ষমতা- গ্রামে গ্রামে সেল তৈরি হয়ে আছে- কর্মীরা সব তৈরি, শুধু ডাক দেবার অপেক্ষা, একবার ডাক দিলেই বিপ্লব আরম্ভ হয়ে যাবে। কিন্তু দেখা গেল ‘৫৮ সালের আয়ুবি হামলাতেই পার্টির কর্মীরা আশ্রয় খুঁজে পাচ্ছে না। ‘৫৭ সালে যে-দল সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিল, সেই দলের সঙ্গে নাকি সহযোগিতা করে যেতে হবে। প্রশ্ন করা হল, কেন? তো তার কোনো জবাব নেই। বলা হল, ওপরের নির্দেশ— নেতৃত্বে বিশ্বাস করো— নেতারা বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ করে দেখেছেন— আপাতত সহযোগিতাটাই দরকার প্রথমে।

মনি নির্দেশ মেনে নিল। ‘৬২-তে সে ছাত্রফ্রন্টের সঙ্গে ছিল, আন্দোলন যখন তুঙ্গে, আপোষকামীরা সরকারের সঙ্গে আপোষের জন্যে হাত বাড়িয়ে দিল। জানানো হল, আপাতত আপোষই হোক, ঐ আপোষকামীদের দলের সঙ্গেই সহযোগিতা করতে হবে। আমরা তখন জেলে— মনি বাইরে ছিল। শুনেছি তখনও মনি প্রশ্ন তুলেছিল, যারা আপোষ করবে, তাদের সঙ্গে মিলে আন্দোলনে যাওয়া কেন? সেবারও ঐ একই জবাব শোনা গিয়েছিল— নেতৃত্বে আস্থা রাখো— নেতারা অনেক বেশি জানেন। আগে ভালো কর্মী হও— তারপর প্রশ্ন কোরো।

সেজানের গলার স্বর ধারালো হয়ে উঠতে চায়। রাখী লক্ষ করে, ধীর, শান্ত, গুনগুনানি আলাপের স্বরটা এখন আর শোনা যাচ্ছে না। রাখী জানত না এত কথা। মনি ভাইকে অস্থির হতে দেখেছে সে। রাতের পর রাত জেগে থাকত— বিশ্বাসের কথা বলত, আস্থার কথা বলত। কিন্তু আসলে যে জ্বালাটা কোথায় ছিল, তা রাখীকে কেউ কখনো বলেনি। রাখী আগ্রহী চোখ মেলে রাখল সেজানের দিকে।

মনি তারপর প্রশ্ন করা বাদ দিল। সে জেনে নিল। ভালো কর্মী হওয়া দরকার আগে— জনগণের কাছাকাছি থাকা প্রয়োজন। সে গ্রামে যাবার জন্য খোঁজখবর করতে লাগল। বন্ধুরা বলল, যেও না- সবাইকে গ্রামে গিয়ে কাজ করতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। সে শুনল না। চেনাজানা এক ভদ্রলোকের কাছ থেকে চিঠি নিয়ে- প্রথমে নীলফামারীর দিকে গেল। সেখানে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই লোকজনের সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠল। অল্পবয়সী ছেলেরা খুব মানতে লাগল তাকে— বয়স্ক লোকেরা ভালোবাসল। ঐ যে তার গুণ, সবাই তাকে ভালোবাসবে- সবাই তাকে ভালোবেসে কাছে টেনে নিল। কিন্তু সে আর ক’দিন? আমার আত্মীয় ভদ্রলোক চিঠি লিখে জানালেন, এ কাকে পাঠিয়েছ তোমরা? এ তো সর্বনাশ করে দেবে। ক্ষেতমজুরদের খেপিয়ে তুলছে, আধিয়ারদের উস্কানি দিচ্ছে— শিগির একে নিয়ে যাও, এ তো একেবারেই বদ্ধ পাগল। শুধু আমার আত্মীয়টিই নয়, পার্টির স্থানীয় লোকটিও একজন জোতদার- তিনি সম্ভবত ওপরের দিকে অভিযোগ করেছিলেন। সুতরাং আমরা লিখলাম- ফিরে এসো, সবাইকে খেপিয়ে তুললে কোনো কাজ হয় না।

এরপর মনি আর কী করে? ঐ এলাকায় থাকা তার চলে না। সে উধাও হল সেখান থেকে। চলে গেল আরো ভেতরে। ছ’মাস তার খবর নেই। এই ছ’মাস সে ক্ষেতমজুরদের সঙ্গে নিড়ানির কাজ করেছে, বৃষ্টিতে ভিজেছে, কোদাল দিয়ে মাটি কুপিয়েছে, নাইট ইস্কুলে পড়িয়েছে, জোতদারদের ভাড়াটে গুণ্ডাদের সঙ্গে লাঠালাঠি করেছে। তারপর আর পারেনি একসময়। শরীর আর চলেনি। মন তখন এক হতাশা থেকে আরেক হতাশায় পড়ে পড়ে অবসন্ন। মনি শেষপর্যন্ত মরে গেল।

সেজান থামে। ঘরের ভেতরে বাতি দিয়ে গেছে ইতিমধ্যে। দেয়ালে একটা টিকটিকি শব্দ করে ডেকে ওঠে— অনেকদূরে কে যেন কাকে চিৎকার করে ডাকছে— তার ক্ষীণস্বর ঘরের ভেতরেও শোনা যাচ্ছে। সেজান পানির গেলাশটা আরেকবার হাত বাড়িয়ে নিতে গেলে দেয়ালে প্রকাণ্ড ছায়া পড়ল। রাখী তখন মৃত্যুশয্যায় শায়িত নিজের ভাইয়ের চেহারা দেখতে পাচ্ছে মনের ভেতরে।

সেজান থেমেও থামে না। কেমন স্বগতোক্তির মতো বলে, মনিকে আমি কখনো ভুলতে পারি না। আমি বুঝতে পারি না এখনো, কেন মনি মরল? একি শুধুই জেদ নাকি অভিমান- নাকি অন্যকিছু প্রমাণ করে গেছে ও মরে গিয়ে?

মনি ভাইয়ের কথা শেষপর্যন্ত শেষ হয়। তারপর সেজান আর কিছু বলে না। বলতে চায় না বোধহয়। রাখী তারপরও বসে থাকে অনেকক্ষণ। শেষ একসময় উঠে চলে আসে।

চলে আসে রাখী। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে চলে আসে ঐ দীর্ঘশ্বাস, ঐ বিষাদ, ঐ নিঃশব্দতা। মনের ওপর ভার হয়ে থাকে। তার অস্তিত্বের মর্মমূলটাকে ধরে পিষতে থাকে। রাজনীতি সে বোঝে না— বুঝতে চায়ওনি কখনো। কিন্তু মনে হয়, অন্তত মনি ভাইয়ের ঘটনাগুলো জানবার পর মনে হয়, মনি ভাইয়ের মৃত্যুর দরকার ছিল। মনের ভেতরে দেখতে পায় মনি ভাই দাঁড়াতে চেষ্টা করেছে একটা প্রকাণ্ড ভণ্ডামির বিরুদ্ধে, একটা প্রকাণ্ড প্রতারণার বিরুদ্ধে, একাকী, তবু শক্তপায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে চেয়েছে। শুধু বিশ্বাসে পৌঁছতে পারত, যদি কেউ তাকে বলে দিত, তুমি যা করছ তা-ই ঠিক, তাহলে হয়তো তাকে মরতে হত না। নিজের ভালোবাসা আর অবিশ্বাস, ইচ্ছে আর সন্দেহ- এই দুয়ের খুনোখুনির মধ্যে তাকে পড়তে হল, আর তাতেই রক্তাক্ত হয়ে সে মরে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *