ত্রয়ী উপন্যাস -প্ৰথম পৰ্ব
ত্রয়ী উপন্যাস - দ্বিতীয় পৰ্ব
ত্রয়ী উপন্যাস - তৃতীয় পৰ্ব

পূর্বরাত্রি পূর্বদিন – ১৪

চৌদ্দ

একেক সময় মনে হয় প্রলাপ। আবার মনে হয় প্রলাপ নয়, রাখী খুব সহজ কথা বলছে। এমন কথা, যা সহজেই ভেতর থেকে বার হয়ে আসে। মনে হয়, রাখী নয়, রাখীর শরীর কথা বলছে, মন কথা বলছে, সুমিতাকে শুধু শুনে যেতে হয়।

সেদিন শোক দিবস। ঢাকা শহর রাস্তায় নেমে এসেছে সেদিন। সকালবেলার দিকেই রাখীই ডাকল, চল্ সুমি, বেরোই।

সুমিতার ভয় করে। পাশ কাটাতে চায়। বলে, রাখী তুই অবুঝ হোস না- নিজের শরীরের দিকে তাকিয়ে দ্যাখ্ একবার।

রাখী হাসে, তুই কী ভাবিস আমাকে? আমি কি এতই দুর্বল? আমার কিছু হবে না দেখে নিস। ভাব্ তো, কতদিন ঘরের মধ্যে বসে আছি? আর ভালো লাগে না।

অবুঝ রাখীকে নিয়ে বেরুতে হয়।

তখন শেষ জানুয়ারিতে হালকা রোদ। স্লোগান হবার কথা নয়— তবু দূরে মেঘের ডাকের মতো স্লোগান হচ্ছিল। আর শোনা যাচ্ছিল পায়ের আওয়াজ। মানুষ রাস্তা দিয়ে কেবলি যেন হেঁটে যাচ্ছে-হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ মানুষ একদিক থেকে ক্রমাগত আরেক দিকে চলে যাচ্ছে।

দুজন হাঁটতে হাঁটতে মোড় পর্যন্ত আসে-সেখানে দাঁড়ায়। আকাশে হেলিকপ্টার টহল দিতে বেরিয়েছে। ভোঁ ভোঁ করে পুলিশের টহলগাড়ি ছুটে গেল। আসল মিছিল অনেক দূরে। তবু যেন মিছিলের মানুষ দেখা যায়। রাখী বলে, সুমি আমার ছেলের নাম দেব কী, জানিস?

কী?

আমার ছেলের নাম দেব সেজান।

কী পাগলের মতো কথা তোর, তাই কি হয় নাকি?

কেন হবে না, আমার ছেলের নাম আমি দেব তাতে কার কী?  

সুমিকে চুপ করে থাকতে দেখে বলে, তুই সংসারের নিয়মকানুনের কথা ভাবছিস?— কিন্তু আমি তোদের ঐসব নিয়মকানুন যদি না মানি, তাহলে কী হয়? দেখিস তুই, ওর নাম আমি সেজান দিই কি না।

সুমিতা রাখীর মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে থাকে। দেখে, সেখানে কোমল হাসি ফুটছে। করুণ বিষাদ দিয়ে ঘেরা কিন্তু তবু ভারি কোমল সে হাসিটুকু।

দুজনে ফিরে আসে। রাখীর কথা তখনো ফুরোয় না। যেন মজার ব্যাপার কিছু। জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা তুই তো ডাক্তার, আমার ছেলে এখন শব্দ শুনতে পায়?

সুমিতার হাসি পায়। বলে, পায় বোধহয়।

এই মিছিলের শব্দ শুনতে পাচ্ছে?

এই সময় রাখী নিজের পেটের ভেতরকার ছেলেকে ডাকে, এই সেজান, শুনতে পাস? পায়ের শব্দ শুনতে পাস, স্লোগান শুনতে পাস? আমি তোর মা বলছি, শুনতে পাস?

সুমিতা আর অবাক হয় না, এখন ভয়ও পায় না। এমনিতেই রাখীর শারীরিক অবস্থা খুব ভালো। ক’দিনের মধ্যে মনের দিকে থেকেও স্বাভাবিক হয়ে উঠল। একদিন সাদেক সাহেবের কাছ থেকে সেজানের মৃত্যুর খবরটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানল। শোনা শেষ হলে লম্বা নিশ্বাস নিয়ে সুমির সঙ্গে উঠে এল। রাস্তায় আসবার সময় বলল, শরীরের যত্ন নেবে, এরকম কিন্তু কথা দিয়েছিল আমাকে।

একটু পর আবার নিজের থেকেই মন্তব্য করল, আসলেই ওর মতো লোকের পক্ষে আপনজনকে কথা দিয়ে কথা রাখা খুব মুশকিল, তাই না? ২৭শে জানুয়ারি গেল, কিন্তু ফুরাল না। ঢাকা শহরকে ধরে ধরে কেউ যেন ঝাঁকুনি দিচ্ছে। শুধু ঢাকা শহর নয়, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, খুলনা- গোটা দেশ তখন এপাশ-ওপাশ ফিরছে। সুপ্রাচীন বাসনার উল্লাস নিয়ে, আদিম ক্রোধের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আর রক্তিম ভালোবাসার পতাকা উড়িয়ে- মানুষ ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে এসেছে। সব ইচ্ছে এখন বাইরে ছড়ানো। সুমিতা ঐ ২৭ তারিখের পর থেকে আর আসতে পারে না। ভয়ানক ব্যস্ত ও। সাদেক সাহেব মাঝে মাঝে টেলিফোন করেন। বলেন, ভালো আছ তো? আব্বাও কেমন যেন খেপে উঠেছেন। রোজই বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছেন আর ফিরছেন নানান খবর নিয়ে। রাখীর এখন শুধু সন্তানের জন্য অপেক্ষা, এপ্রিল এখনো দূরে। কিন্তু এই অপেক্ষাতেও রাখীর ক্লান্তি নেই, শূন্যতা নেই, নিঃসঙ্গতা নেই।

একেক দিন মিছিল দেখে রাস্তায় নেমে পড়ে। কোনোদিন য়ুনিভার্সিটির গেটের কাছে, কোনোদিন গুলিস্তানের মোড়ে, কোনোদিন প্রেসক্লাবের সামনে। আর হাঁটে রাখী। শীতের বাতাস টাল খেয়ে যায় দালানে দালানে ধাক্কা লেগে। রাখী তখন মনে-মনে ছেলেকে ডাকে। বলে, দ্যাখ্, এখানে আমি হেঁটেছিলাম— তুইও হাঁটিস এখান দিয়ে, এখানে দাঁড়িয়ে আমি মিছিল দেখেছিলাম— তুইও দেখিস এইখানে দাঁড়িয়ে, সেজানের সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল এখানে, এই গাছতলায়- এখানে তুইও দাঁড়াস, আর এই-যে রাস্তাটা, এই রাস্তায় সেজান মিছিল নিয়ে এগিয়ে গিয়েছিল— তুইও এই রাস্তা দিয়ে মিছিল নিয়ে এগিয়ে যাস, হ্যাঁ রে, পারবি তো?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *