ত্রয়ী উপন্যাস -প্ৰথম পৰ্ব
ত্রয়ী উপন্যাস - দ্বিতীয় পৰ্ব
ত্রয়ী উপন্যাস - তৃতীয় পৰ্ব

দক্ষিণায়নের দিন – ৫

পাঁচ

তখন সন্ধ্যা হচ্ছে। রাখী আকাশে চোখ ফেরাল, রঙ ধরেছে মেঘে মেঘে। ফুলার রোডের দুপাশের গাছপালায় কীরকম একটা ভেজা-ভেজা অন্ধকার। মস্ত তেঁতুলগাছটার কাছে যেতেই লক্ষ করল একটা কাঠবেড়ালি তেঁতুলগাছের গুঁড়ি বেয়ে দ্রুত ওপরে উঠে গেল। জারুলগাছের পাতার বেগুনি রঙের উজ্জ্বল ফুলগুলো অন্ধকারেও নজরে পড়ে। ওদিকে কী একটা গাছে নতুন ফুল এসেছে-এটাই কি নাগকেশর? রাখী চিনতে পারে না।

ঐটুকু পথ যেতে যেতে একসময় দপ করে রাস্তার সব বাতি একসঙ্গে জ্বলে উঠল। রাস্তার ওপরকার সন্ধ্যার অন্ধকার আর বাতির আলো একাকার হয়ে গেল নিমেষে। ডাইনে নতুন য়ুনিভার্সিটি বিল্ডিং কনস্ট্রাকশনের জন্যে বাঁধা ভারার বাঁশগুলো সন্ধ্যাকাশে নানান আঁকিবুকি রেখা টেনে রেখেছে। সামনে লম্বা লাইন, রেলওয়ে ক্রসিং বোধহয় বন্ধ, নিউমার্কেটের খদ্দেরদের গাড়ি সব আটকে রয়েছে। রিকশটা দাঁড়িয়ে পড়তেই সে ডাইনে বাঁয়ে তাকাল। গাড়ির তাহলে এখনো অনেক দেরি। বাঁয়ে য়ুনিভার্সিটি টিচার্স কলোনি গড়ে উঠেছে। নির্মীয়মাণ দালানগুলো দেখে জামান সাহেবের কথা মনে পড়ল। জামান সাহেব সম্ভবত এইসব দালানের কোনো একটাতে বাস করবেন। হামিদ স্যারের কী কষ্ট। একদিকে ভাই বোন মা মিলিয়ে সংসার, অন্যদিকে ফ্যাশনপাগল কালচারিকা বউ। রাখীর হাসি পেয়ে গেল কথাটা মনে পড়াতে। কার যেন তৈরি-করা শব্দ? মেহের না রোকেয়া? বাংলার দুই মানিকজোড় সখী। রাখী জিজ্ঞেস করেছিল, যারা কালচার-টালচার করে ওদের কী বলব এককথায়? শুনে সঙ্গে সঙ্গে মেহেরই বোধহয় বলেছিল, কালচারিকা। রোকেয়া বলেছিল, কালচারিক্শী। শব্দদুটোর মধ্যে কালচারিকা চালু হয়ে গিয়েছিল সে বছর। হামিদ সাহেবের জন্যে খারাপ লাগে, স্ত্রীকে ভালোওবাসেন এদিকে খুব, ওদিকে আবার কিছু বলতেও পারেন না।

একখানা নতুন গাড়ি পাশে এসে ব্রেক কষে দাঁড়ালে পেছনের সিটে আসীন মহিলাকে দেখে রাখীর ভ্রূ কুঁচকায়-কে, রুবি না? ওমা! রুবির বরের টাক কোথায় গেল? বিয়ের দিন না ভারি সুন্দর টাক দেখেছিল। নাকি এ অন্য লোক, রুবি ইতিমধ্যে আর কাউকে জুটিয়েছে। রুবির সাজগোজ দেখবার মতো। সেকেন্ড ইয়ারে উঠেই বলতে শুরু করে দিয়েছিল, আমি ভাই বড়লোক দেখে বিয়ে করব। টাকাপয়সা নেড়েচেড়ে দেখবার বড় সাধ আমার।

রুবিকে ডাকতে চেয়েও ডাকে না রাখী। মনে হল, রুবি সুখী হয়েছে। সুখী না হলে অমন করে সাজে কেউ? অমন করে বরের পাশে বসতে পারে? এ বরং বেশ হয়েছে। পরীক্ষা পাস করে কী লাভ হত ওর? তাছাড়া পড়াশোনা করতে চায়নি রুবি। পষ্টাপষ্টি বলত, পড়ছি, অন্যকিছু করার নেই বলে, পাস করে বিপদে পড়ব নাকি? ঐ পাসটাসের মধ্যে আমি বাপু নেই—কোনো শালা পুরুষমানুষ বউ বেশি লেখাপড়া জানুক তা পছন্দ করে না।

বেশ মজার মেয়ে ছিল রুবি। পালিশ করা মুখ ছিল ওর। অশ্লীল কথা সে নাগাড়ে অনর্গল বলে যেতে পারত।

রাখী ডাকেনি। কিন্তু ততক্ষণে রুবি দেখে ফেলেছে তাকে। ডাকছে, রাখী, রাখী-ই। গাড়ির জানালা দিয়ে গলা বাড়িয়ে দিয়েছে রুবি। রাখী হাত তুলল, ভালো আছ? ব্যস্, ঐ পর্যন্ত, লাইন দেয়া গাড়ি চলতে শুরু করে দিয়েছে তখন। ইচ্ছে থাকলেও দাঁড়াবার উপায় নেই।

নাসিমা বাসায় নেই। ওর মা বলেন, এই তো মিনিট কয় আগে দুজনে বেরিয়ে গেল, বোধহয় কাছাকাছি কোথাও গেছে, তুমি বসো। রাখী নাসিমার মাকে দেখঝল। আরো উজ্জ্বল হয়েছেন। উজ্জ্বল কিন্তু শান্ত, নাসিমার মতোই।

রাখী দোতলার ব্যালকনি থেকে নিচে তাকিয়ে দেখল। তার হঠাৎ খারাপ লাগল। বাসা থেকে বেরিয়ে য়ুনিভার্সিটি গিয়েছিল। সেখান থেকে নার্গিসের ওখানে, নার্গিসের কাছে থেকে এখানে। কারো সঙ্গে দেখা হল না। অথচ আজ না তার হাসান ভাইয়ের সঙ্গে বেরুবার কথা ছিল, সে নাসিমার মায়ের কাছে থেকে বিদায় নিয়ে নিচে নেমে এল। এবং তারপর রিকশয় চেপে সোজা বাড়ি।

বাড়ি ফিরেও রাখীর মনখারাপ ভাবটা কাটে না। সারাবাড়ি চুপচাপ। আব্বা খলিল সাহেবদের ওখানে গেছেন, তার মেয়ের পানচিনি। হাসান ভাই নেই, বুবু একাকী বারান্দায় দাঁড়িয়ে। রাখী নিজের ঘরে কাপড় বদলে কিছুক্ষণ বিছানায় গড়াল। গড়াল আর ভাবল। কোনো মানে হয় না, মিছিমিছি সে বাইরে গিয়েছিল! য়ুনিভার্সিটি যাওয়ার সত্যিকার কোনো দরকার ছিল না। নার্গিসের কাছেও কোনো প্রয়োজন ছিল না। আর নাসিমার কাছে যাওয়া তো শুধু কৌতূহলের জন্যেই। কোনো মানে হয় না এইভাবে ঘুরে বেড়ানোর। সে নিজেকে শাসন করে। বলে, এইভাবে এলোমেলো ঘুরে ঘুরে তোর কী লাভ হয়?

নাকি সে চাইছিল? নিজেকে তিরস্কার করার পরও প্রশ্ন জাগে মনে। সে মনে-মনে চাইছিল জামান সাহেবের সঙ্গে যেন দেখা হয়। নাকি নার্গিসের প্রেমচর্চার নতুন গল্প শোনার জন্য লোভ হয়েছিল তার? আর নাসিমার নতুন অভিজ্ঞতার বর্ণনা শুনতে পারে সেই আকর্ষণই কি তাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল আজিমপুর পর্যন্ত?

এইরকম প্রশ্ন রাখীকে ভয় পাইয়ে দেয়। সে মনের ভেতরে আরো এলোমেলো হয়ে যায়। কেন সে বাইরে বেরুতে চাইছে? এর কারণ কি শুধু উদ্দেশ্যহীনতা? উদ্দেশ্যহীনতার জন্যেই কি সে এইরকম এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে? তাই যদি হয়, তাহলে হাসান ভাইয়ের চাকরির প্রস্তাবটাই-বা এড়াতে চাইছে কেন?

রাখী ভেবে ভেবে কূল পায় না।

হাসান ভাইয়ের মুখোমুখি হতে সঙ্কোচ হচ্ছিল, তবু সে মুখোমুখি হল। হাসান ভাই সোজাসুজি জিজ্ঞেস করল, কই, তুমি তো কাল আমার সঙ্গে গেলে না? ভদ্রলোককে আমি বসিয়ে রেখেছিলাম তোমার জন্যে। ছি ছি, এরকম হবে ভাবলে তোমার চাকরির ব্যাপারে আমি কথা বলতাম না। হাসান ভাই বিলক্ষণ চটেছে, রাখী বুঝল। কিন্তু কিছু বলল না। জানে, বলে কোনো লাভ নেই। যা ইচ্ছে, যতক্ষণ ইচ্ছে, এখন বলবে হাসান ভাই।

হাসান ভাই বলে চলল, তুমি এমন ইরেসপনসিবল হবে, আমি ভাবতেই পারিনি। আজকাল এমন চাকরি কেউ সহজে পায়? আর তুমি কোনো পাত্তাই দিলে না? স্ট্রেঞ্জ, এরকম তো ছিলে না তুমি?

একনাগাড়ে বকাবকি করে একসময় হাসান ভাই চলে গেল। আব্বা শুনেও যেন শুনলেন না। বুবু কিছুটা অনুযোগ করল। বলল, তোর যাওয়া উচিত ছিল রাখী, বলেছিলি যখন যাবি-তবু একটা কাজ হত-এভাবে ঘরে বসে থেকে লাভ কী? রাখী অপ্রস্তুত হল, লজ্জা পেল। বোকার মতো হাসতে চেষ্টা করল। শেষে বলল, কাল ঠিক যাব, দেখো তোমরা।

সেদিন ঠিকই হাসান ভাই নিয়ে গেল। সাততলা বাড়িটা মাথা উঁচু করে দেখে সে। ট্রাভেল এজেন্সির অফিস। এককথায় নাম : ওভারসিজ। কাচের দেয়ালের ওপরে নানা এয়ারলাইনের বিজ্ঞাপন। দুতিনটে প্লেনের মডেল সাজানো। একটা লম্বা ঘর পার হয়ে যেতে হয়। ঘরে বেশ কয়েকটা টেবিল, কয়েকজন মানুষ কাজে ব্যস্ত। দুটি মেয়েকেও দেখে সে। টেবিলের সারি পার হয়ে দুপাশে দুখানা কামরা, তারপরে বড় সাহেবের ঘর।

ভেতরে ঢুকতেই এক ভদ্রলোক চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন, হ্যালো। তারপর হাত বাড়িয়ে রাখীকে বসতে বলেন।

হাসান ভাই জানাল, আজ একেবারে সঙ্গে নিয়ে এসেছি। রোকেয়া রাশেদ, রাখীর নাম বলে হাসল হাসান ভাই। তারপর আবার বলল, মিস রোকেয়া রাশেদ! এরই কথা বলেছিলাম, মাই সিসটার-ইন-ল।

মাজহার খান পরিপূর্ণ চোখ তুলে রাখীর মুখের দিকে তাকালেন। বলেন, আপনার কথা হাসান সেদিন বলেছিল, আপনি আসাতে খুশি হয়েছি।

চাকরিটা যেন তৈরি হয়েই ছিল। রাখীর সঙ্গে কথাবার্তা হল থেমে থেমে। ভদ্রলোক হাসান ভাইয়ের সঙ্গেই নানান কথায় মেতে রইলেন। একফাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, কিছু করছেন এখন?

জি না।

সে কী! স্ট্রেঞ্জ। কিছুই করছেন না?

হাসান ভাই জবাব দিল রাখীর হয়ে। বলল, শি ইজ ট্রাইয়িং ফর অ্যান ওভারসিজ স্কলারশিপ। তা বোধহয় দেরি হবে পেতে-একেবারে ঘরে বসে থাকার চাইতে—

ও শিওর।

রাখীর মনে হল মাজহার খান খুশি হয়েছেন। বলেন, কালই জয়েন করুন। অ্যাপয়েন্টমেন্ট অ্যাপ্রুভড হয়ে আসবে করাচি থেকে, তবে ওতে অসুবিধে নেই। এখানকার ব্যাপারে ঢাকা অফিস যা করে, সেটাই হয়।

শুধু শুনে গেল সে। মাজহার খান চাকরির ব্যাপারে যত-না কথা বলেন, তার চাইতে অনেক বেশি বলেন ব্যবসার ব্যাপারে। আর সব কথাই হল হাসান ভাইয়ের সঙ্গে। কারা কোথায় নতুন কোম্পানি খুলছে সেই নিয়ে নানাবিধ মন্তব্য দুজনার। ঢাকায় যে ব্যবসা আরো বাড়বে, সেই কথা হল। ফাইভ ইয়ার প্ল্যানের ব্যাপারটা যে ভাঁওতা নয়, শিগিরই টাকাপয়সা এসে যাচ্ছে—এসব কথাও উঠল। রাখী শুধু শুনে গেল। এ যেন আলাদা একটা জগৎ। মনে হচ্ছিল তার চিরকালের চেনা জগতের একেবারে বাইরে কোথাও এসে পড়েছে সে। শুধুই শোনা, তার বলবার কিছু নেই।

একসময় মাজহার খান রাখীর দিকে তাকিয়ে বলেন, কিছু যদি মনে না করেন তাহলে অনুরোধ করছি, আপনারা আমার সঙ্গে লাঞ্চে আসুন!

রাখী অপ্রস্তুত হয়। অপ্রস্তুত এবং বিব্রত। সেটা লক্ষ করে হাসান বলে, এক্ষুনি যদি কোনো কাজ না থাকে তাহলে ক্ষতি কী—

রাখী তবু বলে, না, ধন্যবাদ। এক জায়গায় আমাকে যেতে হবে।

মাজহার খান হাসলেন একটুখানি। বলেন, তাহলে খুলেই বলি। ওভারসিজ-এর ম্যানেজিং পার্টনার নাদভী সাহেব এসেছেন, তিনিও লাঞ্চে থাকবেন। তাহলে আপনার চাকরির ব্যাপারটা আজই পাকাপাকি হয়ে যেত!

তবু রাখী কিছু বলতে পারে না। এমন পরিস্থিতিতে সে জীবনে পড়েনি। হাসান ভাই জানালেন, ঠিক আছে, তাহলে আমরা থাকছি। কতক্ষণের আর ব্যাপার।

রাখী দেখে, শুধু দেখে নয়, বরং বলা যায় অনুভবও করল। দিনের বেলাতেই বাতি জ্বলছে। টাইপ মেশিনের অনবরত পটপট শব্দ, অ্যাংলো মেয়েটি কী যেন লিখে চলেছে। ওদিকে জুতোর চলাফেরার শব্দ হচ্ছে। গোটা পরিবেশটাই অন্যরকম।

বাসায় ফিরে এসে রাখী চুপ। চাকরি হয়েছে শুনেও আব্বা কিছু বলেন না। যেন জানতেন, চাকরিটা রাখীর হবেই। বুবু জিজ্ঞেস করে, কেমন লাগল? রাখী জবাব দিতে পারে না। কেন পারে না, তাও সে বুঝতে পারে না। আসলে খারাপ লেগেছে বলতে পারলে কথা ছিল। কিন্তু নাদভী সাহেব, মাজহার সাহেব সুন্দর ভদ্র ব্যবহার করলেন। বিশেষ করে নাদভী সাহেব প্রচুর আগ্রহ দেখিয়েছেন। লাঞ্চ শেষে নাদভী সাহেব বিদায় নেয়ার পর মাজহার খান অফিসে ফিরে এসে জানালেন, মিস রাশেদ, আপনি থাকাতে খুব ভালো হয়েছে। নাদভী আপনাকে দেখে দারুণ ইম্প্রেসড হয়েছেন। বলছিলেন, এরকম একজন ডিগনিফায়েড লেডিরই দরকার ছিল। আপস্টার্ট ফাস্ট মেয়েদের যা চলাফেরা, তাতে ফার্মের প্রেস্টিজের কথা ভাবতে হয় সবসময়।

আগাগোড়া সর্বক্ষণ মাজহার সাহেব রাখীর দিকে নজর রেখেছেন। রাখী ভদ্রলোকের চোখে কেমন একটা বিচিত্র দৃষ্টি লক্ষ করেছে। কে জানে, ভদ্রলোক বাঙালি নন বলেই হয়তোবা তার দৃষ্টিতে ‘মমন নিঃসঙ্কোচ ভাব। একেকবার মনে হচ্ছিল, ভদ্রলোক বোধহয় তাকে যাচাই করে দেখছেন। প্রত্যেকটা ভঙ্গি হিশেব করে মাপছেন।

নাদভী সাহেব মাজহার সাহেবের চাইতেও কমবয়সের মানুষ। অন্তত চেহারায় তাই মনে হল। খোলাখুলি চোখ মেলে তাকিয়ে দেখেননি।

চোখেমুখে সঙ্কোচের একটা ভাব সবসময়ই ছিল। তবে আগ্রহের সঙ্গে কথা বলেছেন। আর নিজের মনে নিঃশব্দে হেসেছেন।

রাখীর তখন, হ্যাঁ সেই মুহূর্তেও, জামান সাহেবের কথা মনে পড়েছে। জামান সাহেব কখনো এঁদের মতো কথা বলেন না। না, অন্তত মাজহার সাহেবের মতো চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে সে কখনো দেখেনি। সবাই ভালো ব্যবহার করলেন। একটা ভালো মাইনের চাকরিও তার হয়ে গেল। হ্যাঁ অতি সহজেই হয়ে গেল। কিন্তু তারপর? তারপর কী হবে? রাখীর কথাটা হঠাৎ মনে হতেই অস্বস্তি লাগতে আরম্ভ করল, এ চাকরি সে করতে পারবে কি?

রাখী জানে না, পারবে কি না। কোনোদিন যে এ-ধরনের কাজ করতে হবে একথা সে স্বপ্নেও ভাবেনি। যত ভালো ব্যবহারই করুন তারা, শেষপর্যন্ত নিজেকে ভারি অপরিচিত আর অনাহূত মনে হচ্ছিল সেখানে। মানুষগুলো, সাজানো চেয়ার টেবিল, লম্বা ঘরখানা, সব যেন অন্যরকম। নিজের জীবনের সঙ্গে এসবের কোথাও কোনোরকমের সামঞ্জস্য খুঁজে পায় না সে।

সারাটা বিকেল বসে বসে ভাবল। প্রায় শেষ বিকেলে যখন উঠতে যাবে, তখন বুবু এল ঘরে। এসে জিজ্ঞেস করল, রাখী চাকরিটা তোর ভালো লাগেনি, তাই না?

বাহ্, সেকথা কখন বললাম, রাখী অবাক হয়।

বুবু রাখীর চেহারা দেখেই সম্ভবত হাসে। বলে, এতে মন খারাপ করার কী আছে, ভালো না লাগে যাস না-যা ভালো না লাগে তা করতে যাবি কেন?

রাখী বিব্রত হয়। কিন্তু তবু নিজেকে লুকোয় না। বলে, আসলে জানো বুবু, আমি ঠিক বুঝতেই পারলাম না, চাকরিটা আমার কেমন লাগল। সব কেমন যেন নতুন—বুঝতে পারছি না শেষপর্যন্ত কী হবে।

বুবু ঘর থেকে টেনে বাইরে নিয়ে এল। হাসান ভাই বলল, আমাদের খাওয়াটা কবে হচ্ছে ম্যাডাম?

রাতে খাওয়ার টেবিলেও আব্বা কিছু বললেন না। রাখী মুখোমুখি খেতে বসে বারবার করে আব্বার দিকে তাকিয়ে দেখছিল। আব্বা তার চাকরি সম্বন্ধে একটি কথাও বললেন না। রান্নার প্রশংসা করলেন। চিংড়ি মাছের মালইকারি অনেকদিন রান্না হ্য় না, বুবু এবার জলপাইয়ের আচার দেবে কি না, মরিয়মের মা দেশে গেলে যেন কাজের লোক দিয়ে যায়—এমনি অনেক কথা হল, তারপর খাওয়া শেষ করে উঠে গেলেন। রাখী চুপ করে থাকল, দেখল শুধু আব্বা কখনো এমন করেন না। সে বুঝতে পারে না, আব্বা তার চাকরি নেয়াটা পছন্দ করেছেন কি না।

নিজের ঘরে ফিরে এসে রাখী আবার একই ভাবনায় পড়ল। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ কাটাল। মনি ভাইয়ের কথা মনে পড়ল। মনি ভাই বেঁচে থাকলে কী বলত আজ? এম. এ. পাস করেছে, ছশো টাকা মাইনের চাকরি হয়েছে—শুনলে কী বলত মনি ভাই? আব্বার মতোই কি চুপ করে থাকত?

রাখী নিশ্চিন্ত হতে পারে না। তার প্রিয় আকাশের দিকে তাকায়। কেউ তাকে কিছু বলছে না, তার নিজের দিক থেকেও কোনো আপত্তির কারণ সে খুঁজে পাচ্ছে না। কিন্তু তবু সে সহজ হতে পারে না। সে বুঝতে পারছে না, ধরতে পারছে না, কিন্তু তবু মনে হচ্ছে, কোথায় যেন একটা বাধা থেকে যাচ্ছে। সেটা কোনোরকম সংস্কার থেকে, না নিজে সে এধরনের কাজের কথা কখনো ভাবেনি বলে, তা সে নিজেই বলতে পারে না।

তবু রাখীর কেমন আশা হয়, আব্বা হয়তো কাল সকালেই ডেকে বলবেন, রাখী, তোকে ও চাকরি করতে হবে না।

কথাটা ভেবে স্বস্তি পায়। মনে-মনে প্রার্থনা করে, আব্বা যেন ঐরকমই কিছু একটা বলেন।

তখন রাত হয়েছে। কে যেন পুরনো গানের সুরে গিটার বাজাচ্ছে। ফিলিমের গান বোধহয়। তবু অনেকক্ষণ ধরে কান পেতে শোনে রাখী। রাতের অন্ধকারে শহরের আকাশে আলোর আভা জেগে আছে কোথাও কোথাও। আকাশের বুক তারায় তারায় ছাওয়া। একবার মনে হল কেউ যেন কোথায় গান গাইছে। ভারী গলায়-ভারী, অথচ ভাঙা-ভাঙা গলায়-মৃদু স্বরে গান গাইছে। কান পাতল রাখী গান শোনার জন্য। কিন্তু শুনতে পেল না, চারদিকে চুপচাপ, নিঃশব্দ। তারপর আবার যখন সে আকাশভর্তি তারার দিকে চাইল, মায়ের কথা ভাবল, মনি ভাইয়ের কথা ভাবল-তখন আবার মনে হল- সত্যিই যেন কে গান গাইছে কোথায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *