ইঁদুর

ইঁদুর

একটা ইঁদুর খাটের তলা থেকে দৌড়ে বেরিয়ে সোজা এসে সুধীনবাবুর ইজিচেয়ারের তলায় ঢুকে গেল। তালতলার চটি থেকে পা-দুটো তাড়াতাড়ি চেয়ারের ওপর তুললেন তিনি। তুলেই হাঁক দিলেন, দেবেন।

দেবেন ছিল না। থাকে না। কখনোই ও আজকাল সময়মতো থাকে না হাতের কাছে।

চ্যাঁচামেচি শুনে শ্যামা দৌড়ে এল, বলল, কী হল বাবু?

সুধীনবাবু ওকে দেখে পা-দুটো নামিয়ে ফেললেন।

মুখে গাম্ভীর্য এনে বললেন ‘ইঁদুর’।

শ্যামা অনেক দিনের লোক। মা, মানে সুধীনবাবুর স্ত্রী থাকতেই সে দশ বছর এবাড়িতে কাজ করেছে। সুধীনবাবুর বড়োছেলে এবং মেজোছেলের বাচ্চারা সবাই শ্যামার হাতেই মানুষ। ওর শরীরে মায়া-দয়া আছে। বয়সও হয়েছে। কপালের দু-পাশের চুলগুলো সব রুপোলি হয়ে গেছে। নিজেরও গেঁটেবাত ডায়াবেটিসের কারণে বাবুর দুঃখ ও একটু বোঝে।

শ্যামা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, হুঁ:। ইঁদুরই তো! ঘর থেকে যে বাঘ বেরোয়নি এই যথেষ্ট! কী অবস্থা করেছে দেবেন ঘরটার! আর বউদিদেরও বলিহারি যাই। বুড়ো শ্বশুরের দিকেও তো মানুষ একটু দেখে! নিজেদের ঘরও তেমনিই। কী নোংরা, কী নোংরা।

সুধীনবাবু কখনো পরনিন্দা পরচর্চা প্রশ্রয় দেননি। এখনও দেন না। চাপা ধমক দিলেন তিনি শ্যামাকে। বললেন, আঃ শ্যামা। যাও, নিজের কাজ করো। দেবেন এলে পাঠিয়ে দিয়ো আমার কাছে।

শ্যামা গজগজ করতে করতে চলে গেল।

সিঁড়ির কাছে গিয়েই শ্যামা চুপ করে গেল। বউদিরা কেউ তার বক্তৃতা শুনতে পেলে আর রক্ষা নেই।

সুধীনবাবুর চোখ দুটো ভারী হয়ে এল। তাঁর আপন বলতে যে একমাত্র মানুষটি ছিল সেই নীহারিকাই চলে গেছেন দু-বছর হল। যদিও নীহারিকা থাকাকালীন তিনি যে তাঁর এতখানি আপন সেকথা পঁয়তাল্লিশ বছরের পার্টনারশিপেও কখনো বুঝতে পারেননি সুধীনবাবু। দাবি করার, জোর খাটানোর, ঝগড়া করার মানুষ ওই এক-জনই ছিল।

নীহারিকার ছবির দিকে তাকালেন একবার সুধীনবাবু। বড়োছেলে একটা অয়েলপেন্টিং করে এনেছে কাকে দিয়ে যেন অনেক পয়সা খরচা করে। বেঁচে থাকাকালীন সপ্তাহে একদিনও ছেলে মা বলে ডাকেনি, কী মা-বাবার ঘরে আসেনি পর্যন্ত। আর মায়ের মৃত্যুর পর ছবি বাঁধিয়ে এনে ভালোবাসার পরাকাষ্ঠা দেখাচ্ছে!

মেজোছেলে গত মৃত্যুদিনে কাগজের ফুলের একটা সাদা মালা এনে নীহারিকার ছবির গলায় পরিয়ে দিয়েছিল। এখন সে সাদা কাগজের ফুলের চেহারা হয়ে গেছে প্রায় রুদ্রাক্ষের মতো। এত ধুলো পড়েছে যে ছবি তো দূরের কথা, মালাটাতেও হাত ছোঁয়ানো যায় না।

মানুষটা চলে গেছে বলে কি কাগজের মালা পরিয়ে তাকে অবহেলা করতে হয় এমন করে? ছেলে-বউরা কি রোজ একটা করে সাদাফুলের মালাও নীহারিকার গলায় পরাতে পারে না? যে তাদের স্তন্যদায়িনী, যে কোলে-কাঁখে করে মানুষ করল, যে সারাজীবনে একদিনও স্বামীর সঙ্গে সিনেমা দেখতে গেল না পাছে ছেলে-মেয়েদের পড়াশুনোর ক্ষতি হয়, সেই মানুষটাকে? জন্মদাত্রী, পরমশুভার্থী মাকেও ওরা এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেল?

ভেবে, বড়োই কষ্ট পান সুধীনবাবু।

দেবেন এল। বলল, ডাকছিলেন?

সুধীনবাবুর কথা বলতে ইচ্ছা করল না। মুখে শুধু বললেন, ইঁদুর।

দেবেন ঘরে আসার আগেই শ্যামার মুখে শুনেছিল। বলল, আজ ইঁদুরের বিষ আনব। মজা টের পাবে বাছাধনরা।

সুধীনবাবু আস্তে আস্তে বললেন, ঘরে ইঁদুর চাষ করে তারপর বিষ দিয়ে মারা কেন? চাষটা বন্ধ করো-না ঘরে।

তারপর বললেন, প্রিভেনশন ইজ বেটার দ্যান কিওর।

সুধীনবাবু অভ্যেসবশেই বলে ফেললেন ইংরেজি। দেবেন ইংরেজিটা বুঝতে পারল না। বলল, ঝাড়ব ঘর। একা লোক চারদিকের কাজ সামলাতে পারি না। এই বড়দা ডাকল সিগারেট আনতে, মেজদা পান আনতে, তা-ও তো ছোড়দারা এবাড়িতে থাকে না, বাঁচোয়া। বউদিরা কি কম ডাকাকাকি করে? শুধু আপনার একার কাজ করলে নাহয় এসব ঠিক ঠিক করে রাখতাম।

এসব কথাতে সুধীনবাবু আজকাল সত্যিই বিরক্ত হন। এসব কথা শুনতে বা আলোচনা করতেও চান না তিনি। তাঁর একার কাজের জন্য তো দেবেনকে অথবা বাড়ির কাউকেই রাখা হয়নি। তাই এসব কথা কোনো ছেলে-বউয়ের কানে গেলে মিছিমিছি অশান্তিই বাড়বে। যতদিন নীহারিকা ছিলেন, ততদিন অন্য কথা ছিল। আজ তাঁর এই অবসরপ্রাপ্ত, কর্মহীন অপ্রয়োজনীয় জীবনে এইরকম তুচ্ছ বিষয় নিয়ে অশান্তি ভালো লাগে না। একা ঘরে ইজিচেয়ারে বসে যতই অনাদর অবহেলা পান, ততই যেন অসহায়তায় চোখের কোল দুটো জ্বালা করে। নীহারিকার কথা মনে পড়ে বার বার।

এই বয়সে সকলেই একটু দেব-দেবী গুরু-টুরুর দিকে ঝোঁকে। সুধীনবাবুর ওইসব দুর্বলতা কখনো ছিল না। সুধীনবাবুর ধারণা যে, যারা জীবনে অনেককানেক অন্যায় করে তারাই শেষজীবনে হঠাৎ ঠাকুরদেবতার শ্রীচরণে হুমড়ি খেয়ে পড়ে পাপক্ষালন করতে চায়। না, সুধীনবাবু যৌবনেও ওসব করেননি বার্ধক্যেও করবেন না।

সবচেয়ে মুশকিল হয় সময় নিয়ে। সময়ের ভার বড়ো ভার। যাঁরা বেশি বয়সে স্বামী হারান তাঁরা এতটা একা হয়ে পড়েন না, কারণ বিধবাদের পক্ষে সংসারের মধ্যে অনেকখানি সময় আদরেই হোক কী অনাদরেই হোক, কেটে যায়ই। কিন্তু বিপত্নীক পুরুষমানুষ সত্যিই বড়ো নির্জন। সময় তাঁদের বুকে পাথরের মতো চেপে বসে। কিছুতেই নড়তে চায় না। বই পড়ে সময় কাটাতেন আগে আগে, কিন্তু এখন চোখও বিদ্রোহ করছে। দু-টি চোখেই ছানি পড়েছে অথচ ম্যাচিয়োর করেনি যে কাটাবেন। সন্ধের পর টিভি দেখে সময় কাটে। তবু শনি-রবিবার বাংলা-হিন্দি সিনেমা যখন হয় তখন আজকাল আর দেখেন না। ছেলে-বউয়েরা বন্ধুবান্ধব নিয়ে জমিয়ে বসে সিনেমা দেখে। তাই হংসমধ্যে বক যথা হয়ে থাকতে খারাপ লাগে তাঁর।

একদিন আড়াল থেকে শুনেছিলেন, বড়োবউমা বলছিলেন কাউকে, বুড়োর রস কম নয়।

এসব শুনেও গায়ে মাখেন না বিশেষ সুধীনবাবু। মাখেন না এই কারণে যে, এ বাড়িটা তাঁর। তাঁর বাড়িতেই ছেলে-বউ নাতিপুতিরা রয়েছে। এই বাজারে আলাদা আলাদা বাড়ি নিয়ে থাকতে হলে প্রত্যেকেই বুঝত। বড়ো সরকারি চাকরি করতেন বলে এখনও মাসে হাজার টাকা করে পেনশন পান উনি। তা ছাড়া ফিক্সড ডিপোজিটের সুদও আছে। নিজের কোনো ব্যাপারে তো তিনি পরের মুখাপেক্ষী ননই উপরন্তু তিনিই ছেলেদের সংসারে প্রতিমাসেই নিজের সামর্থ্যের প্রায় সবটাই ঢেলে দেন। এ কারণেই, আর্থিক বিষয়ে কোনোরকম মানসিক দৈন্য কখনো বোধ করেননি। যতটুকু অবহেলা পান, সুধীনবাবু তা নিছক জেনারেশন গ্যাপ এবং নীহারিকার স্বার্থপরের মতো আগে চলে যাওয়ার দোষের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েই নিশ্চিন্ত থাকেন।

টেলিফোনটা বাজছিল। টেলিফোনটা নীচের বসার ঘরে আছে। ওঁর ঘরে একটা এক্সটেনশন আছে। টেলিফোনটা বেজেই চলল অথচ কেউই ধরছে না। দেবেনটাই-বা কোথায় গেল?

যখন কেউই ধরল না, তখন অগত্যা নিজেই উঠলেন। কোমরটা কনকন করে উঠল। ধীরে ধীরে গিয়ে রিসিভারটা তুললেন। ওপাশ থেকে মিষ্টিগলা ভেসে এল।

কে? দাদু?

সুধীনবাবুর মুখ-চোখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বললেন, হ্যাঁ দাদু। তোমার কী খবর?

ভালো। ওপাশ থেকে পাঁচ বছরের মিষ্টি বলল।

তুমি কবে আসবে আমাদের বাড়ি?

আসব না। আড়ি তোমার সঙ্গে।

সুধীনবাবু উদবিগ্ন গলায় বললেন, কেন কেন? আড়ি কেন? কী করেছি আমি?

তুমি আমাকে রথ কিনে দিলে না কেন? আজ রথ! আমাদের বাড়ির দোতলার মিঠুকে ওর দিদা কিনে দিয়েছে। পাশের বাড়ির বুজুকে ওর বাবা কিনে দিয়েছে। আমাকে কেউ কিনে দিল না।

সুধীনবাবু বললেন, ঠিকই তো। বড্ড ভুল হয়ে গেছে তো। ভেরি সরি। তোমাকে কালই কিনে দেব।

মিষ্টি বলল, কাল কিনলে কী হবে? রথ তো আজ হয়েই গেল।

তাতে কী? উলটোরথের দিন টানবে।

আচ্ছা। আশ্বস্ত হয়ে বলল মিষ্টি।

তোমার মা-বাবা কোথায়?

পার্টিতে গেছে।

তুমি একা আছ?

না, বেলাদি আছে।

তুমি খেয়েছ?

না, খাব।

কী খাবে?

এই ভাত আর পেঁপের তরকারি। আমার তো শরীর ভালো না। ও জানো দাদু, দাদু আজ না কাঁচকলার ঝুরি করবে রঘুদাদা। ঝুরি খেতে কী ভালো, না?

হ্যাঁ হ্যাঁ, খুব ভালো।

আজ থেকে দশ বছর আগে হলে এই কথার উত্তরে সুধীনবাবু হয়তো বলতেন, খুব ভালো। ঝুরি, ঝুড়ি ঝুড়ি খেতে ভালো।

তখন কত সহজে রসিকতা করতে পারতেন। কত আনন্দ ছিল মনে। আজকাল নিজের সব চেয়ে প্রিয়তম ছোট্ট নাতনির সঙ্গেও রসিকতা করেন না তিনি।

তারপর বললেন, শোনো, আমি এক্ষুনি মেলায় যাচ্ছি তোমার জন্যে রথ কিনতে। তুমি কি আসবে এখানে? মেলায় যাবে আমার সঙ্গে?

এখন? এখন কী করে যাব? এখন তো খাব। মা বকবে এখন গেলে। কার সঙ্গে যাব?

ঠিক আছে।

তারপর বললেন, আজ রথ, তুমি পাঁপড়ভাজা খেয়েছিলে?

পাঁপড়ভাজা? না তো। রথের দিন বুঝি পাঁপড়ভাজা খেতে হয়?

হয় তো। আমরা তো তাই-ই খেতাম ছোটোবেলায়। তোমার দিদা থাকতেও। এবার খাইনি।

মা পাঁপড়ভাজা খেলে রাগ করে। বলে, পেট আপসেট করবে।

ও—ও। না, না। তাহলে খেয়ো না।

রেখে দিই? মিষ্টিগলায় মিষ্টি বলল।

আচ্ছা।

নাতনি রিসিভার নামিয়ে রাখল।

সুধীনবাবু ডাকলেন, দেবেন, অ্যাই দেবেন।

সাড়া নেই।

ঠাকুর সিঁড়ি দিয়ে উঠছিল ওপরে। বলল, দেবেনের সঙ্গে তো আমার রাস্তায় দেখা হল বাবু। দেবেন তো ঋষির দোকানে গেল বউদির জন্যে ভেলপুরি কিনতে। আর দইবড়া।

ড্রাইভারকে ডাকো তো ঠাকুর। সে কি আছে, না চলে গেছে?

ড্রাইভার তো বড়দাকে নিয়ে বেরোল, বলছিল, নাখুদা মসজিদের কাছে যাবে। রয়্যাল না কী হোটেল আছে, সেখান থেকে বিরিয়ানি-পোলাউ আনবে। বড়দার সম্বন্ধীরা খেতে আসছেন।

ঠিক আছে। বললেন সুধীনবাবু।

তারপর আস্তে আস্তে ধুতিটা পরলেন। আলমারি খুলে হ্যাঙার থেকে এণ্ডির পাঞ্জাবিটা বের করলেন। ছাতাটা নিলেন। তারপর সাবধানে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামলেন। আজকাল তিনি বাড়ি থেকে বেরোলে কোথায় যাচ্ছেন, কখন ফিরবেন, এবং আদৌ ফিরবেন কি না তা জিজ্ঞেস করার লোক কেউ নেই। উনি ভাবেন, ভালোই হয়েছে। একেবারে মুক্তপুরুষ।

মেজোবউ বসবার ঘরে বসেছিল। বলল, গাড়ি তো দাদা নিয়ে গেছেন, গাড়ি ছাড়াই বেরোচ্ছেন বাবা?

হ্যাঁ।

মেজোবউও আর কিছু বললেন না। সুধীনবাবুও না।

সুধীনবাবু বুঝলেন যে, মেজোবউয়ের তাঁর সম্বন্ধে যত-না মাথাব্যথা, দাদাই যে গাড়িটা বেশি ব্যবহার করে একথাটা তাঁকে জানানোর উৎসাহটাই তার চেয়ে অনেক বেশি।

টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছিল সকাল থেকে। তখনও পড়ছিল। ছাতাটা খুললেন তিনি। রথের দিনে প্রত্যেক বছরই বৃষ্টি হয়। সারাপথ কাদা প্যাচপ্যাচ করছে। হাঁটুতে এতই ব্যথা যে, পদ্মপুকুর হেঁটে যাওয়া তাঁর পক্ষে অসম্ভব। মোড়ে এসে রিকশা নিলেন। তারপর মেলায় পৌঁছে একটা রথ কিনলেন সাড়ে চার টাকা দিয়ে। জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রার কাঠের মূর্তিও কিনলেন।

ফেরার সময় একটা মিনিবাস আস্তে করে ধাক্কা দিল রিকশাটাকে। একটু হলে তিনি ও রিকশাওয়ালা দু-জনেই পড়ে যেতেন। কিন্তু পড়লেন না। রিকশায় চড়া মানেই লোকের কাঁধে চড়া। যৌবনে কখনো সেজন্য রিকশা চড়েননি তিনি। কিন্তু এখন নিজের পায়ের ওপর আর জোর নেই বলে পরস্কন্ধারূঢ় হন নিরুপায়েই।

গাড়িটাও তাঁর নিজেরই। যেবার প্রথম ওভারহেড ভালভয়ের অ্যাম্বাসাডার বেরুল, সেবার কিনেছিলেন। আজ অনেক বছর হল। কণ্ডিশন এখনও ভালোই আছে। একহাতের গাড়ি ছিল। এখন ছেলেরাই চড়ে। ওরাই চাঁদা করে ড্রাইভার রেখেছে। ছেলেরা অবশ্য বলে, ‘বাবা যখনই আপনার দরকার একটু আগে বলে দেবেন, গাড়ি নিয়েই বেরোবেন।’ কিন্তু নিজের গাড়ি নিয়ে বেরোতে হলেও পাঁচ দিন আগে থেকে অন্যদের বলাবলি তাঁর পছন্দ হয় না।

তা ছাড়া, যাবেনই-বা কোথায়? সত্তর বছরে পৌঁছে সংসারে বন্ধু, হিতাকাঙ্ক্ষী, আত্মীয়-পরিজনের স্বরূপ মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছেন তিনি। যতদিন বড়ো সরকারি চাকরিতে ছিলেন, প্রভাব-প্রতিপত্তি, বেকারদের চাকরি করে দেওয়ার ক্ষমতা এ সমস্তই বিদ্যমান ছিল, ততদিন তাঁর কাছে লোকের ভিড়ের অভাব হয়নি। বন্ধুরা এসেছে দলে দলে। আজকে সারাদিনে দুটো কথা বলার লোকও পান না এক-জনও। তাই, গাড়ির প্রয়োজন তাঁর মিটে গেছে। যখন দরকার হয় তখন এমন হঠাৎ হঠাৎই দরকার হয়। আগে বলবার সময় কোথায় পান?

বাড়ির কাছাকাছি আসতেই প্রতিবেশী জগবন্ধুবাবুর সঙ্গে দেখা। ময়দার কল আছে ভদ্রলোকের। হাসিখুশি মোটাসোটা আমুদে মানুষ। বয়সে সুধীনবাবুর চেয়ে বছর চার-পাঁচেক ছোটো। তিনি গাড়ি থামিয়ে দুটো কথা বলে নিলেন। বললেন, কী খবর বড়োসাহেবের? গেছিলেন কোথায়? রিকশা কেন? গাড়ি কী হল?

সুধীনবাবু হাসলেন। গাড়ির কথাটা এড়িয়ে গিয়ে বললেন, এই রথের মেলায়। কাছাকাছিই।

ওহো তাই তো! রথ দেখছি যে! তা পেঁয়াজি-ফুলুরি খেলেন?

সুধীনবাবু হাসলেন। বললেন, অম্বল।

কীসের অম্বল? ইয়াং ম্যান। জগবন্ধুবাবু বললেন।

তারপর বললেন, চলুন চলুন আমার বাড়ি। আপনাকে দেখে যদি আমার গৃহিণী গালাগালি থেকে ক্ষান্ত হন। আজ বড়ো দেরি হয়ে গেল ফিরতে। ওঁকে নিয়ে এক জায়গায় যাওয়ার ছিল। চলুন। আপনার সুন্দর মুখ দেখলেই রাগ পড়ে যাবে।

সুধীনবাবু হাসলেন। আজকাল যেমন নিজে রসিকতা করতে পারেন না। অন্য কেউ করলেও ভালো লাগে না।

বললেন, আজ ছেড়ে দিন।

তারপরই বলতে গেলেন, শুনুন! স্ত্রীকে অমন হেলাফেলা করবেন না। স্ত্রী যে কী জিনিস, চলে গেলে বুঝবেন। কিন্তু কথাটা আর বললেন না। ভাবলেন, তিনি নিজেও বুঝতেন না, কী জিনিস স্ত্রী, নীহারিকা থাকতে। ভাবলেন স্ত্রীর কথা ওঠালে জগবন্ধুবাবু ভাবতে পারেন যে, দাঁত চলে যাওয়ায় দাঁতের কদর বুঝেছে বুড়ো। হ্যা:-হ্যা:।

রিকশাওয়ালাকে বিদায় দিয়ে রথটা নিয়ে বাড়ি ঢুকতে গিয়েই দেখলেন, বড়ো দুটো রথ সুন্দর করে সাজিয়ে-টাজিয়ে তার বড়োছেলের ও মেজোছেলের পুত্ররা টানাটানি করছে।

সুধীনবাবু বললেন, রথ? এ কী? রথ কোথায় পেলি?

বা রে! বাবা কিনে দিয়েছে। বাবা কিনে দিয়েছে।

শান্টু বলল, দাদু ওই রথটা আমাকে দাও।

সুধীনবাবু গম্ভীর মুখে বললেন, না। এটা মিষ্টির।

বলেই, ওপরে চলে গেলেন আস্তে আস্তে।

দেবেন এসে ভিজে ছাতাটা নিল।

জামাকাপড় ছাড়তে ছাড়তে সুধীনবাবু খুব দুঃখিত হলেন। যা ভেবেছিলেন, তার কিছুই হল না। ভেবেছিলেন ছেলেরা সব এক বাড়িতে থাকবে। জমজমাট সংসার। নীহারিকার ফর্সা লঞ্জীশ্রীসম্পন্ন চেহারাটা মনে পড়ল। চওড়া লালপেড়ে শাড়ি। চাবির গোছা আঁচলে। বউরা ঘিরে রয়েছে। ছেলেদের ভাব গলায় গলায়। মা-বাবা ছেলে-বউ।

কিছুই হল না।

ছোটোছেলে দীপু পড়াশুনোয় সবচেয়ে খারাপ ছিল। ইউনিভার্সিটির পরীক্ষায় কখনোই তেমন ভালো করেনি। কিন্তু জীবনের পরীক্ষাতে ও-ই সবচেয়ে সফল হল। সাহেবি কোম্পানিতে সামান্য সেলসম্যানের চাকরিতে ঢুকে দেখতে দেখতে মার্কেটিং ম্যানেজার হল। কোম্পানির ফ্ল্যাট, কোম্পানির গাড়ি। দীপুর বউ শিখা বোম্বের মেয়ে। ওর বাবা ছিলেন এক মার্কেন্টাইল ফার্মের বড়োকর্তা। বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে। সাহেবি ধরনের মানুষ। তার পক্ষে এই বাড়িতে পাঁচমিশেলি রুচির মধ্যে থাকা সম্ভব হল না। মিষ্টিটাকে বড়ো মিস করেন সুধীনবাবু। আর ও কী-যে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে। নীহারিকার বড়োই প্রিয় ছিল এই নাতনি।

আসলের চেয়ে সুদ যে বড়ো, একথা যাদের সুদ নেই তারা জানেন না।

আজকাল দীপু ও শিখার সঙ্গেও দেখা হয় না বেশি। সপ্তাহে একদিন করে আসে। অবশ্য ফোন করে খোঁজখবর নেয় মাঝেমধ্যে। রান্না করে এটা-ওটা পাঠায়। কিন্তু মিষ্টির জন্যেই মনটা হুহু করে সুধীনবাবুর। নীহারিকা চলে যাওয়ার পর মিষ্টি ওদের নতুন ফ্ল্যাটে উঠে যাওয়ায় দ্বিতীয়বার ধাক্কা খেয়েছিলেন তিনি। পুরোপুরি নি:সঙ্গ হয়ে পড়েছিলেন তিনি।

যখন দীপু চলে গেছিল, খুব রাগ হয়েছিল সুধীনবাবুর। কিন্তু এখন মনে হয় যে, তাঁর প্রজন্মের মানুষদের পক্ষে, সমস্ত পৃথিবী জুড়ে যে যৌথ পরিবারের ভাঙন আরম্ভ হয়েছে তা রোধ করা তার সম্ভব নয়। আলাদা থাকা এক-এক সময় ভালো বলেও মনে হয়। তাতে সম্পর্ক বোধ হয় ভালো থাকে। যদি প্রত্যেকের রুচি, রোজগার, শিক্ষা এসব এরকম না হয়, তাহলে জোর করে একসঙ্গে থেকে বাইরের লোককে সুখের বন্যা দেখানো হয় বটে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে পায়ের তলায় মাটি সরতে থাকে। কেউ অত্যাচার করে, কেউ অত্যাচারিত হয়। যার রোজগার বেশি এবং যার কম তাদের দু-জনেরই দু-রকম কমপ্লেক্স জন্মায়। সেটা প্রত্যেকেরই জীবন উপভোগের পথে বাধাস্বরূপ। সুধীনবাবু আর নীহারিকা সবাইকে নিয়েই থাকতে চেয়েছিলেন জড়িয়ে। কিন্তু তিনি নিজের জীবনেও দেখেছেন যৌথ পরিবারে কেউ ঠকে, কেউ ঠকায়। কেউ অন্যায় করে, কেউ তা সয়ে যায়। যে ভালো তাকে বোকা ভাবা হয়। জীবন যেহেতু একটাই, তখন যার যার যোগ্যতা, যার যার রুচি, যার যার মতামত নিয়ে আলাদা থাকাই বোধ হয় ভালো। যারা তা থাকতে পারে। বড়োবউ, মেজোবউ তাঁর সামনে কখনো ঝগড়া করে না বটে, কিন্তু সুধীনবাবু বোঝেন, ভালো করেই বোঝেন যে, ওদের মধ্যে সবসময় একটা রেষারেষি, একটা কোল্ড-ওয়াটার চলে। সেটা আরও অসহ্য ঠেকে।

রথ নিয়ে উনি ওপরে উঠে যেতেই মেজোবউ ঘরে গিয়ে উষ্মার সঙ্গে মেজোছেলেকে বললেন, বাড়াবাড়ি।

কেন? কার?

খাটে শুয়ে, বই পড়তে পড়তে মেজো বলল।

কার আবার? তোমার বাবার। মিষ্টির জন্যে নিজেহাতে রথ কিনতে গেলেন, বৃষ্টিতে ভিজে। কেন, আমার ছেলেদের জন্যে তো কখনো একটা চকোলেটও কিনে দেন না?

মেজো বলল, তাই নাকি? বাবা নিজে গেছিলেন? স্ট্রেঞ্জ!

মেজোবউ বলল, তোমার ছেলেরা কি ভেসে এসেছিল?

বড়োবউ জানলার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল যখন সুধীনবাবুর সঙ্গে জগবন্ধুবাবু কথা বলছিলেন।

বড়োবউ মেজোকে ডাকলেন। মেজো বাইরে এলে বলল, দ্যাখ কী লজ্জার।

কী? মেজো বলল।

বাবা জগবন্ধুকে গাড়ি পান না, রিকশায় যাতায়াত করেন, এসব কথা বলছিলেন নিশ্চয়ই। এটা অপমানের নয়? বুড়ো হলে মানুষগুলো কুটিল হয়ে যায়? কাজকর্ম নেই তো!

সুধীনবাবুও ইজিচেয়ারে বসে ভাবছিলেন, স্ট্রেঞ্জ! বড়োছেলে মেজোছেলে নিজেদের ধাড়ি ছেলেদের রথ কিনে দিল, আর ছোটোভাইয়ের একমাত্র মেয়ে মিষ্টির জন্যে চার টাকা দিয়ে একটা রথ কেনার কথা মনে হল না ওদের। এরা একেবারে চামার হয়েছে। তার নিজের ছেলে বলে ভাবতেও কষ্ট হয়।

সুধীনবাবু বোঝেন সব। মুখে কিছু বলেন না। বড়োলোক বাবার কাছে গরিব সেজে থাকার লাভ অনেক। অন্তত তাই ভাবে ওরা। তিনি চিরদিন ন্যায়ের পক্ষে, অন্যায়ের বিপক্ষে। দীপু চলে গেছে বলেই তিনি তাকে দূর করে দিতে পারেন না। উইল করে ফেলেছেন তিনি। যা-কিছুই আছে স্থাবর অস্থাবর, ছেলে-মেয়ে সকলকে সমান ভাগে। বউমারা একথা জানেন না বলেই বোধ হয় রেষারেষি হয়। কে শ্বশুরের বেশি কাছের, তা নিয়ে প্রতিযোগিতা চলে।

ড্রাইভার চলে গেল। বড়োছেলে, শালা ও শালাবউয়ের জন্যে গরম গরম বিরিয়ানি ও চিকেন চাপ নামিয়ে রেখে রাগের গলায় শালাদের সামনেই বলল, বাবা যত বুড়ো হচ্ছেন, ততই ইনকনসিডারেট হচ্ছেন। এত রাতে বৃষ্টির মধ্যে ড্রাইভারকে কি না-পাঠালেই চলত না? গরিব লোকটা সারাদিন খাটছে। বুড়ো হলে মানুষগুলো সেনাইল হয়ে যায়। ভীমরতি ধরে।

বড়োবাবুর বড়োশালা কথা ঘুরিয়ে বলল, যাই বলো আর তাই বলো, শিখা ও দীপু চলে গিয়ে তোমাদের বাড়িটা কেমন খাঁ-খাঁ করে যেন।

বড়োবউ বলল, তা তো লাগবেই দাদা তোমার। আমরা তো শিখার মতো সুন্দরীও নই আর অমন শরীর বের করে সাজতেও পারি না।

বড়োশালা হেসে ফেললেন। বললেন, নমু তুই কোন লজ্জায় একথা বলছিস? তুই যা শরীর করেছিস তা কি কাউকে দেখাবার? তুই তো একেবারে আমাদের কোম্পানির সাপ্লায়ার ঢালাইওয়ালা মি. আগরওয়ালার স্ত্রীর মতন দেখতে হয়ে গেছিস। ওজন কত কুইন্টাল হল?

বোন রেগে গেল। বলল, তোমাদের সব দেমাকি মেয়েছেলে ছাড়া ভালোই লাগে না। শিখার দেমাক একদিন ভাঙব। ভগবান কি নেই? ভগবানই একদিন ওকে মুড়িয়ে খাবেন।

দাদা বললেন, ছি ছি, তুই-না পড়াশুনো করেছিস! তুইও এরকম? টিপিক্যাল! তারপর বললেন, ভগবানের আরও অনেক ইম্পর্ট্যান্ট কাজ আছে। যাই বলিস, তোদের বাড়িতে কিন্তু দীপু-শিখাকে আমার সবচেয়ে পছন্দ। ভেরি স্ট্রেইট-ফরোয়ার্ড।

বড়োবউদি বললেন, খুব লক্ষ্মী মেয়ে কিন্তু শিখা। ওরা যখন এখানে থাকত, একটা ঘরে থাকলে কী হয়, ঘরের মেঝেতে মুখ দেখা যেত। এখন তোদের বাড়িতে ঢুকলে মনই খারাপ হয়ে যায়। মাসিমা আর শিখা চলে গিয়ে তোদের বাড়ি একেবারে শ্রীহীন হয়ে গেছে।

বড়োবউ চটে গেল। বলল, তা এই বাড়িতে আসা কেন বাবা? না এলেই তো পারো। কেউ বাড়ি বয়ে এসে এমন অপমান করে, শুনিনি কোথাও।

ঘর ফাঁকা হতেই বড়োশালা নিজের স্ত্রীকে বললেন, তোমার এমন স্পষ্ট কথা বলার দরকার কী?

আমি স্পষ্ট কথাই বলি। তোমার বোন বলে কি ছেড়ে দেব? ওরা শিখার ধারেকাছে নয়। তাই তো দলাদলি আর পলিটিক্স করে ওকে তাড়াল। শিখা চাপা মেয়ে কিন্তু একদিন আমার কাছে সব বলেছিল। শিখার কী? ও নিজে বড়োলোকের একমাত্র মেয়ে, স্বামীরও যথেষ্ট যোগ্যতা আছে। ও কেন এই নোংরামির মধ্যে থাকবে? আমার সামর্থ্য থাকলে আমিও তোমাদের বাড়ি থাকতাম না। কত সুখেই রেখেছ তুমি আমাকে জগাখিচুড়ির সংসারে।

তারপর বলল, লোকে ঈর্ষা আর হিংসা করে তো আর কারও কপাল পোড়াতে পারে না। কপাল কে নেবে? যে যেমন কপাল করে আসে। তোমার বোনের এই পরশ্রীকাতর স্বভাব আমার মোটে ভালো লাগে না।

আঃ কী করছ! বাড়াবাড়ি কোরো না, শুনতে পাবে।

শুনুক। তোমার মতো আদেখলাও দেখিনি আমি। বিরিয়ানি খাওয়ার এত লোভ তো হোটেলে গিয়ে খেলেই পারো!

আহা! সমীর এত করে নেমন্তন্ন করল। সমীরের কী দোষ। বলল, হুইস্কি খাওয়াবে। বৃষ্টির দিন। সমীর তো ভালোই।

বড়োশালার স্ত্রী বলল, ভালো। তেমনি ভালো। যেমন দেবা, তেমন দেবী। এরকম ছোটোমনের পুরুষও আমি দেখিনি। স্ত্রীর কথায় ওঠে-বসে।

থামো তো! ধমক লাগালেন বড়োশালা।

বড়ো এসে বলল, এসো ঘরে এসো, চুপচাপ হুইস্কি খেতে হবে ঘরে বসে। হাশ-হাশ করে। বাবা জানতে পারলে তো কোনো সম্পত্তিই দিয়ে যাবেন না। ত্যাজ্যপুত্তুর করবেন।

বড়োশালা অবাক হয়ে বললেন, কেন? দীপু তো খেত বাড়িতে মাঝেমধ্যে।

বড়োছেলে সমীর বলল, দীপুর কথা ছাড়ো। ওর কি কোনো রেসপেক্ট আছে নাকি বড়োদের প্রতি? ও সাহেব লোক।

দুই

একী? দেখেছ, সর্বনাশ করেছে। ঘুম থেকে সেদিন উঠেই চেঁচিয়ে উঠলেন সুধীনবাবু।

তারপরই ডাকলেন, দেবেন, দেবেন।

দেবেন নেই যথারীতি!

মেজোবউ তখনই ওপরে এসেছিল। ছেলের খাবারের তাগাদা দিতে। চিৎকার শুনে ঘরে ঢুকে বলল, কী হল বাবা?

ইঁদুর।

কোথায়?

এই দ্যাখো না, তোমার মায়ের লেপটা কেটে কী করেছে।

লেপটা কোথায় ছিল?

সুধীনবাবুর রাগ হল। ভাবলেন, বলেন যে, লেপ কোথায় থাকে তা তো তোমাদেরই জানার কথা মা! এঘরটা তো আবর্জনার স্তূপই হয়ে আছে। কখনো তো চোখ মেলেও দ্যাখো না।

কিন্তু পরক্ষণেই সামলে নিলেন।

পরের বাড়ির মেয়ে। ছেলের বউ। রাগ করেন তাদের ওপরে, সে-অধিকার কোথায়? রাগ করার লোক, ঝগড়া করার লোক তো চলেই গেছেন।

তোমার মায়ের খাটের মাথার কাছেই ভাঁজ করা ছিল। দেখেছ, কেটে তুলোগুলোকে কী করেছে। তোমার মায়ের বড়ো প্রিয় লেপ ছিল ওটা। উনি বলতেন, বড়ো ওম ধরে। সেই যেবার আমরা শীতকালে উটিতে গেছিলাম, সেইবার এই লেপটা সঙ্গে নিয়ে গেছিলেন তোমার মা। সঙ্গে সেবার ছোটনও গেছিল। মনে আছে। ওঃ সেবারে কী শীত! তখন কতই-বা বয়স আমাদের। তোমার মা-র সে কী আনন্দ উটি দেখে।

মেজোবউ মনে মনে বলল, কী কুক্ষণে এই ঘরে ঢুকলাম। এখন বৃদ্ধের মধুচন্দ্রিমার গল্প শুনতে হবে।

এমন সময় দেবেন এল।

সুধীনবাবু বললেন, দেবেন, তুই আমার কাছে মা-র খেয়েই মরে যাবি।

ফেলুন, মেরেই ফেলুন। দেবেন বলল। এই চাকরি আমার আর সহ্য হচ্ছে না। আমি মরে গিয়েই বাঁচি।

সুধীনবাবু বললেন, তুই ইঁদুর মারবি কি মারবি না? দেখেছিস হতভাগা ইডিয়ট? দেখেছিস কী করেছে!

মেজোবউ বললেন, বাবা ইঁদুরের কী দোষ। এই তো ইঁদুরের ধর্ম।

ধর্ম মানে?

প্রায় চটেই উঠেছিলেন সুধীনবাবু।

মেজোবউ বলল, ধর্ম মানে, না কাটলে যে ইঁদুর মারা যায়। মানে, ইঁদুরের দাঁত থাকে এমন যে, সবসময় সেটা জিনিসপত্র কেটে কেটে ঘষে ঘষে ছোটো না করলে সেই দাঁত ইঁদুরের মগজ ফুটো করে দেয়। দেখেন না, ইঁদুর কাগজ কাটে, লেপ কাটে, তোশক কাটে, যা পায় তাই-ই কাটে, যা কাটে সেগুলো কিছুই খায় না। না কাটলে যে ইঁদুর বাঁচতেই পারে না। আমার জুয়োলজি ছিল তো!

তা তো জানতাম না। সুধীনবাবু বললেন।

মেজোবউ মনে মনে বলল, অনেক কিছুই জানেন না আপনি।

দেবেন বলল, দেখেছেন মায়ের লেপটাকে কী করেছে ব্যাটারা? এমন বিষ দেব যে, মানুষ পর্যন্ত মরে যাবে। দেখাচ্ছি মজা।

সুধীনবাবু বললেন, দয়া করে দেখাও।

বড়োবউমা ঘরে ঢুকল। মেজোবউ বাবাকে কী জ্ঞান দিচ্ছে দেখার জন্যে। চান্স পেলেই একা একা বাবার কাছে ঘুসুর ঘুসুর করে। মায়ের যত গয়না ছিল সবই তো হাত করেছে মেজোই। বড়ো কিছুই পায়নি! তবে আনন্দ এইটুকুই যে, ছোটো কিছু চায়ওনি এবং তাকে কিছু দেওয়াও হয়নি। তার স্বামী বড়োলোক তাকে দেবেনই-বা কেন?

বড়োবউমা মধুরস্বরে বলল, বাবা।

বলো।

সুধীনবাবু বললেন।

আজ রাজার জন্মদিন।

তাই নাকি? তা এত দেরি করে বললে, রাজাকেও তো দেখলাম না সকাল থেকে।

ও দেরি করে উঠেছিল। তাই সকালে আসতে পারেনি আপনার কাছে। স্কুল থেকে ফিরেই আসবে।

মেজোবউ বলল, সে কী দিদি, আমারও তো মনেই ছিল না।

বড়োবউ মনে মনে বলল, কত যেন মনে রাখো তুমি!

তারপর বলল, রাজার কয়েক-জন বন্ধুবান্ধবকে খেতে বলব, আর রাজার পিসি ও পিসেমশাইকে। ওর মামা-মাসিদের।

সুধীনবাবু বললেন, দীপু আর শিখাকে বলছ না?

মানে, ও বলছিল, জায়গা কম। লোক বেশি হলে….।

জায়গা যত কমই হোক আমার ছোটোছেলে এবং তার স্ত্রীর দীপু-শিখার জায়গার অকুলান হবে না এবাড়িতে। অন্তত হওয়া উচিত নয় বলেই আমার মনে হয়।

বড়োবউ বুঝল যে, সুধীনবাবু ভীষণ চটেছেন।

বলল, ওরা তো ভালো খায়, ভালো থাকে। ওরা কী সাধারণ ব্যাপারে আসবে? তারপর পার্টি-ফার্টি তো লেগেই আছে। ককটেলস। তাই ভাবছিলাম….।

সুধীনবাবু অনেক বছর পর বড়োবউয়ের চোখে লাল চোখে তাকালেন। বললেন, কী ভাবছিলে?

এমনসময় নীচ থেকে দীপুর কোম্পানির উর্দিপরা ড্রাইভার সুন্দর র‌্যাপিংপেপারে মোড়া একটা এয়ার রাইফেল, একবাক্স চকোলেট আর লাল গোলাপ ফুল নিয়ে এল। সঙ্গে শিখার ছোট্ট চিঠি।

রাজাবাবু,

আজ তোমার জন্মদিন। তোমাকে অনেক অনেক আদর পাঠাচ্ছি তোমার ছোটোকাকু, মিষ্টি ও ছোটোকাকিমা।

আমি যখন ওবাড়িতে ছিলাম তখন তুমি পাশের বাড়ির রুণুর এয়ার রাইফেলটা একদিন চেয়ে পাওনি বলে খুব দুঃখ করেছিলে। আমার মনে আছে। তোমার ছোটোকাকু তাই তোমার জন্যে একটা এয়াররাইফেল পাঠালেন। মিষ্টি ফুল পাঠাল। আর আমি অনেক আদর। তোমার জন্যে পায়েস রেঁধেছি। বিকেলে আমরা সক্কলে তোমার কাছে যাব, পায়েস নিয়ে।

—ইতি ছোটোকাকিমা

চিঠিটা পড়ে বড়োবউমার মুখ কালো হয়ে গেল।

সুধীনবাবু বললেন, কে লিখেছে?

শিখা।

কী লিখেছে? দেখি।

বড়োবউ চিঠিটা এগিয়ে দিল।

চিঠিটা পড়ে সুধীনবাবু বড়োবউমাকে ফিরিয়ে দিলেন।

বড়োবউ বলল, আমি যাই শিখাকে ফোন করি গিয়ে।

সুধীনবাবু কিছু বললেন না।

দেবেন ইঁদুরে-কাটা তুলোর টুকরোগুলো পরিষ্কার করছিল। বাইরের রাস্তার বকুল গাছে কাক ডাকতে লাগল। হঠাৎ বকুলের গন্ধ এল নাকে এক ঝলক। নীহারিকা এই গন্ধ ভারি ভালোবাসতেন।

পাশের বাড়িতে রাজেশ্বরী দত্তের গাওয়া ‘এ পরবাসে রবে কে’ গানের রেকর্ড বাজছিল।

সুধীনবাবুর মনটা উদাস হয়ে গেল। নীহারিকার বড়ো প্রিয় গান ছিল এটি। সত্যিই পরবাস! শুধুই স্বার্থকোলাহল, শুধুই বিবাদ।

তিন

বারান্দার বাইরেটা বেলুন আর কাগজে সাজানো হয়েছে। বাচ্চারা হইচই করছে। আজকাল হইচই মোটে সহ্য হয় না সুধীনবাবুর। নিজের ঘরেই আছেন।

নীচে গাড়ির শব্দ হল। বোধ হয় বড়োবউমার দাদা বউদিরা এল। সুধীনবাবুর একমাত্র মেয়ে ফুচি। ওরা এখন দিল্লিতেই সেটেলড। একমাসের ছুটিতে এসেছে এখানে। নীহারিকা থাকলে এখানে এসেই উঠত। নীহারিকা যাওয়ার পর আর ওঠে না। কেন ওঠে না তা বলেনি ফুচি সুধীনবাবুকে। কিন্তু সুধীনবাবু বোঝেন যে, হয়তো বড়োবউমা বা মেজোবউমা অথবা দুই বউমারই কোনো ব্যবহারে ও বা প্রদীপ দুঃখিত হয়েছে। বোঝেন সবকিছুই। মুখে চুপ করেই থাকেন। একটাই মেয়ে। কিছুই করতে পারেন না ওদের জন্যে। উলটে মেয়ে-জামাই সুধীনবাবুকে নিয়ে এখানে-ওখানে যায়। থিয়েটার দেখতে, যাত্রা দেখতে। বড়োভালো রেস্তরাঁতে খাওয়ায়। পাজামা-পাঞ্জাবি বানিয়ে দেয়। এবারে আসার সময় একটা শাল কিনে নিয়ে এসেছে। কত দামি শাল। কবে এবং কোথায় পরবেন সুধীনবাবু? দিন তো ফুরিয়ে এল।

শিখা আর দীপুর সঙ্গে কিন্তু খুব ভাব ফুচি আর প্রদীপের। প্রত্যেকটা উইক-এণ্ডে ওরা ওখানে গিয়ে থাকে। এটাও একটা প্রচন্ড অশান্তির কারণ। মেজোবউ ও বড়োবউয়ের ধারণা কভেনান্টেড অফিসারে অফিসারে মিলে গেছে। দু-জনেই সাহেব, তা আমাদের কি আর পছন্দ হবে তাদের?

আর একটা গাড়ির শব্দ হল।

ফুচি, প্রদীপ, শিখা ও দীপু একসঙ্গে নামল গাড়ি থেকে। ওদের গলার শব্দ পেলেন সুধীনবাবু। তারপরই মিষ্টির পরিচিত জুতোর শব্দ পেলেন সিঁড়িতে। হালকা পায়ের নরম থপ থপ শব্দ। মুখস্থ হয়ে গেছে সুধীনবাবুর। নাতিরা এত দুরন্ত নয়। মিষ্টি মেয়ে হয়েও ভারি দুরন্ত। এনার্জিতে ভরপুর। ওর হাঁটা-চলা কথা-বলা সমস্তই এতই প্রাণবন্ত যে, পরপারের পথে চোখচাওয়া সুধীনবাবুর ওকে দেখে আবার জীবনকে ব্যাক-গিয়ারে ফেলে অনেক দূরে পিছিয়ে মিষ্টির বয়সে পৌঁছোতে ইচ্ছে করে।

মিষ্টি গাড়ি থেকে নেমেই সোজা দৌড়ে ওপরে আসে ‘দাদু দাদু’ ডাকতে ডাকতে। মিষ্টি যখন সিঁড়ি থেকে ডাকে দাদু-দাদু-দাদু তখন সুধীনবাবুও ঘর থেকে উত্তর দেন কী দাদু, কী দাদু, কী দাদু?

মিষ্টি এসেই সুধীনবাবুর কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আজও পড়ল। সুধীনবাবু ওকে জড়িয়ে ধরলেন, জোরে। যখনই মিষ্টিকে বুকে করেন সুধীনবাবু, সুধীনবাবুর মনে হয়, যেন বিয়ের সময়ের ছোট্ট বালিকাবধূ নীহারিকাকেই আদর করেন। তার একটা কারণও ছিল। মিষ্টি যে পাউডার মাখে, নীহারিকাও সেই পাউডার মাখতেন। একটি পাউডারের গন্ধে মিষ্টির মাধ্যমে তাঁর নীহারিকা তাঁর কাছে ফিরে আসত।

সুধীনবাবু প্রত্যেকবারই মিষ্টিকে কোলে নিয়ে ভাবতেন, পাউডারের কোম্পানি থেকে যায়, শুধু মানুষই চলে যায়।

ফুচি আর প্রদীপও ঘরে এল দীপুর সঙ্গে। শিখা এল না। হয়তো পরে আসবে। শিখার মধ্যে মন-রাখা লোকদেখানো কোনো ব্যাপার নেই। সেটা ভালো যেমন, খারাপও।

একটু পরেই শিখাও এল। পেছনে পেছনে বড়োবউ, মেজোবউ।

ফুচি হাসতে হাসতে সত্যি কথাটা বলল। এই বউদিরা, তোমরা আমার বাবাকে কী করে রেখেছ? ঘরটার কী অবস্থা দ্যাখো তো? এরমধ্যে মানুষ থাকতে পারে? আলমারির মাথায় টিন, নীচে জুতো, ছেঁড়া মশারি, খাটের তলায় পুরো গুদাম!

বলেই চেঁচিয়ে উঠল, ও মা, ওটা কী?

মিষ্টি উত্তেজিত হয়ে হাততালি দিয়ে উঠল দাদুর কোলে বসে, বলল, ইঁদুর ইঁদুর। ও মা! পিসি ইঁদুরকে ভয় পায়।

শিখা হাসতে হাসতে বলল, এসব বলিস না ফুচি, বললেই দিদিরা বলবে আমি তোকে শিখিয়ে দিয়েছি।

শিখা কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে বড়োবউ বলে উঠল, তুমি তো কয়েকদিন এখানে থেকে বাবার ঘরটা পরিষ্কার করে দিয়ে গেলেই পারো।

শিখা হাসল। বলল, নিশ্চয়ই পারি। কিন্তু তা করলে তোমাদের অপমান করা হয় বলেই কখনো তা করিনি। তোমরা যদি অনুমতি দাও তো নিশ্চই করব এবং করে দেখিয়ে দেব যে, এই ঘরই কীভাবে রাখা যায়।

বড়োবউ চেঁচিয়ে উঠল, ‘ম্যা গো’ বলে।

একটা বড়ো ইঁদুর কামড়ে দিয়েছে পায়ে।

মেজোবউমা বলল, ‘দিদি শিগগির ওষুধ লাগা, প্লেগ হবে প্লেগ।’

প্রদীপ অবাক হয়ে তাকাল মেজোবউয়ের দিকে। মেজোবউদি যে এত অশিক্ষিত জানত না প্রদীপ।

ফুচি বলল, বড়দি চলো, চলো নীচে। শিগগিরি ওষুধ লাগিয়ে দিচ্ছি।

তারপর শিখার দিকে চেয়ে বলল, শিখা, আয় আমরা দু-জনে মিলে কাল এসে বাবার ঘরটা পরিষ্কার করে দিয়ে যাই। বউদিরা নানা ঝামেলায় সময় পায় না।

শিখা বলল, বেশ তো! খুব ভালো।

ঘর ছেড়ে যাওয়ার আগে দীপু বলল, কেমন আছ বাবা?

এই আছি!

তোমার ব্লাড সুগার? প্রেসার? সব ঠিক?

ঠিকই আছে!

আসলে সুধীনবাবুর এই বয়সে মেপে খেয়ে, মেপে হেঁটে, প্রেসার মেপে বেঁচে থাকার আর ইচ্ছা নেই। জীবনের সব প্রয়োজনীয়তা সার্থকতা তো শেষই। হাইওয়েতে একটা গাড়ির ইঞ্জিন কাট অফ করে দেওয়া হয়েছে। গিয়ারও নিউট্রালে। এখন যত দূর যায় গড়িয়ে গড়িয়ে। এ গাড়িতে তেল মবিল দিয়ে আর লাভ কী? গন্তব্যই যখন নেই কোনো, একমাত্র থেকে যাওয়া ছাড়া।

দীপু বলল, আমাদের অফিসের ডাক্তারের সঙ্গে ঠিক করেছি, তোমাকে সপ্তাহে একবার করে দেখে যাবেন।

কেন? আমাদের গজেন ডাক্তার কী দোষ করল?

না। উনিও দেখুন। তবে উনি তো মাঝে মাঝে ডুব দিয়ে দেন।

ঘর থেকে উঠে চলে যাওয়ার সময় দীপু বলল, বাবা মিষ্টিকে আজেবাজে কিছু খাইয়ো না যেন। ওর সকাল থেকে পেটের গন্ডগোল। শিখা টিফিন ক্যারিয়ারে করে ওর জন্যে সুক্তো নিয়ে এসেছে। ওই খাবে। ভাতে মেখে।

সুধীনবাবু মুখে বললেন, ঠিক আছে।

মনে মনে বললেন, এদের কায়দার শেষ নেই। ছেলেমানুষ, নেমন্তন্ন খেতে এসেছে, তা না টিফিন ক্যারিয়ারের সুক্তো খাবে। যত্তসব।

রাজা ঘরে এল। মিষ্টি নীচে চল। আমরা কেক কাটব! তুই গান গাইবি না? হ্যাপি বার্থডে?

হ্যাঁ! হ্যাঁ! বলে নেচে উঠল মিষ্টি।

সুধীনবাবু বললেন, আমিও যাব। তারপর মিষ্টির হাত ধরে সিঁড়ি দিয়ে নামলেন নীচে। ততক্ষণে বাচ্চারা সকলে ভীষণ মেতে গেছে।

কেক কাটা হল! গান হল। কেক খাওয়া কিন্তু হল না মিষ্টির। শিখা খুব নির্দয় মা। বলল, মিষ্টি, তোমার ভাগ আমি বাড়ি নিয়ে চলে যাব। কাল ভালো হয়ে গেলে খাবে।

মিষ্টি মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলল না।

সুধীনবাবু বললেন, চলো, কেক কাটা হল, আমরা এবারে ওপরে যাই। তারপর মিষ্টির কানে কানে বললেন, তুমি কি দই খাবে? যদুবাবুর বাজার থেকে দই আনব?

না:।

বলল, মিষ্টি।

ওপরে উঠে দেখেন ঘরে দেবেন কাবাব রেখে গেছে দুটো। একটা প্লেটে। আর প্লেটটা রেখেছে খাটের নীচে মাটিতে। একটা চামচ পর্যন্ত দেয়নি। দেবেনটা দিন-কে-দিন…..।

সুধীনবাবুর শরীরটাও কাল থেকে ভালো নেই। ঠিকই করেছিলেন যে, রাতে শুধু দুধ-দই খাবেন।

কাবাবটা মিষ্টিও দেখেছিল।

বলল, দাদু কাবাব! চোখ বড়ো বড়ো হল ওর।

দাদু বললেন, তোমাকে কেক খেতে দিল না, তুমি কাবাব খাবে কী করে দাদু?

মিষ্টি মুখে কিছু না বলে এমনভাবে তাকাল সুধীনবাবুর চোখে যে, সুধীনবাবুর বুকের মধ্যেটা কেমন যেন করে উঠল। ভদ্রলোক অপত্যস্নেহ কাকে বলে জীবনে জেনেছিলেন। কিন্তু আসলের প্রতি যে-স্নেহ, যে-দরদ, তারমধ্যে কিছুটা তবুও ভারসাম্য থাকে। সুদের প্রতি স্নেহ ও দরদে তা থাকে না। সুধীনবাবুর মনে হয় যিনি দাদু বা দিদা হননি, তিনি জানেন না সুদের কী টান। কী কষ্ট। যে নাতি বা নাতনির প্রতি স্নেহ আছে অসীম কিন্তু যার মালিক তার মা ও বাবা; তাকে আদর করতে, তাকে হাত ধরে বেড়াতে নিয়ে যেতে যখন তার নিজের অনিচ্ছুক ছেলে-মেয়ের অনুমতি চাইতে হয় তখন বুকের মধ্যে বড়ো কষ্ট হয়।

সুদকে ভালোবাসায় ভীষণ জ্বালা।

হঠাৎ সুধীনবাবুর চোয়াল শক্ত হয়ে এল। তাঁর নিজেরও কি কোনো দাবি নেই নাতনির ওপর?

উনি মিষ্টিকে বললেন, তোমার কি এখন পেট ব্যথা করছে?

না তো দাদু।

তবে কী অসুবিধা?

জানি না। সকালে তিনবার পাই করেছিলাম।

তারপর আর যাওনি?

না।

ওষুধ খেয়েছ?

হ্যাঁ। মেকসাফর্ম।

দাঁড়াও। বলে সুধীনবাবু উঠে দাঁড়ালেন। তারপর দরজাটা বন্ধ করলেন ঘরের। বন্ধ করেই তাড়াতাড়ি কাবারের প্লেটটা হাতে করে এনে মিষ্টিকে বললেন, খাও দাদু।

দুটোই? মিষ্টি বলল। তারপর বলল, তুমি একটা খাও দাদু।

দুটোই তুমি খাও। আমি খাব না।

মিষ্টির চোখ-মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। কাবাব মুখে দিল মিষ্টি।

কেমন লাগছে? সুধীনবাবু বললেন।

ভালো। মিষ্টি বলল।

তারপর বলল, ঝাল। তারপরই বলল, গন্ধ লাগছে।

সুধীনবাবু ভাবলেন, শিখা মেয়েটাকে বেশি যত্নে যত্নে একেবারে স্পয়েল করে ফেলেছে। এদের ইমিউনিটি বলে কিছুই ডেভেলপ করেনি। যা-কিছুই খায়, তাতেই অসুখ।

সুধীনবাবু বললেন, আর একটা খাও।

মিষ্টির চোখ-মুখ লাল হয়ে উঠেছিল। বলল, না থাক। খুব ঝাল।

সুধীনবাবু বললেন, দাঁড়াও তোমাকে জল দিই। দেবেনকে ডাকলেই তো জানাজানি হয়ে যাবে। শিখা বা দীপু এখুনি চলে এলে প্রচন্ড ঝামেলা বাঁধাবে। ফুচিও আসতে পারে। তাই নিজেই বারান্দায় গিয়ে কুঁজো থেকে জল গড়িয়ে এনে মিষ্টিকে দিলেন।

মিষ্টি, খেয়েই বলল, দাদু আমি মা-র কাছে যাব।

কেন দাদু? কী হল।

ভালো লাগছে না।

কেন ভালো লাগছে না? হলটা কী তোমার?

না। এমনিই।

আমি পৌঁছে দিয়ে আসব না তুমিই যাবে?

আমি যেতে পারব নীচে।

আচ্ছা। তবে যাও। বাড়ি যাওয়ার আগে আমাকে বলে যেয়ো। একটা আব্বা দিয়ে যেয়ো আমাকে।

আচ্ছা!

মিষ্টি দরজার কাছে পৌঁছোতেই সুধীনবাবু বললেন, কাউকে বোলো না যেন কথাটা।

মিষ্টি হাসল।

ভারি স্মার্ট মেয়েটা। চোখ পিটপিট করে বলল, ‘কাউকে বলব না। প্রমিস।’

চার

অনেক রাত হয়েছে। দেবেন মশারি গুঁজে দিতে এসেছিল। সুধীনবাবু বাঁধানো দাঁতের পাটিটা খুলে একটা জলভরা বাটির মধ্যে রাখলেন। রাতে দুধ-খই খেয়েছিলেন। এখন শরীরটা ভালোই লাগছে। নীচে এখনও ওদের গলা পাচ্ছেন। এগারোটা বাজে। খাওয়াদাওয়া হতে বারোটা-সাড়ে বারোটা হবে। শিখা মিষ্টিকে নিয়ে আগেই চলে গেছে। মিষ্টির শরীরটা নাকি ভালো নেই। দীপুকে ফুচি আর প্রদীপ নামিয়ে দিয়ে যাবে ট্যাক্সি করে।

মিষ্টির শরীরটা ভালো নেই শুনে ভয়ে সুধীনবাবুর মুখ শুকিয়ে গেছে। শিখার রাগি মুখটা ভেসে উঠছে চোখের সামনে।

মশারিটা গুঁজে দিয়ে দেবেন বলল, কাল ঘরে গন্ধ পেলেই বলবেন বাবু।

কীসের গন্ধ?

পচা ইঁদুরের।

কেন? ইঁদুর পচবে কেন?

সুধীনবাবু শুধোলেন।

পচবে না? দুটো কাবাবে ভালো করে ইঁদুর মারা ওষুধ মাখিয়ে রেখেছিলাম খাটের নীচে। একটা এরই মধ্যে খেয়ে ফেলেছে ব্যাটারা। একটা ইঁদুরে নিশ্চয়ই খায়নি। ধেড়ে ইঁদুরের বংশ নির্বংশ হবে এক কামড় খেলে।

সুধীনবাবুর হৃৎপিন্ডটা খাঁচা ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইল একলাফে।

সোজা খাটে উঠে বসলেন। বললেন, ‘দাঁড়া! দাঁড়া! দেবেন।’

তারপর মশারি ছেলে বাইরে এলেন। বললেন, ‘কোথায় দেখি, তোর কাবাব।’

‘এই তো!’ বলেই, দেবেন মিষ্টি যে প্লেট থেকে খেয়েছিল সেটা টেনে বের করল। হতভম্ব হয়ে অনেকক্ষণ নির্বাক হয়ে রইলেন সুধীনবাবু।

এমন সময় নীচ থেকে দেবেনকে মেজোবউমা ডাকল। দেবেন নীচে গেলেই ফিসফিসে গলায় বললেন, বাবা শুয়ে পড়েছেন? খেলেন না?

না শরীর ভালো নেই।

মেজোবউমা বললেন, শোনো, মিষ্টির খুব শরীর খারাপ হয়েছে। ওকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে। এক্ষুনি ফোন এসেছিল ছোটোবউদির। বাবাকে একথা এখন বোলো না। সকালে ঘুম থেকে উঠলেই আমরা খবর দেব। সকালে দেখতে নিয়ে যাব।

দেবেন ওপরে ফিরে গেল।

সুধীনবাবু ইজিচেয়ারে গিয়ে বসেছিলেন। টেবিলের ওপর মিষ্টির একটা ছবি ছিল, সেদিকে তাকিয়েছিলেন। নীহারিকার ছবির দিকেও। দেবেন আসতেই বললেন, বউদি ডাকল কেন?

না, এমনিই….।

বেশি চালাক হয়েছিস না? কী হয়েছে বল?

কিছু তো হয়নি। আপনার কাজ শেষ করে নীচে মেজোবাবুর বিছানা ঠিক করে দিতে বললেন।

ও। তুই মিথ্যা বলছিস না?

না বাবু।

আমাকে টেলিফোনের বইটা দে। গজেন ডাক্তারের ফোন নম্বর জানিস?

আমি জানি না। বলে, দেবেন বইটা এনে দিল।

চশমাটা নাকে লাগিয়ে গজেন ডাক্তারের ফোন নম্বরটা বের করে পাশের ঘরে গিয়ে ডায়াল করলেন উনি। দেবেনকে বললেন, তুই নীচের যা কাজ আছে সেরে তারপর আমার কাছে আয়।

দেবেন চলে গেল নীচে।

গজেন?

বলছি, কে? বড়োকর্তা নাকি? কেমন আছেন? রোজ শোয়ার সময় ক্যাম্পোজ খাচ্ছেন তো একটা করে।

তা খাচ্ছি। শোনো, ইঁদুর মারার ওষুধ।

মানে? বলেন কী আপনি? মাথা খারাপ হল নাকি?

না, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করছি। কোনো খাবারে, ইঁদুর মারার ওষুধ বেশি করে দিয়ে যদি কোনো বাচ্চাকে খাওয়ানো যায় তবে তার এফেক্ট কী হবে?

গজেন ডাক্তার হেসে বলল, আপনি কি গোয়েন্দাগল্প লিখছেন নাকি?

আঃ গজেন! যা জিজ্ঞেস করছি তার উত্তর দাও।

এফেক্ট আর কী হবে? মরে যাবে।

সুধীনবাবুর হাতটা রিসিভার থেকে আলগা হয়ে এল।

বললেন, আর ইউ শিয়োর?

অ্যাবসোলিউটলি।

খাওয়ার কতক্ষণ পরে মারা যাবে?

স্টমাক পাম্প না করলে অল্পক্ষণের মধ্যেই।

আচ্ছা, ঠিক আছে।

গজেন ডাক্তার বললেন, ব্যাপারটা……।

গজেন ডাক্তারের কথা শেষ হওয়ার আগেই সুধীনবাবু ফোনটা নামিয়ে রাখলেন।

দেবেন ফিরে এল একটু পরে। বলল, কী হল বাবু, ঘুমোবেন না। লাইট নিভিয়ে দেব?

সুধীনবাবু বললেন, ঘুমব রে ঘুমব। আমাকে ঘুম পাড়ানোর জন্যে তোদের এত তাড়া কীসের?

তারপরই বললেন, মিষ্টিকে কখন হাসপাতালে নিয়ে গেছে রে?

দেবেন অবাক হল। তারপরেই ভাবল, গজেন ডাক্তারের কাছে শুনেছেন বোধ হয়।

বলল, এক্ষুনি।

সুধীনবাবু মনে মনে হিসেব করলেন, মিষ্টি সন্ধে সাড়ে ছ-টায় ওঁর কাছে এসেছিল। এখন বাজে সাড়ে এগারোটা। অনেক ঘণ্টা।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎ দেবেনের ওপর রেগে উঠলেন তিনি। বললেন, তুই ভেবেছিস কী? রয়ে রয়ে মুরলী বাজাবি? এক্ষুনি আরও আন, বিষ আন, সারাঘরে খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে রাখ, যাতে ঘরের যত ইঁদুর আছে একদিনেই মরে যায়। তুই রোজ রোজ এইরকম বিষ দিবি নাকি? রোজই ইঁদুর পচবে? এটা কি ধাপার মাঠ পেয়েছিস?

কাবাব তো নেই। অবাক হয়ে বলল দেবেন। বিষ মেশাব কীসে?

নবাব হয়েছেন। ইঁদুরকে কাবাব খাওয়াতে হবে না। পাঁউরুটি আন। তাতে মাখিয়ে রাখ। যা শিগগিরি যা।

দেবেন চলে যেতেই, স্লিপিং পিলের শিশিটা নিয়ে এলেন তাড়াতাড়ি দেরাজ খুলে।

তারপর প্যাড বের করে, বলপেন বের করে, চশমা নাকে দিয়ে দ্রুত চিঠি লিখলেন একটা। খামে ভরে, মুখ বন্ধ করলেন সেটার।

দেবেন ফিরে এলেই বললেন, রাখ ওখানে। আমি নিজে দেব আনাচে-কানাচে।

আপনি কেন? আমিই দিচ্ছি। বলে, দেবেন ভালো করে বিষ মাখিয়ে রুটির টুকরোগুলো এদিকে-ওদিকে সব দিকে দিয়ে দিল। আলমারির নীচ, খাটের সব জায়গায়।

সুধীনবাবু বললেন, আমি এখন পড়ব। তুই মশারিটা গুঁজে দিয়ে যা, জল দিয়েছিস?

হ্যাঁ। সব দিয়েছি।

দেবেন চলে যাওয়ার আগে খামে বন্ধ চিঠিটা দেবেনের হাতে দিয়ে বললেন, কাল সকালে এই চিঠিটা ছোটোবউদিকে পাঠিয়ে দিবি ড্রাইভারকে দিয়ে। কেউ না থাকলে, তুই নিজেই যাবি। জরুরি চিঠি। কাল সকালেই। বুঝলি?

আচ্ছা। দেবেন বলল।

এবার যা। ভালো করে খাওয়াদাওয়া করে হাত ধুয়ে নিয়ে ভালো করে। অনেক খাটনি গেছে আজ তোর।

দেবেন বলল, খাটনির কথা বলবেন না বাবু। অন্যরা তো সব গায়ে ফুঁ দিয়ে বেড়াচ্ছে। খাটনি যা, সব দেবেনেরই। তাও তো আপনি বেশি ভালোবাসেন বলে অন্য সব লোকজনের কী আক্রোশ আমার ওপর।

দেবেন চলে যাচ্ছিল। সুধীনবাবু ডাকলেন। বললেন, তুই একটা হাতঘড়ি চেয়েছিলি-না আমার কাছে? বলেই নিজের রোলেক্স ঘড়িটি বালিশের তলা থেকে তুলে দেবেনকে দিলেন।

বললেন, এটা তুই রাখিস।

এ কী! এ কী! বলল দেবেন। এটা যে আপনার নিজের ঘড়ি। এত দামি!

তা হোক। তুইও দামি। তুই-ই নে। সময়ের দাম ফুরিয়ে গেছে আমার কাছে। ঘড়িতে আমার আর কী দরকার?

তাহলেও।

অভিভূত গলায় বলল দেবেন।

এবার যা ভাগ। আমি পড়ব।

সুধীনবাবু ওকে তাড়ালেন।

দেবেন চলে যেতে যেতে ভাবল, আজ ঘড়িটা কাউকে দেখাবে না। কাল দেখাবে। ঠাকুর নটবর সকলকে চমকে দেবে ঘড়িটা দেখিয়ে। তারপরই ভাবল, ও আবার ভাববে না তো যে, চুরি করেছি? ভাবলে কী? বাবুর কাছে ডেকে আনব। বাবুর নিজের মুখেই শুনুক ওরা, দেবেনের কী পজিশন ও বাড়িতে।

দেবেন চলে যেতেই দরজা বন্ধ করে দিলেন সুধীনবাবু। তারপর হামাগুড়ি দিয়ে সারা ঘরময় ঘুরে ঘুরে পাঁউরুটির টুকরোগুলো তুলে খেতে লাগলেন। যেন শিশু হয়ে গেলেন। যেন মিষ্টির চেয়েও ছোটো। হামাগুড়ি দিয়ে থাবা মেরে যমকে মুখে পুরতে লাগলেন। তারপর দাঁতে কাটতে লাগলেন। ছিঁড়ে ছিঁড়ে মৃত্যুকে খেতে লাগলেন তিনি।

বড়ো জ্বালা করতে লাগল বুক পেট। আঃ মিষ্টি! দাদু আমার। প্রমিস। তুমি তোমার প্রমিস রেখেছ দাদু। অত যন্ত্রণাতেও প্রমিস ভাঙোনি। এ আমি কী করলাম। মিষ্টি সোনা আমার! কী করলাম আমি! শেষে…..।

শিখা, তুমিই ঠিক। বুড়োগুলোর কোনোই দিশা নেই।

রুটির টুকরোগুলো চিবোতে চিবোতে, গিলতে গিলতে মনে মনে বললেন, তোমার কী হবে শিখা? দীপুরও কী হবে? মিষ্টিকে ছাড়া তোমরা বাঁচবে কী করে? মনে মনে বলতে লাগলেন সুধীনবাবু।

তারপর স্লিপিং ট্যাবলেটের শিশি খালি করে মুঠো করলেন, দু-গ্লাস জলের সঙ্গে সবগুলো গিলে ফেললেন।

ফেলেই, কোনোক্রমে বিছানায় হামাগুড়ি দিয়ে শিশুরই মতো উঠে শুয়ে পড়লেন।

পাঁচ

বাইরে ভোর হয়ে আসছিল। নার্সিং হোমের ওয়েটিং রুমে বসেছিল ওরা সকলে। শিখা, ফুচি, প্রদীপ, অন্যরা। দীপু ভেতরে ছিল ডাক্তারদের সঙ্গে। মেজোবউ ছিল বাড়িতে, বাচ্চাদের আগলাতে।

ডাক্তার ব্যানার্জি এসে শিখাকে ডাকলেন।

ডাক্তার ব্যানার্জি ভণিতা না করেই বললেন, উই আর সরি! ভেরি ভেরি সরি! ইট ওয়াজ আ কেস অফ পয়জনিং। পুরো চিকিৎসাই তো প্রথমে অন্যরকম হয়েছিল। দেরিও হয়ে গেছিল…..তাই…..। পুলিশ কেস হবে।

ছয়

এখন আর কোনো কষ্টই নেই মিষ্টির। সুধীনবাবুরও কোনো কষ্ট নেই।

সুধীনবাবু গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিলেন।

সুধীনবাবুর খুব কষ্ট হতে লাগল। কষ্টের মধ্যেই যেন হঠাৎ মনে হল, ঘরময়, বাড়িময় তার মস্তিষ্কময়ই ইঁদুর দৌড়াদৌড়ি করছে। ওঁর বাড়িতে, কলকাতা শহরের সব বাড়িতেই যেন লক্ষ-লক্ষ কোটি-কোটি ইঁদুরের বাস। ওরা নিরন্তর কুটি কুটি করে কাটছে। সম্পত্তি কাটছে, সম্পর্ক কাটছে, সুখ-শান্তি-ভালোবাসা, মায়া-মমতা-সততা সবকিছুই কাটছে। খাওয়ার লোভে নয়। শুধু কাটারই লোভে। কাটাই ওদের স্বভাব।

মেজোবউমা বলেছিল, ইঁদুররা কিছু না কেটে বেঁচে থাকতে পারে না।

ঈর্ষায় কাটছে। পরশ্রীকাতরতায় কাটছে। লোভে, ঘেন্নায় কাটছে একে অন্যকে ইঁদুরগুলো। সর্বক্ষণ কুটুর কুটুর কুটুর…..।

হঠাৎই তাঁর মনে হল এতগুলো ইঁদুরের মধ্যে উনি এতদিন ছিলেন কী করে?

সামনে একটা বিরাট চওড়া মসৃণ রাস্তা। চলে গেছে আদিগন্ত। কিন্তু সুন্দর গন্ধভরা জঙ্গলের মধ্য দিয়ে। কত ফুল, পাখি, প্রজাপতি। তাঁর হাতে স্টিয়ারিং। পাশেই গায়ের সঙ্গে গা লাগিয়ে মিষ্টি বসে আছে। ও একটা সুন্দর হলুদ-সাদা ফুল-ফুল ফ্রক পরেছে। জোরে চলেছে গাড়ি। জঙ্গলের মধ্যের পথ দিয়ে। বর্ষার ভোরের বনের থম-ধরা গন্ধে ম-ম করছে চারধার। সবে ভোর হয়েছে। ফুরফুর হাওয়া লাগছে গায়ে।

মিষ্টি বলল, ও দাদু। দিদার কাছে কখন পৌঁছোব?

এই তো! পৌঁছে গেলাম বলে দাদু।

সুধীনবাবু বললেন।

দিদা, তোমাকে দেখে কী বলবে মিষ্টি?

কী বলবে আবার। আদর করবে।

তুমি দিদাকে কিছু বলবে না?

না। কিছু বলব না। আব্বা দেব।

তুমি আব্বা দেবে দিদাকে? দাদু?

একটু চুপ করে থাকলেন সুধীনবাবু।

মিষ্টির গায়ের পাউডারের গন্ধে নীহারিকার গায়ের গন্ধ পেলেন। তারপর বললেন, দেব। আমিও দেব।

দাদু, একটা গল্প বলো না-যেতে যেতে! মিষ্টি বলল!

সুধীনবাবু বললেন, জানো দাদু, একজন বাঁশিওয়ালা ছিল। তার নাম হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালা। সে-না, একদিন সব ইঁদুরদের বাঁশি বাজিয়ে, বাজিয়ে, বাজিয়ে…।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *