অসমাপিকা

অসমাপিকা

দুস শালা! এ কী কেলো রে! পড়াশুনো, ম্যাথামেটিক্স-ফেটিক্স হল না বলেই তো গান-বাজনার লাইনে এলাম। কিন্তু এখানেও দেখি হেভি ঝামেলা রে।

অর্ক বলল।

জন্মেচ কীমরেচ। পালাবে কোতা? দৌড়োতে পারো গুরু, কিন্তু যত জোরেই দৌড়োও-না কেন গুরু, লুকোতে পারবে না। এই ধরাধামে লুকোনোর ব্যবস্থা নেই।

মেরজাপ বলল অর্ককে।

আজ যেন কী পড়াবেন প্রফেসার চাটুজ্জে?

—শ্রুতি।

বলিস কী? শ্রুতি স্যাডোলিকারের গান শুনেছি। তৈরি গলা। অনেক দিন আগেকার দিনের ছাত্রছাত্রীদের তো শ্রুতিই সম্বল ছিল—যখন গুরু-শিষ্য পরম্পরাতে গান শিখত মানুষে। শ্রুতি আবার পড়াবে কী চির?

—অ্যাই! চির বলিসনি।

—কেন?

—কেন মানে?

—গুরুর নাম জানিস না? বাঁদরামো হচ্চে? চিরকুমার চাটুজ্জে।

সে যাই হোক গে যাক। অতবড়ো নাম কে বলবে এ যুগে। এখন কম্পুর যুগ। ই-মেল-এর যুগ। এখন মানুষেরা সেকেণ্ডকে বলে সেক। ইকনমিকসকে বলে ইকো, পলিটিক্যাল সাইন্সকে পল সাইন্স, দিল্লি স্কুল অফ ইকনমিকসকে বলে ডি স্কুল। সময় কোথা? সময় নষ্ট করবার।

তা হোক গে যাক। আমি চিরকে চিরই বলব। হ্যাঁ কুমারই বটে। হাজার কুমারীকে ভেনে দিয়ে নিজে এখনও কুমার।

অ্যাই অর্ক। এরকম ভাষা ব্যবহার করবি না। তোর লজ্জা করে না? তুই ক্লাসিক্যাল মিউজিকের ক্যাপসুল কোর্সে ভরতি হয়েছিস, মা সরস্বতীর কৃপাধন্য হতে চলেছিস, আর তোর মুখে এ কেমন রকবাজদের আর মোটর মেরামতির কারখানা-মিস্ত্রিদের ভাষা।

—ভাষা দিয়ে কিস্যু হয় না। ভাষ্যই আসল। আর…..

কথা বলতে বলতে ওরা পৌঁছে গেল যাদবপুরে চিরকুমার চাটুজ্জের বাড়িতে। নিজের বাড়ি প্রফেসরের। একতলাতে গান শেখাবার মস্ত হল। ঘরজোড়া কার্পেট পাতা। তবে কার্পেটের যেখানে-সেখানে গুরুর বিড়ালনি ‘মুরকি’ হিসি করে করে আর কার্পেটের কার্পেটত্ব রাখেনি। বেড়ালের হিসির গন্ধ আর বেড়ালের চুলের গন্ধ পৃথিবীর কোনো ধূপের গন্ধই মারতে পারে না।

দরজার সামনেই জুতো-চটি-কাবলি সব ছাড়া রয়েছে। ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। দরজাতে দাঁড়িয়ে জুতো খুলতে খুলতেই অর্কর চোখ পড়ল নবাগতার দিকে। একটি হলুদ তাঁতের শাড়ি আর কালো ব্লাউজ পরে গুরুর পায়ের কাছেই বসে আছে সে। চমৎকার কালো কোঁকড়া চুল, কালো ব্লাউজে হলুদ লেসের ফ্রিল দেওয়া।

অর্ক মেরজাপের কানে কানে ফিসফিস করে বলল, এই মালটি কে গুরু।

মেরজাপ নীচুগলাতে বলল, চুপ কর।

প্রফেসার চিরকুমার কথা থামিয়ে ওদের দিকে চেয়ে বললেন, সময়ে কেন আসেন না? আপনাদের জন্য তো আমি শুরু করতে পারি না গান অথবা ক্লাস।

না না, তা কেন করবেন স্যার? ঢাকুরিয়া ব্রিজের কাছের বড়োহলে আজ মিস পুনপুনের নাচ আছে। কী জ্যাম! কী বলব। লোক ঠেলে ঠেলে কোনোরকমে এল বাস।

ঠিক আছে। এখন বসে পড়ুন। বই-খাতা আনেননি?

আপনি তো ‘মহামায়া’ স্টোর থেকে এক্সারসাইজ বুক কিনতে বলেছিলেন স্যার। অন্য দোকান থেকে কিনলে যে চলবে না। তা ওদের খাতা সব শেষ তাই কিনতে পারলাম না।

—তবে?

—এই তো মিস পুনপুনের নাচের প্যামপ্লেটের পেছনে লিখে নেব।

হারমনিয়াম কেনা কি হয়েছে?

প্রফেসার চিরকুমার বললেন।

অর্ক বলল, না স্যার।

—কেন?

—বড্ড দাম স্যার। সাড়ে সাত হাজার টাকা। বাবার কাছে চাইতে গেলাম। বললেন, বাড়ি থেকে বার করে দেব।

—আপনার বাবা কী করেন?

—মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার।

—বাবাকে বলুন একটা হাপর কিনে দিতে। কামারের হাপর। আর কী বলব। আর আপনি মেরজাপবাবু?

স্যার আমি কিনতে গেছিলাম কিন্তু স্টকে নেই। চাপরাশিবাবু বললেন যে, আপনার সব ছাত্র-ছাত্রীকে উনি সাপ্লাই করছেন হারমোনিয়াম। তা হারমোনিয়াম তো আর টেপাকল নয় যে, ডাবু ধরবেন আর ঢালাই করে দেবেন। সুরের যন্ত্র, সময় লাগবে। অত তাড়াতাড়ি অত হারমোনিয়াম বানানো সম্ভব নয়। এটা হাওড়ার ঢালাই কারখানা নয়।

—তাই বললেন?

—হ্যাঁ স্যার।

—ঠিক আছে। পরের দিন অন্য দোকানের নাম বলে দেব।

বলেই বললেন, আচ্ছা তোমরা সকলে আমার লেখা বইটি কি কিনেছ?

ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে দু-জন সমস্বরে বললেন, কোন বইটি স্যার।

আরে আমার লেখা বই আবার ক-টা আছে। এই তো প্রথম বই।

—ও হ্যাঁ। হ্যাঁ। উচ্চাঙ্গ সংগীতের ধারা। নিত্যানন্দ পাবলিকেশনের বই তো।

অনেকে বলল, কিনেছি। অনেকে বলে উঠল, কিনে উঠতে পারিনি স্যার, বড্ড দাম।

কিনলে ক্লাস ফলো করতে খুব সুবিধা হত। তারপর দার্শনিকের মতো মুখ করে মাথা তুলে বললেন, উচ্চাঙ্গ সংগীত ব্যাপারটাই যে দামি। নিম্নাঙ্গ সংগীত শিখলেই পারতে।

একটি চোদ্দো-পনেরো বছরের পাকা ছেলে, ধুতি-পাঞ্জাবি পরা, তালতলার শুঁড়অলা চটি পায়ে দিয়ে একটি মার্সিডিজ গাড়ি করে গান শিখতে আসে প্রতি শনি-রবি। খুবই বড়োলোকের ছেলে এবং সেই বড়োলোকিটা লুকিয়ে রাখার কোনো চেষ্টাই করে না সে। চিরকুমার বলেন যে, সংগীত রিসার্চ অ্যাকাডেমির ‘খুরাম’ আর আমার ‘সিরাজউল’। দু-জনেই প্রডিজি। ছেলেটির নাম সিরাজুল ভট্টাচার্যি। একসময় মুসলমানদের যেমন হিন্দু নাম রাখার ফ্যাশান ছিল এখন হয়েছে হিন্দুদের মুসলমান নাম রাখার ফ্যাশান। নিজেদের হিন্দু বলে পরিচয় দিতেও বড়ো লজ্জা করে আজকাল বাঙালি হিন্দুদের। তাই মুসলমানি দাক্ষিণ্য পাওয়ার জন্য তাদের মধ্যে অনেকেই মুসলমানি নাম রাখা আরম্ভ করেছে।

সে হাত তুলে বলল, আমি কিনেছি। কিন্তু আমার বাবা বইটা নেড়ে-চেড়ে দেখে বললেন ফলস বই। তোদের গুরুভাই-বোন ছাড়া আর কেউ কিনবে না এই বই। এইসব না করে ক্লাসের মাইনে বাড়িয়ে দিলেই তো পারে তোর গুরু।

আর একজন ছাত্র বলল, হারমোনিয়াম দোকানের চাপরাশিবাবু বললেন, একটি হারমোনিয়ামে আমার তো মাত্র থাকে সাড়ে চার হাজার টাকা, বাকি তিন হাজার টাকা তো চিরকুমারবাবুই নিয়ে নেন কমিশন বাবদ। সাড়ে চার হাজারে তো লাভ সাড়ে চার আনাও থাকে না। অথচ একটা হারমোনিয়াম বানাতে সময় লাগে কত? তা ছাড়া এ কি রথের মেলার বাঁশি, যে এক মুখ দিয়ে ফুঁ দেবে আর অন্য মুখ দিয়ে আওয়াজ বেরোবে।

চিরকুমারবাবুর পেছনে দু-জন তানপুরা নিয়ে বসে ছিল কিন্তু সুর দিচ্ছিল না, কারণ এখন থিয়োরি ক্লাস হচ্ছে। পাশে রুপোর কাজ করা হারমোনিয়াম সামনে নিয়ে বসে হারমোনিয়াম বাদক ভিরাপ্পান নাইডু। তার আবার মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভদের মতো ভিজিটিং কার্ড আছে। নতুন ছাত্র-ছাত্রী এলেই একটা করে ধরিয়ে দেন। এস. এস. ভিরাপ্পান নাইডু এন. এম. এইচ. পি. অ্যাণ্ড এ. পি. ও. আই.। ভদ্রলোক হারমোনিয়ামের সামনে বসেই নিজের মনে হাসেন, নানারকম মুখভঙ্গি করেন, শিশুরা যেমন দেয়ালা করে। হয়তো মাথার গোলমাল আছে, নয়তো আইনস্টাইনের মতো জিনিয়াস। তাঁর ডিগ্রির তাৎপর্য এখানে আর কেউই জানে না, তিনি নিজে ছাড়া। মেরজাপ মুখুজ্জে পুরোনো এবং তালেবর ছাত্র বলে এবং নাইডুকে মাসে মাসে সে ‘মিউজিক ক্যাপসুল’-এর যাবতীয় খবর সাপ্লাই করার জন্য মাসোহারা দেয় বলেই নাইডুর ডিগ্রিগুলোর তাৎপর্য জানতে পেরেছে। অর্ক মেরজাপের কাছেই জানতে পেরেছিল এন.এম.এইচ.পি-র মানে হল নন-ম্যাট্রিক হারমোনিয়াম প্লেয়ার। আর এ. পি. ও. আই. হচ্চে, অলসো প্লেজ আদার ইনস্ট্রুমেন্টস।

চির স্যার বললেন, অনেক আজেবাজে কথা হয়েছে আজ। বিশেষ করে সিরাজুল তোমাকে বলছি, বাড়িতে সহবত শেখো। আজ তোমাদের ‘শ্রুতি’ সম্বন্ধে বলব।

আমার বাবাই তো বললেন বইটি ফলস। আমার বাবা নিজে বিষ্ণুপুর ঘরানার গাইয়ে। তিনি তো আর আজকালকার ভুঁইফোঁড় মাল-ছড়ানো পয়সাওয়ালা, শাল জড়ানো বোদ্ধা নন।

চুপ করো সিরাজুল। বিহেভ। তোমাকে আমি রাস্টিকেট করে দেব আমার ইউনিভার্সিটি থেকে। তোমাকে বাড়িতে মা-বাবা কি কিছুই শেখান না?

স্যার, বাবা আর মা নিজেরাই সব শিখে উঠতে পারেননি এখনও? তাই আমাকে শেখাবেন কী করে। তা ছাড়া তাঁরা নিজেরা যার যার জগৎ নিয়ে এতই ব্যস্ত থাকেন যে, আমার সঙ্গে দেখা-টেখাই হয় না বিশেষ। সহবত আর শেখাবেন কী করে।

ঠিক আছে তোমার ভাবনা তোমার মা-বাবাই ভাবুন। এইরকম দুর্বিনয়ী ছাত্রর গান-বাজনা হয় না—তার যতই গুণ থাকুক-না-কেন? হ্যাঁ এবারে শোনো। এবং নোটস নাও, যারা খাতা এনেছ।

আগের দিন যা বলেছি তারপর থেকে শুরু করি। সাতটি প্রকৃত স্বর এবং পাঁচটি বিকৃত স্বর মিলিয়ে মোট স্বরের সংখ্যা হয় ১২টি।

আগেকার দিনে, এ দেশে মুসলমানিরাজ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে, তার মানে ধরো থার্টিন্থ সেঞ্চুরির আগে ক্লাসিক্যাল মিউজিকের জগতে শুদ্ধ বিকৃত স্বরগুলি অন্যভাবে বিচার করা হত। তখন এই শ্রুতি অর্থাৎ ‘শ্রুতি’ নামক স্বরের অত্যন্ত সূঞ্জ সব অংশ দিয়েই স্বরের শুদ্ধি বা বিকৃতি ঠিক করা হত। তাতে রাগরাগিণীতে ব্যবহৃত স্বরগুলির চেহারা পরিষ্কার হত আর রাগরাগিণীকে সঠিকভাবে প্রকাশ করাও সহজ হত।

একটু থেমে চিরস্যার বললেন, তারপর মুসলিম প্রভাব যখন পুরোপুরি এল, তখন মুসলিম গুণীরা আমাদের প্রাচীন ভারতের স্বর ও শ্রুতির সম্পর্কে বুঝতে না পেরে উপরোক্ত ১২টি স্বরের প্রচলন করেন। ওই ১২টি স্বর ছিল মুসলিম গুণীদের দেশীয় স্বর। কিংবা বলতে পারো পারসিয়ান স্বর। তাতে স্বরের সূঞ্জ অংশ বোঝা যায় না বলেই, সংগীত শাস্ত্রীদের, গুণীদের কাছ থেকে সূঞ্জ স্বরের প্রয়োগ বিশেষ যত্নের সঙ্গে শিখে নিতে হয় এবং কঠোরভাবে অনুশীলন করতে হয়। প্রথম যারা গান শিখতে আসছে, মানে শিক্ষাজীবনের প্রথম দিকে, ওই বারোটি স্বর খুবই উপযুক্ত। কিন্তু পরবর্তীকালে স্বরের সূঞ্জ অংশ সম্বন্ধে বিশেষ ধারণা গড়ে তুলতে না পারলে রাগসংগীত কখনোই শেখা হয়ে উঠবে না।

আমাদের প্রাচীন সংগীতকার সেই মুনিঋষি আচার্য সংগীত নায়কদের এইসব রাগরাগিণী এবং তাদের অ্যাপ্লিকেশন সম্বন্ধে ফাণ্ডা ছিল অসাধারণ। তারপরে ইণ্ডিয়াতে মুসলমানেরা এসে মৌরসিপাট্টা গেড়ে বসার পরে অনেক হিন্দু সংগীতকারেরা ফোর্সিবলি ধর্মান্তরিত হওয়ার ভয়ে এখানে-ওখানে পালিয়ে গেলেন। কিছু আবার পরিচয় গোপন করে নির্জন জায়গাতে পাহাড়ের জঙ্গলে বসবাস করতে লাগলেন। এর ফলে ইণ্ডিয়াতে প্রকৃত সংগীতশাস্ত্র ক্রমে ক্রমে হারিয়ে তো যায়ই, সাধারণের কাছে ধীরে ধীরে দুর্বোধ্য হয়ে পড়ে। নতুন এক হাইব্রিড তাইচুঙ্গ-এর মতো সংগীতশাস্ত্রর জন্ম হল, তার নাম হল ‘ঠাটবাদ’ এবং ‘মেলবাদ’।

অর্ক ফিসফিস করে বলল, কী হেভি ফাণ্ডা মাইরি!

মেরজাপ বলল, তব্বে! আমি কি আর তোকে বেজায়গাতে এনেছি।

এই নতুন শাস্ত্রের সঙ্গে কিন্তু প্রাচীন শাস্ত্রের বিশেষ রিলেশন নেই। নর্থ ইণ্ডিয়া, সাউথ ইণ্ডিয়াতে এখন এই ঠাটবাদী স্কুলেরই রবরবা।

এই জন্যই কি স্যার যেসব ক্রিয়াসিদ্ধ গায়কেরা আছেন তাঁরা বলেন যে, ক্ল্যাসিকাল মিউজিকের থিয়োরিটিকাল ও প্র্যাকটিকাল দিক আলাদা?

—এগজ্যাক্টলি।

—বা:। তোমার নাম কী?

নীল টপ ও ফেডেড জিন্স পরা মেয়েটি বলল, নীলি।

—তোমাদের বাড়িতে বুঝি ক্ল্যাসিকাল মিউজিকের চর্চা আছে?

নীল সপ্রতিভ হলেও অত-জন ছেলে-মেয়ে ওর মুখের দিকে চেয়ে আছে তা বুঝতে পেরে মুখ একটু নামিয়ে নিয়ে বলল, তা আছে। তবে এসব কথা আমি একটি বই থেকে জেনেছি।

—বই? কী বই? তুমি আমার ‘উচ্চাঙ্গ সংগীতের ধারা’ কিনেছ বুঝি?

—এখনও কিনিনি।

—তবে? এ কোন বই?

—শাস্ত্রীয় সংগীত পরিচয়। ড. প্রদীপকুমার ঘোষের লেখা।

একটি লম্বা-চওড়া ছেলে, দেখলে মনে হয় পিট্টুতে চ্যাম্পিয়ান, উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমিও পড়েছিলাম একথা একটি বইয়ে। কলেজস্ট্রিটের দেজ পাবলিশিং থেকে কিনেছিলাম।

—কি হে লাড্ডু? তুমিও পড়েছ নাকি এই বই?

—না স্যার। পড়ার জন্য ঠিক পড়িনি। আমার সেজদি বিয়ের আগে যখন ক্ল্যাসিকাল শিখছিল খুব জোর, তখন কলেজস্ট্রিটে গিয়ে বাবার অর্ডারে কিনে নিয়ে এসেছিলাম। ওর হবু শ্বশুর সি. ডি. প্লেয়ারে দিনরাত ইণ্ডিয়ান ক্ল্যাসিকাল শুনতেন, তাই।

—না, না। এই বইয়ের কথা……

না না। বিশেষ কোনো বইয়ের কথা কেউ বলেনি। বাবা বলেছিলেন ইণ্ডিয়ান ক্ল্যাসিকালের ওপরে গোটাকয় বই কিনে নিয়ে আসতে। সেজদির ভবিষ্যৎ যাতে ফুল-ফলন্ত হয় সেইজন্য। বিয়ের তখনও একমাস দেরি। বাবা বলেছিলেন একমাসে ক্ল্যাসিকাল মিউজিকে মাস্টার হতে পারবে না? সেজদি রবীন্দ্রভারতীর বাংলার ছাত্রী। তখন তো আপনার এই কনডেন্সড কোর্স চালু হয়নি। তা দেজ পাবলিশিং-এ বলতে তারাই দিয়েছিলেন। তার মধ্যে এই বইটিও ছিল।

—এই বইটিকেই তুমি বিশেষ করে মনে রাখলে কেন?

—বইয়ের কভারটা দারুণ ঝিং-চ্যাক ছিল। গ্রাফিক্সের কাজ। তখন তো কম্পিউটারের এমন রমরমা ছিল না।

—অ। তা তুমি আমার ক্ল্যাসিকাল মিউজিকের ক্লাসে ভরতি হয়েছ কেন? তোমার শাশুড়ি কি……?

—না স্যার, আমার কেসটা অন্য। আমি ভেটেরিনারি ডাক্তারি পড়ছি।

একথা বলতেই ছাত্র-ছাত্রীদের অনেকে হেসে ফেলল। অনেকে মানেই বুঝল না ‘ভেটেরিনারি’ শব্দটির, উচ্চাঙ্গ সংগীত এবং গোরু-ঘোড়ার ডাক্তারির মধ্যে সম্বন্ধ কী? তা বুঝতে না পেরেই হয়তো চুপ করে থাকল।

প্রফেসার চিরকুমার বললেন, বেগ ইয়োর পার্ডন লাড্ডু।

স্যার, মডার্ন-মোস্ট ডিসকভারি হচ্ছে গান শুনলে গোরু বেশি দুধ দেয়, স্বাস্থ্যবান বাছুরের জন্ম দেয়। তাই এই গ্লোবালাইজেশনের যুগে বাবা বলেন, ভেটেরিনারি সায়ান্স এবং ক্ল্যাসিকাল মিউজিক-এর সায়ান্স মধ্যের সম্পর্ক নিয়ে পিএইচডি করতে।

—পিএইচডি? কোন ইউনিভার্সিটিতে?

পিণ্ডিসাসকান, আলাবামা, ইউ.এস.এ.। আপনি যেখানে পুজোর সময়ে পর পর অনেকগুলো প্রোগ্রাম করে এলেন স্যার। আমার ছোটোকাকার ছোটোশালা তো ওখানেই থাকেন, উনিই তো ছোটোকাকাকে লিখেছেন।

তোমার ছোটোকাকার ছোটোশালা ওখানে কী করেন? উনি কি গোরু- ঘোড়ার ডাক্তার? না উচ্চাঙ্গ সংগীতজ্ঞ?

উনি এন.আর.আই.।

আহা, সে তো বুঝতেই পারছি, নইলে সেখানে থাকবেন কেন? কী করেন? মানে, জীবিকার জন্যে কী করেন?

শুনেছি একটা পশ রেস্তরাঁয় থালা-বাসন ধোন। নিজের বাড়ি আছে, গাড়ি আছে, টিভি আছে তিনটে। ভেরি সাকসেসফুল মানুষ, অধিকাংশ এন.আর.আই.-রাই যেমন আর কী।

‘ওয়াহ! ওয়াহ! জিন্দগি মে এক ইনসান কি ঔর ক্যা চাহিয়ে।’

মোহনপ্রসাদ লাডসারিয়া বলল। সে দু-বছর শিখছে প্রফেসার চিরকুমারের কাছে। তবে ঠুংরির দিকেই নজর বেশি।

তারপর একটু চুপ করে কনটেমপ্টে করে মোহনপ্রসাদ বলল, আরে ইয়ার, কেয়া দেশ হ্যায়। টাইমপে হুঁয়া যাকর সিটল করনেসে আজ তো ম্যায় কোড়োরোপতি বন যাতা থা।

সিরাজুল অনেকক্ষণ সংযম দেখিয়ে চুপ করেছিল। সে এবারে বলল, ‘আপ অমিতাভজি কি কওন বনেগা কোড়োরোপতি মে কাহে কা না শামিল হোতে হেঁ।’

প্রফেসর চিরকুমার স্যার বললেন, সবে পুজো গেছে, তোমরা সবাই এখনও ফেস্টিভ মুডে তাই আমি সব ইনডিসিপ্লিন সহ্য করে নিচ্ছি। পরদিন থেকে কিন্তু…..। আচ্ছা। নাউ লেটস গেট ব্যাক টু শ্রুতি এগেইন।

তারপর বললেন, কতগুলি শ্রুতি আছে বলতে পারো কি কেউ?

লাড্ডু বলল, পারি স্যার।

—পারো? আচ্ছা কতগুলি শ্রুতি আছে তাই বলো তো আগে।

বাইশটি।

—কী কী নাম?

তীব্র, কুমুদ্বতী, মন্দা, ছন্দবতী, দয়াবতী, রঞ্জনী রৌদ্রী, ক্রোধা, বক্তিকা, প্রসারিণী, প্রীতি, মার্জনী, রক্তা, সন্দিপনী, আলাপিনী, রোহিণী, রম্য, উগ্রা, আর—আর ক্ষোভিণী।

—বা:। কিন্তু উনিশটা হল যে, আর তিনটি বাদ গেল কেন?

তাই না? ইস মনে পড়ছে না কেন?

কে বলতে পারে?

সেই হলুদ শাড়িপরা মেয়েটি হাত তুলল।

—বলো, বলো মা।

সে বলল, রক্তিকা, ক্ষিতি এবং মদন্তী।

বা:। ফার্স্ট ক্লাস। এখন শোনো, তোমরা যারা শ্রুতি সম্বন্ধে আরও জানতে চাও আমার বইটা তাড়াতাড়ি পড়ে ফেলো।

তারপর বললেন, ভারতমুনির মতে যেকোনো ৪ শ্রুতিসম্পন্ন স্বরের মধ্যে দুটি ক্ষুদ্রান্তর, ১টি মধ্যান্তর এবং ১টি বৃহদান্তর শ্রুতি থাকবে। স্বরান্তর সম্বন্ধে পুজোর আগের শেষক্লাসে তোমাদের আগেই বলেছি।

এখন শোনো, মন দিয়ে। ভারতমুনির মতে ক্ষুদ্রান্তরের মাপ হচ্ছে অনুপাত বা ২২ সেন্টস, মধ্যান্তরের মাপ ভগ্নাংশ বা ৭০ সেন্টস এবং বৃহদান্তরের মাপ ভগ্নাংশ বা ৯০ সেন্টস।

ম্যাথামেটিক্সের ছাত্র প্রেসিডেন্সির যযাতি চ্যাটার্জি, প্রফেসর চিরকুমারের ছাত্র, উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল, ডোন্ট মাইণ্ড স্যার, আমি ম্যাথামেটিক্সের ছাত্র বলেই জিজ্ঞেস করছি অনুপাত বা ভগ্নাংশ থেকে সেন্টস-এ কী করে পৌঁছোব?

অর্ক ভাবল, গান শিখতে এসে এ কোন বিপদে পড়ল!

প্রফেসার চিরকুমার একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, তোমার হবে চ্যাটার্জি। এইরকম ইনকুইজিটিভনেসই তো দরকার একমাসের ক্ল্যাসিকাল মিউজিকের এক মাসের কনডেন্সড ক্যাপশন কোর্সে। গানের জ্ঞান সমুদ্রের মতো। সিন্ধুকে বিন্দুতে আটানো তো সহজ কাজ নয়। আমার এই কাজে তোমার মতো ম্যাথমেটিশিয়ানের সাহায্যও দরকার। শোনো তা হলে বলি, অন্যরা হয়তো Bored হবে It’s all in the game.

এই ফ্রেজটি এবারে আমেরিকাতে গিয়ে শিখেছেন প্রফেসার। প্রায়ই ব্যবহার করেন। মওকামতো ব্যবহার করে শ্লাঘা বোধ করলেন।

চ্যাটার্জি তোমার প্রশ্নের উত্তর বলি:

সূত্র—

এখন ভগ্নাংশ বা অনুপাত থেকে সেন্টস-এ আসতে হলে, এখানে লব = ৯ এবং হর = ৮।

সূত্র অনুযায়ী।

বুঝলে চ্যাটার্জি?

এইভাবেই আমরা যেকোনো ভগ্নাংশ থেকে সেন্টসের হিসেবে পৌঁছোতে পারি।

অর্ক বলল উরি ফাদার! এটা কি গানের ক্লাস?

তাও আবার কনডেন্সড ক্যাপসুল? আজই শেষ এখানে আসা আমার। বুঝলি মেরজাপ।

এমন সময়ে মোবাইল ফোনটা বাজতে লাগল প্রফেসর চিরকুমারের সিল্কের কুর্তার পকেট থেকে।

মুখে কৃত্রিম বিরক্তি ফুটিয়ে তুলে সুইচটা অন করে বললেন, যেটা খুশি নিয়ে যাও। আমি কোথাওই বেরোব না। বড়ো বা ছোটো যেকোনো গাড়িই নিয়ে যেতে পারো। আমাকে জিজ্ঞেস করার কী ছিল? দু-টি গাড়ি, দু-টি ড্রাইভারই তো বসেই আছে।

বলেই, মোবাইলটা বন্ধ করে বললেন, জেনে গেছে তো যে, কল রিসিভ করতে চার্জ নেই অতএব….

ছাত্র-ছাত্রীদের কারও বুঝতে অসুবিধা হল না যে, প্রফেসার চিরকুমারের লেখা বই বা তারই নির্দেশিত দোকানের হারমোনিয়াম না কিনলেও তাঁর কিছু যায়-আসে না। তিনি প্রকৃতই বড়োলোক। ছাত্র-ছাত্রীদের দয়া বা সহযোগিতা ব্যতিরেকেই বড়োলোক। আর প্রকৃত গুণী না হলে কি বড়োলোক কেউই হতে পারে?

দুই

সরস্বতী পুজোর বেশি দেরি নেই। মেরজাপদের ভবানীপুরের গঙ্গাপারের প্রাচীন পাড়ার পুজোতে এখনও পুরোনো ঐতিহ্য বজায় আছে। সরস্বতী পুজোর রাতে যে- বনেদি বাড়ির উঠোনে পুজো হয় তারই দালানে গান-বাজনার আসর বসে। জনগণের অভিরুচি অনুযায়ী সবরকম গানেরই বন্দোবস্ত করতে হয়। জীবনমুখী থেকে উচ্চাঙ্গ সংগীত। ধীরে ধীরে উচ্চাঙ্গ সংগীতের কদর আবার ফিরে আসছে। মাঝে যেমন কর্পূরের মতো উবেই গেছিল তেমন নয় এখন, তবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে গান শোনার সময় এখন কার আছে? টেস্ট ক্রিকেটের জায়গায় ওয়ান ডে ক্রিকেটের মতন এই উচ্চাঙ্গ সংগীতের বেলাতেও কিছু করা উচিত। সেদিন তো নচিকেতা এক জায়গাতে বললেন যে, যমুনা নদীর জল শুকিয়ে যেতে বসেছে। আর কার এখন সময় আছে ‘যমুনা কি তীর’ শুনবে ঘণ্টা দু-ঘণ্টাভর। এই জেট এজ-এ ওসব গান-ফান সব অচল।

সময় সংক্ষেপ করতে হবে। ট্র্যাডিশন উড়িয়ে দিতে হবে। ক্রস ব্যাটে মারলেও ক্ষতি নেই, বাম্পারের পর বাম্পার দিলেও ক্ষতি নেই, রান করতে হবে, উইকেট পেতে হবে, কী করে হচ্ছে দ্যাট ইজ ইমম্যাটেরিয়াল, কোড়োরোপতি হতে হবে, ওই জন্যেই তো চিরকুমার স্যারকে এত ভালো লাগে। মানুষটা প্র্যাগমাটিক। উনি ওঁর স্কুলে একটি ডিপ্লোমা চালু করেছেন। ছ-মাসের কোর্স। তাতে রিটন টেস্ট থাকবে আর একটা ভাইবাবসি থুড়ি প্র্যাকটিকাল। বোর্ডে এস. আর. এ. থেকে একজনকে নেবেন, ভাতখান্ডে স্কুল থেকে একজনকে আর পুনের মারাঠি লবি থেকে একজন। প্লেনে যাতায়াত, তাজ বেঙ্গলে থাকা আর পঞ্চাশ হাজার করে ফিস। ডাকলেই আসবে। আজকাল ক্যাশই হল আসল। সুন্দরী মেয়েকে না বলা সোজা, বাপ-মায়ের আদেশ না-শোনা রেওয়াজ, কিন্তু ক্যাশকে ‘না’ বলার হিম্মত কার আছে? এই ডিপ্লোমা দেওয়া হবে তাজ বেঙ্গলে—সারাবাংলার মিডিয়া, ইনক্লুডিং ইলেকট্রনিক মিডিয়াকেও ডাকা হবে। তারপর ‘ক্ল্যাসিকাল-ক্যাপসুল’ ডিপ্লোমা নেওয়ার জন্যেই স্যারের স্কুলে মারামারি হবে।

মেরজাপদের পাড়ার যে বাড়ির ঠাকুরদালানে পুজো হবে তার পাশের বাড়ি হরিপদ ঘোষের। এক সময়ের নামি ক্লাসিকাল ভোকালিস্ট। আজকাল কেউ নামও জানে না। তাঁর কাছে তাঁর হারমোনিয়ামটা চাইতে যাওয়াতে যা-তা বলে তাড়িয়ে দিয়েছেন উনি পাড়ার ছেলেদের। হারমোনিয়ামটা প্রয়োজন ছিল সবিতাদির জন্যে। বেশি আর্টিস্ট বললে খরচ, তাই ওঁকেই বলেছে ওরা সবরকম গান গাইবার জন্যে। আর জীবনমুখী গান গাইবার জন্যে বজ্রকীটকে। তাঁর পদবি জানে না ওরা। পদবি-ফদবির কারবার উঠে গেছে। বাপ-ঠাকুরদার খোঁজ কে রাখে—এখন সবাই স্বয়ম্ভু। ক-দিন বাদে তো টেস্ট-টিউব বেবি ছাড়া ক্লোনিংও হবে। মানুষের কোনো অতীত থাকবে না। থাকবে না কোনো বংশপরিচয়। হরিজেঠু ধমকে ওদের বলেছিলেন, ‘হারমোনিয়াম কি হ্যাজাক নাকি? না প্রেসার কুকার? যে তোমরা চাইলেই দেওয়া যাবে? এইসব জিনিসের ব্যবহার ক-টা মানুষ জানে? কে তোমাদের সবিতাদিদি? তাঁরা তো শুনি ছ-টি হারমোনিয়াম ছ-টি তবলা নিয়ে গান গাইতে বসেন। গান কি ঘোড়াদৌড় না ক্যারাটে? যাও যাও, ওসব হবে না।

ছেলেরা ঠিক করেছে আজই সন্ধের পর ইট মেরে বুড়োর বাড়ির সব ক-টি জানলার কাচ ভেঙে দেবে আর তাঁর নাতনিকে আওয়াজ দেবে। আমের গুটি কেবল এসেছে, তাই সই, একদিন ব্যানার্জিদের পোড়োবাড়িতে ধরে নিয়ে গিয়ে কাঁচামিঠে আম খাবে সকলে মিলে আর কাঠবিড়ালি। সরস্বতী পুজোতে চাঁদাও দেবে না, হারমোনিয়ামও দেবে না, আর নিজে ক্ল্যাসিকাল মিউজিক মারাবে সেটি হবে না। বুড়োর যুবতী নাতনির মন্দ্রসপ্তকের কোমল পর্দাগুলোকে সকলে মিলে ফর্দাফাই করে দেবে। গান-বাজনাতে যারা মদত দেবে না তাদের হাল এমনই হবে। বুড়ো করবেটা কী? ছাত্রও নেই একজন, রোজগারও নেই কোনো। ইঞ্জিনিয়ার ছেলে মরে গেছে কবে, আছে ছেলের বউ আর ওই নাতনি। তার নাম আবার এক শ্রুতির নামে, ‘কুমুদ্বতী’। ক্লাস টেনে পড়ে নিভাননি বালিকা বিদ্যালয়ে।

হরিপদবাবু একলাই বসেছিলেন বাইরের ঘরে তক্তপোশের ওপর। তাঁর ওপরে একটা শতরঞ্চি পাতা। সেটার রং ছিল একদিন ঘোর লাল। তেলচিটে হয়ে এখন কালো দেখায়। জানলার কার্নিশে পায়রাগুলো বকবকম করছে। আজ রেশন তুলতে হবে। বউমা মনে করিয়ে দিয়ে গেছে দু-বার। কাজের মেয়ে মোক্ষদা যাবে রেশন তুলতে। কিন্তু টাকা কোথায়? মাসের শেষ।

বাইরের ভেজানো দরজা খুলে বিপিন ঢুকল, কী হরিকাকা? একা বসে যে!

একাই তো আমি। তুই-ই শুধু আসিস মাঝেমধ্যে। আর সবাই তো ভুলে গেছে। গান-বাজনার কদর আর আছে কী?

গান-বাজনা বোলো না হরিকাকা, বলো বাজনা-গান। সেদিন রামকুমারবাবুর গান শুনতে গেছিলাম দক্ষিণেশ্বরে। শ্যামাসংগীত। অনেক কথা হল। তিনিই বললেন কথাটা। বললেন, আরে গান-বাজনা আর নেই। এখন শুধু বাজনা-গান। খালি গলাতে বা শুধু তানপুরাতে গাইতে বলো তো হরি এক-জনকেও আজকাল। দেখবে সুর হয় লাগছে না, লাগলেও পুরো লাগছে না, স্বর কাঁপছে আর সেইসব গাইয়েরই বছরে আঠারো-কুড়ি লাখ রোজগার হেসে-খেলে।

—তাই? রামবাবু তাই বলেছেন? রামবাবু তাও জীবনের শেষে এসে কিছু মান, কিছু যশ, কিছু অর্থ পেয়েছেন। গোপালবাবুর খোঁজ কি রাখো কোনো?

—কোন গোপালবাবু?

আরে হাওড়ার গোপাল চট্টোপাধ্যায়। টপ্পা গায়ক। টপ্পা-ধামার-ধ্রুপদ এসবও যে গান, কীর্তন যে বাঙালির এক পরমসম্পদ, এসব আর কে মনে রেখেছে আজকাল। খোঁজ নিয়ে দেখো তো! গোপালবাবুরও ওইরকমই দশা। তাও তাঁর ছেলে আছে, সেও গান-বাজনা করে, রেডিয়োতে গায়। আর রেডিয়োতে গেয়েও-বা কী হবে এখন। প্রসার ভারতী না কী হয়েছে। গত বছর রাতে একটি খেয়ালের প্রোগ্রাম করেছিলাম। আমি এ-হাই। তাও পেলে হাজার দেড়েক পেতাম। তা আজ অবধিও চেক পেলাম না। এদিকে রেশন তোলার টাকা নেই।

—আরে তাতে কী হয়েছে কাকা? আমি তো আছি। কুমুদ্বতী কোথায়?

সে কম্পিউটার ক্লাস করতে গেছে। যদি ডিপ্লোমা পেয়ে কোথাও কাজ পায় একটা স্কুল ফাইনাল পাশ করার সঙ্গে সঙ্গেই।

—মন্দ্রা কোথায়?

—জানি না। নিশ্চয়ই রান্না ঘরে। গিয়ে দ্যাখো-না।

—আহা দেখে আসি। রেশন না তুললে চলবে কী করে!

তোর হাতে ওটা কীসের থলি রে বিপিন?

আজ বাজারে গেছিলাম। ভালো ইলিশ উঠেছিল। বাড়ির জন্য নিলাম তাই। ভাবলাম আপনার জন্যেও একটা নিই।

—ইলিশ! বলিস কী তুই? ইলিশের তো শুনেছি দেড়শো পৌনে দুশো কেজি।

—তা তো হবেই হরিকাকা। এক বোতল বিয়ারের দাম আজকাল ৪০ টাকা। টাকার কি আর দাম আছে কিছু? যাই, দেখি গে মন্দ্রাকে দিয়ে আসি। আজ আমার পরিবার গেছে শ্বশুরবাড়ি, ছেলেকে নিয়ে ইলিশ মাছ নিয়ে বরানগরে। তাই আমি আজ দুপুরে আপনার এখানেই খাব। আর একটু গান-বাজনাও হবে।

হরিপদবাবু চুপ করে অর্ধেক কৃতজ্ঞতা অর্ধেক গ্লানিমাখা চোখে বিপিনের দিকে চেয়ে রইলেন। বিপিন বসবার ঘর থেকেই—মন্দ্রা, কোথায় তুমি? বলে ভেতরে চলে গেল।

একটু পরেই মোক্ষদা রেশনের থলি এবং বাজারের থলি হাতে গদগদ মুখে দরজা খুলে বাইরে গেল। হরিবাবু বুঝলেন যা বোঝার। তারপর বাতের ব্যথাতে কঁকিয়ে কঁকিয়ে নিজেই হারমোনিয়ামটাকে এনে তক্তপোশের ওপরে রাখলেন। তবলা আর বাঁয়াটাকেও আনবেন ভাবলেন। কিন্তু বাজাবে কে?

হারমোনিয়ামটার ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে তাঁর চোখে জল এল। জার্মানির তৈরি রিড, হাতির দাঁতের চাবি। আর তানপুরাটা? মিরাজের। তুম্বটা আফ্রিকা থেকে আমদানি করা কুমড়ো থেকে বানানো। আর তবলাটাই-বা কী? পুণে থেকে আনিয়েছিলেন। একবার হাত ছোঁয়ালেই অনুরণন ওঠে। উস্তাদ কেরামতুল্লা খাঁ সাহেবের ছেলে সাবির একবার দেখে বলেছিল আমাকে দেবেন চাচাজি, যা দাম চাইবেন তাই দেব। উনি বলেছিলেন, তুমি নিজে বাহাদুর হয়ে এরকম কথা আর কারওকে বোলো না। এ তো শুধুমাত্র তবলাই নয় বেটা। এরমধ্যেই যে আমার জীবন-যৌবন সব বাঁধা পড়ে আছে।

মাঝে মাঝেই মাঝরাতে উঠে দেখে যান হরিবাবু ইঁদুরে কেটে দিয়ে গেল কি না!

বিপিন এল। বলল, মন্দ্রাকে বললাম একটু ইলিশ মাছ ভাজা করে দিতে। দেখুন হরিকাকা, আপনার জন্যে কী এনেছি।

—কী এটা?

—রিকার্ডো রিসার্ভা রাম।

—সেটা কী জিনিস? রাম তো জানি, ওল্ড মংক।

—খেয়েই দ্যাখো। দাঁড়াও জল নিয়ে আসি। ফ্রিজ তো নেই, থাকলে বরফ দিয়ে জমত ভালো। একটু লেবু আর লংকা ফেলে দিচ্ছি। আমি প্রসাদ নেব। তুমিই বেশিটা খেয়ে আশাবরি শোনাও তো দেখি। তোমার স্পেশাল আশাবরি।

—আমার গলাও আজকাল সুরে বলে না।

আলবাত বলে। দুটো পেগ খাও তারপর দেখি গলা বলে কি না! আমি তানপুরা ছাড়ব। কোথায় সেটা?

ওই আছে ওইখানে, সাবধানে ছাড়িস।

ইলিশ মাছ ভাজা খেয়ে, দু-পেগ রাম খেয়ে সত্যিই হরিবাবুর প্রাণটা একটু গান গান করতে লাগল। ইতিমধ্যে কুমুদ্বতীও এল। পাঁচ বছর বয়সে বাবা-হারানো নানারকমের অভাবের মধ্যে বড়ো হয়ে-ওঠা মেয়েটাও খুব খুশি হয় বিপিন এলে। যে সুন্দর ফ্রকটা ও পরে আছে সেটাও পুজোর সময় বিপিনেরই দেওয়া।

হরিবাবু আর একটা রাম ঢেলে নিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বুঝলেন, তার বউমা তো বটেই নাতনিটাও-না কোনোদিন বিপিনের ভোগে চলে যায়। একদিন বিপিনকে বলেছিলেন, তুই এত টাকা কোত্থেকে পাস রে বিপিন? চাকরি তো করিস আবগারি ইন্সপেক্টরের।

অমন প্রশ্ন করবেন না কাকা। টাকা কী কাজে লাগে আজকাল টাকার পরিচয় সেটাই। শুধুমাত্র সেটা। টাকা কোথা থেকে এল, কী করে এল, সেটা অবান্তর। টাকা চারধারে উড়ে বেড়াচ্ছে। শুধু ধরে নিতে জানা চাই। একবার সেই ধরাটা শিখে নিতে পারলেই গপাগপ করে ধরে যাও। তুমি এইসব নিয়ে মাথা ঘামাবে না। অতীন তো কবেই চলে গেছে। সবসময়ই মনে করবে যে আমি তোমার চলে-যাওয়া ছেলে।

বিপিন বলল, কুমু, তুই তানপুরা ছাড়। আমি তবলাতে বসি। আয় অনেক দিন পর একটু গান-বাজনা হোক। খিদে হলে ইলিশ মাছটা জমবে ভালো।

আসছি কাকু।

বলে কুমুদ্বতী বাইরে পরার জামা ছেড়ে আসতে গেল।

তানপুরাটাও নিয়ে এল বিপিন।

তারপর বলল, চারধারে আজকাল ক্ল্যাসিকাল মিউজিকের স্কুল হচ্ছে। ইয়ং ছেলে- মেয়েদের শখ হয়েছে যে সকলেই অজয় চক্রবর্তী, রশিদ খাঁ হবে। অজয়দার মেয়ে কৌশিকী তো দারুণ গাইছে। রশিদের দুটি পুঁচকি পুঁচকি মেয়ে আছে। নাম রেখেছে সুহা আর সুঘরাই। তারাও কালে খুব ভালো গাইবে।

—কী নাম বললি?

—রাগের নামে নাম, সুহা আর সুঘরাই।

—বা: বা:, ভারি সুন্দর তো। গাইয়ের মেয়েদের নাম তো এরকমই হওয়া উচিত।

—রশিদের বাড়ির নামটাও চমৎকার দিয়েছে।

—কী?

—‘শ্রী’। তাও রাগের নামে।

—বা:।

আর কী বাড়ি হিরুকাকা! দেখলেও চোখ জুড়ায়।

—রশিদ রশিদই। ক্রিকেট তো লক্ষ বাঙালি ছেলেই খেলে। সবাই কি সৌরভ হতে পেরেছে না পারবে? ঈশ্বরের দয়া থাকে কারও কারও ওপরে। রশিদের গান আমি ওর আট বছর বয়সে শুনেছি। ওর জাত আলাদা। উস্তাদ বড়ে গুলাম আলি খাঁ সাহেবের পর এমন জলদগম্ভীর গলা আর শুনেছি বলে মনে পড়ে না। তবে আমাদের অজয়ও ভালো গায়। খুবই ভালো। উলহাস আছে, অরুণ আছে, সকলেই ভালো।

—তা কেন বিপিন? যার যেমন ইচ্ছে সে তেমন করবে। আমরা যারা সাধারণ, তাদের কী এক্তিয়ার আছে প্রকৃত গুণীদের উপদেশ দেবার? তাঁরা কুদরতি ইনসান, কুদরত তাঁদের যেখানে নিয়ে যাবেন তাঁরা সেখানেই যাবেন।

আমি বলছিলাম, আপনিও-না কেন এরকম একটা স্কুল খুলে ফেলুন? আমি ক্যাপিটাল দেব, বিজ্ঞাপন দেব, সাজসরঞ্জাম কিনে দেব, আপনিও ছ-মাস কী এক বছরের ডিপ্লোমা ক্লাস চালু করুন। চেষ্টাচরিত্রির করে, দরকার হলে টাকা খাইয়ে সরকারি অ্যাফিলিয়েশন একটা জোগাড় করতে পারলে আর দেখছে কে? মাসে আপনার এক লাখ রোজগার হবে হেসে-খেলে আর কুমুকেও তুলে ধরতে পারবেন। বেটির ওপরেও ঈশ্বরের আশীর্বাদ আছে।

—ছি: ছি:। অমন বলিসনে বিপিন। টাকা তোর মাথাই খারাপ করে দিয়েছে। তোর বাবা কী আমি পয়সা রোজগার করার জন্যে গান-বাজনা শিখিনি। আমাদের গুরু গিরিজাবাবু—বলেই, দু-কানে হাত ছোঁয়ালেন, আমাদের তেমন গায়ক তৈরি করেননি। পয়সা যদি থাকে তো ভালো, না এলে নেই, তা বলে ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সংগীতের এতবড়ো অবমাননা আমার দ্বারা হবে না।

—তবে আর কী। না গেয়ে থাকো। চিরকুমারবাবু কী করে ফেললেন জানো না? একখানা ওপেল আর একখানা ওয়াগন-আর গাড়ি। যাদবপুরে চোখ ঝলসানো তেতলা বাড়ি, ঘনঘন ফরেন টুর।

যাক যাক, ওসব কথা থাক। আনপড় এন. আর. আই.দের গান শোনাবার জন্যে ঘনঘন বাইরে গেলেই কিছু ল্যাজ গজায় না। আরে দেশের মানুষ তাকে কী চোখে দেখে, কতটুকু ইজ্জত দেয় দ্যাখ।

তারপর বললেন, আমি না খেয়েই মরব তাও ভালো, তোর আর আমার কাছে আসতে হবে না, বিকার্ডি আর ইলিশ মাছ খাওয়াতে হবে না, র‌্যাশন তোলার টাকাও দিতে হবে না, আমি…..

বলতে বলতে কেঁদে ফেললেন হরিবাবু।

বিপিন বলল, এ কী কেলো। আপনার ভালোর জন্যে বললাম।

আমার ভালোর কথা তোকে ভাবতে হবে না। ওই চিরকুমার তো একটা গিধধর। পাটের ব্যাবসা বা ভেলিগুড়ের ব্যাবসা করলেও ও টাকা রোজগার করতে পারত। ও ক্ল্যাসিকাল মিউজিকের এতবড়ো সর্বনাশ কেন যে করতে বসেছে, তা ওই জানে।

আপনি গাইবেন না আশাবরি? কতদিন শুনিনি? ধুরন্ধর বিপিন ঠিক জায়গাতে ঘা দিল।

গাইছি, বললেন হরিবাবু। তারপর বললেন, ‘এই চিরকুমারদের ঈশ্বর ক্ষমা করবেন না। এত মানুষের এত সুদীর্ঘ দিনের সাধনা আর ত্যাগকে ও ধূলিসাৎ করে দেয় এমন সাধ্য কী ওর। এই সময়টাই বাংলার সংগীত জগতে সবচেয়ে বড়ো পরীক্ষার সময়, বুঝলি বিপিন। ইকনমিকসে কুমুদবাবুর কাছে পড়েছিলাম ‘BAD MONEY DRIVES AWAY GOOD MONEY’ কী সংগীতজগতে, কী সাহিত্যজগতে সর্বত্রই এই নিয়মই হয়েছে। কিন্তু এই সময়টার হাত থেকে আমরা যদি নিজেদের বাঁচাতে পারি—পারব, বাঁচাতেই হবে, তবে ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সংগীত আবার তার স্বমহিমাতে অধিষ্ঠিত হবে। দেখিস।

অনেকক্ষণ পরে হরিবাবু, ভবানীপুরে সেই প্রায়ান্ধকার ঘরে, কার্নিশের পায়রার বকম-বকমের মধ্যে, সুর লাগালেন হারমোনিয়ামে এবং তারপর গলায়। কুমু আগেই তানপুরা ছাড়তে শুরু করেছিল। তানপুরা, দেখল বিপিন, বাঁধাই ছিল। তারপর সুর লাগালেন হরিবাবু। সামান্য আলাপ করে ধরে দিলেন হিরুবাবু ‘তুয়া চরণ-কমল পর মন ভ্রমর ভালভান যঁউ চন্দ চকোর।’

এই উতরি—রেখবওয়ালা আশাবরি সকলে রাগের চেহারা অবিকৃত রেখে গাইতে পারেন না। অনেক বড়ো বড়ো উস্তাদও গুবলেট করে ফেলেন। খেয়ালের শরীরের মধ্যে একটু এদিক-ওদিক নড়তে-চড়তে গেলেই ভৈরবী বা জৌনপুরির ছায়া পড়ে। অথবা কোমল রেখাবটি চড়ে গিয়ে তীব্র রেখাব হয়ে যায়। আবার প্রাণপণে রেখাবের কোমলত্ব সুরক্ষিত করতে গেলেও হয় বিলাসখানি না-হয় নট ভৈরবের চেহারা ধরতে পারে এই আশাবরি। উস্তাদ বদল খাঁ সাহেব নাকি বলতেন, তেমন হলে, সঙ্গে সঙ্গে আশাবরির ‘হলাকত’ অর্থাৎ বেমক্কা মৃত্যু ঘটে। হয়তো এইসব কারণেই খেয়ালিরা উতরা-রেখাবকে ছেঁটে ফেলে দিয়ে তার জায়গাতে চড়ি রেখাব কায়েম করেছিলেন।

কিন্তু এইসব কোনো ফাঁদেই পা না-দিয়ে হরিকাকা গভীর সুরে ডুবে গিয়ে অসামান্যভাবে সেই উতরা রেখাবওয়াল আশাবরি গেয়ে চলছিলেন। গানের বাণী যেন মধুলোভী মৌমাছির মতন গানের ওপরে একবার উড়ে আর বার বসে সরে সরে যাচ্ছিল।

গান শুনতে শুনতে বিপিনের দু-চোখ দিয়ে জলের ধারা বইতে লাগল। এক সময়ে অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে এবং সাধনা করার মতো করে উচ্চাঙ্গ সংগীত শিখেছিল। কিন্তু ও এখন অন্যরকম হয়ে গেছে। একেবারেই অন্যরকম।

ঘুসখোর, দুশ্চরিত্র, ধান্দাবাজ বিপিন নি:শব্দে কাঁদতে কাঁদতে হঠাৎই আবিষ্কার করল যে, তখনও ও পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়নি। তখনও তার শুদ্ধির সম্ভাবনা আছে, যা শুধু এমন গানের মধ্যে দিয়েই সম্ভব।

শক্তি চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘প্রভু নষ্ট হয়ে যাই’। যে মানুষ বুঝতে পারে যে, সে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বা গেছে, শুধু তার পক্ষেই হয়তো শুদ্ধি সম্ভব।

বিপিন ঠিক করল যে রাগে সে গাইবে বলে আজ সকালে মন ঠিক করেছে, সেই রাগেই গাইবে বাকি জীবন। অন্য কোনো তীব্র ও কোমল স্বরের বা অন্য কোনো রাগের ভেজালকে সে ভিড়তে দেবে না আর তার জীবনের গানে।

বিপিন ভাবছিল, এই জন্যেই বোধ হয় শুদ্ধ গান, শুদ্ধ সাহিত্য, শুদ্ধ চিত্রকলা হাজার হাজার বছর ধরে অন্ধ-বেপথু মানুষকে সততার স্নিগ্ধ পথে হাত ধরে চালিত করে নিয়ে এসেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *