জগন্নাথ

জগন্নাথ

পুলিনবাবু নস্যির ডিবেটা বের করে এক টিপ নস্যি নিলেন। নীলরঙা ফুলহাতা শার্টের কোলের কাছে পড়ল কিছুটা। ঘাড় নীচু করে দেখলেন একবার উদ্দেশ্যহীন চোখে, বাইফোকাল চশমার ফাঁক দিয়ে। বাঁ-পকেট থেকে ছেঁড়া ন্যাকড়া বের করে ঝাড়লেন জায়গাটা।

তারপরই, সামনে খুলে-রাখা পার্সোনাল লেজারটাতে চোখ দু-টি নিবদ্ধ করলেন।

উলটোদিকের টেবিল থেকে তাঁর অল্পবয়সি সহকর্মী হেমেন বলল, কী সিনেমা দেখলেন দাদা? দেখলেন কিছু দাদা?

শুনতে পেলেন না পুলিনবাবু।

যখন যে কাজটা করেন তাতে এমনই ডুবে যান উনি যে, তখন পৃথিবীর অন্য কিছু সম্বন্ধেই হুঁশ থাকে না।

হেমেন আবারও বলল, এই যে পুলিনদা। কোনো সিনেমাই দেখলেন না এবারে কলকাতায় এসে? গৌতম ঘোষ-এর ‘পার’ও না?

মুখ তুললেন উনি।

হেমেনের দিকে একবার তাকিয়েই, মুখ নামিয়ে বললেন, ‘পার’ অনেক দূরে এখনও। তেষট্টি হাজার দুশো পঁয়ষট্টি টাকার ডিফারেন্স ছিল ট্রায়াল ব্যালান্স-এ। মোটে হাজার পাঁচেক টাকা খুঁজে পেলাম। কিন্তু সাড়ে ছ-হাজার আবার বেড়ে গেল। ক্রেডিটে বেশি ছিল।

ঘরের সকলেই প্রায় হেসে উঠল একসঙ্গে, পুলিনবাবুর কথা শুনে।

তাদের সম্মিলিত হাসির শব্দে মুখ তুলে চাইলেন পুলিনবাবু। হাসির কারণটা ঠিক বুঝতে পারলেন না।

হেমেন বলল, আপনাকে নিয়ে চলে না দাদা। ট্রায়াল ব্যালান্স-এর পার তো চিরদিনই দূরে থাকে। ‘পার’ ছবিটাও দেখলেন না?— কলকাতায় এলেন আপনি? গৌতম ঘোষের ছবি। একটা বড়ো কিছু মিস করলেন জীবনে!

ছবি? পুলিনবাবু স্বগতোক্তি করলেন। স্বপ্নোত্থিতর মতো।

হ্যাঁ হ্যাঁ ছবি! ফিলিম।

উনি কোনো উত্তর দিলেন না। চোখ নামিয়ে নিজের কাজ করতে লাগলেন।

বেশিদিন খাতা লিখলে মানুষ সত্যিই আপনার মতো মাছিমারা কেরানিই হয়ে যায়। হেমেন বলল।

হেমেনের টেবিলেই বসে যিশু। যিশু বলল, শুয়োর পার করাবার সিনটা দারুণ, না রে?

জবাব নেই।

সমরেশ মজুমদারের লেখা, না?

সমরেশ মজুমদার নয় রে? গুরু সমরেশ বসুর। গল্পের নাম ছিল ‘পাড়ি’।

গৌতম ঘোষের সঙ্গে আলাপ থাকলে বলতাম, এবার আমাদের দুঃখ-দুর্দশার কাহিনি নিয়ে একটা ছবি তুলতে। এই ধর আমাদের পুলিনদা। এঁকে নিয়ে যদি কোনো লেখক একটি গল্প লিখত তবে কী করুণ হত বল তো? শুয়োরগুলো তাও পেরিয়ে গেল নদী। কত মানুষ আছে আমাদেরই মধ্যে, যারা চেষ্টা করল, নাকানিচোবানি খেল; কিন্তু নদী আর পেরুনো হল না তাদের।

গোপেন হেসে উঠল হেমেনের কথায়।

কিন্তু হাসবার জন্যে বলেনি হেমেন কথাটা। অন্যরা স্তব্ধ হয়ে পুলিনদার দিকে চেয়ে রইল।

স্টিল-ফ্রেমের চশমাটা সরু নাকের ডগায় নেমে এসেছিল।

পুলিনদা চোখ দু-টি লেজার থেকে তুলে ওদের দিকে তাকালেন। বললেন, ঠিকই বলেছ হেমেন। বায়োস্কোপের হিরো হওয়া শুয়োরের চেয়েও নিকৃষ্ট অনেক মানুষই থাকে। সত্যিই থাকে। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, যেমন আমি।

এমন সময় রন্টু, হেমেনের সিগারেট আর পুলিনবাবুর পান নিয়ে, সুয়িং ডোর খুলে ঢুকল।

ঢুকেই বলল, আবার এয়েচে।

কে?

পানটা নিতে নিতে পুলিনবাবু শুধোলেন।

সেই। কম্পু কোম্পানির লোক।

হেমেন, গোপেন এবং অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্টের সকলেই কাজ ছেড়ে এই নতুন আলোচনায় মেতে উঠল।

রন্টু চায়ের জলটা চাপিয়ে দিয়ে বলল, ইনি অন্য কোম্পানির লোক। সেদিন এসেছিল এইচ.এম.টি. থেকে।

ছোটোসাহেব কী বলছেন?

ছোটোসায়েব তো নেবেনই বলেছেন?

সবাই শালা রাজীব গান্ধি হয়ে গেল মাইরি! কম্পিউটার না বসালে আর এফিসিয়েন্সি বাড়ছে না! সকলেই মডার্ন। ছোটোবাবুর বাবা খোদ মালিক যে এতদিন হাফহাতা ফতুয়া গায়ে আর ভুঁড়ির নীচে ধুতি পরে এই বিজনেস এত বড়ো করে গেল সেই আসল মালিকই এখন ফোতো। কম্পিউটার না বসালে নাকি এফিসিয়েন্সি বাড়ানো যাচ্ছে না। প্র্যাগমাটিজম আনতে হবে। আমরা সকলেই ওয়ার্থলেস। শালা আমাদের সুদ্ধু নাজাই খাতে লিখে দিলে র‌্যা!

ঠিক সেই সময়েই ছোটোবাবু দরজা খুলে ঢুকলেন। চোখে ফোটোসান লেন্সের চশমা। আলো বাড়া-কমার সঙ্গে সঙ্গে রং পালটে যায়। ছোটোবাবুর মুখের খচরামির রঙেরই মতো। জিন্স-এর ওপরে ঘি-রঙা একটা টি-শার্ট। সিল্কের।

ওকে দেখেই সকলে চুপ করে গিয়েই দাঁড়িয়ে উঠলেন।

শুধুমাত্র পুলিনবাবু ছাড়া। টেবিলের নীচে অদৃশ্য হয়ে-যাওয়া একপাটি চটি খোঁজার জন্যে এদিকে-ওদিকে পা চালাচ্ছিলেন উনি তখন আপ্রাণ চেষ্টায়। বাঁ-পায়ের চটিটা কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছিলেন না। এই রন্টু ছোকরা যত বারই ওঁর টেবিলের কাছে আসে, তত বারই লাথি দিয়ে ওঁর চটিগুলো এদিক-ওদিক ছটকে দেয়। ইচ্ছে করে যে করে, তা নয়। ছোঁড়ার পায়ে খুর লাগানো আছে।

পুলিনবাবু।

ছোটোবাবু ডাকলেন।

স্যার।

বলেই, এক পায়ে চটি গলিয়ে উঠে দাঁড়ালেন উনি।

কতদূর হল আপনার? বাগান থেকে ফোন এসেছিল। তাড়াতাড়ি দরকার আপনাকে সেখানে। এবারে আবার ট্যাক্স-অডিটের ঝামেলা আছে। অডিটের ছেলেরা আপনার জন্যে বসে আছে। মিলিয়ে দিয়েই ফিরে যান।

ছোটোবাবু প্রায় বাঙালিদের মতোই বাংলা বলেন। অথচ বাঙালি ওঁরা মোটেই নন। বাঙালিরা এই কোম্পানিতে কেরানিই। যত বড়ো বড়ো পোস্ট সবই তাঁর নিজের রাজ্যের লোক।

পুলিনবাবু বললেন, আজ্ঞে। কিন্তু ডিফারেন্স যে বেড়ে গেল এদিকে, স্যার।

তা আমি জানি না। মিলিয়ে দিয়েই চলে যান। বুঝেছেন?

শেষ শব্দটাতে অসহিষ্ণুতার ছোঁয়া লাগানো।

ছোটোবাবু চলে গেলেন তাঁর নিজের চেম্বারে।

বাবাই বলল, কম্পিউটারের কথা আর বলিস না। তার খেল দেখলি সেদিন?

কোনদিন?

সকলেই জিজ্ঞেস করল সমস্বরে। পুলিনবাবু ছাড়া।

আরে! ওই তো শনিবার না রবিবার রাতে। মিস ইউনিভার্স-এর সিলেকশন দেখাল না টিভিতে? স্টেটস-এর মায়ামি থেকে? স্যাটালাইটে? একটা কাপড় কোম্পানির স্পনসরড প্রোগ্রাম ছিল।

আমরা তো দেখিনি!

আমি গেসলুম মামাবাড়িতে। রাত প্রায় পৌনে এগোরোটায় ছিল। কালার টিভিতে দেখলুম। সুন্দরী মেয়ে ছিল দুটিই। আর সবই দাঁত বের করা। কী করতে যে গেছে। একজন মিস আয়ার্ল্যাণ্ড। আর অন্য-জন মিস স্পেইন। কম্পিউটারে সব জাজদের দেওয়া ডাটা ফিড করে তার উত্তর আবার সেখানকার মস্ত এক অ্যাকাউন্টেন্সি ফার্ম-এর পার্টনার নিজে নিয়ে এলেন।

কে হল মিস ইউনিভার্স?

ঝুল। পুরো ব্যাপারটাই ঝুল। ওদের দু-জনের কেউই হল না। হল বোধ হয় মিস পুরটোরিকো। সোনাগাছির মাসির মতো চেহারা মাইরি, দাঁতের পাটির মধ্যে আবার কী একটা মিসিং। এবং মিশি অ্যাডেড। কোনো মানে হয়!

হেমেন বলল, কথাই তো আছে! কম্পিউটারে যদি গার্বেজ ফিড করো তো গার্বেজই বেরুবে। মানুষের মাথার কোনোই দাম নেই। সবই নাকি কম্পিউটারে করে দেবে! আমরা কি বসে বসে…..

বাবাই বলল, আরে! তোরাও যেমন। আজকাল আমার ছোটোবাবুর মতো সাহেব ব্যাবসাদারেরা কী করছে জানিস না? খাতায় যত তিন-নম্বরি হিসেব সব কম্পিউটারের ভেতর পুরে দিচ্ছে। ধরো শালা! রেইড করে কী ধরবে? ইনকাম-ট্যাক্স ডিপার্টের লোক এসে আঙুল চুষবে বসে বসে। নো খাতাপত্তর, নো হিসেব। লুকিয়ে থাকবে জ্বলজ্বলে নানারঙা ডিজিটালস-এ…..

এবার যতীন বলল, তিন নম্বরটা আবার কী মাল মাইরি? আমাদের দু-নম্বরি অবধিই তো জানা ছিল। তুইও দেখছি কম্পিউটারের মতোই অ্যাডভান্সড হয়ে যাচ্ছিস। আমাদের মোটা বুদ্ধির বাইরে।

সে কী রে! অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্টে কাজ করিস আর তিন নম্বর কাকে বলে তাই-ই জানিস না?

না তো!

সকলেই বলল সমস্বরে।

একমাত্র পুলিনবাবু ছাড়া।

এখানে উনিই একমাত্র মানুষ, যিনি এক নম্বর ছাড়া কিছুই জানেন না। একনম্বরি মানুষ তিনি, সে যুগের মানুষ, সেযুগে কম্পিউটারও ছিল না, দু-নম্বর এসবও ছিল না।

সকলে আবারও বলল, বল বাবাই! বুঝিয়ে বল।

বাবাই যিশুকে বলল, আগে সিগারেট ছাড়ো তো গুরু!

সিগারেট ধরিয়ে লম্বা একটা টান মেরে বলল, মনে করো আমাদের পাঁচ-জনের একটা পার্টনারশিপ ফার্ম আছে। আমরা প্রফিট করলাম, ধরো, পাঁচ লাখ। তার মধ্যে আড়াই লাখ এক নম্বরে দেখালাম আর আড়াই লাখ দু-নম্বর করে দিলাম। মনে করো আমার হাতেই অ্যাকাউন্টস। এই ব্যাপারটা শুধু আমিই জানি। আমি অন্য পার্টনারদের বললাম, আসলে প্রফিট হয়েছিল সাড়ে চার লাখ। মানে আড়াই নয়, শুধু দু-লাখই দু-নম্বর করা হয়েছে। ওই দু-লাখ পাঁচ-জনে চল্লিশ হাজার টাকা করে ভাগ করে নিলাম। বাকি পঞ্চাশ আমি একা মেরে দিলাম। ওই পঞ্চাশ হাজার টাকাটা আমার তিন নম্বর হল না?

সকলেই হো-হো করে হেসে উঠল।

যতীন টেবিল বাজাল উত্তেজনায়।

শুধু পুলিনবাবুই হাসলেন না।

আরও এক টিপ নস্যি দিয়ে ট্রায়াল ব্যালান্স-এর ডিফারেন্স খুঁজতে লাগলেন। মনে মনে বললেন, এই ছোকরাগুলো পোস্টিং কাস্টিং কিছুই ঠিক করে করবে না, তা ডিফারেন্সের কী দোষ। ডিফারেন্স তো হবেই। একদল দায়িত্বজ্ঞানহীন ছোকরার দল।

হেমেন বলল, তুই এই তিন নম্বর শিখলি কার কাছ থেকে?

কেন? আমাদের যে ফার্ম চায়ের বাক্স সাপ্লাই করে, সেই আগরওয়ালার কাছে। তাদের অ্যাকাউন্টেন্ট ভারি কম্পিটেন্ট।

পুলিনবাবু একবার তাকালেন আড়চোখে।

কিন্তু কিছু বললেন না।

মনে মনে বললেন, কম্পিটেন্ট! চোর হলেই আজকাল কম্পিটেন্ট!

পুলিনবাবু বাগানের অ্যাকাউন্টেন্ট! উত্তরবঙ্গ ডুয়ার্সে এখন বাঙালিদের বাগান আর নেই বললেই চলে। সাহেবদের বাগানগুলোও সব কিনে নিয়েছে বড়োলোক মাড়োয়ারিরা।

ছোটো বাগানগুলোও সব কিনে নিয়েছে। মাঝারি মাড়োয়ারিরা। তারাই এখন সাহেব।

একটা-দুটো বাগান অন্যরাও কিনেছে, যেমন কলকাতার কেনিলওয়ার্থ হোটেলের সিন্ধি মালিক ভরত সাহেব। পরে অবশ্য বাগান ছেড়ে দিয়েছেন উনি।

যারাই তাদের অন্ন দিয়েছে, তাদের চাকরি খাওয়ার ক্ষমতা যাদেরই হাতে যখনই ছিল, যারাই লাথি মারার ক্ষমতা রেখেছে তাদের; বাঙালিদের কাছে তারাই সাহেব। মালিক চিরদিনই।

সাহেবরা এই দেশ শোষণ করতে এসেছিল বটে তবুও তাদের রাখঢাক, আদবকায়দা ছিল। এখানকার বিভিন্ন দেশীয় এক-পুরুষ দু-পুরুষের বড়োলোক সাহেবদের সেসব কিছুই নেই। চায়ের গাছের ডাল ভেঙে পাতার সঙ্গে মিশিয়ে দিচ্ছে। যা খুশি করছে। চক্ষুলজ্জা ব্যাপারটা জলাঞ্জলি না দিলে বোধ হয় পয়সা করা যায় না। পয়সার জন্যে মানুষ এমন হামলে পড়েছে যে, যা-কিছুই ভালো তার সব কিছুকেই ফেলে দিচ্ছে সকলে। যার টাকা আছে সে-ই সব। আর কোনো কিছুই দরকার নেই ‘সাহেব’ হতে। আগে দরকার হত। যে মানুষই গাড়ি চড়তেন তাঁর শুধুমাত্র টাকা ছাড়াও অন্য ব্যাপার ছিলই। বিদ্যা-মেধা-সততা-আভিজাত্য ইত্যাদি ইত্যাদি।

পঁয়ষট্টি বছরের পুলিনবাবুর পক্ষে এই নতুন পরিবেশ খাপ-খাওয়াতে প্রতিমুহূর্ত বড়োই অসুবিধে হয়। উনি এই কম্পিউটারের যুগের মানুষ তো নন! সাহেবি আমলের ডানকান ব্রাদার্স-এর একটি বাগানের অ্যাকাউন্টেন্ট ছিলেন তিনি। সেই চাকরি ছেড়ে এসে এই চাকরিতে ঢুকেছেন। তাও বছর দশেক হয়ে গেল।

ওঁর মনে পড়ে গেল যে, যেদিন প্রথম একটি অ্যাডিং মেশিন আসে তাঁদের বাগানে, তার পরদিনই নবীন মুহুরি আত্মহত্যা করেছিল কৃষ্ণচূড়া গাছের ডাল থেকে গলায় দড়ি বেঁধে। নবীনের সবচেয়ে বড়ো গর্ব ছিল যে, চোখের নিমেষে সে ট্রায়াল ব্যালান্স, ব্যালান্সশিট, ডেটরস-ক্রেডিটরস-এর লিস্টের নীচে ডান হাতের তর্জনী দ্রুতগতিতে বুলিয়েই যোগফল বসিয়ে দিতে পারত। নবীনের কোনো যোগে কেউই কখনো ভুল ধরতে পারেনি। সাহেব কোম্পানির অডিটররা এসে ধন্য ধন্য করতেন সবাই নবীনকে। জীবনের পঞ্চাশ বছর ধরে সে যা গড়ে তুলেছিল; খ্যাতি-গর্ব—তার পারদর্শিতা সবই এক নিমেষে একটি সাড়ে সাতশো টাকা দামের সবুজরঙা ছোট্ট জার্মান মেশিন গুঁড়ো গুঁড়ো করে দিল। এই অপমান, অসহায়তা; ভবিষ্যতের অনিশ্চিতি কিছুতেই সহ্য করতে পারেনি নবীন।

নিজেকে মেরেই নিজেকে বাঁচিয়েছিল সেদিন। কিছু মানুষ ওইরকমই হয়। জীবনের চেয়েও মানকে বেশি ভালোবাসে তারা। পুলিনবাবু নবীনের মতো হতে পারেননি।

বৈশাখের সকালে শিমুলের ডাল থেকে ঝুলতে-থাকা সাদা ধুতি জড়ানো অর্ধ-উলঙ্গ দুলতে-থাকা মৃতদেহটা এখনও দুঃস্বপ্নে দেখেন পুলিনবাবু।

মাঝে মাঝে ভাবেন, মরে গিয়ে বেঁচে গেছে নবীনটা!

এতদিন পরে, এই কম্পিউটার বুঝি তাঁরও মৃত্যুর কারণ হয়ে এল।

অথচ তিনি যে নিজেকে মেরে নিজেকে বাঁচাবেন তার উপায় নেই কোনো। দু-টি মেয়ে এখনও বিয়ের বাকি। ছোটোছেলেটা অমানুষই হয়ে গেল। লেখাপড়া তো করলই না। এক পার্টির অ্যাকশন স্কোয়াডে আছে সে।

শিলিগুড়িতে গিয়ে মাস্তানি করছিল এতদিন। এখন নাকি নেপালের ধুলাবাড়ি থেকে যেসব জিনিস চোরাচালান হয়ে শিলিগুড়িতে আসে রাতারাতি, সেইসব নিয়ে আসে তাঁদেরই জাতি-গোষ্ঠী, যাদের মুখ চেনেন না, নাম জানেন না পুলীনবাবু, অথচ যাদের প্রত্যেকের সঙ্গে এক নীরব অসহায়তার অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে তিনি আজও বাঁধা আছেন; তাঁদেরই মেয়ে-বউরাই নাকি রাতের অন্ধকারে জঙ্গলে জঙ্গলে মাথায় করে, আঁচলে বেঁধে, সীমান্তের নদী পেরিয়ে টেপ-রেকর্ডার, মদ, ক্যালকুলেটার, ভি.সি.আর. এবং আরও কত সব চকচকে জিনিস, যা নইলে আজকের আধুনিক মানুষদের ‘বেঁচে থাকার’ কোনো মানেই হয় না, সেইসব বয়ে নিয়ে আসে।

সেই মেয়ে-বউয়েরা শুধু গতরে পরিশ্রম যে করে তাই-ই নয়। তাদের নিজেদের অনেক সময়েই মানুষখেকো হিংস্র হায়নাদের হাতেও তুলে দিতে হয়। বিনিময়ে, মোটা ভাত-কাপড়ও জোটে না তাদের। আর মুনাফা লোটে ধুলাবাড়ির আর শিলিগুড়ির অবাঙালি ব্যাবসাদারেরা।

পুলিনবাবুর ছোটোছেলে এখন এইসব চোরাচালানের কোনো একটি দলের গুণ্ডা হিসেবে ভিড়ে গেছে। তৈরি হয়েই আছেন পুলিনবাবু। যেকোনো দিন শিলিগুড়ি থেকে তার মৃত্যুসংবাদ পাবেন।

বড়োটা মানুষ হয়েছিল, কিন্তু মানুষ হওয়ার পরই অমানুষ হয়ে গেছে। মানুষ-অমানুষ অনেক রকমেরই হয়।

তিনহাজারি চাকরি করে এখন সে কলকাতায়। কিন্তু শ্যামবাজারের একটি মেয়েকে বিয়ে করে সে কুঁদঘাটে নিজের বাড়ি করে ক্যালকেশিয়ান হয়ে গেছে। স্কুটার কিনেছে। বাবা-মা-ভাই-বোন সকলকেই ভুলে গেছে। তার শাশুড়ি আর শালিই তার সব এখন।

পুলিনবাবুর মনে হয়, এও এক ধরনের মৃত্যু। নবীন মুহুরি, শিমুল গাছ থেকে ঝুলে পড়েছিল। নিজেকে মেরেছিল; নিজেকে বাঁচাবার জন্যে। তার বড়োছেলেও নিজেকে মারল। অন্য মৃত্যু। নিজেকে বাঁচাবার জন্যে। মৃত্যুরই মতো, সে-বাঁচাটাও অন্য এক ধরনের বাঁচা। জীবন এবং মৃত্যুরও অনেকই রকম হয়।

দুই

বাগানে ফিরে এসেছেন পুলিনবাবু। এক্ষুনি ফিরলেন। বড়োই ক্লান্ত।

যেদিন ফেরার কথা ছিল, তার দু-দিন আগেই। কলকাতায় যেতে হয়েছিল, কারণ কলকাতার ট্রায়াল ব্যালান্স ওরা কেউই মিলোতে পারেনি বলেই। আজকালকার ছোকরারা নিজের নিজের কাজ ছাড়া সব বিষয়েই পন্ডিত! লজ্জা করে ওদের দেখে।

মিলিয়ে দিয়ে ফিরে গেছেন উনি। ডান পকেটের নস্যিমাখা লাল রুমালটারই মতো নিজের আত্মশ্লাঘায় বুক ভরে। জীবনে তিনি একে-একে হারিয়েছেন অনেক কিছুই। স্ত্রী মনোরমাকে। বড়োকে, ছোটোকে। নিজের বুকের মধ্যের এই জিনিসটিও হারিয়ে গেলে বেঁচে থাকার মতো আর কোনো অবলম্বনই যে থাকবে না তাঁর!

সকাল থেকে খুবই বৃষ্টি হয়েছে। উত্তরবাংলার বৃষ্টি! অগাস্টের মাঝামাঝি। বিকেলের দিকে আকাশ পরিষ্কার হয়ে তিস্তা আর হিমালয় চমৎকার দেখাচ্ছিল। নদ এবারেও তান্ডব করবে মনে হচ্ছে। কাল বাগানের অফিসে শুনেছিলেন যে, কাঠামবাড়ির বাংলো নাকি আবারও ভাসাবার উপক্রম করেছে হারামজাদা। চ্যাংমারির চরের অবস্থা তথৈবচ।

বিনু বলল, খাইয়া লও বাবা। দুগা খাইয়া লইয়া ছুটি কইরা দ্যাও আমারে। তিনুটার জ্বর তিন দিন থিক্যা। আমারও শরীলডা ভালো ঠ্যাকতাছে না।

—রাঁধছস কী?

কী আর। পোলাউ মাংস তো আর রান্ধি নাই। হেই বর্ষায় তরিতরকারিরও আকাল পড়ছে। পাওন যায় না কিছুই। ধোঁকার ডালনা আর রুটি রাইন্ধা থুইছি। দিমু কি না কও?

চাঁদটা উঠেছিল বিশ্বচরাচর উদ্ভাসিত করে। কোয়ার্টার্সের বারান্দায় বসে বৃষ্টিভেজা প্রকৃতি, চায়ের বাগান, কুলি লাইনের টিনের ছাদ, ম্যানেজারের বাংলো, এসব দেখতে দেখতে অনেকই পুরোনো দিনে চলে গিয়েছিলেন পুলিনবাবু।

বিনুর কথায় বললেন, দিয়া দে তবে। তরে ছুটি কইরাই দিই।

অভিমানের সুর লেগেছিল গলায়।

তিনি নিজে যে কবে ছুটি পাবেন চিরদিনের মতো? কিন্তু ছেলে-মেয়েরা কেউই বোঝে না তাঁর গলায় কখন অভিমান লাগে আর চোখে কখন দুঃখ চমকায়। সেসব বুঝতেন একমাত্র মনোরমাই। একজন পুরুষের জীবনে তাঁর স্ত্রীর মতো বুঝদার মানুষ বোধ হয় আর কেউই হয় না। হয়তো স্ত্রীর জীবনেও স্বামীর মতো। মজার কথা এই যে, দু-জনেই বেঁচে থাকাকালীন ঝগড়াই হয় বেশি। ঝগড়া যে সকলের সঙ্গে করার অধিকার আদৌ নেই, একথাটা দু-জনের মধ্যে একজন হঠাৎ চলে গিয়ে অন্যজনকে বুঝিয়ে দিয়ে যান।

খাওয়া-দাওয়ার পর বারান্দায় বসেছিলেন পুলিনবাবু। এই কোয়ার্টারটা একেবারে ফাঁকায়। ধারেকাছে আর কোয়ার্টার নেই কোনো।

মনোরমা, নির্জনতা গাছগাছালি এসব পছন্দ করতেন বলেই অফিস থেকে এবং অন্য কোয়ার্টার থেকে দূর হলেও এই কোয়ার্টরই নিয়েছিলেন। একজন মেকানিকের কোয়ার্টার ছিল আগে এটি। বাগানের মোটর, ট্রাক্টর সারাত সে।

নিজেই পান সেজে খেলেন একটা। হাতল ভাঙা কাঠের ইজিচেয়ারটাতে বসে, বারান্দায় খুঁটির গায়ে দু-পা তুলে দিয়ে, জোনাকি-জ্বলা, ব্যাং-ডাকা রাতের দিকে চেয়ে বসে রইলেন।

খেতে যতটুকু সময় গেছে তারই মধ্যে চাঁদ ঢেকে গেছে মেঘে। ঝুরুঝুরু করে হাওয়া বইছে। বৃষ্টি নামবে এক্ষুনি। কদম গাছ দু-টিতে খুব কদম ধরেছে। কদম আর তাঁর দরজার পাশের জুঁইয়ের লতার গন্ধ মিশে আমেজের মতো লাগছে।

বিনু বারান্দায় এসে বলল, শুইবা না তুমি?

শুমু আন। তিনু কই? তার জ্বর কত দ্যাখছস?

দেখুম। বলেই বিনু ঘরে চলে গেল।

মিনিট পনেরো পর আবারও বিনু এসে বলল, তোমার আজ হইলডা কী? শুইয়া পড়ো। রাত তো প্রায় নয়ডা বাজে।

সোজা হয়ে বসলেন পুলিনবাবু চেয়ারে। মেয়ের ব্যবহারটা কেমন যেন বিসদৃশ, সন্দেহজনক ঠেকল তাঁর কাছে।

কী মনে করে, উনি ‘যাইতাছি’ বলে, নিজের ঘরে গিয়ে শোবার ভান করে পড়ে রইলেন।

বাইরের বৃষ্টিভেজা প্রকৃতি আসন্ন বর্ষণের জন্য তৈরি হচ্ছিল। ফিসফিস করছিল হাওয়া। দূরের ঝরনার আওয়াজের মতো মৃদু ঝরঝরানি আওয়াজ ভেসে আসছিল কানে—দূরের তিস্তার আওয়াজ।

পুলিনবাবুর একটু তন্দ্রামতো এসেছিল। এমন সময় একটা গাড়ির শব্দ শুনলেন তাঁর কোয়ার্টারের রাস্তায়। এদিকে এটা ছাড়া দ্বিতীয় বাড়ি নেই। গাড়ি তো আসে না পথে কোনো? কার গাড়ি? এত রাতে? হেডলাইট জ্বালিয়ে একটা অ্যাম্বাসাডার গাড়ি এসে থামল তাঁরই কোয়ার্টারের সামনে।

পুলিনবাবু মড়ার মতো পড়ে রইলেন। সস্তা সেন্টের গন্ধ পেলেন হঠাৎ নাকে। বুঝলেন, বিনু তাঁর ঘরে এল। শাড়ির মৃদু খসখসও শুনতে পেলেন। শুলেই পুলিনবাবুর নাক ডাকে। বিনু ভাবল, উনি গভীর ঘুমে আছেন।

এমন সময় একটি চেনা গলা শুনতে পেলেন।—তিনু!

তিনু বলল, দিদি! তুই এখনও তৈরি হস নাই?

বিনু ধমকে বলল, চুপ! আস্তে ক ছেমড়ি। বাবায় আইসা গেছে গিয়া।

—অ্যাঁ?

—হ্যাঁ।

—কোথায়?

ঘুমাইতাছে।

পরক্ষণেই স্বগতোক্তি করল, ঘুমাইছে কি না তাই-বা কমু ক্যামনে? ওরে বরং কইয়া দে তুই যে, আমি আইজ যামু না। বাবায় উইঠ্যা পড়ে যদি তো এক্কেরে পেরলয় বান্ধাইবে।

কইস কী তুই? গিরধারী তো নেশায় চুর হইয়া গাড়ির পিছনের সিটে বইস্যা আছে। আর বাগানের বাংলোয় বইস্যা আছে জোড়া-খাটে তাগো বাগানের মালিক। হ্যায় লোকডা একডা জংলি রে!

আস্তে। আস্তে। তরে কইলাম কী আমি? বিনু বলল, বিরক্তি, ভয় এবং উদবেগে। নীচু গলায়।

তিনুর বয়স আঠারো। স্বভাব চঞ্চল, বেপরোয়া। গলার স্বরও জোর। সে তেড়ে বলল, অত চুপ চুপ করতাছিস কীর লইগ্যা? বাবায় কিছু বইলাই দেখুক-না একবার! কী রাজকন্যাদের মত্বই রাখছে আমাগো। বেশি কিছু কইলে, আমি রাত্তারাতিই চইল্যা যামু আনে।

গলা শুকিয়ে গেল বিনুর।

বলল, যাবি কোন চুলায়?

ক্যান? কলকাতায়! গিরধারীর মালিক কইছে। কইছে, রানি কইরা রাখব আমারে। ভাবছস কী তুই?

এবারে পুলিনবাবু যথাসম্ভব কম শব্দ করে উঠে বসলেন খাটে। গিরধারী তাঁদের বাগানের পাশেই যে মাড়োয়ারির বাগান, তার ক্যাশিয়ার। আর যে বাঙালি ছেলেটির গলা পেলেন তিনি এক্ষুনি, সে তার ছোটোছেলের বন্ধু। স্টোর্সবাবুর সেজোছেলে বঙ্কু।

তাঁর দুই অবিবাহিত মেয়েই তাহলে……

বুকের মধ্যে ভীষণ কষ্ট হতে লাগল তাঁর। বুকের মাঝখানটাতে ব্যথা করতে লাগল।

এখন উঠে বাইরে গেলে গিরধারী এবং ছোটোর বন্ধু বঙ্কু জেনে যাবে যে, পুলিনবাবুর কিছুই অগোচর নেই। অথচ না গেলেও…..। এবং গেলেও……

কিন্তু যাবেনই-বা কেন? কী করে যাবেন? কোন মুখে? তার মেয়েরা চলে যাক যেখানে খুশি। ছেলেরা যেমন গেছে। শিলিগুড়ি বা জলপাইগুড়ির পাড়ায় ঘর নিয়ে ব্যাবসা করুক গিয়ে। নয়তো কলকাতাতেই যাক। তাদের বুড়ো, হতভাগা বাবার ঘরে তারা তো রাজকন্যার মতো ছিল না। তারা যদি ভালো খাওয়া, ভালো থাকাকেই সবচেয়ে বড়ো বলে ভেবে থাকে, তবে তাই থাক তারা। তাই পাক। এক জীবনে যে যা চায়, তাই তো পায়। পাওয়া উচিত অন্তত। যে যেমন করে তা পেতে চায়, তেমন করেই পাক।

গাড়ি থেকে গিরধারীর জড়ানো গলা ভেসে এল।

‘আররে এ বঙ্কু! কিতনা দের লাগেগি শালিকি তৈয়ারি হোনেমে?’

বঙ্কু তাকে চুপ করার জন্যে যেন কী বলল, চাপা গলায়। গাড়ির দরজা বন্ধ হওয়ার আওয়াজ হল।

পুলিনবাবু খাটে উঠে বসলেন। পুরোপুরি। পদ্মাসনে বসলেন। একটু পরে শবাসন। মনটাকে দু-পায়ের জড়ো করা বুড়ো আঙুলে সমাধিস্থ করবেন।

তিনু বলল, যা-না দিদি। রাত কাবার কইরা ফিরিস না তা বইল্যা আবার। আমারও ভীষণই ঘুম পাইছে। বাজে লোক একডা। ওই মালিকডা যাচ্ছেতাই। এমন চটকাচটকি করছে-না। আমি পাল্লা ভ্যাজাইয়া দিয়া শুইয়া পড়ুম।

—টাকা? তরে টাকা দিচ্ছ?

বিনু শুধোল তিনুকে?

—হ্যাঁ। দিবে না ক্যান?

কত দিচ্ছ?

—পঞ্চাশ! তোরেও তাই দিবে। যা গিয়া এখন।

তিনু, বিনুকে মিথ্যে কথা বলল।

পেয়েছিল আসলে দুটি পঞ্চাশ টাকার নোট।

মনে মনে হিসেব করল। একটা টু-ব্যাণ্ড রেডিয়ো আর একটা ক্যাসেট প্লেয়ার আর ক-খানা ভালো শাড়ি-শায়া-ব্লাউজ এবং একজোড়া সোনার বালা এবং এক শিশি বিলাইতি ইন্টিমেট পারফিউম…..। এইসব কেনার টাকা জমতে ও নিজেই ক্ষয়ে যাবে বোধ হয়, চন্দন কাঠের মতো ঘর্ষণে ঘর্ষণে।

পুলিনবাবু আবারও শুয়ে পড়লেন। শুয়ে শুয়ে সবই বুঝতে পারলেন। তার ছোটোমেয়ে ঘরে ফিরল, বড়োমেয়ে চলে গেল। গাড়িটার শব্দ যতক্ষণ-না মিলিয়ে গেল ততক্ষণ শুয়েই রইলেন খাটে। মড়ার মতো। শবাসনে। তিনি তো মড়াই।

এখন মরে গিয়েও যে বাঁচবেন, সে সময়ও আর বাকি নেই। কিন্তু মনটা কিছুতেই দু-পায়ের জোড়া করা বুড়ো আঙুলে বসে থাকতে চাইছে না।

পাশের ঘরে তিনু শাড়ি বদলাচ্ছিল। শব্দ পাচ্ছিলেন পুলিনবাবু। বিনুর চেয়েও তিনুর ওপরে রাগ অনেকই বেশি হচ্ছিল তার। মাত্র আঠারো বছর বয়স! এই ছোকরা-ছুকরিগুলান কত্ত সহজে নষ্ট হইয়া যায়। কত্ত সহজে! কত্ত সস্তায়! সহ্যশক্তি কতই কম অ্যাদের! লোভও কত বেশি। ছি ছি! ওদের মূল্যবোধ পুলিনবাবুদের বোধ থেকে কতই আলাদা।

পূর্ববাংলার দেশ থেকে যেদিন ভিটেমাটি ছেড়ে চলে আসতে হয়েছিল পুলিনবাবুর, তখন তার বয়স এই তিনুরই মতো আঠারো। বাবাকে কেটে ফেলেছিল তার পরিচিত মানুষেরা। মাকে বিবস্ত্র করে বাঁশবাগানের পাশ দিয়ে নিয়ে গিয়েছিল তাদেরই মাঠে, এমন মানুষেরা, যাদের পুলিনবাবু মামা বা চাচা বলে ডাকতেন। মায়ের চিৎকার, ‘ও খোকন, আমারে বাঁচা’। তারপর ‘মাইরাই ফ্যালাও তোমরা। মাইরাই….’

একটা তীব্র ক্রোধ, অসহায় এক বোবা বোধ কাজ করেছিল তাঁর ভেতর তখন। অসহায়ের নিষ্ফল ক্রোধ। যা পৃথিবীর সমস্ত প্রান্তে এই মুহূর্তেও অসংখ্য মানুষের ভেতর কাজ করছে। সেই বোধটাই আজ তেষট্টি বছর বয়সেও কাজ করে যাচ্ছে। তাঁকে প্রতিমুহূর্ত কুরে কুরে খেয়ে যাচ্ছে। কতগুলো অশিক্ষিত, নিপীড়িত, হীনম্মন্যতায় ভোগা মানুষ যা করতে পেরেছিল তার বাবার প্রতি, মায়ের প্রতি, তা তিনি কী করে করবেন? ভাবতেই পারেনি। প্রতিশোধ নেওয়ার স্পৃহা পর্যন্ত জাগেনি। তখন ভগবানকে বলেছিলেন, ভগবান! ক্ষমা করে দিয়ো এদের। ভগবান! আমাকে আমার চেয়েও অনেক বড়ো করে দাও। যেন, ক্ষমা করতে পারি সকলকে।

মারামারি, কাটাকাটি, বলাৎকার, চুরি-ডাকাতি, এসব করার শিক্ষা তো তিনি বাবা-ঠাকুরদার কাছ থেকে কখনো পাননি! তাই সেই আঠারো বছরের নি:সম্বল অবস্থা থেকে আজকের এক অন্যরকম নি:সম্বল অবস্থাতে পৌঁছোতে কত এবং কতরকম কষ্টই যে করতে হয়েছে, তা তিনিই জানেন। কিন্তু কখনোই সম্মান খোয়াননি। মাথা নোয়াননি। এই পর্যায়ে পৌঁছেও তিনি নিজেকে বদলাতে পারলেন না। কিন্তু বদলানো যে দরকার নিজেকে, তা বেশ বুঝতে পারছেন। বিশেষ করে, আজ রাতে। কোনো মানুষেরই পক্ষে চিরদিন গৌতমবুদ্ধ হয়ে থাকা উচিত নয়, সারাজীবন মনুষ্যত্ব খুইয়েও।

সারারাত ঘুম হল না পুলিনবাবুর। খাটে বসে লুঙ্গিটাকেই চাদরের মতো গায়ে জড়িয়ে জানলা দিয়ে বাইরে চেয়ে নস্যি নিয়ে রাতটা কাটালেন। আওয়াজ পেলেন, রাত তিনটে নাগাদ তাঁর বেশ্যা মেয়েদের মধ্যে বড়ো-জন ফিরে এল।

ভোরের আলো ভালো করে ফুটতেই দেওয়ালের পেরেকে ঝোলানো পাঞ্জাবিটা গায়ে দিয়ে লুঙ্গি পরেই বেরিয়ে পড়লেন পুলিনবাবু, তখন তাঁর আদরের, গর্বের, তার জীবনের শেষ অবলম্বন বিনু আর তিনু অঘোরে ঘুমোচ্ছিল।

মাধবের চায়ের দোকানে অনেকে চা খাচ্ছেন। কাগজ আসতে আসতে এখানে বিকেল হয়ে যায়। ট্রানজিস্টর খুলে দিয়েছে মাধব। চা খেতে আরও অনেকেই এল দোকানে। পুলিনবাবুকে দেখে মাধব তো অবাক। এই বাগানে অনেক বছর এসেছেন। ডানকানের বাগান থেকে রিটায়ার করার পর। একদিনও মাধব দেখেনি পুলিনবাবুকে তার দোকানে আসতে। এত সকালে তাঁকে দেখে বলল, আরে! আপনি যে বাবু?

পুলিনবাবুর মাথায় কাজ করছিল না। কানদুটি ভোঁ-ভোঁ করছিল।

তবু বললেন মাধবের ওরিজিনাল দেশ রংপুরের ভাষাতেই। বয়স তো হতিছে! এট্টু মর্নিং ওয়াক কইরবার লাগে।

একজন অপরিচিত ভদ্রলোক চা খেতে খেতে অন্যজনকে বললেন, পাঞ্জাব-সমস্যা তো মিটিয়ে দিলেন রাজীব গান্ধি। এবার আসামও মিটবে।

সন্দ আছে। মিটবে কি? আসামকে উনি দেবেনটা কী? চন্ডীগড় না নদীর জল?

প্রথম-জন বললেন, তা জানি না। তবে একটা কথা বুঝে ফেলেছি, যদিও বড়ো দেরি করে বুঝলাম।

কী?

এই পৃথিবী হচ্ছে শক্তর ভক্ত, নরমের যম। এ সর্দারজিগুলো তার মাকে না মারলে ছেলের সুর কি এত নরম হত? বাংলাতেও তো পার্টিশন হয়েছিল। আমরা বাঙালিরা, না আমাদের যারা তাড়াল তাদের সঙ্গে লড়লাম, না অন্য কারও সঙ্গেই। মার খেতে খেতে আমাদের ভদ্দরলোকি গুমোর নিয়ে পিছু হটতে হটতে এমন জায়গায় পৌঁছেছি আজ যে, আমাদের এখন পশ্চিমবঙ্গ থেকেও চলে যেতে হয় কি না দ্যাখো!

ঠিকই কইছেন। অন্য সক্কলই হইল গিয়া বীরের জাত, আর আমরা হইলাম গিয়া ভীরুর জাত। সকলেই চিন্যা ফ্যালাইছে আমাগো।

হাঁটতে হাঁটতে চললেন পুলিনবাবু, চা খাওয়ার পর, কামারের বাড়ির দিকে। বাসস্ট্যাণ্ডের পাশেই তার বাড়ি আর কামারশালা। দিবারাত্র হাপর চলে খপর-খাপর।

রাধু সবেই দোকান খুলে বসেছিল।

—আরে! অ্যাকাউন্টেন্টবাবু যে! খবর কী? এত সক্কালে? কোনদিকে আইছিলেন?

—তোমার কাছে।

—কন দেহি, কী দরকার? বঁটি বানাইয়া দিমু একখান? কোদাল লাগব নিশ্চয় বাগানের লইগ্যা?

না রাধু। বঁটি বা কোদালে চলব না। একখান রামদা বানাইয়া দাও দেহি। লাইটের উপর। বেশি ভারী য্যান না হয়! বুঝছ!

—কাইটবেন কী, তা দিয়া? তা তো আমারে কইবেন। হেই মতোই বানাইয়া দিমু আনে অ্যাক্কেরে ফাসকেলাস কইর‌্যা।

কী যে কাটুম, তা অ্যাহেনো ঠিক করি নাই। তবে, ঘরে একটা থাকনের দরকার বড়ো। যা দিনকাল! মানুষই কাইটতে অইব হয়তো।

তা ঠিকোই কইছেন বাবু। চুরি-ডাকাতি তো লাইগাই আছে। চোর-ডাকাইত কাটোনের লগ্যেই বানাইয়া দিমু আনে। লাইটের উপর। ভার অইব না। দুই হাতে তুইল্যা বসাইয়া দিবেন। ধড় থিক্যা মুন্ডুখান সট কইর‌্যা খুইল্যা যাইব গিয়া!

—কবে দিবা রাধু?

—তাড়াতাড়িই দিমু।

—কবে?

—সাত দিনের মধ্যেই দিমু।

সাত দিন? কও কী তুমি? না, না। আমার একদিনের মধ্যেই চাই।

কন কী বাবু? পাঁঠা বাইন্ধা থুইছেন নাকি উঠানে। এত্ত তাড়াতাড়ি কীসের?

পেরায় সেইরকমই। বাঁইন্ধাই থুইছি কইতে পারো।

বললেন পুলিনবাবু।

তারপর বললেন, নিবা কত, তা কও?

আপনারে সস্তা কইরাই দিমু। আইজকাল ইস্টিলের যা দাম! তা তো র‌্যাল কোম্পানির চোরাই ইস্টিল বইল্যাই এত হস্তায় দিতে পারতাছি! তা, একশোই দিবেন আনে আপনি।

—একশো? এতগুলা টাকা! চমকে উঠলেন পুলিনবাবু।

তারপরই ভাবলেন, পাক্কা স্টিলের একটা মানুষ মারা হাতিয়ারই তো? তাঁর মেয়েদের এক-এক জনের একঘন্টা দু-ঘণ্টার ভাড়াই যদি একশো টাকা হয়, তাহলে রাধুর এত পরিশ্রম এবং ইস্পাতের বিনিময়ে একশোটা টাকা তো বেশি চায়নি। যে করেই হোক জোগাড় করে দেবেন তিনি।

উনি বললেন, দিমু আনে। কিন্তু কাইল সন্ধ্যার পরই লাগব আমার।

কাউরে খুনটুন করবেন না তো আবার? আপনার ভাবগতিক তো আমার ভালো ঠ্যাকতেছে না!

হাসলেন পুলিনবাবু। ম্নান হাসি।

বললেন, খুনখারাপি যদি করতেই পারতাম তাইলে আজ আমাগো কি এই দশা হয় রাধু? আমারই একলার ক্যান, পেত্যেক বাঙালিরই কি আজ এই দশা হইত।

রাধু কথাটার মানে না-বুঝে চেয়ে থাকল। কথাটা অস্পষ্ট হলেও তার মন যেন কথাটাতে সায় দিল।

আর কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই পুলিনবাবু চলে গেলেন। তাড়াতাড়ি হাঁটার জন্যে লুঙ্গিটা উঁচু করে কোমরে বেঁধে নিয়ে।

উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরতে ঘুরতে নদীর ধারে গিয়েই দাঁড়িয়ে পড়লেন পুলিনবাবু।

তর্জনগর্জন করা তিস্তা দিয়ে জঙ্গলের কাঠ ভেসে যাচ্ছে। সেই প্রবলবেগে ভেসে-যাওয়া বড়ো বড়ো গাছের গুঁড়িগুলোকে কী দুঃসাহস এবং পরিশ্রমের সঙ্গে অল্প ক-টি মানুষ তাদের শক্তসবল হাত আর হাতে হাতে জড়ানো দড়ি দিয়ে বাঁচিয়ে নিচ্ছে। একটি-একটি করে। জীবন বিপন্ন করেও। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন অনেকক্ষণ পুলিনবাবু।

লোকগুলো চেঁচামেচি করছিল।

উনি শুনলেন, গতকাল ওদেরই মধ্যে একজনকে নাকি নিয়ে গেছে তিস্তা। নেপালি চার-পাঁচ জন। অন্যরা, ভারতের অন্য প্রদেশের লোক।

ভেসে-যাওয়া কিছুকে বাঁচাতে হলে নিজেদের মধ্যেও কারও কারও ভেসে যাওয়ার জন্যে তৈরি থাকতে হয়ই বোধ হয়। ভাবলেন উনি। এমনি করেই, বর্ষার তিস্তার স্রোতেরই মুখে ভেসে-যাওয়া কাঠের মতো একটা পুরো জাত তার ডালপালা শিকড়-বাকড় সুদ্ধ ভেসে যাচ্ছে, তাঁর নিজের এবং সমস্ত জাতের চোখের সামনে দিয়েই; অথচ এক-জনও মানুষ কী একটাও হাত তাঁকে বাঁচাবার চেষ্টা করল না। প্রাণ দিয়ে চেষ্টা করা দূরে থাকুক, একটা আঙুল পর্যন্ত নাড়াল না কেউই।

ভেসে যাচ্ছে, শুধু পুলিনবাবুর একার সংসারই নয়; পুরো একটা জাতের ভবিষ্যৎ; গত সাঁইত্রিশ বছর ধরে নিশ্চিন্ত সর্বনাশের দিকে।

সময় নেই আর।

শুধু ভিক্ষা চাওয়ার জন্যেই পেতে রাখা দুটি হাত নিয়েই বোধ হয় জন্মেছিলেন পুলিনবাবুরা। ভগবানের কাছে ভিক্ষা, মালিকের কাছে ভিক্ষা, ভিনরাজ্যের ব্যাবসাদারদের কাছে ভিক্ষা, নিজের রাজ্যে, নিজের রাজধানীতে থেকেও তৃতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে বেঁচে থাকার ভিক্ষা, কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে ভিক্ষা।

তাঁদের উদাসীন গালে সকলেই চড় মেরে যায়। সংস্কৃতির দোহাই দিয়ে, ভদ্রতার দোহাই দিয়ে, থুথু গেলেন বাঙালি জাতের বুদ্ধিজীবীরা। তাঁরা সকলেই আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব হয়ে-ওঠার প্রতিযোগিতাতে সদাই শামিল।

হাত কি পুলিনবাবুদের আদৌ আছে? বা ছিল? যে হাত নিশ্চিত অন্যায়কারীর গলা টিপে ধরে শ্বাসরুদ্ধ করে; তার দু-চোখের মণিকে ঠিকরে বাইরে আনতে পারে?

পুলিনবাবুরা এক ঠুঁটোজগন্নাথের জাত।

কোয়ার্টারের দিকে ফিরতে লাগলেন তিনি। বাবুলাইনের পাশ দিয়ে। বাঙালি বাবুরা সবাই ঘুমোচ্ছেন এখনও। কে জানে, কখন ভাঙবে এঁদের ঘুম।

চিরঘুমে পেয়েছে সকলকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *