গুমোর

গুমোর

সেরাইকেলা থেকে এসে টাটা শহর পেরিয়ে হাইওয়েতে পড়েই ওদের খেয়াল হল যে, তেল নেয়নি। কিছু পথ আসতেই পেট্রোল পাম্প পড়ল সামনে। গাড়ি আস্তে পাম্পে ঢোকাল দীপ।

তাতা বলল, ব্যাটারির জল, মোবিল এসব চেক করেছিলি!

সব, সব। তুমি তো জমিদারবাবু। তখন ঘুমুচ্ছিলে। তা ছাড়া মোবিল তো দেখতে হয় গাড়ি স্টার্ট করার আগে। গাড়ি চললেই মোবিল ওপরে উঠে আসে।

তাতা বলল, আমি আর গাড়ির কী বুঝি? আমার মিনিবাসই ভালো। তবে গাড়ি গন্ডগোল করলে তখনই বোঝা যাবে তুমিও কতটুকু বোঝো-না-বোঝো! ঠিকমতো যতক্ষণ চলছে ততক্ষণ তো থিয়োরিতে সকলেই ডক্টরেট।

একটি ছেলে দৌড়ে এল পাম্পের ভেতর থেকে। বলল, ‘কিতনা সাহাব?’

গাড়িটা বন্ধ করে দিয়েছিল দীপ। আবার একবার চাবিটা ঘুরিয়ে তেল কতখানি আছে দেখে বলল, পঁচিশ।

যতক্ষণে ছেলেটি তেল দিচ্ছিল ততক্ষণে অন্য একটি ছেলে এসে গাড়ির উইণ্ডস্ক্রিনটা পরিষ্কার করে দিল।

তেল দেওয়া শেষ করে প্রথম ছেলেটি বলল, আউর কুছ চাইয়ে সাব? মোবিল, ব্যাটারিকা পানি?

নেহি ভাই।

পানি দিজিয়েগা সাব?

দ্বিতীয় ছেলেটি শুধোল।

নেহি। সুক্রিয়া।

হিন্দি ফিলমের নায়কের মতো বলল, তাতা।

টাকা দিয়ে, চেঞ্জ নিয়ে, গাড়ি যখন হাইওয়েতে পড়ল, তখন একটা সিগারেট ধরিয়ে তাতা দীপকে বলল, ডিফারেন্সটা দেখলি?

কীসের?

গিয়ার বদলাতে বদলাতে দীপ জিজ্ঞেস করল।

সার্ভিসের।

হুঁ।

এ যদি বাঙালির পাম্প হত তো দেখতিস, দশবার হর্ন বাজানোর পর একজন লোক অত্যন্ত বিরক্ত মুখে বেরিয়ে বলত, আমার দশটা হাত নেই মশাই! অত তাড়া কীসের?

যা বলেছিস। দীপ বলল।

এমন লেথার্জিক জাত দুটো নেই। নো-ওয়াণ্ডার, সমস্ত কলকাতা শহরে এখন বাঙালিরা মাইনরিটি! মানে, দে ডু নট রিয়্যালি ম্যাটার এনি মোর!

দীপ নিজের মনেই হেসে উঠল। বলল, রাসবিহারী অ্যাভিনিউতে একবার এক বাঙালি দোকানে জ্যাঠাইমার জন্যে শাড়ি কিনতে গেছি। গরমের দিন। দুপুর বেলা। লোডশেডিং ছিল। দেখি ক্যাশবাক্স সামনে নিয়ে গেঞ্জিটা গুটিয়ে বুক অবধি তুলে মালিক হাতপাখা হাতে অদ্ভুত ভঙ্গিতে ভোঁস ভোঁস করে ঘুমোচ্ছে। আর যে দোকানে মালিক ঘুমোয়, কর্মচারী তো নিশ্চয়ই ঘুমোবে। যাই হোক, প্রায় ঠেলেঠুলেই বলতে গেলে একজনকে তুলে বললুম, শাড়ি দেখান। ধনেখালি।

সেলসম্যান ঘুম ভাঙাতে বিরক্ত হয়ে লাল চোখ করে ধমকে বলল, কত দামের?

প্রথম প্রশ্ন শুনেই রক্ত চড়ে গেল মাথায়। আমার সাধ্য পঞ্চাশও হতে পারে পাঁচশোও হতে পারে। শাড়ি না দেখিয়েই দাম?

যাই হোক। বললাম, শ-খানেকের মধ্যে।

একটা পুঁটলি খুলে গোটা কয় শাড়ি দেখাল। রং পছন্দ হল না, পাড় পছন্দ হল না; জমিও নয়।

বললুম, আর নেই?

কেন? এতগুলোর মধ্যে একটাও পছন্দ হল না।

হল না তো!

কী জানি বাবা!

নিজের মনেই বিড়বিড় করে বলল সেলসম্যান। তারপর ওপরের দিকে তাকিয়ে হাঁক দিল, নিত্যে-এ-এ। এই নিত্যে! শালারা দোতলাতে গাঁটরির আড়ালে সবসময়ই ঘুমোচ্ছে।

নিত্য সাড়া দিল না।

আমার দিকে চেয়ে সেলসম্যান বলল, আপনিও মশাই শাড়ি কিনতে আসার আর টাইম পেলেন না?

ইতিমধ্যে নিত্যে গাঁটরির আড়াল থেকে বলল, বলতিচো কী গো গোবিন্দদা? যা বলবে বলো-না, এত চ্যাঁচাতিছ কেন?

ধনেখালি। মনোহারী, ফ্যালো গাঁট।

এই ফেললুম।

বলেই ধপ্পাস করে একটা ইয়াব্বড়ো গাঁট সটান কাঠের দোতলা বারান্দা থেকে নীচে। একটু হলে আমার ঘাড়েই পড়ত।

সেলসম্যান বিরক্তমুখে গাঁটরি খুলে বলল, দেখুন, এরমধ্যে পছন্দ না হলে বুঝতে হবে শাড়ি কেনার মতলবে আপনি আসেননি। আমাদের ঘুম ভাঙাবার মতলবেই এয়েচেন।

জবাবে কী বলব ভেবে না পেয়ে, মালিকের দিকে তাকালাম।

মালিক মাঝে একবার দয়া করে চোখ খুলেছিলেন; আবার চোখ বুজে ফেললেন। শাড়ি কিনলে তো টাকা ওঁর কাছেই দিতে হবে আমাকে। তখন তো চোখ খুলতেই হবে। অনেকই কষ্ট হবে তাই একটু আরাম করে নিচ্ছেন।

তাতা বলল, তারপর? ধনেখালি-মনোহারীর গাঁটরিতে মনোমতো শাড়ি পেলি?

দুস। টেস্ট বলে কিসসু নেই। গুচ্ছের ক্যাঁটকেটে রঙের দামি শাড়িতে ঠাসা। নেড়েচেড়ে বললাম, আর নেই।

আরও? সেলসম্যান বলল আমার আস্পর্ধা দেখে, চোখ রাঙিয়ে।

তারপর কী বলল জানিস? বলল, এত শাড়ি বাপের জন্মে কখনো একসঙ্গে দেখেছিলেন?

আমি বললুম, কী করে দেখব? আমার বাবার তাঁতের কাজ ছিল না; শাড়ির দোকানও নয়; অতএব…..

দীপ হেসে উঠল।

বলল, টিপিক্যাল বাঙালি ব্যাবসাদার!

তাতা বলল, শোন-না। আরও কিছুদূর হেঁটে এসে দেখি এক সিন্ধির দোকান। ছোট্ট দোকান। কিন্তু এয়ারকণ্ডিশণ্ড। দরজা ঠেলে ঢুকতেই মনে হল আমি যেন কোনো রাজা-মহারাজা! কে মালিক আর কে কর্মচারী কিছুই বোঝবার উপায় নেই। যে ক-জন লোক ছিল সকলে একইসঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে আপ্যায়ন করল।

তাঁতের শাড়ি কথাটা আমার মুখ থেকে বেরোবার আগেই আমার সামনে বোধ হয় একটার পর একটা এবং কম করে গোটা বিশেক শাড়ি খুলে দেখানো হয়ে গেল। আর এক-একটা শাড়ি ধরে খুলে পাড়ের প্রশস্তি করে, জমির গুণ গেয়ে এমন ভালোবেসে যত্নের সঙ্গে দেখাতে লাগল যে, মনে হল যেন শাড়ি তো দেখাচ্ছে না, মেয়ে দেখতে আসা ভাবী-শ্বশুরবাড়ির লোকদের সামনে নিজের মেয়েকেই দেখাচ্ছে।

ইতিমধ্যে কোথা থেকে একটা উর্দিপরা ছোকরা এসে হাতে একটা ক্যাম্পাকোলার ঠাণ্ডা বোতল আর স্ট্র ধরিয়ে দিয়ে গেল।

তারপর?

তাতা পায়ের ওপর পা তুলে দিয়ে আরাম করে বসে বলল, তারপর তুই-ই বল, মহিলারা হলে আলাদা কথা ছিল। তাদের চক্ষুলজ্জা বলে কিছুই নেই এসব ব্যাপারে। কিন্তু যেকোনো পুরুষমানুষের পক্ষেই এরপরেও সে দোকান থেকে শাড়ি না কিনে বেরিয়ে আসা সম্ভব?

পছন্দসই শাড়ি পেলি?

পছন্দসই মানে কী? প্রত্যেকটা পছন্দসই। কোনটা ফেলে কোনটা নিই এ নিয়েই এক মহাচিন্তায় পড়ে গেলুম। কিন্তু পাঁচ মিনিটের মধ্যে প্যাকেট বগলে নিয়ে ক্যাম্পাকোলা খেয়ে বেরিয়ে এলুম।

দাম? দাম বেশি নিল না?

কোনো সন্দেহ নেই। কম করে ওই বাঙালি দোকান থেকে পাঁচ-দশ টাকা বেশিই নিলে, কিন্তু হোয়াট ডাজ ইট ম্যাটার? থিঙ্ক অফ দা সার্ভিস। দা ডিফারেন্স ইন অ্যাপ্রোচ। ওরা ব্যাবসা করতে এসেছে। খদ্দের ওদের কাছে ভগবান। আর বাঙালি দোকানদার মাত্রই মনে করে, তারা খদ্দেরকে কৃতার্থ করছে।

সত্যি। ভারি দুঃখ লাগে। ভাবলে এত্ত খারাপ লাগে।

সিগারেটটা জানলা দিয়ে বাইরে ছুড়ে ফেলে দীপ বলল, হবে না, কিসসু হবে না; ভিখিরি হয়ে গিয়েও শিখলাম না কিছুই।

তাতা বলল, একটা জিনিস লক্ষ করেছিস? আজকাল কিন্তু সাউথের পাড়ায় পাড়ায় শাড়ির দোকান হয়েছে অনেক।

তা হয়েছে। বেকার ছেলেরা করছে। অথবা তাদের বউরা। আজকাল সাধারণ চাকরিতে কি একজনের রোজগারে চলে? তবে এসব কি আর ব্যাবসা? আসল যা ব্যাবসা সবই চলে গেছে মাড়োয়ারি, গুজরাতি, পাঞ্জাবিদের হাতে। ওরা চব্বিশ ঘণ্টা খাটে। ব্যবহার ভালো। কোথা থেকে এসে কোথায় জুড়ে বসেছে। ফলে আমরা এখন নিজের দেশেই নিজেরা পরদেশি। বাঙালির ব্যাবসা ক-টা আছে এই বাংলাতেই? আর যা আছে তা ক-পয়সার ব্যাবসা? বল?

যা বলেছিস। আজ থেকে দশ-পনেরো বছর বাদে কলকাতা শহরের চৌহদ্দির মধ্যে ক-জন বাঙালি থাকে দেখিস। সকলকেই চলে যেতে হবে শহরতলিতে। ব্যাংকরাপ্ট হয়ে যাচ্ছি আমরা সবদিক দিয়েই। দীপ বলল।

আজকাল প্রফেশনেও ওরা লিড করছে। কেন এরকম হচ্ছে বল তো? আমাদের আসল দোষটা কী?

পরশ্রীকাতরতা। নিজেদের মধ্যে খেয়োখেয়ি, কামড়াকামড়ি। নিজেদের কমিউনিটিতে কেউ বড়ো হলে অন্য সকলে তার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করা তো দূরে থাকুক, তাকে কীভাবে কাছা ধরে টেনে নামাবে সেই চক্রান্তেই সবটুকু সময় নষ্ট করছে। এবং সবচেয়ে দুঃখের কথা, আলটিমেটলি নামাচ্ছেও। নিজের নাক কেটে পরের যাত্রাভঙ্গ করাতে এমন দক্ষ জাত আর এই দেশে নেই।

যা বলেছিস।

অবশ্য এরমধ্যে একটা কথা ভাবার আছে। একটা বড়োকথা। বাঙালির কাছে কোনোদিনও ম্যাটেরিয়াল ওয়েল-বিইংটা বড়ো ছিল না হয়তো। বাঙালি গান শোনে, বাজনা বাজায়, বই পড়ে বই লেখে, বাঙালির রবীন্দ্রনাথ আছেন। রবিশঙ্কর, সত্যজিৎ আছেন। বাঙালি ফুটবল আর ক্রিকেটপাগল। ক্রিকেটের এমন সমঝদার আর কোন জাতে আছে বল? খুব কম অন্য প্রদেশীয়দেরই জীবনে এত বিভিন্ন দিক আছে, এত ওয়াইড ইন্টারেস্ট আছে।

বুলশিট। দীপ উত্তেজিত গলায় বলল।

টোটাল বুলশিট। লেম এক্সকিউজ।

তারপর বলল, যা যা, আসল কথা হল ‘মুখেন মারিতং জগৎ।’ একটি ফাঁকিবাজ হুজুগে জাত আমরা। ক্রিকেট এতই যদি বুঝি তো টেস্ট ক্রিকেটে ক-জন বাঙালির নাম করতে পারি আমরা? জানি আমরা সবই, কিন্তু করি না কিছুই। কিসসু না করেই সবজান্তা! সাধনা না-করেই সব বোদ্ধা!

একটু চুপ করে থেকে দীপ আবার বলল, বাঙালির সবচেয়ে বড়ো শত্রু কী বল তো?

সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্স।

না। তার চেয়েও বড়ো শত্রু? কী নয়, কে? যে এই জাতটার সর্বনাশের গোড়া? এই ফালতু সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্সেরও মূল?

—কে?

—জোব চার্নক। সে ব্যাটা ইংরেজ যদি সুতানুটি, গোবিন্দপুরে এসে জাহাজ না ভেড়াত, তাহলে এ জাতটার হয়তো আর এই দুর্দশা হত না। ভারতবর্ষের মধ্যে প্রথমে ইংরেজি শিখে, প্রথমে আই. সি. এস. জজ, ডাক্তার, উকিল, ব্যারিস্টার, সলিসিটর, বেনিয়ান, মুতসুদ্দি সব হয়ে আমরা ভাবলাম, আমরা কী বুঝি হনু! ইংরেজি ভাষাকে আমরা শিক্ষার সঙ্গে গুলিয়ে ফেললাম। যেন ভারতবর্ষে তার আগে শিক্ষা-সভ্যতা বলে কিছুই ছিল না। শুধু পা চেটে আর ইংরেজির জ্ঞান দিয়ে বৈতরণি যে পেরোনো যায় না এখন তা আমরা চোখের জলে নাকের জলে বুঝছি। কী বলিস? বুঝছি না?

বুঝলাম আর কই! এখনও তো গুমোর যায়নি। আর সবই গেছে, কিন্তু গুমোর যায়নি। যেকোনো জায়গায় তিনশো টাকা মাইনেতে চাকরি করতে পারি আমরা, কিন্তু পারি না একটা পানের দোকান করতে। বড়োই ইজ্জতে লাগে। ইজ্জত! বে-ইজ্জতের আর কী বাকি আছে?

ছাড় তো, অন্য কথা বল। মন খারাপ হয়ে যায়। নিজেদের কথা আর বলিস না। এসব কথা যদি কাউকে বলতেও যাস, সে বলবে মেলা জ্ঞান দেবেন না মশায়! চুপ কর। যা হবার হোক।

একটু চুপ করে থেকে দীপ বলল, যে কমিউনিটি নিজেদেরই টেনে নামায়, যাদের কোনো ফিলিং নেই একে অন্যের প্রতি; কিছুমাত্রও যারা করে না অন্যের জন্যে, নিজেদের মধ্যে কারও ভালো হলে হিংসেয় যাদের বুক জ্বলে যায়; তাদের কপালে আরও অনেক দুঃখ আছে। এখনই কী? তুই লিখে রাখ।

আরও কত দুঃখ? এখনও কি যথেষ্ট হয়নি?

না, হয়নি।

দুই

বহড়াগড়ার কিছু আগে টায়ার পাংচার হল ওদের গাড়ির। হতেই, দেখা গেল যে, গাড়ির প্যাসেঞ্জারের মতো মালিকও গাড়ি সম্বন্ধে কিছু জানে না। কাঁদো-কাঁদো মুখে কবুল করল যে, জীবনে কখনো নিজে হাতে টায়ার বদলায়নি দীপ। অতএব দু-জনে হুমড়ি খেয়ে পড়ে জামাকাপড়ে ধুলোবালি মেখে, অনেক কসরত করে অনেকক্ষণ ধরে টায়ার চেঞ্জ করল।

বহড়াগড়াতে পৌঁছোতে পৌঁছোতে প্রায় সাতটা হয়ে গেল। টিউবটা সারাতে হবে। সেই ফাঁকে চা-টা খেয়ে নিল ওরা।

তাতা বলল, তোর বিদ্যে তো দেখলাম! এবার পথে রাতের অন্ধকারের কোনো মেকানিক্যাল বা ইলেকট্রিক্যাল ট্রাবল হলে কী হবে?

অলুক্ষুণে কথা বলিস না তো! দীপ বিরক্তির গলায় বলল।

তারপর বলল স্বগতোক্তির মতো—রাতের বেলা এসব রাস্তা আজকাল সেফ নয়। কোনো রাস্তাই সেফ নয়। গাড়ি তো দূরের কথা; ট্রেন পর্যন্ত সেফ নয়। তাই ওসব কথা একেবারেই বলিস না।

টিউব সারিয়ে নিয়ে বেরোল যখন, তখন প্রায় পৌনে আটটা বাজে। আকাশে বেশ মেঘ করেছে। কলাইকুণ্ডার আগে থেকে বৃষ্টিও পেল। কুড়ি-পঁচিশ কিলোমিটার রাস্তা। তারপর বিদ্যুৎ চমকানি আর মেঘের গর্জন।

আন্দুল যখন পৌঁছোল এসে, তখন ঠিক এগারোটা। বটানিকস-এর পাশে এসে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। তারপর রামকেষ্টপুর গাড়ি পৌঁছোতেই গোঁ-গোঁ-গোঁ শব্দ করে গাড়ি থেমে গেল।

রাস্তাঘাট প্রায় জনশূন্য। কিছুক্ষণ গাড়িতে বসে ওরা একে অন্যকে গালাগালি করল গাড়ি সম্বন্ধে কিছুই না জানার জন্য।

তারপর তাতা নেমে ঠেলতে লাগল গাড়ি, বৃষ্টির মধ্যেই। দীপ স্টিয়ারিং-এ বসে কী করা যায় তাই ভাবতে লাগল, আব্রা-কা-ডাব্রা; আব্রা-কা-ডাব্রা।

তাতা গাড়ি ঠেলতে ঠেলতে গাড়ির মালিক বন্ধু দীপকে যা-তা গালাগালি করতে লাগল মনে মনে। এমন বন্ধুর চেয়ে শত্রুও ভালো।

তেমাথাতে এসে পৌঁছোল গাড়িটা। সামনে একটা পেট্রোল পাম্পও ছিল। বাঙালির পাম্প। দীপ গাড়ি থামিয়ে পাম্পে গিয়ে মিস্ত্রির খোঁজ করল।

মিস্ত্রি নেই। এত রাতে মিস্ত্রি কোথায়?

কী করা যায়?

কী বলব?

একটা ফোন করতে পারি?

ফোনের চাবি মালিক নিয়ে গেছেন। মালিক ঠিক আটটায় চলে যান। ফোন ধরা যাবে; কিন্তু করা যাবে না।

গাড়িটা এখানে রাতের মতো রেখে যেতে পারি? আরও তো ট্যাক্সি-ফ্যাক্সি আছে দেখছি পাম্পে।

পারেন। গাড়ি চুরি হলে, আমরা কোনো দায়িত্ব নেব না। আর রাতে রাখার জন্য দশ টাকা নেব।

তাহলে কী করা যায়?

কী বলব?

বলেই ভদ্রলোক হাঁক ছাড়লেন, কী রে পেঁচো, দু-খিলি অখয়েরি গুণ্ডি মোহিনী আনতে বললুম-না তোকে।

দীপ ফিরে এল গাড়িতে। তারপর বনেটটা খুলে হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকল পাশে।

যে কিছুই বোঝে না গাড়ির, সে বনেট বন্ধ থাকলেও বোঝে না, খোলা থাকলেও বোঝে না। তোর সঙ্গে আসাই অন্যায় হয়েছে। এই-ই শেষ, তুই একটা ইরেসপনসিবল চাইল্ড। এ যদি রামকেষ্টপুর না হয়ে জঙ্গলের মধ্যে হত?

তাতা রাগে ফেটে পড়ে বলল।

দীপ লজ্জিত ছিল; অপদস্থও। এবার রেগে গিয়ে বলল, এ তো জঙ্গলের বাপ। আজকালকার জঙ্গলের বাঘ-ভাল্লুক, শহরের মানুষের চেয়ে অনেক ভালো।

তাতা এবার একটা সিগারেট ধরিয়ে বিদ্রূপাত্মক গলায় বলল, গাড়িটা স্টার্ট কর—চল তাহলে জঙ্গলেই ফিরে যাই আবার।

দীপ কথাটা হজম করে গুম মেরে বসে রইল।

কয়েক-জন ধুতি-পাঞ্জাবি পরা মাঝবয়সি বাঙালি ভদ্রলোক জটলা করে দাঁড়িয়েছিলেন গাড়িটার কাছেই, একটা পানের দোকানের ছাউনির নীচে, বৃষ্টি থেকে মাথা বাঁচিয়ে। বৃষ্টির জোর ততক্ষণে কমেছে কিন্তু টিপটিপ করে পড়ছে। মনে হচ্ছে, এমনই চলবে সারারাত।

দীপ বনেট বন্ধ করে এসে গাড়িতে বসল। ভিজে একেবারে চুপচুপে। তাতা তো আগেই ভিজেছিল গাড়ি ঠেলতে গিয়ে। কাচ-মোছা ন্যাকড়া দিয়ে দু-জনেই ভালো করে মাথা মুছল।

তাতা হঠাৎ বলল, ওই দ্যাখ বাঙালিদের। বঙ্গনন্দনরা সব গ্যাঁজাচ্ছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। লোকগুলোরকখনো বয়স হবে না। কলেজজীবনে যেমন ফুটপাথে দাঁড়িয়ে গ্যাঁজাত, এখনও তেমনি গেঁজিয়ে যাচ্ছে। এক ব্যাটাও কি একটু সাহায্যের কথা বলবে? তুই গিয়ে বল, দেখবি খেঁকিয়ে উঠবে। রাস্তাও তো ক্রমশ নির্জন হয়ে আসছে রে! এত রাতে এখান থেকে যে ট্যাক্সি করে ভবানীপুর যাব, তারও তো উপায় নেই। গাড়িটাকে ফেলে রাখাও যায় না। নতুন গাড়ি। কী করি বল তো?

গাড়ি তো আমার নয়। থাকলে, গাড়ি কেন এবং কী করে চলে আর কেনই-বা হঠাৎ পথে থেমে যায়, তা নিশ্চয়ই জেনে নিতাম গাড়ি নিয়ে শহর ছেড়ে বেরুবার আগে। আমি বরং এগোই তাহলে। হেঁটে অথবা রিকশা করেও হাওড়া স্টেশনে পৌঁছোতে পারলে একটা গতি আমার হবেই। তোর গাড়ি, তুই থাক।

চাপা অভিমানের গলায় দীপ বলল, তুই তাহলেই চলে যা। আমার জন্যে কেন ঝামেলায় পড়বি?

ঝোড়োকাকের মতো পাতলা হয়ে যাওয়া ক-গাছি ভেজা চুল নাড়িয়ে তাতা প্রচন্ড চটে উঠে বলল, ঝামেলার বাকি কী আর রেখেছিস?

তারপরেই তাতা পানের দোকানের দিকে চেয়ে একটু কান খাড়া করে শুনে বলল, লোকগুলোকী নিয়ে আলোচনা করছে রে?

ঘোড়া।

ঘোড়া?

হ্যাঁ। কাল শনিবার-না? রেস আছে তো। সকলেই টেনে আছে। মুখে গন্ধ পেলাম। শালা! কী আর হবে এদের! তুই এদের বলবি সাহায্যের জন্যে? ফুঁ:।

—একবার গিয়ে বলই-না তবুও। দীপ অনুনয় করে বলল।

কী, বলবটা কী। বলব, আমরা বুড়ো খোকারা গাড়ি চড়ে সাতশো মাইল ঘুরে এলাম জঙ্গলে জঙ্গলে। আর বাড়ির দোরগোড়াতে রামকেষ্টপুরে এসে গাড়ি খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু কী যে খারাপ হল, কেন খারপ হল আমরা জানি না, বুঝি না। কচিখোকা! দুধের শিশু। দাদারা, আমাদের বাঁচান—এই বলে কাঁদব?

দীপ এ অপমানটাও বেমালুম হজম করল।

—লোকগুলো যে ভদ্রলোক, ছিনতাই পার্টি নয়; তাই-বা কে জানে? আমার হাতের ঘড়িটা আবার রোলেক্স। মানিব্যাগেও শ-পাঁচেক টাকা আছে।

—আমার এইচএমটি। তোর গাড়িতে বেড়াতে এসে আমার ঘড়ি গেলে তুই-ই কিনে দিবি। মানিব্যাগে সাঁইত্রিশ টাকা আছে। গেলে, সেটাও দিবি। প্লাস মানিব্যাগের দাম, তেরো টাকা। মনে থাকে যেন।

দীপ তবুও চুপ করে রইল।

পথ আস্তে আস্তে একদম ফাঁকা হয়ে আসছে। লোকগুলোর আলোচনা কিন্তু তখনও শেষ হয়নি। ঘোড়ায় চড়ে যুদ্ধ করত, ভারতের অন্যান্য প্রদেশীয়রা রাজ্যের পর রাজ্য জয় করত অবহেলায়। স্বয়ংবর সভা থেকে সুন্দরী তুলে আনত। আর এই বাঙালিরা? ঘোড়ায় চড়ে সর্বনাশের পথে যাচ্ছে! রেসের ঘোড়া। তাও নিজে চড়ে নয়।

এবার বোধ হয় আড্ডা ভাঙল। একে-একে দলছুট হতে লাগল লোকগুলো। ডি-ফ্রস্ট হয়ে গড়িয়ে গেল বিভিন্ন দিকে।

দীপ গলা বাড়িয়ে ওদের কিছু বলবে বলবে করল, কিন্তু লজ্জা করল; বলতে পারল না।

এই লজ্জাই বাঙালিকে খেল—এই লজ্জা, এই অদ্ভুত মানসিকতা। দীপ ভাবল।

এমন সময় ওঁদের মধ্যে একজন গাড়ির পাশ দিয়ে যেতে যেতে থেমে গিয়ে বললেন, কী হল দাদা? অনেকক্ষণ থেকেই দেখছি দাঁড়িয়ে আছেন ঠায় এখানে। এ পাড়া কিন্তু ভালো নয়। রাতও হল। এবার এগোন।

তারপর বললেন, হলটা কী? গাড়ি খারাপ হল নাকি?

হ্যাঁ। দীপ বলল।

কী খারাপ হয়েছে? তেল আসছে না।

তাতা তাড়াতাড়ি জানলার দিয়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল।

টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছিল। জামাকাপড় এমনিতেই ভিজেছে। তাই বাঁ-হাতটা জানলা দিয়ে বাইরে রেখেই বসেছিল। পিটপিট করে বৃষ্টি পড়ছিল হাতে। পড়ুক। এখন শরীর-মনে সাড় নেই কোনো। ক্লান্ত, বিরক্ত।

ভদ্রলোক আবার জিজ্ঞেস করলেন, গাড়ির কমপ্লেইনটা কী দাদা, তা তো বলবেন?

তাতা মুখটাকে এক হ্যাঁচকাতে আরও বাঁ-দিকে ঘোরাল। ঘাড়ে লাগল।

দীপ হঠাৎ ফোড়া ফাটার মতো বলল, জানি না। গাড়ির কিছুই বুঝি না দাদা!

অ্যাই রে! কী ঝামেলায় ফেললেন বলুন তো! আমার তো গাড়ি নেই, আমি যে সাইকেলের সওয়ারি। সাইকেল হলে, এক্ষুনি ঠিক করতে পারতুম। বলেই, হাঁক ছাড়লেন বন্ধুদের—অ্যাই রমেশ, চাঁদু, মানকে, চিনু যাসনি তোরা। এঁরা বিপদে পড়েছেন। ইদিকে আয়।

যাঁরা এলেন তাঁদের মধ্যে মনে হল, একজন গাড়ি সম্বন্ধে কিছু বোঝেন-টোঝেন।

যে ভদ্রলোক প্রথমে এসেছিলেন, তিনি চিনিয়ে দিয়ে বললেন, অ্যাই যে, আমার বন্ধু মানকে। মানকে দাস। যৌবনে মহাকাপ্তান ছেল। লালরঙা স্পোর্টস-মডেল বেন্টলি চেপে ঘোড়ার মাঠে যেত আমাদের নিয়ে। স্কচ ছাড়া খেত না। বেনারসের সুরাতিয়া বাইজি ছাড়া কারও গলার গজল ঠুংরি ভালো লাগত না তখন। এখন পা-গাড়ি ওনার। তবে এখনও কোনো গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ শুনেই আমার দোস্ত বলে দেবে কী ব্যামো গাড়ির।

কিন্তু কোনো শব্দই করছে না যে ইঞ্জিন। দীপ হতাশার গলায় বলল।

সে কী মশাই! ভদ্রলোক হেসে ফেললেন। আঁতুড়েই নুন গিলিয়েছেন?

মানিকবাবু, মানে মানকে দেখে-টেকে বললেন, হয় ব্যাটারি জ্বলে গেছে, নয় ডায়নামো চার্জ দিচ্ছে না। ব্যাটারিতে জল ছিল তো? ফ্যানবেল্ট? ফ্যানবেল্ট ঠিক আছে?

দীপ যেন ল্যাটিন কী হিব্রু শুনছে। এমনই মুখ করে তাকিয়ে রইল মানিকবাবুর মুখে নির্বাক হয়ে।

তাতা হঠাৎ বলল, আরে আপনারা পানের দোকানের ছাউনির নীচে ছিলেন, এখন একেবারে ভিজে গেলেন যে।

চাঁদু বলে যে ভদ্রলোক তিনি বললেন, বাঙালি বিপদে পড়েছে, একটু নাহয় ভিজলুমই! রোজ তো আর বিপদে পড়বেন না আপনারা! তা ছাড়া, এ তো দেশেরই বৃষ্টি। এতে অসুখ ধরবে না।

তারপর ওঁরা সকলে মিলে বিষ্টিতে দাঁড়িয়ে মিনিট পাঁচেক উত্তেজিত আলোচনা করার পর মানিকবাবু বললেন, পটলের গ্যারেজেই নিয়ে যেতে হবে। এ ছাড়া উপায় নেই কোনো।

পটলা কি আর মানুষ আছে? বাংলা টেনে, খিচুড়ি সেঁটে, লম্বা দিয়েছে এতক্ষণে। ঠাণ্ডার দিন।

লম্বা দিলে আমরা টেনে ওকে বেঁকিয়ে দেব। রোজ তো আর করি না। দাদারা বিপদে পড়েছেন।

বলেই বললেন, থাকেন কোথায় দাদারা?

দীপ বলল, আমি ভবানীপুর। আর আমার বন্ধু টালিগঞ্জ।

হুঁ! বাবা! এ পৃথিবীর একেবারে অন্যপ্রান্তে।

তাতা ও দীপ এতক্ষণে নেমে দাঁড়িয়েছিল। এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলল, ঠেলবার লোকও তো দেখছি না একজনও। কোনো কুলি কী ঠেলাওয়ালা……

কেন? মানিকবাবু বললেন। আমরা কি লোক নই?

সে কী? আপনারা গাড়ি ঠেলবেন? তাতা বলল।

দীপ অবাক হয়ে বলল, পটলবাবুর গ্যারাজ কত দূর?

তা আধমাইলটাক তো হবেই কম করে। পৌনে এক মাইলও হতে পারে।

বলেন কী? দীপ আঁতকে উঠল।

এ ছাড়া উপায় কী? এখন কোনো গ্যারেজ খোলা নেই। পটলা আমাদের, মানে বন্ধুর মতো।

চাঁদুবাবু বললেন, কথায় কথা বাড়ে। খামোখা দেরি করছিস কেন?

তারপর দীপকে প্রায় ধমক দিয়েই বললেন, দাদা আপনি স্টিয়ারিং-এ বসুন তো।

তাতা ওদের সঙ্গে হাত লাগাল। দীপ ওদের নির্দেশানুযায়ী স্টিয়ারিং ঘোরাতে লাগল। তরতর করে নৌকোর মতো চলতে লাগল গাড়ি।

বেশ দূরে যাওয়ার পর গাড়িটা একটা ভাঙাচোরা কাঁচা গলির মধ্যে ঢুকে পড়ল। লোডশেডিং হয়ে গেল ঝুপ করে। ঠিক সেই সময়েই।

দীপের তলপেট ভয়ে গুড়গুড় করতে লাগল। আজকে প্রাণটাই যাবে।

তাতা গাড়ি ঠেলতে ঠেলতে দৌড়ে পালিয়ে যেতে হলে কোনদিক দিয়ে যাবে, তা একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিল। ওরও ভয়ে গলা শুকিয়ে গেছিল।

ক-টা বাজল রে?

মানিকবাবু শুধোলেন।

দীপ বলল, পৌনে বারোটা।

রোলেক্স অটোমেটিক ডে-ডেট। আমি দেখে নিয়েছি। মৃন্ময়বাবু বললেন।

দীপের জিভ শুকিয়ে কাঠ হয়ে এল। কী ঘড়ি সেটা পর্যন্ত দেখে নিয়েছে। এরা নিশ্চয়ই ডাকাত-ফাকাত।

কখন যে পটল মিস্ত্রির গ্যারেজ পৌঁছোল গাড়ি, অন্ধকারে পচা নর্দমার পাশ দিয়ে, দীপ বুঝতেই পারল না। ঘোরের মধ্যে ছিল যেন। মাটির মেঝে, বাঁশের চাঁচের; মাত্র দুটি গাড়ি ধরে এমন সাইজের একটি টিনের শেড। অতিছোট্ট কারখানা।

পটল মিস্ত্রি সত্যি সত্যিই লম্বা দিয়েছিল। একটা কাঠের বেঞ্চে আণ্ডারওয়্যার পরে শুয়ে, খালি গায়ে নাক ডাকছিল।

কথামতোই তাকে টেনে ব্যাঁকা করলেন মানিকবাবু, চাঁদুবাবু আর মৃন্ময়বাবু মিলে।

মানিকবাবু ঠিকই ধরেছিলেন। কাট-আউটের গোলমাল ও আর্মেচারেরও সামান্য গোলমাল ছিল। সারতে লাগল প্রায় একঘণ্টা। যতক্ষণ-না গাড়ি ঠিক হল ওঁদের মধ্যে মৃন্ময়বাবু আর মানিকবাবু বসে রইলেন। দীপ আর তাতাকে নমস্কার করে চাঁদুবাবু একটু আগে চলে গেছিলেন।

বা: বা:! ইঞ্জিন তো চমৎকার বলছে। হেড লাইট, হর্ন; সব ঠিক।

দীপ উজ্জ্বল মুখে বলল, কত দেব?

পটল বলল, কাটুন তো আপনারা। এই মানকেদাটার যত্ত থার্ড কেলাস কান্ড। কাটুন, এবার একটু ঘুমুই। ঘুমুতে দিন। পয়সা নেব না।

তা কি হয়? দীপ বলল।

মৃন্ময়বাবু বললেন, জোর করেই যদি দ্যান তো দিয়ে দিন পাঁচটা টাকা।

পাঁচ টাকা কী? উনি কতবড়ো উপকার করলেন আমাদের, কতক্ষণ ধরে পরিশ্রম করলেন এতরাতে।

দীপ কুড়িটা টাকা বের করল।

পটল মিস্ত্রি মানিকবাবুকে রুক্ষস্বরে বলল, ‘অ্যাই মানকেদা, ভদ্রলোককে বলে দাও আমি ভিখিরি নই যে বকশিশ নেব। নেহাত তোমার খাতিরেই মাঝরাত্তিরে করলুম। আমি শালা বাঙালির বাচ্চা, পয়সাই আমার কাছে সব নয়। পয়সা চাইলে অনেক মালই এতদিনে জমাতে পারতুম।’

মানিকবাবু ধমকে বললেন, ‘মেলা ভ্যাচোর ভ্যাচোর করিসনি। নে, এই দশটা টাকা রাখ। আমি দিচ্ছি। শালা, চ্যারিটেবল ডিসপেনসারি খুলে বসেছে এখানে। গাড়ল।’

বলে, বাকি দশ টাকা দীপকে ফেরত দিলেন। গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করে গলির মধ্যে দাঁড়িয়ে, ইঞ্জিন স্টার্ট রেখেই দরজা খুলে দীপ গাড়ি থেকে নামল। তাতাও। বলল, ‘আপনারাও উঠুন এগিয়ে দিই।’

মৃন্ময়বাবু হাসলেন। বললেন, ‘সে তো এগোনো হবে না দাদা, পেছোনো হবে।’ আমরা দু-জনেই এদিকেই থাকি।

বলেই লোডশেডিং-হওয়া রাতের হাওড়ার কাঁচা নর্দমা ঘেরা ওই অন্ধকার গলির গভীরতর অন্ধকারে আঙুল দেখালেন।

দীপ বলল, আপনাদের জন্যে আমি। মানে আমরা কী করতে পারি…..? যদি বলেন, মানে…..বলেই, ও কাউকেই জীবনে ঠকায়নি, ঠকাতে চায় না এমন ভাবমাখা গর্বগর্ব মুখ করে হিপ-পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করল।

মানিব্যাগ বের করার পরও ওঁদের চুপ করে থাকতে দেখে, ঘাবড়ে গিয়ে তাড়াতাড়ি বলল, ‘কালকে আবার আপনাদের রেস…..আপনারা বই দেখছিলেন…..রেস মানেই তো খরচা।

মানিকবাবু বুক-ছেঁড়া একটা অতিসস্তা মোটা কাপড়ের পাঞ্জাবি আর মোটা ধুতি পরেছিলেন।

হেসে বললেন, ‘বাঙালি হয়ে অন্য বাঙালির বিপদে এতটুকু না করলে, কী করলাম!’

মৃন্ময়বাবু বললেন, ‘আমার একটা ছোট্ট ঘড়ি সারানোর দোকান আছে। রাধাবাজার। দোকান মানে, একটা ঘড়ির দোকানের বারান্দাতে বসি। একদিন আসবেন। চা খেয়ে যাবেন এককাপ। আপনার ঘড়িটা কিন্তু রাজা-ঘড়ি।’

দীপ বোকা-বোকা হাসল। কী বলবে, তা একেবারেই ভেবে পেল না। মানিব্যাগটা পকেটে রেখে বলল, আপনারা কিন্তু কিছু মনে করবেন না, আমি কিন্তু আপনাদের অপমান করতে চাইনি।

মানিকবাবু হেসে বললেন, ‘অপমান কে কাকে করে মশাই! আমরা গায়ে মাখলে তো ওসব কথা। আসল ব্যাপার কী জানেন? টাকাকে যদি এতই দামি ভাবতুম, তবে অমন করে টাকা ওড়াতে পারতুম না। বাঙালির কাছে টাকার চেয়েও বড়ো যে অনেক কিছুই ছিল। এবং আছে। টাকাওয়ালা মাড়োয়ারি-গুজরাতি-পাঞ্জাবিরা বাঙালিকে শুধু টাকা নেই আর টাকার লোভ নেই বলেই হেয় করে এল চিরদিন। আর বাঙালিও কান নিয়ে গেছে শুনে ওদের কথামতো দৌড়ুতে শুরু করল নিজের কানে হাত না দিয়েই।’

তারপর একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘কিন্তু আপনি তো একজন বাঙালি। বাঙালি হয়েও বাঙালিকে ভুল বোঝা কি ঠিক?’

তাতা কথা ঘুরিয়ে বলল, ‘রাত তো প্রায় দেড়টা। আপানাদের খাওয়াদাওয়া….বাড়িতে চিন্তা….’

মানিকবাবু জোরে হেসে উঠলেন। বললেন, আমার তো বউ-ই নেই। যখন মাল ছেল, না-বিয়ে করা অনেকেই ছেল। তবে, মৃন্ময়ের আছে। বিয়ে-করা বউ। পাড়ায় যখন যারই বিপদ হয়, মৃন্ময় সবচেয়ে আগে দৌড়ে যায়। ওর বউ নিশ্চিত ভাত নিয়ে জেগে বসে থাকবে ওর জন্যে। আপনাদের কোনোই চিন্তা নেই। মৃন্ময়কে সে ভালো করেই চেনে।

দীপ বলল, ছি ছি! এত রাতে। আমাদের জন্যে আপনাদের সকলের…….

মানিকবাবু ধমক লাগালেন।

বললেন, যান, পালান তো এবার। আপানাদের বউরা কি ওয়্যারলেসে খবর পেয়েছেন যে, আপনারা কেয়ার-অফ মৃন্ময় বাঁড়ুয্যে আছেন? চিন্তা বুঝি তাঁদের নেই?

মৃন্ময়বাবু বিনীত মুখে বললেন, ‘আপনাদের তাড়া না থাকলে গরিবের বাড়িতেই একটু খিচুড়ি খেয়ে যেতে পারতেন। আমার বউ খুব তাড়াতাড়ি রেঁধে দিত। দেরি হত না কিন্তু।’

দীপ বলল, না না, আমাদের রাত ন-টার মধ্যে পৌঁছোনোর কথা ছিল।

তাহলে আর একটাও কথা নয়। এক্ষুনি রওয়ানা হোন ভালোয় ভালোয়।

তাতা নমস্কার করে বলল, যাচ্ছি দাদা।

যাওয়া নেই, আসুন।

বলে, ওঁরা দু-জনেই হাত তুলে নমস্কার করলেন ওদের দু-জনকে। তারপর ঝুপঝুপে অন্ধকারে আর টিপটিপে বৃষ্টিতে কাঁচা গলির মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।

গাড়ির হেডলাইটটা অন্ধকার গলিটাকে পুরোপুরি আলোয় ভরে দিয়েছিল! দীপ গাড়ি চালাচ্ছিল চুপ করে। তাতাও চুপ করেছিল। কেউই কোনো কথা বলছিল না। তাতার চোখের সামনে মানিকবাবুর বুক-ছেঁড়া, মোটা, অতিসাধারণ কাপড়ের সস্তা পাঞ্জাবিটা ভেসে উঠছিল।

দীপের চোখের কোণ দুটো জ্বালা করছিল।

তাতা একটা সিগারেট নিজের মুখে দিয়ে ধরিয়ে দীপের মুখেও একটা গুঁজে দিল। তারপর কাঁপা কাঁপা হাতে দেশলাই জ্বালাতে জ্বালাতে বিড়বিড় করে বলল, এই আমরা; আমরা শালা একটা আশ্চর্য……

তাতার মুখনি:সৃত বাক্যের শেষাংশটি ভেঙে গেল ওর জিভের মধ্যে।

দেশলাই-এর কাঠিটা জ্বলে উঠেই দপ করে নিবে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *