তেইশ
পুরনো কথা বলার মুশকিল এই যে, সব কথা ক্রমবিন্যাসে আসে না। আগের কথা পরে, পরের কথা আগে হয়ে যায়। পিছারার খালের আশপাশের কথা বলতে গিয়ে তাই অনেক কথাই বেশ মেশামেশি হয়ে যাচ্ছে। আবার ঘুরেফিরে আমাদের দুই সম্প্রদায়ের পারস্পরিক সম্পর্কের যেসব কথা অনিবার্যভাবেই আসছে, তাও আগে-পিছে হয়ে যাচ্ছে।
তারুলি স্কুল ছাড়ার কয়েক দিন পর বাবা এক সকালে আমাকে ডেকে বললেন—আইজ থিকা তুই কীর্তিপাশার স্কুলে যাবি। তারুলি স্কুল ছাড়ার পর মনে একটা অস্থিরতা বোধ করছিলাম। যদিও বাবা প্রসন্নকুমার বিদ্যালয়ে মাস্টারি শুরু করার পর অনেকটাই দায়িত্বশীল হয়েছিলেন, তবু যতক্ষণ ভর্তি না হচ্ছি ততক্ষণ আশ্বস্ত হতে পারছিলাম না। যদি আবার সিদ্ধান্ত নিতে দেরি বা ভুল করেন, তাহলে তো অবস্থা চৌপাট। আবার তারুলি স্কুল ছাড়ার ব্যাপারে আমার মনে একটা মানসিক গ্লানিও কাজ করছিল। নিজেকে বিশ্বাসঘাতক, নিমকহারাম বলে বোধ হচ্ছিল। কিন্তু আমার কোনো উপায় ছিল না। এবার নবম শ্রেণি। যেখান থেকে এসেছি সেখানে আমি প্রথম স্থানাধিকারী ছাত্র। কিন্তু সেই স্কুলের বিশেষ কোনো মান্যতা নেই। যেখানে যাচ্ছি সেই স্কুলে অনেক ভালো ভালো ছাত্রছাত্রী। তাদের সঙ্গে আমার পাল্লা দিতে হবে। মনে বেশ ভয়।
স্কুলে যখন পৌঁছলাম, তখন আমি প্রায় একটা দর্শনীয় বস্তু। সেখানে দু-একজনকে চিনি। বেশির ভাগই অচেনা। এই স্কুলের রেক্টর স্যারের খ্যাতি অনেক শুনেছি। চিরকুমার, খেয়ালি এবং অসম্ভব পণ্ডিত সেই বৃদ্ধকে নাকি হেডমাস্টারমশাই পর্যন্ত ভয় পান। আগের স্কুলের মাস্টারসাহেবরা আমাকে দারুণ ভালোবাসতেন। এখানে অবস্থাটা কী দাঁড়াবে সেটা একটা চিন্তার ব্যাপার। ওইসব দিনে আমরা ছাত্ররা মাস্টারমশাইদের স্নেহ, ভালোবাসা পাওয়ার জন্য খুবই আকাঙ্ক্ষী ছিলাম। অবশ্য পরীক্ষার নম্বর সংক্রান্ত ব্যাপারের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক ছিল না। মাস্টারমশাইদের চালচলন, গাম্ভীর্য, জ্ঞানার্জনের ব্যাপারে তাঁদের নিষ্ঠা ইত্যাদি খুবই আকর্ষণীয় বোধ হতো। তাঁদের সাহচর্য পেলে মনে খুব আনন্দ হতো। তাঁরা কোনো কিছু আদেশ করলে যেন বর্তে যেতাম। আমার এরকম মানসিকতার কারণ বোধহয় বাল্যাবধি স্কুলে পড়ার সুযোগ না পাওয়া এবং এই ধরনের জীবনের জন্য নিয়ত আকাঙ্ক্ষার মধ্যেই নিহিত। বস্তুত এই সময়টায় স্কুল এবং মাস্টারমশাইদের প্রতি আমি বড়ই কৃতজ্ঞ ছিলাম।
আগেই বলেছি, এর আগে আমি এই স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে এক বছর পড়েছিলাম। ওই বছরেই দেশে বোধহয় প্রথম সাধারণ নির্বাচন হয়। সেবার নির্বাচনে পূর্বপাকিস্তানে যুক্তফ্রন্ট সরকার তৈরি হলো। প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার আলি মির্জা সাহেব তখন দেশের সর্বময় কর্তা। রাজধানী করাচি। মুসলিম লিগ তখন পূর্ব পাকিস্তানে আর তেমন জনপ্রিয় নয়। সেটা ১৯৫৪ সাল। আওয়ামী লীগ পার্টি ক্রমশ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। নির্বাচনের অব্যবহিত পরেই নানা কারণে সংসদে গোলযোগ শুরু হয়। যতদূর মনে পড়ে, এ সময় সংসদীয় বিতর্ক এক মাৎস্যনায়ী রূপ গ্রহণ করলে একদা মারদাঙ্গার ফলে স্বয়ং স্পিকারই সংসদের মধ্যে খুন হয়। সে এক ভীষণ অবস্থা।
আমাদের তালুকদারির রেশ তখনও আছে। কর্তারা এ দেশে থাকবেন কি ওপারে পাড়ি দেবেন, এরকম এক দোদুল্যমানতায় বিমূঢ়। এ কারণে ফাইভ থেকে পরীক্ষায় পাস করলেও আমার সিক্সে ওঠা হয়নি। আবার ওপারে পাড়ি দেয়া না হলেও কর্তারা কিছু সঠিক সদ্ধিান্ত নিতে না পারায় আমার পড়াশোনাটাই বন্ধ হয়ে যায়। আমি আবার গো-চরানো, খেতখামারিকরণ ইত্যাদিতে জড়িয়ে পড়ি। এ কারণে এক তীব্র মানসিক ক্লেশ আমাকে পেয়ে বসে। বাড়ির বইপত্রগুলোই তখন এই বিষাদ থেকে অনেকটা বাঁচায়। তবে এই সময়টায় আমি ব্যাপকভাবে পুরাণ, মহাভারত, ভাগবত, ভগবদ্গীতা ইত্যাদি গ্রন্থ পাঠে যত্নবান হয়েছিলাম বলে পরবর্তীকালে অনেক সুবিধে হয়েছিল। পারিবারিক প্রভাবের জন্য এ সময় আমি খুবই ধার্মিক জীবেনর প্রতি আকৃষ্ট ছিলাম। অদৃষ্টবাদিতা আমাকে তখন আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছিল। আমার দীনদশার জন্য এ কারণে আমি অদৃষ্ট ছাড়া কাউকেই দায়ী করতে পারিনি।
এইসব কারণে যখন আমি আবার প্রসন্নকুমার বিদ্যালয়ে গিয়ে পড়লাম, তখন আমার আনন্দের আর সীমা ছিল না। কিন্তু প্রথম দিনেই আমার সেই আনন্দ বেশ খানিকটা চোট খেয়ে গেল। মনে আছে ক্লাসে যখন গিয়ে বসেছি, সহপাঠীরা সকলে আমাকে খুব সহজে নেয়নি। কিছু ছাত্র আমার আচার-আচরণে মুসলমানি ছাপ আবিষ্কার করল। কেউ-বা আমার আগেই স্কুল বিষয়ে কিছু উৎকট মন্তব্য করে আমাকে উত্তেজিত করতে প্রয়াস পেল। অবশ্য এসবে খুব বেশি দিন চলল না। একসময় সবার সঙ্গেই বেশ হৃদ্যতা তৈরি হয়ে গেল। আমি এসবে যতটা ক্ষুব্ধ না হয়েছি, একদিন হেডস্যারের একটি মন্তব্যে তার থেকে অনেক বেশি দুঃখ হয়েছিল। সেই বয়সের কিছু স্বাভাবিক দুষ্টুমির জন্য তিনি বলেছিলেন, এটা তারুলি স্কুল নয়। এখানের আদব-কায়দা আলাদা। এখানে সভ্যভদ্র হয়ে থাকতে হবে। তিনি যদি আমার দুষ্টুমির জন্য যথোচিত তিরস্কার করতেন, আমার দুঃখ হতো না। আমার মনে হয়েছিল স্কুলের প্রসঙ্গটি এনে তিনি ব্যাপারটাকে অকারণে সাম্প্রদায়িকভাবে কদর্য করে তুলেছিলেন। সে ক্ষেত্রে যে ছেলেরা আমার মধ্যে মুসলমানি ছাপ আবিষ্কার করেছিল তাদের মানসিকতার সঙ্গে হেডস্যারের মানসিকতার কোনো তফাত ছিল না। আমি এ সময় সাম্প্রদায়িক মানসিকতায় অবস্থান করলেও তারুলি স্কুলে পড়াশোনা করাকালীন দাদিআম্মার সংস্পর্শে এসে অনেক সহনশীল হয়েছিলাম, যদিও পশ্চিমবঙ্গে আসার আগে পর্যন্ত অসাম্প্রদায়িক মনোভাবের অদিকারী হতে পারিনি।
সে যা হোক, এই স্কুলে এসে আমার সবচেয়ে বড় লাভ যেটা হলো, তা হচ্ছে আমি রেক্টর স্যারের নজরে পড়ার সৌভাগ্য অর্জন করলাম। তাঁর একটা খ্যাপাটে অনুবাদের ক্লাস ছিল। সেখানে প্রথম দিনই তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছিলেন। মনে আছে প্রথম দিনের খ্যাপাটে ক্লাসে তিনি বলতে বলতে ঢুকেছিলেন, পৌষ মাসের দিন। একা আমি, কাজের অন্ত নাই। এ-কাজ ও-কাজ সে-কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়।—ইংরাজি করো।—আমি সবার আগে খাতা নিয়ে তাঁর টেবিলে উপস্থিত হলে তিনি প্রথমে খাতার লেখা এবং পরে আমাকে দেখলেন। পরিচয় জানতে চাইলেন। বললেন,—যা ল্যাখলা, ব্যাকরণগতভাবে শুদ্ধ। কিন্তু The sentences should have been more smart. It is English and English is a very smart language. এ ভাষা য্যারগো মাতৃভাষা হ্যারা য্যামন সব্বদা ফিটফাট থাকেন, ভাষাড়াও হেরকমই ফিটফাট রাখতে চায়েন তেনারা।
ক্রমশ এই বৃদ্ধ আমাকে নিবিড় স্নেহে আপন করে নিতে থাকেন। তিনি আমাদের ইংরেজি, সংস্কৃত এবং ইতিহাস পড়াতেন। এই তিনটি বিষয়েই তাঁর ছিল অগাধ পাণ্ডিত্য এবং তিনটিতেই তিনি সেই যুগে মাস্টার ডিগ্রি নিয়েছিলেন। তাঁর নিজের বলতে সংসারে কেউ ছিল না। দার পরিগ্রহ করেননি। ভাইয়েরা বহুকাল দেশছাড়া। ছাত্ররাই তাঁর সব। একদিন স্যার বাবাকে বললেন,—আপনার তো অনেকগুলো পোলাপান, এইডিরে আমি নিমু। দিবেন?–তো বাবা বললেন, হেয়ার আর কথা কী? নেন। ও আপনের ধারে মানুষ অইবে হেয়াতো কপালের ব্যাপার।-সেই থেকে আমি স্যারের বাড়ির সারাক্ষণের বাসিন্দা হই। সে এক গুরুগৃহবাসের প্রাচীনকালীন বন্দোবস্ত প্রায়। তাঁর এবং আমর দুজনের রান্নাবান্না, ঘরবাড়ি পরিচ্ছন্ন রাখা, জামাকাপড় কাচা, গরু বাছুরের দেখভাল করা—এইসব আমাকে করতে হতো। এইসব করে-কম্মে আমি স্কুলে যেতাম। এখানে রাত্রিবেলা অনেক ছাত্র থাকত। স্যার তাদের মিনিমাঙনা পড়াতেন। আমি ক্লাস নাইন থেকে একেবারে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা অবধিই তাঁর কাছে ছিলাম। মাঝখানের কিছু সময় ছাড়া।
স্যারের বাড়িটি ছিল প্রায় তপোবনের মতো গাছপালা ঘেরা নিরালা নিঃঝুম একটি আশ্রমের মতো। আমরা আশ্রম-বালকেরা অবশ্য কেউই শান্তশিষ্ট ব্রহ্মচারী ছিলাম না। প্রত্যেকেই ছিলাম একেকটি অসতের ভাণ্ড। তাঁর গাছের ডাব খেয়ে, আম, জাম, জামরুল ইত্যাদি ঋতু অনুযায়ী ফল-পাকড়ার সদ্ব্যবহার করে আমাদের দিব্য দিন কাটত। এ ছাড়া শীতের সময় খেজুর রসের পায়েস, এদিক-ওদিক থেকে চুরি ছ্যাচরামি করে পাঁঠাটা, মুরগিটা, হাঁসটা জোগাড় হলে চড়িভাতি করে আমরা বেশ আহ্লাদে দিন কাটাচ্ছিলাম। স্যার আমাদের সন্ধেবেলা ঘণ্টাদুয়েক পড়িয়ে খেয়েদেয়ে ‘টোঙ্গের ঘরে’ শুতে যেতেন। আমি পূর্বোক্ত নিত্যকর্ম সমাধা করে যথাসময়ে তাঁর কাছে গিয়ে বেশ ভালো ছেলের মতো গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়তাম। আমাদের কারুকার্য তিনি আদৌ টের পেতেন না। ভোরবেলা সবাই উঠে খানিকক্ষণ পড়ার ভান করে যে যার বাড়ি চলে যেত। আমি আমার কাজকর্ম সমাধা করে স্যারের সঙ্গে স্কুলে চলে যেতাম। আমাদের ওপর স্যারের অসম্ভব বিশ্বাস ছিল। ফলে আমাদের দৌরাত্ম্য ক্রমশ মাত্রা ছাড়িয়ে যেতে লাগল। আমরা স্যারের বাড়িতে বসে তেমন কিছু পড়াশোনা করতাম না। কাছাকাছি তুলসী নট্ট বলে একটি ছেলে ছিল। তার বাড়িতে কোনো বয়স্ক গার্জেন ছিল না। সে পড়াশোনার পাট চুকিয়ে নিজের জমিজমার তদারকি করত। ওই বয়সেই তার বিয়েটাও হয়ে গিয়েছিল, একটা ছেলেও হয়েছিল বেশ দলমলে। আমাদের আহৃত সম্পদ তুলসীর বউ বেশ তরিবত সহকারে পাক করে দিত। আমরাও সেসব সদ্ব্যবহার করে বউটিকে প্রাণভরে আশীর্বাদ করতাম।
স্যারের বাড়িতে আমরা নৈশ্যবিদ্যার্থীরা যেসব কাণ্ডকারখানা করে যাচ্ছিলাম, তাকে আর যা-ই হোক বিদ্যার্থীসুলভ আচরণ বলা চলে না। স্কুলেও তখন আমাদের বেশক পাখা গজিয়েছিল। তখন একদিন কী কারণে স্মরণ নেই, ছাত্ররা একটা ধর্মঘটমতো করি। তখনকার দিনে ওখানে এ ধরনের ঘটনার কথা কেউ চিন্তাও করত না। যারা বয়ঃকনিষ্ঠ ছিলাম, তারা ব্যাপারটির গুরুত্ব আদৌ বুঝতেই পারিনি। কয়েকজন বয়স্ক ছাত্র ছিল ঘটনাটির হোতা। স্যারের কী না কী ত্রুটি-বিচ্যুতির অছিলায় তারা ঘটনাটি ঘটায়। একটা উত্তেজনাময় পরিস্থিতি। সবাই ক্লাস ছেড়ে বেরিয়ে এসে হুল্লোড় করেছিলাম, এ কথা মনে আছে। আমাদের মাথায়ই আসেনি যে, স্যারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ জানানোর কোনো অর্থই নেই। সদাশিব শিশু-প্রকৃতির মানুষ। তাঁর বিরুদ্ধে যে কারও কোনো ক্ষোভ থাকতে পারে, এরকম কোনো ধারণাও তাঁর মাথায় ছিল না। তার ওপর তিনিই একমাত্র শিক্ষক, যিনি বিনা বেতনে শুধু স্কুলে নয়, তাঁর বাড়িতেও শিক্ষাদান করেন। যে যখন খুশি তাঁর কাছে গিয়ে পড়া বুঝে নিতে পারে। কখনোই না নেই। যদিও গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য যথেষ্ট শস্য তাঁর জমিতে উৎপন্ন হয় এবং প্রয়োজনের তুলনায় তা অনেক বেশি। কিন্তু অন্নচিন্তা না থাকলেই যে লোকে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াবে, এ দৃষ্টান্ত আজকে কেন তখনকার দিনেও খুব একটা ছিল না। এহেন মানুষের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ? ফল হলো মারাত্মক। স্যার ভীষণ ক্ষুব্ধ এবং অভিমানাহত হলেন। সিদ্ধান্ত নিলেন, আর নয়, স্কুলের সঙ্গে কোনো সংশ্রবই তিনি আর রাখবেন না। আহত ক্ষুব্ধ বৃদ্ধ হনহন করে যখন বাড়ির রাস্তা ধরলেন, আমরা তখন হুল্লোড়ে মত্ত।
পরদিন থেকে তাঁর স্কুলে আসা বন্ধ। রাতেও পড়াতে বসেন না। থাকতেও বলেন না, যেতেও বলেন না। আমি যথারীতি রান্নাবান্না করি। নিজে নিয়ে-থুয়ে খান। আমাকে ডাকেন না। কারও সঙ্গেই কোনো বাক্যালাপ নেই। সকালে দুটি পান্তা খেয়ে তাঁর গরুগুলোকে (যেগুলো কোনোকালে এক ফোঁটা দুধ দিয়েছে বলে আমার স্মৃতিতে নেই) নিয়ে দূরের কোনো মাঠে চরাতে যান। হাতে থাকে একখানা বই। তা নেসফিল্ডের গ্রামারও হতে পারে, ব্যাকরণ কৌমুদীও হতে পারে, আবার কালিদাস হতেও বাধা নেই। গরু আর বই। এই দুই বৈপরীত্য নিয়ে তাঁর জগৎ। বই বিযুক্তিতে গরু আর গরু বিযুক্তিকে বই। গরুরা উন্মুক্ত মাঠে তাদের মতে চরে খায়, তিনি বই নিয়ে একটা গাছের ছায়ায় বসে তাঁর মতো সময় কাটান। যদিও বই বিযুক্তিকে গরু আর গরু বিযুক্তিতে বই আমাদের অঞ্চলে ভিন্ন অর্থে পরম্পরা, কিন্তু স্যার বোধহয় ভেবেছিলেন যে, আমাদের মতো দুপেয়ে গরু চরানোর চাইতে চার পেয়েদের চরানো ভালো। কারণ দুধ না পাওয়া গেলেও সেই গো-সেবার পুণ্যিটা ফ্যালনা নয়। দুপেয়েদের চরিয়ে তো না রাম না গঙ্গা। একসময় আমাকেও বই বগলে করে গোচারণে যেতে হতো বলে বিষয়টিতে আমার দুর্বলতা প্রখর। তাই অধ্যাপকের ঈদৃশ আচরণে অন্যেরা ক্ষুব্ধ হলেও আমি হইনি। আমি জানি গরু চরানো এবং বই পড়া দুটোই, অথবা আলাদা আলাদাভাবে যদি কারও নেশা হয়, তবে তার নাওয়া-খাওয়ার সময়জ্ঞান থাকে না। স্যারেরও ছিল না। তিনি গরু নিয়ে বেরিয়ে গেলে, রান্নাবান্না সেরে, তাঁর খাবার সাজিয়ে রেখে, খেয়ে নিয়ে আমিই স্কুলে চলে যেতাম। বেশির ভাগ দিনই ফিরে এসে দেখতাম, খাবার ঠাণ্ডা হয়ে যেমনটি ছিল তেমনটিই পড়ে আছে। তিনি তখনও ফেরেনননি। দু-একদিন দেখার পর আমি স্কুল কামাই করতে শুরু করলাম। বারোটা, সাড়ে বারোটা বেজে গেলে যদি মানুষটিকে ধরে এনে দুমুঠো না খাওয়াতাম, তবে হয়তো তিনি তাঁর ওই অক্ষীরা গোবীদের সম্বোধন করে বাশিষ্ঠ শ্লোক উচ্চারণ করে বলতেন, হে কামধেনু ভগবতি, এইসব মনুষ্য এবং জীবদিগকে অন্নপ্রদান করো। ইহারা বড়ই বুভুক্ষু।
ব্যাপারটা যে এতদূর গড়াবে, তা আমরা বা মাস্টারমশাইরা কেউই আঁচ করতে পারিনি। স্যার আমাদের শিক্ষালয়ের প্রাণস্বরূপ ছিলেন। নিঃস্বার্থে শুধু একজন শিক্ষাব্রতী হিসেবে তিনি প্রায় তাঁর গোটা জীবন এই শিক্ষালয়ের উন্নতি এবং ছাত্রদের হিতার্থে অতন্দ্র ছিলেন। চিরকুমার অশ্বিনীকুমারের জীবনে অন্য কোনো ধ্যানজ্ঞান ছিল না। এই শিক্ষালয়ের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা রোহিনীকুমার ছিলেন শ্রেষ্ঠতম মানুষ। বাল্যাবধি স্যার ওই মহান মানুষটির প্রতি বিশেষভাবে আকৃষ্ট ছিলেন। তাঁর যৌবনকালে অশ্বিনীকুমার আট-দশ বছর বয়সের বালক মাত্ৰ। তিনি রোহিনীকুমারের নানাবিধ লোকহিতকর কর্মের সাক্ষী। এ কারণেই এই বিদ্যালয়ের ওপরে এক প্রগাঢ় মমতা সারা জীবন তাঁকে এর সেবায় একনিষ্ঠ রেখেছে।
রোহিনীকুমার তাঁর মানসজগতে যে এক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন, তা তাঁর মুখেই শুনেছি। বলতেন, অতবড় একটা পরিবারের সন্তান হয়ে তিনি কী করলেন আর আমরা কী করি। তিনি যদি ইচ্ছে করতেন, তাঁর পরিবারের অন্যদের মতো যেমন খুশি ভোগবিলাসে মত্ত থাকতে পারতেন। সে যুগে কেউ এ কারণে তাঁকে কিছু বলতেও সাহস পেত না। বরং সেটাই তাঁর ক্ষেত্রে স্বাভাবিক হতো। কিন্তু তিনি তো তা করেননি। তিনি তাঁর যুগানুযায়ী আদর্শে শিক্ষাবিস্তার, সাহিত্যচর্চা, ইতিহাসচর্চা তথা দরিদ্র অধ্যপকদের বৃত্তি প্রদান এবং অন্যান্য লোক ও সমাজহিতকর কর্মে তাঁর স্বল্পায়ু জীবন ব্যয় করে গেছেন।
এ কথা মিথ্যা নয়। রোহিনীকুমারের পরিবারে বিলাসব্যসনে জীবন পার করা কিছু গল্পকথা নয়। তার নমুনা আমরা বাল্যে কিছুটা দেখেছি। নবাবি আমলের ভূস্বামী তাঁরা। অর্থের অভাব কাকে বলে তা কোনো দিনই জানেননি। সেই বংশে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র থেকে শুরু করে বিষ প্রয়োগে হত্যা ইত্যাদি অনেক কিছুই ঘটেছে। সেই পরিবারের সন্তান যদি প্রথাগত আচরণে না গিয়ে সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন, সমাজবিজ্ঞান তথা লোকহিতৈষণার হাজারও কর্মে জীবনপাত করেন, তবে সে এক অনুকরণীয় জীবন তো বটেই। সেই পুণ্যশ্লোক মানুষটির অসমাপ্ত কার্য এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য অশ্বিনীকুমার তাঁর জীবন উৎসর্গ করেছিলেন।
এই হেন মানুষটিকে আমরা আঘাত করেছিলাম। তখন বুঝিনি, পরে যখন বুঝেছি অনুশোচনায় দগ্ধ হয়েছি। সে অনেক কথা। এখন কীভাবে স্যারকে আবার স্কুলে আনা হলো সেই কাহিনি বলব।
মাস্টারমশাইদের মধ্যে একজন অশ্বিনীবাবু ছাড়া কেউই খুব বড়মাপের শিক্ষক ছিলেন না। তিনিই ছিলেন একজন অসীম জ্ঞানসম্পন্ন মানুষ। তাঁর অধ্যয়ন, সর্বোপরি তাঁর মেধার তুল্য মেধা অন্য কোনো মাস্টারমশাইদের মধ্যে যে ছিল না, এ কথা অন্যদের প্রতি সশ্রদ্ধ থেকেও বলতে আমার কোনো দ্বিধা নেই। তাই তিনি যখন স্কুলে আসা বন্ধ করলেন, আমরা যে কজন তাঁর ন্যাওটা ছেলেমেয়ে, প্রমাদ গুনলাম। ধর্মঘটের গোটা ব্যাপারটা আমাদের খুব জোলো বলে বোধ হতে লাগল।
স্কুলে অন্য মাস্টারমশাইরাও আমাদের ওই দিনকার আচরণে বিরক্ত হয়েছিলেন। তাঁদের কেউ কেউ স্যারের কাছে গিয়েওছিলেন, অনুরোধ করে যদি ফিরিয়ে আনা যায়। কিন্তু তাঁর এক কথা, আর না। আমরা কম বয়স্করা তো বুঝিইনি, স্যার নিজেও বুঝতে পারেননি এরকম একটা ঘটনা ঘটার কারণ কী? তাঁর খুব সম্ভব মনে হয়েছিল যে, শুধু ছাত্ররাই নয়, তাঁকে এভাবে অপদস্থ করার পেছনে আরও কেউ কেউ আছে যারা ব্যাপারটা উসকে দিয়েছে। গ্রামগাঁয়ের স্কুল। কুচক্রীপনার আখড়া। স্যারের জনপ্রিয়তা কারও ঈর্ষার কারণ হয়ে থাকবে। ছাত্রদের মধ্যে যে দুজন ঘটনাটির হোতা মুসা এবং হাকিম, তারা আর যা-ই হোক ছাত্র অথাব মানুষ হিসেবে আদৌ আদর্শস্থানীয় তো নয়ই, বরং নানান অসৎ কাজের ভাণ্ড। আমরা ছোটরা নিছক সাময়িক হুল্লোড়ের লোভে দলে ভিড়েছিলাম ফলাফলের কথা চিন্তা না করেই। মুসা এবং হাকিমকে সম্ভবত কেউ উসকে দিয়ে থাকবে এবং সে স্কুলেরই কেউ। পরে বুঝেছিলাম ঘটনাটা সেরকমই ষড়যন্ত্রমূলক।
যা হোক, এ অবস্থায় একদিন মৌলবি স্যার আমাদের বললেন যে, আমরা যেন সবাই অশ্বিনীবাবুর পা ধরে ক্ষমা চেয়ে স্কুলে নিয়ে আসি। মৌলবি স্যার মানুষটি খুবই সজ্জন ছিলেন। স্যারকে খুব শ্রদ্ধাও করতেন। তিনিও স্যারের প্রতি এরকম আচরণে মর্মাহত হয়েছিলেন। আমরা তাঁর কথামতো হেডস্যারের কাছে গিয়ে আমাদের সিদ্ধান্ত জানালে তিনি বললেন, পালের গোদা হাকিম আর মুসাকেও নিয়ে যেয়ো। স্যার কিন্তু জানেন, এ কাজ কে করেছে। তারাও যেন স্যারের পায়ে পড়ে ক্ষমা চায়।
কিন্তু মুসা আর হাকিম জানাল যে, তারা সঙ্গে যেতে পারে কিন্তু পায়-টায় ধরতে পারবে না। ওসব ইসলামে বারণ। তারা বে-ইসলামি কাজ করতে পারবে না। যা হোক, আমরা দলবেঁধে স্যারের কাছে গিয়ে তাঁর পায়ের ওপরে গড়াগড়ি দিতে লাগলাম। হাকিম আর মুসা ছাড়াও অন্য অনেক মুসলমান ছাত্র আমাদের সঙ্গে ছিল। তারাও আমাদের পন্থাই অনুসরণ করছিল। কিন্তু স্যারের ওই এক কথা—আর না। আমি আর পড়াব না। আমরা যতই তাঁর পায়ে পড়ি, তিনি ততই তাড়ান। হাকিম আর মুসা কোনো কথা বলছে না। সে এক বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা। এমন সময় দেখি আমাদের ‘হুজুর’ অর্থাৎ মৌলবি স্যার আসছেন। তাঁকে আসতে দেখে হাকিম আর মুসা একটু ঘাবড়ে যায়। মৌলবি স্যার মানুষটি বড় ধর্মপ্রাণ। তিনি এলে আমরা তাঁকে আদাব আরজ এবং প্রণাম করে হাকিম আর মুসাকে প্রায় দায়রায় সোপর্দ করি। কিন্তু তারা মৌলবি স্যারকে দেখে প্রথমে ঘাবড়ে গেলেও তাদের গোঁ বহাল রাখে। হুজুরকে তারা প্রশ্ন করে যে, মুসলমান একমাত্র আল্লাহকে ছাড়া কাউকে ‘সেজদা’ করতে পারে কি না। হুজুর বললেন, তা পারে না। কিন্তু তোমরা মুসলমানশাস্ত্রের কতটুকু মানো বা জানো, সেটা বলো তো শুনি। তোমরা কি জানো ওস্তাদ অর্থাৎ গুরুর আর্জি আল্লাহর দরবারে তত্নগদ কবুল হয়? তিনি ওস্তাদের ইজ্জতের কথাটাই আগে বিচার করেন। সে জন্য জিজ্ঞাসা করি, তোমরা দুজনে কি এই মান্যমানের সঙ্গে বে-ইসলামি কিছু আচরণ করেছ? সত্য কথা বলবে। এখন হাকিম আর মুসার বাগ্যন্ত্র কাজ করে না। তারা যে কর্মকাণ্ডটির নেতৃত্বে ছিল, তা বে-ইসলামি কি না তাদের জানা নেই। মৌলবি স্যার তাদের সংকট বুঝতে পারেন। উত্তরের অপেক্ষা না করে বলেন, তোমরা ওই কবিতাটি পড়েছ? ওই যে—
বাদশা আলমগীর
কুমারে তাঁহার পড়াইত এক
মৌলবি দিল্লির
তো বাদশা আলমগীর নাকি একদিন দেখেন যে, তাঁর আওলাদ মৌলবি সাহেবের পায়ে পানি ঢেলে দিচ্ছে আর তিনি নিজেই তাঁর পা প্রক্ষালন করছেন। দৃশ্যটি দেখে তাঁর তাজ্জব মালুম হলো। তিনি মৌলবি সাহেবকে ডেকে পাঠালেন এত্তেলা পেয়ে তো মৌলবি সাহেবের অবস্থা বেসামাল। তিনি ধরেই নিলেন যে, তাঁর গর্দান যাবে, শাহজাদা তাঁর পায়ে পানি দিচ্ছে এবং স্বয়ং বাদশাহ তা দেখে ফেলেছেন। হায় আল্লাহ! কিন্তু বাদশাহ বললেন অন্য কথা। তিনি বললেন, এ কেমন কথা যে ওস্তাদ হয়ে আপনি নিজের পা নিজের হাতে প্রক্ষালন করছেন? শাহজাদা কেন তার হাতে এই কাজটি নিজে করবে না? এ তো আপনি তাকে ভুল শিক্ষা দিচ্ছেন। ওস্তাদকে খুশি রাখা তো ফরজ। তো এই হলো আসল কথা। তোমরা এখন নিজেরা বুঝে দেখো তোমাদের ওস্তাদকে কীভাবে তোমরা খুশি করবে।
মৌলবি স্যারের গল্প এবং সিদ্ধান্ত শুনে হাকিম আর মুসার অবস্থা তখন সসেমিরা। মানিক ফিসফিস করে মুসার কানে কানে বলে, পড় না, পড়ে যা না পায়ের ওপর। পরে না হয় আল্লাহর কাছে মাফ চেয়ে নিবি। বিজয় আমাদের মধ্যে বেশ খানিকটা হৃষ্টপুষ্ট বিধায়, হিড়হিড় করে দুজনকে টেনে এনে স্যারের সামনে ফেলে দেয়। বলে, যা করার কর, নইলে দুজনের মাথায় মাথা ঠুকে চালতা বানিয়ে দেব।
তখন আর উপায় নেই দেখে তারা গুটি গুটি পায়ে স্যারের দিকে এগোতে থাকলে স্যার বলেন, তোমাদের আমি এমনিই ক্ষমা করলাম, পায়ে হাত দেবে না। ইসলামে বারণ আছে। তা ছাড়া আমিও ব্যাপারটা পছন্দ করি না। তবে যদি জিজ্ঞাসা করো, এদের প্রণাম নিই কেন? তো বলব, এটাও একটা পরম্পরাগত শিষ্টাচার। ইংরেজিতে বলে Anthropomorphism অর্থাৎ মানুষের প্রতি দেবত্ব আরোপ। যেমন পিরের দরগায় কবরের ওপর লালশালু বিছিয়ে ধূপ দীপ জ্বেলে খাদেমদের বসে থাকা। সে অনেক কথা। ইসলামে সিজদা একমাত্র আল্লাহকেই করা যায় এমতো বিধি। কথাটা কিন্তু সেজদা নয়, সিজদা। তবে গুরুজনদের হাঁটুতে হাত ছুঁইয়ে আবার নিজের বুকে ঠেকানোর একটা ব্যাপার আছে ইসলামি সমাজে। সেটা কদমবুসি নয়, তসলিম বলা যেতে পারে।
এই হলেন অশ্বিনীবাবু, আমাদের স্যার। শেখাবার কোনো সুযোগ ঘটলে সামান্যতম কার্পণ্য করেন না। ছাত্ররা তা গ্রহণ করতে পারুক কি না-পারুক। স্যারের এরূপ ভাবান্তর ঘটলে মৌলবি স্যার যারপরনাই আহ্লাদিত হলেন। আমরাও। হুজুর বলেন, আপনি যা ব্যাখ্যা করলেন তা অতি ন্যায্য এবং হক কথা। আপনি মুরুব্বি মহাজন মানুষ। কিন্তু ‘পোলাপান অসাইদ্য বেয়াদপ’। তবু আমার আরজি, আপনি ওদের দোয়া করেন। চলেন। স্কুলে যাই। সবাই আপনার জন্য বসে আছেন।
এরপর স্যার আর কোনো আপত্তি করেন না। আমরা প্রায় মিছিল করে স্যারকে নিয়ে স্কুলে আসি। স্কুলের মাঠে পৌঁছেই তাঁকে ঘিরে আমাদের উদোম নৃত্য। সে এক দেখার মতো অবস্থা। বাজারগামী বা পথচারী লোকেরা এসে মাঠে ভিড় করে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখে। বিজয় স্যারকে কাঁধে নিয়ে টিচার্সরুমে নির্দিষ্ট চেয়ারটিতে বসিয়ে খাঁটি চান্দ্রদ্বীপি ভাষায় বলে, আমরা পোলাপান। পোলাপানেরা অসাইদ্য বেয়াদপ অয়, জানেন না? আর পোলাপানের উপার রাগ করলে ভগবান পাপ দে। তয়, আর যদি কোনো দিন বেয়াদবি করি তো মা কালীর কিরা, আল্লার কিরা, মোগো মাথায় যেন ঠাণ্ডা পড়ে। স্যার বলেন, ধুর ছাই, ও কথা বলে না। তোরা শুধু একটু পড়াশোনা করে মানুষ হ, আমি দেখে সুখ পাই।
কিন্তু এখানেই শেষ নয়। কিছুদিন যেতে না যেতেই আমাদের আবার পাখা গজাল। সব শপথের কথা সবাই ভুলে গেলাম। স্যারের বাড়িতে নৈশআড্ডা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। এক বয়সি অনেকগুলো ছোকরা একসঙ্গে থাকলে যা হয় আর কি। রাত একটু হলেই স্যার যখন ‘টোঙ্গের’ ঘরে উঠে যেতেন, আমাদের মোচ্ছব শুরু হয়ে যেত। অন্য যেসব ছেলে স্যারের বাড়িতে রাতে থাকত, তাদের কারও অবস্থাই আমার মতো করুণ ছিল না। তাদের মধ্যে কেউ কেউ বছরের পর বছর ফেল করেও নির্বিকার চিত্তে পরীক্ষা দিয়েই যেত। পরীক্ষাজনিত কোনো দুশ্চিন্তা তাদের পীড়িত কখনোই করত না। তারা অনেকেই বিড়ি-সিগারেট ধরেছিল, গঞ্জের শহরে রাতবিরেতে কমলা টকিজে সিনেমা দেখে আসত। এমনকি এক-আধজন প্রেম-প্রেম বিষয়েও অভিজ্ঞ হয়েছিল তখনই। আমি তখনও ওসব বিষয়ে খুবই খাজা ছিলাম। তখনও সিনেমা ব্যাপারটা কী ধারণা ছিল না। বিড়ি-তামাক, বাড়িতে যখন চাকর-বাকরদের রাজত্ব ছিল, দু-এক টান যে হয়নি এমন নয়। পরেও বাবার প্যাকেট থেকে চুরিচামারি করে এক-আধটা সিগারেট টেনেছি কিন্তু গুছিয়ে উচ্ছৃঙ্খল আড্ডা মারার সুযোগ কখনো পাইনি। তাই স্যারের বাড়িতে এই আড্ডায় খুবই মজে গেলাম। অভিজ্ঞ সাথিরা যখন সিনেমার রসাল গল্প, নানান গ্রামীণ কেচ্ছা-কেলেঙ্কারির খবর রসিয়ে বলত, মজা পেতাম খুব। এর সঙ্গে চলত ধূমপান—অবশ্যই বিড়ি। মাঝে মাঝে সিনেমার গান, তৎসহ টেবিলের ওপর তাল বাজানো অথবা সদ্য শেষ হওয়া কোনো যাত্রাপালার গান, সংলাপ–অর্থাৎ হুল্লোড়বাজির রাম-ক্যাওড়া। পরীক্ষা, পড়াশোনা তখন শিকেয়। শুধু স্যার যতক্ষণ নিচের তলায়, ততক্ষণই যা মোহমুদ্গার আওড়ানো।
এরপর আমাদের নৈতিক চরিত্রের মান এত উন্নত হলো যে, শত্রুরা দেখলে ঈর্ষায় তাদের বুক ফেটে যেত। এরকম উন্নতি ওই অজপাড়াগাঁ অঞ্চলে বড় একটা নজরে আসে না। স্যারের বাড়িতে যে কটি সুবোধ, সুশীল পোলাপান ছিলাম, তারা বেশ চমৎকার একটি আলবেরাদরিতে দীক্ষিত হলাম এবং ধাপে ধাপে আমাদের উন্নতি ঘটতে লাগল। টেস্ট পরীক্ষার তখনও মাস ছয়েক বাকি। আমরা নির্ভয়। কমলা টকিজে নাইট শো দেখে ভোররাত্রে ফিরে আসছি। ইভনিং শো দেখতে গেলে বিকেল-বিকেল বেরোতে হয়, স্যারের কাছে ধরা পড়ে যাওয়ার বিপদ আছে, তাই নাইট শো। সে এক অসামান্য কষ্টসহিষ্ণুতার ইতিহাস। তিন মাইল হেঁটে যাওয়া এবং শো শেষে মাঝরাত্তিরে তিন মাইল হেঁটে ফিরে আসা। শীতের রাত হলে ব্যাপারটা কীরকম দাঁড়ায় সহজেই অনুমেয়।
তখনও কিলোমিটার বা নয়া পয়সা চালু হয়নি। দূরত্ব বোঝাতে মাইল বা ক্রোশ এবং এক টাকা বলতে ষোলো আনা, চার পয়সায় এক আনা। সুপারির ব্যবসা আমাদের ওখানে বরাবরই ব্যাপক। বেচাকেনার হিসেব, এগারোটা সুপারিতে এক ‘গা’, তার বাইশ ‘গায় এক কুড়ি, একশ ‘গা’য় একশ, অর্থাৎ একশ সুপারি বলতে ১০০ × ১১ = ১১০০ বুঝতে হবে। সেই বাইশা কুড়ির এক কুড়ি সুপারি বাজার-হাটে বেচলে পাওয়া যেত এক টাকা। এরকম দু-তিন কুড়ির ইন্তেজাম হলে ‘বাইসকোপ’ দেখা, গঞ্জের বিখ্যাত বাঘা রাজভোগ জনপ্রতি গোটা চারেক করে সেসব দিনে কিছু ব্যাপার ছিল না। সর্বশেষ একটা করে ‘কাইচি’ সিগ্রেট। সুপারির অভাব আলবেরাদরদের কখনোই ভোগ করতে হয়নি, স্যারের বিস্তীর্ণ বাগান আছে এবং আমরা ছাড়া তাঁর বিশেষ কোনো হকদার বা ওয়ারিশ নেই। একটা ঘরে শুকনো করে রাখা এন্তের সুপারি বিক্রির অপেক্ষায়—মানে এন্তের পয়সা।
জীবন তখন মধুময়, রহস্যময়ও। কণ্ঠে সবসময় গান—”তুমি যে আমার, ওগো তুমি যে আমার’। অবশ্য যখন সুপারি অর্থাৎ পয়সা রমরম তখন। অঘটনে ‘ভালোবাসা মোরে ভিখারি করেছে, তোমারে করেছে রানি’। কিন্তু আলবেরাদরদের সবাই যে একসঙ্গেই এই মহৎ সুখ উপভোগ করতে পারতাম, তা নয়। স্যারকে ধোকা দেবার ব্যবস্থাটিও বেশ বিচক্ষণতার সঙ্গে তৈরি করা হয়েছিল। আমাদের সঙ্গে একটি ছেলে ছিল, রাজ্জাক। তার মুখ দেখলে কোনো সন্দেহ-পিচেশ মাস্টারমশাইও বলতে পারবেন না যে, এই ফেরেশতার মতো নবীন বালক এমন অসততার ভাণ্ড। সে ছিল এক কাহার-সন্তান। পৈতৃক পেশা পুরুষানুক্রমে লাঠি, সড়কিবাজি। কাহার অর্থে আমাদের ওখানে পালকি-বেহারা নয়, লাঠিয়াল। জমিদারি তালুকদারি আমলে চাকরানসূত্রে জমি ভোগকারি এবং মালিকের প্রয়োজনে লাঠিবাজি। সে যা হোক, শান্ত-নম্র সুন্দর স্বভাব এবং পড়াশোনায় আগ্রহ ইত্যাদি দেখে স্যার বলতেন, তুই তো দেখছি দৈত্যকুলে প্ৰহ্লাদ। স্যার বড় আহ্লাদে এসব বলতেন। সেই রাজ্জাকই ব্যবস্থা করে দিয়েছিল, যাতে আলবেরাদরির সবাই সুখ ভোগের সমান সুযোগ পায়। সে তিনটি দলে আলবেরাদরিকে ভাগ করে কোন দল কবে গঞ্জে যাবে তার একটি নির্ঘণ্ট তৈরি করে দেয়। যাতে স্যার ওপর থেকে বুঝতে না পারেন নিচে কে আছে, কে নেই। ওপরে একবার উঠলে রাতে তিনি আদৌ নিচে নামতেন না। বুড়ো মানুষ। বাঁশের মই বেয়ে, কুপি হাতে ওঠানামা করা কষ্টকর।
স্যারের রাজ্জাক, মানিক এবং আমার ওপর বিলক্ষণ অন্ধ বিশ্বাস ছিল, বিশেষ করে আমার ওপর। কারণ ওই গুরুগৃহে আমি সর্বক্ষণের আরুণী। আমার বিষয়ে স্যারের ধারণা আমি তখনও পর্যন্ত ইন্টেলেকুয়ালি ‘গাবলা’ যাইনি। ‘গাবলা’ যাওয়া অর্থে মিসক্যারেজ। অন্য সবগুলো ‘অসইব্যের গাছ’, ওদের কিছু হওয়ার নয়। কিন্তু আমি যে তখন মোটামুটি গাবলা যাওয়ার পথে, এ সংবাদ তাঁর কাছে ছিল না। আমি যে আলবেরাদরির একজন সক্রিয় সদস্য, তার বিন্দু-বিসর্গও মহাশয় জানতে পারেননি। তাঁর ধারণা ছিল অন্য সবাই গোল্লায় যেতে পারে, আমি পারি না। এখানে তাঁর মস্ত ভুল হয়েছিল। স্যার তাঁর মাতৃদায়কালেও নাকি কাচা কোচা, লোহার চাবি সমেত খালি পায়ে কলকাতার রাস্তায় হেঁটে গিয়েও তাঁর ভার্সিটির পরীক্ষার নির্ধারিত কক্ষে পৌঁছে পরীক্ষা দিতে ত্রুটি করেননি। তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টা তাঁকে অভীষ্ট স্তরে পৌঁছে দিয়েছিল। অনুরূপ অবস্থার একজন এতিম প্রায় কিশোর কীভাবে যে ঈদৃশ ইলুতেপনায় যেতে পারে, তা তাঁর হিসেবে ছিল না।
তবে কিনা চোরের দশ দিন আর গেরস্তের এক দিন। ধরা তো পড়তেই হবে। সেদিন বোধহয় আমরা অতিমাত্রায় স্বাধিকার-প্রমত্ত হয়েছিলাম। রাজ্জাক আর বেলায়েত বলে একটি ছেলে–সেদিন একটু দেরিতে গুরুগৃহে এসেছিল। তারা এমনই একটা সময়ে এসে পৌঁছল যে, সেদিন আর কারও পক্ষেই গঞ্জে যাবার সময় ছিল না। ততক্ষণে স্যার ওপরে উঠে গেছেন। তারা দুহাঁড়ি খেজুরের রস কোত্থেকে, অবশ্যই চুরি করে নিয়ে এসেছে। বলল, আজ আমরা সিন্নি খাব। এই সিন্নি বস্তুটি হলো খেজুরের রসে নারকোল কোরা বা নাকোলের দুধ এবং চাল সহযোগে তৈরি এক ধরনের পায়েস বা মিষ্টান্ন। এ বস্তুটি অতি বাল্যকাল থেকেই আমাদের খুব প্রিয়। শীতের মরসুমে শিউলিদের রস চুরি করে আমরা হামেশা এই অমৃতভোজ্যটির সদ্ব্যবহার করতাম। অপহরণজনিত অপরাধে পরদিন ভোরবেলার শিউলিকৃত খামার অর্থাৎ গালাগালি ফাউ হিসেবে মিলত। সে খামারের তরিকাই আলাদা।
তো সেদিনকার মোচ্ছব হিসেবে সিন্নি ধার্য হলো। একদিকে সিন্নি পাক হচ্ছে এবং তার মদির গন্ধ চারদিক আমোদিত করছে। অন্যদিকে আমরা বদের ভট্টাচার্যিরা স্থান, কাল, পাত্র ভুলে গিয়ে সিনেমার গান ধরেছি, সঙ্গে টেবিলের তবলা। কমলা টকিজে তখন দারুণ হিট ‘বই’ চলছে ‘শাপমোচন’। আমাদের গান গর্জিত হচ্ছে—
‘সুরের আকাশে তুমি যে গো শুকতারা’। অতগুলো বিচিত্র কণ্ঠে তার যা প্রকাশরূপ ফুটে উঠেছিল, তাতে ‘গানটি গর্জিত হচ্ছে’ বলা ছাড়া অন্য শব্দ আমার জানা নেই। আর এই শব্দটাই যে সঠিকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে, মুহূর্তকালের মধ্যেই তার প্রমাণ পাওয়া গেল। টোঙ্গের ওপর থেকে স্যারের ফোকলা হুংকার এবং ছরছর করে তাঁর ভূতলে অবতরণ। মহাশয় ক্রোধাতিশয্যে দ্রুততাবশত যে মইয়ের সব কটা সিঁড়ি ব্যবহার করেননি, এ কথা একভরি সত্য। সামনে পড়ে প্রথমেই কেষ্টা অর্থাৎ বিজয় খেল একখানা চাপড়। মানিকটা ছিটকে ডিউজ বলের মতো বেরিয়ে গেল। আমি রান্নাঘরে সিন্নির তরিবত করছিলাম বলে ঝড়ের মুখে পড়িনি। অন্য যারা পালাতে পারেনি তাদের দুর্গতি দেখিনি, তবে প্রত্যেকেই দু-চারখানা চড়চাপড় খেয়েছে একমাত্র রাজ্জাক ছাড়া। সে কখন যেন তার ইসলামিক ইতিহাসের বইখানা খুলে, হ্যারিকেনটি উসকে দুলে দুলে পড়তে শুরু করে দিয়েছিল।
‘রসুলে করীম (দঃ)-এর নেতৃত্বে নেতৃত্বে আল্লাহ তায়লার কুদরতে অ্যা কুদরতে বদরের বদরের যুদ্ধে, অ্যাঁ বদরের যুদ্ধে মুসলমানগণ বিজয়ী হইলে বাক্য শেষ হওয়ার আগেই বাঘ সামনে। বদরের যুদ্ধে আর যারই হোক, রাজ্জাকের জয় হলো না। মার খেল না বটে, তবে স্যার তার কানটি ধরে—পড়া দেখাচ্ছ? অ্যা পড়া?—বেরো, বেরো এ বাড়ির থেকে—কতকগুলো কুষ্মাণ্ড—যাঃ—বলে একেবারে দরজার বাইরে বার করে দিলেন। অবস্থা বেগতিক দেখে সিন্নির হাঁড়ি নামিয়ে উনুনে জল ঢেলে আমিও চম্পট। অপরিসীম গুরুবল, আমি রান্নাঘরে থাকায় স্যারের নজরে পড়িনি।
বাইরে এসে দেখি মূর্তিমানেরা সব অন্ধকারে শীতের মধ্যে পুকুরধারে বসে কুঁই কুঁই করছে। অতঃপরের সংলাপ চান্দ্রদ্বীপি কথনে না বললে ন্যাড়া-ন্যাড়া লাগবে, তাই সেই ভাষায়ই বলি। রাজ্জাক বলে, মুইতো বিনাদোষে খেদানি খাইলাম। এহন কাইল যদি আবার বাজানের ধারে কয়েন তো মোর অইয়া গেল। বেলায়েত বলে, ক্যা? সিন্নি খাবা না? রসের সিন্নি? কাইল বেনইয়া কালে রসওলাগো খামারডাই খালি খাবা? এ কথায় সবার পেটের মধ্যে খিদে যেন হঠাৎ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে আহা রে, আমাদের সাধের সিন্নি, সে বোধহয় ‘আফুডাই’ গেল। কেষ্টা অর্থাৎ বিজয় বরাবরই বাস্তববুদ্ধির ছেলে। সে বলে, আরে, হাড়িডা লইয়া আয় না কেউ পাকঘর থিকা। কপালে যা আছে তো অইবেই সিন্নিডা হুদাহুদি নষ্ট হয় কেন? তার লগে এট্টা গেলাসও আনিস। গেলাসে অবশ্য সিন্নি খাওয়ার নিয়ম নয়, কিন্তু পাত্রাভাব। অতএব ঘুরিয়ে ফিরিয়ে গ্লাসে করে খাওয়া। হাঁড়িতে ডুবাও, খাও। সিন্নিটা নামিয়ে রেখে বুদ্ধিমানের কাজই করেছিলাম। যেটুকু সিদ্ধ হওয়া বাকি ছিল, হাঁড়ির গরমে ততক্ষণে তা দিব্য তৈরি হয়েছে এবং ঠাণ্ডা আর ঘন হয়ে জিনিসটা বেশ সুস্বাদুও হয়েছে।
হাঁড়ি শেষ হতে সময় লাগে না বিশেষ কিন্তু তারপর? স্যার যে দরজার কাছেই বসে আছেন, তা বুঝতে পারছিলাম সবাই। কারওই সাহস হচ্ছিল না গিয়ে ক্ষমা-টমা চাইবার। বস্তুত এরকম ক্রুদ্ধ হতে তাঁকে বিশেষ দেখিনি আমরা। সবাই এবার আমায় পাকড়াল, তুই যা, যাইয়া বেয়াকের অইয়া ক্ষমা চা–তোরে কিছু কইবে না। বিজয় বলল, সেই ভালো, তুই গেলেই নিরাপদ। তুই তো প্রায় তাঁর পোষ্যপুত্র। কিন্তু আমার সংকট যে আরও গভীরে, সেটা ওরা বুঝছে না। আমি তো জানি আমাকে তিনি কতখানি স্নেহ করেন। আমার এহেন পরিণতিতে তিনি যে কতখানি দুঃখিত এবং ব্যথিত হবেন, সে কথা এরা কেউ বুঝবে না। এইসব ভেবে আমার খুব আত্মগ্লানি হলো। কী অবস্থা থেকে আমাকে স্যার কোথায় তুলছিলেন, আর আমি কী করে চলেছি। কিন্তু সেসব তো আছেই, এখন কাছে যাই কী করে? বললাম, ভাই দেখ, আমরা বেশ কিছুদিন ধরে যা খুশি তাই করে যাচ্ছিলাম। স্যার কিছু বলেননি। আমাদের ওপর তার নিশ্চয়ই একটা বিশ্বাস ছিল যে, পরীক্ষা এগিয়ে এলে আমরা নিশ্চয়ই হুঁশিয়ার হব। কিন্তু আজ তাঁর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে। তিনি প্রকৃতই রেগে গেছেন আজ। এ অবস্থায় আমাদের সবারই একসঙ্গে গিয়ে তাঁর কছে ক্ষমা চাওয়া উচিত।
সবাই আমার কথার যাথার্থ্য স্বীকার করলেও পালের গোদারা কেউই এগিয়ে এলো না। নৈশবিদ্যার্থীদের মধ্যে একজন ছিল ওখানকার এক অতি সম্ভ্রান্ত ব্ৰাহ্মণ পরিবারের সন্তান। কিন্তু বার কয়েক চেষ্টা করেও সে ম্যাট্রিকের চৌকাঠ পেরোতে পারেনি। বয়সে আমাদের অনেকেরই কাকার বয়সি। সে সকাতরে আমায় বললে, ভাইডি আর যে যাউক আমি কিন্তু যাইতে পারমু না। এই নিয়া আমার চাইরবার। তার থিকাও বড় কথা—আমার চরিত্তিরডাও ভালো না, এ কথা স্যারে জানে। এহন হেইসব লইয়া তোগো সামনে যদি দুকথা কয়, তোরা পোলাপান মানুষ, বোজোই তো।
‘—’ দা আমাদের ক্লাসে সবচেয়ে বয়স্ক সহপাঠী। যৌবনিক চাপল্য এবং প্রদাহে সে ইতোমধ্যেই এ অঞ্চলে বেশ নাম করে ফেলেছে। এমনকি ওই সময়কার সামাজিক মাৎস্যন্যায়ের সামূহিক সুযোগগুলোও সে নির্বিচারে ব্যবহার করছে। একটি বনেদি ভূস্বামী পরিবারের অসামান্যা রূপবতী একটি কন্যাকে যে সে প্রায়শই নিভৃতে পায়, এ কথা বহুবারই সে আমাদের বলেছে। তা ছাড়া সেই সুন্দরীর ভাইয়ের সঙ্গে সে যে গঞ্জের বিশেষ গলিতে যাতায়াত করে, তা-ও কারও অজানা নেই। অতএব তার এখনকার আশঙ্কা অমূলক নয়। তার মতো আরও দু-একজন আমাদের মধ্যে আছে—কিছু কমবেশি খ্যাতির অধিকারী। তা এরকম এক পশ্চাৎপট কাঁধে নিয়ে এখন আমরা স্যারের সামনে কীভাবে যাব, সেই সমস্যার সমাধান কিছুতেই করতে পারছি না। ব্রাহ্মণকুমার যাবে না, বিজয় দুই চাপড় খেয়েছে, তার যাওয়ার সাহস নেই, রাজ্জাককে স্যার কান ধরে বার করে দিয়েছেন, মানিক আমাকে ছাড়া এক পা নড়বে না ধনুর্ভঙ্গ পণ করে বসে আছে-বাকিদের তো কথাই নেই। তাই বাধ্য হয়ে নিজের ঘাড়েই দায়িত্ব নিয়ে এক পা, দুপা করে ঘরের দিকে এগোই। পায়ের শব্দ শুনে ঘর থেকে হুংকার—কে? বলি— আমি স্যার। পরবর্তী নির্দেশ—শুধু তুমি আসবে, আর কেউ না। অর্থাৎ আমার রান্নাঘরে থাকাটা নজর এড়িয়ে গেছে। ঘরে ঢুকতে জিজ্ঞেস করেন, তুই ছিলি কোথায়? জলসায় তো দেখলাম না। হরিহরি! জান বাঁচানোর এ মওকা ছাড়ে কোন ‘পাড়ায়’? অবলীলাক্রমে মিথ্যে বলি, আমি তো পায়খানায় গিয়েছিলাম। হঠাৎ গণ্ডগোল শুনে বেরিয়ে দেখি সব পুকুরপারে। তা আপনি এত রাত্রে নিচে এলেন কেন? শরীর ঠিক আছে তো? এ সব কথা যতটা করুণ এবং মিহি করে বলা যায় তার কসরত চলল। পায়খানায় যাওয়ার কথায় স্যার একটু ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। জিজ্ঞেস করলেন, এত রাত্রে পায়খানায় গেলি, পেট খারাপ হয়নি তো? অসময় বলি, না তেমন কিছু না, ওই একটু আমাশা মতন—মানে শাকটা সকালে একটু বেশি খেয়ে ফেলেছিলাম।—পুরো নিশ্চিন্ত করানো নেই। বুঝতেই পারছি বুড়ো এখন আমার শরীর বিষয়ে চিন্তিত এবং সে কারণে রাগের পারদ নামছে। প্ৰথমে তাঁর আস্থাটা পুরোপুরি অর্জন করা জরুরি। জানতে চাই, হঠাৎ মনে হলো আপনার গলা শুনলাম, কাকে যেন বকছেন। তা সবাই পুকুরপারে কেন?
: খেদিয়ে দিয়েছি।
: সে কী? কেন? ওরা কী করেছে?
না, একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। কী হয়েছিল তা পায়খানায় গেলেও না শোনার মতো নয়। তাই সেটা ঢাকা দেয়ার জন্য তাড়াতাড়ি বলি, মনে হচ্ছিল কে যেন গান গাইছিল। তারপর আপনার বকাবকি।
: তা হলে তো শুনেছই। এ কি মানুষে সহ্য করতে পারে? কতগুলো গরু। সবকটা ফেল করবে, এ আমি লিখে দিতে পারি। বলে দে কাল থেকে কেউ যেন এখানে আর না আসে। আমি পড়াতে পারব না। তার মানে আমি ছাড়া আর সবাই। যাকগে, ভাবলাম, আগে নিজের খুঁটাটা তো পোক্ত করি, তারপর ওদের ব্যবস্থা করা যাবে। বলি, ঠিক আছে। মনে হচ্ছে আপনার খুব রাগ হয়েছে। আর এরাও—সত্যি এত হুল্লোড়পনা কি ভালো? সে যাক, অনেক রাত হয়েছে, আপনি এবার উঠুন তো, আগে আমি ওপরে দিয়ে আসি, নইলে শরীর খারাপ হবে। চলুন। বলে হাত ধরে আস্তে আস্তে মইয়ের কাছে গিয়ে বললাম—
: আপনি যে অন্ধকারে মই বেয়ে নেমে এলেন, যদি পড়ে যেতেন? কী সর্বনাশ হতো বলুন তো?
: পড়েই তো গিয়েছি। বাঁ পাটায় বেশ লেগেওছে।
সাত তাড়াতাড়ি কুপি ধরে পাটা দেখলাম। জিজ্ঞেস করলাম, মচকায়নি তো? একটু চুন-হলুদ গরম করে দেব?
: না, তার দরকার হবে না। তুই আলোটা ধর, আমি উঠি। আর ওদের বলে দিস যা বললাম।
: ঠিক আছে, সে আমি কাল দেখব’খন। আপনি উত্তেজিত হবেন না। আপনি অসুস্থ হলে আমি বিপদে পড়ব। বুড়ো ওপরে উঠে যেতেই এক লাফে পুকুরধারে গিয়ে খুব চেঁচিয়ে বলতে লাগলাম, যাতে স্যার ওপর থেকে শুনতে পান, তোরা পেয়েছিস কী, অ্যাঁ? স্যার পড়ে গিয়ে পা মচকে একসা কাণ্ড করেছেন। তোরা তো সকালে উঠে যে যার বাড়ি চলে যাবি। স্যারকে নিয়ে আমি কী করব তখন? তখন সমস্বরে সবাই—সত্যই মচকাইছে না ভাঙছে? এঃ এহন উপায়? এইসব জোরে জোরে বলতে থাকে। আমি আস্তে করে জানাই, ন্যাকামি আর কোরো না। বুড়ো চটেছে বেজায়। যা হোক করে ওপরে তুলে দিয়ে এসেছি। মিথ্যে কথা যা বলেছি তাতে সাত পুরুষের নরক, দোজখ, জাহান্নাম সবকয়টাই একসঙ্গে হবে। এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। এবার চলো তো বাছারা চুঁ শব্দটি না করে গিয়ে গুটি গুটি শুয়ে পড়ো। হ্যাঁ, কাল থেকে তোমাদের সবার আসা বারণ। শুধু আমি থাকব আর স্যার—আর কেউ না। সবাই অবশ্য জানত, এটা ফাঁকা আওয়াজ। সকালে স্যার সব ভুলে যাবেন।