বিষাদবৃক্ষ – ২৮

আটাশ

সামাজিক অবস্থা যখন এরকম এক ইলুতে ধরনের রাস্তা ধরল, তখন আমি একনাগাড়ে আট-আটটি মাস মাস্টারমশাইয়ের বাড়িতে কাটালাম। এই সময় থেকেই পিছারার খালের জগতের সঙ্গে শারীরিক ও সামাজিক যোগাযোগ পুরোপুরি পরিত্যাগ করি। মাঝে বার তিনেক মাত্র বাড়ি গিয়েছি। বাবার সঙ্গে স্কুলে দেখা হয়। অন্যদের সঙ্গে হয় না। অথচ মনের সামান্যতম আনন্দটুকু বজায় রাখতে হলেও পারিবারিক যোগাযোগটুকু প্রয়োজন। সামাজিক যোগাযোগের তো আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। এখন যেন পারিবারিক সংযোগটুকুও ছিন্ন হয়ে শুধু ব্যক্তিক অস্তিত্বের ধারাটুকু মাত্র ধরে আছি। এখানে সমবয়সি সহপাঠীরা আছে। তাদের সঙ্গে খেলাধুলা, পড়াশোনা, গল্পগুজব সবই করছি। কিন্তু পিছারার খালের বাঁধনটুকুর ছোঁয়া আর পাচ্ছি না।

স্যারের বাড়িতে প্রথম প্রথম খুবই ভালো লাগছিল। লেখাপড়া, সেখানকার অন্যান্য ছাত্রদের সাহচর্য খুবই আকর্ষণীয় বোধ হয়েছিল। কিন্তু ক্রমশ নিজেকে বড় স্বার্থপর মনে হতে লাগল। মা এবং ভাইবোনগুলোর জন্য বড় মনখারাপ করতে লাগল। আমি এখানে দুবেলা পেটপুরে খাচ্ছি-দাচ্ছি। রান্নাবান্না, ঘরদোর পরিষ্কার, গরুবাছুরের দেখভাল ইত্যাদি কাজে পরিশ্রম হলেও বিগত দিনগুলোর তুলনায় তা নিতান্তই সামান্য পরিশ্রম। ওদিকে বাবার মাসকাবারি চল্লিশ টাকায় বাড়িতে যে কী হচ্ছে তা জানতে পারছি না। ছোটন মাঝে মাঝে এসে স্কুলে খবর দেয়—অবস্থা ভালো না। আসলে আমার এবং ছোটনের রোজগার তখন বন্ধ। মাত্র দুবছর আগে দুর্ভিক্ষ গেছে। বাড়িতে আসবাবপত্র কিছুই প্রায় অবশিষ্ট নেই। সবকিছুই বিক্রিবাটা শেষ। মাস্টারমশাইকে সব খুলে বললামও একদিন, আর অনুমতি চাইলাম কয়েক দিন বাড়িতে গিয়ে থাকার। মাস্টারমশাই জানতে চাইলেন, পড়াশোনার কী হবে। আমার নিজের বইপত্তর নেই। অন্য যারা পড়তে আসে তাদের বই পড়ি। বাড়িতে গেলে সে সুযোগ হবে না। কিন্তু অবস্থা এমন যে আমার না গেলেই নয়। আবার এও ভাবছিলাম যে, পড়াশোনার এখানেই ইতি কি না। কারণ বাড়ির আর্থিক অবস্থা সামাল দিতে গেলে ছোটন আর আমাকে আবার আগের দিনগুলোর কাজকর্মতেই ফিরে যেতে হবে। ফাইনাল পরীক্ষার আর বিশেষ দেরি নেই। সব কথা শুনে স্যার খুব গম্ভীর হয়ে গেলেন। বুঝলাম তাঁর রাগ হয়েছে। এসব ঝঞ্ঝাটের কথা তিনি পছন্দ করেন না। তা ছাড়া বাবার ওপর তাঁর ক্রোধ। কী? না—’খাওয়াইতে পারে না, এতগুলা পোলামাইয়া কী দরকার? আবার বিড়ি সিগারেট খাইয়া পয়সা নষ্ট করে।’ সেকালে পরিকল্পিত পরিবার বিষয়ে কোনো সরকারি কার্যক্রম শুরু হয়নি। তখনকার দিনে অধিক সন্তান বিরূপ সমালোচনার বিষয় ছিল না। তাই মাস্টারমশাইয়ের রাগের কারণটি আমি বুঝতে পারলাম না। কিন্তু মাস্টারমশাই গম্ভীর। কোনো কথা বলেন না। গরুবাছুর নিজেই মাঠে নিয়ে যান। আমার হাত থেকে দড়ি কেড়ে নিয়ে হট হট হট করে তাদের মাঠে নিয়ে ঘাস খাওয়ান, চরিয়ে আনেন। রান্নাবান্না আমিই করি, কিন্তু খাওয়ার সময় আমায় ডাকেন না। এর ফাঁকে খেয়ে নিয়ে ‘টোঙ্গের ঘরে’ গিয়ে শুয়ে পড়েন। আমার খুব কষ্ট হতে থাকে।

আমার সংকট একসময় তীব্র হলো। বাড়ির অসহায়তার ব্যাপারটা বাবার ওপর পুরোপুরি ছাড়ার কথা ভাবতে পারছিলাম না। বাবা উদাসীন প্রকৃতির মানুষ। ঘটনার তীব্রতার সময় তাঁর উদাসীনতা আরও বৃদ্ধি পায়, এমন জানি। ঘরে চাল না থাকলে তিনি ‘গুরু যা করেন’ বলে এখনও নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। এটা তাঁর মৌলিক চরিত্র। যদিও মাস্টারি শুরু করার পর থেকে তিনি বেশ কিছুটা দায়িত্বশীল হয়েছেন, তথাপি, ব্যাপক বিপর্যয়ে পূর্বপন্থাই অবলম্বন করে থাকেন। ‘গুরু কৃপাহি কেবলম্।

স্যারের বাড়ি ‘মটকি’ ভরা চাল। পুরনো চাল। বছরের শেষেও তা শূন্য হয় না। নতুন চাল অন্য মটকিতে। আমি যদৃচ্ছ ব্যবহার করছি। পেটপুরে খাচ্ছি। বাড়িতে চালের দীনতা ভয়াবহ। দুর্ভিক্ষের আগে এখানের বাজারে চাল বিকোত পাঁচ টাকা কাঠি। সে চাল এখন পাঁচ থেকে দশ, দশ থেকে পনেরো, এভাবে লাফাতে লাফাতে বাড়ছে। তথাপি দেশে এখন সরকারিভাবে দুর্ভিক্ষ নেই। আমেরিকা চাল জোগাচ্ছে। টাকার মূল্যমান নিম্নগামী, দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বগামী। সাধারণ রোজগারিদের নাভিশ্বাস।

ইত্যবসরে টের পাই দেশের তাবৎ ঐহিত্যময় চাষের, বিশেষ করে ধানের উৎপাদনের ক্ষেত্রে এক দানবিক বিপর্যয় ঘটে গেছে। আবহমানকালের চাষের পদ্ধতির পরিবর্তন হচ্ছে। জাপানি প্রথায় ধানের চাষ হচ্ছে, কোথাও-বা নতুন ধরনের সার প্রয়োগে অভিনব উন্নত চাষপদ্ধতির প্রবর্তন হচ্ছে। কিন্তু বুজে যাওয়া খাল-নদী-জলাশয়ের সংস্কার হচ্ছে না। উন্নত চাষ প্রথার সার্বিক ব্যাপক প্রয়োগের উপরিকাঠামো নেই। ফলে কিছু ক্ষেত্রে উৎপাদন বাড়লেও সার্বিকভাবে বাড়ছে না। মানুষের অভাব, দারিদ্র্য বেড়েই যাচ্ছে। ঐতিহ্যগত ধান যেমন, আউশ, কার্তিকদল আগুণি, বালাম এইসব অপসৃত হয়ে আই আর এইট, ইরি, অমুক তমুক ইত্যাদি কুৎসিত নামের ধানেরা এসে মাঠজুড়ে অধিষ্ঠান করছে। যাদের জমিতে এসব হচ্ছে তারা সব বৃহৎ চাষি। তারা কিছুকাল এই লাভের ফসল তুলল। কিন্তু সামগ্রিক ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ না হওয়ায় ঐতিহ্যের ফসলও নষ্ট হলো, আবার উন্নয়নও মাঝপথে মুখ থুবড়ে পড়ল। রাষ্ট্রনেতারা বা উপযাচক উপকারীরা কেউই আমার কৃষককুলকে আধুনিকতায় পৌঁছে দিতে সক্ষম হলো না। ব্যাপারটা যে এরকমভাবে হয় না, তা আমাদের দেশের কর্তারা বুঝলেন না, তাঁদের বিদেশি প্রভুরা বোঝাতে চাইলেন না।

আমাদের বাড়ির চৌহদ্দিতে যেটুকু ধানিজমি ছিল, তার উপজের কিছু অংশ তখন আমরা পেতাম। তাতে মাস দুয়েকের মতো চালের সংস্থান হতো। জ্যাঠামশাইয়ের সংসারের সদস্যসংখ্যা কম, তাঁদের খুব একটা অসুবিধে ছিল না। কিন্তু আমাদের ভাগের ওই মাস দুয়েকের সংস্থান এবং বাবার চল্লিশ টাকায় মায়ের পক্ষে এতগুলো প্রাণীর আহার-বস্ত্র সংস্থান করা প্রায় অসম্ভব ছিল।

এদিকে মহাবিভ্রাট। মাস্টারমশাই আমাকে কিছুই বলছেন না। আমি তাঁর আদেশ না পেলে বাড়ি যেতে পারছি না, এখানেও পড়াশোনায় মন দিতে পারছি না। মাস্টারমশাই আমার ওপর রাগ করে আমাকেও পড়াচ্ছেন না, অন্যদেরও দেখছেন না। এই সময়টায় তাঁকে আমার বড় নিষ্ঠুর এবং অত্যাচারী বলে মনে হচ্ছিল। সেসব কথা অবশ্য এখন মনে পড়লেও নিজেকে বড় অপরাধী বলে মনে হয়। যিনি আমার জ্ঞানাঞ্জন-শলাকা, সেই মহান পুরুষকে তখন কত অন্যায়ভাবেই না মনে মনে স্বার্থপর, অত্যাচারী এবং নিষ্ঠুর বলেছি। তাঁর মানসিকতাকে বোঝার কোনো চেষ্টাই তো করিনি।

এরকম সময় একদিন তাঁকে আবার ধরলাম। বললাম—আপনে আমার ওপর রাগ করইয়া আছেন। আপনে না আদেশ দিলে তো বাড়ি যাইতে আছি না। আমি কী করমু কয়েন?—মাস্টারমশাই সংক্ষেপে বললেন, আইজ ইস্কুলে তোমার বাবার লগে কথা কমু, তারপর দেহি।—বাবার সঙ্গে আমার বাক্যালাপ কোনোকালেই খুব একটা বেশি হতো না। শিক্ষকতা গ্রহণ করার পর তাঁর যে পরিবর্তনটি ঘটেছিল, তাতে আগের মতো উদাসীন তিনি ছিলেন না বটে, তবে খোঁজখবরও খুব একটা করতেন না। এ জন্য বাড়ির অবস্থার কথা তার সঙ্গে আলোচনা করা কখনোই হতো না। শুধু অনটনের ভার তীব্র হলে মাস্টারমশাইয়ের কাছ থেকে দশ-বিশ টাকা ধার করতে বলতেন। মাস্টারমশাই এ কারণে যারপরনাই বিরক্ত হতেন। বাবার সামনেই তিনি তাঁর সমালোচনা করতেন এবং প্রায় ধমকাতেন। বাবা তাঁকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করতেন এবং তাঁর শিশুসুলভ স্বভাব জানতেন বলে কিছু গায়ে মাখতেন না। বরং নানান ঠাট্টা-ইয়ার্কির কথা বলে তাঁকে আরও চটিয়ে দিতেন। মাস্টারমশাই তখন বাবাকে অন্য মাস্টারমশাইদের সামনে আক্রমণ করে প্রশ্ন করে যেতেন— যেমন, অত সিগারেট খায়েন ক্যান?

—বদ অইভ্যাস, হেয়া ছাড়া অম্বুরি তামুকটা তো এহন আর জোডাইতে পারি না, আর হেয়া সাজানের লইগ্যা চাকরবাকরও নাই, এস্টেট যাওয়ার পর থিকা

—আপনে আসলেই জমিদারের অপদার্থ পোলা। এস্টেটের পয়সা খালি উড়াইছেন, অথচ পোলাপান তো মানুষ করার ব্যবস্থা রাহেন নায়। হারা জীবন খালি বাবুগিরি করছেন।

-কথাডা মিথ্যা না। তয় ব্যবস্থা যদি কিছু রাখতাম হেলে পোলাগুলাও আমার মতোই অপদার্থ হইতে মনে অয়।

–আপনে আমার লগে ফাইজলামো করতে আছেন, না? আমি কৈলাম সিরিয়াস। I strongly despise your whimsical life-style. You must think for your children. Don’t you see that they are suffering?

—হেয়ার লাইগ্যাই তো কই, আপনে সেক্রেটারিরে কইয়া আমার চল্লিশ টাকাডারে একশ চল্লিশ করইয়া দেন। You are the rector. আপনের কথার এট্টা দাম আছে।

—ইস্কুলের হে ক্ষ্যামতা নাই।

—তাইলে আর কী করণ? তয় তো মাঝে মাঝে আপনার দশ-বিশ টাকা ধার দিতেই হইবে।—বলে বাবা তাঁর পকেটে হাত ঢুকিয়ে টাকা নেয়ার ভঙ্গি করতেন। কিন্তু তাঁর পকেট থেকে হয়তো বেরোত একগাছা পাটের দড়ি। বাবা সব মাস্টারমশাইদের সেটি দেখিয়ে বলতেন—দ্যাহেন আপনেরা। স্যারের পকেটে পাওয়া গেছে। দড়ি লইয়া কী করবেন? গলায় দড়ি দেবেন?—আসলে স্কুলে আসার সময় হয়তো একটি গোবৎসকে মুক্ত করে দড়িগাছা পকেটেই রেখেছিলেন, তখন তা ধরা পড়ে রগড়ের কারণ হয়। বাবার প্রশ্নের উত্তরে বলেন,—গলায় দড়ি আমি দিমু ক্যান? হেয়া তো আপনের দেয়া উচিত।—বাবা বলতেন যে তাঁর সেরকম কোনো ইচ্ছে নেই, যদিও কারণ আছে অনেক। তবে মাস্টারমশাইয়ের যেহেতু কোনো জাগতিক ঝঞ্ঝাট নেই, এ ক্ষেত্রে তাঁর সুবিধে অনেক। মরলে কেউ বিধবাও হবে না, কেউ না খেয়েও মরবে না বা কেউ কাঁদবেও না। এইসব রগড় চলত এবং মাস্টারমশাই একসময় রাগ করে বাজারের দিকে চলে যেতেন। বাবা বলতেন, চললেন। এহন বাজার থিকা এক স্যার গুড় কেনবেন আর হারা রাস্তা খাইতে খাইতে বাড়ি যাইয়া আবার পুথি খুলইয়া বইবেন।—কথাটা মিথ্যে ছিল না।

স্কুলে সেদিন বাবার সঙ্গে তাঁর কী কথা হয়েছিল জানি না, স্কুল ছুটি হলে বাবা আমাকে ডেকে বলেছিলেন,—উনি যেমন কইবেন, সেইরকম চলবি। বাড়ির কথা ভাবতে হইবে না। যেমন চলার চলবে। —বাবার এ কথায় আমি বিশেষ ভরসা পেলাম না। তাঁর বাস্তবভাব কোনো কালেই খুব তীক্ষ্ণ নয়। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম—চাউলের দাম যেভাবে বাড়তে আছে, হেতে কীভাবে যে চলবে হেয়াই তো বুজি না। তুমি কি অইন্য কিছু ভাবলা?

—ভাবছি বাড়িতে কিছু ছাত্তর পড়ামু। তারা রাত্তিরে ওহানেই থাকপে। এভাবে কিছু রোজগার হইতে পারে।

–এহনও কাউরে পাইছ এরকম?

–নৈকাঠির পাঁচ-ছয়জোন কইছে পড়বে। তয় তোর বোধহয় মাঝে মাঝে আইতে হইবে। তোর স্যারের লগে এ বিষয়ে কথা কইছি।

–স্যারে তো একদিনও আমারে বাড়ি যাইতে দিতে চায়েন না। কইলে খালি রাগ হয়েন আর থুম্বা দিয়া থাহেন।

—না আইজ হেনার লগে অনেক কথা অইছে। আসলে বৈরাগী মনের মানুষ, ঘর-সংসার করেন নায় তো, সব বোজেন না ঠিকমতো।

বাবার এই কথাটিতে আমার হাসি পেল। বৈরাগী তো শুধু মাস্টারমশাই-ই ছিলেন না, বাবা নিজেও তাই-ই ছিলেন। তবে দুজনের বৈরাগ্যে তফাত ছিল। মাস্টারমশাই সংসারধর্ম করেননি। তাঁর জগৎ শুধু পুঁথিপত্তর, ছাত্র এবং গরুবাছুরের সেবা। সেখানে রোজগারের ধান্দা নেই। জমির ধান অসুমার। জমি যারা চাষ করে তারাই বেশিটা নেয়, তারপরেও যা থাকে তাতে বছরের ফসলে দুবছর-তিন বছর চলে। একক মনুষ্য। ইচ্ছে হলে খান, না হলে মুড়ি, চিড়ে চিবিয়ে দিন গুজরান তাঁর বহুকালের অভ্যেস। পড়শিদের মধ্যে এক জ্ঞাতিগোষ্ঠী আছে। তারা মাঝেমধ্যে খোঁজখবর করে। তাদের গুষ্ঠি বেশ বড়। ফলে মাস্টারমশাইয়ের ‘মটকার’ চাল কখন যে ফাঁকা হয়ে তাদের জঠরানল নিবৃত্ত করে তিনি তা টের পান না। সে বাড়ির দুই ডাঙর ছেলে যখন-তখন এসে তাঁর অনুপস্থিতিতে ‘মটকা’ থেকে চাল নিয়ে যায়। আমাকে বলে—হুমানইয়া, উড়ইয়া আইয়া জুড়ইয়া বইছ, জ্যাডায় মরলে হ্যার বিষয় খাবা ভাবছ? আমরা থাকতে হেয়া অইবে না।—আমার মাথায় এরকম চিন্তা কদাচ ছিল না। স্যারকে বলতেও পারি না। অথচ লজ্জা অপমানে অন্তরাত্মা কুঁকড়ে থাকে। এদিকে ‘মটকার’ চাল কমতেই থাকে। মনে মনে ভীত থাকি উনি যদি জানতে পেরে আমাকে সন্দেহ করেন?

দোতলা টিনের বাড়ি। মেঝে মাটির। অবয়ব কাঠের। মাটির মেঝেতে পোঁতা তিন-চারটি মটকায় চাল। সেখান থেকে তোলো, সিদ্ধ করো, কিছু ব্যঞ্জন বা পুকুরের মৎস্যাদি সহযোগে খাও। এমতো অবস্থা। গৃহে কোনো রমণী না থাকায় বাড়িটার কোনো ছিরিছাদ নেই। মেঝে শেষ কবে যে লেপা হয়েছিল তার ইতিহাস বোধকরি গৃহকর্তাও জানেন না। বর্তমানে অর্থাৎ তখন আমি সব সামলাবার দায়িত্বে। বাড়িতে ঢোকার মুখে একটি পুকুর, যা তখন ডোবারই সামিল। সেখানে শিং, মাগুর, কই, খলসেদের স্বাভাবিক আবির্ভাব এবং তিরোভাব। সেখানে গ্রীষ্মে আবার নিদারুণ শুষ্কাবস্থা। তাই মাস্টারমশাইয়ের বিধি ছিল জলাভাবে মৎস্যদের উত্তোলন তথা মটকায় জীয়ন, মাঝে মাঝে সুযোগমতো ভক্ষণ, অবশিষ্টদের আবার বর্ষাগমে ডোবা জলভর্তি হলে পুনরায় যথাস্থানে স্থাপন। সেই সময় তাদের শারীরিক আকার এতই করুণ হতো যে, ভক্ষণ করার কথা কেউ ভাবতেই পারত না। মাছগুলোর গোটা শরীর একটা পাতলা চামড়ায় ঢাকা কঙ্কাল বিশেষ হতো এবং তাদের মাথাগুলোই শুধু তাদের অস্তিত্বের সাক্ষ্য দিত। এদের জন্য মাস্টারমশাইয়ের বেশ একটা আহা-আহা ভাব ছিল। তাঁর বৈরাগ্যের স্বরূপ ছিল এমতো।

বাবার বৈরাগ্যের ধরনটি আলাদা। তাঁর সংসারধর্ম সাতিশয় প্রবল। সন্তানসন্ততিতে আমরা ভাইবোনেরা তেরোজন। তাঁর দুই সংসারের বৃত্তান্ত আগেই বলেছি। পঞ্চাশ-একান্নর দাঙ্গার অব্যবহিত পরে আমার সহোদর জ্যেষ্ঠদের, জ্যাঠামশাইয়ের সন্তানদের শেষ দুই পুত্র বাদে অন্যদের এবং আমাদের দিদিকে নিয়ে বুড়িপিসিমা এবং জ্যাঠামশাইয়ের সমা কলকাতায় পাড়ি দেন। জ্যাঠামশাইয়ের সন্তানদের মধ্যে ছিলেন তিন দিদি, একজন দাদা এবং তাঁর ছোট কন্যা। আমাদের দিদিরা, সর্বমোট চারজন, সবাই বিবাহযোগ্যা। আমার ছোট দাদা সেবার ম্যাট্রিক দেবেন বলে বছরখানেক বাড়িতে ছিলেন। পাস করে তিনিও কলকাতায় চলে যান। কলকাতায় তখন বড়দাদা রেলের চাকুরে। সার্কাস রেঞ্জের একটি বাড়ির গোটা তেতলাটি জুড়ে তখন আমার দুই কাকা, এক কাকার পরিবার এবং যারা বাড়ি থেকে গেলেন তাঁরা থাকতেন। এই পরিবারের কর্তৃত্বে বুড়িপিসিমা দীর্ঘকাল রাজ্যপাট করেন। এঁর কথা ইতিপূর্বে বলা হয়েছে। ইনি শতবর্ষ অতিক্রম করেও সুস্থ মস্তিষ্কে বেঁচে ছিলেন এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত পরনিন্দা, পরচর্চা, ছোটদের উচ্ছন্নে যাওয়া ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তর আক্ষেপাদি করে গেছেন।

সে অনেক কথা। বলার দরকারও নেই বিশেষ। শুধু এইটুকুই বলি যে, এই ব্যাপক একান্নবর্তী পরিবারের কর্তৃত্বের মধ্যে অদৃশ্য দাবার ছক সাজানো ছিল। পারিবারিক রাজনীতির দাবার ছক। সেই খেলায় ‘বড়েরা’ হামেশা প্রতিপক্ষের অন্দরমহলে ঢুকে মন্ত্রী হয়ে সব অসাধ্য সাধন করেছেন। শুধু মাঝপথে আমার ন্যালাখ্যাপা দাদাগুলো বাজে বিচ্ছিরি চালে দু-এক ঘর এগিয়েই কুপোকাত। ফলে একটা সময় সার্কাস রেঞ্জের ওই তেতলার ছকের বাইরে খোলা রাস্তায় তারা নিজেদের নিতান্ত ‘এতিম’ হিসেবে দেখতে পায়। তারপর ভাসতে ভাসতে কখনো এ-ঘাট, কখনো ও-ঘাট করে নোঙর ফেলার চেষ্টা করতে থাকে, কিন্তু কোথাও হালে পানি পায় না। সাময়িক স্থায়িত্বে যদি কোথাও আশ্রিত হয়, পরমুহূর্তেই আবার খড়কুটোর মতো এক দমকায় উড়ে বিক্ষিপ্ত হয়ে গিয়ে পড়ে কোনো বস্তি অথবা গোরস্তানের পরিত্যক্ত একচালা টিনের ছাউনির নিচে। পিছারার খালপারের আমরা দুশ্চিন্তায়, বিষণ্নতায় দিন, মাস, বছর পার করি। তালুকদারি থাকাকালীন সময়ে বাড়ি থেকে ভারা ভারা জিনিসপত্র যেত। ইলিশের সময় ইলিশ নুন হলুদে জারিয়ে ক্যানেস্তারা ভর্তি করে মা পাঠাতেন। আমসত্ত্ব, কুলের আচার, তেঁতুল জারানো আচার, চালতের গুঁড়োর পিঠে, কাঠবাদামের মোয়া, এটা ওটা সব সাধারণ জিনিস, কিন্তু অসম্ভব পরিশ্রম এবং যত্নের সঙ্গে তৈরি খাবারদাবার যেমন যেত, তেমনি টাকাপয়সা, দামি জিনিসপত্তরও প্রভূতই যেত, যা আমি নিজে দেখেছি। কিন্তু অনেক পরে জেনেছি এর কিছুই হয় পৌঁছত না, না হয় আমার দাদা-দিদিরা তার কিছুই পেতেন না। এসব ছোট কথা, ছোট দুঃখের ব্যাপার হয়তো। কিন্তু আমার পিছারার খালের জগৎটাও যেহেতু ছোট, তাই এগুলোই আমার জীবনের বড় ব্যথা হয়ে অক্ষয় হয়ে আছে। আজও সেই কাঠবাদাম কুড়োনোর জন্য ঘোর জঙ্গলের মধ্যে আমার আর ছোটনের দুঃসাহসিক অভিযানের কথা ভুলতে পারি না। ভুলতে পারি না অতি কষ্ট করে আনা সাধারণ বুনো বাদামগুলো অসীম ধৈর্যে, খোলা ছাড়িয়ে আস্ত শাঁসগুলো জড়ো করে মায়ের কাছে দেয়ার কথা এবং অবশ্যই তার একটাও নিজেরা না খেয়ে। কেউ কি কখনো জানবে আমাদের ওই শিশু-হৃদয়ের অবশ্যম্ভাবী লোভ সংবরণ করে ওই বাদাম বা আম বা কুল বা চালতার গুঁড়োর পিঠে (যাঁরা খাননি তাঁরা কখনো অবশ্য জানবেন না) বা মিষ্টি তেঁতুলের আচার, কীভাবে প্রাণে ধরে, দাদা-দিদিরা খাবে বলে, আমরা নিজেরা না খেয়ে পাঠাতাম। কিন্তু তা যে তাঁরা পেতেন না, তখন তো তা জানিনি। সাধারণ, অতি সাধারণ তুচ্ছাতিতুচ্ছ এইসব। অথচ আমার জন্য সারা জীবনে কী যে দুঃখবহনকারী এইসব বাস্তবতার আঘাত, তা যাঁরা আমার মতো জীবনযাপন করেননি, তাঁরা বুঝতে পারবেন না।

এক-একটা দিন তখন এমন যেত যে, মা এবং আমি প্রায় সারা দিন কান্নাকাটি করতাম। তখন দিনের পর দিন দাদাদের একটি চিঠির প্রতীক্ষায় থাকতে থাকতে মা ধৈর্য হারিয়ে ফেলতেন। এসব অনেক আগের কথা। প্রসঙ্গক্রমে বলছি। বাবা তখন কিছু করেন না। তালুকদারির মোটা ভাতকাপড় বিনে পরিশ্রমে লভ্য। বাবাও নিশ্চয়ই অনেক দুশ্চিন্তা করতেন, কিন্তু তা আমাদের গোচর ছিল না। পিছারার খালপারে বসে মা একা একা কাঁদতেন তাঁর দেশ ছেড়ে যাওয়া সন্তানদের জন্য। কিন্তু তাঁর এই দুঃখের জন্য, দুর্ভাগ্যের জন্য কাউকেই দায়ী করতেন না। না পরিবারের পুরুষদের, না রাষ্ট্রনেতাদের। অথচ একসময় নাকি স্বদেশিওলা নানান নেতা তাঁর হাতের ‘রন্ধন খাইয়া’ তারিফ করে গেছেন। সে যাকগে, যেদিন কোনো চিঠি আসত কারও এবং সংবাদে থাকত যে, তারা ওখানে ভালো আছে, সেদিন মায়ের রূপ যেন উছলে পড়ত। আর আমিও খুব উদ্দীপ্ত বোধ করতাম। এইসব দিনগুলো ছিল আমাদের উৎসবের দিন। সেসব দিনে মায়ের গানের গলা অসাধারণ খোলতাই হতো। মেজাজ হতো ফুরফুরে, প্রায় রানি মহারানিদের মতো। পাড়া-প্রতিবেশীরা মায়ের উচ্চকণ্ঠের গান শুনতে পেত’পাগলা মনটারে তুই বাঁধ’।—তারা বুঝত ‘আইজ ছিরিমতী লাবণ্যপ্রভা তেনার পোলাগো চিঠি পাইছেন।’ আমার মায়ের নাম লাবণ্যপ্রভা। তা সেসব দিনগুলোতে আমি মায়ের লাবণ্য উছলে উঠতে দেখেছি।

বাবাও তখন যেন উদ্যোগী হয়ে ভবিষ্যতের নানান সম্ভাব্য-অসম্ভাব্য প্রকল্প নিয়ে মায়ের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতেন। তখন অভাব তুঙ্গে গেলেও তাকে গ্রাহ্য না করার মতন একটা সাময়িক শক্তি যেন আমরা সংগ্রহ করতে পারতাম। তালুকদারি থাকাকালীন সময়ে বাবা মাঝে মাঝে দাদাদের কাছে যেতেন কলকাতায়। জ্যাঠামশাইও যেতেন। কিন্তু আশ্চর্য, তাঁর মার বা বড় মার যে তাঁদের সন্তানদের দেখার ইচ্ছে আদৌ হতে পারে, বা এ যে তাঁদের পক্ষে একটা বিষম কষ্টের ব্যাপার, এ কথা কোনো দিনও বোধ করেননি। আরও আশ্চর্য হচ্ছে এই যে, মা বা বড় মা, মানে জেঠিমাও তাঁদের স্বামীদের কাছে এরকম কোনো প্রত্যাশায় প্রত্যাশী হবার মানসিকতায়ও ছিলেন না। যেন তাঁরা দেখে এলেই সব ঠিক আছে। তাঁদের যেন এরকম কোনো আকাঙ্ক্ষাও ছিল না। তখনকার দিনে আমার পিছারার খালের জগৎটাই এরকম ছিল।

যখন মধ্যস্বত্বলোপ আইন পাস হলো, যখন আমরা আর জ্যাঠামশাইয়েরা পৃথগান্ন হলাম, যখন আমাদের প্রকৃত দারিদ্র্য শুরু হলো, তখন থেকে বাবার আর কোনো উপায় থাকল না দাদাদের কাছে যাবার। তখন তিনি, ‘তোমারই ইচ্ছা হোক পূর্ণ করুণাময় স্বামী, দাও দুঃখ যত পারো সকলই সহিব আমি’—এরকম উচ্চারণে অসীম এক বৈরাগ্যে মগ্ন হলেন।

এই সময়টা থেকেই মা আমার ওপর আস্তে আস্তে নির্ভরশীল হতে লাগলেন। সংসারের দায়িত্বও ক্রমশ আমার ওপর ন্যস্ত হতে থাকল। কিন্তু দাদাদের বিচ্ছেদজনিত কারণে মায়ের যাবতীয় ভাবনাচিন্তা এবং ভালোবাসা তাদেরই দিকে প্রবাহিত থাকল খুব স্বাভাবিক কারণে। আমি এবং ছোটন এ কারণে কোনো দিনই সেই সময় বাবা বা মায়ের ভালোবাসার, আদরের বা একটা স্নেহার্ত বচনেরও আস্বাদ পাইনি। ছোটরা তখন এতই ছোট যে, এ সমস্যা তাদের বোধেই আসেনি। অবশ্য এ জন্য আমরা বা মা-বাবা কেউই দায়ী ছিলাম না। এ ছিল দেশভাগ, খণ্ডিত স্বাধীনতা এবং কোনো পুনর্বাসন ব্যতিরেকে মধ্যস্বত্ব বিলোপের পুরস্কার আমাদের সকলের জন্য। শুধু আমার পরিবারই এই পুরস্কারের আধিকারিক ছিল না। এরকম পরিবার অনেকই ছিল।

প্রসন্নকুমার স্কুলে ভর্তি হবার পর যখন মাস্টারমশাইয়ের বাড়িতে ব্ৰহ্মচর্যে স্থায়ী হলাম, তখন থেকে মায়ের সঙ্গে আমার বিচ্ছেদের শুরু। সাংসারিক দিক থেকে তা যেমন অসুবিধেজনক ছিল, মায়ের এবং আমার মানসিকতার পক্ষেও তা অসম্ভব ক্লেশকর হয়েছিল। যখন মায়ের কাছে মাঝেমধ্যে যেতাম তখন ব্যাপারটি বুঝতে পারতাম। এই সময়েই মায়ের ভালোবাসার গাঢ়তা আমার অনুভবে এলো। স্যারের বাড়িতে প্রায় মাসখানেক থেকে প্রথম যেদিন বাড়ি গিয়েছিলাম, সেদিনটা ছিল আমার জীবনের এক আশ্চর্য দিন। ছোট ভাইবোনগুলো উঠোনে খেলছিল। শীতের পড়ন্ত বেলা। স্কুলশেষে বাবার সঙ্গে ফিরেছিলাম। আমাকে দূর থেকে আসতে দেখে ভাইবোনগুলো পাখির মতো কোলাহল করে উঠেছিল। ছোট বোনদুটো টলমল করতে করতে এসে ঝাঁপিয়ে কোলে চড়ে বসল। আমার কীরকম যেন কান্না পাচ্ছিল। ছোটন, তার পরের বোনটা এবং আর দুটো ভাইবোন, তাদের অসংখ্য জমানো কথা বলে যাচ্ছিল। তার মধ্যে কত নালিশ, কত অভিযোগ! আমি সবাইকে আগলে নিয়ে যখন ঘরে ঢুকলাম, মা এক আশ্চর্য আদরে আমাকে জড়িয়ে ধরে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন আর কাঁদছিলেন। সে এক ব্যাপক কাণ্ড। জীবনে এরকম স্নেহাদর সেই প্রথম। সেদিন আমি প্রকৃত বুঝেছিলাম, দূরে থাকার কারণে মা আমার জন্য কতটা উদ্বিগ্ন। যারা আরও দূরে, তাহলে তাদের জন্য তাঁর উদ্বিগ্নতা আরও কত গভীর। এখনকার বোধে মনে হয়, আমার মায়ের অনুভূতির জগৎটাই ছিল তখন প্রায় একটা বোবা পশুর মতো। বিশেষত তাঁর সন্তানদের বিষয়ে। সে অনুভূতি তাঁর নিতান্ত সাহচর্যে না থাকলে বোঝা সম্ভব ছিল না। আমি দূরে কিছুদিন থাকার পর কাছে এলে এই অনুভূতির স্বরূপ বুঝতে শিখলাম। আমরা এর আগে কখনো নিজেদের অনুভবগুলো একে অন্যের কাছে প্রকাশ করতে পারতাম না। শুধু একের কান্না দেখে অন্যে কাঁদতাম। এবার থেকে মা তাঁর দুশ্চিন্তা, দুঃখ এবং উদ্বিগ্নতার জন্য সমব্যথী হিসেবে আমাকে পেলেন। নিয়ত দারিদ্র্য এবং উদ্বিগ্নতার দিনগুলোতেও সে আমাদের এক অপ্রমেয় আশীর্বাদ হয়েছিল, মায়ের কাছেও এবং আমার কাছেও।

আমার ছোট ভাইবোনগুলোকে, তারুলি স্কুলে আমার ছাত্রজীবন আরম্ভ করার আগে থেকেই, আমিই অক্ষর-পরিচয় করানো, কিছু গণিত এবং ইংরেজির প্রাথমিক জ্ঞান আমার সাধ্যমতো শিক্ষা দিতে চেষ্টা করেছিলাম। ছোটনের পরের বোনটা আমাদের পাঁচজন ভাইবোনের পরে জন্মেছিল। এর আগে আমার বড় বৈমাত্রেয় দিদিই ছিলেন মা-বাবার একমাত্র কন্যা। তাঁর বাল্যকালে মাতৃবিয়োগের দুর্ঘটনা থাকলেও মায়ের অভাব তাঁকে কোনো দিনই অনুভব করতে হয়নি। আগেই বলা হয়েছে যে, আমার মা এসে সেই দুরূহ সমস্যার সমাধান করেছিলেন। যে সময়ের কথা বলছি তখন দিনি কলকাতায় চলে এসেছেন। তাঁর আসার সময় আমার এই বোনটা বছর দুই কি আড়াই এরকম এবং আমাদের সর্বকনিষ্ঠ ভাইটি সদ্যোজাত। এ কারণে আমার এই বোনটি বাবা, মা এবং আমার কাছে অসম্ভব প্রিয় ছিল। আমার আগের ভাইবোনেরা কলকাতায় চলে গেলে বাড়িতে আমিই তখন বড়। ভাইটা ছোট বলে আর এই বোনটা এতগুলো ভাইয়ের পর জন্মেছে বলে আজীবন এদের প্রতি আমার একটু স্নেহের পক্ষপাতিত্বর পাল্লা ভারী থেকে গেছে, তবে পরের তিনটে বোন জন্ম থেকে আমারই হাতে বড় হয়েছে বলে এবং তাদের তাবৎ ‘গু-মুত’ ঘেঁটেছি বলে তারা যতটা আমার বোন তার থেকে বেশি যেন আমার সন্তান, এরকম একটা বোধ এখনও আমার মধ্যে ক্রিয়াশীল।

ছোট ভাইটার তখন প্রায় দ্বিতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হবার বয়স হয়েছে। সেবার বাড়িতে গেলে ভাইদুটো এবং বোনটা বলতে লাগল, দাদার মতো তারাও স্কুলে পড়বে। সে এক মহাহুল্লোড়। আমি অবশ্য খুবই উৎফুল্ল বোধ করছিলাম। এরা আমার অনুপস্থিতির এই সময়টুকুর মধ্যে যথেষ্ট সাহসী এবং চটপটে বা ইংরেজিতে যাকে বলে স্মার্ট, তাই হয়ে উঠেছে। বুঝলাম আমার পরিবারে একটা পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে। ওদের সব আদর, আবদার, নালিশ বরাবরই আমার কাছেই হতো। এখন পাছে দাদা কালই আবার অনির্দিষ্টকালের জন্য তাদের কাছ-ছাড়া হয়, তাই সবাই হল্লা শুরু করল, তারাও দাদার মতো স্কুলে যাবে।

আমি আমার স্কুলে যাবার বৃত্তান্ত ইতিপূর্বে বর্ণনা করেছি। সে ক্ষেত্রেই অত সংগ্রাম করতে হয়েছে। এখন এতগুলো ভাইবোনকে স্কুলে ভর্তি করার সংগ্রামটা এ অবস্থায় যে আমি কীভাবে করব, ভেবে পাচ্ছিলাম না। বাবা প্রসন্নকুমার বিদ্যালয়ের শিক্ষক বিধায় আমাকে হয়তো বিনা বেতনে পড়াবার সুযোগ পেতে পারেন, কিন্তু তিন-তিনটে ভাইবোনকে ফ্রি পড়ানোর সুযোগ তাঁর ছিল না। একমাত্র ছোট ভাইটাকে প্রাইমারিতে দেয়া সম্ভব ছিল, প্রাইমারি অর্থাৎ পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত তখন শিক্ষালাভ ফ্রি ছিল। আর দুটো ভাইবোনকে ষষ্ঠ শ্রেণিতে দিতে হয়, সে ক্ষেত্রে খরচ একটা অবশ্য ব্যাপার। মা-বাবার সঙ্গে আলোচনা করেও কিনারা হলো না। কিন্তু কনিষ্ঠ ভ্রাতাটি আমার সেই বয়সেই যথেষ্ট বীরেন্দ্র বীর বিক্রম কেশরী হয়ে উঠেছিল। যদিও তার বিক্রম এবং তজ্জনিত অত্যাচার ভোগ করতে হতো ওই বোনটাকেই, যেহেতু তারা পিঠাপিঠি। এর মধ্যেই সে একদিন একখানা কাটারি দিয়ে তার দিদির কর্ণচ্ছেদ করেছে এবং আমি তার কাছাকাছি না থাকলে সে যে অচিরেই একটি মাতৃঘাতী পরশুরাম হবে, এ ব্যাপারে কারওই দ্বিমত ছিল না। এমতো হওয়ার সপক্ষে তার একটা জন্মগত যৌক্তিকতাও যে ছিল না, তাও বলা যাবে না। প্রায় পঞ্চাশের দাঙ্গা চলাকালীনই তার জন্ম, একান্ন-বাহান্ন সালের ডিসেম্বরের কোনো একটা তারিখে, যতদূর মনে আছে। তাই তাকে খানিকটা দাঙ্গাকারীর স্বাধিকার দেওয়া ছিলই। কিন্তু ব্যাপারটা যে একেবারে ‘বিগিনস অ্যাট হোম’ হবে এরকম ভাবনা বা দুর্ভাবনা কারওই ছিল না। সে যা হোক, সেই পরমাণু-ব্যক্তিত্বটি এখন তার স্বাধিকার প্রকাশ করল এই আবদারে যে, সে দাদার মতো বইখাতা নিয়ে স্কুলে যাবেই। ঠিক হলো সে বাবার সঙ্গে নিয়মিত স্কুলে যাবে। তাকে দ্বিতীয় শ্রেণিতে ভর্তি করে দেয়া হলো। বড় দুটোর জন্য তখনও কিছু করতে পারলাম না বলে কষ্ট হলো।

পরের মাসে যখন বাড়িতে গেলাম, তখন ওদের দুর্দশা দেখে আমার এত খারাপ লাগল যে নিজের ওপর বড় ধিক্কার জন্মাল। ওরা বাড়িতে যেটুকু পড়াশোনার চর্চা করত, অভিমান করে তাও ছেড়ে দিয়ে সারাদিন শুধু আগান-বাগান ঘুরে বেড়ায়, যেমন একসময় আমার অবস্থা ছিল। ছোট ভাইটা খুব মাতব্বরি করছিল যে, ওরা পাড়াশোনা করে না, ওদের কিছু হবে না। তার প্রতিটি হাবেভাবে সে প্রকাশ করছিল যে, সে একজন বেশ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি তার দাদার মতোই। দাদা এবং সে দুজনেই স্কুলে পড়ে এবং ওরা আগানে-বাগানে ঘুরে বেড়ায়, কিসসু লেখপড়া করে না—ইত্যাদি। তার হাবভাব দেখে মজা লাগলেও বড় দুটোর জন্য বেশ কষ্ট হলো। কিন্তু কিছু অনিবার্য কারণে ওদের ভর্তির ব্যাপারটা পরবর্তী শিক্ষাবর্ষ পর্যন্ত ঝুলিয়ে রাখতে হলো। কোনো উপায়ই ছিল না যে, ওদের তক্ষুনি স্কুলে দিই। তাদেরকেও সেরকম বুঝ দিয়ে রাখলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *