বিষাদবৃক্ষ – ৪

চার

আমাদের ছোটবেলায় যেসব পুকুর আমাদের গাঁয়ে ছিল, সেগুলো আদৌ বদ্ধ জলাশয় ছিল না। কোনো-না-কোনো খালের সঙ্গে তার একটা সম্পর্কসূত্র থাকত। এই সম্পর্ক বা সংযোগসূত্রটিকে আমাদের ওখানে বলা হতো ‘জান’। শব্দটি যদিও বাংলা শব্দ নয়, তথাপি আমরা বাঙ্গাল বা বাংলা হিসেবেই তাকে জেনেছি। ‘জান’ অর্থে প্রাণ। পুকুরের বা দিঘির প্রাণ তো ওই সংযোগসূত্র বা প্রণালিকাটিই হবে। আমি এমন কোনো দিঘি বা পুকুর বাল্যে দেখিনি যার একটি জান নেই।

আমাদের বাড়ির পেছনে একটি বেশ লম্বা পুকুর ছিল। সে যতটা লম্বা, ততটা চওড়া নয়। পিছারার খালের সঙ্গে একটি জান-এর দ্বারা সংযুক্ত। আমাদের এ-বাড়ির বংশপুরুষ, রমাপতি সেন কবিবল্লভের সময়কালের পুকুর এটি। তখন সামনের বড় খাল ছিল হয়তো বিশাল এবং তামাম এলাকা ছিল গোলপাতা, সুন্দরী, গেউয়ার জঙ্গলে আচ্ছন্ন এক বনভূমি। কবিবল্লভমশাই এ অঞ্চলে যখন প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন, তখন এই পুস্কুরিণীর নাকি জন্ম, এবং সেই সময় থেকে আমাদের পরম্পরা শুরু। এসব শোনা কথা, কিংবদন্তি। তবে আমি যা দেখেছি তা বলছি। পুকুরটিতে একটি বাঁধানো ঘাট ছিল। সেই ঘাটের বাঁধানো তা আমার কৈশোরে যেটুকু লভ্য ছিল, তাতে আমার ঊর্ধ্বতন দশম পুরুষের অর্থাৎ কবিবল্লভমশাইয়ের দাবি নাকচ করা সংগত হয় না। পুকুরটি এবং ঘাটটি প্রকৃতই প্রাচীন। তখন পিছারার খালটির ‘গতর’ও বেশ হৃষ্টপুষ্ট। কেননা, ভূমি তখনও নবীনা। মহাশয় ছিলেন পার্শ্ববর্তী চৌধুরী জমিদারদের জ্ঞাতিভাই। যাঁদের জমিনজায়দাদ বাদশাহি বা নবাবি সনদে, তামার পাতে। অনুমান হয় কবিবল্লভমশাই কোবরেজ ছিলেন। জ্ঞানত এইসব উপাধি কোবরেজদেরই দেখেছি। কিন্তু অত পেছনে গেলে চলবে না। যেটুকু বলতে চাইছি তা-ই বলি। আমি ওই ঘাটের ঘাটত্ব দেখেছি কিছু দাঁত বার করা ইটের সারিতে। বড়ই করুণভাবে তার আকৃতিই তাকে ঘাট বলতে বাধ্য করে শুধু। তবে আসল কথা হচ্ছে ঘাটটি তখনও ছিল, এবং জানটিও ছিল। ওই ঘাটের উঁচুতে ছিল একটি লিচু গাছ। তারই তলায় মাটি খুঁড়ে এলেবেলে সামগ্রী দিয়ে রান্নাবাড়ি খেলতাম আমরা, আশপাশ-বাড়ির ছেলেমেয়েরা। তখন বোধকরি আমার বয়স পাঁচ পেরিয়েছে কি পেরোয়নি। ক্ষীণ স্মৃতি। পাড়ায় ডাক্তারবাড়ি কোবরেজবাড়ি বা অমুকবাড়ি তমুকবাড়ির ছেলেমেয়েরা মিলে তখন কাদার পায়েস, কাদার পোলাও, কাদার তরকারি ইত্যাদি দিয়ে সেখানে নিত্য তিরিশ দিন মোচ্ছব করতাম। তখনও কেউ ওখানের চৌহদ্দি ছেড়ে কোথাও চলে যাবে এমন কার্যকারণ ঘটেনি। শুধু মাঝে মাঝে বড়দের কিছু দুর্বোধ্য আলোচনা কানে যেত, ‘এহানে কি আর আমরা থাকতে পারমু? কাইলকার দ্যাশ আইজ বিদ্যাশ অইয়া গ্যালে। গান্দি এডা করলে কী?’

আমাদের মধ্যে যারা একটু বয়স্ক-বয়স্কা, তারা একসময় আস্তে আস্তে লিচু গাছতলার খেলা ছেড়ে অন্য জগতে চলে যেতে থাকে। তখন আমার নজরে কিছু নতুন ঘটনা, এই পিছারার খালের আশেপাশের বনবাদাড়ে দৃশ্যমান হতে থাকে, যার অর্থ আমার সম্যক বোধ হয় না। যৌনবোধের ব্যাপারটি স্বাভাবিকভাবে যখন আসা উচিত তার একটু আগেই বোধ হয় গ্রামীণ ছেলেমেয়েদের অথবা আমার কৈশোরক কালের ওই পরিবেশে এসে থাকে। কারণ অন্য ছেলেমেয়েদের ক্ষেত্রেও তো সেরকমই দেখেছি। যাঁরা মনে করেন পাঁচ থেকে সাত বছরের বালক-বালিকাদের যৌনতা বিষয়ে কোনো অনুভূতি বা কৌতূহল থাকে না, তাঁরা বোধকরি স্মৃতি রোমন্থনে অপারগ। এসব বিষয়ে অভিভাবকেরা শিশুদের যত শিশু মনে করেন, তারা প্রকৃতপক্ষে যে আদৌ সেমতো ‘বেহেস্তি আদম বা ইভ’, তা কিন্তু নয়। স্বকীয় অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই আমি এমন কথা বলছি। কিন্তু তা কি পূর্ণ যৌনজ্ঞান? তা অবশ্যই নয়।

আমাদের পাশের ডাক্তারবাড়িটিতে অনেকগুলোই যুবতী মেয়ে ছিল। তখনকার রীতি অনুযায়ী সহধর্মিণী যতদিন ফলপ্রসূ থাকবেন, ততদিনই সন্তানোৎপাদন অব্যাহত রাখা পুরুষদের যেন বিধেয় কার্য ছিল। তা শেষের জাতকটির জন্মসময়ে হয়তো প্রথম জাতিকার যৌবনকাল দীর্ঘ সন্তাপে শেষ হতে চলেছে। পিতার তথাপি ভ্রুপেক্ষ নেই। এখন প্রথম জাতিকা যদি কোনো স্বভাবজ অসৈরণ আচরণ করে, তবে তার দুরদুর ছিছি। অথচ মা-বাপের আচরণকে কেউই অস্বাভাবিক বলে না। ডাক্তারবাড়ির যুবতী মেয়েরা আমাদের বয়সি ছেলেদের যেসব গল্পকথা বলত, তার বেশির ভাগ তাৎপর্যই আমরা বুঝতাম না। তারা কিন্তু বলতেও আনন্দ পেত এবং কখনো কখনো সেইসব গল্পের ব্যাখ্যান তথা তদনুযায়ী কৃৎকরণে উদ্যোগী হতো। আমরা তখন নিতান্তই শৈশব ছাড়িয়ে কৈশোরে প্রবেশ করতে চলেছি। এই সময়ে, সঠিক স্মরণ করতে পারি না, দেশ ত্যাগ করার কার্যকারণ খুব পরিপক্ব হয়েছিল কি না। তবে দু-একটি পরিবার তখন গ্রাম ত্যাগ করেছে। পাকিস্তান নামক শিশুরাষ্ট্রটির দাঁত নখ ধারালো হয়ে উঠেছে। পিছারার খালের জগতের চৌহদ্দিতে ফাটল ধরেছে। ওই সময় থেকেই কি আমার ওই সবুজ ভূখণ্ডের সমাজে অবক্ষয়ের ফাটল ধরে গিয়েছিল? পুরুষমানুষ, স্ত্রীমানুষ সবাই কেন যে তাদের সীমালংঘন করে একে অন্যের জগতে প্রবেশ করছিল, তা বোঝার বয়স তখনও আমার হয়নি। তবে যেটুকু জ্ঞান তখনও পর্যন্ত অর্জিত, তাতে পরে বুঝেছি, এই কু-আচার সমাজসিদ্ধ নয়। এটা একটা মাৎস্যন্যায়ী ব্যাপার।

আমাদের ওই বয়সে যুবতীদের রহস্যাচরণ না-বোঝা স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু ডাক্তারবাড়ির যুবতীরা যখন গঞ্জ থেকে আসা তাদের কিছু তথাকথিত মামাদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াত আগানে-বাগানে, তখন তাদের কিছু রহস্যাচরণ যেন আমাদের কৌতূহলের যৌনতার জগৎকেই শুধু আলোড়িত করত, যদিও তখন তা আমাদের বোধগম্যতার আওতায় ছিল না। যৌনতা তখনও আমা হেন জনেদের স্বাভাবিক আকর্ষণ নয়। এ বিষয়ে কৌতূহলটাই তখন বাস্তব। যেমন, ওইবাড়ির একটি মেয়েকে যেদিন আমি একটা তেঁতুল গাছের তলায় তার এক ওইরকম শহুরে মামার সঙ্গে জড়াজড়ি অবস্থায় দেখি তখনও জানি না যে ওই মামা একজন বিবাহিত পুরুষ। দু-একদিনের মধ্যে শহর থেকে ওই মামার এক ভাই যখন আমাদের গাঁয়ে এসে ধুন্ধুমার কাণ্ড করে তার দাদাকে ফিরিয়ে নিয়ে গেল, সেই সময়কার আলাপ-আলোচনায় বুঝলাম, মামার ব্যাপারটা ঠিক মামাতো নয়।

তাদের ওই ‘শঙ্খবন্ধন’ আমার চোখে পড়েছিল। আমার যৌনতার জগৎ তখন এরকম ক্রিয়ার বিষয়ে অভিজ্ঞ নয়। আমার মনে হয়েছিল মেয়েটি কিছু অন্যায় করেছে বলে মামাটি তাকে শান্তি দিচ্ছে। কিন্তু তা যে নিতান্তই ভুল সেটা বুঝলাম পরে ওই মেয়েটি যখন আমাকে একগুচ্ছ কাঁটাবহরী অর্থাৎ বৈঁচিফল দিয়ে কড়ার করিয়ে নিতে চাইল যেন আমি এ কথা কাউকে না-বলি। নারী-পুরুষের দৈহিক এই বিশেষ সম্পর্কটি বিষয়ে এই ছিল আমার প্রথম পাঠ। সে ছিল আমার তুলনায় অনেক বড়। অতঃপর এ বিষয়ে সে আমাকে অনেক কথাই বলেছিল। কিন্তু এর পেছনে যে করুণ এবং কদর্য কিছু ব্যাপার ছিল, তা শুনে আমি তখন এবং পরবর্তীকালেও খুবই যন্ত্রণা বোধ করেছি। যথাসময়ে সে প্রসঙ্গ আসবে। এখন খানিক পশ্চাৎকথা বলে নিই।

শুরুতে যে নগেন ডাক্তারমশাইয়ের কথা উল্লেখ করেছি, তাঁকে নিয়েই এই পশ্চাৎকথা শুরু করা দরকার। মেয়েটির প্রসঙ্গে যে ডাক্তারবাড়ির কথা বললাম, সেই ডাক্তারবাবুর ডাক্তার হওয়া সম্ভব হয়েছিল নগেনমশাইয়ের দয়ায়। নগেনমশাই একসময় ছিলেন এক কিংবদন্তির ডাক্তার। পিছারার খালের সোঁতার পাশেই তাঁর ঘর-গেরস্থালি-আরোগ্যশালা। দীর্ঘ দেহ, আবক্ষ শুভ্রশ্মশ্রু, গৌরবর্ণ অনিন্দ্যকান্তি পুরুষ। সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত তথা আয়ুর্বেদ বিষয়ে ধন্বন্তরী। যুগানুযায়ী অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসাশাস্ত্রেও বিলক্ষণ ‘এলেম’ এবং চিকিৎসা বিষয়ে নিত্যনতুন উদ্ভাবন তাঁর নেশা। অন্য নেশার মধ্যে স্বহস্তে প্রস্তুত তীব্র শক্তির ‘কোহল’। গ্রাম-গ্রামান্তরে রোগীপত্তর যথেষ্ট, কারণ ওইসব স্থানে কোনোকালেই পাস করা ডাক্তার ছিল না। নগেনমশাই ছিলেন স্বয়ম্ভূ ডাক্তার। কলেজে পাস করা নন। তবে সবাই বলতেন যে, মশাই প্রকৃতই চিকিৎসক ছিলেন। হাতুড়ে নন।

কোহলের ব্যাপারটা ছাড়া তার অন্য দোষ বিশেষ কিছুই ছিল না। দূর-দূরান্তরে যেতে তার বাহন ছিল একটি ঘোড়া, নাম ‘উড়ইয়াল মহারাজ। তবে সে নাম নিতান্তই আদর করে রাখা, তার গমনের গতির জন্য নয়। তার এবং তার আরোহীর উভয়ের মেজাজই বেশ গয়ংগচ্ছ স্বভাবের। যখন রোগীর নাভিশ্বাস তখনও তাদের যেমন গতি, রোগীর সামান্য পীড়ায়ও তার কোনো ভিন্নাচার নেই। ভদ্দরলোকের এক কথা। তুমি মরতে বসেছ বলে, আমাদের পগারে পড়ে হাত-পা ভেঙে ‘দ’ হয়ে বসে থাকতে হবে এমন কোনো শাস্ত্রবাক্য নেই। তোমরা তোমাদের মতো চলো। আমি আমার মতো। আবার ঘোড়ারও আছে নাকি মালিকের সেই বিশেষ ধাতটি। কোহলের নেশাটি মালিক এবং ঘোড়া উভয়ের। আরোহী যদি দূর পথে রোগী দেখতে যাবার সময়ে এক ঢোক আরক গলায় ঢালেন, ঘোড়া বলে, আমার চাই দুঢোক। ডাক্তার হিসেবে মশাই তার এ দাবি অন্যায্য মনে করেন না। মানুষ আর ঘোড়ার মাত্রা কি কখনো এক হতে পারে। যেমন এক জাত-রাখালকে চিকিৎসা করার সময় মশাই সাধারণ অপেক্ষা তিনগুণ বেশি মাত্রায় ওষুধ দিলে তাঁর এক শাগরেদ, হাহা করেন কী, করেন কী, বলে চেঁচিয়ে উঠেছিল। তিনি তখন অম্লানবদনে বলেছিলেন, ‘অর মাত্রা গবাদিপশুর হিসেবেই ধরতে হইবে। কেননা অর চরিত্রে খুব স্বাভাবিক কারণেই তাদের গুণ অর্শাইছে। বোজলা কিনা, অর দোয়াদশ দণ্ডকাল সোমায় তো গরুগুলার লগেই কাডে। হে কারণ অর মাত্রা মনুইষ্যের থিকা অদিক অইবেই—এডা জানবা। ইতর সংসর্গে প্রকৃতি ভিন্ন অয়। এয়া শাস্তর। ভিন্ন প্রকৃতিতে ভিন্ন ভেষজাচার।’

কিন্তু পগারে তাঁরা উভয়েই মাঝেমধ্যে পড়তেন। তখন ঘোড়া বলে ‘আমায় তোল’ আরোহী বলেন, ‘আমারে উডা’। অনেক সময় রাত কাবার হয়ে যেত এই ওঠাউঠির পর্বে। ভোর সবেরে সর্বাঙ্গ পঙ্কবিভূষিত হয়ে কণ্টকে চর্চিত দেহ, মশাই এবং ঘোড়া বাড়ি ফিরতেন। তাঁর স্ত্রী অর্থাৎ আমাদের নগেনজেঠিমার শাপশাপান্ত শুনে আমরা বুঝতে পারতাম এতক্ষণে মশাই ফিরেছেন। পাড়ার অবনীকাকু এবং দাসজ্যাঠা, জেঠিমার আওয়াজ শুনে যখন সেখানে যেতেন আমরা বালখিল্যরাও রগড় দেখতে হাজির হতাম। নগেনজ্যাঠা তখন তাঁর উঠোনের বেল গাছটার তলায় আধাচিত। ঘোড়াটা অদ্ভুত ভঙ্গিতে তার সামনের ঠ্যাং দুটো বিস্তারিত করে যেন বেশ স্নেহার্ত নয়নে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। অবনীকাকু আর দাসজ্যাঠা এসে শুধোতেন, ও দাদা, আপনের কী অইছে? আপনে গড়াইতে আছেন ক্যান? জেঠিমা বলতেন, অইছে অ্যারগো মাথা। কাইল রুগি দ্যাখথে যাইয়া হারারাইত পগারে-পড়ইয়া আছেলেন দুই জোনেই। এহন আইছেন। এই দ্যাহ, এডা খালি।—নগেনমশাই এতক্ষণে চৈতন্যে এসে বলেন, হরি বলোরে ভাই, সংসার সকলি জলময়। অবনীকাকু এবং দাসজ্যাঠা বলেন, এডা আপনার অন্যায্য কাম দাদা। এহন বয়স অইছে একটু বোজন লাগে। হেয়া যাউক, কাইল গ্যাছেলেন কই?

: কদমার পোলারে দ্যাখথে।

: হ্যার অইছে কী?

: কইলে বুজবি? প্যাডে তো ‘ক’ অক্ষর গোমাংস ভাবইয়া হান্দাওই নায় একবন্ন। বুজবি কোন কাফা। তথাপি দুজনেই পীড়াপীড়ি করলে সবিস্তারে কদমের ছেলের রোগ, সেখানে গভীর রাত অবধি বসে থেকে তার চিকিৎসা করণ এবং বিপদ কাটলে তার বাড়ি ফেরার প্রচেষ্টার কথা বলেন। পরে দাসজ্যাঠাকে বলেন, নিজেও তো টুকটাক ডাক্তারির চেষ্টা করতে আছ। আইজ থিকা আমার কম্পাউন্ডারিটা ধরো। আখেরে কাম অইবে। আমি একলা আর সামলাইতে পারতে আছি না।

তদবধি দাস ডাক্তার এবং তাঁর বাড়িটা ডাক্তারবাড়ি।

নগেনমশাইয়ের কাছে কিছুকাল কম্পাউন্ডারি করে এবং তালিম নিয়ে দাসজ্যাঠা একসময় নিজেই একজন ডাক্তার হয়ে বসেন। তখন নগেনমশাই অতিবৃদ্ধ। স্থবির প্রায়। উত্তরাধিকারসূত্রে মশাইয়ের চিকিৎসার এলাকায় দাসজ্যাঠার দখলদারি হয়। তাঁর ছোট ভাই গঞ্জে একটি বেশ ডাঙ্গর ওষুধের দোকান দিয়ে সেকালে মবলগ দুপয়সার অধিকারী। স্ত্রী-পুত্র-কন্যা গাঁয়ের বাড়িতে থাকে, গঞ্জে বাসাবাড়ি করে তাঁর বাণিজ্য চলে। জ্যাঠা, যাঁকে অতঃপর ডাক্তারজ্যাঠা বলেই উল্লেখ করব, তাঁর ডাক্তারির তাবৎ ওষুধ ছোট ভাইয়ের ওখান থেকেই আনেন। একান্নবর্তী পরিবার। এইসব ব্যবস্থাপনায় তাঁদের সংসার তখন স্বাচ্ছন্দ্যের শীর্ষে। ডাক্তারজ্যাঠার বাড়িতে তখন এলা কাছিমের মাংস তো ওব্‌লা বোয়াল মাছের রগরগা ঝোল। এভাবে চলছিল বড় চমৎকার। আমাদের তখন তাবৎ লীলাখেলার স্থান ওবাড়ির বিশাল উঠোন। ছোট বউ বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে কখনো বাড়িতে কখনো গঞ্জের বাসায়। তবে তাঁর বড় অংখার। তাঁর ‘সোয়ামি’র ওষুধের দৌলতেই তো ভাসুরের এই রমরম ‘প্যাকটিস’। নইলে শুধু ডাক্তারি জানলে আর কপয়সা? ভাই ‘ছাপ্লাই’ দেয় বলেই না মিনি মাঙনার ওষুধ, যার এমনি দাম গঞ্জে তিন পয়সা, তো গাঁয়ে বিকোয় তিন আনায়। নেবে তো নাও, না নেবে গঞ্জের থেকে আনো। এ কারণে ছোট বউ ক্রমশ আত্ম-ভবিষ্যৎ হিসেব করেন। এতগুলো ভাসুরঝি, তাদের বিয়ে ‘ছোডো জোনের’ ঘাড়ে গস্ত হয় তবে তো তাঁর নিজের এবং সন্তানদের ভবিষ্যৎ ‘ফাডা’। তাই একসময় ডাক্তারজ্যাঠার পসার মার খেতে থাকে ও বাড়িতে নিত্য তিরিশ দিন ঝগড়ার সূত্রপাত হয়। ছোট বউয়ের চাপাগলা তীক্ষ্ণতায় মাত্রা পায়। ডাক্তারজ্যাঠার স্বাভাবিক উচ্চকণ্ঠ এবং স্বভাবজ ‘গাইল খামার’ ক্রমশ উচ্চনাদী হয়। কিন্তু সে বিষয়ে পরে আসছি। আসল ব্যাপারটা বলি। ছোট বউ একসময় গঞ্জে গিয়ে অনড় হন। একদা কোনো একটা ঝগড়ায় ভাসুরকে তিনি সামনাসামনিই বলে ফেলেন, ‘ভাসুর না বাছুর’। অতঃপর তাঁর গঞ্জে গমন এবং আলাদা হওন আবশ্যিক হয়।

তখনও ডাক্তারজ্যাঠার পসার এমন কিছু কম নয়। কারণ ও দিগরে ডাক্তার বগে আর কেউ নেই। নগেনমশাই অবশ্য তখনও দেহে, কিন্তু গৃহে নেই। বৃদ্ধ হয়েছেন। অতিবৃদ্ধ। একমাত্র পুত্র হীরা বাতে পঙ্গু। নাতিদের শিক্ষা-সংস্কার কিছু নেই। সংসার অচল। রোগীপত্তরের অসদ্ভাব। একসময় বাড়িখানা বিক্রি হয়ে যায়। সপরিবারে তখন তাঁদের অবস্থান হয় আমাদের বাড়ির পশ্চিমের দালানে। দালান বলতে এ ক্ষেত্রে পাকাবাড়ি বুঝতে হবে। একতলা, তিন-চারটি কক্ষযুক্ত বাড়ি। আমরা বলতাম পশ্চিমের ঘর। ঘর অর্থে বাড়ি। তবে তা আমাদের চৌহদ্দির মধ্যে এবং দখলে। সেখানে কিয়ৎকাল স্থিতি করে মশাই সপরিবারে গঞ্জের এক আঘাটায়। তারপর আর খবর জানি না।

দাসজ্যাঠা ডাক্তার হিসেবে পসার জমিয়ে ফেলেছিলেন তখন। আগেই বলেছি, ওই বাড়িটি বাল্যে কৈশোরে অসামান্য আকর্ষণের স্থান ছিল। আকর্ষণের প্রধান হেতু ছিল ওই বাড়ির একটি বিস্তৃত খেলার অঙ্গন। তখন পঞ্চাশের শুরুয়াত। গ্রাম ইতস্তত খালি হয়ে চলেছে। তথাপি যে কয়েকটি পরিবার আছে, সেসব বাড়ির ছেলেপুলেরা, আমরা, ওই অঙ্গনে তখনকার দিনে ‘পলাপলি’, ‘কানামাছি’, ‘উপেন টি বাক্স’ ইত্যাদি খেলতাম। ডাক্তারবাড়ির মেয়েরা অনেক ধরনের খেলাধুলো জানত। তাদের মামাবাড়ি ছিল বরিশালের শহর-ঘেঁষা কাশীপুর গ্রামে। তারা প্রায়ই মামাবাড়ি যেত, আর ওখান থেকে শিখে আসত ওইসব খেলা। আমরা হরবখত কেন, কখনোই মামাবাড়ি যেতে পারতাম না। ওরা যখন ওদের মামাবাড়ির নানা গল্প, খেলাধুলোর খবর আমাদের বলত, বড় হিংসা হতো। একটি মজার খেলা, ওদের কাছে শিখে আমরা ওখানে খেলতাম। খেলাটির নাম ‘উপেন টি বাক্স’। খেলাটি একটি ছড়ার মাধ্যমে শুরু হতো—

উপেন টি বাক্স
রাইটানা ট্যাক্সো
বিবিয়ানা চুলটানা
রাজেনবাবুর বৈঠকখানা।
রাজবাড়িতে যেতে
পানের খিলে খেতে
পানের মধ্যে মরিচবাটা
ইস্কাবনের ছবি আঁটা। *

[* ছড়াটির অবশ্য অঞ্চলভেদে পাঠান্তর আছে। তবে, আমাদের ওখানে এটিই চালু ছিল।]

ছড়াটির বোধ হয় কোনো ‘সাহেবি’ কৌলীন্য এককালে ছিল। উপেন টি বাক্স এবং রাইটানা ট্যাক্সো কথা দুটির মধ্যে তার আভাস পাই। কথা দুটি বোধ হয় ‘চা’-এর প্রচলনকালের কোনও বিজ্ঞাপনি পদ্য থেকে নেয়া হয়ে থাকবে। ‘ওপেন টি বক্সেস/রাইট অ্যান্ড অ্যাকসেস’–এরকম পাঠেই একমাত্র এর অর্থন্যাস হয়। অবশ্য বাকি পদসমূহের অর্থকরণ করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি।

আমাদের মতো নাবালক-নাবালিকা ছাড়াও যারা ওখানে তখন যথেষ্ট ডাঙ্গর, তারাও ওই বাড়িতে বেশ ভিড় জমাত। গঞ্জের মামাদের আকর্ষণের সঙ্গে গাঁয়ের উঠতিদের আকর্ষণের একটা কার্যকারণ সম্পর্ক যে এ ব্যাপারে ছিল, তা পরে বুঝেছি। কিন্তু দাসজ্যাঠার পসার যতদিন শাঁসে-জলে ছিল, যতদিন গঞ্জের দোকান থেকে ওষুধের সরবরাহ অব্যাহত ছিল, ততদিন এ বাড়িতে এ ধরনের কদাচার শুরু হয়নি। এই বাড়িটি তখন প্রকৃতই একটি গৃহস্থবাড়ি ছিল। এ বাড়ির মেয়েরা ব্রত, উৎসব, খেলাধুলো এবং সাধারণ ঘর-গেরস্থালিতে বড় আনন্দময় জীবনযাপন করত, আমরাও সেই উৎসবের অংশী ছিলাম। সে সময়কার মাঘমণ্ডল, তারার ব্রত, তিল কুচারী ইত্যাদির কথা আজও মনে আছে।

এ বাড়ির সামনের অঙ্গনে আঁকা মাঘমণ্ডলের ব্রতচিত্র আমাদের বড় মোহিত করত। এখনও যেন চোখ বুজলে সেই আল্পনায়িত অঙ্গন উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। এখনও মাঘের ভোরে ঘুম ভেঙে গেলে যেন শুনতে পাই মাঘমণ্ডলের ওই ‘গৌরীরা’ সমস্বরে গাইছে—

যে জল ছোঁয়নালো
কাগে আর বগে
সেই জল ছুঁইলাম মোরা
দুব্বার আগে।

মনে হয়, যেন এক্ষুনি আমরা, পাড়ার ছেলেদের দঙ্গল, ডাক্তারবাড়ির ওই ব্রতের অঙ্গনের উদ্দেশে ছুট লাগাব। দাসজ্যাঠা সেখানে আমাদের সবার জন্য বাঁশপাতার অগ্নিকুণ্ড জ্বালিয়ে রেখেছেন, যাতে আমরা আগুন পোহাতে পারি। গৌরীরা এক্ষুনি আমাদের বলবে, ‘তোরাও আমাগো লগে গা’।–আমরা সেসব দিনে অবশ্যই গাইতাম ওদের সঙ্গে। নচেৎ ওরা যখন ‘আম কাঁঠালের পিঁড়ি’ ভাসাবে, তখন তো আমাদের নাম বলবে না, বা অন্য সময় পরণকথার গল্পও বলবে না। ব্রতশেষে রোজ তারা কাঁঠালের কুসীর নৌকো ভাসিয়ে গাইত

আম কাঁঠালের পিঁড়িখানি
গঙ্গাজলে ভাসে
আমার ভাইধনেরা
সেই পিঁড়িতে বসে।

আমরা তখন তাদের অনুরোধ করতাম, আমাদের নাম আলাদা আলাদা করে বলতে। তারা তখন গাইত–

আম কাঁঠালের পিঁড়িখানি
গঙ্গাজলে ভাসে
আমার ভাই অমুক
সেই পিঁড়িতে বসে।

সেই বয়সটায় মেয়ে-পুরুষের বিভাজন থাকে না। সে কারণে আমরা নির্মল শৈশবের অকৃত্রিম আনন্দের আস্বাদ পেতাম।

কিন্তু এ বাড়ির সবচেয়ে বড় দোষ যেটা ছিল, তা হচ্ছে মেয়েদের বিয়ের ব্যাপারে কত্তাদের উদাসীনতা। ডাক্তারজ্যাঠার ছজন মেয়ের মধ্যে শুধু বড়জনেরই বিয়ে হয়েছিল। তখন তার বয়স অনেক। সে অবশ্য দেশের বাড়িতে থাকত না। মামাবাড়ি না কোথায় যেন থাকত এবং সেখান থেকেই তার বিয়ে হয়েছিল। মেজ মেয়ের বিয়ে যখন হলো তখন ডাক্তারের পড়ন্তকাল প্রায়। কোনোরকমে নমো নমো করে বিয়ে। তারপরে আরও চারজন। তাদের সবারই বিয়ে-থা একসময় হয়েছিল, কিন্তু স্বজাতির মধ্যে নয়। ডাক্তারের তখন অবস্থা একান্তই খারাপ। ওই সময়েও নিম্নজাতীয় লোকেরা উচ্চজাতীয় কন্যা বিবাহ করলে কন্যাপণ দিত। ডাক্তারজ্যাঠা পরবর্তী এই চার মেয়ের বিয়েতেই কন্যাপণ নিয়েছিলেন। যতটুকু সমাজ তখনও এ অঞ্চলে অবশিষ্ট ছিল, সেই সমাজ তাঁকে এ জন্য রেয়াৎ করেনি। কিন্তু জ্যাঠার উপায় ছিল না।

প্রথমত ছোট বউ গঞ্জে স্থায়ী হলে তাঁর ওষুধ সরবরাহে বাধা পড়ে। দ্বিতীয়ত তখন গ্রাম শূন্য প্রায়। ডাক্তারজ্যাঠা বৃদ্ধ হয়েছেন, দূর-দূরান্তরে যেতে পারেন না। রোগীপত্তরের অসদ্ভাব। তাই কোনোরকমে মেয়েদের একটা গতি করলেন, যেমন ঘরেই হোক। কিন্তু এ অনেক পরের কথা। প্রকৃত সমস্যা শুরু হয়েছিল, যখন ছোট ভাই যিনি গঞ্জের বাজারে বাসাবাড়ি নিয়ে থাকতেন, হঠাৎ করে মারা যান। তিনি মারা যেতে ওষুধের সরবরাহ একেবারেই বন্ধ হয়ে গেল। উপরন্তু কিছুদিন বাদে দোকানের একটা বন্দোবস্ত করে ছোটবউ তাঁর পুত্র-কন্যা নিয়ে এসে বাড়িতে হাজির। তখনও জ্যাঠার চার মেয়ের বিয়ে বাকি। দুটি ছেলে নিতান্ত শিশু। ছোট বউ গঞ্জের বাসাবাড়িটি রেখে দিয়েছিলেন। মাঝে মাঝে গিয়ে থাকতেন। মহিলা বাইরের মানুষদের সঙ্গে অত্যন্ত নম্র ভদ্র ব্যবহার করতেন। কিন্তু বাড়িতে ক্রমশ হয়ে উঠলেন রণরঙ্গিণী। এখন সংসারের মূল ক্ষমতা তাঁর নিজের হাতে। দোকানে কর্মচারী রেখে কাজ চালান। মাসে একবার-দুবার গিয়ে, একে-তাকে দিয়ে হিসেব পরীক্ষা করিয়ে কড়ায়-গণ্ডায় বুঝে নেন। এসবই ঠিক ছিল। কিন্তু একদা তাঁর জ্ঞানচক্ষুর উন্মীলন হলে তিনি দেখলেন যে, সংসারে ঝগড়া করাটাই কিছু পরমার্থ নয়। বরঞ্চ কাঁচা মাংস কাঁচা পয়সা আনে। তিনি অতএব পয়সাকে আরাধ্য করলেন কাঁচা মাংসের বিনিময়ে। পয়সায় পয়সা ব্যবসায়ের মাধ্যমে আনার বুদ্ধি তাঁর ছিল। এক্ষণে কাঁচা পয়সার দিকে তাঁর নজর পড়ল। চোখের সামনে ভাসুরঝিদের মধ্যে তিনটি বেশ কাঁচা মাংসল যুবতী। সুতরাং তাঁর মনে বাণিজ্যবৃত্তির উদ্যোগের আবহসংগীত বেজে উঠল—

আয় লো অলি কুসুম তুলি
বাবুর বাগানে।

ছোট বউ দেখলেন, ভাসুরঝিরা বেশ ডাগর-ডোগর ডবকা। তাদের তখন ‘কান্ত কাহুন, কাম দারুণ’ অবস্থা। গ্রামের উঠতি যুবকেরা আসে, গল্পসল্প করে, তাদের লালা ঝরে। ঝরে ভাসুরঝিদেরও। কিন্তু চেনাজানার মধ্যে তখনও এমন কিছু সুবিধে সুযোগ তৈরি হয়নি যে, ‘ঐ দেহমূলে অনঙ্গ মথির অঙ্গেরও লইব স্বাদ’ এমতো প্রকরণে স্বীয় ‘পিরীতি’র আখর টানবে কেউ। তখনও পিছারার খালপারের জগতের ততটা দীনদশা হয়নি। ছোট বউ হিসেব করলেন, গঞ্জের লোকেদের কে চেনে এই পিছারার খালধারে? তিনি অকালে বিধবা হলে, যেহেতু তাঁর একটি সুন্দর আয়ের সংস্থান ওই ওষুধের দোকানটি ছিল, তাই অনেক অবস্থাপন্ন ভাই জুটে গিয়েছিল তাঁর যারা তাঁকে ওই গঞ্জের শহরে দেখভাল করত। অতএব, একসময় তিনি ভাবলেন যে তাঁর এইসব ভাইয়েরা যদি গ্রামের বাড়িতে মাঝেমধ্যে আনাগোনা করে, তবে গাঁয়েও তার প্রভাব-প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পায় এবং কিছু অনিবার্য কার্যকারণ সংঘটনে দুটো পয়সাও বাড়তি আয় হতে পারে।

আমি ছোট বউয়ের বাসাবাড়িতে বেশ কয়েকবার ইতিপূর্বে গিয়েছিলাম। আমাদের তখন তালুকদারির জীবন শেষ। নানা ফন্দিফিকির করে সংসারের অন্ন জোটানোর কাজ করতে হতো। তার মধ্যে একটি কাজ ছিল জঙ্গল থেকে শটি তুলে এনে পরিষ্কার করে টিনের আকসায় ঘষে জলে থিতান করে করে পালো তৈরি করা। এপারে এসে শটিফুড বলে একটা বালখাদ্যের নাম শুনেছি। বোধহয় সেই বস্তুটি আমাদের সেই শটির পালো। বস্তুটি বার্লিজাতীয়। যতদূর জানি, এখনও চাষে আসেনি, নিতান্ত জংলা। কিন্তু আমাদের এলাকায় তার স্বাভাবিক সৃজন অসুমার ছিল। আমরা একসময় এই বস্তুটিকে আর্থিক রোজগারের জন্য আশ্রয় করেছিলাম। অনেক ক্লেশের সেই পালো নিয়ে আমাকে শৈশবের সেইসব দিনে যখন গঞ্জে বিক্রি করার জন্য যেতে হতো, তখন ওই ছোট বউয়ের বাসাবাড়িতে আমি কখনো কখনো রাত্রিযাপন করতাম। ‘পালোটা’ তিনিই কিনে নিতেন ওজন করে। কিন্তু সে ওজনের মা-বাপ থাকত না। বাড়তি মাপটুকুকে তিনি বলতেন, এটুক আর মাপার কী আছে, বোঝতেই পারতে আছি, দিদি এটুক আমারে খাইতে দিছেন। মহিলা ছিলেন এমনই এক হিসেব-নিকেশের মানুষ।

ছোট বউয়ের বাসার সামনের গলির মধ্যেই ছিল বেশ্যাপল্লি। তাঁর জানালায় বসে ওই পল্লির লীলাখেলা দিব্য দেখা যেত। ওঃ কী ভয়ানক হুল্লোড়ই না সেখানে হত এবং কত রকমের চরিত্রই না সেখানে দেখা যেত! মনে আছে, একজন ‘হোঁতকা’ মোটালোক সেখানে যেত। আমি তখন প্রায়ই ‘পালো’ বিক্রি করতে গঞ্জে যেতাম এবং ওই ছোট বউয়ের বাসাবাড়িতে রাত কাটাতাম। সন্ধে হলেই আমি ওদের জানালাটির ধারে চুপটি করে বসে থাকতাম। ছোট বউ মাঝেমধ্যেই এসে জিজ্ঞেস করত, ‘ওয়া এত দ্যাহ কী অ্যাঁ? ওয়া দেহন নাই। ওয়া অসইব্য।’ কিন্তু আমি দেখতাম ওই হোঁতকা লোকটি এসেই হাঁক পাড়ত, ‘বিলাই, বিলাই, ও মোর বিলাই, আয়ো, হারমনিয়ামডা বাইর করো।’ বিলাই এসে হারমোনিয়াম বের করে দিয়ে নিজের কাজে চলে যেত। সেই মাতাল তখন গাইতে বসত–

প্রেম একবার এসেছিল নীরবে–

মদালস কণ্ঠে সে অনেকক্ষণ ধরে এই সংগীত-সাধনা করত। ছোট বউ বোধ করি তাঁর এই প্রতিবেশীদের নিত্যকর্ম সন্দর্শনে কর্মপন্থা স্থির করে থাকবেন। তারপর থেকেই গাঁয়ের বাড়িতে তাঁর ভাইদের অর্থাৎ এ বাড়ির মামাদের আগমনের সূত্রপাত হয়। ছোট বউ এভাবে তাঁর রোজগারের পথ প্রশস্ত করেন। আমরা যারা শহর-গঞ্জ বা নগরজীবনের তেমন খবর রাখতাম না, তারা সে কারণেই এ বাড়ির : বিষয়ে ততটা দুশ্চিন্তিত ছিলাম না। কিন্তু এসব ঘটনা বেশিদিন চাপা থাকে না। শহরের যেসব মধুপায়ীরা এখানে নিয়মিত এসে থাকত, একসময় তাদের পরিবারস্থ লোকেরা এসে হুজ্জোত বাধিয়ে দিল। এদের মধ্যে বেশির ভাগ লোকই ছিল বিবাহিত। অতএব তাদের আত্মজনেরা এসে এই মামাত্ব ব্যাপারটার ইতি করে দিলে ছোট বউয়ের ঈদৃশ ব্যবসা চোট খায় এবং তিনি একসময় গঞ্জে ফিরে যান।

অবাক কাণ্ড এই যে, আমাদের গ্রামের কর্তাব্যক্তিরা এ ব্যাপারটা নিয়ে কিছুমাত্র আলোড়ন করলেন না। তাঁরা যে এরকম একটা অনৈতিক কর্মকাণ্ডকে প্রশ্রয় দিতেন তা নয়। তবে তখনকার আর্থিক, সামাজিক রাষ্ট্রীয় পরিবস্থা তাঁদের করে তুলেছিল অসম্ভব উদাসীন। তাঁরা শুধু নিজেদের আহার, বস্ত্রসংগ্রহ এবং দৈহিক সুরক্ষা ব্যতীত সমাজজীবনের কোনো দায়দায়িত্বের প্রতিই মনোযোগী ছিলেন না। কোনো বিষয়েই যেন তাঁদের মন ছিল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *