বিষাদবৃক্ষ – ৩৯

ঊনচল্লিশ

পরদিন ভোর না হতেই সবার ওঠার আগে চুপিচুপি টিনের বাক্সটি নিয়ে বের হয়ে পড়লাম। চাকরবাকরেরা উঠে গিয়েছিল। এবং দরজা খোলা ছিল। আমি কায়দা করে সবার অলক্ষেই বেরিয়ে গেলাম। তখনও বেশ অন্ধকার। আগের রাতে বৃষ্টি হয়েছিল। বর্ষা আসতে আর বিলম্ব নেই। ভোরের বৃষ্টিভেজা হাওয়া নদীর স্নিগ্ধতা মাখিয়ে আমার ক্লেদাক্ত অনুভূতিকে যেন নির্মল করে দিতে লাগল। আমি অনুমানে লঞ্চঘাট অভিমুখে চলতে লাগলাম। পকেটে ভর্তি হওয়ার পয়সাগুলো ছাড়া তিন-চারটি অতিরিক্ত টাকা ছিল। ভাবলাম লঞ্চঘাটে গিয়ে প্রথমেই যে লঞ্চটি পাব তাতে চড়ে বাড়ি ফিরে যাব। যেখান থেকে বেরিয়ে এসেছি সেখানে কোনোক্রমেই আর যাব না। যদি সেই লোকটি এসে আমাকে অনুরোধও করে, তথাপি না।

লঞ্চঘাটে যখন পৌঁছোলাম তখন ভোরের আলো সবে ফুটেছে। আমি একটি লঞ্চ কোম্পানির অফিসের বারান্দায় একটি টুলের ওপর বসে রইলাম। অফিসটি তখনও খোলেনি। ফজরের আজান শুনে উঠে এসেছিলাম। গতরাত্রে ঘুমের খুবই ব্যাঘাত ঘটেছিল। তাই খানিকক্ষণ একা ওভাবে বসে থাকার পর খুব ঘুম পেল। টুলটির ওপর শুয়ে পড়ে আমি অতল ঘুমে তলিয়ে গেলাম। গভীর ঘুমের মধ্যে একটা তাৎপর্যপূর্ণ স্বপ্ন দেখতে থাকলাম। দেখলাম ওই শহরের সমস্ত লোক, তারা সবাই উলঙ্গ, তারা আমাকে তাড়া করে ধরতে আসছে। তারা সবাই বীভৎসদর্শন। আমি প্রাণপণে ছুটে পালাবার চেষ্টা করছি, কিন্তু পা চলছে না। কখনো দেখলাম জ্যাঠামশাই আমাকে দুহাতে তুলে চাকরদের দিকে নিক্ষেপ করছেন, বলছেন, এটাকে ভালো করে দুরুস্ত কর। এটা বাড়ির কুলাঙ্গার, সব মান-ইজ্জত-আভিজাত্য ডুবিয়ে দিয়েছে। মার এটাকে। এটা জনমজুর খাটে, বাড়ির নারকেল-সুপারি চুরি করে হাটে বিক্রি করে। এটা চোর, বদমাশ। আমি যেন হাত জোড় করে সবার কাছে মিনতি করছি, দেখো তোমরা আমাকে মেরো না। বড় খিদে পেয়েছে। আমাকে কিছু খেতে দাও। কিন্তু তথাপি প্রচণ্ড প্রহারে তারা আমাকে ছিন্নভিন্ন করছিল যেন।

হঠাৎ কে যেন আমাকে সজোরে এক ধাক্কা দিল। আমি ঘুমের ঘোরে না-আ, না-আ বলে চেঁচিয়ে উঠতে যে লোকটি ধাক্কা দিয়েছিল, সে শুধোলো, কি মিঞা, খোয়াব দ্যাখথে আছেলেন নাহি? তখন অনেক বেলা হয়ে গেছে। মুখের ওপর রোদ্দুর পড়েছে। আমি ধড়মড় করে উঠে বসতে ধুতি শার্ট পরা এক ভদ্রলোক, সম্ভবত যে লোকটি আমায় ধাক্কা দিয়ে তুলে দিয়েছিল তার ওপরওয়ালা, আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, কৈখনে আইচ? যাইবা কৈ? আমার স্বপ্নের বিভীষিকা তখনও কাটেনি। দুই হাতে চোখ রগড়িয়ে কোনোমতে আমি গন্তব্যস্থলের কথা জানালাম। তিনি খুব অবাক হয়ে আমাকে আরও কিছু প্রশ্ন করে মোটামুটি ব্যাপারটা বুঝলেন। সাজিয়ে গুছিয়ে মিথ্যে কথা বলাটা তখনও রপ্ত হবার মতো বয়স হয়নি। তাই তাঁর প্রশ্নের উত্তরে সত্য কথাই জানালাম। যার কাছ থেকে পালিয়ে এসেছি, সেই লোকটিকে তিনি চিনলেন, জ্যাঠামশাইকেও। খুব আশ্চর্য হয়ে আবার জিজ্ঞেস করলেন, কী কাণ্ড অ্যাঁ? ওই হারামজাদারে এই শহরে কে না চিনে? এক নম্বর মালউয়া। তোমার জ্যাঠায় তার কাছে তোমারে রাখতে গেলেন ক্যান? ছিঃ ছিঃ! আমি ভদ্রলোককে লোকটির গতরাতের আচরণ বিষয়ে কিছুই বলিনি। শুধু ওইখানে যে থাকা যাবে না, তা-ই বলেছিলাম। তাঁর প্রতিক্রিয়া দেখে বুঝলাম তিনি তাকে হাড়ে হাড়ে চেনেন এবং ঘৃণাও করেন।

এরপরে তিনি আমার পরীক্ষার ফল, বাড়ির অবস্থা ইত্যাদি শুনে বললেন যে, আমার বাড়ি ফিরে যাবার প্রয়োজন নেই। থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত তিনিই করে দেবেন। প্রতিদানে তাঁর সন্তানদের আমি পড়াব। প্রস্তাব শুনে আমি স্বর্গ হাতে পেলাম। তিনি আমাকে চা, রুটি, সন্দেশ ইত্যাদি খাইয়ে তাঁর স্ত্রীর কাছে একটি চিরকুট লিখে দিয়ে বললেন, এই লও। রিকশা ঠিক কইরা দিতাছি, স্যায় আমার বাসা চিনে। তোমারে পৌঁছাইয়া দিবঅনে। তোমার বউদিরে গিয়ে এই চিটখান দিবা। সব ব্যবস্থা অইয়া যাইবঅনে। আইজ আর কলেজে যাইবার হ্যাপা কইর না। বাসায় গিয়া খাইয়া লইয়া বিশ্রাম করো। কাইল যা অউক দেখন যাইব। তিনি ঢাকার টানে কথা বলছিলেন। শহরে আমার একটা আশ্রয় হলো।

পরের দিন ভদ্রলোক তাঁর পাড়ার একটি ছেলেকে আমার সঙ্গে দিয়ে বলে দিলেন যে, আমি নিতান্তই গ্রামের ছেলে, সে যেন ভর্তির ব্যাপারে আমাকে প্রয়োজনীয় সাহায্য করে। ছেলেটি আমার চাইতে বয়সে খানিকটা বড় হলেও কলেজের পথে যেতে যেতে তার সঙ্গে বেশ গাঢ় একটা বন্ধুত্ব গড়ে উঠল। ছেলেটি বেশ বুদ্ধিমান এবং পোড়খাওয়া। কলেজে ভর্তির কাজ সেরে ফেরার পথে এ কথা সে কথার শেষে সে বলল, দেখো, দাদা মানুষটি এমনিতে ভালোই কিন্তু খুব বদরাগী। তাঁর মেজাজ বুঝে চলবে। বউদি সম্পর্কে দেখলাম, তার মনোভাব বেশ কঠিন। তাঁকে যে সে আদৌ পছন্দ করে না, সে কথাটি বেশ পরিষ্কারভাবেই জানাল। তবে কেন বা কী বৃত্তান্ত সেসব বিষয়ে সে কিছুই বলল না। ছেলেটির নাম অহীন, অহীন ঘোষ।

কলেজে যাতায়াত শুরু করতে প্রাথমিক অবস্থায় আমি খানিকটা হতভম্ব হয়ে পড়েছিলাম। বিরাট বিরাট বাড়ি, সেইসব বাড়িতে বিভিন্ন বিভাগের ক্লাসরুম। বিস্তীর্ণ মাঠ। মাঠের এক প্রান্তে টানা হোস্টেলের টিনের বাড়ি। ব্যারাকের মতো ঝকঝকে তকতকে জামাকাপড় পরা ছেলেমেয়েরা বইখাতা হাতে ক্লাসে যাচ্ছে। কেউ কেউ ঘুরে বেড়াচ্ছে। বরিশাল ব্রজমোহন দত্ত কলেজ। আমার স্বপ্নের স্থান। কিন্তু আমার নিজের পোশাক-আশাকে বড়ই দীনতা মাখানো। মনে হতে লাগল এদের কেউ কেউ হয়তো আমারও সহপাঠী কিংবা পাঠিনী হবে। আমার এই দীন আকৃতি দেখে হয়তো এরা কেউই আমার সঙ্গে কথাবার্তা বলবে না। কারও সঙ্গে বন্ধুত্ব হবারও সম্ভাবনা নেই। মনটা বড়ই দমে গেল। আমি সরলভাবে একদিন অহীনকে সব খুলে বললাম। সে বিষয়টিকে আদৌ গুরুত্বই দিল না। সে জানাল, গ্রাম থেকে শহরে এলে প্রথম প্রথম এমনটা হয় বটে তবে কয়েক দিন গেলেই সব ঠিক হয়ে যায়। অহীনের পোশাকপরিচ্ছদও খুব একটা উঁচুমানের ছিল না। কিন্তু সে জন্য তার কোনো দীনতা ছিল না। ও বলল, দেখো এসব কিছু না। আমারও প্রথম প্রথম এরকম হয়েছিল। কেটে গেছে। আমিও গ্রামেরই ছেলে এবং তোমার মতোই দুস্থ। ওর কথা শুনে আমার বেশ আরাম বোধ হলো। অন্তত একজনকে পেয়েছি যার কাছে মন খুলে কথা বলতে পারব।

কথায় কথায় জানলাম তার বাড়ি জেলা সদরের কাছেই একটি গ্রামে। সেও শহরের কলেজে পড়তেই এসেছিল। হঠাৎ তার বাবা মারা যেতে পারিবারিক দুস্থতার কারণে পড়া ছেড়ে রোজগারের চেষ্টায় নেমে পড়তে হয়। বাড়িতে বিধবা মা এবং তিনটি ছোট বোন আছে। অহীনের আয়েই তাঁদের কোনোক্রমে চলে। পড়া ছেড়ে দিয়ে ও সদর হাসপাতালে সামান্য একটা চাকরি করে, আর বাকি সময় ট্যুইশানি করে কিছু আয় করে। শহরে আমারই মতো একটি বাড়িতে ছেলে পড়িয়ে থাকা-খাওয়ার সংস্থান। ওর কথা শুনে বড় কষ্ট হলো। আমার তবু বাবা আছেন। ওর অবস্থা আমার থেকেও করুণ।

আমার আশ্রয়দাতার ছয়টি ছেলে এবং একটি মেয়ে। মেয়েটি সবার ছোট। তাঁর স্ত্রী অতগুলো সন্তানের জননী হওয়া সত্ত্বেও যথেষ্ট সুন্দরী এবং যৌবনবতী। সংগীতশিক্ষা বিষয়ে বেশ অনুরাগিনী। সবসময়ই সেজেগুজে থাকতে ভালোবাসেন। বাড়িতে একটি সর্বক্ষণের চাকর আছে। সব কাজ, রান্নবান্না সে-ই করে। মহিলাকে কিছুই করতে হয় না। বেশ আরাম বিলাস এবং সংগীতচর্চায়ই দিন কাটে। মাত্ৰ এই কয়েকটি দিনেই দেখলাম তাঁর স্তাবকসংখ্যা অনেক। তাঁরা শহরের বেশ উচ্চবিত্ত। সাহিত্য, সংগীত ইত্যাদি নিয়ে প্রায় প্রতি সন্ধ্যায়ই বাড়িতে আসর বসে। চলে প্রায় রাত দশটা সাড়ে দশটা পর্যন্ত। বড় ছেলেটিকে পড়াবার জন্য একজন আলাদা শিক্ষক। ছেলেরা আমার কাছে দুবেলা পড়ে। পড়া অবশ্য তাদের বিশেষ কিছুই হয় না। কারণ তারা প্রত্যেকেই একেকটি মূর্তিমান বিভীষিকা। তারা এতজন না হয়ে একজন মাত্র হলেও আমার পক্ষে সামলানো অসম্ভব ছিল। এখানে আসার পর দিন থেকেই ব্যাপারটি আমি বুঝতে পেরেছিলাম। মহিলা অবশ্য এসব বিষয়ে পুরোপুরি উদাসীন ছিলেন। নিজের জগৎ নিয়ে তিনি এতই মশগুল থাকতেন যে, সন্তানদের বিষয়ে ব্যয় করার মতো কোনো সময়ই থাকত না তাঁর।

অহীন এসব জানত। একদিন বলল, তোমাকে ভয় দেখাচ্ছি না, তবে ওখানে থাকা তোমার পক্ষে সম্ভব হবে বলে বোধ হয় না। হলেও পড়াশোনা যে আদৌ করতে পারবে না, সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত। একে তো শ্রীমতী গানেশ্বরীর সারা দিনব্যাপী গলার ব্যায়াম করা, তার ওপর ছেলেগুলো একেকটা হাড়বজ্জাত। দিনভর হুড়াঙ্গামা করে বেড়ায়, পাড়াপড়শিরা ওদের দৌরাত্ম্যে অতিষ্ঠ। আবার সন্ধেবেলা গান, সাহিত্য, শিল্প নিয়ে নিত্যকার মাইফেল। তুমি যে কদিন ওখানে টিকতে পারবে ঈশ্বর জানেন। কিন্তু আমি তখন তার এই দুশ্চিন্তাকে আমল দিইনি। কারণ, সদ্য সদ্য ওই আশ্রয়টি আমার প্রায় অলৌকিকভাবে জুটেছে। চেষ্টা তো করতেই হবে। তখনকার নিয়ম অনুযায়ী ম্যাট্রিকুলেশন পাস করলে আইএআইএসসি বা আইকম পড়তে হতো। আমাদের বছর থেকে নিয়ম হলো এগারো ক্লাস/বারো ক্লাস। বারো ক্লাসে পাস করলে বিএ ইত্যাদি। আমি সাইন্স নিয়ে এগারো ক্লাসে ভর্তি হয়েছিলাম। বিজ্ঞান বিষয় হিসেবে আমার কাছে আকর্ষণীয় ছিল না। তদুপরি পড়াশোনা করার এই হাল। এ কারণে আমি আর্টসের বিভাগে চলে গেলাম। বিশ্বাস ছিল পরীক্ষার আগে দিনকয়েক কলেজ কামাই করে ঠেসে পড়তে পারলে উতরে যাব। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অহীনের সঙ্গে ব্যবস্থা করলাম যে, যতদিন পারি দুপুরে তার ঘরে গিয়ে গোপনে পড়াশোনাটা সেরে নেব। অহীন খুব সাগ্রহে সম্মতি জানাল। সে-ই ইতোমধ্যে একটি ছাত্রীও জুটিয়ে দিয়েছিল। কলেজের পর তাকে পড়িয়ে বাসায় ফিরতাম। মাইনে দশ টাকা। ষাট/বাষট্টির কালে দশ টাকা বড় কম পয়সা ছিল না। হাতখরচের জন্য তার প্রয়োজনও ছিল। সেসব দিনে আমার দৈনন্দিন রুটিন ছিল—ভোর চারটে/সাড়ে চারটে নাগাদ উঠে রাস্তার কল থেকে বালতি করে জল এনে ড্রাম ভর্তি করা। দুবেলা রান্নার জন্য কয়লা ভাঙা। বউদি সাড়ে চারটা-পাঁচটা থেকে গলা সাধেন, চলে সাড়ে ছটা পর্যন্ত। তারপর চা-জলখাবার খাওয়া। সাতটা থেকে ছেলেদের পড়াশোনা নিয়ে বসা। মাঝে মাঝে বড়টিকেও নিয়ে বসতে হয়। নটা পর্যন্ত এই চলে। তারপর স্নান খাওয়া সেরে কলেজ। কলেজ ট্যুইশানি ফেরত আবার সেই রুটিন। এর মধ্যে আবার বাজার করার দায়িত্বটাও দাদা আমাকে নিতে বললেন। ফলে পড়াশোনার জন্য কোনো সময়ই আর থাকল না। জল তোলা, কয়লা ভাঙা এবং বাজারের দায়িত্বটা আগে ছিল চাকরটির। এখন অন্য কাজ দুটির জন্য খুশি হলেও বাজারের ব্যাপারটা হাতছাড়া হওয়ায় সে আমার ওপর বিলক্ষণ চটে গেল। সে ভাবল, এ ব্যাপারে নিশ্চয়ই আমার হাত আছে। ভোর চারটে থেকেই দাদা বিছানার ভেতর থেকে হাঁক পাড়তেন জলটা তাড়াতাড়ি ধরার জন্য। দেরি হলে লাইন পড়ে যাবে। শীতের দিনে এই কাজটায় আমার বেশ কষ্ট হতো। গরম জামাকাপড় বিশেষ ছিল না বললেই চলে। এই শহরে অনধিক নয়-দশ মাস আমার স্থায়িত্ব ছিল। এখন তারই বৃত্তান্ত বলব।

ব্রজমোহন কলেজে আমার কলেজজীবন খুব খারাপ কাটছিল না। অসামান্য কিছু অধ্যাপক-অধ্যাপিকা সেখানে ছিলেন। সর্বজনশ্রদ্ধেয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী সাহেব ছিলেন আমাদের অধ্যক্ষ। তখন তাঁর যুবাবয়স, একটু হ্রস্বদেহ হলেও অত্যন্ত সুদর্শন এবং নিজস্ব বিষয়ে অসামান্য জ্ঞানী এবং ছাত্রদের প্রতি খুবই সহানুভূতিশীল মানুষ ছিলেন তিনি। তাঁর কাছে বিভিন্ন ব্যাপারে যতবার গিয়েছি বুঝেছি তিনি প্রকৃতই একজন অধ্যাপক। তাঁর কোনোরকম সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি কোনো দিন আমার নজরে অন্তত পড়েনি। অন্য অধ্যাপক-অধ্যাপিকাদের মধ্যে যাঁদের কথা বিশেষ করে মনে আছে এবং যাঁদের সাহচর্যে এসেছি, তাঁরা হলেন মনোরমা গুহঠাকুরতা, রফিকুল ইসলাম এবং দ্বিজেন শর্মা। সবাই স্ব স্ব ক্ষেত্রে অসাধারণতার স্বাক্ষর রেখেছেন। দ্বিজেন শর্মা এখন প্রায় অশীতি ছুঁই-ছুঁই। তাঁকে অবশ্য তখন বেশি দিন পাইনি। বোটানির লোক। প্রথমে ছিলেন ডিমনস্ট্রেটর। পরে অধ্যাপক হন। কিছুদিন পরে তিনি ঢাকা চলে যান। বাংলাদেশ যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই তিনি মস্কো যান হায়াৎ মামুদ এবং আরও অনেকের সঙ্গে এবং দীর্ঘকাল প্রগতি প্রকাশনায় অনুবাদকের কাজ করেন। আজ পর্যন্ত তাঁর সারস্বত সাধনা অব্যাহত। আমার সঙ্গে অদ্যপি যোগাযোগ বর্তমান।

সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে রফিকুল ইসলাম সাহেবের কথা। তাঁর মঙ্গোলিয়ান ধাঁচের মুখাকৃতি, ছুঁচোলো গোঁফ এবং রসিক মেজাজটির কথা আজও মনে পড়ে। মতবাদের দিক দিয়ে কম্যুনিস্টপন্থি ছিলেন। তিনি আমাদের বঙ্কিমের কমলাকান্তের দপ্তরের কিছু নির্বাচিত প্রবন্ধ পড়াতেন। তাঁর পড়ানোর রকমটি এমন চমৎকার ছিল যে, একটু মনোযোগ সহকারে শুনলে বাড়িতে আর পড়তে হতো না। মানুষটি আমাদের কাছে খুবই প্রিয় ছিলেন, কিন্তু অধ্যাপকমহলে তাঁর সুখ্যাতি ছিল না। শুনেছি তাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শ এর জন্য দায়ী ছিল। অবশ্য এ নিয়ে তাঁর কোনো নালিশ ছিল না। ভদ্রলোক কবিতা লিখতেন একসময়। কী এক অজ্ঞাত কারণে ষাটের দশকের একেবারে শেষ নাগাদ তিনি নাকি আত্মহত্যা করেছিলেন বলে শুনেছি।

কবীর চৌধুরী সাহেব একসময় অধ্যাপনা ছেড়ে আমেরিকাতে পড়াশোনা করতে গেছেন। পরে ঢাকা বাংলাদেশ অ্যাকাডেমির মহাপ্রবন্ধকও হন। তিনি এখনও ঢাকায় আছেন এবং যতদূর জানি সুস্থই আছেন। অনুবাদক হিসেবেও তিনি যথেষ্ট সুখ্যাতির অধিকারী। আমার অতিস্বল্পকালের ওখানকার কলেজজীবনে এঁরাই আজও স্মৃতির অধ্যাপক হিসেবে আছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *