বিষাদবৃক্ষ – ৪০

চল্লিশ

আমার আশ্রয়দাতার বাসায় পূর্বোক্ত সব কাজকর্ম করা, কলেজ করা এবং ছাত্রী পড়ানো সেরেও আমি শহরটিকে ভালো করে দেখার লোভও সংবরণ করতে পারিনি। শহরটি আমাকে ভীষণভাবে আকর্ষণ করেছিল। তার অলিগলি, অন্ধিসন্ধি সব জানবার এবং চিনবার এক উদগ্র আকাঙ্ক্ষা আমাকে পেয়ে বসেছিল। পকেটে প্রায় কিছুই তখনকার দিনে থাকত না। কিন্তু পায়ে হেঁটে শহরকে প্রদক্ষিণ করা বা মেপে নেয়ার ব্যাপারে আমার কোনো ক্লান্তি ছিল না। সময় সুযোগ পেলেই আমি ঘুরে ঘুরে শহরটিকে দেখতাম। আমার জীবনের প্রথম শহর। এ কারণে বহু বিশিষ্ট এবং অবিশিষ্ট সাধারণজনের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটেছিল। কচিৎ কদাচিৎ সময় পেলে অহীন আমায় সঙ্গ দিত।

এ প্রসঙ্গে আমি বিস্তারে যাব না। বিশিষ্টজনেদের বিষয়েও কিছুমাত্র জানাবার আকাঙ্ক্ষা আমার নেই। শুধু একজন পতিতা নারীর জীবনসংগ্রাম এবং অপরিমাণ স্নেহের কিছু আখ্যান বলার চেষ্টা করব। এই শহর পরিক্রমাকালে, এক ছুটির দিনে দুপুরে অহীন আমাকে নিয়ে গেল সেই গলিতে, যে গলিটি শহরের হসপিটাল রোড ধরে ব্রজমোহন কলেজের দিকে যেতে বাঁ হাতে পড়ে। এটিই ছিল শহরের পতিতাপল্লি। সাধারণত এই গলি দিয়ে আমরা যাতায়াত করতাম না। অহীন গলির একেবারে প্রত্যন্তে একটি কুঁড়েঘরের সামনে দাঁড়িয়ে ডাকল, মাসিমা—দরজা খোলো, আমি অহীন। দরজার ঝাঁপ খুলে যে বৃদ্ধা এসে দাঁড়ালেন, তাঁকে আমি চিনি। তিনি প্রায়ই আমার আশ্রয়দাতার বাড়ি যান। তাঁর মেজপুত্রটি এই মহিলার বিশেষ আদরের। সবাই সেখানে তাঁকে মাসিমা বলে ডাকে, আমিও। কিন্তু তিনি যে এই পাড়ায় থাকেন তা জানতাম না। বাসায় তাঁর সম্পর্কে বেশ একটু ছুঁৎমার্গীয় ভাব দেখেছি, বিশেষ করে বাসার গিন্নির ব্যবহারে। তাঁর এই মহিলার বিষয়ে বিরক্তি কখনোই গোপন থাকত না। শুনেছিলাম মহিলা আমার আশ্রয়দাতার কী রকমের যেন মাসিমা হন। তিনি তাঁর প্রতি খুব একটা অসদয় ছিলেন না। মাসিমা ওই বাসায় সাধারণত দুপুরের দিকেই যেতেন এবং আমি থাকলে আমার সঙ্গে খানিকটা গল্পও করতেন। বাড়ির সবচেয়ে দুরন্ত মেজ ছেলেটি দেখতাম তাঁর কাছে খুব শান্ত থাকত। বউদি সাধারণত এ সময় বাসায় থাকতেন না। মেজ ছেলেটিকে যে তিনি একেবারে ছোট থেকে মানুষ করেছেন, সে কথা তাঁর কাছেই শুনেছিলাম। অসম্ভব ভালোবাসতেন তিনি এই ছেলেটিকে। যখন আসতেন তাকে নিয়েই বেশিক্ষণ সময় কাটত তাঁর। এ নিয়ে দাদা বউদির ভেতরে মাঝে মাঝে কথা কাটাকাটিও হতো। কিন্তু তখনও ব্যাপারটির রহস্য আমার কাছে পরিষ্কার হয়নি। আজ এই পাড়ায় তাঁকে দেখে আমার সংস্কারে প্রচণ্ড আঘাত লাগল। কারণ, জানতাম যে ওই এলাকায় কোনো ভদ্রগৃহস্থের বাসা নেই।

যা হোক ঝাঁপ খুলে আমাদের দেখে মাসিমা খুবই আন্তরিকতার সঙ্গে ‘এসো বাবা এসো বাবা’ বলে আমাদের ভেতরে নিয়ে গেলেন। বাঁশের দরমার বেড়া এবং টালির চালার একখানি বেশ বড় ঘর। মেঝে মাটির। এক কোনে কিছু হাঁড়ি কড়াই বাসন এবং রান্নার উনুন। বাকি জায়গায় গুটিয়ে রাখা কয়েকটি কাঁথা-কাপড়ের বিছানা। জনা দুয়েক বৃদ্ধ বসে আছেন। বিছানার সংখ্যা দেখে মনে হলো আরও কয়েকজন সেখানে থাকেন। অহীন জানতে চাইল, আর সব কোথায়? ‘ভিক্ষেয় গেছে। আজকে আর আমরা বেরোব না। আজ ওদের পালা।’—বলে মাসিমা যেন খানিকটা অস্বস্তিভরে আমার দিকে চাইলেন। হয়তো ভাবছিলেন তাঁদের ভিক্ষেবৃত্তির কথা আমি জানি কি না অথবা অন্য কিছু। খানিকক্ষণ নানা কথাবার্তা বলে অহীন পকেট থেকে দুটো টাকা বের করে মাসিমার হাতে দিয়ে বলল, ঘুরতে ঘুরতে এসে পড়লাম। দুপুরবেলা, কিছু আনতে পারিনি। এইটা রাখো। বিকেলে যা হোক কিছু কিনে কেটে খাও। এর বেশি কিছু করি এমন তো উপায় আমার নেই। মাসিমা বললেন, তুই আর কত করবি? মরণও হয় না। কত পাপ যে করেছি। অহীন বাধা দিয়ে বলল, ব্যস ব্যস, এসব কথা বললে আর আসব না বলে দিচ্ছি। কিন্তু কী ব্যাপার, দুপুরবেলা এলাম, জল-বাতাসা দিলে না? তা ছাড়া ও আজ প্রথম এলো তোমার কাছে।—দাঁড়া। বলে মাসিমা বাইরে কোথায় গেলেন। খানিক বাদে ঝকঝকে একটা পেতলের ঘটিতে একঘটি জল আর একটা কাগজের মোড়কে কিছু বাতাসা এনে সামনে দিয়ে বললেন, ছিল না। জবার ঘর থেকে আনলাম। মেয়েটা আমাকে খুব মানে। বিপদে-আপদে যথাসাধ্য করে। কিন্তু করবে কী করে, ওর ঘরে বসে কজন আর? তার ওপর পুলিশ, গুণ্ডা, মাতাল এরা তো পয়সাই দেয় না।

জল-বাতাসা খেয়ে অহীন আর আমি বিদায় নিলাম। মাসিমা গলির মুখ অবধি এগিয়ে দিয়ে বললেন, আবার এসো, বাবা। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি যে এখানে এলে এ কথাটা বাসায় বোলো না। তোমার বউদি রাগ করতে পারে।

মাসিমা চলে গেলে অহীন জিজ্ঞেস করল, মাসিমার বাসায় এনেছি বলে রাগ করোনি তো?

–না, তবে একটু অস্বস্তি বোধ করছি।

এঁর বিষয়ে তুমি কতটা জানো? আমার যে এতটা জানা ছিল না, এ কথা বলায় অহীন খুব অবাক হয়ে গেল। বলল, সেকি? এ নিয়ে বাসায় বিতণ্ডা শোনোনি কিছু? বললাম, শুনেছি তবে গোটা ব্যাপারটা বুঝিনি ঠিকমতো। আমি জানতাম উনি দাদার দূর সম্পর্কের মাসি, দুস্থ। মাঝে মাঝে দাদা দু-দশ টাকা সাহায্য দেন তাই বউদির রাগ। অহীন বলল, তা হলে তুমি কিছুই জানো না। বলার মতো কাহিনি এটা নয়, তবে পাছে এই মহিলাকে তুমি ভুল বোঝো বা অশ্রদ্ধা করো, তাই গোটা বৃত্তান্ত তোমার জানা উচিত। চলো আমরা সদর রোডে বিপিন মহল্লার ওখানে গিয়ে খানিক বসি।

বিপিন মহল্লা নামটি আসলে ভুল উচ্চারণের ফল। আসল নাম ছিল বিবির মহল্লা। এখন সেখানে সদর পৌরসভার অফিস। অফিসের সামনে সারি সারি বিশালকায় পাম গাছ সাহেব আমলের অহংকার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আছে কিছু অন্য গাছপালাও। চারদিকে বাঁধানো একটি সুন্দর পুকুর। বেশ মনোরম জায়গাটি। চার পয়সার বাদামভাজা কিনে দুজনে একটা গাছের ছায়ায় বসলাম। অহীন বাদামভাজা খেতে খেতে মাসিমার দূরদৃষ্টের কাহিনি বলতে লাগল। সে কাহিনি এ দেশে কিছু নতুন নয়। আর পাঁচটা ঘটনার মতোই। তবু অহীন যেমন বলল তা-ই লিখছি।

মাসিমা আমার আশ্রয়দাতা দাদার দূরসম্পর্কের নন, আপন মাসিমাই। অহীন, মাসিমা, দাদারা সবাই ঘোষবংশীয়। শিক্ষায়, ধনে মানে না হলেও তাঁরা গাভার অধিবাসীই ছিলেন একদা। পরে এই শহরে এসে স্থায়ী হন। গাভার ঘোষেরা নানা কারণে খুবই বিখ্যাত। মাসিমার বাবা বিখ্যাত লোক না হলেও বেশ বনেদি গেরস্ত ছিলেন। যথাসময়ে মাসিমার বিয়েথাও দিয়েছিলেন। একটি ছেলেও হয়েছিল তাঁর। স্বামী সদরে মোটামুটি ভালো ব্যবসা করতেন। পাটের ব্যবসা ছিল তাঁর। বেশ সচ্ছল সুখী সংসার ছিল মাসিমার। নথুল্লাবাদে নিজস্ব বাড়ি, পাকা মেঝে, কাঠের ফ্রেমে টিনের ছাউনি। ব্যবসার কাজকর্ম সেরে, দোকান এবং গুদাম ঘরগুলোয় তালা বন্ধ করে বাড়ি ফিরতে প্রায়ই রাত হতো ভদ্রলোকের। ছেলে তার মামার বাড়িতে থেকে গাভা হাই স্কুলে পড়ত। তখন ক্লাস টেনে পড়ে সে। এই সময় কুখ্যাত বরিশাল রায়ট হয়। দাঙ্গার প্রথম দিনেই ভদ্রলোকের দোকান লুট হয় এবং গুদামগুলো পুড়িয়ে দেয়া হয়। তিনি কোনোক্রমে পালিয়ে বাড়ি আসেন। কিন্তু গুণ্ডারা তাঁর পেছন ছাড়েনি। প্রায় দশ-বারোজন গুণ্ডা দরজা ভেঙে ঢুকে ঘরের খুঁটির সঙ্গে তাঁকে বেঁধে মাসিমার ওপর চড়াও হয়। মাসিমার তখন বয়স তেমন কিছু কম নয় আটতিরিশ-চল্লিশ হবে। তবে দেখতে সুন্দরী এবং স্বাস্থ্যবতী। গুণ্ডাদের মধ্যে অনেকেই ভদ্রলোকের পরিচিত ছিল। সে কারণেই হোক অথবা দাঙ্গা, লুটের উৎসাহে তারা মাসিমাকে তুলে বাইরে নিয়ে ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। ভদ্রলোক আগুনে পুড়েই মারা যান। সাগরদির একজন বয়স্ক মুসলমান ভদ্রলোক এই ঘটনার তিন দিন পর কালিজিরা নদীর পারের একটা ঝোপ থেকে মাসিমাকে উদ্ধার করেন। তখন তাঁর শরীরে একগাছা সুতোও ছিল না। সমস্ত দেহ আঁচড়-কামড়ের ক্ষত। সে এক বীভৎস রক্তাক্ত অবস্থা। তবু তাঁর প্রাণটুকু ছিল। মুসলমান ভদ্রলোক তাঁকে তাঁর বাড়িতে নিয়ে এসে চিকিৎসাপত্তর করিয়ে সুস্থ করে তোলেন। খোঁজখবর করে গাভায় তাঁর বাপের বাড়িতে খবর দেন। বাবা তখন বেঁচে নেই। মা ভাইয়েরা আছে কিন্তু দাঙ্গার প্রাবল্যে একেকজন একেক জায়গায় পালিয়ে বেড়াচ্ছে, শুধু মা বাড়িতে।

ভদ্রলোক খবর দেয়ার বেশ কয়েক দিন পর দাঙ্গার প্রকোপ কমলেও বাড়ির কেউ এলো না। তখন তিনি মাসিমাকে সঙ্গে নিয়ে তাঁর বাপের বাড়ি গিয়ে পড়শিদের কাছে জানলেন যে, তারা সবাই হিন্দুস্থান চলে গেছেন গোপনে। মাসিমা ততদিনে নিজের ভাগ্য মোটামুটি বুঝে গেছেন। কান্নাকাটি করতে করতে একসময় বুঝে গেছেন এতে কোনোই লাভ নেই। উলটো আশ্রয়দাতার এবং তাঁর বাড়ির মানুষদের অশান্তি বাড়ানো। তাই একদিন তিনি ভদ্রলোককে বললেন, বাবা, আপনি আমাকে নিজের মেয়ের মতো আগলে বাঁচিয়ে রেখেছেন এতদিন। কিন্তু এভাবে তো সারা জীবন কাটবে না। আপনি বরং আমাকে আমার নথুল্লাবাদের বাড়িতে থাকার মতো ব্যবস্থা করে দিন। ওই পোড়া টিন, কাঠ যা আছে তাই দিয়ে। আর্যলক্ষ্মী ব্যাংকে আমার স্বামীর কিছু টাকাপয়সা আছে আমি জানি। সেই টাকার ওয়ারিশ আমি। আপনি যদি দাঁড়িয়ে থেকে একটু ব্যবস্থা করেন। মুসলমান ভদ্রলোক বলেছিলেন, মা, আমি জানতাম তোমাদের সমাজ খুব নিষ্ঠুর, কিন্তু এতটা জানতাম না। আবার আমাদের সমাজও যে খুব উদার তা-ও নয়। কিন্তু সেসব যাউক, তুমি যেমন বললে, তা-ই হবে। তবে তোমার ছেলেকে যাতে কাছে এনে রাখতে পারো সেই চেষ্টাও দেখতে হবে। ছেলে নিশ্চয় তার মামাদের সঙ্গে কলকাতায় আছে। যা হোক দেখি কী করতে পারি।

অহীন বলেছিল, ব্যবস্থা সেরকমই করা হলো। কিন্তু দুঃখ পাওয়া মাসিমার জন্য বরাদ্দ ছিল। সেই মুসলমান ভদ্রলোকই সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। ছেলের খোঁজও পেয়েছিলেন, কিন্তু সে আসতে রাজি হয়নি। ছেলে তখন ম্যাট্রিক পাস করে বঙ্গবাসী কলেজে পড়ে। বেলেঘাটায় মামাদের কাছে থাকে। আমি জানতে চাইলাম, ছেলে আসতে চাইল না কেন? অহীন ম্লান হেসে উত্তর দিয়েছিল, তার মায়ের জাত গিয়েছে বলে। বহুদিন তিনি মুসলমানের বাড়িতে থেকে তাদের অন্নজল খেয়েছেন –সুতরাং জাত তো গেছেই। তা ছাড়া দাঙ্গায় লুট হয়ে যাওয়া, ধর্ষিতা মেয়েমানুষকে আমাদের সমাজ কবেই-বা ফেরত নেয়, সমাজ আছে না?

দেশব্যাপী ওই ঘোর তমসার কালেও সমাজ বড় জাগ্রত দৃষ্টি রেখেছিল যাতে জাত না যায়। সে যা হোক, তারপর থেকে মাসিমার একক জীবনসংগ্রাম। ব্যাংকের টাকা ফুরোতে সময় লাগেনি। মুসলমান ভদ্রলোক যতদিন বেঁচেছিলেন, ততদিন যা হোক করে দুমুঠো খাবার জুটেছিল, তিনি মারা গেলে মাসিমা প্রকৃত অসহায় এবং অরক্ষিত হলেন। বাপের বাড়ির গ্রাম গাভা এবং আশপাশে অনেক আত্মীয়স্বজন ছিল। কিন্তু তাদেরও সমাজ এড়িয়ে কিছু করার সাহস বা মানসিকতা ছিল না। সুতরাং উপোস এবং উঞ্ছবৃত্তি। এই সময় এক বুড়ি প্রায়ই ভিক্ষে করতে আসত। মাসিমার কাছে ভিক্ষে পেত না, তবু আসত। দুদণ্ড দুঃখের কথা বলত। সে-ই বুদ্ধিটা দেয়। তার পরামর্শে বাড়িটা সামান্য দামে বিক্রি করে দিয়ে মাঝবয়সি মাসিমা নিষিদ্ধ এলাকার একটি খোপরিঘরে উঠে আসেন। তখনও হয়তো ভাবেননি যে, ওই পাড়ারই কদর্য জীবন তাঁকে অবলম্বন করতে হবে। কিন্তু স্থানমাহাত্ম্য বলে একটা ব্যাপার তো আছে, আর বাড়ি-বেচা টাকাও একসময় শেষ, অতএব কুপি হাতে দরজার কাছে একদিন দাঁড়াতেই হলো। মাসিমার গৃহস্থজীবন পঙ্কিলতায় ডুবে গেল, যার জন্য তাঁর কোনও দায়িত্ব ছিল না। কীরকম যেন সহজসরল অথচ পূর্বনির্ধারিতভাবে গোটা ব্যাপারটা ঘটে ঘটে গেল। আত্মীয়স্বজনেরা এ নিয়ে দূর দূর ছি ছি করল। নানারকম সরস গল্পগুজব ছড়াল, এমনকি তাঁর স্বামীকে পুড়িয়ে মারার ব্যাপারে যে তিনিও জড়িত ছিলেন এ কথা বলতেও তাদের আটকাল না। মাসিমা সবই শুনতে পেতেন, কিন্তু তাঁর কীই-বা করার ছিল।

আমার আশ্রয়দাতা ভদ্রলোক একটা লঞ্চ কোম্পানির ম্যানেজারের চাকরি নিয়ে এ শহরে এসে আস্তানা গাড়ারও বেশ কিছুকাল পরে মাসিমার সন্ধান পান। তিনিও সবই জানতেন, কিন্তু তখন মাসিমা ভিক্ষেজীবী। মাঝবয়সে দেহব্যবসা অবলম্বন করতে হয়েছিল বলে বছর পাঁচ-ছয়েকের মধ্যেই তিনি ভগ্নস্বাস্থ্য এবং রোগগ্রস্ত। এই জীবনযাপনের প্রায় অনিবার্য রোগের জন্য মাশুল গুনতে হচ্ছে তাঁকে। দাদা খোঁজ পাবার পর অন্তত একটা বড় কাজ করেছিলেন তাঁর জন্য। ভালো ডাক্তার দেখিয়ে রোগটা সারিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু বউদির জন্যই বিশেষত, মাসিমাকে বাসায় আশ্রয় দিতে পারেননি। নচেৎ খেয়ালি এবং দাপুটে স্বভাবের মানুষ তিনি, সমাজ-টমাজ খুব একটা তোয়াক্কা করতেন না।

এর সবই অহীনের কাছে শোনা। অহীন আরও বলেছিল যে, মাসিমা একদিন দাদার বাসায় গেলে বউদি নাকি চূড়ান্ত অপমান করেছিলেন তাঁকে। দাদা অনেক অনুরোধ জানিয়েও তাঁকে নিরস্ত করতে পারেননি। উলটো বউদি আরও ক্ষিপ্ত হয়ে দাদাকে বলেছিলেন, তোমার লজ্জা করে না একটা বুড়ি খানকির হয়ে আমার সঙ্গে ঝগড়া করছ। অহীন বলেছিল, সেই দিন প্রথম দাদার রাগ দেখেছিলাম। ক্রোধে দিশেহারা হয়ে সপাটে দুখানা চড় কশিয়ে দিয়েছিলেন বউদির গালে এবং বলেছিলেন, এইরকম শব্দ যদি জীবনে আর উচ্চারণ করিস জ্যান্ত পুঁতে ফেলব। তা ছাড়া তুই নিজে কী? তুই ভাবছিস তোর মতিগতি আমি বুঝি না। মাসিমা অসহায় হয়ে অভাবে যা করেছেন, তুই তো স্বভাবের জন্য তা-ই করছিস। অহীন বলল, কিন্তু আশ্চর্য কি জানো? মাসিমা এ জন্যে দাদাকেই তিরস্কার করলেন। বললেন, ‘ছি ছি, তুই বউয়ের গায়ে হাত তুললি। ওর কী দোষ? সবাই যা বলে ও তা-ই বলেছে। মিথ্যে তো কিছু বলেনি।’ আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম, কিন্তু করার কিছুই ছিল না। আমিও অবশ্য দাদার আচরণ এবং তুই-তুকারি করে স্ত্রীর সঙ্গে বচসা করাটা মানতে পারিনি। কিন্তু তাঁর জায়গায় আমি হলেও হয়তো ওরকমই করতাম। এটা বছর দুয়েক আগের ঘটনা। তারপর মাসিমা বেশ কিছুদিন আসেননি। কিন্তু ছেলেটার টানে তাঁকে আসতেই হয়। তবে আগে জেনেশুনে নেন, বউদি বাড়ি আছেন কি না।

মাসিমার কথা শেষ হলে আমরা দুজনেই অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইলাম। অসম্ভব বিষণ্ণ লাগছিল নিজেদের। তখন বেলা প্রায় গড়িয়ে গেছে। বয়স্ক সৌখিন মিঞা সাহেব ও বাবুরা সাজগোছ করে ছড়ি হাতে কীর্তনখোলার তীরে বেলপার্কের দিকে চলেছেন হাওয়া খেতে। ওই সময়েও বরিশাল শহরে হিন্দুবাবুদের উপস্থিতি নেহাত কম নয়। বেশির ভাগই উকিল নয়তো ডাক্তার। সবাই বেশ প্রতিপত্তিশালী। কিছু আছেন স্কুল-কলেজের শিক্ষকতায়। সবই খোশগল্প করতে করতে চলেছেন। এঁদের দেখলে মনে হয় না সমাজে সমস্যা নামে কোনো কিছু আছে অথবা মাত্র সওয়া দশক আগে এই শহরে তথা জিলায় মাসিমার মতো হাজার হাজার মেয়ে বয়স নির্বিশেষে ধর্ষিতা হয়ে এঁদেরই মতো বাপ-ভাইয়ের অথবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্বামীর সংসারে আশ্রয় না পেয়ে এই অন্ধকার জীবন অবলম্বন করেছিল। অহীনকে আমার এই চিন্তার কথা জানালে সে বলল, অথচ মজা দেখো, এঁদেরই যদি কেউ তোমাকে আমাকে মাসিমার ঘর থেকে বের হতে দেখেন তবে কী ছিছিক্কারই না করবেন। আমি বললাম, তাহলেও আমরা মাসিমার মতো মহিলাদের কাছে যাওয়া বন্ধ করতে পারব না। না, সেটা সম্ভব হবে না। আমি টের পাচ্ছিলাম আমার মধ্যে একটা যেন অন্য বোধের অঙ্কুরোদ্গাম হচ্ছে। আমি ব্যক্তিক এবং পারিবারিক সুখ-দুঃখের সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে বৃহত্তর দুঃখের জগতে প্রবেশ করতে চলেছি, অহীন হাত ধরে আমায় নিয়ে যাচ্ছে। সেখানে ঘৃণা ব্যাপারটা নিচের থেকে ওপর দিকে প্রধাবিত। এতদিন সেটাকে শুধু ওপর থেকে নিচের দিকে প্রবহমান দেখতেই অভ্যস্ত ছিলাম। আমার এই নতুন বোধের প্রথম শুরু অহীন এবং তাত্ত্বিকগ্রন্থ মাসিমার অলিখিত জীনবসংগ্রামের কথা। সময়টা ১৯৬২ সালের শরৎ। তখনও বরিশাল শহরের প্রকৃত দৈন্যদশা শুরু হয়নি। তখনও শহরের সেই বিখ্যাত রুচিরা নামক রেস্তোরাঁটি আড্ডার একটি প্রসিদ্ধ কেন্দ্র। অশ্বিনীকুমার দত্তের বাড়িটি তখনও ছাত্রাবাস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছিল। তার পার্শ্ববর্তী সতুসেন মশাইয়ের বাড়িটিও একটি জমজমাট সাংস্কৃতিক আড্ডার খোলামেলা স্থান হিসেবে শহরের মহিমা ঘোষণা করছিল। তখনও নারায়ণ সাহা নামক একজন অসাধারণ কণ্ঠের অধিকারী গানের মাস্টারমশাই তাঁর গানের স্কুলটি বড় নিপুণভাবে পরিচালনা করছিলেন, যার পাশ থেকে যাবার সময় আমরা শুনতে পেতাম তিনি শেখাচ্ছেন—

আমি মারের সাগর পাড়ি দেব গো
এই বিষম ঝড়ের বায়ে

অথবা—

মোর প্রথম মনের মুকুল
ঝরে গেল হায়—ইত্যাদি।

চিটাগাং রেস্টুরেন্টে তখনও চার আনায় কষা মাংস এবং পরোটা খেয়ে আমরা দুআনার টিকিটে সোনালি সিনেমা হলে ‘শাপমোচন’, ‘পথে হল দেরী’ ইত্যাদি বই (ছবি বা ফিল্ম কথাগুলো তখনও ব্যবহারে আসেনি) দেখতে পারতাম। যদিও এ সৌভাগ্য আমার বা অহীনের একবার কি দুবার বই হয়নি। হসপিটাল রোডের ওপরে স্থিত সুদৃশ্য ইউএনআইএস লাইব্রেরিটিতে বিনে পয়সায় যতক্ষণ খুশি বইপত্তর নাড়াঘাঁটা বা পড়ার কোনো অসুবিধে তখনও ছিল না। ডগলাস বোর্ডিং বা অক্সফোর্ড মিশন স্কুলের ফাদারেরা তখনও সাইকেলে যেতে যেতে চেনা অচেনা সব ছেলেদেরই কুশল জিজ্ঞেস করতেন, কী ভালো আছ তো? খেলা করছিস না শুধু পড়ছিস? অ্যা-হাঃ হাঃ।

এইরকম সময়ে একদিন শুনলাম জেনারেল প্রেসিডেন্ট শহরে আসছেন। খবরটি সমগ্র ছাত্র-জনতার মধ্যে যেন স্ফুলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়ল। প্রেসিডেন্ট সাহেব তখন পর্যন্ত কোনো ব্যাপক গণআন্দোলনের মুখোমুখি হননি। বিগত চার বছর ধরে আস্তে আস্তে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে বেশ একটা স্থিতাবস্থার মধ্যে আছেন। তাঁর রাজপাট দিব্য চলছিল। শুধু মাঝে মাঝে বিরোধী পক্ষীয় নেতাদের শায়েস্তা রাখার জন্য খানসাহেব তাঁদের জেলে পাঠিয়ে দিতেন। যতদূর মনে পড়ে এই সময়ে মুজিবুর রহমানকে জেলে পাঠানো হয়েছিল। এ কারণে ছাত্ররা তাঁর মুক্তির জন্য মিটিং মিছিল ধর্মঘট ইত্যাদি করছিল। অবশ্য ঢাকা এবং অন্যান্য বড় শহরগুলোতেই এইসব আন্দোলন বেশি হতো। এ দেশে যে কোনো আন্দোলনের মূল শক্তি ছিল ছাত্ররা। তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অনুগামী হয়ে আলাদা আলাদা ইউনিয়নে বিভক্ত ছিল। ফলে কলেজ ইউনিভার্সিটিগুলোতে মাঝে মাঝে বিসংবাদ, মারামারি, লাঠালাঠি হতো। তবে সরকারবিরোধী কোনো আন্দোলনের সময় একমাত্র মুসলিম লিগ এবং জামায়াতে ইসলামের অনুগামী ছাত্ররা ছাড়া সবাই সংঘবদ্ধভাবে সাড়া জাগাত। এই শহরে এ ছাড়া অন্য কোনো বড় আন্দোলনের স্মৃতি আমার নেই। এখন জেনারেল প্রেসিডেন্টের আগমন উপলক্ষ্যে একটা গরম হাওয়া বইতে শুরু করল। তার প্রত্যক্ষ কারণও ছিল। প্রেসিডেন্টের সফর নিরুপদ্রব করার জন্য স্থানীয় প্রশাসন কিছু রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেপ্তার করে। এর মধ্যে কিছু ছাত্রনেতাও ছিলেন। এ কারণে ছাত্ররা যারপরনাই ক্রুদ্ধ হলো। তারা সিদ্ধান্ত নিল যে, প্রেসিডেন্টকে তারা কালো পতাকা দেখাবে এবং ‘গো ব্যাক’ ধ্বনি তুলবে। এইরকম এক সংকল্প নিয়ে কলেজে জোর মিটিং, জমায়েত হতে লাগল। মুসলিম লিগপন্থি ছাত্ররা এর বিরোধিতা করলে বেশ কয়েকটা মারপিটও হয়ে গেল। জেনারেল প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখালে কী ভয়াবহ কাণ্ড ঘটতে পারে, অধ্যাপক মহোদয়েরা তা অনুমান করে ছাত্রদের শান্ত থাকার জন্য উপদেশ করলেন। রফিকুল ইসলাম সাহেব বামপন্থি মানুষ, কিন্তু সর্বজনপ্রিয়, বিশেষত ছাত্রসমাজে। তিনি আন্দোলনের যাথার্থ্য স্বীকার করেও প্রস্তুতিবিহীন অবস্থায় এভাবে ছাত্রদের ঝাঁপিয়ে পড়া সংগত মনে করলেন না, বরং ভবিষ্যতে বড় রকমের সংগ্রামের জন্য তাদের প্রস্তুতি নিতে বললেন। যা হোক, শেষ পর্যন্ত ছাত্ররা এই আন্দোলন থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নিল।

এইসব অভিজ্ঞতা আমার জীবনে এই প্রথম। গ্রামে থাককালীন একমাত্র নির্বাচনের সময় ছাড়া কোনোরকম রাজনৈতিক লড়াই বিষয়ে আদৌ কোনো উত্তেজনা দেখিনি। শহরে, নগরে যা ঘটত, কচিৎ-কদাচিৎ বাসি খবরের কাগজ মারফত তার সংবাদ জানতাম। শহরজীবনে এসে এই প্রথম রাজনীতির তপ্ত বাতাবরণ সম্পর্কে ধারণা শুরু হলো। তবে এই ঘটনায় একটা জিনিস বুঝলাম জেনারেল প্রেসিডেন্টের নিরঙ্কুশ এবং নিরুপদ্রব শাসন আর বেশি দিন চলবে না। অচিরেই দেশে সংঘর্ষের বাতাবরণ তৈরি হবে। প্রসঙ্গক্রমে এই সময়কার গ্রামীণ সাধারণ জনজীবনে রাজনৈতিক মনোভাব কীরকম ছিল সে বিষয়ে দু-এক কথা বলে মূল প্রসঙ্গে ফিরব। মুসলিম লিগ তখনও সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী দল। বিশেষত গ্রামাঞ্চলে যেহেতু দেশের স্বাধীনতালাভের সময় এই দল কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে ছিল, সে কারণে এর গণভিত্তি তখনও অন্য দলগুলো থেকে স্বাভাবিকভাবে বেশি ছিল। অন্যান্য দলগুলোর বিশেষ কোনো গণভিত্তি ছিল না। ফজলুল হক সাহেবের কৃষক প্রজা পার্টির তখন প্রায় অস্তিত্বই নেই। তা ছাড়া এই দল একটা সময়ে মুসলিম লিগের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল। গ্রামীণ মানুষ এ কারণে সেই দলকে আর আলাদা ভাবত না। সাধারণ মুসলমান সমাজ যারা বেশির ভাগই গ্রামের অধিবাসী, তারা জানত মুসলিম লিগই আজাদি হাসিল করেছে এবং বর্তমান সরকার যখন মুসলিম লিগের সমর্থনে আছে তখন তার বিরোধিতা নিতান্ত নাজায়েজ। এই সময়েও গ্রামীণ কোনো জমায়েতে গান করা হতো–

ফুটল পাকিস্তান গোলাপ
ফুল লিগের বাগিচায়
মিস্টার জিন্না ফোটাইলেন ফুল
সারা দুনিয়ায়।

সুতরাং একমাত্র ভাষা আন্দোলন ছাড়া ওই সময় ওই মাপের ব্যাপক আন্দোলন দানা বাঁধতে পারেনি। জেনারেল প্রেসিডেন্টের দমননীতি সব বামপন্থি তথা বিরোধী দলগুলোকে প্রায় ছিন্নভিন্ন করে ফেলে চূড়ান্ত একনায়কত্বে বেশ দৃঢ়। সামান্যতম উত্তেজনার কারণ দেখলেও ফৌজি শাসকেরা তা দমন করার জন্য উদ্যত অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে ইতস্তত করত না। ফলে শহর অঞ্চলগুলোতে বহু ছাত্রই গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়ত। এই ছাত্রদের একটা ব্যাপক অংশ যেহেতু গ্রাম থেকে যেত, সেহেতু আমরা গ্রামবাসীরা ফৌজি প্রতাপ বিষয়ে তথা রাজনৈতিক আন্দোলন বিষয়ে কিছুটা ওয়াকিবহাল ছিলাম। নচেৎ, দেশ কে বা কারা শাসন করে, তারা ফৌজি না নির্বাচিত প্রতিনিধি, তা নিয়ে সাধারণ গ্রামবাসীর কোনো শিরঃপীড়া ঘটত না। চাল, ডাল, তেল, নুনের দাম ঠিক থাকলে এবং দাঙ্গা-ফ্যাসাদ না থাকলেই সরকার ভালো। সোজা হিসেব। একমাত্র নির্বাচনের সময় ভোটের ক্যানভাস করে দু-একজন বড়মাপের নেতা গ্রামে আসতেন। সব লোক তাঁদের সভায় গিয়ে গরম গরম কথা শুনে আসত এবং সেই নিয়ে কিছুদিন হাটেবাজারে উত্তেজক আলোচনা চলত। কোনো পার্টিরই কোনো কর্মী সাধারণ বা আজকের দিনে যাকে ক্যাডার বলে তা ছিল না। অন্তত আমি আমাদের অঞ্চলে কোনো দিন তা দেখিনি। সুতরাং রাজনৈতিক আন্দোলন বিষয়ে প্রচার বা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের উদ্ধারকর্ম এসবের দায় নিতে আমি আমার অঞ্চলে কোনো দলকে কোনো দিন দেখিনি। আমাদের প্রত্যাশাও সেরকম ছিল না, কারণ এ বিষয়ে কোনো ধারণাই জন্মেনি তখনও।

সাধারণ হিন্দু গ্রামবাসীদের আবার এর ওপর অন্য একটা বদ্ধমূল ধারণা ছিল। তারা ভাবত সরকার যেই হোক কোনো কোনো মুসলমান তার অনুগামী না হয়েই পারে না, কারণ দেশটা মুসলমানদের। সেখানে যে অন্যরকম মতাবলম্বী মুসলমানও থাকতে পারে তা তাদের বিশ্বাসে ছিল না এবং তার কারণও ছিল। তবে যেহেতু তা সবাই জানেন, নতুন করে বলার প্রয়োজন দেখি না।

যা হোক মূল প্রসঙ্গে আসি, প্রেসিডেন্টবিরোধী বিক্ষোভ তো মুলতবি রইল। উলটো ছাত্রদের যেটা করতে বাধ্য করা হলো, তা বড় অভিনব এবং লজ্জাকর। সে সময়ে আমাদের ইউসিসির (ইউনিভার্সিটি ক্যাডেট কোর) ট্রেনিং দেয়া হতো। এটা বাধ্যতামূলক ছিল। ট্রেনিং বলতে প্যারেড, কিছু হালকা অস্ত্রচালনা শিক্ষা, ক্যাম্প করা এইসব আর কি। আমরা এ জন্য দুই প্রস্থ ইউনিফর্ম, এক জোড়া মিলিটারি বুট এবং একটা ক্যানভাসের বেল্ট পেতাম। সপ্তাহে তিন দিন এই ট্রেনিং দেয়া হতো। একজন ফৌজি ক্যাপ্টেন আর জনা দুই করপোরাল আমাদের এই প্রশিক্ষণ দিত। প্রশিক্ষণের দিনগুলোতে আমরা ফৌজি নিয়ম নিগড়ে বাধ্যতামূলকভাবে থাকতাম। কেউ কোনো আদেশ অবহেলা করলে কোর্টমার্শালে তার বিচার হতো। এখন আমাদের ওপর আদেশ হলো জেনারেল প্রেসিডেন্টের আগমন উপলক্ষ্যে আমাদের ইউনিফর্ম পরিহিত অবস্থায় সারিবদ্ধভাবে তাঁকে অভ্যর্থনা করতে হবে। আদেশটি জারি হবার পর লিগপন্থি ছাত্র ইউনিয়নের ছেলেরা বেশ খানিকটা ফ্যাক ফ্যাক করে হেসে নিল। যথাসময়ে একটি বিশেষ হেলিকপ্টারে জেনারেল প্রেসিডেন্ট আগমন করলেন। খুব মোলায়েম উর্দুভাষায় ছাত্রদের কর্তব্য, ইসলাম এবং দেশের স্বার্থে আমাদের কী কী করণীয় ইত্যাদি বিষয়ে একটি সারগর্ভ ভাষণদান করে আবার উড়ে চলে গেলেন। দেশের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে করমর্দন করে আমরা বিলক্ষণ ধন্য হলাম। অনেকের মনে অবশ্যই ক্রোধ, ক্ষোভ স্বাভাবিকভাবে এসেছিল, তবে আমার মবলগ লাভ হয়েছিল এক জোড়া আনকোরা পোশাক, হোক না ফৌজি, আর অনেক দিন কিনতে তো হবে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *