বিষাদবৃক্ষ – ২৭

সাতাশ

এই মামলার নিষ্পত্তি কবে হয়েছিল, নাকি খরচের ধাক্কায় জেরবার হয়ে তালুকদার নিজেই মামলা তুলে নিয়েছিলেন, আজ আর তা আমার মনে নেই। বোধহয় তুলেই নিয়েছিলেন। কেননা, মাঝে মাঝে দেখতাম তিনি জ্যাঠামশাইয়ের কাছে এসে বলতেন, বড়দাদা এবার আমারে অইব্যাহতি দেন, আর তো পারি না।— জ্যাঠামশাই আড়ালে বলতেন, অইব্যাহতি চায়, এঃ আরে আগে কবরের উপার দুব্বা গজাউক, তয় না অইব্যাহতি। শালা, ছাড়া-ভিডা খাবা? চেয়ারম্যান হবা। আমারে কায়দা করবা?

সলিমুল্লাহও প্রচুর অর্থক্ষয় করে দেখলেন যে, ‘বড়বাবু মোরও খায়, শত্তুরেরও খায়।’ তিনি ব্যবসায়ী মানুষ। একসময় ‘দুত্তোরুনইয়া, চেয়ারম্যানগিরির ফলনাতা হরি’—বলে তালুকদারের সঙ্গে মিটমাট করে নিয়েছিলেন বোধহয়। মাঝখান থেকে মোল্লা মৌলার দল একসময় ইউনিয়ন কাউন্সিল দখল করে নেয় এবং লম্বা কালো কুচকুচে দাড়ি-চুলওলা প্রায় পিরপ্রতিম এক জনাব চেয়ারম্যান হয়ে বসেন। পিরসাহেব তখন আমাদের ওখানে বেশ একজন মান্যমান ব্যক্তি। চেয়ারম্যান হয়েই তিনি ফতোয়া দিলেন যে, অতঃপর ইউনিয়ন কাউন্সিলের বিচার-আচার শরিয়তি নিয়মেই চলবে। দেশটা ইসলামি, তার ব্যবস্থাপনা যদি শরিয়ত অনুযায়ী না হয়, তবে পাক-ই-স্তান অথবা ইসলাম কথাগুলোর কোনো অর্থই থাকে না। চেয়ারম্যান হবার পর তিনি মিলাদুন্নবির এক ম্যায়ফিলে যে ভাষণটি দিয়েছিলেন, তার মোদ্দা বক্তব্য আমার আজও বেশ মনে আছে। তিনি বলেছিলেন, বেরাদরানে ইসলাম, আপনেরা জানেন আমি আল্লাহ পাকের একজোন নেক, ইমানদার বান্দা হিসাবেই এতাবৎকাল দীনের খেদমত এবং পরহেজগারিতে নিযুক্ত আছিলাম। আল্লাহ পাক রহমানের রহিম। তেনায় ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যানরূপ বান্দার পদে আমারে বওয়াইছেন। আপনেরা জানেন, আমি আল্লাহ পাকের কুদরত ছাড়া অন্য কোনো কিছুই চাই না। তয়, আমার মতন একজন সামাইন্য বান্দার উপার যহন এই হেকমত তিনি ফরমাইছেন, তহন জানকবুল করইয়া আমি তাঁর হুকুমত মোতাবেক বেরাদরির খিদমত করুম, এ বিষয়ে সন্দেহ নাই, ইনশাল্লাহ। এবং তিনি অতঃপর শরিয়তি বিধি মোতাবেক কাজকর্ম শুরু করলেন।

এই শরিয়তি কানুনের একটি বিচারের কথা বেশ মনে আছে। ঘটনাটি যদিও খুবই গা-ঘিনঘিন-কর, তথাপি বলতে হচ্ছে। দেলোয়ার নামে তারুলি গ্রামের একটি ছেলেকে নিয়ে এই মামলা। এই সময়টিতে আমাদের পিছারার খালের এপার-ওপারের প্রায় সব বনেদি গেরস্ত ভিটেগুলোই শূন্য। তার বেশির ভাগই তারুলি বা নৈকাঠির মোটামুটি সচ্ছল মুসলমানদের দখলে। জঙ্গল-আগাছায় ওইসব ভিটে এবং নারকেল সুপারির বাগানগুলো ছেয়ে গেছে। সেসব জায়গার কিছু জ্যাঠামশাইয়ের অথবা চলে যাওয়া মানুষদের অক্ষম শরিকদের দখলেও আছে। তখনও এইসব আগান-বাগানে কেউ যদি কিছু অপকর্ম করত, কারওই নজরে পড়ার উপায় ছিল না। মানুষ কাঠকুটো আনতে অথবা ফলপাকড়া পাড়ার জন্য ছাড়া কখনো এসব স্থানে আসত না। তবে তারুলি নৈকাঠি বা আমাদের আশপাশের অন্যান্য স্থানের লোকেদের গরুবাছুর এসব জায়গায় চরত।

দেলোয়ার তাদের গরু নিয়ে যেত এইসব বাগানে। তাদের দখলে ছিল আমাদের ওখানে চটকিবাড়ির খানিকটা অংশ। খুবই সুন্দর এবং স্বাস্থ্যবান চেহারার এই দেলোয়ার প্রাকৃতিক নির্বন্ধে অথবা কী কারণে জানি না একসময় পশুমেহী হিসেবে পরিচিতি পায়। একদিন এই চটকিবাড়ির নিভৃত নারকেল বাগানে একটি সদ্যযুবতী বাছুরকে একা পেয়ে সে তার সঙ্গে শারীরিক সম্বন্ধ করে। দুর্ভাগ্যক্রমে বাছুরটির মালিক ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করে এবং আমাদের দু-একজনকে ডেকে সাক্ষী মানে। তার ইচ্ছা ছিল বোধহয় আমাদের সঙ্গে নিয়ে দেলোয়ারকে পেটানো। কিন্তু আমরা তাতে রাজি না হয়ে তাকে পরামর্শ দিলাম চেয়ারম্যান হুজুরের শরিয়তি কাউন্সিলে নালিশ জানাতে। সেও তাই করল। হুজুর চেয়ারম্যান মজলিশ ডেকে বিচার করলেন। আমরা সবাই সেই মজলিশে উপস্থিত ছিলাম। পিরসাহেব বললেন, ইয়া আল্লাহ ইয়া নবি! কেয়ামত কি আইয়া পড়ল? বেরাদরানে ইসলাম, হে আমার দেলের নবির বান্দারা আপনেরা দ্যাহেন কী? এ্যাত্তো বড় মুসিবত পয়দা হইয়া গেল, আর আপনেরা সব খামোশ অইয়া আছেন? হায় আল্লাহ, ইয়া নসিব! হুজুর চেয়ারম্যান আরও বললেন যে, পাক কোরানে এরকম না-ফরজ, না-পাক কাম করনের জন্য আল্লাহতায়ালার যে গজবের উদাহরণ আছে, কোনো বান্দা যদি সেই বিষয় অবগত থাকে তবে তার পক্ষে এহেন নাজায়েজ কাজ করা কখনোই সম্ভব নয়। এ যেন সাদ্দুম নগরীর সেইসব অভিশপ্ত জাহেলদের বদ রুহ ভর করা ‘ছাওয়াল পান’ এই পাকভূমিতে এসে হাজির হয়েছে। আজ যদি ইসলামের সেই সুদিন থাকত, তবে এইসব কুফরিদের পাথর মেরে মেরে ফেলা হতো। যা হোক, শেষ পর্যন্ত হুজুর রায় ফরমালেন যে, পশুর সঙ্গে জেনা করা অতি অপবিত্র কজ। এ স্থলে এই কর্মদ্বারা জানোয়ারটিকেও হারাম করা হয়েছে। অতএব সর্বপ্রথম এই নাপাক জনোয়ারটিকে হালাল করা জায়েজ। আর যে অনাচারী আদমজাত পবিত্ৰ ইসলামে শরিক হওয়া সত্ত্বেও এহেন অপকর্ম করতে পারে, তার উপযুক্ত শাস্তি হওয়া উচিত দশ-ঘা কোড়া অর্থাৎ চাবুক।

ফলত হারাম পশুকে জবেহ করে হালাল করা হলো এবং তার গোস্ত আমজনতার মধ্যে বিতরণ করা হল। অনাচারী আদমজাতকে দশ ঘা কোড়া মেরে তাড়িয়ে দেয়া হলো। সমবেত জনগণ, বলাই বাহুল্য এই বিচারে সাতিশয় আহ্লাদিত হয়ে হুজুর এবং ইসলামের নামে জয়ধ্বনি দিতে লাগল। শুধু গরুর মালিক সেই গরিব মানুষটি মৃত পশুটির নীলচে স্থির চোখের দিকে তাকিয়ে একবার ‘আল্লাহ’ বলে ডুকরে কেঁদে উঠে ছুটে পালিয়ে গেল।

এরপর এই রচনায় আমার পিছারার খালের জগতের কোনো সামাজিক ঘটনার কিছুই আর উল্লেখ করার মতো নেই। কেননা হিন্দু গ্রামগুলোতে গ্রামপ্রতি দু-একটি অসহায় পরিবার ছাড়া আর কেউ নেই। সুতরাং সামাজিক কর্ম, উৎসব, পার্বণ বলতেও কিছু নেই। একদার বারো মাসের তেরো ব্রত পার্বণের যারা শরিক তারা এই সোঁতার মায়া কাটিয়ে কোথায় কোথায় গিয়ে কোন মিল-কারখানায় কাজ করছে, না কলকাতার শহরতলিতে কোথাও মুদি দোকান বা সবজির দোকান দিয়ে বসেছে, না অন্য কোনো পেশার আশ্রয় নিয়েছে জানি না কেউ। শুধু জানি, তারা একেবারেই হারিয়ে গেছে, আর কোনো দিন ফিরবে না। ভিটেবাড়ি, বাগানগুলো সব ধানের জমি হচ্ছে। ওসব জায়গায় কোনওদিন মানুষের ঘরবাড়ি ছিল, তা আর বোঝা যাচ্ছে না। শুধু যেসব পরিবারের কোনো একজন বা দুজন থেকে গেছে, তারা কিছুকাল সেইসব চলে যাওয়া আত্মজনেদের কাছ থেকে দু-একটি চিঠি পায় তখন। সেইসব চিঠিতে অনেক প্রশ্ন থাকে, আক্ষেপ থাকে এবং উপদেশও থাকত। কেউ কেউ এমনও লেখে যে, তারা চলে যাওয়ায় অমুকের অর্থাৎ থেকে যাওয়া মানুষদের নিশ্চয়ই কিছু অবস্থার উন্নতি হয়ে থাকবে, কেননা ঘরবাড়ি জমি-জিরেত সবই তো এখন তাদের ভোগেই লাগছে। যারা চিঠি লেখে, তারা জানে না যে এখানে যারা রয়ে গেছে তারা আর আগের তারা নেই। ছায়াশরীরের মতো শরীর নিয়ে তারা ছায়াময় একটা সমাজে বাস করছে। তাদের গেরস্থালিও ছায়া-গেরস্থালি। যা একদিন ছিল, তারই ছায়া নিয়ে তারা বর্তমান এবং ভবিষ্যৎবিহীন এক জীবন কাটাচ্ছে।

থাকার মধ্যে আছেন আমাদের বাড়ির সামনের বড় খালপারের জোড়া রেনট্রির সেই বিশাল মহীরূহ। তাঁরা অতি প্রাচীন এবং উভয় সমাজেরই সকলের নমস্য অতিবৃদ্ধ প্রপিতামহের মতো। আরও হয়তো বছর তিরিশ-চল্লিশ ধরে তাঁরা এমনই থাকবেন। তারপর যখন সব গাছ কাটা হয়ে যাবে, সব খাল শুকিয়ে যাবে এবং সব মাটি শুধু লোভের জমি হবে, তখন হয়তো ওইসব থেকে-যাওয়া প্রচ্ছায়াদের কেউ বৃক্ষ-কসাইদের কাছে তাঁদের অকেজো বুড়ো বলদের মতো বিক্রি করে দুদিনের অন্ন জোগাবে। এভাবেই তাঁরা একদিন অন্তর্হিত হলে বহুকাল পরে সেখানে আমি একদিন আজকের এই শূন্যতার পূর্ণ অবয়ব দেখতে পাব এবং পিছারার খালের জগতের শেষ স্মৃতিটুকুর মোহময়তা আমার লুপ্ত হয়ে যাবে। তারপর থেকে চলে যাওয়াদের মনখারাপ করা চিঠিপত্র কারও কাছে আসবে না, কেননা স্মৃতির সোঁতা ততদিনে বিস্মৃতির চোরাবালিতে পথ হারিয়ে কোনো এক অন্ধকার গহ্বরে বিলীন হয়ে যাবে, কে জানে? তখনও আজকের এই জমিবুভুক্ষু মানুষদের সন্তানেরা এই ভূমির লোল স্তন শুষে শুষে আরও ক্ষীণ প্রচ্ছায়া শরীর নিয়ে ঘুরে বেড়াবে। কিছুই আর প্রাক্তন স্বপ্নসম্ভব বর্ণাঢ্যতায় ফিরে যাবে না। বুড়িপিসিমা আর নগেনজেঠিমার স্বপ্ন শূন্যতায় মিশে যাবে।

যেসব মুসলমান গ্রাম আজ সাময়িক রক্তসঞ্চারে আমদের চোখে উজ্জ্বল বোধ হচ্ছে, সেগুলোও একদিন এরকমই হয়ে যাবে। কারণ সেখানের সমাজদেহেও সহস্ৰজিহ্ব এক লোভী অতিকায় দানব তার আশ্রয় পাকা করে নিয়েছে। অন্য সমাজকে গেলার পালা শেষ হলে সে নিজেকেই গিলতে শুরু করবে এবং তখন এই জনপদ নদীহীন, বৃক্ষহীন, ছায়াহীন এক খাঁখাঁ প্রান্তর হয়ে পড়ে থাকবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *