চৌদ্দ
রাখালিজীবনের ওই আনন্দটুকুও চলে গেলে আমি আর কিছুতেই মন লাগাতে পারছিলাম না। তখন বয়স ঠিক কত মনে নেই। বয়সের হিসেবটা আমাদের ভাইবোনদের ক্ষেত্রে বরাবরই একটু গোলমেলে। কারণ আমরা ছিলাম আট ভাই, পাঁচ বোন। বাবার দুই সংসারের ফসল। বড়দাদা, দিদি এবং ছোড়দাদা ছাড়া অন্য কারওই জন্মতারিখ বা সাল মা-বাবা নিজেরাও বোধহয় জানতেন না। অনুমানে বোধহয় তখন বছর আট-দশেক বয়েস হবে আমার। কিছুদিনের জন্য কীর্তিপাশার স্কুলের ফ্রি-প্রাইমারিতে ক্লাস ফাইভে পড়েছিলাম। তারপর পরীক্ষা শেষ হলে জ্যাঠামশাই বলেছিলেন যে, এখানে আর কিছু হবার নেই। ওকেও এবার কলকাতায় পাঠিয়ে দেয়া যাক। বলেছিলেন বটে, কাজে করেননি। কেননা এই সময়ে মধ্যস্বত্ব বিলোপ আইনটি পাস হয়। বেশ কিছুদিন ধরেই মধ্যস্বত্ব প্রথার বিলোপ বিষয়ে কর্তাদের আলাপ-আলোচনা চলছিল। এই নিয়ে বাবা-জ্যাঠামশাইয়ের একটা চাপা উত্তেজনাও দেখা গেছে সেসময়। তবে ব্যাপারটার গুরুত্ব বোঝার মতো বয়স, বুদ্ধি তখনও ছিল না বলে খুব একটা ভাবিত হইনি।
একদিন গভীর রাত্রে জ্যাঠামশাই এবং নায়েবমশাই দক্ষিণের ‘মহাল’ থেকে ফিরে এলেন। দরদালানের বারান্দায় চাকরপাট এবং অন্দরের মহিলামহল চঞ্চল হয়ে উঠল তাদের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থার জন্য। জ্যাঠামশাই নায়েবমশাইকে দিয়ে বাবাকে ঘুম থেকে ওঠালেন। সিঁড়ির চত্বরে বসল তাদের আলোচনা সভা। জ্যাঠামশাই কোনো ভূমিকা না করেই বললেন, ভাইটি, We are lost. The zamindari system has been confiscated by the Government. We have now to decide, what to do next and how to survive. বাবা এবং জ্যাঠামশাইয়ের মধ্যে কখনো বিতণ্ডা হতে বিশেষ দেখা যায়নি। যদি কখনো হতো, তার সংলাপের মাধ্যম হতো ইংরেজি। এও এক ধরনের আভিজাত্য। কারণ চাকরপাট, বাড়ির অন্দরমহল, আশপাশবাড়ির লোকেরা আছে। তারা যেন দুভাইয়ের মনোমালিন্য বিষয়ে কিছু না জানতে পারে, তাই এই সতর্কতা। সাধারণ্যে তাদের ভাবমূর্তি যেন নষ্ট না হয়। সে রাত্রে মা রান্নার ব্যবস্থার জন্য উঠে যেতেই জেগে গিয়েছিলাম। এবং বাবা জ্যাঠামশায়ের বার্তালাপ শুনছিলাম আড়ালে দাঁড়িয়ে। তখনও ইংরেজি ভাষা ভালো করে বোঝার মতো ক্ষমতা হয়নি। তবে মোদ্দা ব্যাপারটা বুঝেছিলাম এবং পরবর্তীকালের নানান আলোচনার জন্য ব্যাপারটার পুরো discourseটা মনে থেকেই গিয়েছিল। বাবা জ্যাঠামশাইয়ের কথা শুনে জানতে চাইলেন যে জমিদারি, তালুকদারি বা মধ্যস্বত্বীয় ব্যবস্থা অবশ্যই বিলোপ করা হতে পারে, কিন্তু খাসজমিগুলো যতক্ষণ দখলে থাকবে ততক্ষণ ধ্বংস হয়ে যাবার প্রশ্ন ওঠে না। সরকার নিশ্চয়ই এইসব মানুষকে না খেয়ে মরার পথে ঠেলে দেবে না। এবং যেসব ভোজ্যদ্রব্য ‘মহাল’ থেকে এতকাল ধরে এসেছে, তা না আসার কোনো কারণই তো নেই। কেননা সেসব তো প্রজাপত্তনির উপজ নয়। তা তো খাসজমির ফসল। জ্যাঠামশাই একটি অট্টহাস্য করে বললেন, আহা! তুমি তো দেখি কিছুই খবর রাহ না। আর রাখবাই-বা ক্যামনে? নিজের হাতে কিছুই তো করনায়।—কিন্তু আশ্চর্য! তুমি কি মেয়েদের বিয়েতে যে এইসব খাসজমি বিক্রি করে টাকা জোগাড় করতে হয়েছিল সেসব ভুলে গেছ? বাবা বললেন যে, এরকম একটা গল্প তিনি এই প্রথম শুনলেন। সারা জীবন তিনি তাঁর জ্যেষ্ঠর বাধ্য থেকেছেন। এবারও তার অন্যথা হবে না। কিন্তু তিনি খুব ক্ষোভের সঙ্গে জানালেন যে, এই বিপুল সম্পত্তির অর্ধাংশের মালিক হয়েও কোনোদিনই এর হিসেব তিনি জানতে চাননি।
বাবা এতগুলো কথা একসঙ্গে জ্যাঠামশাইকে কোনোদিনই বলেননি। ফলত, তাঁর এমতো প্রতিক্রিয়ায় জ্যাঠামশাই খুবই ক্ষুব্ধ হলেন। বললেন যে, এটা স্বাভাবিক, সংসারে এটাই নিয়ম। যে ব্যক্তি পরিবারের জন্য সবকিছু করে, তাকেই সব ক্ষয়ক্ষতি এবং লাঞ্ছনা ভোগ করতে হয়। বাবা বলেছিলেন, এ বিষয়ে বিতণ্ডার প্রয়োজন নেই। If you think it’s all right, it’s all right. I will never open this chapter again. Be satisfied yourself বলে বাবা ঘরে চলে গেলেন।
পরেও জেনেছি আমাদের তালুকদারির প্রজাপত্তনি জমির অর্থাৎ যার খাজনার অধিকারী আমরা, তা খুব একটা সামান্য ছিল না। কিন্তু তার তুলনায় অনেক বেশি আয়ের ব্যবস্থা ছিল খাসজমি থেকে। খাসজমির তখন কোনো সীমা নির্ধারণের ব্যাপার ছিল না। ফলে তার আয় থেকে মধ্যস্বত্বভোগীদের খোরাকির ব্যবস্থা বেশ ভালোভাবেই চলার কথা ছিল। পিছারার খালে নৌকোয় নানান সামগ্ৰী আসত, অথবা যেসব বড় ঘাসি নৌকোগুলো সেখানে ঢুকতে না পেরে বড় খালে থাকত, তাতে যেসব সামগ্রী আসত, তা সবই খাসজমির উপজ সামগ্রী। প্রজাপত্তনির খাজনা সে তুলনায় কিছুই না। কিন্তু সেসবের গতি যে কী হলো, তা একমাত্র জ্যাঠামশাই আর নায়েবমশাই-ই জানতেন। সেসব খাসজমির আর কোনো হদিসই পাওয়া গেল না কোনোদিন।
এরপর শুরু হলো এক উঞ্ছবৃত্তির জীবন। পিছারার খাল বা বড় খাল, কোনো খালের সোঁতা ধরেই আর ধান-মান-কলা-কচুর বহর আসল না। প্রায় একবছর সময় ধরে চলল বড়বাড়ির সঞ্চিত ঐতিহ্যময় দ্রব্যাদির জলের দামে বিক্রি করা এবং সেই মূল্যে অন্ন সংগ্রহ। বাড়ির উঠোনে বড় বাঁশের খুঁটোয় বাঁধা হলো দাঁড়িপাল্লা। তাতে ওজন করা হতে লাগল পুরনো কাঁসা-পিতল এবং তামার বাসনপত্তর। পর্বতপ্রমাণ সব ডেগ, ডেকচি, গামলা, পরাত, থালা, হাঁড়ি, কলসি এবং তাবৎ বাসনপত্তর। গ্রাম-গাঁয়ে ভোজে মোচ্ছবে হরবখত আজকের দিনের মতো ডেকোরেটর্সকে খবর দিলেই এসব পাওয়া যেত না। ছিলই না এরকম ব্যবস্থা। তাই বড় বনেদি বাড়িগুলোতে এসব থাকত। কেননা, প্রয়োজনটা তাদেরই বেশি হতো। অন্যদের শ্রাদ্ধে, বিবাহে বা ভোগ মহোৎসবে, বারোয়ারি কাজে। এখন সেসব দেদার বিক্রি হতে লাগল। তারও হিসেবপত্তর করার দায়িত্ব নায়েবমশাইয়ের। তাঁর তখনও ছুটি হয়নি, যদিও নায়েবি শেষ, কেননা, তালুক-মুলক চৌপাট। নায়েবমশাই সিঁড়ির পোস্তায় বসে কাগজ-কলম নিয়ে মাপজোক হিসেবপত্তর লিখছেন। ব্যাপারীরা ওজন করছে এবং বলছে। এদিকে অবশিষ্ট চাকরপাট যারা ছিল তারা মালগুদাম থেকে মালপত্তর বার করে উঠোনে টাল দিচ্ছে। মা ঘরের মধ্য থেকে এইসব দেখছেন আর চোখের জলে বুক ভাসাচ্ছেন। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, বাবা বা জ্যাঠামশাইয়ের আচরণে কোনো দুঃখবোধের প্রকাশই নেই এ ব্যাপারে। সম্পদ অর্জিত না হলে তার প্রতি বোধহয় কোনো মমত্ব জন্মে না। তদুপরি তখন তাদের অদ্যভক্ষ্যোধনুর্গুণঃ অবস্থা। বিষয়সম্পদ থেকে সঞ্চয় করে রাখার কথা কোনোদিন ভাবেননি। পিতৃপুরুষের সম্পত্তির মারফত কখনো দীয়তাং ভুজ্যতাং, কখনো-বা গয়ং গচ্ছ দিনযাপন। একসময় চাকর, দাস, দাসী, মোচ্ছব। এখন বাসন বিক্রি করে খাওয়া। ক্রমশ বাসনকোসন শেষ তো অন্যান্য মহার্ঘ বস্তু, সোনারুপার অলংকার, রুপোর গ্লাস, সোনার থালা, রুপোর থালা, পুরনো স্বর্ণ এবং রৌপ্যমুদ্রা—সব বিক্রি, বিক্রি আর বিক্রি। সর্বশেষ পিতামহ ঠাকুরের খেয়ালি সন্নেসীপনার সম্পদ, সে এক অবিশ্বাস্য কাণ্ড। কী, না তার গুরুদেব শ্রীমৎ প্রভুপাদ বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী মহাশয়ের নাতিক্ষুদ্র সোনায় বাঁধানো ফটো ফ্রেমের সোনাটুকু নরুন দিয়ে চেঁছে চটিয়ে তা-ও বিক্রি করে পেটভরা। সবই অবশ্য জলের দামে। কারণ আভিজাত্য যায়নি। বাবুরা কি এইসব ছাইছাতা নিয়ে বাজারে বিক্রি করতে যেতে পারেন? বাবুদের অবশ্য কাণ্ডজ্ঞানও নেই, কী বস্তুর কী মূল্য। অতএব চাকরেরা বিক্রিবাটা করে যা এনে দেয় তা-ই সই। বেচাকেনার ‘কামডা’, নিতান্তই ‘ছোডলোকের কাম’–ওয়া বাবুরা কহনো পারে?
এইসব কার্যকলাপের মধ্যেও বাঙ্গাল সামন্ত চরিত্রের কিছু বিশেষ ভাব প্রকটন। একটি কাহিনি বললে বিষয়টির স্বরূপ বোঝা যাবে। বাড়ির তখনকার একমাত্র চাকর ফটিককে গঞ্জে পাঠিয়েছিলেন বাবা একখানা বেশ বড়সড় রুপোর থালা বিক্রি করার জন্য। সে ফিরে এসে তাঁকে দিল একশ কুড়ি টাকা। তখনকার বাজারে আমাদের প্রায় তিন মাসের সমস্যার সমাধান। বাবা খুশি। এদিকে তাঁর এক জিমন্যাস্ট শিষ্য নারায়ণ ঠাকুর, ফটিকের পশ্চাদনুসরণে প্রকৃত মূল্য জেনে আসেন। নারায়ণ ঠাকুরের বরাবরই একটু চোর ধরার বাতিক। তিনি এসে জ্যাঠামশাইয়ের দরবারে নালিশ রুজু করলেন। অপরাধ হাতেনাতে প্রমাণিত। নারায়ণ ঠাকুর জ্যাঠামশাইয়ের সামনেই ফটিককে মারলেন পেল্লায় এক ‘থাবড়া’। ঘটনাটি ঘটেছিল সন্ধের খানিকটা পর। জ্যাঠামশাই তখন তার দোতলার শয্যাগৃহে। প্রহৃত ফটিক বিকট চিৎকারে কান্না জুড়ে দিল। বাবা থাকতেন নিচের তলায়। ফটিকের কান্না এবং নারায়ণ ঠাকুরের চেঁচামেচি শুনে একখানা লাঠি হাতে দোতলায় উঠে এসে নারায়ণ ঠাকুরকে আপাদমস্তক পেটালেন। নারায়ণ ঠাকুর যতই তাঁকে বোঝাবার চেষ্টা করেন, ততই তিনি তাঁকে পেটান। আর বলেন, তুই আমাগো চাকরের গায় হাত দিলি কোন সাহসে? তুই জানো না চাকররে মারা আর বাবুগো মারা একই কথা? ও যে চোর, হেয়া তুই আমারে কবি আর আমি জানুম? আমি জানি না যে ওর তিন পুরুষ এ বাড়ির থিকা চুরি করইয়াই বাঁচইয়া আছে? ইত্যাদি। এমতো সামন্ত-আভিজাত্য আর খুব একটা দেখিনি কখনো।
এভাবেই বাড়ির জৌলুস আস্তে আস্তে শেষ হতে লাগল। বাসনপত্তর সোনাদানা দিয়ে শুরু হয়ে ক্রমশ তা ঢেঁকিঘর, গোলাঘর, গোয়ালঘর, ‘বউনা’ ঘর এবং বৈঠকখানা ঘরগুলোর টিন, কাঠ, চেয়ার, টেবিল, দেরাজ, তক্তপোশ ইত্যাদিতে পৌঁছোল। কর্তারা তখনও কর্মক্ষম পুরুষ, কিন্তু কর্মে আগ্রহ নেই। জ্যাঠামশাইয়ের যা-ও আছে, বাবা এ-বিষয়ে একেবারেই শুদ্ধ, বুদ্ধ, নিত্য ও মুক্ত, সাংখ্যের পুরুষ। বাস্তব বিচারে অপদার্থ। তফাত শুধু এই সাংখ্যের পুরুষের ভক্ষণ, মলমূত্রাদি বর্জন ইত্যাকার কর্মও নেই। বাবা, এখানকার ভাষাবিন্যাসে বলতে গেলে আগে হাগতেন বাইরে, এখন ঘরে। প্রায় সেই সাংখ্যপুরুষের স্তরেই উঠে গেছেন। তবে ঝাপট লাগছে তাঁর প্রকৃতির গায়ে, কেননা প্রকৃতিকে তো অনেকগুলো মুখে অন্ন জোগাতে হয়। অতএব প্রকৃতি ওই দর্শনের তত্ত্বানুযায়ীই প্রায় সদা চঞ্চলা, সদা বিঘূর্ণিতা। ঘূর্ণনের কেন্দ্রের পুরুষ স্থিতাবস্থায়।
বাড়িটি ছিল পূর্বদীঘল বা সূর্যদীঘল। আমাদের বাড়িতে দুটি সুদৃশ্য বৈঠকখানা ঘর ছিল। বাড়ির বিস্তীর্ণ প্রলম্ব সোপানগুলো বেশ খানিকটা উঁচু থেকে উঠোন অবধি নামলে উঠোনের ব্যাপক ব্যাপ্তি। তারপর একটি নাতি-প্রশস্ত পথ। সামনের দিকে বেশ খানিকটা এগোলে দুই ধাপের সিঁড়ির সংযুক্তিতে প্রথম বৈঠকখানা ঘরটি। আমরা বলতাম লামার বৈঠকখানা বা ছোট বৈঠকখানা। লামার বৈঠকখানার অর্থ হচ্ছে নিচের বৈঠকখানা। অর্থাৎ এরপরে আরেকটি বৈঠকখানা আছে, যা একটু উঁচুতে। ছোট বৈঠকখানা পেরিয়ে তিন সিঁড়ি নেমে আবার প্রলম্বিত রাস্তা, সোজা প্রায় সিকি মাইল গিয়ে বড় খালের ওপর লোহার পুল পর্যন্ত। রাস্তার দুপাশে ক্রমান্বয়ে ফুলের বাগান, বাগান পেরিয়ে দুপাশে দুটি বৃহৎ জলাশয়, তারপরে বাঁহাতি তিনটি মন্দির এবং তৎসহ ফুলের বাগান এবং নারকেল-সুপারির শ্রেণি মন্দিরের মধ্যে একটি পঞ্চরত্ন। মন্দিরের অভ্যন্তরে তিন ভাইয়ের সমাধি — চন্দ্রমোহন, জগৎচন্দ্র এবং গুরুদাস, প্রস্তরফলকে নাম খোদাই করা আছে। আর দুটির একটি জ্যাঠামশাইয়ের মা শ্রীমতী কুসুমকুমারী দেবীর সমাধিমন্দির। অপরটি সৌন্দর্যবর্ধনকারী একটি মণ্ডপরচনা অবশ্যই মন্দিরাকৃতির। এরপরই আমাদের প্রশস্ত ঘাটবাঁধানো দিঘি এবং তার পুবপার ঘেঁষে পোস্ট অফিসের বাড়িটি। তারপর পাঠশালাবাড়ি। এরই আশেপাশের প্রত্যন্তে নায়েবাড়ি, কুমোরবাড়ি, ধোপাবাড়ি, নাপিতবাড়ি এইসব। শুধু ভূঁইমালীরা থাকত বাড়ির পেছনের দক্ষিণ-পশ্চিমের এক কোনের দিকে। পিছারার খাল ঘেঁষে। একমাত্র নায়েবাড়ি ছাড়া সব বাড়িগুলোই ‘চাকরান’ সূত্রে অর্থাৎ খানাবাড়ির প্রজা ছিল তারা। কিন্তু এসব আলোচ্য নয়। শুধু বৈঠকখানা দুটির অবস্থান জানানোর জন্য অবস্থান জানানোর জন্য এতসব বলা যা একান্তই বৈঠকখানাবিষয়ক।
আমাদের ছোট বৈঠকখানাটি ছিল বস্তুত একটি জাদুঘর। প্রশস্ত এই বৈঠকখানাটিতে বেশ কিছু তক্তপোশ পাতা থাকত, পুবদক্ষিণ কোণ ঘেঁষে ছিল একটি আরামকেদারা। এ ছাড়া দু-চারখানা চেয়ার, এসবও ছিল। সবচেয়ে আকর্ষক ছিল ঘরটির দেয়াল। বাড়িটি ছিল শণের ছাউনি এবং কাঠের ফ্রেমের কাঠের দেয়ালগুলো জুড়ে অসংখ্য হরিণ আর মোষের শিং। নিচে দেয়াল ঘেঁষে হাতির মাথা, বাঘের মাথা, গণ্ডারের চোয়াল ইত্যাদি। ঘরটিকে প্রায় বেষ্টন করে ‘আড়ার’ নিচ থেকে ঝোলানো ছিল একটি অজগরের চামড়া। সেটি শুকিয়ে প্রায় কাষ্ঠবৎ হয়ে গিয়েছিল। যে অজগরটির চামড়া এতটা দৈর্ঘ্য এবং প্রস্থ জুড়ে ছিল, জীবিতাবস্থায় সেটি যে কী ভীষণাকৃতির ছিল, তা অনুমান করা অসম্ভব ছিল না। এটির বিষয়ে একটি সুন্দর কিংবদন্তিও ছিল। কিংবদন্তি ছিল মোষ, হরিণ ইত্যাদির শিং এবং অন্যান্য জীবজন্তুর মাথা, চামড়া বিষয়েও। সেসব সুন্দরবন আবাদকালের ব্যাপারস্যাপার। বুড়িপিসিমা বলতেন এসব কিংবদন্তির গল্প। বুড়ির এসব কথা বলার হক ছিল ন’সিকের। কেননা জগৎ সেন মহাশয়ের একমাত্র কন্যা। তার জ্ঞানকালেই এ বাড়ির তাবৎ রহট। দীর্ঘজীবনের অধিকারিণী বুড়িপিসিমা অতএব যা বলতেন, তা-ই আমাদের কাছে ইতিহাস বোধ হতো। এর মধ্যে তাঁর বাতেল্লাবাজি একেবারে ছিল না এ কথা বলব না। তবে তার পরত ভাগ করে একটু জেনে নিলেই তা দিব্য ইতিহাস হতো। বুড়ি বলতেন, এ্যার বেয়াক কিছুই কর্তাগো সোমায়ের জমি হাসিল করনের লইগ্যা। সুন্দইরবনে না আছিল, এমন কোনো জানোয়ার নাই। জমি হাসিল করার সোমায়, আর ওই শিকার-টিকারে যাইয়া কর্তারা এইসব মারছেন। হেইসব জানোয়ারের মুণ্ড এগুলান। বাড়িতে জগৎ সেন মশায়ের দুখানা বৃহৎ তৈলচিত্র ছিল মধ্যের ঘরের সামনের এবং পেছনের দেয়ালে টাঙানো। একখানার অংকন অসম্পূর্ণ ছিল। আর্টিস্ট সম্ভবত ঊনবিংশ শতকের কেউ হবেন। মহাশয়ের প্রতিকৃতির মধ্যে আকর্ষণীয় ছিল তার দীর্ঘদেহ এবং প্রগাঢ় চক্ষু দুটি, মাথার বিস্তীর্ণ ইন্দ্রলুপ্ত এবং তার চৌহদ্দির সাদা পশমের মতো চুলের আভাস। হাতে একটি ফরসির নল। সধূম আলবোলাটি ঈষৎ দূরে। গায়ে একখানা জামিয়ার। দেখলেই দাম জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে। একবার তাতালেই বোঝা যায় মহাশয় বেশ ‘হুনিয়ার’ পুরুষ। গৌরকান্তি, উন্নত নাসা, গভীর চক্ষু, দীর্ঘদেহী রাজবৎ উন্নত মহামহিম পুরুষ। ইনিই আমার প্রপিতামহ জগৎ সেনমশাই। বুড়িপিসিমার বাবা। কিন্তু ধ্যাৎ, বুড়ি যা-ই বলুক, এরকম বাপ থাকা খুব ভয়ের কথা। দেখলেই মনে হয়, বকবে। এই তৈলচিত্রটি দেখিয়ে আমাদের বাল্যকালে বুড়ি ‘খ্যানে অখ্যানে’ আমাদের ভয় দেখাতেন।
তা মহাশয়ের নাকি একটি গাদা বন্দুক ছিল সেই কালে। সেও গল্পকথা। তবে শুধু গাদা বন্দুক দিয়ে যে ছোট বৈঠকখানার ওইসব পশুদের শিকার করা সম্ভব হয়েছিল তা মনে হয় না। কেননা, অন্য পশুদের কথা ছেড়ে দিলেও, ওই হাতি, বাঘ আর যেসব মহিষের মাথাগুলো শিংসহ ওখানে ঝোলানো ছিল তা শিকার করা অসম্ভব ব্যাপার। তা সেই গাদা বন্দুক নাকি আবার জ্ঞাতিভাই চৌধুরীরা কায়দা করে মহাশয়ের হাত থেকে কেড়ে নিয়েছিল। ছোটবেলায় বুড়ির এসব গল্প শুনে মহাশয়ের বীরত্ব বিষয়ে খুবই সন্দিহান হয়ে পড়তাম এবং ওইসব জন্তুজানোয়ারের নিধন যে তার হাতে হয়েছে এরকম বিশ্বাস কিছুতেই আমাদের মনে আসত না। আবার যখন একটু বড় হয়ে খানিক জ্ঞানগম্যি হলো, তখন সুন্দরবন আবাদকালে সে স্থানে হস্তীশিকার বিষয়টাও যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য বলে বোধ হয়নি। কিন্তু অজগরের ব্যাপারটি অবিশ্বাস করার মতো ছিল না। বুড়ি এ বিষয়ে যে গল্পটি বলতেন, তা আক্ষরিক সত্য না হলেও ঐতিহাসিক ঘটনা হবার জন্য আঠারো আনা হকদারির অধিকারী। কারণ ওই অজগরের বিশালকায় শরীরটি না দেখলেও তার চামড়ার দৈর্ঘ্য-প্রস্থ বেধ আমরা সম্যক দেখেছি এবং তার দেহান্তের প্রায় শতবর্ষ পরের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে। তাতেই যা বোঝা গেছে কিংবদন্তিটি সে তুলনায় খুব একটা বাতেল্লা নয়। বরং আরও খানিকটা হলেও কিছু অন্যায় হতো না। সে যাক, বুড়ি বলেছিলেন যে, সুন্দরবন আবাদকালে যে কাঠুরিয়ারা সেখানের বিশাল সুন্দরী, গরাণ, গেউয়া এইসব গাছ কাটত, তারা মাঝে মাঝেই ক্লান্তি অপনোদনের জন্য ওই গাছগুলোর ওপর বসেই তামাক-টামাক খেত। তারা গাছ কাটতে যাবার সময় দিনের পর দিন জঙ্গলে থাকত বলে গন্ধককাঠি, আগুনের তাওয়া, তুষ, তামাক, হুঁকো কলকে এইসব জিনিসপত্র নিয়েই সেখানে যেত। আবাদিত স্থানগুলোতে, যেখানে দু-এক ঘর বসতি হতো, সেখানে তাদের থাকা-খাওয়ার স্থান নির্দিষ্ট থাকত। সুন্দরবনে তখন অসম্ভব বাঘ, সাপ এবং অন্যান্য হিংস্র জন্তুর প্রাদুর্ভাব। এ কারণে যে জমিদার বা তালুকদারের হয়ে তারা কাজ করত, তাদের এক সশস্ত্র বাহিনী এদের পাহারা দিত। সশস্ত্র বলতে তারা ছিল তিরন্দাজ, বল্লমধারী পাইক। এরাই সব পশুগুলোকে শিকার করত।
তা একবার নাকি কাঠুরেরা একটা জায়গায় বিশ্রাম এবং তামাক খাওয়ার প্রয়োজনে একটা বড় গাছের গুঁড়ির ওপর বসে অনেকক্ষণ ধরে গালগল্প করছিল। তামাক পুড়ে গেলে কেউ একজন কলকের আগুন ঠুকে ঠুকে সেই গাছটির ওপর ফেলছিল এবং আবার তামাক সাজাচ্ছিল। এইসব কৃৎকর্মের মধ্যে হঠাৎ গাছটা নড়ে ওঠে। কাঠুরেরা দেখে যে, ওটা আসলে গাছ নয়, একটা অজগরের শরীর। তখন তারা কুড়ুল দিয়ে নাকি আগা-ল্যাজা কেটে সেটাকে মারে। সেই অজগরের চামড়াই ছোট বৈঠকখানার ঝালর সদৃশ চামড়াটি।
সব বেচে খাওয়ার দিনগুলোতে দেখা গেল এসবেরও খদ্দের আছে এবং এইসব হরিণের শিং, মোষের শিং, হাতির দাঁত, বাঘের চামড়া, হরিণের চামড়া সব কিছু, জলের দামে বিকিয়ে যায়। এই বস্তুগুলো এতদিন ছোট বৈঠকখানার সৌষ্ঠব বাড়িয়েই রেখেছিল শুধু। তা বর্তমান কর্তাদের অভ্যেসেই ছিল, নজরে ছিল না। এই ঘরটি ব্যবহৃত হতো প্রধানত ছোটবাবু মানে বাবার বৈঠকখানা ঘর হিসেবে। এখানে তিনি তাঁর লোকজনদের নিয়ে বসতেন। একসময় বাড়ির বয়ঃসন্ধি অতিক্রান্ত ছেলেরা এটিকে ব্যবহার করত তাদের ‘ডরমিটরি’ হিসেবে। রাতে ঘুমোবার ব্যবস্থাও তাদের এখানেই। এখন এর অভ্যন্তরের সামগ্রী এবং গড়নের কাঠকুটো বিক্রি হচ্ছে। তক্তপোশ, আরামকেদারা, সাধারণ বেঞ্চি-চেয়ারগুলোও বিক্রি হচ্ছে। একটা গোল মেহগনির টেবিল ছিল। ছোটখাটো সভার আয়োজনে এখানে আসর বসলে নগেনমশাইকে এই টেবিলের ওপর বাঁ হাত রেখে আমি বক্তৃতা করতে শুনেছি। তখন আমি খুবই ছোট। তবে মনে আছে, এই টেবিলটির ওপর পাশার ছক রেখে বিরাজদাদু এবং বাবা, যাঁরা সম্পর্কে খুড়ো-ভাইপো, পাশা খেলতেন, অন্ধকার না হওয়া পর্যন্ত কয়েকবার কচ্ছয়—বারো, পোয়াবারো-তেরো ইত্যাদি করতেন। তামা, কাঁসা, পিতল, সোনাদানা শেষ হলে এখন সেসব বিক্রি হতে লাগল। ছোট বৈঠকখানার সরঞ্জামগুলোর মধ্যে একটি অদ্ভুত জিনিস ছিল। সেটি হলো সুদৃশ্য একপাটি পাম্প ‘শু’। তার মাপ সোয়া হাত। সেটিও ‘আড়ার’ পাড়ের সঙ্গে ঝোলানো থাকত। বুড়িপিসিমাকে একদা এর ব্যবহারের বিষয় জিজ্ঞেস করলে, বুড়ি বলেছিলেন, ওয়ার আর ব্যবহার নাই। এককালে কত্তারা ‘আনাডা’ পেরজাগো শায়েস্তা করতেন ওই জোতা দিয়া। এহন তো আর হেদিন নাই, খালি জোতাহান ঝোলতে আছে। আমাদের বাড়িতেও যে এরকম ‘জোতার’ ব্যবহার হতো আগে জানতাম না। আমরা ছোটবেলা থেকে চৌধুরীবাড়ির বিষয়ে শুনতাম তাঁরা ছিলেন প্রবল অত্যাচারী। তাঁদের বাড়ির সামনে থেকে কেউ জুতো পায়ে বা ছাতা মাথায় দিয়ে গেলে তাঁরা প্রচণ্ড শাস্তির বিধান করতেন তাদের। কেননা এটা তাঁদের মতে নিতান্তই বেয়াদবি-কাণ্ড। প্রসঙ্গত বলি, সম্প্রতি ওই বংশের একজনের সঙ্গে তাদের পরিবার বিষয়ে কথা বলতে গেলে ভদ্রলোক বলেছিলেন, দেখুন, ওই বাড়ির বিষয়ে আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করবেন না। আমি এখন একজন রেলের সাধারণ শ্রমিক। আমি আমার ঠাকুরদামশাইয়ের পরিচয়ে পরিচিত হতে চাই না। আমি জানি তিনি শেষ পর্যন্ত কীভাবে মরেছেন, কিন্তু তা তাঁর প্রাপ্য ছিল। আমাকে কিছু বলবেন না। আমি সবই জানি। ভদ্রলোক আমাকে অনেক কথাই বলেছিলেন, বলার সময় তিনি স্পর্শকাতরতার জন্য কেঁদেও ফেলেছিলেন। এই চৌধুরীরা প্রকৃতই অত্যাচারী ছিলেন এবং ভদ্রলোক তাঁর যে ঠাকুরদার কথা বললেন, তিনি শেষ পর্যন্ত যে ওখানে ভিক্ষাবৃত্তিতে জীবনপাত করেছেন, তা আমি দেখেছি।
বড় বৈঠকখানা ঘরটি ছিল বর্গাকৃতি এক আটচালা কাষ্ঠ-মণ্ডপ। তার অর্ধেক অংশে একটি এপ্রান্ত-ওপ্রান্ত জোড়া মঞ্চ, থিয়েটারের। বাড়ির ছোট কর্তা থিয়েটারের ব্যাপারে উৎসাহী। নিজে অভিনয়াদি করেন। তাঁর এ ব্যাপারে খ্যাতি ছিল খুবই। এক-আধবার নাকি স্টার থিয়েটারে শিশির ভাদুড়ির সঙ্গে সীতা না কী নাটকে অভিনয় করে নামও করেছিলেন। কিন্তু জ্যাঠামশাই জানতে পেরে কান ধরে বাড়িতে এনে বলেছিলেন, স্টেইজ বানাইয়া দিতে আছি, যা করার বাড়িতেই করো। চরিত্তিরডা খারাপ করইয়া বংশের নাম ডুবাইও না। তখনকার দিনে পাবলিক থিয়েটারে অভিনয় করলে নাকি ‘চরিত্তির’ একেবারে নষ্ট হয়ে যেত। কেননা সেখানে স্ত্রীচরিত্রে ‘মাগিরা’ অভিনয়াদি করত। আমাদের বাড়ির স্টেজে কখনো স্ত্রীচরিত্রে মেয়েরা অভিনয় করেনি। ‘সিরাজদ্দৌল্লা’ নাটকে আলেয়া, লুৎফাদের দিব্য পুরুষ্টু গোঁফ ছিল। পার্ট করার সময় তাঁরা তা কামিয়ে নিতেন। সে গল্প পরে বলছি। আসল প্রসঙ্গে আসি। সেই স্টেজ এখন সাধারণ কাঠের দামে বিক্রি হচ্ছে। এভাবে ছোট এবং বড় বৈঠকখানার আসবাব সব বিক্রি হয়ে গেলেও বৈঠকখানা ঘর দুটি আরও কিছুকাল ছিল। বাষট্টি সালের প্রলয়ংকরী ঝড়ে তা ভেঙে পড়লে তার টিন, কাঠ, তক্তা সব বিক্রি করতে বেশ সুবিধে হলো। দুই বৈঠকখানার দুটি ভিত দুটি বড় চিতার মতো বাড়ির সামনেটায় দিনরাত খাঁ খাঁ করতে লাগল।
আমাদের ওখানের গঞ্জে একটি যাত্রাদল ছিল নাথ কোম্পানি নামে। তার অধিকারীমশাই, নাম গোপাল নাথ, একাধারে ব্যবসায়ী, তার ওপর যাত্রার দলের রোজগারে মবলগ দুপয়সার বড় মানুষ। তখনকার দিনে পুববাংলায় তাবৎ নায়েক বন্ধুরা তাঁর গুণগ্রাহী এবং অনুগ্রহভাজন ছিলেন। গোপাল নাথ জানতেন যে, আমাদের বাড়িতে থিয়েটারের নানারকম সরঞ্জামাদি আছে। যখন বাড়ির মূল্যবান বাসনপত্র এবং অন্যান্য শৌখিন জিনিসগুলো জলের দরে বিক্রি হচ্ছিল, নাথমশাই তার অনেক কিছুই কিনে নিয়েছিলেন। নাথমশাই মানুষ বেশ ভালোই ছিলেন। আমাদের বাড়িতে অভিনয়কালে বাবার অনেক অভিনয়ও তিনি করতেন। তাঁর দলের জন্য অভিনেতা নির্বাচন ব্যাপারটি শুনেছি বেশ দক্ষতার সঙ্গেই তিনি করতেন। অভিনেতা নির্বাচনের আগে জেনে নিতেন তারা আমাদের বাড়ির মঞ্চের অভিনয় দেখেছে কি না।
বাবার অভিনয় আর পাশা খেলার গুরু এবং জ্ঞাতি খুড়ো বিরাজ সেনমশাই। আমাদের বিরাজদাদু, এ সময় এই নাথমশাইয়ের কোম্পানিতে পেশাদার অভিনেতা হিসেবে কাজ নেন। বিরাজদাদু তখনকার দিনে সারা বাংলায় একজন নামকরা যাত্রা অভিনেতা। দীর্ঘকায় গ্রিসীয় চেহারার মানুষ। কণ্ঠস্বর যেন নাভিকুণ্ডলী থেকে উঠে সরাসরি মূর্ধাকে আঘাত করে। তাঁরই সুপারিশক্রমে নাথমশাই একদিন বাবার কাছে এলেন দাদুকে সঙ্গে নিয়েই। বাবা তাকে বিলক্ষণ খাতির-মহব্বত করে সৎকার করলে তিনি খুবই বিনয়ের সঙ্গে বললেন যে, যদিও এরকম একটা কথা উত্থাপন করতে তার কুণ্ঠা হচ্ছে, তবু ছোটবাবু যদি তার দলে যোগ দেন তবে তাঁর যোগ্য সাম্মানিক দিতে তিনি কার্পণ্য করবেন না। বিরাজদাদু বললেন, ভাইপো, না করইও না। আমারে দ্যাহ। কোনোদিন ভাবছেলা যে আমি যাত্রপালায় অভিনয় বেচুম? দ্যাহ, এহন আমিও হেই কাম করইয়াই তো খাই। তুমিও আয়ো। আর বাড়ির থিয়েটারের সামগ্রীগুলা নাথমশাইয়েরে দিয়া দেও। ওয়া আর আমাগো কোনো কামে লাগবে না। নাথমশাই উপযুক্ত মূল্য দিয়াই নেবেন। স্টেইজ ক্র্যাফটগুলা অকারণ নষ্ট অইতাছে। ওগুলাও দিয়া দেও। ওনার ব্যবসা আছে এসবের।
বাবা তাঁর খুড়োর দিকে সেদিন কীভাবে এ কথার পর তাকিয়েছিলেন, খেয়াল করে দেখিনি। এসব ভাঙনের দৃশ্য দেখে বোঝার বয়স সে নয়। পরে নানান কথাবার্তা স্মৃতি রোমন্থন ইত্যাকার ঘটনায় বুঝেছিলাম তাঁর সেদিনের অনুভূতি। বিশেষত, মায়ের কাছে এই দুই অভিনেতার অনেক গল্প শুনে শুনেও একটা ধারণা জন্মে গিয়েছিল তাই এসব কথা এখন লিখতে পারছি। বিরাজদাদু বলেছিলেন, ভাইস্তা, তোমারে আমি আর কী কমু। আমার বুকটাও তো ফাডইয়া যায়। এই স্টেইজ, এইসব সিন তুমি আর আমি কত মেহন্নত করইয়াই না বানাইছিলাম। আর আইজ দ্যাহ, তোমার গুরু অইয়াও আমিই তোমারে কইতে আছি যে এগুলা এহন জঞ্জাল। এগুলা বেচইয়া দেও। ভাইস্তা, অন্নঃ ব্রহ্ম ইতি। এইডাই শ্যাষ কথা জানবা। ‘অন্নাধ্যেব খল্বিমানি ভূতানি জায়ন্তে।/অনুরূপামৃতম্যডিভাতি ওঁ অন্নঃ ইব্ৰহ্মঃ।’ বাবা বলেছিলেন, সব তো বোজলাম, তয় দাদার ধারে না জিগাইয়া তো কিছু করতে পারি না। এ কথায় খুড়া ক্রুদ্ধ হন। বলেন, তোমার দাদায় করবে কাফা। হে ট্যাহে ট্যাহা বান্দুক তুমি গুষ্টি লইয়া মরো। বাবা বলেন, খুড়ো তুমি চেতইও না। আমারে তো জানো। দাদায় কইলে, আগুনেও ঝাঁপ দিমু, কিন্তু হ্যার অবাইধ্য হইতে পারমু না। তয় থিয়েটারের সরঞ্জাম আমার নিজস্ব ব্যাপার। নাথমশাইরে হেয়া আমি এহনই দিয়া দিতাছি। পয়সার লইগ্যা না। পয়সা উনি না দিলেও চলবে। উনি নাটকের আদর করেন এইডাই বড় কথা। ওনার সোমায়মতো লোক পাড়াইয়া উনি য্যান বেয়াক লইয়া যায়েন।
গোপাল নাথ এতক্ষণ কোনো কথাই বলেননি। শুধু খুড়ো-ভাইপোর হা-হুতাশ শুনছিলেন। এখন বললেন, ছোডোবাবু, আমি আপনেরে জোড়হাত করইয়া নিবেদন জানইয়া গেলাম, আপনে যদি আমার দলে আয়েন, হেডা আমার ভাইগ্য বলইয়া জানুম। বাবা বললেন, দেহি দাদায় কী কয়। নাথমশাই বললেন, জিনিসগুলা ফডিকরে দিয়া পাড়াইবেন। উপযুক্ত মূল্য দিতে আমি কসুর করুম না। এইভাবে থিয়েটারের সরঞ্জামগুলো চলে গেল। এর অনেক আগেই বিভিন্ন সিনগুলো কেটে মা আমাদের ইজের ইত্যাদি তৈরি করে দিতেন। তালুক থাকা অবস্থায়ও আমরা কোনোদিন ভালো জামাকাপড় পরেছি এরকম স্মৃতি নেই। একবার পুজোর সময় শুধু নায়েবমশাই পুজোর নানাবিধ বাজার করার সঙ্গে আমাদের জন্য ছিট কাপড়ের নতুন জামা ইজের কিনে এনেছিলেন। এখনও সে স্মৃতি বেশ জ্বলজ্বল করছে। কেননা সেই জামা এবং ইজেরের ভাঁজের ধুলোর দাগগুলো না ছেঁড়া অবধি বহাল ছিল। এ কারণে সিনের জামাকাপড় বহু আগে থেকেই আমরা পরতে অভ্যস্ত ছিলাম। এ বিষয়ে ক্রমশ আরও বিশদ হব। এখন বিরাজদাদুর আর তার ভাইস্তার অভিনয়জীবনের কথা বলি।
এই খুড়া-ভাইস্তার ব্যাপারটা জ্যাঠামশাইয়ের ততদিনই পছন্দের ছিল, যতদিন তাঁরা বাড়ির স্টেজকে আশ্রয় করে অভিনয়াদি করতেন। তখন জ্যাঠামশাই নাকি তাঁদের যথেষ্ট মদতও করতেন। বাড়িতে তখন প্রায়শই নাটক হতো। এসব গল্প শুনেছি সেই জান্দা বা জানকী নাথের কাছে। মা অথবা পাড়ার বয়স্ক-বয়স্কাদের কাছেও অনেক শুনেছি। তা ছাড়া বাড়িতে অভিনীত সেইসব নাটক একসময় পড়েওছি। উত্তরা, সিরাজদ্দৌল্লা, মির কাসিম, বঙ্গে বর্গী, মেবার পতন, শাহজাহান, কঙ্কাবতীর ঘাট, চণ্ডীদাস, পল্লিসমাজ এবং অনুরূপ হাজারও নাটক এখানে অভিনীত হয়েছে এবং এই খুড়া-ভাইস্তা সেসব নাটকের মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন। আগেই বলেছি গ্রামের অন্য একটি বাড়িতেও একটি মঞ্চ ছিল এবং সেখানেও এঁরা সবাই অভিনয় করতেন। জান্দা বলত, বোজলানি, উনি যহন সীতা নাটকে রাবণ সাজইয়া সীতা হরণের লইগ্যা তারে কান্ধে উড়াইয়া লইতেন, মেয়ারা কইতো হালায় হুদা রাবণ। নাইলে অত বড় এট্টা ছ্যামড়ারে ওইরহম কান্ধে উড়াইয়া লওন যায়? প্রসঙ্গত, সীতার অভিনয় যিনি করতেন তিনি কখনোই ‘ছেমড়ি’ ছিলেন না। তখন তাবৎ মহিলা চরিত্রে ‘ছ্যামড়ারাই’ ছেমড়ির ভূমিকায় অভিনয়াদি করতেন।
বিরাজদাদুর মদ্যপানে একটু অতিরিক্ত আসক্তি ছিল। গলায় একঢোক না নিলে তাঁর ‘পাট’ খুলত না। যখনই কোনো অভিনয়াদির ব্যাপার থাকত, বাবা নাকি ‘জান্দাকে’ গঞ্জে পাঠিয়ে খুড়োর ব্যবস্থাদির বিষয়ে মনোযোগী হতেন। জান্দার কাছে জেনেছি যে মেথরবাড়ি থেকে একবোতল মদ ওইসব দিনে নাকি প্রায়ই তাঁকে এনে দিতে হতো। আমাদের ওখানে মদের প্রচলন খুব একটা ছিল না। যাঁরা খেতেন তাঁরা মেথরবাড়ির ‘দেশি’ কোহলেই তেষ্টা মেটাতেন। কিন্তু বিরাজদাদুর নাকি ঢোক মানেই গেলাস, এরকম এক অভ্যেস ছিল। অভিনয়াদির সময় এ কারণে বিভ্রাট হতো খুব। বাবার কাছেই শুনেছি, উত্তরা নাটক হচ্ছে, বাবা ঘটোৎকচ, দাদু অর্জুন। বাবা বলতেন, কীসের ছাতার ঘটোৎকচ আর কীসের অর্জুন। খুড়া তহন আমার মদে টং। হে দেহি, বেয়াক আমার পাট কয়। আমি ফিসফিস করইয়া কই, খুড়া, ও পাট আমার, ওয়া আপনে কইবেন না। আপনে তো অর্জুন, আমার খুল্লতাত। মধ্যম পাণ্ডবপুত্র আমি ঘটোৎকচ। হেয়া কেডা শোনে কার কথা। খুড়ায় খালি ধাবার দে আর কয়, চোপড়াও বেয়াদব, বাইরেও তুই আমার ভাইস্তা, থিয়েটারেও তুই আমার ভাইস্তা। তুই আমারে শেখাবি? তো এই যহন অবস্থা, বাইরে হইচই? কী? না খুড়ায় খ্যাপছে। খুড়ায় খ্যাপছে না ঐরাবত খ্যাপছে। ফেলা ফেলা ড্রপ ফেলা, ক্যালেঙ্কারির একশ্যাষ। নাইলে বেয়াক মাডি। তখন ড্রপ ফেলে মুখরক্ষা। বেশ খানিকক্ষণ বাদে খুড়োকে টকদই এটা ওটা খাইয়ে আবার নাটকের শুরু।
এই গল্প শুধু নাটক, অভিনয় বিষয়ে নয়, এ গল্প ফেঁদেছি বড় বৈঠকখানার তাবৎ কথা বলার জন্য। এর বেশিটাই মায়ের কাছে শোনা। এইসব অভিনয়-কথা, বড় বৈঠকখানার আনুষঙ্গিক গল্প ইত্যাদির তাবৎ ভাণ্ডার ছিল তাঁর কাছে। ভাণ্ডার বলতে বেশ কয়েকটা সিন্দুক যেন তাঁর নিজস্ব দখলেই ছিল। তাঁর এই দখলদারির বা মালিকানার কারণও ছিল বেশ পোক্ত। বাড়ির ছোট বউ বা সোনাবউ হওয়ার সুবাদে, গেরস্থালি পরিচালনায়, অন্দরমহলে তিনিই ছিলেন একচ্ছত্র কর্ত্রী। বড় এবং ছোট বৈঠকখানা থেকে হামেশা চিরকুট আসত কর্তাদের। বেণুর মা, অদ্য জনাদশেক বিশিষ্ট অতিথি এই বাটিতে মধ্যাহ্নভোজন করিবেন। বিপিনকে দিয়া রণমতির বাজার হইতে আবশ্যকীয় ভোজ্যাদির সরঞ্জাম আনাইয়া লওয়া যাইতে পারে। নায়েবের নিকট হইতে পয়সা নিয়া বিপিনকে দিয়া আনাইয়া লওয়া হউক। মহাশয়েরা বড়ই মাইন্যমান। অতএব রন্ধন উত্তম হওয়া আবশ্যক। আপাতত, শ্বেতপাথরের গেলাস এবং পিরিচে দধির শরবত ও কিঞ্চিৎ উত্তম মিষ্টান্ন পাঠানো আবশ্যক হয়।—এরকম চিরকুট বৈঠকখানা ঘর থেকে তখনকার দিনে অন্তত বেশ কয়েকবার আসত। মাও বিনা বাক্যব্যয়ে সেসব সরবরাহ করতেন।
মা বলতেন, হে এক উদ্াগ। কত যে মানুষ তোগো এই বড় বৈঠকখানায় আইত হেয়ার শ্যাষ নাই। খালি একজোনেরই দেখছেলাম বৈঠকখানায় ঢোকেন নাই। বড় খালপারের বড় রেনট্রি গাছটার তলায় হেবার হেনায় আর হ্যার ভোলান্টিয়াররা সভা করইয়া গেলেন। খাওনদাওন আপ্যায়ন বেয়াকই হেহানে অইলে। তিনি নাকি সুভাষচন্দ্র। তার আগমন এবং সভাকরণ বিষয়ে বাবা নাকি স্বয়ং খুবই উদ্যোগী ছিলেন। ডাক্তারজ্যাঠা বলেছিলেন, তোমার বাবায় আর সুভাষবাবু পাশাপাশি বইছেলেন। হেয়ার ছবিও আছিল। যা হোক, সে ছবি আমি দেখিনি। মা নাকি তখন অসামান্য সব খাবারদাবার তৈরি করে তাদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা করেছিলেন। পরবর্তীকালে কিছু অসামান্য চিনেমাটির পেয়ালা-পিরিচ মায়ের আলমারিতে দেখেছি। সবুজাভ রং, মা বলতেন—এগুলা ওই যহন সুভাষবাবু আইছেলেন তহন আমি কেনাইছিলাম। আশ্চর্য! মায়েরা কোনোদিন ভদ্রলোককে নেতাজি বলতেন না। বলতেন, সুভাষবাবু, সতীন সেনমশাইকে বলতেন, সতীনদায়, শৈলেন দাশগুপ্তকে বলতেন, বেচউয়া, মা তাঁর মাসিমা ছিলেন।
মায়ের বিষ্টান্ন-সরবরাহক ছিল আমাদের ফটিক দাসের বাবা শশী দাস। তার ছিল একটা বিস্কুটের ‘তাবাল’। আর সেই তাবালের পাশের চুলোয় রসগোল্লার রস সহযোগে মোদকের সামগ্রী বানাত। শশী দাসের রসগোল্লার চাঙাড়ি আর বিস্কুটের তাবাল ছিল মায়ের অতিথি সৎকারের ভাণ্ডার। সেখানে মাসকাবারি ব্যবস্থা ছিল তাঁর। কেউ গিয়ে বললেই হয়। শশী দাস বলত, ‘রসগোল্লা ট্যাহায় ষোলোড়া। একটা একপয়সা। য্যার নেতে অয়, নেও, না নেতে অয়, নৈকাডির হাড়ে যাইয়া হোগামারাইয়া দুপয়সায় কেনো এহেকটা। খাইয়া দ্যাখফা কেমন লাগে। হোগামারনডুক ফাউ। হোগামারানো বলতে এ ক্ষেত্রে ওই দীর্ঘপথ অতিক্রম করা বুঝতে হবে। অসভ্য অর্থে নয়। সে যা হোক, শশী দাসের বাণিজ্যরীতিটি ছিল এরকম। শুধু মায়ের ব্যাপারে তার রীতকানুন ছিল আলাদা। বলত, সোনাঠাইরেণের ব্যাপার আলাক। হেনায় যদি চায়েন এককুড়ি রসগোল্লা, মুই দিমু দুকুড়ি। জানি তো, লাগবে হ্যানে। আর মোর পয়সারও চিন্তা নাই। পোলা দুইডারে তো হেনার ধারেই দিয়া দিচ্ছি। সে পোলাদের কথা পরে বলা যাবে। এখন মায়ের অন্য বিত্তান্ত বলি।
মা বলতেন, স্বদেশি যুগে এবং দেশভাগের পরেও তাবড় তাবড় নেতারা নাকি বাড়িতে আসতেন, আর এই রকম চিরকুট আসত বৈঠকখানা থেকে। এর মধ্যে শুধু সতীনদাদাই অন্দরে আসতেন। বউমাদের খবর করতেন। বাকিরা বাইরে থিহা আইতেন, বাইরে থিহা যাইতেন। মা চিরকুট অনুযায়ী খাবারদাবারের ব্যবস্থা করতেন। তখন মহালের আয় ছিল অসুমার। কোনো কিছুই অপ্রতুল নয়। দুপুরের রান্নার বাড়তি ভাত পিছারার পুহইরে ঢালইয়া দেত ঝি মাথারিরা, মাছেগো খাওনের লইগ্যা। পাড়া-প্রতিবেশীরা বলত যে, মা লক্ষ্মীর এরকম অসম্মান তিনি সহ্য করবেন না। তখন বাজার সরকার মোটা পেতলে বাঁধানো তেল চকচকে বাঁশের লাঠি হাতে এব্লা ওব্লা আসত বাড়ির তেল-মশলা সরবরাহ করতে। রান্নার মশলাপত্তর, তেল এইসব জোগান দিত সে। জান্দার কাছে শুনেছি যে, একবার নাকি সে তার লাঠিখানা দেখতে চেয়েছিল। কিন্তু তেল-সরকার তা দেখতে দিতে চায়নি বলে জান্দা লাঠিখানা নিয়ে টানাটানি শুরু করে। তার বোধহয় কোনো সন্দেহ হয়ে থাকবে। একসময় লাঠির মাথার পেতলের মুখটি খুলে যায় এবং প্রায় সের তিনেক তেল ভলকে ভলকে বেরিয়ে পড়ে। সরকার অপ্রস্তুত। জান্দাকে আড়ালে নিয়ে তখন তার আবেদন, ক্যারুরে কিছু কইও না।
পেছনে পিছারার খাল, সামনে বড় খাল। বড় খালের ওপর যে পুলটি (পুল মানে এখানে ব্রিজ ধরতে হবে) সেটি আমাদের খানাবাড়ির জমির শেষ প্রান্ত। বড় খালের ওপর দেহ এলিয়ে সেই বৃহৎ রেনট্রি, আর তার তীর থেকে খানিক প্ৰশন্তে আরেকটি। পুল পেরিয়ে রাস্তাটি ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তা। আমাদের রায়বাহাদুর ঠাকুরদা ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের একজন মেম্বারও ছিলেন একসময়। তাঁরই দৌলতে ওই রাস্তাটি হয়েছিল, যার দীর্ঘতা গঞ্জ অবধি। রাস্তাটি বিখ্যাত, কিন্তু কাঁচা, তাহলেও সভ্যতা থেকে তিন মাইল যোগাযোগরক্ষাকারী একটি সুউচ্চ মৃন্ময় রাস্তাও সে যুগে কিছু ফেলনা ব্যাপার নয়। আর বড় খালপারের সেই মহাবৃক্ষদম্পতির গভীর মাহাত্ম্য তো আছেই।
তবে আমার স্মৃতিতে রাস্তার মাহাত্ম্য অনেক হলেও রেনট্রি গাছদুটির উপস্থিতির প্রগাঢ়তা অনেক বেশি। বড় বৈঠকখানা, দিঘি, পুকুর দুটি, পোস্ট অফিসের বাড়িটি এবং লোহার পুলটি আমার কাছে অনেক গভীর বার্তাবহ। আমরা বলতাম, ‘পোলকাটা’ অর্থাৎ পোলঘাটা। এখানে এককালে একটি কাঠের ঘাট তৈরি করা হয়েছিল, পুলটির ঠিক গায়ে। ওই যেবার সুভাষবাবু আইলেন, হেইবার করা অইছেলে। বিধুমুখী ল্যান্ডিং ঘাট। ওই ঘাট দিয়েই নাকি মহাশয় অবতরণ করেছিলেন লঞ্চ থেকে। বিধুমুখী আমার বাবা, জ্যাঠামশাইয়ের ঠাকুমা অর্থাৎ জগৎ সেনমশাইয়ের বিধবা। এই রেনট্রির তলায়ই মায়েদের সুভাষবাবুর সভা হয়েছিল। আমি সেসব গল্প শুনেছি, দেখিনি। কিন্তু সে আমার অনুষঙ্গ নয়। আমার অনুষঙ্গ হচ্ছে, আমাদের বড় বৈঠকখানা থেকে শুরু করে এই ‘পোলঘাটার’ রেনট্রির তলা পর্যন্ত যেসব লোকাচরণ এবং লোকানুষ্ঠানগুলো হয়েছে সেইসব। তার সঙ্গে অবশ্যই এর বিপরীতকল্প ঘটনার স্মৃতিমন্থন, যা আমাদের হিন্দু এবং মুসলমান উভয় সমাজের শিকড়ে বিষ প্রয়োগ করেছিল এবং যে বিষের জ্বালায় আজও আমরা সবাই জ্বলছি, জ্বলছি এই উপমহাদেশ জুড়েই। আমার আজও কেন যেন মনে হয় ওই বৃক্ষ দুটিই আমার পিছারার খালের জগতে পিতামহ এবং পিতামহী এবং তা সম্প্রদায়-নির্বিশেষেরই, আর আমরা যেন তাদের নির্দেশ কখনোই মানিনি বলে আজ এই অন্ধকারে।
এইখানের এই রেনট্রি গাছের নিচে, দেশভাগ এবং দাঙ্গার পরেও, যখন পাকিস্তান তার প্রতাপে প্রায় উগ্রচণ্ড, তখনও বিজয়া দশমীর মেলায় হিন্দু এবং মুসলমান অপবর্ণীয় বা বর্গীয় মানুষদের আপসে ছোরাখেলা, লাঠিখেলা দেখেছি। আমাদের বড় বৈঠকখানার সিঁড়ি পেরিয়ে দুপাশের গোলাপবাগান ছাড়িয়ে, তারপর ডান-বাঁয়ে দুটি বড় পুকুরের মাঝখান দিয়ে আরও এগিয়ে এসে দিঘির ঘাটলা বাঁয়ে রেখে প্রায় সিকি মাইল বিস্তৃতিতে ব্যাপক মানুষের মেলা দেখেছি, যারা ভিন্নধর্মী হয়েও নিতান্ত স্বজনের একাত্মতায় সেখানে মিলেছে। সেখানে রাতের পর রাত গুণাবিবির গান হয়েছে। রূপভান কন্যার পালা হয়েছে, রয়ানি, কীর্তন ইত্যাদি কীই-বা না হয়েছে। কিন্তু সেসব একসময় ওই পিছারার খালের মতোই যেন শুকিয়ে গেল।
এইসব কথা বলতে গেলে খেই থাকে না। দেখার স্মৃতি শোনার স্মৃতি সব মিলেমিশে এক হয়ে যায়। শুধু জ্বলজ্বল করে কিছু বিশেষ মুহূর্ত। যেমন আমাদের শেষ সামন্তক্ষণের বেচাকেনা করে দিন গুজরানের কথা। বাড়ির থিয়েটারের স্টেজ, সেট সেটিংস, অভিনয়ের পোশাক, অস্ত্রশস্ত্র, পরচুল, দাড়ি এইসব বিক্রি হয়ে যাওয়া। সিনসিনারিও দিয়ে আমাদের জামা ইজের তৈরির কথা। সিনসিনারিগুলো, আগে থেকেই এর অন্য ব্যবহার শুরু হওয়ায়, সেগুলো বিক্রি করা হয়নি। ওগুলো যাত্রার অভিনয়ে কাজেও লাগে না। ওই যে একবার নায়েবমশাইয়ের এনে দেয়া নতুন জামাকাপড় পুজোয় পেয়েছিলাম, স্মৃতিতে নতুন জামাকাপড় সেই প্রথম এবং সেই শেষ। তার পরের স্মৃতিই ‘সিন’কাটা ইজের এবং জামা। মা বানাতেন, আমরা পরতাম। কারও ইজেরের পাছায় মুর্শিদাবাদ প্রাসাদের খানিকটা, কারও সামনের দিকটায় বর্গিরা ঘোড়সওয়ার হয়ে বল্লম উঁচিয়ে লড়াকু, কারও জামার পাশে হয়তো একটা মন্দিরের চূড়ার খানিকটা বা একটা প্রাচীন ঘাটের সিঁড়ি। সে এক অনবদ্য শিল্প।
‘সিরাজদৌল্লা’ নাটকের গানগুলো মা খুব ভালো করেই তুলেছিলেন। বাবারও ওই নাটকটি খুবই পছন্দের। বরাবর নাম-ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। দশজনে তারিফ করেছে। আমি দেখতাম মা এইসব ‘সিন’ কেটে জামা ইজের বানাবার সময় একাগ্রমনে গাইতেন সেইসব নাটকের গান —
পথহারা পাখি
কেঁদে ফিরি একা—
আমার বয়স তখন খুব কম হলেও তার কষ্ট এবং আবেগ কিছু যেন বুঝতাম। বাবা পালঙ্কের ওপর বসে একের পর এক ফরমাশ করতেন, ওই গানটা করো না, ওই যে, বলে নিজেই বেসুরো গলায় গাইতে চেষ্টা করতেন, মা ধরে নিতেন –
বাহিরে অন্তরে
ঝড় উঠিয়াছে
আশ্রয় যাচি হায়
কাহারও কাছে।
বস্তুতই তাঁদের তখন বাহিরে-অন্তরে একটা ঝড়ের ব্যাপার ঘটত এবং তাঁরা কোথাও আশ্রয় পেতেন না যেন। তাঁরা যে জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন, তার দুঃখনিশি ভোর কোনো দিনও হয়নি, হওয়ার কথাও নয়। সুতরাং মায়ের গাওয়া সেই গান—
বুঝি দঃখনিশি মোর
হবে না হবে না ভোর
ফুটিবে না আশার
আলোকরেখা।–
প্রকৃতই তাঁরা তাঁদের আশার আলোকরেখার সাক্ষাৎ আর কোনো দিনই পাননি। তাঁরা ছিলেন প্রকৃতই পথহারা পাখি।
মা এইসব গান করতেন সেসব দিনে। তাঁর স্মৃতিতে এসব তখনও বড় জ্বলজ্বলে। কাটা সিনের ওই ছবিগুলো, ওইসব নাটকের অনুষঙ্গ খুব স্বাভাবিকভাবেই আসত তাঁর মনে। কিন্তু কী গভীর দুঃখময় তখন তাঁর গায়কী। হায়! এই তো সেদিনেই না এইসব তিনি মঞ্চে দেখেছেন, যে মঞ্চে তাঁর স্বামী এবং অবশ্যই যিনি তাঁর দয়িত পুরুষ, যিনি একজন সুঠাম সাবলীল যুবক নায়ক, তিনি এইসব দৃশ্যের পটে নবাব, বাদশা বা চক্রবর্তী সম্রাটের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। হায়! আজ তাঁর সেইসব সামগ্রী ব্যবহার করতে হচ্ছে তাঁদেরই সন্তানদের লজ্জা নিবারণের বস্ত্র হিসেবে। তিনি আর তাঁর এই পুরুষটিকে ‘সিরাজ’ হিসেবে দেখবেন না। প্রতিবেশী মেয়ে-বধূরা আর কোনো দিন তাঁর দিকে ঈর্ষাতুর চক্ষে তাকাবে না এবং ভাববে না যে ওই পুরুষটি এই নারীর দয়িত এবং স্বামী। এই দাহ যে কী অসম্ভব দাহ, মায়ের গান শুনে ওই বয়সেও আমি যে তা বুঝিনি এমন নয়।
ছোট বা বড় বৈঠকখানায় দিনমানে কোনো দিন বাড়ির বউ, মেয়ে, ঝিয়েরা যেতে পারত না। কেননা, তা ছিল পুরুষদের রাজপাট। সেখানে যখন নাটক-মাইফেল হতো, তখন ছোট বৈঠকখানাটি ছেড়ে দেয়া হতো বাড়ির মেয়েমহলের জন্য। ছিকের আড়ালের ব্যবস্থা অবশ্য আমি দেখিনি, তবে শুনেছি এককালে প্রায় সে রকমই কিছু ব্যবস্থা তাদের জন্য রাখা হতো। দুর্গাপূজার আরতি দেখা বা এইসব নাটকাদির অভিনয় দেখার জন্য তাদের ব্যবস্থা হতো এখানে। বাড়ির মেয়েদের কোনো দিনই বড় বৈঠকখানায় যেতে আমি ওই শেষ অবস্থায়ও দেখিনি। অন্দরমহল থেকে বৈঠকখানার দূরত্ব ছিল প্রায় দেড়-দুশ মিটারের রাস্তা। একমাত্র বিজয়ার দিন গোটা দুর্গামণ্ডপ আর বড় বৈঠকখানা তাদের দখলদারিতে ছেড়ে দেয়া হতো। তখন আইশ্য পইশ্য অতিথি অইভ্যাগত পুরুষদের সেখানে অধিকার থাকত না। মহিলাদের জন্য তখন তা ছেড়ে দেয়া হতো। সেখানে যেমন বাড়ির বা পাড়ার মহিলারা থাকতেন, তেমন আশপাশ মিঞাদের বিবিরাও ভিড় করতেন। তখন প্রতিমাবরণ, সিন্দুর খেলার পাট চলত। পুরুষদের মধ্যে বরণবাদ্য বাজানোর জন্য নট্টমশাইয়েরা, মণ্ডবী জানকী নাথ এবং তার সহযোগী কিছু আবশ্যকীয় চাকর পুরুষরাই থাকতে পারত। এই সময়টি ছাড়া মেয়েরা কখনো বড় বৈঠকখানার চৌহদ্দিতে যাবার অধিকার পেতেন না। ওখানে তখন থাকত বড়বাবুর দরবার। কত প্রজাপাট, কত মানুষজন, কত বিচার-আচারের রহট সেখানে। সাধারণ ‘মাথারিরা’ কে সেখানে যেতে পারে? এ সময়ে জ্যাঠামশাই বড় একটা বাড়িতে থাকতেন না। একদিন সন্ধ্যার পর মা আমায় বললেন, এহন তো ভাসুর ঠাকুর বাড়ি নাই। আমারে এট্টু বড় বৈঠকখানায় লইয়া যাবি? তখনও আটচালা বড় বৈঠকখানা ঘরটা ঝড়ে ভেঙে পড়েনি, তবে মঞ্চটা বিক্রি হয়ে গেছে। মায়ের কথায় তাঁকে নিয়ে গেলাম সেখানে। শূন্যতা খাঁ খাঁ করছে চারদিকে। মঞ্চের ফাঁকা জায়গাটায় চাঁদের আলো পড়ে শূন্যতা যেন আরও অনেক বেশি প্রকট হয়েছিল সেদিন। চারদিকে কেউ নেই। বড় বৈঠকখানার এ রকম শূন্যতা আমাদের অন্দরবাসিনী মায়ের বোধহয় কল্পনায় আদৌ ছিল না। তিনি হয়তো ভাবছিলেন, হয়তো কেন, নিশ্চয়ই ভাবছিলেন, এই কি সেই স্থান, যেখানে তাঁর সুদর্শন, সুঠাম শরীর, নায়কোচিত কণ্ঠসম্পদের অধিকারী স্বামী এবং দয়িত অভিনয়কালে স্বর্ণসীতাকে জীবন্ত সীতাভ্রমে সীতা সীতা সীতা বলে উন্মাদের মতো আলিঙ্গনে উদ্যত হতেন? এবং মা যে তখন নিজেকেই জীবন্ত সীতা মনে করে অশ্রুজলে বুক ভাসাতেন, এ বিষয়ে আমার কিছুমাত্র সন্দেহ নেই। কেননা আমি তো মায়ের কাছে এবং অন্যজনেদের কাছেও শুনেছি যে, সেইসব দিনে এই মঞ্চে ‘সিরাজদৌল্লা’ নাটক অভিনয়কালে ‘আলেয়া’ নামে সভানর্তকীটি, যে আসলে একজন উঠতিবয়সি ছোকরা, তার কোকিলকণ্ঠের গান-
আমি আলোর শিখা
অন্ধ আঁধারে আমি দীপকণিকা-
শুনে মা তার প্রতি ঈর্ষিতা হতেন। মায়ের সখীরা, যাঁরা ছিকের আড়ালে ছোট বৈঠকখানা থেকে এই ‘ঠিয়াটার’ দেখতেন, তাঁরা ওই আলেয়াবেশী ছোকরাকে মায়ের সতীন বলে ঠাট্টা করতেন। এভাবেই চন্দ্রগুপ্ত নাটকে ছায়াকে ঈর্ষা করতেন তিনি। কিন্তু কীসব মধুর ঈর্ষার দিনই না গেছে। যেন এক স্বপ্নের মতো ব্যাপার ঘটল তাঁর জীবনে। আজ সেই স্থানে চাঁদের জ্যোৎস্না যেমন প্রাচীনকথা মনে পড়িয়ে তাঁকে আকুল করছে, তেমনই সেই স্মৃতিতাড়নায় মা যেন এক হরিষ বিষাদে অন্যরকম হয়ে গেলেন।
মঞ্চের এলাকাটি পরিক্রমা করে আবিষ্টের মতো মা একবার উত্তরের দুর্গামণ্ডপের সিঁড়ির দিকে, একবার পশ্চিমের ছোট বৈঠকখানার বাঁধানো সংযুক্তির দিকে, আবার কখনো যে কোনটিকে সাজঘরের এলাকা ছিল, সেইসব স্থানে ঘুরতে ঘুরতে পুবের লাল-সাদা আরামবেদিকা দুটি পেরিয়ে ওই রঙেরই সোপানগুলো ভাঙতে ভাঙতে তিনিও যেন একসময় শেষ সোপানটিতে গিয়ে ভেঙে পড়েন। সামনে বিস্তীর্ণ রাস্তার দুপাশের মাঠেও জ্যোৎস্না পড়েছে। কিন্তু খাঁ খাঁ করছে। ফুলের বাগানটা আর নেই। গোলাপ গাছগুলোও নেই। বাঁ-হাতি দাদুর বাগানের দিকটা তখন আর দেখা যাচ্ছে না। দেখা গেলে মা জানতে পারতেন, ওই কাঁটাতারে ঘেরা বাগানটিতে অতি পরিচিত গেটটিও ভেঙে গেছে। বাগানটি আর বাগান হিসেবে নেই। শুধু দাদু আর ঠাকুমার পাশাপাশি চিতা দুটি এখনও মাথা উঁচু করে আছে, তাও নেহাত মাটির স্পর্ধায়। সেখানে কোনো সমাধিসৌধ নির্মিত হয়নি। কেন হয়নি তা জানি না। তবে তাঁরা যখন গত হয়েছিলেন, তখন হতে কোনো বাধা ছিল না, বরং এটাই তখন রীতি ছিল।
বড় বৈঠকখানার শেষ পৈঠায় বসে মা দুহাতে মুখ ঢেকে এক হাহাকার-কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন সেদিন। আমি কিছুটা বুঝে, কিছুটা না বুঝে, ওমা, মা, মাগো, তুমি কান্দ ক্যান? বলে তাঁকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দেয়ার প্রয়াস পাচ্ছিলাম। কান্নার আবেগ প্রশমিত হতে মা খুব দরাজকণ্ঠে গান গাইতে শুরু করলেন। মা, তাঁর ওই হাহাকার-কান্নার পর যে গানটি ধরলেন, তা বড় অর্থবহ তাঁর এতাবৎকালের যাপিতজীবনের পরম্পরায়। গানটি ছিল—
ভেঙে গেছে মোর স্বপ্নের ঘোর
ছিঁড়ে গেছে মোর বীণার তার
ভগ্ন পরানে, এ মহাশ্মশানে
আজি কি মা গান গাহিব আর।
মা এ রকম অনেক গানই একের পর এক গেয়ে যাচ্ছিলেন সেদিন। আমি শুনছিলাম আর ভাবছিলাম। ভাবছিলাম, মায়ের কী দুঃখ! এর বেশি সেদিন আর কিছু ভাবিনি। কিন্তু পরে ভেবেছি এবং বুঝেছিও, মায়ের ব্যাপারটা শুধু একদার সুখস্মৃতি এবং পরবর্তীকালের সব হারানোর দুঃখ-বেদনাই শুধু নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আরও অনেক কিছু। সেসব মানুষের শেকড়-বাকড় শুকিয়ে যাওয়ার অথবা নষ্ট হয়ে যাওয়ার ব্যাপার। মা যে খুব সুশিক্ষিতা মহিলা ছিলেন না, সে কথা আগেও বলেছি, কিন্তু তার ভাবের গভীরতায় কোনো খামতি ছিল না বোধহয়। যেদিনকার কথা বলছি, তখন আমার বয়স বা মানসিকতা এই ভাবের বিষয়ে যথেষ্ট সংবেদনে হয়তো ছিল না, কিন্তু পরবর্তীকালে স্মৃতি তাঁর এই গহন বোধ বিষয়ে আমাকে বড়ই শ্লাঘার জগতে পৌঁছে দিয়েছে। এই বোধই কি মানুষকে বিপন্ন বিস্ময়ে প্রোথিত করে? অথবা এই কি মায়ের কাছ থেকে আমার প্রাপ্য উত্তরাধিকার?
সেদিন যখন সেই বহির্বাটির শূন্যতা প্রদক্ষিণ করে মা আর আমি অন্দরের অবরোধে গেলাম, তখন বাবা তাঁর সতত আশ্রয় পালঙ্কটির ওপর স্বভাবসম্মতভাবে ধ্যানাশ্রয়ী। ওই পালঙ্কটি তখনও বিক্রি হয়ে যায়নি। এটি তাদের বিয়ের পালঙ্ক। পরে অবশ্য এটিও বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। আমি ঘরে না ঢুকে দরদালানের সামনের সোপানে বসেছিলাম। মা ঘরে চলে গিয়েছিলেন। আমার কানে এই সময় একটা জলদমন্ত্র কণ্ঠস্বর পৌঁছেছিল। সেই কণ্ঠটি বাবার। আজ পর্যন্ত তার রণন ভুলিনি। শ্মশান দেইখ্যা আইলা? কেমন দ্যাখলা?’ বাবা যে আমাদের এই নৈশপর্যবেক্ষণ খেয়াল করেছেন এবং তাঁর স্ত্রীর এই দুঃখভোগের শরীকও হয়েছেন তা বুঝলাম যখন মায়ের হেঁচকি তুলে কান্নার শব্দ এবং প্রত্যুত্তরে বাবার উচ্চারণ শুনলাম। সময় সব সৃজন করে, সময়ই তা ধ্বংস করে। সময় বা কালের মাহাত্ম্য কেউই পুঙ্খ পুঙ্খ জানে না। কাল স্তম্ব থেকে ব্রহ্ম, অর্থাৎ প্রত্যক্ষ থেকে অনির্বচনীয়ে শুদ্ধমাত্র ধারণায় প্রলম্ব। প্রত্যক্ষে আমরা শুধু সৃজন, বর্ধন এবং ধ্বংসকেই অভিজ্ঞতায় পাই। মহাজনেরা তাই সৃজনেও উৎফুল্ল হয় না, বিধ্বংসেও কাতর হন না। আত্মস্থ হও এবং সব গ্রহণ করো। এ ছাড়া উপায় নেই।
বাবা, মায়ের বোধ্য সংলাপেই এইসব বলছিলেন। তিনি, আগেই বলেছি, আবেগতাড়িত নটচরিত্রের মনুষ্য। অত্যন্ত সংবেদনাহত হলে অনর্গল নাট্যসংলাপ বা কবিতা আবৃত্তি করা ছিল তাঁর স্বভাব। মাকে খুবই স্নেহের সঙ্গে আহ্বান করে বললেন, বসো, শোনো এ কথা তোমাকে ছাড়া আর কাউকেই তো শোনাতে পারিনি। শোনো, বুঝতে পারবে—
Ask her forgiveness?
Do you but mark how this become the house :
Dear wife (daughter), I confess I am old;
Age is unnecessary; on my knees I beg
that you’ll vouchsafe me raiment, bed and food.
শেকসপিয়রের রচনায় যেখানে daughter শব্দটি ছিল, মনে আছে, বাবা অবলীলাক্রমে সেখানে wife শব্দটি ব্যবহার করলেন। বাবা হামেশা এ রকম করতেন। এ রকম ব্যবহার প্রায়ই তাঁর আবৃত্তিতে শুনেছি বলে প্রায় মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। বাবা শেকসপিয়র খুব পছন্দ করতেন এবং সততই তা অধ্যয়নও করতেন। এ কারণেই দেখেছি, সঠিক সংলাপটি সময়মতো তাঁর এসে যেত। মায়ের শিক্ষাদীক্ষার বিষয়টি আগেই বলা হয়েছে। ইংরেজি ভাষায় তাঁর আদৌ কাণ্ডজ্ঞান ছিল না। কিন্তু বাবার কাণ্ডজ্ঞান মায়ের থেকে কিছু অধিক ছিল না বলে এইসব সংলাপ মাকে শুনতেই হতো, তা কী হর্ষে কী বিষাদে। আবার এও এক চমৎকারিত্ব যে, এভাবেই আমাদের মা একসময় তাঁর নিজের ধরনে এইসব সংলাপের তাৎপর্য বুঝতেও পারতেন। তাঁর স্বভাবের মধ্যে বাবার স্বভাবের এক ছায়াচেতনা যেন গ্রথিত হয়ে গিয়েছিল। সেদিনের সেই সান্ধ্য ঘটনার প্রেক্ষিতে তা অন্তরাল থেকে আমার শ্রবণে যেন আরও বেশি গাঢ়তায় ধরা পড়েছিল। বাবার ওই আবৃত্তি মা কী বুঝেছিলেন জানি না। আবৃত্তি শেষে বাবা বলেছিলেন, কিছু গাও, মা তাঁর কান্নাজড়ানো কাঁপা কাঁপা গলায় যে গানটি গেয়েছিলেন, সিঁড়ির সোপানটির শেষ ধাপে বসে সেই গান শোনার স্মৃতি আমার আজও ম্লান হয়নি। সেটি বড় তাৎপর্যপূর্ণ গান অতুলপ্রসাদের, তার অন্তরাটি ছিল—
ঝড়েতে বাঁধন টুটে
দিশাহারা ধেনু ছুটে
তাই তরি তব তটে
লাগিল এবার।
সেদিন ওই পরিবেশে গানটি আমাকে যত না মোহিত করেছিল তার দশগুণ বেশি আবেগমথিত করেছিল আমার বাবাকে। কারণ বড় বৈঠকখানা, মঞ্চ এবং এ ব্যাপারে তাবৎ অনুষঙ্গ তো তাঁরই নস্টালজিয়া। আমি শুধু এই বেদনার এক অবশ্যম্ভাবী গ্রাহক মাত্র। সংবেদনশীল কোনো মানুষ যেমন কোনো প্রতিভাধর ধ্রুপদী গায়কের সুরমাধ্যমের আর্ত বিচরণের গ্রাহক হয়, আমার তখন তেমনই অবস্থা।
বাবা আবেগমথিত সময়গুলোতে যেন ঠিক প্রকৃতিস্থ থাকতেন না। হয় ক্রমান্বয়ে নাটকের সংলাপ বা কবিতার চরণ আবৃত্তি করতেন, অথবা মাকে আদেশ করতেন গান গাওয়ার জন্য। এই সময়ে আমি তাঁকে এ রকমই দেখেছি। তখন কখনো শেকসপিয়র থেকে, কখনো-বা গিরিশচন্দ্র থেকে অনর্গল আবৃত্তি করে যেতেন। তাঁর কণ্ঠে প্রসাদগুণ ছিল এবং আমাদের এই ব্যাপক কক্ষগুলো অতিক্রম করে তাঁর ধ্বনি এবং সুস্পষ্ট সুন্দর উচ্চারিত শব্দগুলো দরদালানের বিস্তৃতিতে গমগম করত। ওইদিন, এ কথা পরে আমার মনে হয়েছে যে, তাঁর অতীতের সম্পদশীল জীবনচর্যার সময়ের সামন্তসুলভ আচরণাবলি হয়তো তাঁকে ক্ষতবিক্ষত করছিল। বোধহয় তাঁদের অকারণ প্রজানিগ্রহে যে অন্ন এবং সম্পদ আহৃত, তার ভোক্তা যে তিনিও, এ কথাই ওইসব আবৃত্তি, উদ্ধৃতির মাধ্যমে প্রকাশ করতে চাইতেন তিনি।
মায়ের গানটি শেষ হলে আমি সিঁড়ির সোপানে বসে ওই গমগমে আওয়াজে শুনেছিলাম তাঁর আবৃত্তি–
জানো না জানো না কৃশোদরি,
যে অনলে জ্বলে প্রাণ মম; তাই কই
ব্যথা দিতে করি কথা আলোচনা;
সরলে, জানো না
দিন দিন পলে পলে কত সহি
উন্মত্ত প্রভাবে দুৰ্ম্মদ ক্ষত্ৰিয়কুল
নিত্য নিত্য করে বলো পরস্পরে
দীন প্রজা বিকল্প বিগ্রহে,
কারু শস্য দহে শরানলে
কারু গৃহ রথসঞ্চালনে,
কষ্টার্জিত ধন নিত্য দেয় রণব্যয়ে,
জায়া পুত্ৰ অন্ন বিনা মরে।
এইসব আগে, পরে, তাঁর আবেগের সময় অথবা জ্বরতপ্ততায় অনেকবারই শুনেছি বলে মনে আছে। মায়ের গাওয়া শেষ গানটি ছিল সেদিন বড়ই আক্ষেপের
এ জীবনে মিটিল না সাধ
ভালোবাসি।
বাবার স্পর্শকাতরতা, আবেগ ইত্যাদি মাকে এতই প্রভাবিত করেছিল যে, তিনি সারাটি জীবন যেন তাঁর ছায়ামাত্র হয়েই বেঁচেছিলেন। বাবার যে মানসিক দ্বন্দ্বটির কথা ইতিপূর্বে বলেছি, তার প্রশমনের জন্য মায়ের এই আজীবনের নিবেদিত চিত্ততা এক অসামান্য শান্তির প্রলেপ বলে আমার বরাবর মনে হয়েছে। এ রকম গাঢ় দাম্পত্য সম্পর্ক আজ অবধি আমি দেখিনি।
মা লিখেছিলেন, আজ দীপযাত্রা। (কিন্তু) আমার জীবনদীপ তো নিভিয়া গিয়াছে। আমি আজ অন্ধকারে থাকিব। আজ আলো আর আমার ভালো লাগে না, আজ আর আমার কিছুর দরকার নাই এ পৃথিবীতে, ছেলেমেয়েরা বড় হইয়াছে। এখনই তুমি তোমার জন্য বাঁচা দরকার মনে না করিয়া চলিয়া গেলে আমাকে নিলে না? আমি আজ একেবারেই সংসারে (নিজেকে) অশান্তি বলিয়া মনে করি। কোনো কাজেই তো আর লাগি না।