আঠারো
একটা সময় ছিল যখন পিছারার খাল এবং বড় খালের দুই পারের ভদ্রলোক-হিন্দু যাঁরা, তাঁদের কেউ কেউ কলকাতায় থাকেন, চাকরি করেন, দোল-দুগ্গোচ্ছব-পূজাপার্বণে বাড়ি আসেন। পরিবারস্থ অন্যান্যরা দেশের বাড়িতেই থাকেন। জমিজমা, চাষবাস ইত্যাদি দেখাশোনা, সাতপুরুষের নানান আইশ্য নিয়ম পালন এইসব তাঁদের কাজ। কলকাতার বাবুদের দেশের বাড়িতে বড় কদর। তাঁরা দেশ-বিদেশের নানান খোঁজখবর রাখেন, রাজনীতি সমাজনীতি নিয়ে নানান তর্ক-বিতর্ক করেন। চকচকে শরীর, চা-বিস্কুট খান, শৌখিন ধাত তাঁদের। আর যাঁরা প্রান্তিক সাধারণ মানুষ, যারা বছরভর চাষবাস ফাইফরমাশ খেটে দিন গুজরান করে, তারা অবাক বিস্ময়ে এঁদের দেখে। তাঁদের সামান্যতম কাছাকাছি আসতে পারলেও শ্রদ্ধাভক্তিতে আনত হয়ে কৃত কৃতার্থ বোধ করে। মাঝেমধ্যে টাকাটা সিকেটা, জামাটা ধুতিটা পেয়ে ভাবে—বড় মাইনষেরগো পোলা, দিলডা বড় তো অইবেই। এইসব ভদ্রলোকবাড়ির কামকাজে আশপাশের ব্যাপক সাধারণ হিন্দু-মুসলমানজনের রুজি-রোজগার। এঁদের পার্বণই তাঁদের পার্বণ। এঁদের সুদিনেই তাঁদের সুদিন। শতচ্ছিন্ন হাঁটু ধুতি পরনে নিশিকান্ত নাটুয়া অথবা ‘আষ্ট গোন্ডা তালিমারা’ লুঙ্গিধারী এরফানউল্লাহ, এ কারণে, যখন একটা কোডা ধুতি বা ‘চ্যাক চ্যাক’ লুঙ্গি উপহার পায়, তারা আহ্লাদে বেশক ‘ফাউকায়’। আট-দশ গ্রাম ঘুরে, তারা এই সম্মানের বৈভব দেখায় মানুষদের,—অমুক বাড়ির কইলকাতইয়া বাবু দেছে। পোশাকের চাইতেও পোশাক প্রাপ্তির সম্মান তখন তাদের কাছে বড় হয়ে ওঠে। আবার এইসব কলকাত্তাই বাবুরা যখন এই পিছারার খালের চৌহদ্দিতে আসেন তখন বেশ কিছু আধুনিকতা তাঁদের গায়ে জড়িয়ে নিয়ে আসেন। তাঁদের আলাপ-আলোচনা, আচার-আচরণ, গান-বাজনা, থিয়েটার এবং নানান শখ-শৌখিনতায় তা প্রকাশ পায়। আমার পিছারার খাল, বড় খালের অজ গ্রামীণজগতে এভাবেই এক ধরনের আধুনিকতার প্রকাশ ঘটে। সেই আধুনিকতায় এইসব মানুষ কোনো-না-কোনোভাবে ঋদ্ধ হয়। সেই ঋদ্ধতায় তারা শুধু এটুকুই ভাবতে পারে যে—বাবুগো পোলাপানেগো নিয়ইত ক্যাতো চোমৎকার!—তাদের ‘পোলাপানেরা’ তখন ‘সাজ-সবেরে’ গোখাটা খাটে ফসলের খেতে। এইসব অনিবার্য এবং প্রায় চিরন্তনী ঘটনাগুলো ঘটে পিছারার খাল এবং বড় খালের দুই ধারে, বিশেষত শারদীয় উৎসবের সময়টিতে। কেননা এই সময়েই কলকাতাপ্রবাসী বাবুরা বাড়িতে আসেন, দেশের বাড়ি। বছরের বেশির ভাগটিই কাটে তাঁদের কলকাত্তার বাসাবাড়ি অথবা মেসবাড়িতে। এঁদের মধ্যে কেউবা চাকরিজীবী, কেউ-বা কলেজে পড়াশোনা করতে গেছেন। তদানীন্তনকালের রীতি অনুযায়ী এঁরা বেশিরভাগই, বয়স যাই হোক, বিবাহিত। স্ত্রী এবং যাঁদের সন্তানাদি জন্মেছে, তাদের দেশের বাড়িতেই রাখা বিধি। সে অর্থে আমার পিছারার খালের চৌহদ্দির ভদ্রসমাজের যুবকেরা সম্প্রদায় নির্বিশেষে প্রোষিতপত্নীক এবং তাঁদের পত্নীরা প্রোষিতভর্তৃকা। অতএব দোল মোচ্ছব, দুগ্গোচ্ছব, শ্রদ্ধাদি যে কারণেই তাঁদের এই স্থানে আগমন ঘটুক, তা বড়ই বর্ণাঢ্য এবং আনন্দের হয়। সাধারণ মানুষেরা এই আনন্দের অংশী বলে, যার যা সাধ্য সেই অনুসারে নিজেদের এবং সন্তানদেরও বঞ্চিত করে তাদের শ্রেষ্ঠ সামগ্রীগুলো এঁদের ভোগের জন্য মিনিমাঙনা দিয়ে যায়। তখনও ভাঙন স্পষ্ট হয়নি বলে এঁরাও তা সহজ অধিকারে গ্রহণ করেন। অবশ্যই তাঁরা এই মানুষদের আকাঙ্ক্ষার বিষয়েও উদাসীন থাকেন না।
ব্যবধান অবশ্যই তখন ছিল। ছিল শোষণ এবং সুবিধে গ্রহণের পরম্পরাও, তথাপি কোথাও যেন একটা নিশ্চিত আত্মীয়তা ছিল। প্রান্তিকজনেরা জানত, এঁরা মা-বাপ, স্ত্রী-পুত্র-কন্যা-আত্মীয়-বান্ধবদের ছেড়ে কোথায় কোন বিদেশবিভুঁইয়ে থাকেন, আহা! তারা কী খায়েন, কী-বা করেন, অতএব এঁরাও যখন দেশের বাড়িতে আসতেন এইসব প্রান্তিক মানুষদের কথা কিছুই যে ভাবতেন না এমন নয়। এই মানুষদের সম্পর্ক একান্তই যে খাদ্য-খাদকের ছিল তা বলব না। আত্মীয়তার বন্ধন একটা যে ছিল, তা দেখেছি এবং জেনেছিও।
তারপর শারদীয় উৎসব শেষ হয়ে গেলে পৃথিবীর এই প্রান্তে হেমন্ত নামত ফসল কাটার মরসুম হয়ে। তীব্র কর্মপ্রবাহে তখন প্রান্তিকজনেরা প্রবাসী এইসব মানুষদের বয়ে আনা নতুনতা, আধুনিকতা এবং চাকচিক্যের উষ্ণতা ক্রমশ বিস্মৃত হয়ে আটপৌরে হতে থাকত, কিন্তু তা নিঃশেষে বিলীন হতো না। থিতু হয়ে তা একসময়ে তাদের মধ্যে কিংবদন্তি তথা পরণকথা হয়ে এক ধ্রুবপদ হতো। এই ধ্রুবপদটি তাদের অভ্যেসে গভীর এক প্রভাব ফেলেছিল, আর তার বহতা ছিল বহু, বহুকাল ধরে। গ্রামগুলো যখন শূন্য হয়ে গেল, যখন আর কোনো কিরায়া নৌকো প্রবাসী এইসব বাবুদের নিয়ে বড় খালপারের রেনট্রির শিকড়ে কাছি বেঁধে নোঙর করত না, তখনও প্রান্তিক এই মানুষদের মধ্যে এই আকাঙ্ক্ষার অপেক্ষা দেখেছি। বড় খালপারের উঁচু পথ ধরে চলার সময় তারা বলাবলি করত ‘অমুকবাড়ির অমুকবাবুর পোলায় তয় কি এবার পূজায় আইবে না’, তাঁরা একসময় থেকে আর আসেন না। কিয়ারা নৌকোগুলোর সংখ্যা আস্তে আস্তে কমতে থাকে। যেসব বাড়ির ছেলে তাঁরা, সেইসব ঘরগুলো তালাবন্ধ থেকে থেকে ভূতুড়ে হয় অথবা শুধু ভিতটা একটা কুৎসিত বেঢপ চিতার মতো পড়ে থেকে খাঁখাঁ করতে থাকে।
প্রান্তিকজনেরা গোপাট থেকে গাভি বা বলদগুলোর লেজ মুচড়োতে মুচড়োতে ফিরিয়ে নিয়ে আসার সময় ভাবে, ‘হ্যারা আর আয় না ক্যান?’ আমি দেখেছি এই সময় এইসব মানুষের বুকে যেন এক বিষাদের জন্ম হতো। সেই বিষাদ শারদীয় উৎসব শেষ হবার পরও হেমন্তের ধানের ছড়ায়, ঘাসের শিশিরে যেন এক করুণ ছবি হয়ে দুলতেই থাকত, দুলতেই থাকত। আমাদের বাড়ির পুরনো মুনিষ-মাহিন্দরেরা এই কলকাতার বাবুদের ঘরে ফেরা নিয়ে নানান স্মৃতিকথা বলত, আর হুতাশ করত, আহা! কী দিনই না গেছে! কী আছিল আর কী অইল! তাদের জবানে আমাদেরই একদার কথা গল্প শুনতে শুনতে আমার এই সময়ে খুবই মন খারাপ হত, মন খারাপ বোধকরি আমার চাইতে তাদেরই হতো বেশি।
এরকম এক সময়ই তখনও তালুকদারি লুপ্ত হয়নি, আমাদের বাড়িতে একজন সর্বক্ষণের রাখাল বহাল হয়েছিল। তার নাম নাগর আলি, যার কথা আগেই বলেছি। নাগর আলি ভাই ছিল সেই সময় আমরা যে কটি বালক গ্রামে ছিলাম, তাদের সর্দার, যদিও তার তখন চুলদাড়ি সাদা। সে আমাদের বড় বৈঠকখানার দরবারে বাবুদের অনুপস্থিতিকালে আমাদের নিয়ে আসর জমাত। গল্প বা কিস্সা বলা এবং কথায় কথায় গান গাওয়া ছিল তার স্বভাব। লোকটি অকৃতদার। প্রায় জন্মসূত্রেই রাখাল। ভরাভর্তি গ্রামের সুখের দিনের গল্প তার কাছেই বেশি শুনতাম। কলকাতার বাবুদের ঘরে ফেরার এবং তাদের নানা ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে আমাদের বেশ রসিয়ে গল্প করত সে। গ্রাম শূন্য করে চলে যাওয়া মানুষদের ওপর তার ছিল ভীষণ অভিমান। ভাগাভাগি, হানাহানির ব্যাপারে তার যে কী পর্যন্ত বিতৃষ্ণা ছিল আজও তা মনে পড়লে চোখে জল আসে। একবার ইউনিয়ন বোর্ডের নির্বাচনের সময় সে একখানা গান বেঁধেছিল। সেই গান মাঝে মাঝেই সে আমাদের শোনাত। সে গাইত–
যতসব দীনদরদি
তারা সব পাইছেন
গদি খালি মোরা দেহি
হাতে কাম নাই
ও মেয়া ভাই রে
কওছেন দেহি
ক্যামনে প্যাট চালাই?
হিন্দুরা যায় হিন্দুস্থানে
আর দরদীরা ট্যাহা গোনে
আর নজর হ্যারগো ডাহার পানে
মোগো হিসাব নাই—
ও মেয়া ভাই রে
কওছেন দেহি ক্যামনে প্যাট চালাই।
তাদের পেট চালাবার ব্যবস্থা ইতিপূর্বে যা ছিল, তা যে খুব উচ্চ আদর্শের তা অবশ্যই নয়। তবে সেটা একটা ব্যবস্থা তো বটেই। এখন ব্যাপক গেরস্ত হিন্দু মধ্যবিত্ত গ্রাম শূন্য করে যেতে থাকলে তাদের গতি কী হয়?
তখন যে কথা বলেছি, হিন্দু-মুসলমান উভয় সমাজেরই বনেদি, শিক্ষিতদের অনেকেই দেশের বাড়িতে পরিজনদের রেখে শহর কলকাতায় অথবা ঢাকা-চট্টগ্রাম ইত্যাদি শহরে চাকরিজীবীর জীবনযাপন করতেন। এইসব স্থানে কারও কারও একটা আস্তানা বহুকাল থেকেই ছিল, দেশভাগের পর তার দ্রুত বিস্তৃতি ঘটতে থাকে। যেন দেশভাগজনিত সমস্যায় ওই আশ্রয়কে অবলম্বন করা যায়। এই ব্যবস্থা অবশ্যই শুধু উচ্চ এবং মধ্যবিত্তদের ছিল। এর ফলেই আধুনিকতার কেন্দ্র মহানগরী কলকাতার সঙ্গে এই অজ গ্রামীণজগতের একটা নিয়ত যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল একদা।
আমাদের বড়দা ছিলেন বাড়ির জ্যেষ্ঠ পুত্র। তিনি কলকাতায় পড়াশোনা করতেন, পরে চাকরিসূত্রেও সেখানেই তাঁর অবস্থান। ছুটিতে যখন বাড়ি আসতেন, সে এক কাণ্ড। ‘বড় বাড়ির বড়পোলায় বাড়ি আইছে।’ খালের ঘাটে বাহারি নৌকো লেগেছে। খানাবাড়ির ধোপা, নাপিত বা কুমোরদের কেউ তা দেখতে পেয়ে অন্দরে খবর দিতে ছুটছে। কী? না, ‘উনি আইয়া পড়ছেন’। আমরা দেখতাম, একজন সুবেশ যুবা, পরনে এন্ডির পাঞ্জাবি এবং চুড়িদার পাজামা, তীক্ষ্ণ গ্রিসীয় নাসা আর গভীর চোখ এবং উজ্জ্বল স্বাস্থ্যের প্রায় পরণকথার রাজপুত্তুরের মতন পুরুষ নৌকো থেকে অবতরণ করছেন। জনাকয়েক খানাবাড়ির মনুষ্যপ্রজা তাঁর যাবতীয় বোঝা কাড়াকাড়ি করে বয়ে আনছে বাড়ির দিকে। বাড়িতে মহা হইচই, ধুমধাম। বিপিনকে বাজারে পাঠানো হচ্ছে। কেউ পুকুরে জাল ফেলছে। সে এক অসুমার কাণ্ড। বড়দাদা তখন কলকাতায় থাকেন, রেলের বাবু, উপরন্তু ঘোরতর তালুকদারি জমিদারিতন্ত্রের বিরোধী। মহানগরীর কমিউনিস্ট তন্ত্রাচারী। সামন্ততন্ত্রের ভয়ানক সমালোচক। কিন্তু অন্যদিকে বেজায় মেজাজি আর রোমান্টিক। সে এক প্রগাঢ় বিত্তান্ত। বড়দাদার চরিত্রে নানান গুণের সমাহার, যার থই পাওয়া ভার। এ ক্ষেত্রে বাবার একটি কুবচন মনে আছে। তিনি বলেছিলেন, কমিউনিস্ট, তয় হেয়া বুজি হাউসের। অর্থাৎ শখের। বড়দাদার আচরণে সামন্তপনার কিছু ঘাটতি তখন দেখিনি। চাকরবাকর বা খানাবাড়ির প্রজাদের প্রতি আচরণে যে নমুনার প্রকাশ আমার স্মৃতিতে আছে তা বাবার মন্তব্যের বিপরীত নয়। কিন্তু তাঁর নানাবিধ গুণে যে আমরা অর্থাৎ তাঁর কনিষ্ঠরা ঋদ্ধ হয়েছি এ কথাও মিথ্যে নয়।
আমরা ছোটরা তখন আগানে-বাগানে ঘুরি, পুকুরে বড়শি ফেলে মাছ ধরি, পাতিশিয়ালের গর্ত খুঁড়ে তাদের ছানা বের করে এনে পাঁঠাবলি খেলি। দাদা আমাদের ইদৃশ ইলুতেপনায় যৎপরোনাস্তি বিরক্ত হয়ে শক্ত শক্ত অঙ্ক আর ট্রান্সলেশন দিয়ে দরদালানের বারান্দায় বসিয়ে দিতেন। না পারলে বেদম প্রহার। এ কারণে তাঁর আগমনের আনন্দ অচিরেই মাটি হতো। তবে এ যন্ত্রণা আমাদের খুব বেশিক্ষণ সইতে হতো না। অন্যান্য বাড়ির যাঁরা ততক্ষণে এসে পৌঁছতেন, তাঁরা অচিরে হাজির হয়ে তাস, পাশা, দাবা, নৌকো ভ্রমণ, চড়িভাতি এবং কমিউনিস্ট নিয়ে ব্যস্ত হয়ে আমাদের অব্যাহতি দিতেন। আমরাও তখন বড়শি হাতে আবার বেড়, পুকুর বা খালধারে গিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচতাম।
দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পর দাদা তাঁর বন্ধুবর্গকে নিয়ে ছোট বৈঠকখানার তক্তপোশগুলোতে জাঁকিয়ে বসে কমিউনিস্টির তক্ক করতেন। কখনো-বা বায়োস্কোপ, থিয়েটার, শচীন কত্তা বা অন্য কোনো গায়কের গান এবং আবৃত্তি এইসব করতেন। তখনকার প্রান্তিক হিন্দু-মুসলমান সাধারণজনেরাও এই আসরে এসে শ্রোতা হতো। এভাবেই মাহনগরীর আধুনিকতার কথা কিছু কিঞ্চিৎ পিছারার খালের মানুষদের তৃপ্ত করত। প্রান্তিকজনেরা এভাবেই কলকাতার বাবুদের হালচাল, কথাবার্তা শুনে সেই আশ্চর্য নগরীর বিষয়ে কিছু ধারণা তৈরি করে নিত।
কিন্তু একসময় এই দেশের বাড়িতে আসার এবং গ্রামকে উৎসবের চূড়ান্তে পৌঁছনোর পালা শেষ হয়ে গেল। পিছারার খাল আর বড় খালের পারে সৃষ্টি হলো এক বিশাল শূন্যতা। সেই শূন্যতা আমি স্বয়ং উপলব্ধি করেছি, উপলব্ধি করতে দেখেছি ওখানে থেকে যাওয়া হিন্দুদের এবং মুসলমানজনেদেরও। এমনকি যারা হিন্দুদের দেশত্যাগজনিত কারণে সমূহ লাভবান, তাদের বাড়ির যুবজনেরা বা মেয়েরা এই শূন্যতার কারণে যে নিদারুণ কষ্ট ভোগ করত, তাও তো দেখেছি। এই শূন্যতা ভরাট করার উপায় এখানের মুসলমান সমাজের মানুষদের তখন ছিল না। পিছারার খালের আবেষ্টনীর মুসলমান এবং তফসিলী সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষদের মধ্যে কোনো মধ্যবিত্ত শ্রেণির অস্তিত্ব ছিল না। যা দু-একজন এই শ্রেণিচরিত্রের ছিলেন, তাঁরা শ্রেণি গঠন করেননি, শুধুই মধ্যবিত্ত শ্রেণি বলতে হিন্দু সম্প্রদায়ের ভদ্রবাবুরাই ওখানে সমাজের স্তম্ভ এবং এ কারণেই তাঁদের দেশত্যাগ এই বিরাট শূন্যতার বাতাবরণ তৈরি করেছিল। পিছারার খালের অবেষ্টনীতে আজও যদি কেউ হঠাৎ গিয়ে পড়ে, সেই শূন্যতা আজ পঞ্চাশ বছর পরেও কবরের নিস্তব্ধতার মতোই হাহাকারপূর্ণ তা কি হিন্দু গ্রামে কি মুসলমান গ্রামে। সেখানে আর নতুন কোনো সমাজ সৃজন হলো না। মুসলমানসমাজের যুবকেরা, যারা শিক্ষিত মার্জিত হলো, তারা শহরে-নগরে নিজ নিজ পরিবারস্থদের স্থানান্তরিত করল। জমিজমা ইত্যাদির শাসন শহর থেকেই তারা করতে থাকল। তাদের কিছু দুর্বল আত্মীয়স্বজন, যারা চাকরিজীবী নয়, তাদের ওপর দায়িত্ব থাকল এই জমির উপজসমূহের মূল্য তাদের শহরের ঠিকানায় পৌছে দেয়ার এবং চাষবাসের ব্যবস্থাপনাদির ওপর নজর রাখার। এ কারণে এই পিছারার খালের, বড় খালের আশপাশের গ্রামগুলোতে অবশিষ্ট থাকল একান্ত কৃষি এবং কৃষিশ্রমনির্ভর যারা তারাই, যদিও জমির মালিকানা শহরের চাকরিজীবী বা পেশাগতভাবে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল অথবা ব্যবসাজীবীদের হাতেই। অনুপস্থিত ভোক্তারা কৃষির উন্নয়ন বিষয়ে কিছুমাত্র যত্নবান হলো না। তাই এই স্থানের আর কোনোই উন্নতি দেখা গেল না। খাল, নদী, পুকুরের সংস্কার হলো না, কৃষির বিষয়ে যুগানুযায়ী অধিক ফলনের প্রচেষ্টা হলো না, ব্যাপারটা পরম্পরাগত নিয়মেই চলতে থাকল। এভাবেই মানুষ দুঃখের পঙ্কে নিমজ্জিত হতে লাগল আরও বেশি করে। এখানে তখনও যারা ভিটে আঁকড়ে পড়ে, তারা আমার বাল্যের দেখা সেই প্রায় আদিম ব্যবস্থায়ই ছিল। মধ্যস্বত্ব লোপ হয়েও তাদের কোনো উন্নতিই হয়নি। তারা কোনো অর্থনৈতিক পুনর্বাসন পায়নি।