বিষাদবৃক্ষ – ৪৫

পঁয়তাল্লিশ

পরদিন সকালেই বাড়ি ফেরার তোড়জোড় করছি, মাইমা অর্থাৎ বড়দার শাশুড়ি বললেন, কাল রাতে তো কিছু খাওয়াতে পারলাম না, এ বেলাটা থেকে দুপুরের খাওয়াদাওয়া সেরে যাও। আবার কবে দেখা হবে-না-হবে। কথাটা ফেলতে পারলাম না। এতদিন আত্মজন-বিবর্জিত এই শহরে তাঁর স্নেহচ্ছায়াই আমার অবলম্বন ছিল। তাঁর সঙ্গে আরও একটি সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, সেটা বিভিন্ন গল্প, কবিতা পঠনপাঠনের। মহিলার পড়ার অভ্যেসটি ছিল অসম্ভব ঈর্ষণীয়। আমি তাঁকে প্রায়শই লাইব্রেরি থেক বইপুস্তক এনে দিতাম। অনেক আলোচনা, সমালোচনার আনন্দ তাঁর সঙ্গে উপভোগ করেছি। সেইসব মধুর স্মৃতি আজ মনে পড়ছে। সুতরাং থেকে গেলাম। দুপুরের খাওয়াদাওয়া সেরে বাসে চলে যাব।

সেদিন শুক্রবার। এখানে শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন। ভাবলাম একটু ঘুরে আসি বন্ধুদের সঙ্গে দেখাসাক্ষৎ করে। প্রথমেই মনে পড়ল ইসমাইলের কথা। আমার সহপাঠী। অসম্ভব ভালোবাসত আমাকে। আলেকান্দা রোডে একটা বাড়িতে থাকে পেয়িং গেস্ট হিসেবে। বাড়ি সন্দ্বীপে। তবে ওর কথা প্রথমেই মনে পড়ার একটা বিশেষ হেতু ছিল গত বছর (১৯৬২ সাল) ভারতের জব্বলপুর না কোথায় দাঙ্গা হয়েছিল হিন্দু-মুসলমানে। কী কারণে মনে নেই। তার পালটা হিসেবে এ-দেশের বিভিন্ন স্থানে তখন দাঙ্গা-পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। বরিশালেও তখন হাওয়া বেশ গরম। আমি তখন এখানকার দাদার বাসায়। সেই সময় একদিন দাদা অফিস থেকে ফিরতে অসম্ভব দেরি করায় বউদি খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন। দাদার অফিস বাসা থেকে বেশ দূরে কীর্তনখোলার পারে, লঞ্চঘাটে। ওই এলাকাটাই সবচেয়ে গোলমালের জায়গা ছিল, কারণ ওখানে বেশ কিছুসংখ্যক বিহারি মুসলমানদের ব্যবসা এবং বসবাস। এখানকার দাঙ্গায় সাধারণত বিহারি মুসলামনরাই নেতৃত্ব দিত। বউদির উদ্বেগে আমি একটা হ্যারিকেন নিয়ে দাদার সন্ধানে লঞ্চঘাটের দিকে চলেছি। রাস্তায় আলো নেই, দাঙ্গাবাজরাই সম্ভবত বাল্বগুলোকে নষ্ট করে দিয়েছিল। আবার বড় রাস্তাগুলোতে কারফিউ জারি করা হয়েছে। তাই ভেতরের অলিগলি দিয়ে এগোচ্ছিলাম। তখন রাত প্রায় দশটা-সাড়ে দশটা। চারদিক শুনসান। কাঠপট্টির গলি ধরে এগোচ্ছি। মনে বেশ আতঙ্ক। হঠাৎ কে একজন আমার বাঁ হাতটা ধরে একটা ঝাঁকানি দিয়ে ধমকের স্বরে বলল, কোথায় যাচ্ছিস? ঘটনার আকস্মিকতায় আমার প্রায় বাহ্যজ্ঞান লুপ্ত। হ্যারিকেনের আলোয় লোকটার মুখও দেখতে পারছি না। সে আবার বলল, এই রাস্তায় এত রাত্রে কোথায় যাচ্ছিস? জানিস না লঞ্চঘাটে এই সন্ধের সময় তিন-তিনটে লোককে স্ট্যাব করা হয়েছে? এ কথায় একটু বাহ্যজ্ঞান হলো। দেখলাম ইসমাইল। বললাম, ওঃ যা ভয় পাইয়ে দিয়েছিলি। আসলে দাদা এখনও ফেরেনি কিনা, তাই বউদি বললেন—। বাঃ চমৎকার! দাদা ফেরেননি বলে বউদি তাঁর ভাইকে ছোরা খেতে পাঠালেন এই দুপুর-রাত্রে। চল তোকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসি। শহরের অবস্থা খুব খারাপ। এতক্ষণে যে তুই ছোরা খাসনি তা একমাত্র আল্লা মাবুদের দোয়ায়। তোর দাদা ঠিক ফিরবে। চল। সে আমাকে একরকম জোর করেই ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল সেদিন। বাসায় পৌঁছে দেখি দাদা ফিরেছেন এবং বউদিকে খুব বকাঝকা করছেন আমাকে ওই অবস্থায় পাঠিয়েছেন বলে এবং তিনি যথেষ্ট দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। ইসমাইলের সঙ্গে আমাকে ফিরতে দেখে তাঁরা আশ্বস্ত হলেন। ইসমাইল এ বাসায় আমার সূত্রে পরিচিত ছিল। মাঝে মাঝে আসত। দাদা ওর খুব প্রশংসা করছিলেন। কিন্তু ইসমাইল সেদিন যারপরনাই বিরক্ত হয়েছিল। বউদির দিকে তাকিয়ে ও বলেছিল, এখন আমার প্রশংসা করছেন কিন্তু যদি কিছু ঘটত তখন কিন্তু জাত তুলে গাল দিতেন। বলে আমাকে বলল, অবস্থা স্বাভাবিক না হলে একদম বেরোবি না। বলে সে অন্ধকারের মধ্যেই চলে গেল আলেকান্দার দিকে। সে জায়গাটা এখান থেকে বেশ দূর।

পরে ইসমাইলের সঙ্গে এ নিয়ে আমার আরও কথা হয়েছিল। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, সে ওই দিন বউদিকে ওরকম একটা কথা বলেছিল কেন। ইসমাইল খুবই স্পষ্টবাক। ও উত্তরে বলেছিল, তা বলার কী আছে? তোরা হিন্দুরা সুযোগ পেলেই কি ‘মোছলার জাত এরকমই হয়’ বলে আমাদের গাল দিস না? ধর সেদিন যদি তোকে ওখানে আমি আহত অবস্থায় নিয়ে যেতাম, তুই কি ভাবছিস তোর ওই দাদা-বউদি আমাকে কিছুমাত্র বিশ্বাস করত? কিন্তু যা-ই বলিস সেদিন ভাগ্যিস আমি বাড়ি থেকে লঞ্চে ফিরছিলাম এবং ওই পথেই আসছিলাম। আর লঞ্চঘাটে আমি যা দেখে এসেছিলাম, তাতে সেখানে গেলে তোকে আর আস্ত ফিরতে হতো না। ওর কথায় কিছুমাত্র মিথ্যে ছিল না এবং ওর সেদিনকার বিরক্তিও খুবই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু তখন আমরা ওখানে তো মুসলমানমাত্রকে অবিশ্বাস করতাম। আমাদের জন্মাবধি শিক্ষাটাই ওরকম ছিল। তাই ইসমাইলের কথায় একটু আঘাত পেলেও তার সত্যতা অস্বীকার করতে পারিনি।

ইসমাইলের বাসায় গিয়ে ওকে পেলাম। ও আমাকে দেখে প্রথমে খুবই উল্লসিত হলেও পরে বিষণ্ন হয়ে গেল। কলেজের ব্যাপার, আমার পরীক্ষা দিতে না পারার কারণ—সবই ও জেনেছিল। সেই নিয়ে কিছুক্ষণ হা-হুতাশ করে বলল, যাক, যা হবার তো হয়েছে। দমে যাস না। একটা বছর এমন কিছু বিরাট ব্যাপার নয়। আগামীবারের জন্য এখন থেকে ব্যবস্থা কর। একটু বোস, আমি দেখি চা পাওয়া যায় কি না। বলে ও বাইরের দোকান থেকে কিছুক্ষণের মধ্যেই পরোটা, ডিমভাজা, চা এইসব নিয়ে এলো। চা-নাস্তা করে প্রায় ঘণ্টা দুয়েক ওর সঙ্গে গল্প করে উঠলাম। ফেরার সময় বললাম, জানি না আর দেখা হবে কি না। তবে তোর কথা চিরদিন আমার মনে থাকবে। ওর চোখে জল এসে গিয়েছিল, আমারও। কী যে সেই আত্মীয়তা! আজও বুকের মধ্যে যেন তা গুমরে ওঠে।

ওর ওখান থেকে ফিরে আর কোথাও গেলাম না। ভালো লাগছিল না। যেখানেই যাব, সেই তো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আমার দুর্ভাগ্যের কথাই আসবে। তার থেকে খেয়েদেয়ে বাড়ি ফিরে যাই।

খাওয়াদাওয়া সেরে, কালীদা এবং অন্য সবার কাছে বিদায় নিয়ে যখন বড় রাস্তায় এসে পড়লাম, তখন দুপুর একটা-দেড়টা। হসপিটাল রোড। দুপুর আড়াইটেয় একটা লঞ্চ আছে। ভাবলাম সেই লঞ্চেই ফিরব। দাদার দেয়া একটা পরিচয়পত্র ছিল। তিনি লঞ্চ কোম্পানিতে কাজ করতেন। এ জন্য আমাদের দিকের কোনো লঞ্চেই আমার ভাড়া লাগত না। হসপিটাল রোড ধরে যেতে যেতে মনে হলো মাসিমার সঙ্গেও কেন না একটু দেখা করে যাই। হাতে যথেষ্ট সময় ছিল। মাসিমার ঝোপড়িতে তিনি এবং আরও যাঁরা বাস করতেন সবাই সমান অসহায়। প্রায় দু-আড়াই মাস আগে এই শহর ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম। জানি না কে কেমন আছেন। ঝোপড়িতে গিয়ে দেখি তাঁরা দুপুরের খাওয়া শেষ করে সামনের ছোট্ট দাওয়ায় সবাই বসে আছেন। আমাকে দেখে মাসিমার সে কী আনন্দ! আমি নির্দ্বিধায় তাঁর দাওয়ায় বসে তাঁদের খবরাখবর নিতে লাগলাম। অনেক কথা, অনেক গল্প হতে লাগল। মাসিমা জিজ্ঞেস করলেন, আজ থাকবি না চলে যাবি? আমি যদিও যাবার জন্যই বেরিয়েছি কিন্তু কী মনে হলো, বললাম, থাকব। তোমার এখানে থাকব আজকে। মাসিমা বললেন, তুই এখানে থাকবি, তোর ভয় করবে না?

–কীসের ভয়?

–কেউ যদি কিছু বলে?

-–মাসিমার বাসায় থাকলে কেউ কিছু বলে তো বলুক। আমার কোনো ভয় নেই।

–খাবি কী?

বললাম, দাঁড়াও, বাজার করব। তুমি রান্না করতে পারবে না? মাসিমা একগাল হেসে বললেন, পারব না কেন? আমরা কি না খেয়ে থাকি নাকি? আমি বললাম, না সেসব না, আজকে আমরা সবাই ভালোমন্দ খাব। যাই বাজার করে আনি, একটা থলি দাও। মাসিমা একটা থলি এনে দিলে আমি বাজার থেকে কাছিমের মাংস নিলাম দুই সের। আট আনা করে সের তখন। অন্যান্য নানারকম তরিতরকারিও নিলাম। আমার তখন পকেট গরম। সুতরাং কোনো কিছুতেই কার্পণ্য করলাম না। বাজার থেকে ফিরতে ফিরতে বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যা। মাসিমা খুব চমৎকার রান্না করলেন। ওই বুড়িদের সঙ্গে আমি একটি চমৎকার সন্ধে কাটালাম। সেইরকম আনন্দের স্বাদ মানুষ কদাচিৎ পায়। অবহেলিত লাঞ্ছিত মানুষের ক্ষণিক সুখ তাদের সঙ্গে একত্রে উপভোগ করার যে এক প্রগাঢ়তা, তা কজনের ভাগ্যেই-বা ঘটে? তাঁরা অনেক রাত পর্যন্ত কীর্তন গেয়ে গল্প করে কাটালেন।

পরদিন কাকভোরে মাসিমা আমাকে তুলে দিয়ে বললেন, তুমি এখনই যাও। বেলা হলে নিন্দা। মানুষ তো সব বুঝবে না। মানুষের বোঝার বিষয়টা যে আমার বিচারে আর নেই, সে কথা মাসিমাকে বোঝাতে যাওয়া বৃথা। তাঁরা তাঁদের আর আমাদের সমাজগত বিভেদটা বেশ ভালোই বোঝেন। আমি যে বেশ্যাপল্লিতে একটি রাত অতিবাহিত করেছি, তা তাঁর পরিণতবুদ্ধিতে যেরকম ক্রিয়া করেছিল, তিনি সেরকমই আমাকে বোঝালেন। আমিও তাঁকে প্রণাম করে বেরিয়ে পড়লাম। তখন ও বেশ অন্ধকার, আলো তেমন ফুটে ওঠেনি। রাতের রসিক অতিথিরা তখনও দু-একজন ওই পল্লিতে আনাগোনা করছিল। আমি ঝোপড়ি থেকে বের হয়ে বেশ নিরুত্তাপচিত্তে এবং অবলীলায় বড় রাস্তায় এসে পড়লাম। একটি রিকশায় চড়ে বসলাম, বাসস্ট্যান্ড চলো। রিকশাআলা একটু মুচকি হেসে প্যাডেলে একটি ইঙ্গিতপূর্ণ ঠ্যালা মেরে বলল, এ্যাতো বেয়ানেই আইলেন।

রিকশায় বসে সারাটা রাস্তা মাসিমাদের কথা ভাবতে ভাবতে চললাম। আমার জীবনের সমস্যা এক আর এঁদেরটা অন্যরকম। কিন্তু একটি স্থানে সবারই মিল আছে, সেটা পেট এবং তার জ্বালা। সবাই পেটের জ্বালায় জ্বলে, আমি পেটের জ্বালায়ই নানান রাস্তা হাঁটছি। শুধু রাস্তার তফাত। মূলধন একই, তা দৈহিক শ্রম। দেহই আমাদের অগতির গতি। এই জায়গায় আমাদের কোনো তফাত ছিল না বলেই তাঁদের সঙ্গে এক-কামারাদারি অনুভব করলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *