বিষাদবৃক্ষ – ৫

পাঁচ

আমার এই আলেখ্যের জন্য সময়কাল হিসেবে আমি ন্যূনধিক দশ বছরের মতো একটা পরিসর নিয়েছি। সেই দশ বছর সময়কালটি উনিশশ একান্ন-বাহান্ন থেকে উনিশশ বাষট্টি-তেষট্টি পর্যন্ত বিস্তৃত। এই সময়টায় আমি শৈশব, কৈশোর অতিক্রম করে যৌবনের দরজায় সবে পা দিয়েছি। পাকিস্তান তখনও শিশুরাষ্ট্র। আমার অভিজ্ঞতার দৌড় পিছারার খালের চৌহদ্দি থেকে শুরু করে বরিশাল শহর পর্যন্ত। অতএব, এমন দাবি করি না যে এ আলেখ্য তদানীন্তন গোটা পূর্ব পাকিস্তানের সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সমাজেতিহাস। আঞ্চলিক অবস্থা বর্ণনা করার জন্য আমি শুধু পিছারার খালের দুধারের দু-একটা পরিবারকে বেছে নিয়েছি এবং আমার ব্যক্তি হিসেবে বেড়ে ওঠার আলেখ্য দিয়ে তখনকার সংখ্যালঘুদের অবস্থা বর্ণনা করতে চাইছি। আমার পরিবার ওখানে যেহেতু নানা কারণে একসময় গুরুত্ব পেয়েছিল, সে কারণে তার নানাবিধ আখ্যান আমি অবলম্বন করেছি। বিশেষত একটি ঘোষিত সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে, আমার মতো একটি সংখ্যালঘু সমাজের কিশোরের কী ধরনের সামাজিক তথা রাষ্ট্রীয় প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে পথে চলতে হয়েছিল, তারই আলেখ্য এটি। তালুকদারি মধ্যস্বত্বভোগীদের তখন নাভিশ্বাস। রব উঠেছে মধ্যস্বত্বলোপ আইন পাশ হচ্ছে। সরকার ইতিমধ্যেই জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ করেছে। ফলে আমাদের বাড়িতে দীয়তাং ভুজ্যতাং-এর দিন গত। খাওয়াদাওয়ার মূল বস্তু অর্থাৎ ধান-মাল-কলা-কচু-গুড়-মরিচ ইত্যাদি তখনও ছিল। কিন্তু রসনাতৃপ্তিকারী আহার নিতান্ত অপ্রতুল। হলেও কালেভদ্রে বা পূজাপার্বণে।

আমার ডাক্তারবাড়িতে যাতায়াতের অন্যতম আকর্ষণ ছিল এই যে, সেখানে গেলেই ‘দুর’ ‘কাছিম’ বা ‘কাডউয়ার’ মাংসের মুখরোচক কিছু-না-কিছু পাওয়া যেত। আর একটা আকর্ষণ ছিল ডাক্তারজ্যাঠার সংগ্রহের কিছু বইপুস্তক। আমাদের বাড়িতে একটা ঘরে প্রচুর বইপুস্তকের আয়োজন ছিল। বাড়ির চাকরবাকরেরা আমাদের পড়তিকালে ওইসব বইপত্তর বান্ডিল বান্ডিল বাজারের মুদিখানায় বেচে দিত সের দরে। এটা তাদের আয়ের একটা বাড়তি উৎস। এসব ঘটনা আমার জ্ঞান হওয়ার অনেক আগে থেকেই চলে আসছিল। এদিকে নজর দেয়ার মতো কেউ ছিল না। তখন আমাদের বই-ই প্রায় ভিক্ষে করে আমাকে পড়তে হচ্ছিল। ডাক্তারজ্যাঠা ওইসব চাকরদের কাছ থেকে পছন্দমতো কিছু বই সংগ্রহ করে রাখতেন। ভাগ্যিস তিনি সেসব রেখেছিলেন। তাই তো ওগুলো তখন পড়তে পেতাম। এ কারণে ডাক্তারজ্যাঠার প্রতি কী যে কৃতজ্ঞ ছিলাম! এভাবে বিজয়বসন্ত, স্বর্ণলতা, অমর গ্রন্থাবলি, নারায়ণচন্দ্রের গ্রন্থাবলি, ছেলেদের মহাভারত, রামায়ণ, বাঁধানো প্রবাসী, বঙ্গবাণী, ভারতবর্ষ, বঙ্গদর্শন ইত্যাকার কত বই-ই না পড়েছি তাঁর সংগ্রহ থেকে নিয়ে। বলতেন—মুই কেউরে কৈলম বই দিনা। তয় এইসব বই তোমাগোই তো, হে কারণ তোমারে দেওনে দোষ নাই। পড়বা, ফেরত দেবা।’ বাবাকে বলতেন—’অর পড়াশোনায় মতিগতি বেশ ভালো। অরে এট্টু ইস্কুলে দেন।’ কিন্তু কে কাকে স্কুলে দেয়? সামন্ত বিক্রমের যে তখন নাভিশ্বাস সে কথা আগেই বলেছি। এই নাভিশ্বাসের কারণে তাঁদের রুচিরও বিকৃতি ঘটতে শুরু করেছে। বাড়ির ছেলেমেয়েদের কোনো ব্যাপারেই তাঁদের চিন্তাভাবনা নেই। শিক্ষা তো দূরস্থান। তাঁদের দুটো অট্টালিকার প্রতিটি ইটের খাঁজে সাজানো এক কিংবদন্তির আভিজাত্য। কত কঠিনভাবেই না সেই সময় আমরা এই মিথ্যে আভিজাত্যের মূল্য দিয়েছি, সে ইতিহাস বর্ণনা দুরূহ।

আমার বাড়ির কর্তারা সে সময়টায় যে জীবনযাপন ধ্রুব করে নিয়েছিলেন, সেইসব খুঁটিনাটি এ বয়সেও অসম্ভব গ্লানি আর মনঃপীড়ার কারণ। মধ্যস্বত্বলোপ আইন তখন জারি হয়। ইতিপূর্বের দাঙ্গার প্রকোপ এ সময় স্তিমিত থাকলেও, সংখ্যালঘুরা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দুর্ভাবনায় ক্রমশ পশ্চিমবাংলার দিকে চলমান। যাঁরা চলে যাচ্ছেন, তাঁদের ভদ্রাসন, সাজানো বাগান, বাঁধানো ঘাট এবং পুরুষানুক্রমের তাবৎ ঐতিহ্য তথা সঞ্চিত সম্পদ পরিত্যাগ করে কিংবা নামমাত্র দামে বেচে দিয়ে দেশত্যাগ করছেন।

আশপাশ মুসলমান গ্রামগুলোতে যথেষ্ট উচ্চবিত্ত মুসলমান পরিবার বিশেষ ছিল না। মাঝারি মাপের যারা তারাই এখন সব ছেড়ে-যাওয়া হিন্দুদের সম্পদ নিয়ে নিজেদের ঘর এবং জীবন সাজাতে চেষ্টা করছে। এই সময়টা থেকে বড়, মাঝারি এবং কিছু ছোট কৃষক পরিবারও ছেড়ে-যাওয়া হিন্দুর সম্পত্তির পড়ে-পাওয়া চৌদ্দ আনায় বেশ সচ্ছল হয়ে ওঠে। রাতারাতি তাদের বাড়িঘরদোরের চেহারা বদলে যেতে থাকে এবং তারা বেশ হোমরা-চোমরা হয়ে দাঁড়ায়। আমার এই উজানি খালের সোঁতার এক কিনারেই ছিল আমাদের এলাকার স্কুলটি। তিনটি গ্রামের নামের আদ্যক্ষর নিয়ে স্কুলের নাম। ছাত্ররা ছিল বেশির ভাগ হিন্দু। মুসলমান জোতদার এবং তালুকদারদের ছেলেরাও কেউ কেউ সেখানে পড়তে আসত দূর দূর গ্রাম থেকে। একান্নর দাঙ্গার পর থেকে স্কুলটি আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যায়। এই স্কুলটি বন্ধ হওয়ার সঙ্গে আমাদের এলাকার ভদ্র হিন্দু গৃহস্থদের দেশত্যাগের সম্পর্ক আছে। সেসব দিনের কথা স্মরণ করতেও বড় কষ্ট হয়। পাশাপাশি প্রায় হাত ধরাধরি করে তিনটি গ্রাম যেন তিনটি বোন। তিনটি গ্রাম মিলে একটি একক। তখনকার দিনে এখানে একটি উচ্চ বিদ্যালয়, একটি বালিকা বিদ্যালয়, সেলাই শেখার স্কুল, ফুটবল খেলার জন্য একটি সুদৃশ্য মাঠ, দুটি বনেদি বাড়িতে দুটি অভিনয়-মঞ্চ—কী নেই সেখানে? হাইস্কুলের অসামান্য একতলা বাড়িটির একটি কক্ষে চমৎকার একটি লাইব্রেরি। সে এক সাজানো স্বর্গ যেন। প্রত্যেক মানুষই তার গ্রাম বা শহরকে ভালোবাসে, কিন্তু আমার পিছারার খালের দুধারের এই তিনটি গ্রামের তুল্য সুসজ্জিত এবং সম্পন্ন গ্রাম আমি আর দেখিনি।

স্কুল, বাজার, দোকান ইত্যাদি যেমন সেখানে সাজানো ছিল, তেমনি ছিল লোকায়ত দেবদেবীদের ‘থান’, যেখানে ঋতুকালের বিভিন্ন সময় মেলা বসত। সেই মেলায় হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষই উৎসব-আনন্দে ভরপুর থাকত। কামেশ্বরী মন্দির, পঞ্চদেবতার থান, গলুইয়া খোলা ইত্যাদি স্থানসমূহের বিশালাকার বৃক্ষাবলির নিচে চৈতি গাজনের সময় বা অন্য উপলক্ষ্যে মেলা বসত। সে এক অপূর্ব সমারোহ। নীল গাজনের সময়ই এই উৎসবটি হতো বর্ণাঢ্য। নিম্নবর্ণীয় হিন্দু চাষিরা এইসময় আসত শিবের গোটা পরিবারটির সাজে সজ্জিত হয়ে। বিশেষ বিশেষ গেরস্থবাড়ির প্রশস্ত অঙ্গনে ঢুকেই মোষের শিংয়ের শিঙায় ফুঁ দিয়ে চাষি শিব তার আগমনবার্তা জানাত। তার সঙ্গে গৌরী, লক্ষ্মী-সরস্বতী, কার্তিক-গণেশরা, দল ভারী হলে নন্দী-ভৃঙ্গি, নারদ, পর্বত এরাও থাকত।

প্রথমেই হাতের জ্বলন্ত ‘পাঁজাল’টির মধ্যে একমুঠো ধূপধুনো দিয়ে নারদ গোটা অঙ্গনটি পরিক্রমা করে নিত। মুখে আবৃত্তি করতে থাকত—

ধূপ ধরন ধুপতি ধরন
ঘোর অন্ধকার
যতদূর ওঠে ধোঁয়া
গগন মণ্ডলে
তথা হইতে মহাদেব
লামেন ক্ষিতি তলে।

মায়েরা, বাপরা, সগলে আসইয়া হাজির হয়েন।

ঘরের দরজায় বুড়াশিব গুষ্টি গোত্তোর লইয়া।
দেইখ্যা শুনইয়া দেবেন দান হরষিত হইয়া ॥
তিরভুবনের স্বামী আইছেন ভিক্ষু তের রাজা।
গেরস্তের কইল্যাণে বাজুক ডম্বরুর বাজা ॥

সঙ্গে সঙ্গে শুরু হতো মহাদেবের গালবাদ্য ববম্ এবং ডম্বরুর ডিমি ডিমি ডিমি ডিমি। গোটা গ্রামের ছেলেমেয়ে বউরা সব এসে হাজির। নারদের উৎসাহ বেড়ে যেত। শিব থাকত অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে। গোটা পরিবার তখন তাকে ঘিরে নাচ এবং গান গাইত

ক্ষিতিতলে মহাদেবের
অবতরণ হইল।
এবার মহাদেবের নামে সবে
হরিহরি বলো।
ভাঙ ধুতুরা গাজা মাজা
থাহে যদি ঘরে
সাজাইয়া গুজাইয়া দেও
মহাদেবের তরে।
নারদের ঝুলিতে দেবেন
মুডা মুড়া চাইল।
ত্যাল দেবেন ঘেরতো দেবেন
মুসুরির ডাইল।
ত্যাল ঘেরতো দিয়া মোরা
কী ব্যাঞ্জন বানামু।
কান পাতইয়া হোনেন গীত
হক কতাই কমু ॥
উইস্থা ভাজা খাইতে মজা
ঘেরতেরি সোম্বার।
আরে গরম গরম ভাজা খাইতে
লাগে চোমোৎকার ॥

বলো ভাই, গেরস্তের কইল্যাণে হরি হরি বলো। শিবো শিবো বলো। মা জননী অন্ন দেও মা। খ্যাতে ফসল নাই, গোলায় চাউল নাই। অকালে হে কারণে জেরবার পরান। বাবা ভোলা মহেশ্বর কয়, অন্নপুন্না ফ্যান চায়। এ আকালে করো মাগো গরিবের তেরাণ।

এইসব কথা-ছন্দের মধ্যে কখনও ঢাক ঢোল কাঁসি বাজে, কখনো নাচ-গান হয়। গানের মধ্যে প্রধান থাকে শিব গৌরীর বিয়ের কথা, শিবের বার্ধক্য, গৌরীর দুর্ভাগ্য, তাঁদের সংসারে অনটনের কোন্দল। অঙ্গনে যাঁরা শিবের ‘গুষ্টি’ সেজে এসেছে সবাই বহুরূপী। বিগত পূজার সময়কার দুর্গা ঠাকুরদের রং করা পাটের ফেসোর চুল, দাড়ি এইসব নিয়ে রংচং যা জুটেছে, তাই দিয়ে বহুরূপী সেজে সবাই নাচ-গান করে। দান চায়। ছাইভস্ম মাখা জটাধারী বাবা ভোলানাথ ভিক্ষে চায়। নারদ ঝোলায় ভরে। সব মিলিয়ে যদিও দৈন্যদশার প্রদর্শনী, তথাপি এরই মধ্যে রঙ্গরসও কম থাকে না। হঠাৎ পর্বত বেরিয়ে আসে দলের মধ্য থেকে। নারদ তার মামা। দেখ না দেখ মাতা-ভাগ্নেতে জোর ‘কাজইয়া’ লেগে যায়। পর্বত বলে, ঠাকুর তোমার স্যাবক নারদ মোর মামা। তমো কই, ও চুতমারানির পোয় আসলেই ছ্যাচড়া। অর নেইয়ত সাইদ্যের পাপিষ্ট। যদি জিগাও ক্যান? তো কই

মামার ঝুলির মইদ্যে ঝুলি।
গেরস্তানি অন্ন দে খায় বুলবুলি ॥

আসলে মামায় একছের চোর। ‘বউ নাই ঝি নাই, এলহা এট্টা প্যাট। তমো দ্যাহ যুইত্তো বোন্দে (গোপনে) করে ল্যাট ঘ্যাট।’ মোরা প্যাডের জ্বালায় ভিক্ষা করতে বাইর অইছি আর হে লাংচুনির পোয়, হেই ভিক্ষার চাউল লইয়া এদার ওদার করে। মুই কই ঠাহুর তুমি এ্যার বিহিত করো।

অতএব, দাতা গৃহস্থ এবং শিব স্বয়ং, নারদের ঝুলি তালাশ করে চুরির মাল বের করে। চাষি শিব বলে, তোরে আইজ থিহা ত্যাইজ্য করলাম। তুই মোর ধারের থিহা যা গিয়া। যেহানে পারো হোগামারাইয়া খা গিয়া। নারদ এ কথায় ভীষণ ‘কোদ’ করে। এ একেবারে ‘ক’ র-ফলায় ‘ও’-কার ‘ধ’–কোদ। বলে এ্যাতোবড় কতা? তয় মুই চললাম। কতায় কয়—

য্যার লইগ্যা করলাম চুরি
হেই কয় চোর?
তয়, আইজ থিহা দলাদলি
তোর লগে মোর
থাকতা কৈলাসে, খাইতা
ভাঙ ভোঙ গাজা।
মোরইনা দৌলতে অইলা
ভিক্ষুতের রাজা ॥
তিরভুবন ভরমিয়া
আনি এডাওড়া।
কারণ অকারণে ঘড়াও
নিত্য নতুন ল্যাডা ॥
আইজ থিহা পিথগা
তোর লগে মুই।
মায়রে লইয়া আলাগ অইলাম
হোগামারা তুই ॥

এ কথায় মহাদেবের টনক নড়ে। সতত নেশাভাঙে বিভোর। অচল শরীর। সংসারটা বস্তুত নারদের ভিক্ষাতেই চলে। ছেলেরা তো অকম্মার ঢেঁকি। এসব ভাবনায় ভাবিতা হয়ে ‘জগন্মাতা’ সংসারের আর দশজন মায়ের মতোই সবাইকে তুচ্ছ করে নারদের কাছে যাওয়ার প্রস্তুতি করেন।

প্রতি বছর নীলগাজনের শিব তার পরিবারসহ পরিক্রমার প্রাক্কালে প্রথম আবির্ভাব ঘটাত আমাদের হাইস্কুল বা আমরা যাকে বড় স্কুল বলতাম তার সামনের মাঠে। হেডমাস্টারমশাইয়ের কাছ থেকে তারা আগেভাগে অনুমতি নিয়ে রাখত। তিনি তাদের বলে দিতেন যে, তারা যেন আদিরসাত্মক লীলাখেলার কীর্তন সেখানে না দেখায়। তারাও অবশ্য তাঁর আদেশ অনুযায়ী সঙ-যাত্রার অভিনয়াদি সেখানে করত। ‘লেইজারের’ সময় তারা সেখানে বেশ খানিকক্ষণ মহড়া দিয়ে বের হতো গ্রাম পরিক্রমায়। তারা যেহেতু আগেভাগে হেডমাস্টারমশাইয়ের অনুমতি নিয়ে নিত, আমরা জানতে পারতাম অমুক দিন লেইজারের সময় স্কুলের মাঠে নীলগাজনের সঙ হবে। ছাত্র-শিক্ষক সবাই সেই সঙ দেখার জন্য জমায়েত হতাম।

কিন্তু গেরস্তবাড়িতে এইসব শালীনতা রক্ষার দায় এই সঙেদের ওপর চাপানো যেত না। সেখানে তারা বিশেষ বিশেষ পরিবার এবং ব্যক্তির দোষগুণ নিয়ে সঙ করত। এই সঙের মাধ্যম অবশ্যই গান এবং কথকতা। ব্যাপারটি ঠিক নাটকও নয়, প্রহসনও নয়। আবার যে শুধু গ্রামীণ খেউড়, তাও নয়। এর মধ্যে অনেক কিছুই থাকত। গেরস্তরা, হরগৌরী কোন্দলের আদিরসাত্মক বর্ণনে, এদের উপর কোনো বিধিনিষেধ আরোপ করতেন না। গেরস্তের অঙ্গনে এক একদিন অপরাত্নে এইসব নীলগাজনিরা উপস্থিত হয়ে তাদের লীলাখেলা দেখাত। গেরস্তবাড়ির স্ত্রী-কন্যারা, এমনকি কর্তারাও এইসব অভিনয়াদির বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠান পুনরভিনয়ে দেখার জন্য তাদের উৎসাহিত করত। দলের অধিকারীমশাই, কত্তাগো মা বুইনেগো যেমন আইজ্ঞা, এমতো উচ্চারণে গৌরীকে একটু খেপিয়ে তখন আসরে নামতেন। গৌরী তখন শিবের নানাবিধ চারিত্রিক দোষত্রুটি নিয়ে শোরগোল তুললে নারদ কিন্তু বেবাক বিভেদ ভুলে শিবের পক্ষ নিত। এই নিয়ে চূড়ান্ত রগড়। তখন নারদ না মায়ের, না বাপের। নারদ তখন এক উদ্ভট গান জুড়ে দিত

ও তোরা গৌরী দেখবি আয়
শিবের বাসি বিয়া অয়
আর বুড়া বররে দেখিয়ে গৌরী
কান্দিয়া ভাসায়।

নারদ বলে,

‘তুমি যদি সতি সাদ্ধি এক মোন এক পেরান। তয় ক্যান বুড়া বরেরে দেইখ্যা ব্যাকুলিত মন। এই বরের লইগ্যা তো তুমি তপেস্যা করিলা। এহন ক্যানও করো কোন্দোল বুড়া বুড়া বলইয়া ॥’ নারদের কথায় গৌরীর হয় সাংঘাতিক লাজ, সে

গায় —

মোর মনে বেচাল নাই
বেচাল হের মন
গঙ্গারে দেইখ্যা ক্যান
ফাউকায় বদন?
কোন দেব হইয়া
মস্তকে ধরে গাঙ
কোন দেব হইয়া
নিত্য খোঁজে লাঙ?
একবার মরলাম মুই
তাহার অপবাদে।
অবশেষে জপেতপে
ফ্যালাইলাম ফাঁদে ॥
তমো দ্যাহ তিলোচন
আড় দিকে চায়।
ব্যালগাছ দেইখ্যাও তার
কুভাব মনে আয় ॥
মুই যদি সব্বজনের
আদিমাতা হই।
মোর ঘরে নিত্যদিন
ভিক্ষা মাগবি তুই ॥

এইসব রঙ্গরসে নীলগাজনের লীলাখেলা হতো। তবে এরা সবচেয়ে জম্পেশ আসরটি বসাত ডাক্তারবাড়ির উঠোনে। আশপাশ দশবাড়ির মেয়েমদ্দ তখন সেখানে উপস্থিত। হরগৌরীর কোন্দল বাদ দিয়ে তখন শুরু হতো ওই বাড়ির কোন্দলের বিন্যাস। এর কারণটা আগেই বলেছি। এ বাড়ির মেয়ে-বউয়েরা সারাদিনই ঝগড়ায় শুধু বাড়ি নয়, গোটা গাঁ-ই মাথায় করে রাখত। ভোর থেকেই মহড়া শুরু হতো তার। ভাষার ব্যাপারে জেঠি, খুড়ি এবং মেয়েদের কারওই কোনো বাছবিচার ছিল না। ডাক্তারজ্যাঠা তখন তাঁর রোগীপত্তর নিয়ে ব্যস্ত। অথবা বাজারে গিয়েছেন, বেলা বারোটায় শোনা যেত তাঁর হুংকার। ওই সময় হয় রোগী দেখা শেষ, নয় তিনি বাজার থেকে ফিরেছেন। ওর ওওও চুতমারানিরা, তোরা থামবি?—তখন ক্রমশ তাঁর কণ্ঠ উচ্চ এবং মহিলামহলের গলা খাদে। তবে ভাষা সবাই একই শব্দবন্ধে ব্যবহার করতেন। ডাক্তারজ্যাঠা সম্পর্কনির্বিশেষে সবার প্রতি সমবিচার করতেন এবং তাদের সম্ভাব্য অথবা অসম্ভাব্য উপপতিগণের অক্ষমতা বিষয়ে পুনঃ পুনঃ আফসোস প্রকাশ করতেন। নীলগাজনের সঙওলাদের এসব অজ্ঞাত ছিল না। পাড়া-প্রতিবেশীরা বলা বাহুল্য এই ঢপের কেত্তনে সাতিশয় রগড় উপভোগ করত।

পৌষ মাসের দিনগুলোতে ছিল প্রকৃত আনন্দের উৎসব। পিঠেপুলি, খেজুর রসের পায়েস তো ছিলই। এই সময় নিম্নবর্গীয় চাষি, বিশেষত যারা গতরখাটা এবং ভূমিহীন মানুষ, তারা মাঙনে বের হতো। উপলক্ষ্য কুমির পূজা। আমাদের পিছারার খালের ধারে ধারে তারা মাটির কুমির বানাত। লেজটার ওপর একটা কেয়াপাতার করাত থাকত লম্বালম্বি। মাথার ওপর দুটো বড় জলশামুক বসিয়ে চোখ বানানো হতো। কুমিরগুলোকে বলি দেয়া হতো খণ্ড খণ্ড করে। এই পূজাকে বারোবাঘের পূজাও বলা হতো। বারো বাঘের এক বাঘ কুমির।

কুমির, বাঘ, কাঁকড়া ইত্যাদি লোকায়ত পূজা বহুকাল আগের থেকেই সম্ভবত আমাদের এইসব অঞ্চলে প্রচলিত ছিল। জলজঙ্গল এবং বন্য জীবজন্তুর সঙ্গে লড়াই করে এই ভূমি আবাদ হয়েছিল। তখন জলে কুমির, ডাঙায় বাঘ, সাপকে নিয়ে বারো বাঘ। এই পূজার উৎসবটি তথাকথিত ভদ্রসমাজে প্রচলিত ছিল না। শীতের এই সময়টায় গেরস্তের নতুন ফসল কাটা হয়েছে। খাটুয়া মানুষদের হাতে বিশেষ কাজ নেই। তাই এই উৎসবটি উপলক্ষ্য করে গেরস্থের গোলা থেকে কিছু সংগ্রহ করা। সন্ধের সময় জনা দশ-বারো লোক এসে গেরস্তের আঙিনায় ধ্বনি দিত, ‘ঠাকুর কুলাই ভো’। ব্যস অমনি সবাই ছুটে এসে অঙ্গনে জমা হতো। তারা ছড়া বলত, বারো বাঘের ছড়া—

আইলাম লো সরণে
লক্ষ্মীদেবীর বরণে
লক্ষ্মীদেবী দিবেন বর
চাউল কড়ি বিস্তর
চাউল না দিয়া দিবেন কড়ি
শ্যাষ কাডালে সোনার লড়ি
সোনার লড়ি রুপার বাড়া—

শুরুয়াতটি অন্যভাবেও হতো। যেমন –

আইলাম লো লড়ইয়া
হস্তীর পিডে চড়ইয়া
হস্তী গেলরে
হস্তী গেল বেগমপুর
বেগমপুরে কী কাজ করে
রাজার মায়না খাইয়া বাঁচে–

এরকম সব ছড়া বলার পর শুরু করত বারো বাঘের পরিচয়। তাও ছড়া করেই বলত। এইসময় নানা ধরনের অশ্লীলতা প্রযুক্ত বাক্যপদের ব্যবহার করত তারা। তবে গেরস্ত-গেরস্তানিরা তাতে কোনো দোষ তো ধরতেনই না উপরন্তু মজা উপভোগ করতেন প্রচুর। অবশ্য প্রকৃত অর্থে এগুলোকে ঠিক অশ্লীল বলা হয়তো সংগত হয় না। এখানকার এবং বিশেষত এইসব মানুষদের ভাষা শব্দপদ এরকমই। তারা ছড়া কাটত–

এক বাঘ রে
এক বাঘ ছৈলা গাছে
মুতইয়া দিল রে
মুতইয়া দিল ভ্যাদামাছে—

অথবা

এক বাঘের রে
এক বাঘের কপালে সিন্দুর
পোলা বিয়ায় রে
পোলা বিয়ায় ঝাপউয়া ইন্দুর।

উচ্চবর্ণীয় বা বর্গীয় মানুষদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী অন্দোলন করার কোনো উপযুক্ত মঞ্চ ছিল না এখানে। সম্বচ্ছর তাদের অন্যায়, অত্যাচার, অবহেলা মুখবুজে সহ্য করে যাওয়াই ছিল নিম্নবর্ণীয়/বর্গীয় মানুষদের পরম্পরা। কিন্তু ভিতরে ভিতরে ক্ষোভ, দহন তো নিশ্চয়ই থাকত। সেইসব ক্ষোভের প্রকাশ ঘটত এই সময় নীলগাজনের সঙের এবং বারোবাঘের ছড়ায়। তখন তারা ব্যক্তিবিশেষকে এবং কখনো কখনো সমাজকেই বিদ্ধ করত তাদের ছড়ার মাধ্যমে। তার প্রকাশভঙ্গি হয়তো সবসময় নির্দিষ্ট অন্যায়-অত্যাচারকে সরাসরি নির্দেশ করত না, তবে তা যে চরিত্রগতভাবে প্রতিবাদী এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। মজার ব্যাপার এই যে, উদ্দিষ্ট ব্যক্তিদের সামনাসামনি এইসব ব্যঙ্গ বিদ্রুপ বর্ষিত হলেও এ নিয়ে কোনো বিতণ্ডা বা প্রতিশোধাত্মক পরিবস্থার সৃষ্টি হতো না। যেন এক অলিখিত নিয়মে নিম্নবর্ণীয়/বর্গীয়রা এই অধিকার ভোগ করত। দু-একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি খোলসা হবে। যেমন—

এক বাঘ রে এক বাঘ ডাক্তারবাবু
ছোডো বউয়ের রে
ছোডো বউয়ের খামারে কাবু

এক বাঘ রে এক বাঘ অবনী স্যান
ছাইছে বইয়া রে ছাইছে বইয়া খায় ফ্যান।

এক বাঘ রে এক বাঘ হিমাংশু গোপ্ত
হোগায় হ্যার রে
হোগায় হ্যার তিনডা গত্ত

এক বাঘ রে
এক বাঘ সতীন স্যান
বুদ্ধি দিয়ারে বুদ্ধি দিয়া ভাঙে ঠ্যাং।

এইরকমভাবে যার যার ওপর তাদের ক্ষোভ আছে অথচ প্রতিবাদ করার সাহস সামর্থ্য নেই, তাদের ওপর একহাত নেয়ার প্রবণতা এইসব ছড়ায় লক্ষণীয়। অমার্জিত ভাষা, বিকৃত উচ্চারণ, যা শুধু ভাষার আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যের জন্যই নয়, বরং উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তাকে যতটা স্থূলতায় নেয়া যায়, তা-ই যেন এইসব মানুষদের প্রচেষ্টা ছিল। প্রতিবাদের এও একটি ধরন বলেই বোধহয়। কিন্তু তার ভিতরে রগড় বা আনন্দ করার প্রবণতা যতটা, অসম্মান করার প্রচেষ্টা ততটা থাকত না।

এইরকম সব ছড়া বলে গেরস্তদের খুশি করে তারা সিধে পেত চাল, ডাল, আনাজ, পয়সা এবং শেষতক আবার ‘ঠাকুর কুলাই ভো’ বলে চলে যেত। কিন্তু এরই মধ্যে এক চোরাস্রোতে এইসব আনন্দের উৎসগুলো শুকিয়ে আসছিল। কিন্তু তখনও পিছারার খাল আর বড় খালপারের সেই বৃক্ষদম্পতি সহর্ষেই বিরাজমান ছিল।*

[* বস্তুত এই অনুষ্ঠানটি আসলে বাস্তু দেবতার পূজা। জল-জঙ্গল অধ্যুষিত এই অঞ্চলে এদের পূর্বজরা যখন প্রথম আবাদ শুরু করে বাস্তু প্রতিষ্ঠা করে, তখন উল্লেখিত বারোবাঘের প্রাদুর্ভাব ব্যাপক ছিল। সে কারণেই এই পূজার প্রচলন হয়ে থাকবে।]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *