তিরিশ
আটান্ন-ঊনষাট সাল। পিছারার খালের আশপাশের ভদ্রহিন্দু গেরস্তরা প্রায় শতকরা নিরানব্বই ভাগ তখন গ্রাম ত্যাগ করেছে। শুধু নিরুপায় কিছু ভদ্রহিন্দু এবং নিম্নবর্ণীয়রা, যুগি, নাপিত, ধোপা, কামার, কুমোরেরা গ্রামে রয়ে গেছে। নিম্নবর্ণীয়দের তখনও ভরসা আছে যে, মুসলমান শাসকশ্রেণি তাদের ওপর আঘাত হানবে না। পাকিস্তান শিডিউলড কাস্ট ফেডারেশন তখনও বেশ পোক্ত এক সংগঠন। তাদের বেশ কয়েকজন নেতা আছেন, নিজেদের জাত-গোষ্ঠীর কথা এঁরা বেশ জোরের সঙ্গেই রাষ্ট্রের কাছে বলে থাকেন। কিন্তু মার্শাল প্রেসিডেন্ট ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ব্যাপারটা অন্য দিকে মোড় নিতে থাকে। তখন মুসলিম লিগের প্রাক্তন প্রতিজ্ঞাগুলো যেন প্রায় পরিকল্পিতভাবে হারিয়ে যাবার পথে। তখন আর নিম্নবর্ণীয় বা বর্গীয় হিন্দু-মুসলমানদের অভিন্ন স্বার্থের কথা ক্ষমতাসীন কায়েমি স্বার্থান্বেষী সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িকদের মনে থাকে না। অথচ পাকিস্তান কায়েম করার সময় এই নিম্নবিত্ত নিম্নবর্গ তথা নিম্নবর্ণের মানুষদের সমর্থনের জন্য মুসলিম লিগ এক অভিন্ন স্বার্থের কথা বলেছিল। লাঙল যার জমি তার এরকম ‘নারা’ লাগিয়েছিল। সামন্ততন্ত্রের অন্ত্যেষ্টির কথা, তেভাগার কথা, কত কিছুই না বলেছিল তারা তখন। কিন্তু যখন ভদ্রলোক হিন্দুরা মাটি থেকে উচ্ছেদ হলো, যখন দেখা গেল অতি অনায়াসে ছেড়ে-যাওয়া মানুষদের জমিজমা, ভিটেমাটি করায়ত্ত করা যাচ্ছে, তখন লোভ তার জিহ্বার সংখ্যা বাড়িয়ে ফেলল। তখন বিচারটা হলো এই যে, যেনতেন প্রকারের হিন্দুর বাড়িঘর জমিনজায়দাদ দখল করি।
উচ্চবর্গীয়দের সম্পত্তি দখল হলে, তখন তাদের নজর পড়ে অপবর্গীয়/ বর্ণীয়দের গেরস্থালিতে। অতএব দখলকারীরা কায়দা পালটাতে শুরু করে। স্বাধীনতাকালীন দাঙ্গার কায়দা, যেমন ধর্মান্তরকরণ, কোতলকরণ, দেশান্তরী হতে ছল-বল-কৌশলের নানাবিধ প্রয়োগ—এসব আর থাকে না। তারা দেখেছে একজন হিন্দু ধর্মান্তরিত হলে তার সম্পত্তি দখল করা যায় না। কোতল করলে কোনো কোনো স্থান থেকে তার প্রতিবাদ, প্রতি-আক্রমণ ঘটে। তাই ও কায়দায় আর চলবে না। তারা হিন্দুদের এবার জাতভিত্তিকভাবে উৎসৃজনের কায়দাটি গ্রহণ করে। প্রথমে তাঁতি বা যুগিদের ভিটেমাটি দখল শুরু হয়। জোলা এবং তাঁতিরা কাছাকাছি বসবাসকারী, ঐতিহাসিকক্রমে একই রক্তের মানুষ। কিন্তু তাঁতি বা যুগিরা সংখ্যায় যেমন ব্যাপক নয়, তেমনই তাদের পেছনে শিডিউলড কাস্ট ফেডারেশনের মদতও আমার ওই এলাকায় তেমন পোক্ত দেখিনি। তাই প্ৰথমে তারা, তৎপরে কিছু কিছু নেতাই দেশ থেকে পালাতে লাগলেন। তবে নমঃশূদ্রজাতীয় মানুষেরা আমাদের ওখানে সহজে সব ছাড়তে রাজি হয়নি। তারাও ছিল ওখানকারই ভূমিপুত্র। বন কেটে বসত তারাও গড়েছে ওখানে। বস্তুত সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বের তৃণমূল স্তরের সংঘাত এই মানুষগুলোর মধ্যে জারিত হলো রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে নেতাদের অপশাসন, স্বার্থান্বেষী মোল্লাতন্ত্র তথা প্রতিষ্ঠিত এবং উঠতি জোতদারদের দৌলতে। তখন আমাদের প্রথম সংহতি-সংগীতের সেইসব পঙক্তিগুলো হারিয়ে যেতে থাকল—
হিন্দু ও মুসলিম এক পরানের
আমরা করি না বিবাদ।
অপবর্ণীয় নমঃশূদ্র সম্প্রদায় আর অপবর্ণীয় মুসলমানদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সংঘাত যতটা ক্ষতিকারক হয়েছিল, উচ্চবর্ণীয় ভদ্রলোক হিন্দুর সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বের কারণে উচ্ছেদ ততটা ক্ষতিকারক ছিল না। আমাদের ওই গ্রামগুলোর নমঃশূদ্রজাতীয় মানুষরা, গ্রামীণ আচার, বিশ্বাস, লোকায়ত ধর্মাচার এবং তৎসম্পর্কীয় মেলা-মোচ্ছব নিয়ে তাদেরই রক্তসম্পর্কীয় কিন্তু বিধর্মী নিম্নবর্ণীয় মুসলমান প্রতিবেশীদের সঙ্গে অনেক কাল ধরেই বেশ ছিল। ভদ্র হিন্দু গৃহস্থদের দেশত্যাগ তাদের ততটা ধ্বস্ত করেনি। তখন শুধু উচ্চবর্ণীয়রাই রাষ্ট্র-প্লবতার কারণে দেশত্যাগী, প্রায় নিশ্চিহ্ন। কিন্তু এহ বাহ্য।
বিগত দুর্ভিক্ষের প্রভাব তখনও বেশ টের পাওয়া যাচ্ছে। এই সময়টায় আমি প্রসন্নকুমার বিদ্যালয়ে এসে ক্লাস নাইনে ভর্তি হয়েছিলাম। এই গ্রাম কীর্তিপাশা। আগে দাদিআম্মার প্রসঙ্গে যে কীর্তিনারায়ণ রায়ের নাম করেছিলাম, যিনি ইসলাম কবুল করে আমাদের গ্রামের পুবপ্রান্তে তাঁর বসতি গড়েছিলেন তাঁর নামানুসারেই নাকি এই গ্রামের নাম কীর্তিপাশা হয়। আমার মনে হয় কীর্তিপাশা নামটির বিষয়ে কিংবদন্তিটি মিথ্যে নয়। কীর্তিপাশার জমিদারেরা কীর্তিনারায়ণের পরবর্তীকালীন সময়ে ওখানে বিখ্যাত হন। তাঁদের বংশীয় কারও নামে স্থানটির নামকরণের কোনো কিংবদন্তি শুনিনি। তবে যখন কীর্তিপাশার এই প্রসন্নকুমার বিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম, দেখলাম, এই স্থানটি আমাদের পিছারার খালের জগতের মতো নিঝুম, নিঃশূন্য নয়। এখানে একটি বাজার, স্কুল এবং এর চৌহদ্দির গ্রামগুলোতে ব্যাপক নমঃশূদ্র, কৈবর্ত, কর্মকার ইত্যাদির নিম্নবর্ণীয় হিন্দুদের বসতি থাকায় এখানে একটা অন্য পরিবশে বিরাজিত ছিল। গ্রামীণ সাংস্কৃতিক জীবনে যেসব অবলম্বন আমাদের বরাবর ‘ওম’ দিয়ে এসেছে, তার অনেকটাই এখানে লভ্য ছিল। যাত্রা-থিয়েটার, মেলা, প্রতিযোগিতামূলক ফুটবল, হাডুডু ইত্যাদি খেলার অনুষ্ঠান তখনও এখানে দিব্য জমিয়ে হতো। প্রসন্নকুমার বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বেশির ভাগই হিন্দু। বাজারটি বেশ জনসমাগমে সরগরম।
পিছারার খালের ওই নিঃশূন্য অঞ্চল থেকে বেরিয়ে এসে যখন এই জনসমাগমে পড়লাম, তখন থেকে গোটা স্কুলজীবনটা, অর্থাৎ প্রায় আড়াই-তিন বছর বেশ আনন্দে কাটিয়েছে। স্কুলের সময় ছাড়াও, অধিকাংশ সময় ওই বাজারেই আমাদের কাটত। এই সময় থেকে পিছারার খালের কথা ভুলতে শুরু করি। সেখানে তখন যুগিপাড়া, নাপিতপাড়া ছাড়া আর বিশেষ জনবসতি নেই। গোটা জেলায় ‘বরিশাল রায়ট’ নামক পঞ্চাশ-একান্নর দাঙ্গায় ভূমিত্যাগী হয়েছিল প্রায় ছয় লাখ হিন্দু। এই দাঙ্গার পর আমাদের জেলার বিভিন্ন হাই স্কুলের অন্তত পঞ্চাশজন হেডমাস্টারকে জেলে নিক্ষেপ করা হয় বলে শুনেছি। নিরাপত্তার অভাবে শত শত শিক্ষক তখন দেশত্যাগ করেন। ১৯৫০-৫১ সালের দাঙ্গা সংঘটিত না হলে আমাদের এই চন্দ্রদ্বীপ এলাকার শিক্ষার হার অনেক বেশি হতো এবং সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই জেলার জনগণ বাংলাদেশে অবশ্যই আরও অগ্রগামী ভূমিকা পালন করতে পারত। এই দাঙ্গার পর থেকেই মুসলমান সমাজে গুণ্ডারা সামাজিক এবং রাজনৈতিকভাবে হিন্দুদের ওপর নির্যাতন শুরু করেছিল। হিন্দুরা এ সময় থেকেই প্রকৃতপক্ষে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত হতে থাকে। শিল্প, বাণিজ্য, চাকরি ইত্যাদির ক্ষেত্র থেকে তাদের উৎসৃজন ক্রমশ ব্যাপক হারে শুরু হয়। তথাপি এই পরিবস্থার মধ্যে প্রসন্নকুমার বিদ্যালয়টি যে টিকে গিয়েছিল তার কারণ, এই গ্রামটির চারদিকে নমঃশূদ্রদের ব্যাপক অবস্থিতি এবং তারা তখনও দেশ ছাড়ার কথা কেউ বিশেষ ভাবছে না। উপরন্তু চিত্ত সুতার, মনোরঞ্জন শিকদার—এঁরা তখন রাজনৈতিক জগতের হোমড়া-চোমড়া এবং তফসিলিজাতীয়দের নেতা।
কিন্তু মার্শাল আইয়ুব খান সাহেব একটু কায়েমি হয়ে বসেই এমন কলকাঠি নাড়া শুরু করলেন যে, নমঃশূদ্র সম্প্রদায়েরও ভিত আলগা হতে লাগল। যে কথা দিয়ে প্রসঙ্গের শুরু—এই সময়টায় সংখ্যালঘু বিতাড়ন শুরু হয় এক ভিন্ন কায়দায়। প্রত্যক্ষ দাঙ্গার দিন তখন থেকে শেষ হয়ে গেছে। নারায়ে তকবির আল্লাহু আকবর ধ্বনি তুলে একদা যেমন তথাকথিত ‘ভদ্রলোক’ হিন্দুদের পিলে চমকে দেয়া গিয়েছিল, নমঃশূদ্র বা অনুরূপ জাতির মানুষদের সেভাবে চমকানো বা কায়দা করা যায়নি। গ্রামীণ পরিমণ্ডলে দেশজ অস্ত্রের ব্যবহার এরাও ভালোই জানত। তা ছাড়া এখানকার সাধারণ শ্রেণির মুসলমানেরা এবং নমঃশূদ্ররা রক্তের বিচারে, সাংস্কৃতিক বিচারে এবং রাজনৈতিক মেলবন্ধনে ছিল পরস্পরের খুব কাছাকাছি। তাই তাদের ওপর এই অকস্মাৎ আক্রমণকে তারা বিশ্বাসঘাতকতা বলেই গ্রহণ করল এবং যথাসাধ্য প্রতিরোধের জন্য সচেষ্ট হলো। এই বিশ্বাসঘাতকতা মুসলিম লিগের তরফ থেকেই যে করা হয়েছিল, তাতে দ্বিমত থাকার কোনো কারণ নেই। কেননা মুসলিম লিগের তরফ থেকে স্বাধীনতার প্রাক্কালে এই মানুষদের অর্থাৎ আধিয়ার, তেভাগা আন্দোলকারী, বেঠবেগারি-বিরোধী, সামন্ত নিপীড়িত তাবৎ অপবর্গী সাধারণ বর্ণ হিন্দু এবং মুসলমান চাষি সমাজকে এক প্রগাঢ় ‘ওয়াদা’ প্রদান করা হয়েছিল। এইসব মানুষ সামগ্রিকভাবেই হিন্দু সামন্তদের দ্বারা ব্যাপকভাবে শোষিত এবং নির্যাতিত ছিল।
পিছারার খালের চৌহদ্দিতে যেমন, গোটা পূর্ববাংলায়ও তেমনি, সামন্ত শ্রেণি বলতে হিন্দু সামন্তদেরই সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল। কিন্তু তা ছিল মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণির সামগ্রিক হিসেবে। তার অর্থ এই নয় যে, মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যের জমিদার বা অন্য মধ্যস্বত্বভোগীরা সাধারণ এইসব মানুষদের শোষণ বা নির্যাতন করত না। আমার পরিমণ্ডলে আমি অনেক তথাকথিত তালুকদার দেখেছি যারা সাম্প্রদায়িকভাবে মুসলমান এবং শ্রেণিশোষণ বা নির্যাতনে অথবা আর্থিক প্রবন্ধে, ওখানকার হিন্দু জমিদার বা তালুকদারদের তুলনায় কিছুমাত্র ভিন্ন নয়। সে ক্ষেত্রে লিগপন্থিরা সাধারণদের বুঝিয়েছিল যে, পাকিস্তান কায়েম হলে সামন্ততন্ত্র উচ্ছেদ হবে এবং অবস্থাপন্নদের সংযত রাখার জন্য ইসলামি বিধিমতে ‘জাকাত’, ‘খয়রাত’ ইত্যাদি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ‘তেভাগা’র অনুসরণ যে পাকিস্তান কায়েম হলে স্বাভাবিকভাবেই হবে, এ বিষয়ে সাধারণ চাষিদের ব্যাপকভাবে বলা হয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তান কায়েম হবার পর, এমনকি মধ্যস্বত্ব প্রথা উচ্ছেদ হবার পরও, এই প্রতিজ্ঞা পালনের কোনোই প্রচেষ্টা হয়নি। না হওয়ার কারণটিও অবশ্য শরিয়তি ব্যবস্থার অন্তর্গত, অন্যের ‘হক্কের সম্পত্তি দখল করা নাজায়েজ। এসব বিতর্কে তখন অন্তত কেউ যাননি। ফলত, হিন্দু উচ্ছেদকরণের কায়দাটি পাকিস্তান কায়েম হবার পর ক্রমান্বয়ে প্রথমে হিন্দু মধ্যস্বত্বভোগী, তৎপর অসংগঠিত হিন্দু অপবর্ণী এবং সর্বশেষ সংগঠিত হিন্দু অপবর্ণীয়দের (পাঠক, বর্গ ও বর্ণের ভিন্নতা এ ক্ষেত্রে বিচার করবেন) উচ্ছেদে তার বৃত্ত সম্পূর্ণ করে।
এখন কথা হচ্ছে, এ সংবাদ আমি কীভাবে জানি বা এইসব হিসেবের সূত্র কী? প্রসন্নকুমার বিদ্যালয়ে আগত এবং পাঠরত আমার সতীর্থ অপবর্ণীয় বান্ধবরাই এ তথ্য বলে, বা, তাদের হঠাৎ হঠাৎ অন্তর্ধানে আমি অন্যদের কাছে জিজ্ঞেস করে তা জানতে পারি। এইসব থেকেই আমি লক্ষ করে দেখেছি, নিম্নবর্ণীয়, শিডিউলড কাস্ট ফেডারেশনের অন্তর্গত মানুষরা, যারা ওই দেশে পূর্ণ মর্যাদায় থাকতে পারবে বলে বিশ্বাস ছিল, তারাও দেশত্যাগ করতে শুরু করে। কিন্তু তারা কি কোনো ব্যাপক সাম্প্রদায়িক আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়েছিল পঞ্চাশ-একান্ন সালের দাঙ্গার সময়ের মতো? না। কারণ মার্শাল প্রেসিডেন্ট সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নাকি পছন্দ করতেন না, এরকম আমরা তখন জেনেছি, দেখেছিও। তবে যেটা জানিনি এবং যে কারণে অপবর্গীয়/বর্ণীয় মানুষেরা দেশ ছেড়ে তখনও নিরুদ্দেশ যাত্রা করছিল, তার কারণ নিশ্চয়ই মার্শাল প্রেসিডেন্টের ইচ্ছার মধ্যেই নিহিত ছিল যে, এরাও চলে যাক। দেশের ওপর অধিক জনসংখ্যার চাপ কমুক এবং ভূমির দখলদারি বিশেষ সম্প্রদায়ের হাতে আসুক। এটা মোল্লাতন্ত্রের সদুপদেশ। জেনারেলও স্বার্থসন্ধ হয়ে তাই বুঝলেন।
এই সময়টায় দেশে কৃষিবিষয়ক বিশেষজ্ঞরা আসছিলেন—আমেরিকা এবং জাপান থেকে। জাপানিরা অবশ্য তখনকার আন্তর্জাতিক কারণে বকলমায় মার্কিনই। তখন এক লপ্তায় অনেক জমি চাই, জাপানি প্রথায় ধানের চাষ চাই, কৃষিকর্মে ট্রাক্টরের ব্যবহার চাই, হল্যান্ডের পদ্ধতিতে আলুর চাষের উদ্ভাবন চাই—এইসব বিষয়ে ইস্ট পাকিস্তান ইনফরমেশন, পাকিস্তান অবজার্ভার ইত্যাদি পত্রিকায় ব্যাপক লেখাপত্তর প্রকাশ হতো। কিন্তু দেশের লোক যেহেতু বেহেড ‘ক’ অক্ষর হারাম, তাই লাল, সাদা, পীতবর্ণের সাহেবগণ গামবুট পরে জল-কাদা-জোঁক, সাপ তুচ্ছ করে আমাদের ওখানে মানুষের হিতসাধনে দলে দলে আসতে লাগলেন। এরকম সময়ের একটি সরস ঘটনা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় আছে বলে বলার লোভ সামলাতে পারছি না। মার্কিনি সাহেবেরা আমাদের বড় খালপারের একখণ্ড জমিতে জাপানি প্রথায় ধানের চাষ শেখাতে এসেছেন। আমাদের ওপারের তারুলি গ্রামের কদম আলি চাচা আশপাশে ঘুরঘুর করছেন। মাঝে মাঝে গ্রামীণ অন্যান্য উপস্থিত লোকেদের কাছে উলটোপালটা মন্তব্য করছেন। চাচা পুরুষানুক্রমে জাতচাষি। সাহেবরা প্রায় স্কেল-পেন্সিল নিয়ে কায়দাটা বোঝাবার চেষ্টা পাচ্ছেন যে, ধানের চারার লাইন এমতো সোজা হবে। এখান থেকে জলের প্রবাহ আনতে হবে, এই সার, ওই ওষুধ এরকমভাবে দিলে তবেই অধিক ফসল হবে—এইসব। দোভাষী পাকিস্তানি সাহেবরা ব্যাপারটা স্থানীয় চাষিদের বুঝিয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু তাঁরা একটি ব্যাপারে কিছুই বলছেন না। তা হলো, খেতের জলটা আসবে কোত্থেকে। ধানচাষে যতই কায়দা করা হোক আর সার দেয়া হোক, জল না থাকলে কিছুই কিছু না। তো কদম চাচা শেষতক আর নিজেকে সামলাতে না পেরে স্বনিরুক্তিতে বলেই ফেললেন, এইসব করলে যদি ডবল ধান অয়! তয় তো মোর বাজা গাইডারে ‘ম্যাল’ দিলে বাছুরও হওন লাগে।—’ম্যাল’ অর্থে
‘ম্যাল’ অর্থে ‘পাল’ খাওয়ানো। চাচা আরও বলেছেন—বাপদাদা পরদাদায় কইয়া গেছেন যে, আওলাদ পয়দা করণের লইগ্যা পেরোজন ‘মাতৃরজ’ আর ‘পিতৃবীর্য’। এ্যারা দেহি খালি ‘পিতৃবীর্য’ দিয়াই আওলাদ পয়দা করতে চায়। তয় মোর মোন লয় এই বড় খালডারে না কাডাইলে এহানে একগাছ বালও অইবে না। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে তখনকার দিনে আমাদের অঞ্চলে শ্যালোর প্রচলন ছিল না। চাচার কথায় পাকিস্তানি সাহেবরা চটেন এবং কদম চাচাকে খেদিয়ে দেন। কিন্তু, মনে আছে, তিনি নিরাপদ দূরত্বে থেকে বলে যাচ্ছিলেন—মদনরস না থাকলে পাল খাওয়াইয়া কী অইবে অ্যাঁ?—তোরা যা ইংরাজি করইয়া কও হেয়া বুজি না আমি। তয়, খালডা যদি না কাডা অয় তয় এহানে বাল পাবা বাল।
তার এই কথা একসময়ে অক্ষরে অক্ষরে সত্য হতে দেখেছি। কদম আলি চাচার কথার লব্জ এরকমই ছিল। তো, তাঁর এইসব কথা যখন কেউই আমল দিচ্ছে না, তিনি একটু উত্তেজিত স্বরে কথা বলতে শুরু করলেন। এ কারণে জনৈক মার্কিন সাহেব বিরক্ত হয়ে তাঁকে সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন, হু আর ইউ?—এখন কদম চাচা ‘ইউ’ মানে ‘তুমি’ তা জানেন, কিন্তু ‘হু আর’ তাঁর কাছে ‘শুয়ার’। কারণ, এখানে ‘শ’ উচ্চারণ ‘হ’-য়ে হয়। এ কারণে তাঁর ক্রোধ। কী? না সাহেব ‘হেনারে হুয়ার অর্থাৎ ‘শুয়ার’ হইছেন।’ একে চাষি, তায় মুসলমান। এ কারণে শুয়োরের ওপর তাঁর বিদ্বেষ এবং ঘৃণা প্রকট। তাই চটজলদি তাঁর উত্তর, ‘সায়েব, হুয়ার তোমার বাফে।’—অর্থাৎ সাহেব তখন জাত্যংশে, চাচার বিধিমতে, শূকরপুত্র।
তা এসব ‘কিত্তি’ তো আমাদের নিজেদের দেখা। একসময় বুঝেছি, চাচা তাঁর বেসিক প্রেমিসে একশ ভাগ সঠিক। কিন্তু দেশি বা পরদেশি সাহেবরা তাঁর ভাষা এবং অভিজ্ঞতাকে আমল দিচ্ছে না। বড়খালটা যে শুকিয়ে গিয়ে তার আশপাশের জমিকে ‘মদনরস’ বঞ্চিত করে বাঁজা করে দিচ্ছে, কদম চাচার ভাষায়—এই চুতমারানির পোয়েরা হে কতা বোজলে তো!’