বিষাদবৃক্ষ – ৪৪

চুয়াল্লিশ

গ্রামে থাকাকালীন সমস্যা ছিল একরকম। এখন শহরের জীবনের তামাশাটাও দেখা হলো ভালোভাবেই। দুরাচারী শত্রুর বিরুদ্ধে সাবধানতা অবলম্বন করার কায়দাটা গ্রামের তদানীন্তন পরিবস্থায় রপ্ত করতে পেরেছিলাম। কিন্তু বন্ধুবেশী দুরাচারীর সুযোগ নেয়ার বিরুদ্ধে কী করা যায় সে শিক্ষা ছিল না। অত্যন্ত ভারাক্রান্ত মন নিয়ে পরের দিন বাড়ি ফিরে আসলাম।

বাড়ি আসার পথে লঞ্চেই ধুম জ্বর হলো। বাবা-মা সব শুনে খুবই দুঃখিত হলেন। বাবার যদিও পড়াশোনার ব্যাপারে বিশেষ মোহ আগে ছিল না, কিন্তু আমার বাল্যাবধি আকাঙ্ক্ষা এবং সবরকম প্রচেষ্টার এই পরিণতি দেখে তিনি যারপরনাই দুঃখিত হলেন। পড়াশোনা করার আকাঙ্ক্ষায় জ্ঞান হওয়ার পর থেকে আমি অনেক ক্লেশ, লাঞ্ছনা এবং অপমান সহ্য করেছি। জ্বরতপ্ত মস্তিষ্কে সেইসব স্মৃতি আমাকে আরও আকুল করে তুলল। ভাবলাম, এই নিরর্থক চেষ্টা করে আর লাভ নেই। তার চেয়ে যদি কিছু রোজগার করতে পারি, তবে হয়তো ভাইবোনগুলোকে মানুষ করতে পারব। কিন্তু এতবড় সংসার তার বিশাল হা-মুখ ব্যাদান করে রয়েছে। তার সহস্র অভাব। আমার সামান্য ক্ষমতার রোজগারে কতটুকু সমস্যারই-বা সমাধান হবে?

প্রায় কুড়ি দিন ভোগার পর আপনা থেকেই জ্বর নিরাময় হলো। ওষুধপথ্যের সামর্থ্য ছিল না। বিনিপয়সার জড়িবুটি গিলে একসময় সুস্থ হলাম। আমি সুস্থ হলাম তো বাবা অসুখে পড়লেন। তখনকার দিনে জ্বর হওয়া মানে পনেরো-বিশ দিনের ধাক্কা। মাঝে একদিন স্কুলের মাস্টারমশাইদের সঙ্গে দেখা করতে গেলে তাঁরা আমার অবস্থা শুনে খুবই দুঃখিত হলেন। সময়মতো তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করিনি বলে আমার নির্বুদ্ধিতা নিয়ে নিন্দাবাদও করলেন। যা হোক, হেডমাস্টারমশাই বাবার অসুস্থতাজনিত কারণে অনুপস্থিতির জন্য তাঁর জায়গায় আমাকে ক্লাস করতে আদেশ করলেন। মাইনে দিনে এক টাকা। বাবা সর্বসমেত আঠারো দিন শয্যাশায়ী ছিলেন। সর্বমোট আঠারো টাকা পেলাম। আমার এতকালের রোজগারে এত বেশি টাকা একসঙ্গে কখনো পাইনি। আমার ওই দুঃখের সময়ে সেই কয়দিনের কাজটা এবং তার রোজগার এক সঞ্জীবনীর কাজ করল। তখনকার দিনে আঠারো টাকা অনেক টাকা। তখন পয়সা কম ছিল বলে জিনিসপত্রের দামও কম ছিল। চাল তখন আট আনা-বারো আনা সের। ডাল-মুসুরি দুআনা, খেসারি এক আনা। চা পাঁচ আনায় এক ছটাক। দুটাকা-এক টাকার বাজার করলে দু-তিন দিনের ডালভাত জোগাড় করা কষ্টকর ছিল না। তেলের প্রয়োজন বাড়ির নারকেল অথবা সস্তা তিল তেলেই মিটে যেত। চিনির ব্যবহার ছিল না বললেই চলে। গুড়ই ছিল একমাত্র মিষ্টির উপকরণ।

আগে টিউশনি করে যা রোজগার হতো তার সবটাই সংসারে দিয়ে দিতাম। শহরে বাস করার ফলে নিজের খরচ বলে একটা রোগ জন্মেছিল। তাই এবারের রোজগার থেকে মাকে দশ টাকা দিয়ে বাকি আট টাকা নিজের প্রয়োজনের জন্য রেখে দিলাম। কারণ কবে আবার রোজগারের সুযোগ হবে কে জানে? টিউশনিগুলো তো অনেক দিন হাতছাড়া। বাবা আবার অসুস্থ হয়ে আমাকে রোজগারের সুযোগ দিন, এমনটাও কাম্য ছিল না।

এই সময় ভাগ্য আরেকবার পরিহাস করল। বরিশাল ব্রজমোহন কলেজ থেকে একদিন একটি চিঠি পেলাম। আমার সময়ের অধ্যক্ষ কবীর চৌধুরী সাহেব তখন বদলি হয়ে অন্য কোথাও গিয়েছেন। তাঁর জায়গায় যিনি এসেছেন, তাঁর নাম মেজবাহারুলবার চৌধুরী। কবীর সাহেব আমি থাকাকালীনই বদলি হয়ে চলে গিয়েছিলেন। উপাধ্যক্ষ গোলাম মোস্তফা সাহেব নামে একজন তাঁর জায়গায় কাজ দেখছিলেন। তাঁর সঙ্গে আমার বিশেষ পরিচয় ছিল না। আমি চলে আসার সময় কবীর সাহেব থাকলে আমার অত দুর্ভোগ হতো না। তাঁর সঙ্গে দেখা করলে একটা ব্যবস্থা তিনি অবশ্যই করতেন। সে যা হোক, এখন যে চিঠিটা পেলাম তাতে স্বাক্ষর ছিল মেজবাহারুলবার চৌধুরী সাহেবের। যতদূর স্মরণ আছে চিঠিখানা ছিল নিম্নরূপ—

It is learnt from the office record that a Scholarship for Rs. 15/-p.m. and a Stipend for Rs. 10/-p.m. remained unpaid which were to be paid to you. It is not understood as to why you have not availed of those advantages which the state has provided for the meritorious students in order to ease the burden of their educational expenditure. I also like to intimate you that non acceptance of national scholarship is a gross misconduct on the part of a student.

আরও কীসব কথা যেন ছিল সেই চিঠিতে। যা হোক, চিঠির শেষে তিনি জানিয়েছেন, আমি যেন অচিরেই কলেজ অফিসে গিয়ে কলেজের প্রাপ্য বাদে বাকি টাকা নিয়ে আসি। চিঠিটা পেয়ে আমি তো হতবাক! যে টাকার জন্য ক্লার্কের দাঁত খিঁচুনি এবং গালমন্দ খেয়ে পড়াশোনায় ইস্তফা দিয়ে চলে আসতে বাধ্য হলাম, সেই টাকাই না-নেবার জন্য এখন আমাকে উলটো তিরস্কার শুনতে হচ্ছে। মানুষ যে অদৃষ্ট বা অলৌকিকত্বে বিশ্বাসী হয়, তার কারণ বোধহয় এই ধরনের আকস্মিক সংঘটন। এইসব অভিনব ঘটনার ব্যাখ্যা হঠাৎ করে পাওয়া যায় না বলে মানুষ ভাগ্যবাদী, ঈশ্বরবাদী হয়ে পড়ে। আমারও সেইসব দিনে ঈশ্বরে বিশ্বাস বেশ গাঢ় হয়ে দেখা দিয়েছিল।

পরদিন ভোরের লঞ্চেই সদরে যাত্রা করলাম। কলেজে গিয়ে প্রথমেই অফিসে না গিয়ে অধ্যক্ষ সাহেবের সঙ্গে দেখা করলাম। সেই দিন থেকেই আমাদের পরীক্ষা শুরু। সহপাঠী, সহপাঠিনীরা সবাই তখন পরীক্ষা দিতে ব্যস্ত। আমার পরিচয় পাবার সঙ্গে সঙ্গেই অধ্যক্ষ সাহেব আমাকে তীব্র ভাষায় তিরস্কার করতে শুরু করলেন। ভদ্রলোক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার আপাদমস্তক দেখলেন। আমার দীন-দরিদ্র চেহারা এবং পোশাক-আশাক দেখে সম্ভবত তাঁর বিরক্তি কিছু প্রশমিত হয়ে থাকবে। জিজ্ঞেস করলেন, আমি পরীক্ষায় বসিনি কেন? আমি যথাসম্ভব সংক্ষেপে কিন্তু কিছুই গোপন না করে সব ঘটনা তাঁকে বললাম। শুনে তিনি পুনর্বার ক্রুদ্ধভাবে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, Why didn’t you come to me then? আমি বিনীতভাবে বললাম, you were not here at that time sir, and the previous principal had already left for his new assignment. জনাব চৌধুরী আরও কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করে প্রশ্ন করলেন, Are you a Hindoo? বললাম, yes sir. তিনি হতাশ একটা মুখভঙ্গি করে বললেন, That’s the reason. These people here in this office are awefully communal, I understand that idiot clerk must have done this mischief. But ha! how sad I am. তখনকার দিনের পূর্ব পাকিস্তানে কোনো অফিস বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এইরকম ইংরেজিতেই বার্তালাপ করার রীতি ছিল। ব্রিটিশ আমলের অভ্যেস তখনও যায়নি। সে যা হোক—ওই মাপের একজন মানুষ যে আমা-হেন একজন অভাগার সঙ্গে এইসব কথা বলতে পারেন সেটাই সেদিন আমার কাছে পরম আশ্চর্য বলে বোধ হয়েছিল। তিনি সেদিন আরও নানান কথার মধ্যে বলেছিলেন যে, তাঁর পরামর্শ হলো ওই জাহান্নামে না থেকে ভারতে গিয়ে আমার ভাগ্য পরীক্ষা করে দেখা। অন্যথায় আমার ভবিষ্যৎ ঝরঝরে হতে বাধ্য। অবশ্য তিনি আমাকে এও জানাতে ভুললেন না যে, এরকম দোজখ সেখানেও আছে, এটাও যেন আমি না ভুলি।

তারপরে একটি চিরকুটে কিছু নির্দেশ লিখে আমাকে দিয়ে বললেন সেটি ক্লার্কের কাছে দিতে। অফিসে পৌঁছে পরিচয় দিতে-না-দিতেই লোকটি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল। বলল, অ তুমিই বুজি হেই এস্কলার? আমারে বাঁশ দেওনের চক্কর করতাছ? আমার চাকরি খাবা? আগে ভালো করইয়া কও নায় ক্যান? অ্যাঁ? আমি কিছু না বলে শুধু চিরকুটখানা তার হাতে দিলাম। চিরকুটটি আমি পড়িনি। ভেবেছিলাম তাতে শুধু আমার টাকাপয়সা মিটিয়ে দেবার নির্দেশই ছিল। কিন্তু সে চিরকুটটি পড়ে একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়ল। তখন কোথায়-বা তার সেই তেজ, কোথায়-বা ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ। সে তখন ভয়ে, আতঙ্কে একেবারে অন্য মানুষ। বলতে লাগল, এডা তুমি করলা কী? এহন আমি কী করি কওছেন দেহি? তুমি আগেই ছারের কাছে কমপ্লেইন করলা? আমি এহন বিবি বাচ্চা লইয়া কোথায় যামু? আমি তার এরকম আচরণের কারণ বুঝতে পারছিলাম না। বললাম, দেখুন আমি তো কোনো কমপ্লেইন করিনি। আমি স্যারের চিঠি পেয়ে তাঁর সঙ্গে আজ দেখা করতে তিনি ওই চিরকুটটি আপনাকে দিতে বললেন। কিন্তু আপনার তাতে এত নার্ভাস হওয়ার কী আছে বুঝতে পারছি না। কী আছে ওই চিরকুটে? লোকটি চিরকুটটি আমার হাতে দিয়ে বলল, কী আছে নিজেই পড়ইয়া দ্যাহ। হায় আল্লা, আমি অহন কী করি? চিরকুটটি সত্যিই তার পক্ষে আতঙ্কজনক ছিল। তাতে লেখা ছিল pay the boy his entire dues after adjusting his tution fees for the period of his tenure in this college and call on me immediately along with him for explaining the entire mischief done on him by you. নিচে প্রিন্সিপ্যালের সই। এ যেন আকাশ ফুঁড়ে নেমে আসা আল্লার গজব। লোকটি এখন রীতিমতো আমার অনুগত হয়ে পড়ল যেন। বলতে লাগল; আসলে দোষটা আমার না বোজলা? টাকাডা আইছেই দেরিতে। কিন্তু হে কতা তো ছারে মানবে না। আমার যে কী অইবে—হা আল্লা! বললাম, অত ঘাবড়াচ্ছেন কেন, কাজ করতে গেলে ভুল তো হতেই পারে। একটু বুঝিয়ে বললে উনি নিশ্চয়ই বুঝবেন। না, হেরকম সম্ভাবনা নাই। এ মানুষটা আলাদা কেসেমের। একছের আড়বুজ আদমি। হেয়া ছাড়া কেইসটা লইয়া ইউনিয়নের ছ্যামড়ারা হ্যারে কইছে যে আমি নাকি ইচ্ছা করইয়া ব্যাপারডা চাপা দিছি, য্যাতে তুমি পরীক্ষা দিতে না পারো। আচ্ছা কওছেন দেহি আমি একজোন নেকদার ইমানদার মানুষ, জিন্দিগিতে কোনো দিন হিন্দু-মোছলমান জুদা দেহি নাই, আমি কি পারি এ রহম এট্টা নাপাক কাম করতে?

ব্যাপার তাহলে সত্যি গুরুতর। কিন্তু লোকটি এক আশ্চর্য চরিত্র। সে একবারও আমার সর্বনাশের বিষয়টা উল্লেখ করছিল না। অথবা সে যে একটা জঘন্য অন্যায় করেছে, তার জন্য কোনো অনুতাপও তার আচরণে প্রকাশ পাচ্ছিল না। সে শুধু নিজে কীভাবে বর্তমান বিপদ থেকে মুক্ত হবে তাই ভাবছিল এবং সেই নিয়েই কথা বলে যাচ্ছিল। অবশ্য এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে সে আমার হিসেবনিকেশও করে যাচ্ছিল, তারপর একসময় সে আমাকে একটা খাতায় সই করিয়ে একগুচ্ছ নোট হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, নেও গুনইয়া দেইখ্যা লও। তারপর তোমার লগে এট্টু পেলান করইয়া ছারের ধারে যাই। কলেজ আমার কাছে পাবে আশি টাকা, যেহেতু আমি মাত্র আট মাস ক্লাস করেছি এবং পরীক্ষায় বসতে পারিনি, সে জন্য পুরো বছরের মাইনে দেয়ার প্রশ্ন ওঠে না। আবার সেই কারণেই আমিও পুরো সেশনের টাকা পাব না। মাইনে দশ টাকা মাসে এবং স্টাইপেন্ডও দশ টাকাই, তাই আশি টাকায় কলেজের দেনা মিটবে। পনেরো টাকা হিসেবে আট মাসের স্কলারশিপের টাকাটা আমি পাব। সে ক্ষেত্রে আমার পাওনা একশ কুড়ি টাকা। এই কয়টা টাকা জোগাড় হয়নি বলেই আমি পরীক্ষায় বসতে পারিনি। কিন্তু টাকাটা গুনে দেখলাম ক্লার্ক সাহেব আমাকে দিয়েছে পাঁচশ কুড়ি টাকা। বুঝলাম হিসেবে ভুল করেছে। তখন আমার যা অবস্থা, তাতে গোটা টাকাটা নিয়ে কিছু না বলে চলে আসলে এর কোনো হদিসই থাকত না। কারণ খাতায় আমি একশ কুড়ি টাকা লেখা দেখেই স‍ই করেছিলাম। সেটা লোকটার কুকর্মের একটা জবাবও হতো। কিন্তু পারলাম না। সম্ভবত সে অতিরিক্ত ঘাবড়ে যাওয়ার জন্য ভুল করেছে। টাকাটা তার হাতে দিয়ে বললাম, বোধহয় গুনতে ভুল করেছেন। অনেক বেশিই দিয়ে ফেলেছেন। দেখুন তো। বেশি দিয়ে দেয়ার কথায় সে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে টাকাটা ছিনিয়ে নিল এবং আবার গুনে ভুলটা বুঝতে পারল। কিন্তু কয়লা ধুলেও কি ময়লা যায়? সে আমাকে একশ কুড়ি টাকা দিয়ে বাকি টাকাটা জায়গামতো রেখে বলতে লাগল, দ্যাহছেন দেহি, অ্যাঁ? টাকাডা যদি বাইর অইয়া যাইত? তুমি যদি লইয়া চলইয়া যাইতে? ইস আল্লায় আমারে বাচাইছে। বললাম, নিয়ে চলে যাবার ইচ্ছে থাকলে তো বলতামই না। যা হোক, কী প্ল্যান করবেন বললেন করুন। আমাকে আবার অনেক দূর যেতে হবে। লোকটি প্রকৃতই নির্লজ্জ। আমার সঙ্গে এতসব দুর্ব্যবহার করার পরও, এমনকি আমার এতবড় একটা ক্ষতি করার পরও সে কিনা এখন আমারই সহায়তা চাইছে। সে বলল, পেলান আর কী করুম। আমি কই কি, তুমি তো আমার ছোড ভাইর ল্যাহান, তুমি এট্টু ছারেরে বুঝাইয়া কইয়া দেহছেন যদি কিছু অয়। আসলে তুমি তো এস্কলার ইস্টুডেন্ট, বোজলা না? বুঝেছি সবই, কিন্তু ইনি আমাকে দিয়ে ঠিক কী বলাতে চান সেটা বুঝতে পারছিলাম না। জিজ্ঞেস করলাম, ঠিক আছে, কিন্তু কী বলতে হবে বলে দিন। লোকটিও সেই ব্যাপারটাই বুঝে উঠতে পারছিল না। আসলে সে যতটা বদমায়েশ, ততটা বুদ্ধির অধিকারী ছিল না। একেবারেই বোকা বজ্জাত চরিত্রের লোক। তাই আমার প্রশ্নের উত্তরে সে কী বলবে না বলবে, প্রিন্সিপ্যাল তাকে কী অবস্থায় ফেলবেন, সে-ই বা কী জবাব দেবে, তার কোনো সমাধান তার মাথায় আসছিল না। বলল, বলবা এ ব্যাপারে আমার কোনো কসুর নাই। আমি নিদ্দোষ। এর জবাবে আমার অনেক কিছু জিজ্ঞাসার এবং বলার ছিল। কিন্তু হাতে যথেষ্ট সমস্য না থাকায় বললাম, আচ্ছা চলুন আগে দেখি উনি কী বলেন।

প্রিন্সিপ্যাল সাহেবের ঘরে তখন তিনি একাই ছিলেন। আমি গিয়ে তাঁকে প্রণাম করে দাঁড়াতে তিনি ইশারায় আমাকে সামনের চেয়ারে বসতে বললেন। লোকটি তাঁকে আদাব জানালেও তিনি প্রত্যুত্তর করলেন না। বুঝলাম ভদ্রলোক ভীষণ চটে আছেন। লোকটি দাঁড়িয়েই রইল। প্রিন্সিপ্যাল টেবিলের ওপর ঝুঁকে কী একটা ফাইল দেখছিলেন। আমি আমার তৎকালীন লব্ধ ইংরেজিতে যা বলতে প্রয়াস পেলাম, তা এরকম স্যার, আমি আপনার প্রতি যারপরনাই কৃতজ্ঞ। বস্তুত এটা আমারই দুর্ভাগ্য যে, এরকম একটা অনভিপ্রেত ত্রুটি ঘটে গেছে। এ জন্য এই লোকটিকে দায়ী করে লাভ নেই। ভদ্রলোক হাত তুলে আমাকে থামিয়ে জানতে চাইলেন যে, আমি সত্যিই এই ভুলটাকে অনভিপ্রেত বা আকস্মিক বলে মনে করি কি না। তাঁর বিশ্বাস ঘটনাটি একবারেই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। যা হোক, সে আমি যাই মনে করি না কেন, তিনি লোকটির বিরুদ্ধে আমাকে একটি কমপ্লেইন লেটার জমা দিতে আদেশ করলেন। আরও বললেন, Thereafter, I will show him what begets what. লোকটির ইংরেজি জ্ঞান বোধহয় আদৌ পাকা ছিল না, নইলে সে এতক্ষণে তার ‘ছারের’ পায়ে লুটিয়ে পড়ত। লোকটির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আর তুমি? তোমার কৈফিয়ত কী? No, I will not listen to any argument from you. Be off from my eye-sight, go to your own place. I hate talking to you. লোকটি কাঁপতে কাঁপতে চলে গেল। যাবার আগে আমার দিকে কাতরভাবে একবার তাকিয়ে যেন তার ইতিপূর্বের আবদারের কথাটা স্মরণ করিয়ে গেল। স্যার আবার আমাকে complain letter-টা দিতে বললে আমি বললাম, স্যার, আমি জানি, এ ব্যাপারে কমপ্লেইন লেটার দিলে এর কী হাল হবে। কিন্তু তাতে আমার কী লাভ হবে বলুন? আমি কি আমার নষ্ট দিনগুলো ফেরত পাব, না আমার ক্ষতির কিছু সুরাহা হবে? আমার অবাধ্যতা মাফ করুন, খুব আন্তরিকভাবেই বলছি, এর বিরুদ্ধে আমার কোনো নালিশ নাই। আপনি রাগ করবেন না। এর কৃতকর্মের জন্য কোনো শাস্তি হলে এর পরিবার কষ্ট পাবে, ক্ষতিগ্রস্ত হবে। স্যার খানিকক্ষণ আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে বললেন যে, তিনি বুঝতে পারছেন ওই হতচ্ছাড়া আমার নম্র স্বভাবের জন্য পার পেয়ে যাচ্ছে। এই সুযোগ তাকে দেয়াটা ঠিক হলো না। এই ধরনের মানুষেরা দয়া বা ক্ষমার অযোগ্য। তিনি এও বললেন, দেখো, তোমার এই আবেগপ্রবণতার জন্য শঙ্কা হয় যে, তোমাকে জীবনভর দুর্ভোগ পোহাতে না হয়। It seems to be your basic nature. আমি আবার তাঁকে বললাম, I believe you will kindly forgive him and no harm will be done to him on my accounts. স্যার একটু হেসে বললেন, I appreciate your outlook and will remember your request, but I have to look after the administration of the college as well, you know. ভদ্রলোক আমাকে অনেক আশীর্বাদ করলেন। দুঃখও করলেন অনেক যে, আমার একটা বছর নষ্ট হয়ে গেল, এই বলে। টেস্টের ফলাফলটা জানতে পারিনি, যদিও জানার আর কোনো প্রয়োজনও ছিল না। তবু কৌতূহলটা তো ছিলই। স্যারকে জিজ্ঞেস করতে, তিনি খুব বিষণ্নভাবে বললেন, That is the main reason, my dear boy, that’s why I can’t think of pardoning the clerk. You had stood first in your section, securing marvellous marks, specially in Bengali and English. But what is in that, it only brings more frustration for a victim like you. O. K. good bye and good luck for the days ahead. আমি অত্যন্ত বিষণ্ন মনে তাঁকে প্রণাম করে চলে এলাম, কিন্তু তাঁর মতো একজন মানুষের সংস্পর্শে আসতে পারার জন্য একটা গভীর আনন্দও অনুভব করছিলাম তখন।

ফেরার পথে অফিসে গিয়ে ক্লার্কটিকে জানালাম যে, তার বেশি দুশ্চিন্তা করার প্রয়োজন নেই। আমি স্যারকে যথাসাধ্য তার হয়ে বলেছি এবং তিনি কী বলেছেন সব তাকে জানানোয় সে খুব উৎসাহ সহকারে চাও খাও, নাস্তা করো, বলে আমাকে আপ্যায়নের জন্য পীড়াপীড়ি করতে শুরু করল। লোকটার স্থূলতা তাতে এত বেশি প্রকট হয়ে পড়ল যে, আমি ধৈর্য রাখতে পারলাম না। বললাম, আপনার মতো একটা জঘন্য ইতরের চা-নাস্তা আমার গলা দিয়ে নামবে না। আপনার কপাল ভালো যে কমপ্লেইনের দরখাস্তটা আমি দিইনি। তবে মনে রাখবেন, তৎসত্ত্বেও কিছু হ্যাপা আপনার পোহাতে হবে। স্যার মানুষ কিন্তু খুবই খাঁটি এবং সেটা আপনার মতো জালিমদের জন্য আদৌ সুসংবাদ নয়। এখন থেকে সাবধানে থাকবেন। অকারণে কারও ক্ষতি করবেন না। চলি, খোদা হাফেজ।

রাস্তায় নেমে প্রথম যে কথাটা বুকের মধ্যে ব্যথার কুণ্ডলীর মতো পাক খাচ্ছিল, তা হলো এই কলেজে আমি আর কোনওদিনই হয়ত ঢুকতে পারব না। মাত্র আট-ন মাস আগে যেদিন প্রথম এখানে এসেছিলাম, সেদিন মনে যে অসামান্য উত্তেজনা অনুভব করেছিলাম, আজকের মনের অবস্থা তার সম্পূর্ণ বিপরীত। কলেজের গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে খানিকক্ষণ সেই ঘন লাল রঙের বিশালাকার বাড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে নিজেকে বড় ভাগ্যাহত বলে মনে হচ্ছিল। তখন আমার সহপাঠী-সহপাঠিনীরা পরীক্ষায় ব্যস্ত, আর আমি স্কলারশিপের একশ কুড়ি টাকার নোটগুলো পকেটে নিয়ে রাস্তায়, যে টাকাটা সময়মতো পেলে আমিও এখন তাদের সঙ্গে পরীক্ষা দিতে পারতাম।

কোথায় যাব, কী করব, আজই বাড়ি ফিরব কি না, আজ চলে গেলে কবে আবার আমার এই স্বপ্নের শহরে ফিরে আসতে পারব, এইসব চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। তখন দুপুর পেরিয়ে বেলা বিকেলের দিকে গড়িয়ে পড়েছে। অসম্ভব খিদে পেয়েছিল। একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকে পেটপুরে নানা সুভোজ্য খেলাম। এই শহরে এতদিন আছি, কিন্তু এরকম ভালো করে একদিনও এই ধরনের রেস্তোরাঁয় খাইনি। এটাই আমার প্রথম এবং শেষ ইচ্ছেমতো খাওয়া এ ধরনের নামি রেস্তোরাঁয়। দাম হলো পুরো দুটাকা। তখনকার দিনে আমার প্রায় পাঁচ দিনের খরচ। কিন্তু আজ আমাকে আরও খরচ করতে হবে। গত এক বছরে মায়ের হাতে তৈরি মার্কিন কাপড়ের জামা এবং পাজামার অবস্থা রিফুকর্মের আধিক্যে বড়ই করুণ। পূজার সময় এখানকার দাদা আমাকে একটি পপলিনের হাফশার্ট দিয়েছিলেন, সেটিই একমাত্র ভদ্রস্থ পোশাক। একটা কাপড়-জামার দোকানে ঢুকে মায়ের জন্য একখানা লাল-পেড়ে মিলের কোরা শাড়ি, আমার জন্য একটা পাজামা এবং শার্ট আর যে বোনটি স্কুলে যায়, তার জন্য একটা ফ্রক কিনলাম। বাবার জন্য এক জোড়া ক্যাম্বিসের জুতোও কিনলাম। সর্বসমেত খরচ হলো পনেরো টাকা। এখানে-সেখানে যেতে, জামাকাপড়, বইপত্র নেয়ার জন্য একটা ঝোলার প্রয়োজন ছিল খুবই, তাই একটা ঝোলাও কিনে নিলাম।

সব মালপত্র ঝোলাটায় পুরে দাদার বাসার দিকে চললাম। যখন এসেছি, একবার দেখা না করে যাওয়া উচিত হবে না। তা ছাড়া যখন এখান থেকে চলে গিয়েছিলাম, তখন বউদি বাড়ি ছিল না। ছেলেগুলোর সঙ্গেও দেখা করে যাইনি। যা-ই ঘটুক এবং ছেলেরা যেমনই হোক, তাদের আমি ভালোই বাসতাম। সবচেয়ে বড় কথা, আমার অত্যন্ত দুর্দিনে দাদা আমাকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। আর কোনো দিন এঁদের সঙ্গে দেখা হবে কি না কে জানে? সুতরাং দেখা করে যাওয়াই সংগত মনে হলো।

দাদা তখনও দুপুরের খাওয়া-বিশ্রাম সেরে অফিসে যাননি। বউদিও বাসায় ছিলেন। ছেলেরা আমাকে পেয়ে খুব আনন্দ করতে লাগল। আমারও বেশ ভালোই লাগছিল। মামুলি কথাবার্তা শেষ হলে দাদা জিজ্ঞেস করলেন আমি সেদিন ওখানে রাত্রিবাস করব কি না। যদিও সেদিন ফেরা সম্ভব ছিল না এবং কোথায় রাত কাটাব তারও কিছু ঠিক ছিল না, তবু ওই বাসায় থাকার কথা ভাবতে পারছিলাম না। কারণ অন্য কিছু নয়, যে ঘটনা ঘটে গিয়েছিল তার বিষয়ে কোনো বার্তালাপ পাছে উঠে পড়ে এবং এঁরা বিব্রত হন, এ জন্যই দাদাকে জানালাম যে, রাতে থাকা হবে না, কারণ আমার এক আত্মীয়ের বাসায় নেমন্তন্ন আছে। আমার বড়দার শ্বশুরবাড়ি ওই শহরেই, দাদা তা জানতেন। দাদা কিছু ভালোমন্দ বললেন না। বউদি বললেন, ব্যাপারটা তিনি বুঝেছেন। তা বুঝুন, আমার কিছু করার ছিল না। এখানে রাতে থাকতে হলে আমার শয্যাকণ্টকি হবে। সহজভাবে আগের মতো থাকতে পারব না।

বেরোবার মুখে দাদা বললেন, তর লগে একটু কথা আছে। চল যাইতে যাইতে কই। পরে আইয়া তর বউদির লগে কথা কইস। তাঁর সঙ্গে রাস্তায় এলে তিনি আমার কাঁধের ওপর একখানা হাত রেখে বললেন, আমি জানি তুই আমার ওপর রাগ করছস। কিন্তু তর নিজের দাদায় শাসন করলেও কি তুই রাগ করতিস? আমার আপছোস তরে আমি সেদিন ভুল কইরা মারছি। মানুষটি, আবার বলছি, খুব খারাপ ছিলেন না। সহজসরল। মনে কোনো ঘোরপ্যাচ ছিল না। শুধু রেগে গেলেই যা বিভ্রাট ঘটত। বললাম, আপনার শাসনের জন্য আমার কোনো রাগে নেই। আপনাকে আমি নিজের দাদা বলেই মনে করি। আমারও সেদিন আপনাকে কিছু না জানিয়ে চলে যাওয়া উচিত হয়নি। কিন্তু কলেজের ব্যাপারে সেদিন আমার মনমেজাজ ভালো ছিল না। যা হোক, এসব কথা আপনি ভুলে যান। দাদা ‘আবার আসিস’ বলে চলে গেলেন। আমিও একটা অনাবশ্যক অস্বস্তির হাত থেকে বাঁচলাম।

কিন্তু আমার সেদিনের কথাগুলো সব সত্যি ছিল না। আমার দাদাদের অতি ছোটবেলায় দেখেছি। তাঁদের সাহচর্য কীরকম, আমার অভিজ্ঞতায় তা ছিল না। দীর্ঘকাল তাঁদের সঙ্গছাড়া থাকায় তাঁদের একটা কল্পিত আদর্শমূর্তিই মনের মধ্যে গড়ে নিয়েছিলাম। তখন তাঁরা অন্য দেশে, অন্য ক্লেশে ভেসে বেড়াচ্ছেন। তাঁদের সম্পর্কে আমার তখন এক বিরাট ধারণা, যা কাউকেই বলা যায় না। তাঁদের স্থানে অন্য কাউকেই বসাবার কথা ভাবতে পারতাম না। তথাপি এই দাদার কথাগুলো যে খুবই আন্তরিক ছিল, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। বোধহয় কোনো একটা ব্যাপারে তাঁর কিছু ভুল ধারণা জন্মেছিল। সেটা বউদি সংক্রান্ত বলেই আমার মনে হয়েছে। আগেই বলেছি বউদির অনেক স্তাবক ছিল। দাদার বোধহয় ধারণা হয়েছিল যে বউদির এইসব ব্যাপারের মাধ্যম হিসেবে আমার কিছু ভূমিকা আছে।

যা হোক দাদা চলে গেলে বউদির কাছে আর ফিরে গেলাম না। আবার এই সমস্ত কথার উত্থাপন হোক, তা আমার প্রীতিকর বোধ হলো না। এই শহরে আবার আসব কি না জানা নেই। সবার সঙ্গেই দেখাসাক্ষাৎ করার ইচ্ছে থাকলেও অত সময় নেই। সন্ধে ঘনিয়ে এসেছে। ক্লাসের বন্ধুরা নিশ্চয়ই এতক্ষণে পরীক্ষার পড়া নিয়ে বসেছে। সুতরাং তাদের কাছে যাওয়া চলে না। হঠাৎ অহীনের কথা মনে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে তার সেই সময়কার বিপদের কথা, অসহায় অবস্থার কথা, আমার দুর্দিনে তার প্রাণপাত সহায়তার কথাও মনের মধ্যে এসে ভিড় করে দাঁড়াল। কী অসম্ভব স্বার্থপর মানুষই না আমি। এই শহরে সারাদিন কাটিয়ে শুধু নিজের সমস্যা নিয়েই ব্যস্ত থাকলাম। আমার সবচেয়ে বড় বন্ধুর কথাই মনে পড়ল না। নিজের ওপর বড় ঘৃণা বোধ হলো। অহীন যে বাসায় থাকত সেখানে পায়ে পায়ে চলে গেলাম। বাড়ির কর্ত্রী ভদ্রমহিলাকে আমি চিনতাম। তিনি জানালেন যে, অহীন আর ওখানে থাকে না। আমি চলে আসার কয়েক দিন পরেই সে কোথায় চলে গেছে। খবরটা শুনে আমার ভীষণ দুশ্চিন্তা হল। তার যে বিপদ দেখে গিয়েছিলাম, তাতে কত কী-ই না ঘটতে পারে। কিন্তু সে কথা কাকে জিজ্ঞেস করব? কালীদার কথা মনে হলো। একমাত্র সে-ই এ বিষয়ে কিছু বলতে পারবে। কিন্তু সে কি শহরে এখনও আছে? তারই-বা কী খবর? এইসব ভাবতে ভাবতে বড়দার শ্বশুরের বাসায় গেলাম। কালীদা শহরে এলে এখানেই থাকে। সে শহরে ছিল, কিন্তু বাসায় ছিল না তখন। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না, কালীদা এসে গেল। আমাকে দেখে খুব খুশি হয়ে বলল, কী ব্যাপার, তুমি সেই যে গেলে আর খবর নেই? বললাম, সেসব কথা পরে হবে। অহীন কোথায় আগে বলো। কালীদা বলল, অহীনের কথা পরে বলছি। আগে বলো উঠেছ কোথায়? তোমার ঠ্যাঙাড়ে-দাদার বাসায় নাকি? চলো বাইরে গিয়ে কথা বলি। অনেক কথা আছে।

বড়দার শ্বশুরের বাসা যে গলিটিতে, তার নাম ঝাউতলা দ্বিতীয় গলি। গলিটি গিয়ে শেষ হয়েছে একটি ছোট ব্রিজের গায়ে। ব্রিজটি একটি অতি প্রাচীন খালের ওপর এবং সেটি গিয়ে সরাসরি পড়েছে কীর্তনখোলায়। আমরা ওই বাসা থেকে বেরিয়ে ব্রিজটির ওপরে দাঁড়ালাম। কালীদা বলল, মাধুরীর গর্ভপাত করানো সম্ভব হয়নি। ডাক্তাররা সাহস করেনি। ব্যাপারটা তো বেআইনি। জানাজানি হয়ে গেলে সবারই বিপদ। অহীনের চাকরির অবস্থা তো জানোই। খুবই সামান্য মাইনে। একদিন এসে বলল, কালীদা, একটা উপায় ঠাউরেছি। চাকরি ছেড়ে দিয়ে সবাইকে নিয়ে আমি কলকাতায় চলে যাব। এখানে আর নয়। মাধুরীকে দেখলে আর দুদিন পর সবাই ব্যাপারটা বুঝতে পারবে। তখন কী অবস্থা দাঁড়াবে বুঝতেই পারছ। আমি বললাম, সেখানেও কি এ নিয়ে সমস্যা হবে না? ও বলল, না, ওখানে যাদবপুরে আমার এক মামা আছেন। তাঁকে সব লিখেছিলাম। মামার অবস্থা সচ্ছল নয়, তবে তিনি একটা পরামর্শ দিয়েছেন, ভেবে দেখলাম সেটা করাই ঠিক হবে। আমরা প্রথমে গিয়ে সেখানেই উঠব। মামিমা নেই, মারা গেছেন। একটি ছেলে, আমারই বয়সি। কীসের যেন ব্যাবসা-ট্যাবসা করে। সে-ও আমাকে ওখানে যেতে লিখেছে। চোরাপথে বর্ডার পার হয়ে মাধুরীকে বিধবা সাজিয়ে নিয়ে যাব। মামাই এরকম পরামর্শ দিয়েছেন।

কালীদা যেন এক ঘোরের মধ্যে কথাগুলো বলে যাচ্ছিল, আমিও সেইরকমভাবেই শুনে যাচ্ছিলাম। কালীদা আবার বলতে লাগল, মামা লিখেছিলেন, অনেক মেয়ে তো পেটে বাচ্চা নিয়ে বিধবা হয়ই। ওরটাও আমরা সেরকমই ধরে নেব। পরের ব্যাপার পরে। অহীনেরা তার কয়েক দিন পরেই চলে গেল রে। বলতে বলতে কালীদার গলাটা ধরে আসছিল। আমিও নিজেকে সংযত রাখতে পারছিলাম না। কার অন্যায়ের বোঝা কে বয়! কোথায় বরিশালের কাশীপুর গ্রাম, আর কোথায় পশ্চিমবঙ্গের যাদবপুর। অহীন হয়তো মামা এবং মামাতো ভাইয়ের সহায়তায় একদিন দাঁড়িয়ে যাবে। কিন্তু মাধুরীর কী হবে? অবিবাহিতা মেয়ে, একটা অসভ্য বয়স্ক লোকের জন্য সারা জীবন বিধবা থাকবে? তার সন্তান যদি বেঁচে থাকে, কী পিতৃপরিচয় নিয়ে বাঁচবে সে? যখনকার কথা, তখন এইসব সমস্যার কোনো সহজ সমাধান ছিল না। তবু বলব, মিথ্যাচারের পরামর্শ দিলেও মামা তবু একটা পথ বাতলে দিতে পেরেছিলেন। এইসব কথা কালীদাকে বলতে, সে বলল, এ কথার আরও একটুখানি বাকি আছে। ব্যাপারটা তুই কীভাবে নিবি, এ জন্যই বলিনি। কিন্তু না বলেও উপায় নেই। ওখানে গিয়ে মাধুরীর অ্যাবরশন করানো সম্ভব হয়েছে। ওকে আর বিধবা সেজে থাকতে হবে না। অহীনের চিঠি পেয়েছি গত সপ্তাহেই। লিখেছে, এটা একটা পাপ করলাম কালীদা। কিন্তু তোমরা তো সবই জানো, আর কী উপায় ছিল? মামা বলেছেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মাধুরীর বিয়ে দিয়ে দেবেন। অহীন এখন ওর মামাতো ভাইয়ের সঙ্গে ব্যবসা করছে। সবাই একসঙ্গেই থাকে। ভালোই আছে মনে হয়।

পাপের কথাটা আমার মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল। কিন্তু অন্য কোনো সমাধানের কথাও মনে আসছিল না। যা হোক, মনে মনে প্রার্থনা করলাম, ওরা ভালো থাকুক, শান্তিতে থাকুক। তখনকার দিনে ভ্রূণহত্যা হতো না এমন নয়, কিন্তু সাধারণ্যে তা মহাপাপ বলেই গণ্য হতো। আইনগত দিক দিয়েও তা গ্রাহ্য হতো না। একটা গ্লানি তাই মনের মধ্যে কাঁটার মতো খচখচ করছিল। দুজনে আরও বেশ খানিকক্ষণ ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে রইলাম। একসময় কালীদা জিজ্ঞেস করল, এখন বলো রাতটা কোথায় কাটাবে? আমি বলি আজ ঝাউতলাতেই থাকো। তোমার তো কুটুম ওঁরা, অসুবিধে কী? বললাম, অসুবিধে এমন কিছু নেই, তবে আমার যা অবস্থা, কুটুমবাড়ি সংকোচ লাগে। কালীদা পিঠের ওপর একটা থাবড়া মেরে বলল, ঘোড়ার ডিম লাগে। তোমার আমার মতো অবস্থার মানুষদের আবার সংকোচ কীসের? চলো চলো, তোমার কাহিনি তো শোনা হয়নি এখনও। সেই যে ঠ্যাঙানি খেয়ে গেলে, তারপর কতটা কী উন্নতি করেছ, তা শুনতে হবে না? আজ সারা রাত দুজনে গল্প করব, চলো।

অগত্যা তার সঙ্গে গেলাম। বড়দার শাশুড়ি আমাকে খুবই স্নেহ করতেন। প্রায়ই ডেকে পাঠাতেন যখন কলেজে ছিলাম। কিন্তু সেখানে নিয়মিত থাকা-খাওয়ার অসুবিধে ছিল। প্রথমত, তাঁদের আর্থিক স্থিতি আদৌ ভালো ছিল না। কালীদা এবং তার ছোট ভাই ওখানেই থাকত, পেয়িং গেস্ট হিসেবে। ফলে স্থানের অসংকুলানও ছিল। যা হোক সেদিন সে বাসায়ই থাকলাম। সারা রাতই প্রায় কালীদার সঙ্গে নানা সমস্যা নিয়ে আলোচনা করে কাটল। আমার সব কথা শুনে কালীদা বলল, শোনো আমারও মনে হচ্ছে তোমার প্রিন্সিপ্যাল ঠিক পরামর্শই দিয়েছেন। একটা বছর নষ্ট হয়েছে বলে অমন মুষড়ে পড়লে চলবে না। তুমি বরং তোমার দাদাদের কাছে কলকাতায়ই চলে যাও। এ দেশে আমাদের সত্যিই কিছু হবে না।

কালীদার পরামর্শ বাস্তবানুগ হলেও আমি ভাবছিলাম বাড়ির জনেদের কথা। আমি যদি ও দেশে চলে যাই, তবে কি তা একটা নিতান্ত স্বার্থপরের মতো কাজ হবে না? ছোট ভাইবোনগুলোর কী দশা হবে? ওদের কে দেখবে? দেশের গাঁয়ের যা অবস্থা, তাতে ওরা তো ভেসে যাবে। আবার সবাইকে নিয়ে যে ও দেশে যাব, সেখানে দাদারা চালাবে কী করে? কিন্তু এতসব কথা কালীদাকে বলা যায় না। এইসব আলোচনা এবং চিন্তায় রাতটা কাটল। কোনো নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে আসতে পারলাম না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *