সাত
এইসব কথাই একান্নর দাঙ্গা এবং তার পরবর্তী দশকের কথা। সব স্মৃতি স্মরণে আনতে পারি না। তথাপি যেমন মনে আছে বলে যাই। দাঙ্গার ধকল তখনও চলছে। মাধবপাশার ‘মুদি’ জমিদারদের বাড়িতে যারা আশ্রয় নিয়েছিল, গুণ্ডারা বাড়ি অবরোধ করে এক বীভৎস গণহত্যার অনুষ্ঠান করে তাদের প্রত্যেককে কোতল করেছে। মানপাশা, মুলাদি ইত্যাদি গ্রামে ব্যাপক গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে। রাষ্ট্রনেতারা কেউ-বা বন্ধ করতে পারেননি। লোকমুখে এইসব ঘটনা আরও অতিরঞ্জিত হয়ে পিছারার খালের জগতে পৌঁছেছে এবং তার দুপারের হিন্দুগ্রামগুলোতে আখেরি ভাঙন শুরু হয়েছে। চন্দ্রদ্বীপ রাজবংশধরেরা হতবীর্য, হৃতসম্পদ। হতবীর্য এবং উদাসীন তাদের অধীনস্থ জমিদারকুলের তখনকার বংশধরেরা, যাঁরা তখনও মধ্যস্বত্বের মোহে সাতপুরুষের ভিটে আঁকড়ে বসে। বস্তুত, এঁদের কোনো যাবার জায়গাও ছিল না। বড়দরের ভূস্বামীরা সময়মতোই সুবিধেজনক আশ্রয়ে পাড়ি দিয়েছিলেন। কারণ দেশভাগ এবং দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে ঘৃণা ও হিংসার বাতাবরণ সৃষ্টির এঁরাই ছিলেন মূল হোতা, তাই তাঁদের হিসেব বড় পাকা ছিল।
কিন্তু তখনও আমার পিছারার খালের উজানি সোঁতায় জোয়ার-ভাটা খেলছে, দক্ষিণের সুন্দরবন অঞ্চলে আমাদের যে ‘মহাল’, যেখান থেকে ধান, মান, কলা, কচু, কুমড়া আর গুড়ের নাগরীগুলো যে ঘাসি নৌকাগুলোর গর্ভ থেকে সোজা গোলাঘরে পৌঁছত, তার প্রবাহ বন্ধ হয়নি। তখনও যথানিয়মে শ্রাবণ সংক্রান্তির ভরাগুলো পাঁঠা-বোঝাই করে সেই সুদূর দক্ষিণ থেকে বর্ষার থইথই নদীপথ ধরে আসত। মনসাপূজার বলির পাঁঠা। মনসাপূজা প্রায় বাড়িতেই হতো এবং বলিও হতো। আবার এই ভরার আগমন অব্যাহত থাকত আশ্বিনের দুর্গাপূজার প্রাক্কাল পর্যন্ত। আমাদের বাড়িতে মনসাপূজা থেকে শুরু করে কালীপূজা পর্যন্ত যত পাঁঠার প্রয়োজন, সব এই মনসাপূজার সপ্তাহখানেক আগেই শ্রাবণ সংক্রান্তির ভরায় এসে যেত। এই ভরা বা ঘাসি খানাবাড়ির পিছারার ঘাটেই লাগত।
ভরার চরণদার এবং এইসব পাঁঠাদের সংগ্রাহক ছনু মিরধা পিছারার খালের ঘাটে নেমে সরাসরি আমাদের পাকের ঘরের ছাইচে দাঁড়িয়ে আমার মাকে জানান দিত, তার কয়জন খাওনদার। মা তদনুরূপ ব্যবস্থা নিতেন। সেই পাঁঠাগুলো ভরামুক্ত হলে, যথানিয়মে যুধিষ্ঠির বিশ্বাস ওরফে পাঁঠা বিশ্বাস, তাদের নিয়ে পাঁঠা সেরেস্তায় দাখিল হতো। সেখানে খানাবাড়ির ভুঁইমালী কাত্তিক, ‘কাউয়া পাতা, কাডাল পাতা’ ইত্যাদি পাঠাদের আহারের নিমিত্ত জোগাড় করে রাখত। ছনু মিরধার তখন ছুটি অর্থাৎ আরামের সময়। সে শুধু ‘ধবধবইয়া ফসসা, কিন্তু কেচরিকাডা একখান লোঙ্গি আর এউক্কা ফুডা ফুডা গেঞ্জি পরইয়া বেয়াক কাম তত্ত্বতালাশে ব্যস্ত।’ বলা বাহুল্য, এই বস্ত্র দুটিই তার এ বছরের পূজা উপলক্ষ্যে প্রাপ্য। পাঁঠা বিশ্বাসের জন্য একজোড়া গামছা ও লুঙ্গি এবং পাতার জোগানদার কাত্তিকার একজোড়া মাডা এবং একজোড়া গামছা। পাড়া বিশ্বাস এবং ছনু মিরধার লুঙ্গি মাডা হলে চলবে না। সে কারণ, হয় ফাকডা ফুকড়ি, নয় কেচরিকাডা লুঙ্গি তাদের চাই। মাডা অর্থে মার্কিন থানের কাপড়ের খণ্ড, যা লুঙ্গির মতো করে পরা যায়। যুধিষ্ঠির এবং ছনুর পছন্দের ‘রোঙডা আসমানি বা নীল।’ কাত্তিকার কোনো পছন্দের ব্যাপার থাকতে পারবে না বলে ওই কোডা রঙের মাডা। এই প্রথা বহুকালাবধি চলে আসছে।
যখনকার কথা বলছি তখন দাঙ্গায় বা গণহত্যার তীব্র বিভীষিকা আমাদের কর্তাদের বিধ্বস্ত করলেও, অথবা আমাদের পিছারার খালের দুপাশের বক্সী, উকিল, গুপ্ত, বাড়ুজ্জে, চাটুজ্জে বা গাঙ্গুলিরা দেশত্যাগ করলেও আমাদের এলাকার প্রান্তবর্তী যুগি, নাপিত, কামার, কুমোর, নমশূদ্ররা তখনও যেন কী এক আশার ওপর নির্ভর করে নিশ্চিন্তই ছিল। মহালের প্রজারা আমাদের পরিবারের কর্তাদের সঙ্গে কখনোই এমন আচরণ করেনি, যাতে মনে হতে পারে যে তারা এইসব দাঙ্গা বা গণহত্যার ব্যাপারে কখনোই অংশগ্রহণ করে আমাদের মতো পরিবারগুলোকে কোতল করতে পারে। বস্তুত তাদের কাছে দাঙ্গা, দেশভাগ, মানুষের অস্থির অসহায়তায় আশ্রয় খোঁজা, এগুলোর কোনো সঠিক খবরও বোধহয় ছিল না। তারা সকলেই মধ্যস্বত্বীয় আশ্রয়ের এবং নিয়মের দাস। প্রত্যন্ত দক্ষিণ-পূর্ব সমতটের শিক্ষাদীক্ষা অথবা আধুনিকতার ন্যূনতম প্রসাদের অধিকারী নয় এরকম প্রায় আদিম প্রকৃতিসম্পন্ন মানুষ তারা। আমার এবং আমার মতো কিশোরদেরও বিস্ময় লাগত এদের সরল, আদিম এবং ভবিষ্য চিন্তাবিহীন জীবনযাপন দেখে। আমাদের কর্তারা বোধকরি এদের এই গতানুগতিক জীনবধারার পরম্পরা দেখে আশ্বস্ত ছিলেন যে, এভাবেও চলতে পারে এবং তারা এই কুগ্রহের প্রভাব কাটিয়ে, পুনরায় দোল-দুগ্গোচ্ছব, মোচ্ছব, পুণ্যাহ এবং ইত্যাকার যাবতীয় ইত্যাদি ইত্যাদি যথানিয়মে ভোগ করতে পারবেন। তারা দেশভাগ, জমিভাগের বিষয়টি বোধকরি সম্যক অনুধাবন করেননি। সে যা-ই হোক আমি আমার কাহিনিতেই প্রত্যাবর্তন করি। কাহিনি হয়তো তত্ত্বের স্বরূপ বাতলে দেবে।
এ-সব পোশাক-আশাক সজ্জিত পাঁঠা বিশ্বাস, ছনু মিরধা, কাত্তিকা ভূঁইমালী আমাদের ওই বিশাল চৌদ্দবিঘার আয়তনের খানাবাড়িতে যখন ঘুরে বেড়াত, তখন বর্ষা শেষ হয়ে, শরৎ নামত আমাদের ওই পৃথিবীতে। তখন উঠোনের জল, যা কিনা ভরা কোটালে গোটা এলাকায় দখলদারি জারি করেছিল, তা নামতে শুরু করলে মুথা ঘাস, মধুকূপী এবং দুর্বাদের শিকড় আর গোড়াগুলি বাদামি থাকা সত্ত্বেও ডগাগুলো সবুজাভ হতো। তখন শালুকফুলগুলো মাঠে, পুকুরে বা পগারে অসামান্য ঔজ্জ্বল্যে ঝকমক করে উঠত এবং গৃহস্থের বাগানে স্থলপদ্মের কুঁড়িগুলো ফুটে ওঠার আকাঙ্ক্ষায় আকুলি-বিকুলি শুরু করত। আমাদের নিত্য তিরিশ দিনের চাকর ফটিক, তার চাঁই, বুজনই হোচা ইত্যাদি মাছ মারার সামগ্রীগুলোকে আমাদের সামনের কুমোরবাড়ির বড় আমগাছটা থেকে ঝুলেপড়া শ্যামলতা দিয়ে নতুন করে বেঁধে সব পুকুরের জানগুলোয় আর উজানি সোঁতার বহুতাগুলোতে পেতে রেখে আসত, যার ভিতর নানা জাতের মাছেরা ঢুকে পড়ে আর বেরোনোর পথ পেত না। এইসব মানুষেরা তখনও আদৌ জানতেই পারেনি হয়তো যে, পৃথিবীতে ইতোমধ্যে প্রভূত রক্তপাত ঘটে গেছে এবং এখানে যে এখনও তা ঘটেনি তা নিতান্তই আকস্মিকতা।
তখনও আমরা কিশোরেরা যারা সেই পিছারার খালের বহতায় ছিলাম, তারা শারদী নিশির শেষের প্রহরে ওইসব মাছ, ভাদ্দর-আশ্বিনের তাল তথা নানাজাতীয় ফুল-ফল নিয়ে ঘরে ফিরতাম। সঙ্গে নিয়ে আসতাম আরও সব সামগ্রী। কাছিমের ডিম, পথের ধারে অসহায় ভ্রাম্যমাণ দুর, যা কাছিমেরই স্বগোত্রীয় এক প্রাণী, হোগলের গুঁড়ি এইসব। মা এইসব সামগ্রী দিয়ে আমাদের নানান সুভোজের ব্যবস্থা করতেন।
জীবন তেতো বোধ হতে শুরু করল আমার আশপাশের বিশেষ বিশেষ মানুষদের অকস্মাৎ অন্তর্ধানের সময় থেকে। তার বৃত্তান্ত আগেই বলেছি। বক্সীবাবু চলে গেলে বাকি হিন্দু ভদ্রলোক গেরস্তরা বুঝলেন যে, স্কুল আর চলবে না। তাদের ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা করারও আর কোনো উপায় থাকবে না। সেই সময়টি বড় কঠিন সময়। দাঙ্গা নিয়ে ভয় থাকলেও, ভদ্রলোক গৃহস্থেরা, স্থানীয় মুসলমানদের বিষয়ে বিশেষ চিন্তিত ছিলেন না। তারা বিশ্বাস করতেন যে, এরা এমন কোনো কিছু করবে না যাতে তাঁদের মান-ইজ্জতের ওপর কোনো কালিমা লিপ্ত হতে পারে। কিন্তু পরিস্থিতি ততটা সরল বোধহয় ছিল না। তাঁদের রাখাল, বাগাল, ভাতুয়াদের পর্যন্ত সমীহ করতে শুরু করেছিলেন, যদিও তারা কোনো অপকর্ম কোনোদিনই করেনি। কিন্তু বাড়ির আধপাগল, হাবা অথবা কম বুদ্ধিসম্পন্ন দাসীরা হঠাৎ করে কেন যে গর্ভিণী হতে শুরু করল, তার কার্যকারণ সকলকেই ভাবিত করল। তাঁরা এইসব ঘটনার মধ্যে ভবিষ্যতের পটে এক অনিবার্য অশনি-সংকেত যেন দেখতে পেলেন। এরপর কি তাঁদের কন্যা-বধূদের পালা? এরকম এক বিচার স্বাভাবিকক্রমে তাঁদের মাথায় ভর করল।
আমাদের বাড়িতে অনেক চাকর এবং দাসী ছিল। সেকালে বাড়ির কর্ত্রীরা সাধারণত দাসী-চাকর বহাল করতেন একটি নির্দিষ্ট হিসেবে। পারুল নামের দাসী যদি তার দুই ছেলে নিয়ে ‘কাঁচারাঁড়ি’ হয়, তবে নিঃসন্তান এবং বিপত্নীক বিপিনের তার সঙ্গে একত্রে ‘গোলাঘরের’ অন্দরে থাকায় কোনো ‘আফত্য’ ছিল না। তারা সেভাবেই থাকত। এ কারণে একটাই অঘোষিত চেতাবনি ছিল যে, এই ব্যবস্থায় পারুলের কখনোই অন্তস্থ হওন গ্রাহ্য হবে না। কেননা, তা হলে ‘পুইণ্যের সংসারে পাপ ঢোকবে’। ‘এই পুইণ্যের সংসারের কর্ত্রী ছিলেন আমাদের বুড়িপিসিমা, যাঁর সাত বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল এবং এগারো বছর বয়সে ‘রাঁড়ি’ হয়ে একান্ন সালের দাঙ্গার পর তাঁর ভ্রাতৃ নাতি-নাতনিদের নিয়ে দেশত্যাগ করেন। বুড়ি আমার বাবা-জ্যাঠার পিসিমা। আমরা তাঁর নাতি। কিন্তু আমরাও পিসিমা বলেই ডাকতাম। ডাকত দেশের সব মানুষ। এমনকি সরকারি সায়েব-সুবোরাও। কী ব্রিটিশ, কী পাকিস্তানি, অথবা কি ওদেশ কি এদেশ সবাই পিসিমা বলেই ডাকত তাঁকে এবং কারওই ক্ষমতা ছিল না তাঁকে এড়িয়ে যাওয়ার। কিন্তু সে কথা পরে আসবে, এখন তাঁর ‘পুইণ্যের’ সংসার বিষয়ে যা বলছিলাম, তা-ই বলি। এই সংসারটি কেন যে ‘পুইণ্যের’ সংসার, বড় হবার পর তা আর বোধগম্য হয়নি। ওই বয়সে অবশ্য সরল বিশ্বাসে একে এক অসামান্য পুণ্যের সংসার বলেই বিশ্বাস করেছি। কেননা, এ বাড়িতে দোল, দুগ্গোচ্ছব, দীয়তাং ভুজ্যতাং-এর যেমন ব্যবস্থা ছিল, তেমন ছিল কিছু কিংবদন্তির প্রচলন, যা ওই বুড়িপিসিমাই বোধকরি করেছিলেন। তাঁর দাদা অর্থাৎ আমার ঠাকুরদামশাই ছিলেন এই শাক্ত পরিবারে ব্যতিক্রমী পুরুষ। তিনি বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী মশাইয়ের মন্ত্রশিষ্য ছিলেন এবং তিনি যখন গোস্বামীজির কৃপা লাভ করেন তখন গোস্বামীমশাই ব্রাহ্মসমাজের আচার্যত্ব পরিহার করে সনাতন ‘অজপা’ মন্ত্রের একজন গুরু। ব্রাহ্মদের সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পর্ক নেই। তখন তিনি আর প্রবর্তক বিজয়কৃষ্ণ নন, তাঁর পরিচয় তখন জটিয়াবাবা, যিনি অদ্বৈতবংশীয় গোস্বামী, সনাতনপন্থি। ঠাকুরদামশাই এই গোঁসাইজির শিষ্য। তাঁর ধর্মপ্রবণতা তখন এতই উচ্চমার্গীয় যে, তিনি অন্দরমহল পরিত্যাগ করে বহির্বাটিতে একটি আশ্রমগৃহ নির্মাণ করে তাকে ফল, পুষ্প, কুটির এবং সুদৃশ্য তড়াগে সজ্জিত করে তথায় সাধন-ভজন করতেন। কিংবদন্তি ছিল এই যে, তিনি তখন মহাপুরুষ। তাঁর আশ্রমগৃহে কেউ যখন-তখন প্রবেশ করতে গেলে তিনি নাকি বলতেন, একটু দাঁড়াও, ওরা আছে, ওরা যাউক তারপর আইও। ওরা বলতে সাপ-খোপ জাতীয় প্রাণী, যারা তাঁর কোনো ক্ষতি করত না, শুধু তাঁর সৎসঙ্গ পাওয়ার জন্য আশ্রমে প্রবেশের রাস্তায় আড়াআড়ি নাকি অলম্বুষের মতো শুয়ে থাকত। তিনি হাততালি দিয়ে তাদের সরে যেতে নির্দেশ দিলে তারা সরে যেত এবং কুটিরে প্রবেশেচ্ছুরা তখন যেতে পারত। এ ছাড়া আরও অনেক কিংবদন্তিই ছিল। এইসব কারণে এই বাড়ি ‘পুইণ্যের সংসার’। শুধু ঠাকুমা নাকি বলতেন, ‘এঃ সাধু? অমন সাধু অনেক দেখছি। সাধু যদি অয় হ্যার এ্যাতো পোলাপান অয় কেমনে?’ ঠাকুমা নাকি ঠাকুরদাকে এমন বলতেন। এ কথা মায়ের কাছে শুনেছি। বুড়িপিসিমার বড় দেমাগ ছিল তাঁর বাপ-ভাইয়ের ‘পুইণ্যের সংসার’ বিষয়ে। কিন্তু সেখানেও বুড়ির এক অসামান্য কৌশল দেখে, এ সংসারের ‘পুইণ্যতা’ বিষয়ে খুব একটা বিশ্বাস তৈরি হয়নি। তিনি একদিকে ঝি-চাকরদের স্থায়ীকরণের জন্য তাদের যেমন কিছু ইদিক-উদিকের সুযোগ দিতেন, তেমনই এ কারণে কোনো আতান্তর ঘটলে ভয়ংকর কঠিন ব্যবস্থা নিতেন। তাঁর মানসিকতার এই বৈপরীত্যের কারণ বোধহয় তাঁর নিজস্ব আজীবন যৌন-কৃচ্ছ্রসাধনার বহিঃপ্রকাশ। নচেৎ তাঁর মতো একজন বিবেচক মহিলার আচরণ এরকম হওয়ার কোনো কারণই নেই। এ ক্ষেত্রে একটি বিশেষ ঘটনার উল্লেখ করা প্রয়োজন বোধকরি। ইতোপূর্বে যে পারুলির কথা বলেছি, সে কোনোদিনই অন্তস্থতাজনিত কোনো সমস্যা সৃজন করেনি। কিন্তু যে রাক্ষুসি সময়ের অনুলিপি এই আলেখ্য, তখন, এই সমস্যা ঘটতে শুরু করল বাড়ির হাবা, পাগলা-ঝিদের নিয়ে। এইসব মেয়েরা আমাদের পিছারার খালের প্রত্যন্ত অঞ্চলের অপবর্গীয় এবং অপবর্ণীয় সমাজের প্রতিবন্ধী মেয়ে। বুড়িপিসিমা এদেরকে বড় স্নেহে এবং মমতায়ই আমাদের বাড়ির ব্যাপক কর্মকাণ্ডে কোথাও-না-কোথাও লাগিয়ে দিতেন তারা বাসন মাজত, উঠোন ঝাঁট দিত, ঘরবাড়ি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার কাজে থাকত। দুবেলা, দুমুঠো অন্ন পেত এবং সামান্য বস্ত্র। তা-ই ছিল তখনকার রীতি। নগদ পয়সাকড়ির ব্যবস্থা এদের ক্ষেত্রে ছিল না, থাকা সম্ভবও ছিল না হয়তো। বাড়ির দাপটের সময় এইসব ঝি-চাকরানিদের কোনওরকম বেচাল কেউ দেখেনি। নীরদসি বাবুর অভিজ্ঞতায় যেসব কাহিনি আমরা জেনেছি, সেরকম স্বভাবের মানুষ, আমি অন্তত আমাদের পিছারার খালের জগতে দেখিনি। দাঙ্গা-পরবর্তীকালে আমাদের বাড়ির ‘পাগলি’ ঝি ধবলী হঠাৎ অন্তস্থা হয়ে ব্যাপক সমস্যার সৃষ্টি করলে আগে যেমন বলেছি, সব গৃহস্থেরা প্রমাদ গণে। ভাবে এরপর কার পালা? এবং ওই সময়ে কারও গৃহে যুবতী কন্যা থাকলে স্বাভাবিক কারণে যে বিভীষিকার উদ্ভব হয়, তখনকার সামাজিক প্রেক্ষায় তা উপেক্ষা করা চলে না।
আমি ধবলীর ব্যাপারটা অবশ্যই একদিন আমাদের ‘পিছারার’ পুকুরের ধারে একটি জঙ্গলে প্রত্যক্ষ করেছি। পাশের মুসলমান গ্রামের ‘ছালাম’ নামক একজন যুবক আমাদের পাগলি ধবলীকে যে ভোগ করছে, তা আমি দেখেছি। তারই কিছুকাল পরে ধবলী গর্ভিণী হয়। ধবলী পাগলি। কিন্তু, তা বলে পঞ্চশর তাকে বিদ্ধ করবে না এমন কোনো প্রাকৃতিক নির্দিষ্ট নির্বন্ধ নেই। নীরদসি মশাই, শুধু এসব ক্ষেত্রে, মধ্যবিত্ত তথা উচ্চবিত্তদের কামবিলাস বিষয়ে পাঁচকাহনে বলতে পারেন। কিন্তু আমার ওই ভূখণ্ডে দেশভাগ-পরবর্তী প্রতিটি প্লবতারকালে অপবর্গী/বর্ণীয়রা কী আচরণ করছে তার আলেখ্য বর্ণনা করেননি। পাপ কোন স্তর অবধি পৌঁছেছিল, তিনি সম্ভবত তা দেখেননি। তিনি শুধু কাব্যের মধ্যে সমাজচিত্র দেখে বাঙালির কাম ও প্রেমের তুল্যমূল্যে মনোযোগী হয়েছেন, সর্বসাধারণ বাঙালির সুযোগের সদ্ব্যবহার দেখেননি। দেখার কথাও নয়, কারণ তিনি কিশোরগঞ্জ ছেড়েছিলেন নাকি দ্বাদশ বর্ষ বয়ঃক্রমকালে। দেশভাগ এবং দাঙ্গার প্রাক্কালে আমি দেখেছি বাঙালির কামশৌর্য কতই না ব্যাপক। ছালামও অপবর্গী/বর্ণী সমাজেরই লোক। কিন্তু তাতে কি একটা জনগোষ্ঠীর চারিত্রিক বিচার চূড়ান্তভাবে করা যায়? আমার মনে হয়, এক ব্যক্তি যদি শতজীবী কেন, সহস্ৰজীবীও হন, এমতো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত তাঁর পক্ষে করা যৌক্তিকভাবে সংগত হয় না।
এ ধরনের ঘটনা ক্রমশ ঘটতে থাকলে আমার পিছারার খালধারের মানুষেরা অনির্দেশ যাত্রায় ক্রমশ আরও সচল হতে থাকে। অতঃপর যাদের আর কোনো উপায়ই নেই, তারাই শুধু সেখানে মাটি কামড়ে পড়ে থাকে।
এই সময়কার নানাবিধ কর্মকাণ্ড আমার ওই পিতামহী পিসিমার ক্ষমতার মূলাধারে নাড়া দেয়। প্রথমটি ধবলীর অন্তঃসত্ত্বা হওন। এতাবৎকালে অনেক যুবতী ঝি এ বাড়িতে কর্মরতা ছিল। কেউ কোনোদিন তাদের এই অবস্থা প্রত্যক্ষ করেনি। কিন্তু আজ ধবলী অন্তঃসত্ত্বা এবং সে পাগল। পাগল না হয়ে অন্য কেউ হলে তাকে দূর করে দেয়া সে যুগে কিছু কষ্টকর ছিল না। কিন্তু একজন পাগলিকে কি দূর করে দেয়া যায়? বিশেষত ওইরকম এক আসন্ন প্রসবকালে? কিন্তু এই ঘটনার অভিঘাতে বাড়িসুদ্ধ সবাই রীতিমতো স্তম্ভিত। পিসিমা বললেন, ‘অর কোনো দোষ নাই, তমো, বাড়ির ইজ্জতটারে তো রাহন চাই।’ বস্তুত, বুড়িপিসিমা কোনো যৌন-বিশৃঙ্খলাই সহ্য করতেন না। তাঁর ধারণা ছিল এই বাড়িতে এমতো ‘পাপ’ কখনোই ঘটবে না। কিন্তু তার ঘেরাটোপ এবং শাসনশৃঙ্খলা ভেদ করে যে তাঁর নাতনিদেরই কেউ কেউ প্রতিবেশী কোনো যুবকের সঙ্গে প্রেম-প্রেম খেলা করত, তা বোধহয় তাঁর নজরে ছিল না। পরে দেখেছি এরও অধিক পাপের কারণ এ বাড়িতে ঘটেছে এবং তা পিসিমার ‘পুইণ্যের’ সংসারের কোনো ক্ষতি করতে পারেনি। বোধহয় সেসব ঘটনার খবর পিসিমা জানতেই পারেননি। সে যা হোক ধবলীর বিষয়ে পিসিমা বড়ই কঠোর হলেন। আমার জ্যাঠামশাই যদিও খুব একটা দয়ার শরীর মানুষ ছিলেন না, তথাপি তিনি বলেছিলেন, পিসিমা, তোমার আশ্রয়ে, বিড়ইল, কুকুর, হাঁস, পাড়া-ছাগলও তো আছে? আছে না?
: হঃ হেয়া থাকপে না ক্যান?
: হেগুলা বিয়ায় না?
: বিয়াইবে না ক্যান? জীবের জীবধম্ম, মা ষষ্ঠী হ্যারগো কিরপা করলে তো এসব হওনই উচিত। বিড়ইল মা ষষ্ঠীর বাওন, ঘরের পোষ্য। এ্যারা পায় পায় হাঁটবে, ল্যাঙ্গে ঠ্যাঙ্গে থাকপে, তয় তো গেরস্তের আহ্লাদ।
: তয় ধবলীরে খেদামু ক্যান?
: ও বড়নসু, তুই কও কী? ও যে মনুষ্য, মাইয়ামানুষ, রাঁড়ি?
: না, পিসিমা, তুমি যা যা কইলা, হয়তো ও হেয়ার বেয়াক কিছুই, তয় ও মনুষ্য না। ও এট্টা পশু। ওর কোনো বোধই নাই। অর ভালোমন্দ জ্ঞেয়ান নাই।
: কিন্তু মাইনষে কইবে কী?
: মাইনষে অনেক কিছুই কয়, কইবেও। কিন্তু অর এই অবস্থাও তো মাইনষেই করছে। নাকি কও? ছোটকর্তা বললেন, দাদায় যা কইছেন, ঠিকই কইছেন, পিসিমা। অরে এ অবস্থায় খেদান যায় না। হেডা ধম্ম না।
কিন্তু পিসিমা এ বিচারে সন্তুষ্ট হলেন না। বাবাকে বললেন, বড়নসুর স্বভাবটা শাক্ত স্বভাব কিন্তু তুই আমি তো একই গুরুর শিষ্য। আমরা তো গোঁসাইজির ধারায় আছি। তুইও এমন কথা কও? বাবা বললেন, পিসিমা, আমার মনে অয় সাধনপথে তুমি একটুও আগাও নায়। তোমার মন এহনও অহংকারে মত্ত।
: এ্যার মইদ্যে তুই অহংকার দেখলি?
: দেখলাম বলইয়াই কই—–তোমার উচিত এই অহংকার ত্যাগ করা। নাহংকারাৎ পররিপু। তোমার দাদায় এ কথা পাথরে লেহাইয়া তোমারে দিছেন। তুমি তোমার সিংহ-পালংকের আসনে সেই পাথর রাখছ। রোজ হেয়ার পূজাও করো। তমো কই, তোমার অহংকার আছে।
পরে বুঝেছি, বাবা বুড়ির আজীবন সংযমরক্ষার জন্য এক বিশেষ অহংকারের কথাই তাঁকে বলতে চেয়েছিলেন। বাবা একটি বিশেষ ঘটনার কথাও উল্লেখ করেছিলেন। বলেছিলেন, গোঁসাইজি কিন্তু নিজেও এই দাহ থিকা মুক্তি পায়েন নাই। আর হে কথা নিজের মুহেই তিনি ব্যক্ত করইয়া গ্যাছেন। তুমি তেনার হে বিভ্রাটের বিষয় জানো না?
: হেয়া ক্যামন, হেনায় তো মহাপুরুষ, জিতকাম। হেনার আবার এমতো বেভ্রাট কী?
এর উত্তরে বাবা তাঁকে বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর জীবনের একটি বিশেষ ঘটনার কথা বলেছিলেন। গোঁসাইজি নিজেই এই কথা তার প্রিয়শিষ্য এবং ডায়েরি-লেখক কুলদা ব্রহ্মচারীকে বলেছিলেন। তখন তিনি প্রবর্তক বিজয়কৃষ্ণ। ব্রাহ্মধর্ম প্রচারে আচার্যের কাজ করছেন। একদা এক উপাসনা-সভায় গোঁসাইজি ভাষণদানকালে একটি অষ্টমবর্ষীয়া বালিকাকে দেখেন। তাকে দেখে তিনি এতই মোহিত হন যে, ক্রমশ এই মোহ তাঁকে তীব্রভাবে কাতর করে ফেলে। এমনকি তিনি সভাশেষে নাকি বেশ কিছুটা পথ সেই বালিকাটির পিছু পিছু অনুসরণ করেছিলেন প্রায় তার বাড়ির কাছাকাছি পর্যন্ত গিয়ে। অকস্মাৎ আত্মবুদ্ধি ফিরে এলে তিনি নিজের এই আচরণকে ধিক্কার দিতে দিতে প্রত্যাগমন করেন। বাসায় ফিরে তিনি এই অর্থহীন ক্লেদ থেকে মুক্ত হবার জন্য একটি গান রচনা করেছিলেন। তার শুরুয়াত ছিল—
মলিন পঙ্কিল মনে
কেমনে ডাকিব তোমায়
পারে কি তৃণ পশিতে
জ্বলন্ত পাবক যথায়।
এই কাহিনিটি শোনার পর বাবা খুব কাতরভাবেই পিসিমাকে বলেছিলেন-ধবলীর ব্যাপারডা তুমিও যদি না বোজো, তয় এ সংসারে বোজবে কেডা?
পিসিমা তথাপি ব্যাপারটা মেনে নিতে পারেননি। সে কারণেই তাঁর বয়স্থা নাতনিদের কেলেঙ্কারির হাত থেকে বাঁচানোর জন্যে দেশত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন। তাঁর দেশত্যাগের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের বাড়ি এবং পিছারার খালের জগতের তাবৎ কিংবদন্তির দিনগুলোর অবসান হলো। লোককথা, লোকপার্বণের বারো মাসের তেরো অনুষ্ঠানও অতঃপর লুপ্ত হয়ে গেল। পিসিমাবুড়ির বিষয়ে পরে আরও কিছু বলে প্রসঙ্গটি শেষ করব। আমরা তখন এক অন্য সংস্কৃতির সঙ্গে মুখোমুখি দ্বন্দ্বে। এই দ্বন্দ্বকে আজকের বিচারে আমি আর সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব বলতে পারি না। এই দ্বন্দ্বই বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে শাসক পাকিস্তানিদের জঙ্গি ইসলামি জগাখিচুড়ি সংস্কৃতির দ্বন্দ্ব, যা পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশ আন্দোলনে পরিণতি পায়। কিন্তু এই সময় এই চাপিয়ে দেয়া সংস্কৃতির লক্ষ্যস্থল ছিল শুধু মধ্যবিত্ত তথা তাবৎ হিন্দু সংখ্যালঘুরা। যেহেতু হিন্দুসমাজ মধ্যবিত্ত শিক্ষিতসমাজ বলে পরিচিত তথা প্রতিষ্ঠিত ছিল, সে কারণে চাপিয়ে দেয়া এই জগাখিচুড়ি সংস্কৃতির আক্রমণের প্রথম ধাক্কাটা তারাই অনুভব করে। কিন্তু এর সঙ্গে সশস্ত্র দাঙ্গা এবং দেশভাগের অন্যান্য কুফল মিশ্রিত হয়ে ব্যাপারটা এমন এক পর্যায়ে যায় যে, ব্যাপক মধ্যবিত্ত হিন্দুসমাজ কোনো গণতান্ত্রিক প্রতিরোধে না গিয়ে ভারতের মাটিতে উদ্বাস্তু হয়ে ত্রাণ খোঁজে। যে কয়জন মুষ্টিমেয় হিন্দু মধ্যবিত্ত এই বিপরীত সংস্কৃতির বিরুদ্ধে লড়াই জারি রাখেন, তাঁরা কিছুকাল গত হলেই মুসলমান ছাত্রসমাজ ও বুদ্ধিজীবীসমাজের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ব্যাপক প্রতিরোধ-সংগ্রাম গড়ে তুলতে সক্ষম হন। কিন্তু সে শহর-নগরে। গ্রামগুলো ক্রমশ ধ্বংসই হতে থাকে এবং আর কোনোদিনই মাথা তুলে দাঁড়ায় না এবং গ্রামকে উপেক্ষা করার এই ভুলের মাশুল উভয় সমাজকে আজও দিয়ে যেতে হচ্ছে। কিন্তু সে কথা থাক। সেসব কথা সমাজবিজ্ঞানীদের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের কথা, তাঁরা তা করবেন। আমি পিছারার খালের কথাই বলি।