বিষাদবৃক্ষ – ৩১

একত্রিশ

কিন্তু মধ্যস্বত্বভোগী ভদ্দরলোক হিন্দু গৃহস্থদের দুর্দশায় কেউই ওই ক্রান্তিকালে অশ্রুমোচন করেননি, কারণ তাঁরা পুরুষানুক্রমে যে জঘন্যতায় মানবতাকে অবমাননা করে এসেছেন তার জন্য, সাধারণ মানুষ, কিবা হিন্দু, কিবা মুসলমান, কারওই তাদের প্রতি সহমর্মিতা থাকার কথা ছিল না। এই জেলার ভূমিব্যবস্থা বোধকরি পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে জটিল। জমিদার এবং রায়তের মাঝখানে প্রায় আড়াই লাখ মধ্যস্বত্বভোগী একসময় ছিল—এ কথা একদা বাংলার ভারপ্রাপ্ত সচিব এল বারলি বর্ণনা করেছেন। অতএব এই আড়াই লাখের এবং তাদের অনুচরদের যে বিপুল সংখ্যা, তাদের বিক্রমে তাবৎ সাধারণ মনুষ্য হামেহাল নাজেহাল। অন্তত কয়েক ডজন দুক্রান্তির মধ্যস্বত্বভোগীদের বাত্তেল্লাবাজি আমার জীবনেই দেখেছি। দেখেছি তাঁদের সামন্তসুলভ আচরণ। আমার পরিবারও তার থেকে ভিন্ন নয়। সে কারণে তাঁদের প্রতি সহমর্মিতা পোষণ করা সাধারণ প্রকৃতিপুঞ্জের পক্ষে যে আদৌ সম্ভব নয় সে কথা যৌক্তিকভাবে মানি। তথাপি আমার জন্মভূমির ওই অপবর্গীয়/অপবর্ণীয় মানুষেরা যে এঁদের দুর্দিনে, সহমর্মিতার চূড়ান্ত নিদর্শন রেখেছিল তা-ও তো আমার অজানা নয়। তারাই তো এঁদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল তখন। দাঁড়িয়েছিল এ কারণে যে, এইসব মধ্যস্বত্বভোগীদের অনাচারই একমাত্র বিচার্য বিষয় বলে তাদের মনে হয়নি। এঁদের কিছু সদাচারও ছিল। যা প্রান্তিক মানুষদের কাছে গ্রাহ্য ছিল। তারা সেই সদাচারের প্রতি নিমকহারামি করতে পারেনি। সামন্তবর্গীয় মানুষদের সেই সদাচার বিষয়ে গল্পকার, উপন্যাসকারেরা যথেষ্ট কথন কয়েছেন, অধিক বাগাড়ম্বরের প্রয়োজন হয় না। আমার জন্মভূমির সাধারণ মনুষ্য সেই সদাচারের প্রতি বিশ্বস্ত থেকেই বিভিন্ন সময়ের প্লবতার মুহূর্তে এঁদের পাশে এসে দাঁড়িয়ে তাঁদের প্রাণ পর্যন্ত বাজি রেখেছে। তারা অকাতরে প্রাণ দিয়েছে এবং নিয়েছেও। কিন্তু তৎসত্ত্বেও শেষ রক্ষা হয়নি। এ জন্য ঠিক কোন সম্প্রদায়কে যে দায়ী বলব, তা এতকাল পরেও বুঝে উঠতে পারি না। শুধু ঘটনাপরম্পরাটুকুই যেমন দেখেছি তেমন বলতে পারি। যেমন এখন আমাকে বলতে হবে সেইসব ডাকাতির কার্যক্রম, যে ডাকাতির তরিকা এক আলাদা মাপে, যার সঙ্গে ইতিপূর্বে আমাদের পরিচয় ছিল না।

আমাদের এই জেলার ডাকাতরা যে সাতিশয় ডাকাত এ কথা সর্বজনে জানে এবং এ জন্য তারা কোনো দিনই নিজেদেরকে লজ্জিত বোধ করেনি। আমরাও এইসব ডাকাতদের ঠিক ভয়ংকর অনাত্মীয় ভাবতাম না। তাদের পরিচয় আমাদের কাছে দুঃসাহসিক বীর হিসেবেই গ্রাহ্য ছিল, সমাজবিরোধী হিসেবে নয়। কিন্তু যে ডাকাতির কথা এখন বলতে যাচ্ছি তার মধ্যে বীরত্বের কিছুই নেই। তার মধ্যে কোনো নীতি-নিয়মের ব্যাপারও নেই। তার উদ্দেশ্য একমাত্র ধর্ষণ, লুণ্ঠন এবং সংখ্যালঘুদের সার্বিক উৎখাত। কিন্তু এখানকার পরম্পরাগত ডাকাতিতে এই মানসিকতা ছিল না। এটা অবশ্যই সমাজবিরোধী চরিত্রের। কিন্তু এই সময়কার ডাকাতি অনুষ্ঠিত হতো সেইসব বাড়িগুলোতে যেখানে কিছু সম্পদ আছে এবং যুবতী অথবা কিশোরী মেয়ে আছে। প্রাথমিকভাবে এইসব লক্ষ্যস্থল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের গেরস্থালিতেই শুরু হয়েছিল। এরকম বেশ কিছু ডাকাতি এবং তার ফল আমি চাক্ষুষ করেছি। তার মধ্যের সামান্য কিছুর উল্লেখই শুধু করব। আমাদের নায়েবমশাইয়ের পরিবার তখনও দেশ ছাড়েননি। তবে বাপদাদার ভিটে পরিত্যাগ করে তাঁরা তাঁদের বড় মেয়ের পাকা বাড়িতে বসবাস করছেন। বড় মেয়ে এবং জামাই সপরিবারে তখন দেশত্যাগ করে পাকা বাড়ির পরিবর্তে কলকাতার এক বস্তিতে, খোলার ঘরের বাসিন্দা। নায়েবমশাই তখন ওই বাড়িতে একটি মুদি দোকান দিয়ে কায়েম হয়ে বসেছেন। পাকা বাড়ি, বাড়ির চৌহদ্দিতে বিস্তীর্ণ বাগান, নানা ধরনের গাছ। ফৌজি হামলায় তাঁর নতুন কর্মস্থল পালেদের বার্মাশেল কোম্পানি পাততাড়ি গোটাতে বাধ্য হলে, তিনি মুদির দোকান দিয়ে পরিবার পরিপালনের যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। নায়েবমশাইয়ের দোকানটি খুব খারাপ চলত না। তাঁর পরিবারের লোকসংখ্যা ছিল প্রচুর। দ্বিতীয়পক্ষের স্ত্রী এবং শাশুড়ি, শালা, শালাজ এবং শালার ব্যাটাসহ নিজের দুই সংসারের বেশ কিছু সন্তানাদি নিয়ে ওই একই ছাতের নিচে বাস করতেন।

এক ঘোর বর্ষার মধ্যরাতে বাবার ডাকে আমার ঘুম ভাঙল। নায়েবমশাইয়ের বড় ছেলে আমার সহপাঠী বিধায়, আমি প্রায়শই ওই বাড়িতে রাত কাটাতাম এবং দুজনে পড়াশোনা করতাম। আমার পাঠ্য সব বইপত্র ছিল না বলে এরকম একটা ব্যবস্থা করে নিয়েছিলাম। তখন আমরা ক্লাস নাইনের ছাত্র। মাস্টারমশাইয়ের বাড়িতে তখনও আমি স্থায়ী হইনি। আমি উঠলে বাবা নাগর আলিকে ডাকতে বললেন। সে তখনও আমাদের রাখাল। দূর থেকে আর্তনাদ এবং চিৎকার চেঁচামেচির আভাস ওই ঘন বর্ষা ভেদ করেও আমাদের কানে পৌঁছচ্ছিল। নাগর বলল, ‘মোন লয় নাইব মশায়ের বাড়িতে ডাকাতি অইতাছে। হাথইয়ার লওন লাগে।’ আমরা তিনজনে রামদা, ল্যাজা (সড়কি) এবং ‘ট্যাডা’ অর্থাৎ লম্বা বাঁশের হাতলে দুবিঘত দৈর্ঘ্যের লোহার খাঁজকাটা তীক্ষ্ণধার এক অদ্ভুত ভয়ংকর অস্ত্র নিয়ে ওই জলকাদায় ধাওয়া করলাম। বাইরে বেরিয়ে নাগর মধ্যরাত্রির স্তব্ধতা-ভঙ্গকারী বীভৎস এক রণধ্বনি দিল। সঙ্গে সঙ্গে কাছে দূরের মানুষেরা যারা তখনও গ্রামে ছিল, প্রতিধ্বনি জানাল। আমরা ডাকাতির নির্ধারিত স্থানটি জানিয়ে দেবার জন্য গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে তাদের বুঝিয়ে দিতে লাগলাম কোথায় যেতে হবে। কিছুক্ষণের মধ্যে বেশ কয়েকজন অকুস্থলের কাছাকাছি একটি খালপারে পৌঁছে গেলাম। তখন নাগর এবং তার শ্রেণির মানুষরা ডাকাতদের উদ্দেশে অশ্রাব্য সব গালিগালাজ করছিল। এরা কোনো উত্তেজনা এবং সংঘর্ষের সময় যেসব ভাষা এবং শব্দ ব্যবহার করে, তার শীলিত নাম slang বা খিস্তি। বরিশালীয় ভাষায় বললে বলতে হয় ‘খামার’। নাগর খালধারে পৌঁছেই বুঝতে পেরেছিল ডাকাতরা নৌকোয় এসেছে। বর্ষণের তীব্রতায় এবং অন্ধকারের জন্য কিছুই প্রায় দেখা যাচ্ছিল না। ঘটনাস্থলে পৌঁছনের জন্য খালটি অতিক্রম করা আবশ্যক ছিল। কিন্তু চতুর ডাকাতেরা পারাপারের আলগা ‘চার’-এর গাছটি নামিয়ে রেখেছিল। তা দেখে নাগর, চুতমারানির পোয়ারা চার গাছড়া সরাইয়া দেছে। নাকি হ্যার গা মা বুইনের—ইত্যাদি। হালারপো হালা জারউয়ার পোয়েরা, হামনাহামনি আয়, তয় না বুজি যে এক বাপের আওলাদ।—এইসব বাক্যবন্ধ বলেই যাচ্ছে। তার খেয়াল নেই, ছোটবাবু এবং আরও দু-একজন মুরুব্বি সঙ্গে আছে। সে বলে——চারের’ মায়রে তিনবার। লয়েন মোরা হাতরাইয়াই খাল পার হমু। ছোটবাবু হুঁশিয়ার কৈলম, হালাগো ল্যাগা আর ট্যাডার দিকে নজর রাহন লাগে।—এ কথা শেষ হতে না হতে টং করে এক শব্দ হয়। ডাকাতদের দল উলটোপারের একটা জায়গা থেকে সম্ভবত নাগরকে বিদ্ধ করতে চেয়েছিল তার ‘খামার’ অনুসরণ করে একটি সুপারিকাঠের বল্লমের দ্বারা। বাবার হাতের ল্যাজার বাটখানার ব্যবহার হলো মুহূর্তে এই উড়ন্ত বল্লমকে দিকভ্রষ্ট করার জন্য। প্রতিরোধকারীদের মধ্য থেকে ‘সাবাসি’ ওঠে কেননা অব্যর্থ বিদ্ধতা থেকে নাগর রক্ষা পেল ওই অন্ধকারের মধ্যেও। এ কারণে সমবেত অপবর্গী, অপবর্ণদের খামার অসামান্য পর্দায় মাত্রা পায়।

ডাকাতরা তখন তাদের কাজ সেরে পালাবার পথে। নৌকোর শব্দ পাওয়া যায়। নাগর বলে, গুল্লিবাশখানা থাকলে জলের কাডির গাড়ন খাওয়াইয়া তোগো আড়ইয়া বিচিগুলান থ্যাতলাইয়া দেতে পারতাম।—তার পূর্বপুরুষ বাগ্‌দিকাহার, অথবা নগ্‌দি পাইক। গুলিবাঁশের ব্যবহারে তাদের হস্তলাঘব এখনও কিংবদন্তি। এ অঞ্চলে তির-ধনুকের চল নেই। গুল্লিবাঁশও তির-ধনুকের আকৃতির, কিন্তু তার নিক্ষেপ অস্ত্র তির নয়, জালের কাঠি অথবা পোড়ামাটির ‘গুল্লি’। তবে তার জন্য নাগরকে অধিকক্ষণ আক্ষেপ করতে হলো না। সে অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সঙ্গে পলায়মান নৌকোর বৈঠার আওয়াজ লক্ষ্য করে একটি সুপারিকাঠের বল্লম নিক্ষেপ করে এবং সেখান থেকে একটি তীব্র আর্তনাদ ভেসে আসে। উৎফুল্ল এবং উত্তেজিত প্রতিরোধকারীরা সমবেতভাবে মন্তব্য করে যে, এক ‘লাংচুনীর পোয়রে বোধায় গাথা গেছে।’

খাল পেরিয়ে আমরা যখন নায়েবমশাইয়ের বাড়ি পৌঁছই, তখন সেখানে এক ভীষণ দৃশ্য। পুরুষদের সবাইকে বেঁধে ফেলে রাখা হয়েছে। নায়েবমশাইয়ের গায়ে মাথায় রামদার কোপ এবং গোটা শরীর রক্তে জবজবে। তাঁর শ্যালক, যাকে আমরা সবাই মামা বলে ডাকতাম, তাঁকেও প্রায় ক্ষতবিক্ষত করে ফেলে রাখা হয়েছে। নাবেমশাইয়ের ছেলে, যে আমার সহপাঠী এবং বন্ধু, তাকে হাত পা মুখ বেঁধে এমনভাবে রাখা হয়েছে যে, সে জীবিত কি মৃত বোঝা যাচ্ছে না। সবাইকে ওই অবস্থা থেকে উদ্ধার করে বুঝলাম সৌভাগ্যক্রমে কেউই প্রাণে মারা পড়েননি। কিন্তু চরমতম বীভৎসতা দেখতে হয় নায়েবমশাইয়ের মেয়েটাকে উদ্ধার করার পর। সবাইকে পাওয়া গেলেও তার হদিস পাওয়া যাচ্ছিল না। কাকিমা অর্থাৎ নায়েবমশাইয়ের স্ত্রী শুধু উন্মাদের মতো চিৎকার করে যাচ্ছেন—ও রে মোর রূপাই কৈ? ও রে তোরা দ্যাখ, হ্যারে বুজি উডাইয়া লইয়া গেছে। ও রে ধন পেরান তো গেছেই, তোর জাইত মানও বুজি গেছে।—তাকে উদ্ধার করা হয় বাড়ির পেছন দিকের নির্জন অংশের ঢেঁকিঘর থেকে। তার বয়স বড়জোর তেরো-চৌদ্দ হবে, তবে একটু বাড়বাড়ন্ত গড়নের। সে একা বোবা পশুর মতো গোঁ গোঁ আওয়াজ করছিল। তার চোখে না ছিল কোনো ভাষা, না স্বাভাবিক হুঁশ। তাকে ঘরের মধ্যে নিয়ে আসার পর নায়েবমশাইয়ের পরিবারের সবাই এক ব্যাপক আক্ষেপে সমস্বরে কান্নাকাটি জুড়ে দেয়। লজ্জা আর হতাশায় ভেঙে পড়ে। বস্তুতই এ এক তীব্র আফসোসের ব্যাপার। বাপ, ভাই বা অন্য অভিভাবকরা যদি তাঁদের কিশোরী বা যুবতী স্ত্রী, কন্যাদের ইজ্জতটুকুও রক্ষা না করতে পারেন, তবে বেঁচে থাকার সার্থকতা কোথায়? আর এ কথা তো সবাই জানেন যে, অক্ষতযোনি কিশোরীর ওপরে বলাৎকারের তুল্য সর্বনাশ আর হয় না। আমার সতীর্থ বন্ধুটি তখন আমাকে জড়িয়ে ধরে শুধু একটা কথাই বলে যাচ্ছে—অরগো হাতে তো রামদা আছেলে, আমারে আগে কাডইয়া ফ্যালাইলে না ক্যান?

কিন্তু এই নতুন পদ্ধতির ডাকাতিতে ‘কাডইয়া ফ্যালবার’ নীতি ছিল না। যেসব মানুষ এই ডাকাতির মদতদাতা, তারা খুনখারাপ বিষয়ে একটু ‘নাজুক’ হয়েছিলেন, কারণ আগেই বলেছি, মার্শাল প্রেসিডেন্ট সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা নাকি আদৌ পছন্দ করেন না। পছন্দ না করার কারণ হয়তো সাগরপারের পশ্চিম গার্জেনদের হিসেবি তর্জন। কিন্তু দেশের অতটা নিম্নস্তরে তার রূপায়ণ খুব সহজ কর্ম নয়। তাই এই সাম্প্রদায়িক ডাকাতির উদ্ভাবনা। এই সব ডাকাতির মদতদাতা ছিল নতুন অর্থ এবং ক্ষমতার অধিকারী কিছু মানুষ, যারা বিগত দাঙ্গাগুলোর সময় সংখ্যালঘুদের রক্ষকের ভূমিকা নিয়ে কৌশলে জমি, বাড়ি, সম্পত্তির মোটা ভাগ অধিকার করে নিজেদের অবস্থার ব্যাপক উন্নতি ঘটিয়েছিল। তারা অবশিষ্ট উচ্চবর্ণীয় হিন্দুদেরও যথেষ্ট খাতির-মহব্বত করত। বিপদে অভয় দিত। আবার তাদের পোষা বদমাশদের ব্যবহারও করত ডাকাতির এই নতুন প্রকল্পে। সংখ্যালঘুদের যুবতী বা কিশোরী কন্যাদের সহজে ভোগ করার উদ্দেশ্যে তাদের ছেলেরাও এইসব বদমাশদের সঙ্গে ডাকাতিতে অংশগ্রহণ করত। এই বদমাশগুলো যখন লুটের কাজে ব্যস্ত থাকত, তাদের মালিকপুত্ররা তখন ধর্ষণে উন্মত্ত হতো। নায়েবমশাইয়ের বাড়ির ঘটনায় আমি এই সত্য উপলব্ধি করেছিলাম। তাঁর পাশের আরেকটি বাড়িতেও প্রায় অনুরূপ ঘটনার কথা আমি জানতাম। সেখানে মারামারি, রক্তারক্তি বা লুট কিছুই ঘটেনি। শুধু সে বাড়ির একটি সুন্দরী কন্যার লোভে এইরকম ভদ্রঘরের জনাকয়েক সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের যুবক সিঁদ কেটে ঘরে ঢুকে মেয়েটিকে বলাৎকার করার প্রয়াস পেয়েছিল। কিন্তু মেয়েটির সঠিক অবস্থান অন্ধকারে নির্ধারণ করতে না পেরে তার বিধবা বুড়িজেঠিমাকে জাপটে ধরেছিল। বুড়ি বিকট চিৎকার করে ওঠায় তারা পালিয়ে গিয়েছিল। আমি জানতাম তারা কারা। তারা সেদিন বাড়াবাড়ি করতে পারেনি এ জন্যই যে, কেউ চিনে ফেললে সামাজিকভাবে তারা অপদস্থ হবে। হিন্দু এবং মুসলমান—উভয় সমাজেই তারা যথেষ্ট মান্যগণ্য ছিল।

এভাবে একের পর এক ডাকাতি শুরু হলে বাকি ভদ্রগৃহস্থেরা ক্রমশ বাধ্য হয় নিকটবর্তী শহরে, নচেৎ পশ্চিমবঙ্গে পাড়ি দিতে। তাদের বাড়িঘর, জমিজায়গা এইসব তালেবরদের হাতেই অর্পণ করে যেতে হয় তাদের। ঘটনা ঘটার পর এঁরা এসে দুঃখ করতেন। দেশের হাল দিন দিন কী হচ্ছে, তা নিয়ে আফসোস করতেন। বলতেন, নাঃ আর বোদায় আপনেগো রক্ষা করতে পারলাম না। কী আছেলে আর কী অইলে? আহা! এ দ্যাশে ক্যার যে ইজ্জত করুম আর ক্যারই-বা গিবত করুম হে কতা আল্লা মালিকই জানেন।—এঁরাই তখন বুদ্ধি পরামর্শ দিয়ে জলের দামে অথবা দেখাশোনা করবার ‘অছিলায়’ বিষয়সম্পত্তি দখল করতেন। মুখে বলতেন, ভাব্যেন না যে সুবিদা নিলাম। সম্পত্তি ব্যাক আপনেগোই রইল। আল্লাকসম, মুই এ্যার অছি। তয় অবস্তা তো দ্যাখতেই আছেন। যায়েন, নিজেগো জাগায় নিজেগো মাইনষের মইদ্যে যাইয়া দেইখ্যা হুনইয়া এট্টা ব্যবস্তা করইয়া আয়েন ওপারে যাইয়া। মোরাতো আছিওই। ফিরইয়া আইয়া ব্যাক কিছুই সহিসলামত পাইবেন, ইনশাল্লা। “নিজেগো জাগা’! ‘নিজেগো মানুষ’! যারা দেশ ছেড়ে চলে গেছে তারা কি আমাদের ‘নিজেগো মানুষ’? যাদের সঙ্গে আছি তারা কি ‘নিজেগো নয়’, এ দেশটা তবে ‘আমাগো জাগা’ নয়? তবে নিজেদের মানুষ আর নিজেদের দেশ কোথায় পাব? তার জন্য আরও হাজার বছর ধরে হাজারবার উদ্বাস্তু হব, কিন্তু তবুও কি কোথাও ঠাঁই পাওয়া যাবে? অথবা আজ যে আমার ভূমি দখল করে, ছলে-বলে-কৌশলে আমাকে উদ্বাস্তু করছে, সেও কি আখেরে স্থায়িত্ব পাবে? বাঙালি কি কোনো দিনই নিজের কুঁড়েঘরে নিজের মতন করে বাঁচবে? তার সন্তান কি আদৌ দুধে-ভাতে থাকবে? সে কি আর আদৌ ‘দেশের মানুষ’ থাকবে, না যে ‘দেশ’ নামক বোধকে দুখণ্ড করে দুটি অবোধ্য জাতিরাষ্ট্র তৈরি হয়েছে তাদের কোনো একটির ‘নাগরিক’ বা ‘সিটিজেন’ নামক অচেনা অস্তিত্বে পরিচিত হবার প্রয়াস চালিয়ে যাবে জীবনভর, আর শুধু পরস্পরের রক্ত ঝরাবে? এরকম হাজার প্রশ্ন তোলা যেতে পারে, কিন্তু সাম্প্রদায়িক ভেদাচার, ভ্রাতৃবিদ্বেষের এই নির্বোধ আচরণ, ব্যক্তিক এবং সাম্প্রদায়িক লোভ অথবা সর্বোপরি আত্মহননের এই প্রগাঢ় মর্ষকাম বোধকরি তাকে আরও বহু, বহুকাল ধরে উদ্বাস্তু করেই রাখবে এবং তা সম্প্রদায় নির্বিশেষেই।

এরকম ডাকাতি ঘটানোর সময় ডাকাতরা বলে দিত যে, এরপরও যদি তারা দেশ না ছাড়ে তবে একেবারেই নিকেশ করে দেয়া হবে। কোনো কোনো ঘটনায় নিকেশ যে করা হতো না এমনও নয়। কিন্তু রাষ্ট্রীয় কায়দাকানুনও এ সময় এমন ছিল যে, এসব ঘটনাকে সাধারণ ডাকাতির অতিরিক্ত কিছু বলে মনে করা হতো না। সরেজমিনে যৎপরোনাস্তি নাস্তানাবুদ করত এবং ফলত তাদের আতঙ্কের মাত্রা বৃদ্ধিই পেত। ডাকাতি বা খুন হলে খুনের কোনো কিনারাই হতো না। উপরন্তু, হতভাগ্য গৃহস্থদের ওপর আক্রমণকারীদের আক্রোশ আরও বৃদ্ধি পেত। সারাদিন তথাকথিত হিতৈষীদের স্তোক এবং আশ্বাসবাক্য শুনে আশ্বস্ত থাকলেও সন্ধ্যার আঁধার নামলেই আতঙ্কের শুরু। ঘরের ‘ছাইচে’ পাতার খচমচ বা যে কোনো প্রাকৃতিক শব্দও বুকের রক্ত হিম করে দিত। আগের মতো ঘন বুনোট বসতি নেই। রক্ষক হিসেবে রাষ্ট্রও একচক্ষু ষণ্ডের মতোই নিষ্ঠুর। তার ভাব-চরিত্র বোঝা দায়। সে যে কোন চোখটায় কখন অন্ধ, তা বোঝা ভার। তার শিঙের গুঁতোটাই শুধু টের পাওয়া যায়, অন্ধ চোখটার উদাসীনতাজনিত স্বস্তি কখনোই পাওয়া যায় না।

পূর্বোক্ত ঘটনাটি ঘটার পরদিন থানা পুলিশ আসে। দারোগার বজরা ঘাটে লাগে। সেই দারোগা আলবোলায় তামাক খান। বজরা থেকে নেমে অকুস্থল পর্যন্ত হেঁটে আসার সময় অনুগমনকারী চাপরাশিকে সেই আলবোলা বহন করে নিয়ে আসতে হয় আর সতর্কতার সঙ্গে মাঝে মাঝেই কলকের আগুন উসকে দিতে হয়। তার সামান্যতম অন্যমনস্কতায় দারোগা সাহেবের মৌতাত টাল খেলে, তিনি তার দিকে তাকান রুদ্রচোখে। মুখে শুধু সামান্য উচ্চারণ—বান্দির বাচ্চা খ্যাল রাহনা?

নায়েবমশাইয়ের বাড়ির ডাকাতির তদন্তে যে দারোগা সাহেব সরেজমিন করতে এলেন, তাঁর চাকরি সাহেবি আমলের শেষের দিকের। মেজাজ মর্জিতে ঘোরতর সাহেবি। স্বভাব লম্পটের। বয়স বছর আটত্রিশ-চল্লিশ হবে। তা তিনি এসে প্রথমে বাড়ির এবং পাড়া-প্রতিবেশী পুরুষদের পুছতাছ করলেন। নানারকম লেখাজোখার কাজ এবং ডাকাতদের দ্বারা ভাঙচুরের চিহ্নাদি মাপজোক করে প্রতিবেশীদের বললেন যে, এবার তিনি শুধু বাড়ির লোকদের সঙ্গে কথাবার্তা বলনে,

তাঁরা যেন ওখানে আর ভিড় না বাড়ান। ফলত সবাই নিরাপদ দূরত্বে, আগান-বাগান বা গাছতলায় গিয়ে বিশ্রাম নিতে লাগলেন। দারোগা সাহেব প্রথম থেকেই আমাকে খুব পছন্দ করছিলেন, সে কারণে কাছাকাছি কোথাও অপেক্ষা করতে বললেন, যেন ডাকলে পাওয়া যায়। একটি ছোট ঘরে বসে তিনি তাঁর কাজকর্ম চালাচ্ছিলেন। সব কাজ শেষে তিনি নায়েবমশাইকে বললেন, দ্যাখেন আমাগো চাকরিডাই একটা আহাম্মকির কাম। আপনে একজন মুরুব্বি মানুষ বোজেন তো সবই, তয় জানবেন, কত্তইব্যের খাতিরেই আমাগো অনেক কিছুই করণ লাগে। এই তো দ্যাহেন, আপনের মাইয়ারে এহন এই কত্তইব্যের খাতিরে যে কতাগুলান আমারে জিগাইতে অইবে, হেয়া তো আপনেগো সামনায় আমি জিগাইতে পারি না। তয় ডাহাতির মামলা, আইনত ব্যাক কিছুই আমার জানোন লাগে। ব্যাপারডা আপনে নিশ্চই বোজতে পারতাচ্ছেন। তয়, ইনশাল্লা। আপনের মাইয়ায়ও মোরও মাইয়ারই ল্যাহান।—অর্থাৎ তিনি তাকে কিছু বিশেষ প্রশ্ন করতে চান। সেসব দিনে এ বয়সের একজন মানুষের তেরো-চৌদ্দ বছরের মেয়ে থাকা অসম্ভব ছিল না। আজও হয়তো নেই। অতএব, সেরকম একজন মানুষ, আবার তিনি যদি একজন রাজপুরুষ হন, সেখানে আপত্তির কীই-বা থাকে? এইসব টালবাহানায় দারোগা সাহেব প্রায় ঘণ্টাখানেক ওই হতভাগিনী ধর্ষিতাকে আটকে রাখেন। দরজা বন্ধ থাকে। আমি এবং আমার সেই বন্ধু, নায়েবমশাইয়ের ছেলে, দুজনেই নানারকম অশ্লীল সম্ভাবনায় বন্ধ দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে একে অন্যের দিকে তাকাতেও পারছি না। ভেতর থেকে অস্ফুট স্বরে নানান অর্থপূর্ণ শব্দ কানে এসে আঘাত করতে থাকে। আমরা অসহায়ভাবে অপেক্ষা করতে থাকি কতক্ষণে ওই দরজা খোলা হবে এবং পৃথিবীতে সব কুৎসিত সন্দেহের অবসান হবে। কিন্তু সন্দেহ অবসানের কোনো সম্ভাবনাই ছিল না। ভেতরের অর্থপূর্ণ শব্দ ক্রমশ আমাদের কানে দ্রুত পর্দায় ধ্বনিত হচ্ছিল। আমরা খুব ক্ষীণ করুণ এক কান্নার ব্যথা আমাদের সব অনুভূতি দিয়ে সহ্য করতে বাধ্য হচ্ছিলাম। অসহায়তা আমাদের এক ‘সংকটের’ গভীরতম গহ্বরের শেষ পাতালে যেন পৌঁছে দিচ্ছিল এবং সেরকম এক মুহূর্তে আমাদের সামনে ওই নারকীয় দরজা উন্মুক্ত হলো। আর আমাদের সেই মন্দ-কপালি, হতভাগিনী বোনটি মুখে কাপড় গুঁজে, আমাদের কারও দিকে তাকাতে না পেরে হেঁচকি তুলে কাঁদতে কাঁদতে তার মায়ের কোলে গিয়ে আছড়ে পড়ল।

দারোগা আমাকে ভেতরে ডেকেছিল তখন। তার মুখ চোখের অবস্থা, কপালের ঘাম এবং বেশবাসের ধরন দেখে তাকে আর দারোগা সাহেব বলে সম্মানিত সম্বোধনের কথা ভাবতে পারছিলাম না। তাকে একটা সদ্য রতিক্লান্ত কুকুরের মতো দেখাচ্ছিল। তথাপি যেহেতু সে একজন উর্দিপরা রাজপুরুষ, আমাদের তৎকালীন অসহায়তায় তার আদেশ মেনে নিয়ে আমাকে ভেতরে যেতেই হলো। তখন যা বয়স, তাতে স্ত্রী-পুরুষের গুপ্ত ব্যবহার বিষয়ে আমরা একেবারেই অজ্ঞ, এ কথা বলব না। লোকটা আমাকে ভেতরে ডেকে বলল, বুজলানি, ব্যাপারডা খুবই সিরিয়াস। সি হ্যাজ বিন রেপড। রেপড বাই থ্রি। আহা এ্যাতডুক মাইয়াডা! – কিন্তু তার এই আফসোসোক্তি সত্ত্বেও আমি ঠিকই বুঝতে পেরেছিলাম যে, সি হ্যাজ বিন রেপড নট বাই থ্রি, বাট বাই ফোর।

লোকটা এরপর অনেক কিছুই বলে। আমি এ ব্যাপারে কাউকে সন্দেহ করি কি না জানতে চায়। অত্যন্ত অন্তরঙ্গভাবে এবং খুশির ভঙ্গিতে সে আমাকে জানায় যে, আমরা যদি একটু সহায়তা করি তবে তার পক্ষে অপরাধী শনাক্তকরণ কিছুমাত্র কঠিন হবে না। এখানে যদি আমার পক্ষে খোলাখুলি কিছু বলার অসুবিধে থাকে, আমি নিশ্চিন্তে বজরায় গিয়ে তার সঙ্গে বাতচিৎ করতে পারি। তিনি তাতে খুশিই হবেন। আমার অবশ্যই এই ডাকাতির বিষয়ে কিছু জানানোর ব্যাপার ছিল। সবই সন্দেহক্রমে, তবে তা যুক্তির দিক থেকে যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। এ কথা জানাতে লোকটা আমাকে খুবই খাতির দেখিয়ে তার বজরায় নিয়ে যায়। আর সেখানে যাবার পরপরই খানিকক্ষণের মধ্যে আমি বুঝতে পারি যে, এই লোকটা শুধু লম্পটই নয় একটা চূড়ান্ত সমকামীও এবং তার লক্ষ্য পূরণের জন্য সে সততই সুযোগসন্ধানী।

কিন্তু মানুষকে এমন কতকগুলো ঘটনার মোকাবিলা করতে হয়, যখন বীভৎসতার জন্য হোক বা ঘটনার তীব্র বাস্তবতার জন্যই হোক, সে ব্যাপারটাকে অস্বীকার করতে চায় প্রাণপণে। আমার অবস্থাও সেই সময়টায় সেরকমই দাঁড়ায়। দারোগার ব্যাপারটা যেন ঘটেইনি এবং আমরা দুই বন্ধু নিতান্তই মিথ্যে সন্দেহে কষ্ট পাচ্ছি, এরকম আকাঙ্ক্ষা আমার মনের মধ্যে কাজ করছিল। তার ওপর, সেই লোকটা আমার সঙ্গে এত অমায়িক ব্যবহার করতে শুরু করল যে, আমার মানসিক আকাঙ্ক্ষা ক্রমশ প্রত্যয়ে দাঁড়িয়ে গেল এবং মানুষটিকে আমরা যে অন্যায়ভাবে সন্দেহ করছি, এ কারণে একটু অপরাধবোধও হতে লাগল। সে আমাকে নিয়ে আমাদের খালের খাটের দিকে যেতে যেতে খুবই অন্তরঙ্গভাবে অনেক কথাবার্তা বলতে লাগল। আমি তখন সবে উঠতি বয়সি এক সাধারণ গ্রাম্য কিশোর, যুবক বলা সাজে না। আমাদের গ্রামগাঁয়ের মুরুব্বি লোকরা এই বয়সটাকে আদৌ পাত্তা দেন না, বা কোনাও গম্ভীর আলোচনার যোগ্যও বোধ করেন না। কিন্তু দারোগা সাহেব আমাকে খুব গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার মধ্যে নিয়ে গেলে, আমি যারপরনাই বিগলিত হই। সে বলে যে, অপরাধী যারা, তারা যে মুসলমান সম্প্রদায়ের, সে বিষয়ে তার কোনো সন্দেহ নাই। সে প্রায় আঠারো বছর ধরে ‘দারোগাগিরি করছে এবং বেশির ভাগ সময়েই এই দক্ষিণ-পূর্ববঙ্গে তার কর্মস্থল। সব জায়গায় ঈদৃশ অপরাধীর সংখ্যা হিন্দুর চাইতে মুসলমানই অধিক। সে একজন প্রাক্তন ব্রিটিশ ম্যাজিস্ট্রেটের, যিনি আমাদের জিলাসদরে বহুকাল কাজ করে গেছেন, একটি মন্তব্য উদ্ধৃত করে স্বধর্মীয় মানুষের বিপক্ষেই বলে যে, সাহেব বলেছিলেন, This race ( Mohamadans) may be ended but never be mended. দারোগার মতে, যদিও এ তার স্বজাতির নিন্দা, তথাপি কথাটি সত্য। এইসব মুসলমানরা আদপেই ইমানদার মুসলমান নয় এবং এদের জন্যই তার স্বজাতির নিন্দা সাহেবরাও করে গেছে এবং হিন্দুরাও করে। আসলে এরা প্রকৃতই ছোটলোক। কিন্তু সে যা হোক আমি যদি তাকে একটু সহায়তা করি, তবে তার পক্ষে অপরাধীদের পাকড়াও করা খুব একটা শক্ত হবে না। আমাকে তার খুবই বুদ্ধিমান ছেলে বলে মনে হয়েছে। আমার কথা তার কাছে যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, সে কথা বারবার সে আমাকে জানায়।

বজরাটি বাঁধা আমাদের ঘাটের সেই রেনট্রির শেকড়ে। আমি ওইরকম একজন রাজপুরুষের উষ্ণ অভ্যর্থনা এবং কথাবার্তায় প্রগাঢ় আপ্লুত হয়ে ইতিপূর্বের কুৎসিত সন্দেহের কথা বেমালুম ভুলে যাই। স্বাভাবিক কারণেই আমি বা আমরা তখন স্থানীয় বেশির ভাগ মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষী। সাম্প্রদায়িকতার বিষ তো আমাদের মধ্যে প্রায় পরম্পরাগত। তাই এরকম একজন মরমি রাজপুরুষকে সহায়তা করা সমীচীনই বোধ করি। আমি জানাই যে, এই ডাকাতির মূল আসামি বলে আমি যাকে মনে করি, তার নাম ‘ছালাম’। তার সঙ্গে তার গ্রামের কে বা কারা অংশগ্রহণকারী তা বলা মুশকিল, তবে ছালাম যে এক নম্বর, এরকম সন্দেহ করার নির্দিষ্ট কারণের কথাও দারোগাকে আমি বলি।

ছালামকে নায়েবমশাই তাঁর বাড়িতে পাহারাদারির কাজে রেখেছিলেন। ওই সময়টায় কামলাগিরি, রাখালি এবং পাহারাদারি এইসব কাজের জন্য এরকম ব্যবস্থা আমাদের ওই পিছারার খালের এলাকায় খুবই জরুরি ছিল। এরা দিনের বেলায় খেতের কাজ, গরুবাছুর সামাল দেয়ার কাজ ইত্যাদি করত, আর রাতের বেলা দু-তিনবার বেরিয়ে ‘হুঁশিয়ার’, ‘জাগোওও’ অথবা ‘খবরদারি হোওওও’—বলে হাঁক পাড়ত, যেমন আমাদের বাড়িতে নাগর আলি ভাই ছিল, তেমনই। নাগর আলি ভাইয়ের ইমানদারি এবং কর্তব্যনিষ্ঠার ওপর আমাদের কোনো দিন সন্দেহের কারণ ঘটেনি। তবে যেহেতু ওই সময়টায় পড়াশোনার খাতিরে আমি নায়েবমশাইয়ের ছেলের সঙ্গে প্রায়শই রাত কাটাতাম, ছালামের কিছু উৎপটাং ব্যবহার আমার নজরে পড়েছে। সে ছিল এক তাগড়া জোয়ান। আমাদের ওই অঞ্চলে এইসব মুসলমান যুবকদের যথাসময়ে বিয়ে-শাদি হওয়া খুব সহজ ছিল না। হলেও এরা হিন্দু যুবতী, এমনকি মাঝবয়সি মহিলাদের প্রতিও বড়ই আকাঙ্ক্ষী ছিল। ছালামকে আমি কয়েকবারই লক্ষ করেছি যে, সে নায়েবমশাইয়ের মেয়েকে কিছু বিরক্ত করে। ব্যাপারটা ঠিক প্রেম-প্রণয়জাতীয় নয় বলেই মনে হয়েছে। গ্রামীণ মেয়েরা স্নানের ঘাটের পৈঠায় বসে যে সহজতাটুকু উপভোগ করে, সেখানে হঠাৎ গিয়ে পড়লে আমরা তার মর্যাদার জন্য পথান্তর গ্রহণেই অভ্যস্ত। কিন্তু ছালামের মতো ইবলিসমার্কা ইতররা তখন ঝোপের আড়ালে দাঁড়িয়ে মেয়েদের এই গোপনীয়তাটুকু তারিয়ে চাখে। শুধু তাই নয়, তারা যে ব্যাপারটা দীর্ঘসময় ধরে উপভোগ করেছে, হঠাৎ ঝোপ থেকে বেরিয়ে এসে তা জানিয়েও দেয়। এসব জঘন্যাচার আমার নজর এড়ায় না। অথবা—’এক গেলাস পানি খাওয়াও বলে’, উৎকট ভঙ্গিতে লুঙ্গিটা বিশেষ স্থান অবধি তুলে বসে পড়ে। হাত থেকে জলের গ্লাস নেয়ার সময় অতিরিক্ত স্পর্শন ইত্যাদিও নজরে পড়েছে। কেননা, এসব বিষয়ে, স্বাভাবিক কারণেই আমাদের নজর রাখতে হতো তখন। আমি খুব গূঢ়ভাবে কতগুলো কার্যপরম্পরা এই ডাকাতির বিষয়ে লক্ষ করেছি এবং তা দারোগাকে সরলভাবেই জানাই।

আমি বলেছিলাম যে, ও ডাকাতির রাত্রে নায়েবমশাইয়ের বাড়িতে থাকেনি, যদিও সে পাহারাদার হিসেবে ওই বাড়িতে প্রতি রাতেই থাকে। সে যে ওই রাতেই থাকবে না, সে কথা সে পূর্বাহ্লে নায়েবমশাই বা বাড়ির অন্য কাউকে বলেওনি। আবার ডাকাতির পরদিন সকাল আটটা নাগাদ সে ওখানে এসে খুবই আফসোসের সঙ্গে জানায় যে, সে আগের রাতে একটা বিশেষ কাজে অন্যত্র ছিল বলে আসতে পারেনি। কিন্তু সেই ‘অন্যত্র’ জায়গাটির যে অবস্থানের কথা সে বলে তা নায়েবমশাইয়ের বাড়ির থেকে বড়জোর হাজার দেড়েক কি দুয়েক গজ দূরের একটি কুটির। রাতে বর্ষণ ইত্যাদির প্রাবল্য সত্ত্বেও আমরা যারা ছুটে এসেছিলাম, তারা যদি ওই চিৎকার, কান্না ইত্যাদি শুনতে পারি, অতটুকু তফাতে থেকে সে কেন শুনতে পায় না তা বোঝা খুবই কষ্টসাধ্য। উপরন্তু সে বা তার সঙ্গী যারা ওই কুটিরে আগের রাতে অবস্থান করেছিল, তা ছিল নায়েবমশাইয়ের এক নিকট প্রতিবেশীর খামারবাড়ির মতো ভদ্রলোক ইউনিয়ন বোর্ডের কেরানি। সবাই বলত, কেরানি চৌধুরী। গাঁয়ের বাড়িতে এঁরাই মান্যমান মানুষ। তা যা হোক, তাঁর বাড়ির দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে রেখেছিল ডাকাতরা। তাঁরাও চিৎকার-চেঁচামেচি শুনেছেন। কিন্তু বেরোতে পারেননি। পরের দিন তাঁদের রাখাল এসে ঘরের দরজার বন্ধন খোলে। অথচ তার কয়েক গজ দূরে অবস্থিত ছালামরা নাকি কিছুই শুনতে পায়নি। দারোগা আমার এই কথাগুলো খুবই মনোযোগের সঙ্গে নোট করছিল এবং উৎসাহ দিচ্ছিল এই বলে যে, এসব অতি গুরুত্বপূর্ণ খবর। সে বলল, খানদানি বাড়ির পোলাপানেগো বুদ্দির লগে কি হাইলয়া চাষার বুদ্দির তুলনা অয়?—খানদান এট্টা ব্যাপার, হেয়া হিন্দুরই হউক, চাই মোছলমানের। সে আমাকে বলে যে, আমি যে বাড়ির ‘আওলাদ’, তাঁদের মান্যতা দেয়ার মতো শিক্ষা তার আছে। তার খানদানও এক ‘বহোত উচা তরিকার’। বাল্যাবধি সেও খুবই ‘রহম সহম’ এবং উচ্চ আদর্শে মানুষ। তার খানদানে কোনো বদরক্তের ‘ইলজাম’ আছে এ কথা ‘কোনো খানকির আওলাদ’ বা ‘চুতমারানির পোয়’ও বলতে পারবে না। এরকম এক ভাষায়ই সে এসব তথ্য জানায়।

এইসব বার্তালাপের সময় আমরা তার বজরায় গিয়ে বসেছি। বজরা অতিশয় সুসজ্জিত এবং শোভন। তার প্রকোষ্ঠের শেষপ্রান্তে ‘হুজুরের খাসকামরা”, যার একদিকে দুজন মানুষের বসার মতো শোভনীয় আরাম কৌচ এবং বেশির ভাগ অংশ জুড়ে একটি মনোরম ‘বিস্তারা’ মানে বিছানা। খুবই ছিমছাম। দারোগা সেখানে গিয়ে তার ধড়া-চূড়া বদল করে ঘরোয়া লুঙ্গি গেঞ্জিতে সহজ হলেন এবং আমাকে নিয়ে বসলেন। বসার পরই এই প্রথম তার মুখে অন্য জগতের অন্য শব্দ শুনলাম। এর আগে এরকম একটিও শব্দ তার মুখে উচ্চারিত হয়নি। পিছারার খালের জগতে এইসব শব্দ সাধারণ অপবর্গীরা, চাষিরা অক্লেশে অহরহ বলে এবং আমরা বাল্যাবধি তা শুনে অভ্যস্তও। কিন্তু বাবা, জ্যাঠা বা অনুরূপ গুরুজনদের মুখে এসব শব্দের ব্যবহারে অভ্যস্ত ছিলাম না বলে দারোগার এই শব্দ-ব্যবহার আমাকে আহত করে। জ্ঞানাবধি আমরা এসব শব্দকে ‘অসভ্য কথা’ বলে জেনেছি, যদিও সাধারণ্যে এর ব্যবহারকে কখনোই অশ্লীল বোধ করিনি। এখন দারোগা ঈদৃশ শব্দাবলির ছররা ছিটোতে থাকে, আর আমি নিজেকে ক্রমশ কণ্ডূয়িত করতে থাকি। ছালামের তাবৎ কথা শুনে তার মধ্যে যেন এক অসম্ভব উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। সে বলে, এইসব জালিমেরাই এছলামের বদনামির লইগ্যা দায়ী। এ্যারা খালি চায় কোতখুনে এই য়িন্দু ছেমগিরগো সিনার কাপুর সরাইয়া–এই ছ্যামরারা অইছে সাইদ্যের নাপাক আর হাবিয়ার কীড়া। এ্যারা মাতারিগো দুইডা জাগাই খালি চেনছে।—দারোগা ক্রমশ এইরকম বিন্যাসে যাচ্ছিল আর আমার একখানা হাত তার দুই ঊরুর মাঝখানে রেখে চোখের কৌতুকে আমাকে অশ্লীল ইঙ্গিত করছিল। বজরার মাল্লারা এসব দেখে খুব জোরেই বলাবলি করছিল, ‘ছ্যামড়ার কিসমতডা সাইদ্যের ভালো। ছায়েবের ন্যাকনজরে পড়ছে।’ আমি ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছিলাম, সারা শরীরে একটা ঘিনঘিন ভাব নিয়ে আমি আবার আমার পুরনো বিষণ্ণ, ভুলে যেতে চাওয়া সন্দেহে ফিরে যাচ্ছিলাম। কিন্তু পুলিশ-দারোগা ভয়ের বস্তু। তা ছাড়া আমাদের তদানীন্তন অসহায়তার জন্যও কোনো বিদ্রোহ করতেও পারছিলাম না। মাল্লারা ব্যাপারটিতে আমাকে উৎসাহিত করে যাচ্ছিল অতি উচ্চৈঃস্বরেই। জীবনে এতটা অসম্মানিত এবং ক্লেদাক্ত নিজেকে কখনোই বোধ করিনি। যা হোক, একসময় ব্যাপারটা শান্ততায় এলে দারোগা আমায় বলল. আসলে বোজলা কিনা তোমার কথাই ঠিক ছোমেদইয়াই হ্যার দলবল লইয়া এই ডাকাতিডা করছে। তয়, এ্যার মইদ্যে এট্টু অন্য সোমস্যাও আছে। ওই মাইয়াডিও কৈলম খুব সুবিদার না। দ্যাহ এ্যাতকাল দারোগাগিরি করছি। মনুষ্য চরিত্তির কিছু তো বুজি? না কী কও? সুইজ যদি মোড়ায়, সুতা ঢোকতে পারে না। তয় বোজলা কিনা, এহানে পুলিশের কিছু করার নাই। ডাহাতিডা করাইছে ওই ছেমরিই। ক্যান? না হ্যার মহব্বত ওই ছালামইয়ার লগে এ্যামনে তো সুবিদা করতে পারে না, হেকারণ কায়দা করইয়া এট্টু গাদান খাইলে।

এ কথা স্বীকার করতে গেলে, ওই ত্রয়োদশী বা বড়জোর চতুর্দশী মেয়েটাকে যে পরিমাণ বুদ্ধিশালিনী এবং ধান্দাবাজ বলে মানতে হয়, তার মধ্যে কোনোকালেই আমরা ওই পরিমাণ বুদ্ধিবৃত্তির বা ধান্দাবাজির আভাস প্রত্যক্ষ করিনি। দারোগা আরও জানাল যে, এ নিয়ে তার বেশি কিছু করা সম্ভব নয় একটিই কারণে যে, যদি ছালামকে ধরা হয়, তবে ওই মেয়ের জারিজুরি ‘বেয়াক ফাস অইয়া যাইবে।’ বিশেষত হিন্দু সমাজে তো তার এক ভয়াবহ ফল ফলবে। যা সমাজ একখানা, অতএব ওই বয়সি একটি মেয়ের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে দারোগা কীভাবে এতবড় একটা কাণ্ড করতে পারে? ব্যস, ডাকাতির সুরাহা ওই পর্যন্তই। এরপর আর কীই-বা বলার থাকে? তবে এ সময়কার অনুরূপ ডাকাতির কথা আরও শয়ে-হাজারে বলা যেতে পারে। কিন্তু সেসব বলে এবং ক্রমান্বয়ে রক্তাক্ত হয়ে হয়ে আমরা কোথায় গিয়েই-বা পৌছতে পারি? আবার এইসব কৌশলী ডাকাতি, অসহায়া রমণী, যুবতী বা কিশোরীদের ওপর এই নির্বিকার ভোগ ক্রমশ সাধারণ এবং নিম্নবিত্ত মুসলমান সমাজেরও সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়, কেননা, তখন অসহায় সংখ্যালঘুদের উৎখাতের প্রয়োজন আর থাকে না। কিন্তু যেসব দৈত্য বোতল থেকে বেরিয়ে এসেছিল, তারা থাকে, আর থাকে তাদের এই ভোগ এবং লুণ্ঠনের অভ্যেস।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *