তিন
শুনেছি আমার মায়ের বয়স যখন উনিশ, তখন তিনি নববধূরূপে বড় খাল অবধি নৌকোয় এবং সেখান থেকে অন্দর অবধি পালকিতে চড়ে এসেছিলেন। বাবার বয়স তখন ত্রিশ। মাত্র বছরখানেক আগে তাঁর প্রথমা স্ত্রী তিনটি অপোগণ্ড রেখে লোকান্তরিতা। আমাদের সেই না-দেখা মায়ের ছবি দেখেছি। অসামান্যা সুন্দরী ছিলেন তিনি। বাবা সেই বছরই জীবনের প্রথম এবং শেষবারের মতো তালুকদারি তদারকির জন্য ‘মহালে’ গিয়েছিলেন। ইতোমধ্যে সেই মা রোগে পড়েন। তাঁর অসুস্থতার খবর বাবাকে পাঠানো হয়নি। চিকিৎসাদিও তেমন করানো হয়নি। বাড়ির অন্যান্য মহিলারা অসুখটাকে স্বামীবিরহজনত ন্যাকামি বলে নাকি তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছিলেন। এসব কথা আমার মায়ের কাছ থেকে শোনা। সেই আগের মায়ের বয়স তখন একুশ। শেষ পর্যন্ত যখন খবর পেয়ে বাবা বাড়ি এলেন, ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। আমার সেই মায়ের তখন বাকশক্তি রহিত হয়ে গেছে। শুধু চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়ছিল। তারপরই শেষ। স্বাভাবিক কারণেই ঘটনার তীব্রতা এবং আকস্মিকতায় বাবা স্তব্ধ মূক হয়ে গিয়েছিলেন।
পরিজনদের প্রতি তাঁর ক্ষোভ এবং অভিমানও হয়েছিল প্রচুর। কিন্তু তাঁর তিনটি মাতৃহারা সন্তানকে তো ওই পরিজনদের ভরসায়ই রাখতে হবে, এ কারণে চুপচাপ থেকে গেলেন। মায়ের কাছে শুনেছি যে বাবা নাকি এ সময় রাতের পর রাত জেগে থেকে আমাদের ছোট বৈঠকখানার জানালা দিয়ে সেই আগের মায়ের চিতার দিকে তাকিয়ে থাকতেন। মনে মনে বলতেন, যদি কিছু বলার থাকে বলে যাও। আমি ভয় পাব না। এসব কথা বাবা আমার মাকে বলেছেন। বাবা নাকি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, আর বিয়ে করবেন না। বাড়িতে জনবলের অভাব নেই, অতএব ছেলেমেয়েদের মানুষ করার কোনো অসুবিধা হবার কথা নয়। বাবা খুবই রোমান্টিক স্বভাবের ছিলেন। বাস্তব জ্ঞান বিশেষ ছিল না। তাঁর সন্তানদের মানুষ করার দায় আমাদের কোনো পিসিমা মাসিমা কাকিমা জেঠিমাই গ্রহণ করতে পারলেন না। কারণ তাঁরা নিজেরাই সন্তানসম্পদে একেকজন গান্ধারী। বিশাল পরিবার, কে কারটা দেখে। তাঁরাই একসময় বলতে শুরু করলেন, আহা কয় কী, বিয়াড়া করবে না ক্যান? বয়সটাই-বা কী? হেয়া ছাড়া পোলামাইয়াগুলা দ্যাহনেরও তো এট্টা মানুষ চাই। অতএব রোমান্টিকতার সঙ্গে ‘পোলাপানগুলা’ মানুষ করার বাস্তবতায় সংঘাত লাগে এবং তাদের কষ্টই প্রাধান্য পায়। ছোটটার বয়স তখন এক, তার আগেরটি কন্যা, বয়স আড়াই এবং বড়টি পাঁচ বছরের। এদের প্রতি ক্রমবর্ধিত অনাদর এবং তৎকালীন একান্নবর্তী মধ্যস্বত্বভোগী পরিবারের মানুষদের আচার অভিচার বড় স্থূলতায় ক্রুরতায় প্রকাশ পায়। অতএব বাবা আমাদের মাতৃদেবীকে অনুগৃহীত করেন। এ যুগে হলে বলা যেত অনুগ্রহটি পুরুষের তরফে নয়, নারীর তরফেই হয়েছিল। আমার মায়ের ভাগ্যদোষ, নারী স্বতন্ত্রতার আধুনিক মন্ত্র সেই যুগে তাঁর কানে পৌঁছবার কোনো ব্যবস্থা ছিল না।
বিবাহ-পরবর্তী দিবসে নৌকাযোগে আগমনকালে বাবা তাঁর সদ্যোঢ়া যৌবনবতী পত্নীর কানে যে মন্ত্র দেন, তা বেশ মহোদাদর্শোচিত। সন্তানত্রয়ের মধ্যে বড় দুটিকে বলা হয়েছিল, তাদের মায়ের অসুখ করেছিল বলে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। এখন বলা হলো, তাকে বাড়ি নিয়ে আসা হচ্ছে। অতএব বধূ যেন বাড়িতে ঢোকার পর নববধূসুলভ আচরণ একেবারেই না করেন। এমত আভাস অবশ্য সম্বন্ধ করার প্রাক্কালেই তাকে দেয়া হয়েছিল। কেউ কেউ এমন আভাসও দিয়েছিলেন যে, এইসব কারণেই তাঁরা তালুকদার হওয়া সত্ত্বেও মায়ের মতো একটি গরিব ঘরের কন্যাকে বধূ করে আনছেন। এসবই আমার পরবর্তীকালে শোনা কথা এবং মায়ের কাছেই। কিন্তু আশ্চর্য তিনি যখন এসব কথা বলতেন, তাঁর আচরণে কোনো ক্ষোভ প্রকাশ পেত না। যেন এসব খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। এ ছাড়া এইসব সমস্যা সমাধানের আর উপায়ই-বা কী ছিল? মায়ের ভাবটি ছিল এরকমই। অথবা, ‘তয় এ্যারা করবেই-বা কী?
বাবা অভিনয়াদি বিষয়ে পারঙ্গম পুরুষ। বাড়িতে রঙ্গমঞ্চ বানিয়ে নাটকাদি করে থাকেন। এ কারণে নৌকোয় বসে নবোঢ়াকে যথাসম্ভব প্রয়াতা পত্নীর সজ্জায় সজ্জিত করতে তাঁর প্রচেষ্টার ত্রুটি ছিল না। তথাপি তাঁর পঞ্চবর্ষীয় জ্যেষ্ঠ পুত্রটি নাকি ‘হাসপাতাল’ থেকে ফিরে আসা এই মাতৃকাকে দর্শন করে ‘না, এ আমার মা না’ এরকম অভিমানে ফুঁসে উঠেছিল। বাকিদের অবশ্য এ সত্য উদ্ঘাটন করতে বেশ কিছুকাল সময় এবং উপযুক্ত সাহচর্য দরকার হয়েছিল। আমাদের মায়ের কপালে নতুন বউ হওয়া, অতএব, সম্ভব হলো না। তাঁর আগমনে বাড়িতে কোনো মঙ্গলবাদ্য বাজল না। এমনকি ব্যাপক হুলুধ্বনিও নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছিল। কারণ মাতৃহারা শিশুরা যেন ব্যাপারটি বুঝতে না পারে। তারা যেন হঠাৎ কোনো আন্তরিক আঘাত না পায়।
আমাদের কর্তাদের এইসব ব্যবস্থাপনা বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করব না। আমি শুধু ঘটনাগুলো মায়ের কাছে যেমনটি শুনেছি, তেমনটি বলছি। তবে কর্তাদের এই প্রচেষ্টায় আদৌ কোনো সুফলই যে পাওয়া যায়নি তাও জেনেছি। এই মা যে তাদের নিজের মা নন, তা বলে দেয়ার জন্য বাড়িতে স্পষ্টবাদী, স্পষ্টবাদিনীদের সংখ্যা আদৌ অপ্রতুল ছিল না। এখন আমি ভাবি, এক বছরের শিশুটি যখন এই মায়ের স্তন শোষণ করে কিছুমাত্র মাতৃরস সেখানে না পেয়ে তার সদ্যোত্থিত দু-একটি দুধ-দাঁতের দ্বারা তাঁকে দীর্ণ করত এবং তাঁর মুখের দিকে বোবা চোখে তাকিয়ে থাকত, তখন সেই দৃষ্টির মধ্যে হতাশা দেখে আমার মা শারীরিক এবং মানস যন্ত্রণায় কী মূক কান্নাটাই না কাঁদতেন। কিন্তু কোনো নারীই তাঁর এই যন্ত্রণার প্রতিকারের জন্য সেখানে ছিল না। যদিও ওই অঞ্চলে শিক্ষিতা নারীর আদৌ অভাব ছিল না। আড়াই বছরের খুকিটির তখন পুতুল খেলার বয়স সবে শুরু। তাই সে বড় বেশি তলিয়ে ভাবে না। এই মা তার কাছে খুব একটা অপছন্দেরও নয়, পরও নয়, উপরন্তু এই মায়ের আদর তথা উপঢৌকনও প্রচুর। তাই সে কোনো সমস্যা সৃষ্টি করে না। কিন্তু এহেন স্থিতাবস্থায় একান্নবর্তীর স্বার্থীরা তুষ্ট থাকেন না বলে নানাবিধ কথা বাতাসে ভাসে এবং যে যেমন অর্থে পারে তেমনই ভাষ্য করে। শিশুরা অতএব বড়দের অসভ্য অসভ্য বুদ্ধিতে বুদ্ধিমান হবার শিক্ষা পেতে থাকে। ইতোমধ্যে বছর ঘুরতে না ঘুরতে আমার সহোদর জ্যেষ্ঠ ভূমিষ্ঠ হলে ক্রমশ এই অসভ্যতা আরও বাড়তে থাকে এবং আমার অভাগিনি জননী তাঁর গর্ভজাত প্রথম সন্তানকে প্রকাশ্যে আদর-আহ্লাদ পর্যন্ত করতেও সক্ষম হন না। কেননা, একের আদর অন্যের অনাদর হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। আমার মা এই পরিবারে না নববধূ হিসেবে সম্মান পেলেন, না প্রথম মা হওয়ার গৌরব বোধ করলেন। কিন্তু অহোভাগ্য, একসময় আমার মা সবার সব ভ্রুকুটি এবং বিদ্রুপ তুচ্ছ করে এই তিনটি অমাতৃক শিশুর মাতৃত্বে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন এবং পারিপার্শ্বিক তাবৎ হীনতাকে তুচ্ছ করার মতো রুচিবোধের পরিচয় দেন।
নাটক করা, ফুটবল খেলা ছাড়াও বাবার আরেকটি অভ্যেস ছিল। সেটি পদ্যরচনা করা। আমার মাকে বিয়ে করার পর বাবা দীর্ঘকাল বোধ করি এক দ্বন্দ্বে ভোগেন। এ কথা মায়ের কাছে নানা গল্প-কথা শুনে এবং বাবার কবিতার খাতা পড়ে ধারণা হয়েছে। মাকে যে তিনি বঞ্চনা করেননি পদ্যগুলোতে তার যেন কৈফিয়ত শব্দিত। মায়ের বিয়ের কথাবার্তার শুরুর থেকেই যে ঢাকঢাক গুড়গুড় গোপনভাব শুরু হয়েছিল, তার একটা ধারাবাহিকতা শেষ পর্যন্ত সর্বার্থসিদ্ধকারী আদর্শায়নে স্থিতি পায়। মা, সামান্য গৃহস্থ ঘরের কন্যা, পিতৃহীনা, শিক্ষাদীক্ষায় নিতান্ত দীনা, উপরন্তু অত্যন্ত আত্মনিবেদনকারিণী। নিজস্বতা বা স্বকীয় সত্তা বলে কোনো বোধই নেই। তাঁর সেই তদ্গতপ্রাণতা, এই পরিবারের প্রয়োজনের নিমিত্তে আয়োজিত আদর্শায়নের এক অসম্ভব উর্বর ভূমি হিসেবে গ্রাহ্য হয় এবং মা অত্যন্ত কৃতজ্ঞতায়ই যেন সেই ভূমি হন। কৃতজ্ঞতা এ কারণে যে, তিনি গরিব ঘরের কন্যা আর এই বাড়িটির একটি রাজকীয় আভিজাত্য আছে।
মায়ের কথা ও কাহিনি এবং তাঁর এই পরিবারে প্রতিষ্ঠা লাভের যে ব্যাখ্যান তাঁর কাছ থেকে আমি শুনেছি তাতে মনে হয়েছে, যেন তিনি একদলা নরম মাটি এবং তাঁকে এক ইচ্ছেমতো গড়ন দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। মাও সেমতো তৈরি হতে পেরে কৃতকৃতার্থা হয়েছেন। তাঁর সামনে এ কারণে একটি অসম্ভব রম্য আদর্শ প্রতিমুহূর্তে উপস্থিত করা হতো। সেই আদর্শকে অতিক্রম করার বা বিরুদ্ধাচরণ করার শক্তি কিংবা শিক্ষা তাঁর ছিল না। তিনি প্রকৃতই বড় দীনা রমণী ছিলেন। চূড়ান্ত আত্মনিবেদনে, প্রায় ক্রীতদাসীর মতো সেই আদর্শকে বিশ্বাস করে তাঁর সেবার জগৎটা তৈরি করে নিয়েছিলেন। বলা বাহুল্য, এই সাধনায় তিনি সফলও হয়েছিলেন। বাবা নিজের দ্বন্দ্বের কারণে অথবা বিবেক দংশনের জ্বালা জুড়োতে এ সময় বেশ কয়েকটি পদ্য লেখেন। সেসব পদ্যের নির্গলিতার্থ একদিকে যেমন তাঁর প্রথমার বিদেহী আত্মার উদ্দেশে বেশ কিছু কৈফিয়ত যা তাঁর সন্তানত্রয়ের ওপর নজরদারির প্রায়োজনিকতা বিষয়ে সরব, অপরদিকে দ্বিতীয়ার প্রতি কর্তব্যপরায়ণতা, নারীর আত্মত্যাগ এবং নানাবিধ আদর্শ উচ্চারণে বড় সমৃদ্ধ। তথাপি পিতৃদেব যে সারাটি জীবন এক অপরাধবোধ নিয়েই কাটিয়ে গেছেন তা সম্যক দেখেছি।
মায়ের ক্ষেত্রে বিষয়টি অন্য চমৎকারিত্বের নমুনা। বাড়িতে স্থানীয় কোনো শিল্পীর আঁকা আগের মায়ের একখানি পোর্ট্রেট শোবার ঘরের দেয়ালে সুন্দর ফ্রেমে বাঁধানো। ছবির সামনে ঈষৎ বাড়ানো ওই ফ্রেমেরই একটি কাঠের বর্ধিত অংশ যার ওপর কিছু অর্ঘ্য বা উপাচার নিবেদন করা যায়। বাবার বাকশৈলীতেই হোক বা মনুষ্যের অগোচর স্ত্রীচরিত্রের কোনো গহন কার্যকারণেই হোক আমাদের মা তাঁর সতীনের প্রতি বড়ই ভক্তিমতী ছিলেন। স্মৃতি এ ক্ষেত্রে প্রায় পাথর প্রমাণ। যেহেতু এসব নিজেই স্বচক্ষে দেখেছি। মা ওই ছবির সামনে সকালের এবং বিকেলের চায়ের কাপটি পর্যন্ত নিবেদন না করে স্বয়ং গ্রহণ করতেন না। অন্যান্য ভোজ্যাদির তো কথাই নেই।
এর অনেক দিন পর, বাবা মারা গেলে, মা নিতান্ত যখন নিঃসঙ্গ, তখন তাঁকে একটি বাঁধানো খাতা কিনে দিয়ে বলেছিলাম, মা, সবসময় কান্নাকাটি না করে তোমার যা মনে আসে এই খাতায় লিখে রাখো। এমন একদিন আসবে যখন তুমিও তো থাকবে না, তখন এই খাতা তোমার হয়ে আমাদের সঙ্গে কথা বলবে। আর দেখবে লিখতে শুরু করলে তোমারও একটা অন্যভাব আসবে। তুমি স্মৃতিচারণ করতে করতে একসময় তোমার পরম আকাঙ্ক্ষার ধনকেও খুব কাছে পাবে। মা বলেছিলেন, আমি তো প্রায় নিরক্ষর। আমি কি তা পারব? বলেছিলাম নিশ্চয় পারবে। যেমন পারবে তেমন লিখবে। ভুল ধরার তো কেউ নেই। কিন্তু তিনি যে এই বুঝ দেয়া কথাটিকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন তখন তা বুঝিনি। এখন এই লেখা রচনা করতে বসে, তাঁরই এক হাত-বাসো থেকে বেরোল সেই খাতা। বলা বাহুল্য এ-খাতা এখন আমাদের কাছে এক বহুমূল্য ধন। তা সেখানে তিনি যা লিখেছেন তার কিছু উদ্ধৃতি বর্তমান ক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক হবে না। তিনি লিখেছেন—
‘বরিশালের ভাটিয়া গ্রামে আমার জন্ম। বাড়ির নাম কবিরাজ বাড়ি। দেড় বছর বয়সে আমার বাবা মারা যান। আমার দাদার তখন সাত বছর বয়স। দিদিকে বাবাই বিবাহ দিয়া গিয়াছিলেন। আমার জেঠতুতো ভাইয়েরাই আমাদের ভরণপোষণ করতেন, দাদার লেখাপড়ার খুব মাথা ছিল না। এবং কেহই সেরকম দৃষ্টিও দেয় নাই। মা অনেক দুঃখ করিয়া পরে আমার মামা সত্যপ্রসাদ সেনের বাসায় ওকে রাখিয়া আসিলেন। তিনি মায়ের পিসতুতো ভাই ছিলেন। বেশ পয়সা ছিল তার। তাই মা অনেক বলিয়া দাদাকে তাঁহার বাসায় রাখিয়া আসিলেন। সেই মামার অভিভাবকত্বে সে ছিল। দেখাপরা দূরের দূরের কথা তাহার দাদার সঙ্গে খুবই খারাপ ব্যবহার করিত। দাদা রোজ বাজার করিত, রোজ তাহাদের জামাকাপড় সাবানকাচা করিত, সকলের জুতা ব্রাশ করিত, বিছানা করিত, কয়লা ভাঙিত, ঘর ঝাঁট দিত। মায়ের কাছে দাদা এসব কিছুই জানায় নাই। মা একবার মামাকে লিখিয়াছিলেন ও কিছু রকম লেখাপড়া করে কি না। তাহার উত্তরে মামা লিখিয়াছিলেন তোমার ছেলের লেখাপড়ায় মোটেই মন নাই। ওর কিছুই হইবে না। আমি ভাবিয়াছি ওকে একটা দোকান করিয়া দিব। ১৫ টাকা দিয়া কী দোকান (নাকি তিনি) করিয়া দিয়াছিলেন। (মজার কথা) সেই দোকানের মাল তাহারা বাকি আনিয়াই নাকি দোকান নষ্ট করিয়া দিল।…পলতা মহালক্ষ্মী কটন মিলে আমার জেঠতুতো ভাই (দাদা) উইভিং মাস্টার ছিলেন। তিনি ওকে মিলে ঢুকাইয়া দিলেন। এতদিন পরে মা একটু নিশ্চিন্ত হইয়াছিলেন দাদার জন্য। আমি তখন বড় হইয়াছি। মার সবসময়েই চিন্তা কী করিয়া বিবাহ দিবেন, কীরকম পাত্রে দিবে।
‘আমার গার্জিয়ান ছিলেন আমার জ্যাঠামহাশয় এবং জেঠতুতো ভাইয়েরা। তাঁহারা যে সম্বন্ধ দেখিতেন, তাহা দ্বিতীয় পক্ষেই দেখিতেন। কারণ টাকাপয়সা যাহাতে কম লাগে।
মা একদিন বলিয়াছিলেন, যে আসে তাহাকেই তোমরা মেয়ে দেখাইও না। উহাতে মেয়ের দুর্নাম হয়। অথচ (তাহারা) দেনাপাওনার জন্যই ফিরিয়া যাইত। কিছুদিন পরে কেওরার (আমাদের বাড়ির) সম্বন্ধ এলো। এখান হইতে ৬/৭ বার দেখতে গেল। ফটো তুলিয়া ওদের বাবাকে দেখাইল। ওদের বাবা একখানা কাগজে একটা প্রশ্ন লিখিয়া দিয়াছিলেন “এখানে আসিলে প্রধান কর্তব্য কী” আমি উত্তর লিখিয়াছিলাম “শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা করা, মাতৃহীন শিশুদের পালন করা।” আমাকে যাহা বলিবার বিবাহের রাত্রিতেই সব বলিয়া দিয়াছিলেন। বলিয়াছিলেন, “তুমি ওদের মায়ের ফটো পুজো করবে এতে আমি খুব সুখী হব। ভাতে যদি পোড়া লাগে, তবু আমার ছেলেমেয়ের আব্দার আগে রক্ষা করবে। আমার ছেলেমেয়ের কাছে আমিও না (অর্থাৎ তুচ্ছ)।”
‘বিয়ের দিন রাত্রেই বলেছিলেন আজ তোমাকে নিয়ে যাব। আর কোনোদিন তুমি এখানে আসতে চাইবে না। তুমি ১৯ বছর তোমার মায়ের কাছে ছিলে। যখনই দেখিতে ইচ্ছা হইবে, তখনই তাঁহাকে আনিয়া দেখাইব। আজ যদি আমার ছেলেমেয়েরা তোমার সঙ্গ করিয়া শান্তি পায়, সেটাই তোমার শান্তি। আমি ঠিক সেইভাবেই চলিয়াছি। বলিতেন আমি ওদের মাকে কিছুতেই ভুলিতে পারিব না। তুমি ইহাতে দুঃখ পাইও না। আমি বলিতাম তুমি তাঁহাকে ভুলিও না। তাঁহাকে মনে রাখিয়াই আমাকে ভালোবাসিও তাহাতেই আমি সুখী হইব।
‘বিবাহের ২/৩ দিন পরেই দেখিতাম, বিছানায় বসিয়া কাঁদিতেছেন। আমি যখন শুইতে যাইতাম রাত্রে যেন প্রায়ই এরকম দেখিতাম। আমি তখন কী বলিয়া তাঁহাকে বুঝাইব। কিছুই বুঝিতাম না। একেবারে চুপ করিয়া থাকিতেও পারিতাম না। ভাবিতাম তিনি হয়তো মনে করিবেন আমার দুঃখ দেখিয়া কি ও অভিমান করিয়া থাকে? আমি বলিতাম দুঃখ করিয়া যখন লাভ নাই, তখন এত কাঁদাকাটা করিও না। আমাকে যখন জীবনের সাথী করিয়াছ, তখন তোমার দুঃখের কথাগুলো আমার কাছে বলো, কিছুটা তোমার দুঃখের ভাগ আমিও বহন করি। তুমি হয়তো মনে করিতেছ, আমি এসব কথা শুনিলে দুঃখ পাব। কিন্তু আমি তো প্রস্তুত হইয়াই আসিয়াছি তোমার দুঃখের ভাগ নেয়ার জন্য। নতুন করিয়া তোমাকে কোনো শান্তি আমি দিতে পারিব না সেটা আমি জানি। কিন্তু অশান্তি তোমার করিতে পারিব এটা তো ঠিকই। কারণ যেভাবে তুমি চলিতে চাও, সেখানে বাধা দিলেই অশান্তি হবে। তোমার ছেলেমেয়েকে আদর-যত্ন যদি না করি সেটাও তোমার অশান্তি হবে। তখন তিনি বলিয়াছিলেন এ কথা তুমি ঠিকই বলিয়াছ লাবণ্য। যে কোনোরকম অশান্তি এবং অসুবিধা হইলে স্ত্রীর কাছে আসিয়া যেরকম আশ্রয় পাওয়া যায়, সেরকম আর কোথাও পাওয়া যায় না। আমি আজ নিরাশ্রয়, তোমার কাছে আশ্রয় নিলাম। তখন আমার কাছে কাঁদিতে কাঁদিতে বাচ্চুর মা (অর্থাৎ তাঁর সতীন) সম্পর্কে অনেক কথা বলিয়াছিলেন।
‘বলিয়াছিলেন আমি আমার বাবার একমাত্র ছেলে এবং এক বিশাল সম্পত্তির অধিকারী। কিন্তু (এরা) আমার লীলার সহিত (সতীন) যে ব্যবহার করিয়াছে সেটা আমি লিখিয়া রাখিলে একটা ইতিহাস হইত। আমার মা-বোন এবং তাঁদের সহায়তায় অন্যেরাও তাহার সবসময় দোষ খুঁজিয়াছেন। আমার মনে হয় এদের অত্যাচারই তার এত তাড়াতাড়ি মৃত্যুর কারণ।
‘তাই তোমাকে বলিতেছি তুমি (এদের) সত্মা হইয়া সংসারে ঢুকিয়াছ তোমার ওপর আরও অত্যাচার হইবে। এ জন্য তুমি মন খারাপ করিও না। হয়তো আমিও তোমার খোঁজখবর সবসময় নিতে পারিব না।’
সে যুগের প্রেক্ষিতে কথাগুলো বড়ই মনোমুগ্ধকর। কিন্তু আজকের বিচারে ‘মা’ নামক সেই ব্যক্তির কী মূল্যায়ন আমরা করব তা ভেবে পাই না।
একদিন এই সতীনের উদ্দেশ্যে নিবেদন-রহস্য ভেদ হলো। মায়ের কাছে জানতে চেয়েছিলাম। এর অর্থ কী? এসব কেন? তখন অনেকটা বড় হয়েছি। মা পরিণতবয়স্কা এবং সম্পূর্ণ গৃহিণী। বলেছিলেন, এর অর্থ বোঝানো বড় শক্ত। আমার মনের মধ্যে সেই প্রথমদিন থেকেই একটা কথা ঘুরপাক খাচ্ছে যে, দেখো, তোমার ঘর, তোমার সংসার, তোমার ছেলেমেয়ে সব আমি দখল করে বসেছি তোমার স্বামীও এখন আমার। তুমি আমার অপরাধ নিও না। আমি তোমার কাজই করে যাচ্ছি। নচেৎ আমি কেউ না, কিছু না। তোমার ইচ্ছার মধ্যেই আমি ঢুকে পড়েছি।—মায়ের এই মানসিকতার কোনো পরিবর্তন তাঁর জীবৎকালে কোনোদিন দেখিনি। আমাদের পিছারার খালের দুই পারে কোনো ব্যক্তির দ্বিতীয় পক্ষে এমনকি তৃতীয় পক্ষেও বিবাহ কিছু কম ছিল না। কিন্তু সেসব স্থলে প্রয়াতার প্রতি জীবিতার মনোভাব যেসব শব্দে উচ্চারিত হতো তার উল্লেখ না করাই ভালো। আবার সেসব ক্ষেত্রে প্রয়াতার সন্তানদের দুর্গতির কথাও বেশ মনে আছে। এ কারণে আমার মাকে অনেক বড় মাপের একজন মানুষী হিসেবেই স্মরণ করি, শুধু মা হিসেবে নয়।
তিনি লিখেছিলেন, ‘…আমার নিজের মনে হয়, আমি খুব অসহিষ্ণু ছিলাম না, ঝড়ঝাপটা ঝামেলা জীবনে কম আসে নাই, কিন্তু সবই আমি হজম করিয়া নিয়াছি। সাময়িক হয়তো কিছু সময় আমি দুঃখ পাইয়াছি, কিন্তু ঘরে অশান্তি না হয়, এ চেষ্টা আমি সবসময়ই করিয়াছি। কারণ এ জিনিস (অশান্তি) আমি বেশি সময় সহ্য করিতে পরিতাম না।
‘আমার (আজ) মনে হয়, আমার দাম্পত্যজীবনটা অনেকের চাইতে একটু অন্যরকম ছিল। অনেক (অত্যাচার) সহ্য করিয়া যাহা পাইয়াছিলাম সে জিনিস বোধহয় সকলের ভাগ্যে জোটে না। আমি শান্তি পাইয়াছিলাম।’
মা আমাদের বাড়িতে নববধূ হিসেবে গৃহীতা হননি বটে। তবে একসময় গোটা গ্রামের মানুষদের কাছে সোনাবউ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন। পিছারার খালের বৈকালি জোয়ারের সময় তাঁকে আমি সাঁতার কাটতে দেখেছি, সে ছবি মনে আছে। আমার স্মৃতি-চৈতন্যে এখনও দিব্য টাটকা ওইসব ছবি ধরা আছে যে, তাঁর সঙ্গে গাঁয়ের সোমত্ত মেয়ে-বউরা কেমন হুটোপুটি করে জল খাবলাত আর কলকলি জোয়ারি জলের সঙ্গে সখীপনা করত। আজও আমার বুকের মধ্যে এইসব অলেখা আয়োজন এক ব্যাপক জমি জুড়ে যেন তাম্বু গেড়ে বসে আছে, আর যখন-তখন সেই তাম্বুর ছাউনি থেকে বেরিয়ে এসে গান ধরছে—
আগো ধ-লা জল
ভালোনি আছে গো আমার
বাপ ভাই সকল
মোর বাপেনি চিন্তায় মোরে
ভাই এরা চঞ্চল?
আগো ধলা জল।
এ গান কবে শুনেছিলাম, আমার মা-ই গেয়েছিলেন কি না, আজ আর তা মনে নেই। তবে ছড়া কেটে কেটে এখনও তারা ওই তাম্বুর ভেতর থেকে নাচতে নাচতে বেরিয়ে আসে, বলে ‘ধলা জল জোয়ারের পানি–কোন দূরের থিকা আইছেন জানি,—তারানি জানেন মোর বাপ-ভাইয়ের কুশল। ধলা জলের মেলা কথা, যে বোজে তার বাজে ব্যথা, মুই বাপসোয়াগি মোরও পরান নিত্য টলোমল।’
এ কারণেই পিছারার খালের ওই ‘ধলা’ জলের আখ্যান। সোনাবউ, বউ হয়ে আসার পর, আর কি চটজলদি এই খালের উজানি সোঁতা, যে সোঁতা তাকে বাপের বাড়ির সোঁতাখালে নিয়ে যাবে, তা দেখেছেন? দেখেননি। এ কারণেই বৈকালে গা ধোয়ার সময় তাঁর তাবৎ কথা তো ওই ধলা জলের সঙ্গেই হতো, যে ধলা জল তাঁর বাপের বাড়ির ঘাট ছুঁয়ে এসেছে। বউদের বাপের বাড়ি যাওয়া যে ঝকমারির, তা তো সবাই জানেন। তা সেকালেও যেমন একালেও কিছু কম নেই। কিন্তু একালে জোয়ারের ‘পানি’ ছুঁয়ে কোনো বউ কি বাপের বাড়ির স্পর্শ পায় বা পেতে চায়? জানি না।
আমার মা সোনাবউয়ের ‘গঙ্গাজল’ লক্ষ্মীমণি বোষ্টমি ‘খ্যানে অখ্যানে’ তাঁকে দেহতত্ত্বের পদ শোনাত
কারবা খাঁচা কেবা পাখি
কারে আপন কারে পর দেখি
কার লাগিবা ঝুরে আঁখি
তখন, মায়ের যেমন ভাব ছিল, তিনি কি এ গানেই তাঁর গঙ্গাজলের তত্ত্বের প্রত্যুত্তর করতেন–
নাইওর না গেলাম মুই
বছর বারমাস
ও মোর না পুরিলও মনের সাধ
না মিটিল আশ
মুই না দেখি বাপের মুখ
না দেখি ভাই ধনের সুখ
মুই না হেরি মায়েরও দুঃকও
পানে হা হুতাশ
ধলা জল পিছারার খালে ধেয়ে এসে ঢোকে, আবার ধেয়ে নেমে যায়। সোনাবউ যতক্ষণ গা ধোয় তাঁর শান্তি। কী? না, তাঁর বাপের বাড়ির পিছারার সোঁতা ধরে অনেক বড় বড় খাল, নদীনালা পেরিয়ে এই পিছারার খালে এসে তাঁকে শীতল করছে এই জল। সব আত্মজনের স্পর্শ মাখানো এই জল। এই বোধের নির্যাস নিয়েই বোধ হয় গহন বাংলার ভাটিয়ালি জগৎ জয় করে। কিন্তু সে যেথায় করে, করে। সে কি তার এই বাণী নিয়ে সাধারণ্যে পৌঁছেছে? পৌঁছয়নি। সে কারণে আমার মায়ের গান এই উপমহাদেশে কেউ শুনল না, জানলও না, ভাবলও না। আমার মায়ের মতো মায়েরা সবাই কোথায় যে হারিয়ে গেল?