বিষাদবৃক্ষ – ৪২

বেয়াল্লিশ

এইসব ডামাডোল সাময়িকভাবে স্তিমিত হলে কয়েক দিনের জন্য বাড়িতে চলে এলাম। বিগত কয়েক মাসের মধ্যে মাত্র বার দুয়েক বাড়ি গিয়েছিলাম। এবারে এসে দেখলাম ছাত্র পড়ানোর ব্যবস্থাটি বন্ধ হয়ে গেছে। সংসারের হাল খুবই খারাপ। কিন্তু তখন কিছুই করার উপায় আমার ছিল না। ভেবে দেখলাম, এখন যদি আমি সংসারের কথা ভাবতে বসি তবে দুই মাস বাদে যে পরীক্ষা দিতে হবে, তার সমূহ বিঘ্ন ঘটবে। উপরন্তু, আমার পরীক্ষা-প্রস্তুতিও আশানুরূপ হয়নি। টেস্টের ফলাফল দেখে আমাকে উদ্যোগ নিতে হবে। সংসারের হাল তো বরাবরই এরকম। এভাবেই চলুক। বরং আগামী বছরে কলেজ করার সময় শুরু থেকে কিছু ছাত্রছাত্রী জুটিয়ে যদি কিছু সহায়তা করা যায়, সেই চেষ্টা দেখতে হবে।

বাড়ি আসার সময় অহীনকে বলে এসেছিলাম যে, ইতোমধ্যে টেস্টের ফল বের হলে সে যেন লিস্টটি দেখে আসে এবং ফাইনাল পরীক্ষার ফর্মটিও তুলে রাখে। ফিরে গিয়ে দেখলাম টেস্টের ফল বের হয়েছে ঠিকই তবে লিস্টে আমর নাম তোলা হয়নি। ব্যাপারটা ঠিক বোধগম্য হলো না। পরিচিত কাউকে পেলামও না। সন্ধেবেলা অহীন অফিস ফেরত এসে আমাকে যা বলল, তাতে প্রায় মূর্ছিত হয়ে পড়ার মতো অবস্থা। জীবনে আঘাত কিছু কম পাইনি, কিন্তু অহীনের দেয়া সংবাদটি ছিল কঠিনতম আঘাত। এর জন্য আদৌ প্রস্তুত ছিলাম না। পড়াশোনার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা আমার বিধিলিপি। কিন্তু এ ক্ষেত্রে যে বিধিলিপিটি ছিল তার তুলনা হয় না। অহীন জানাল যে, লিস্টে নাম না দেখে সে খোঁজখবর করে জানতে পেরেছে আমার সারা বছরে মাইনে না দেয়ার জন্য রেজাল্ট উইথহেল্ড রাখা হয়েছে। অহীন আমার scholarship প্রসঙ্গে কথা তুলেছিল, কিন্তু অফিস-ক্লার্ক জানিয়েছেন যে, তাঁর কাছে এরকম কোনো খবর নেই। অতএব মাইনে বাবদ একশো কুড়ি টাকা জমা দিলে তবেই ফল প্রকাশ করা তথা ফর্ম ফিলাপ করার প্রশ্ন ওঠে। তার কথা শুনে আমার চোখের সামনে অন্ধকার নেমে আসল। একশ কুড়ি টাকা তখনকার দিনে অনেক টাকা। তারপর ফর্ম ফিলাপের সময় পরীক্ষার ফি হিসেবে নিশ্চয়ই আরও কিছু টাকা লাগবে। ফর্ম জমা দেবার শেষ তারিখ আর মাত্র দুদিন বাদে। এর মধ্যে বাড়ি গিয়ে যে কোনো উপায় করব তার সময় নেই। কারণ বাড়ি গেলেই যে টাকা জুটবে সেরকম সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। যথেষ্ট সময় থাকলে হয়তো কিছু বিক্রিবাটা করে বাবা দিতে পারতেন। কিন্তু আসল সমস্যা অত সময় নেই। এই শহরেও আমার এমন কোনো বন্ধুবান্ধব নেই যার ক্ষমতা আছে এতগুলো টাকা ধার দেয়ার।

প্রকৃতপক্ষে এই ব্যাপারটার জন্য আমি কাউকেই দায়ী করতে পারি না একমাত্র নিজের মূর্খামিকে ছাড়া। আমর নির্বুদ্ধিতা এ ব্যাপারে প্রায় পাহাড়প্রমাণ। ভর্তি হবার পর আমি কোনো দিন আর কলেজের অফিসে যাইনি। আমার ধারণা ছিল অফিস যথাসময়ে আমায় জানাবে। কিন্তু সেখানে অন্য কোনো স্বার্থান্বেষী অকারণে আমার ক্ষতি করতে পারে, তা আমার বিশ্বাসে ছিল না। আমি যথাসময়ে ব্যাপারটির খবর পাইনি বলেই এই অঘটন ঘটল। আমি এই ঘটনায় যারপরনাই ভেঙে পড়লাম। অহীন বলল, এখনই অত হতাশ হচ্ছ কেন? এখনও তো সময় আছে। চলো টাকা জোগাড়ের চেষ্টা করি। আমরা প্রথমে সেদিন সন্ধ্যাবেলায়ই ঘনিষ্ঠ সহপাঠীদের সঙ্গে পরামর্শ করলাম। এদের মধ্যে আমাদের প্রসন্নকুমার বিদ্যালয়েরও দু-একজন ছাত্র ছিল। তাদের মধ্যে একজন বলল, এ ব্যাপারে একমাত্র বিনয়বাবুই সমস্যা মেটাতে পারেন। চলো তাঁর কাছে যাই। বিনয় সেনমশাই কীর্তিপাশার ছোটহিস্যার জমিদারি দেখতেন। তখন জমিদারি নেই, তবু নানান বিষয়কর্মের খাতিরে তিনি ওই শহরেই বাস করছেন। ছোটহিস্যার জনৈক কর্তার ভাগনে হবার সুবাদে সেই ভদ্রলোক মারা গেলে তিনি জমিদারির কর্ম দেখাশোনা করতেন। সবাই বলল, এটা তাঁর করা উচিতও বটে। কারণ একসময় তিনি স্কুলের একজন কর্মকর্তাও ছিলেন এবং আমি ওই স্কুল থেকে ভালো ফল করেছিলাম। তখন জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলেও আমরা এরকম ভাবনা, চিন্তায় অভ্যস্ত ছিলাম। কিন্তু সমস্যা হলো বিনয়বাবু আমার বাড়ির কর্তাদের বিলক্ষণ চিনতেন। এ কারণেই তাঁর কাছে গিয়ে যে হাত পাততে পারি না এই কথাটা সবাইকে বললাম। এখানে ইজ্জত এবং আভিজাত্যের প্রশ্নের সঙ্গে আরেকটি ব্যাপার ছিল, তা হলো বিনয়বাবুর ব্যঙ্গোক্তির ভয় আর জ্যাঠামশাইয়ের কাছে খবর গেলে তাঁর প্রতিক্রিয়া। তিনি যদি বাবা বা জ্যাঠামশাইয়ের কথা এবং এ ব্যাপারে তাঁদের ঈদৃশ ঔদাসীন্যের বিষয় কিছু জিজ্ঞেস করেন আমি কী উত্তর দেব? বিনয়বাবুকে আমি যতদূর জানতাম তাতে বরাবর তাঁকে খুব দাম্ভিক বলেই মনে হয়েছে। অতএব আমি কখনওই তাঁর কাছে যেতে পারব না। এসব শুনে অহীন বলল, ঠিক আছে, তুমি নিজে নাই-বা গেলে, আমরা কয়েকজন তো তাঁর কাছে গিয়ে আবেদন করতে পারি। সবাই একবাক্যে অহীনের প্রস্তাবে সায় দিল। আমি অহীনকে বলে দিলাম, দেখো ভাই, ব্যাপারটা কোনোক্রমেই যেন আমার জ্যাঠামশাইয়ের কানে না ওঠে। অহীন আমাকে ভরসা দিয়ে বলল, ভয় নেই, আমি বিষয়টা কায়দা করেই তাঁর কাছে উত্থাপন করব। ঠিক হলো পরের দিন সকালে তারা সবাই বিনয়বাবুর বাসায় যাবে।

এই সময়টায় বউদি ওখানে ছিলেন না। তাঁর শিশুকন্যাটিকে নিয়ে তিনি পশ্চিমবঙ্গের দুর্গাপুরে তাঁর ভাইয়ের কাছে গিয়েছেন। তাঁর পাসপোর্ট এবং অন্যান্য প্রয়োজনের জন্য দাদার বেশ খরচ হয়েছে। অতএব তাঁর কাছেও কোনো সাহায্য পাওয়া যাবে না। আমি বাড়িতে থাকার সময়েই বউদি চলে গেছেন। ছেলেরা সব বাড়িতেই আছে। সে আর এক চিন্তা। আমি এসেই এই ফ্যাসাদে পড়লাম, এখন তাদের দেখাশোনাই বা কীভাবে করব, বুঝে উঠতে পারছিলাম না। দাদার সঙ্গে এখনও এসে পর্যন্ত দেখা হয়নি। চাকরটি এবং মাসিমা ছেলেদের দেখাশোনায় আছে। দাদার কাছে আমি কখনো পয়সাকড়ি চাইনি, বর্তমান অবস্থায় তা ভাবতেও পারলাম না।

রাতে খেতে বসে দাদা বললেন যে, বউদি না আসা পর্যন্ত ছেলেদের দেখাশোনার ভার তিনি বিশেষ করে আমার ওপর দিয়ে গেছেন। আমি যেন এর মধ্যে আর বাড়ি না যাই। দাদাকে একটু গম্ভীর মনে হলো। খাওয়া সেরে দাদা ওপরে চলে গেলেন। আমি চাকরটিকে জিজ্ঞেস করলাম, দাদা গম্ভীর কেন? সে জানাল যে, বউদি যাবার পর থেকে ছেলেরা অসম্ভব দুষ্টুমি শুরু করেছে। আশপাশের বাসা থেকে রোজ নালিশ আসে। এ জন্য তাঁর মেজাজ খারাপ। দুপুরে খেতে এসে নাকি জিজ্ঞেস করেছিলেন, আমি কখন এসেছি এবং কোথায় গিয়েছি। চাকরটি জানত আমি কলেজে গিয়েছি। সে তাঁকে তা-ই বলেছে। বাড়ি থেকে ফিরলে দাদা সাধারণত মা, বাবা, ভাইবোনদের খোঁজ নিতেন। এবার দেখলাম তা করলেন না। আমি একটু আতঙ্কিত হলাম।

পরদিন ভোরে দাদা আমাকে জল ধরার জন্য ডাকলেন না। রাঁধুনি চাকরটিই জল আনল। চা-জলখাবার খেয়ে অফিসে যাবার সময় দাদাকে আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কি আমার ওপর কোনো কারণে রাগ করেছেন? দাদা আমার দিকে একবার কীরকম যেন এক কঠিন দৃষ্টিতে তাকালেন এবং চোখ ফিরিয়ে নিয়ে কিছুই না বলে চলে গেলেন। ব্যাপারটা আমার ভালো বোধ হলো না। অথচ আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না আমার অপরাধটা কী। রাঁধুনি বলল, দাদা কিন্তু মনে হয় আপনার ওপর রেগে আছেন। বউদি বাড়ি নেই তো, তাই। কিন্তু আমি আমার কর্তব্যাকর্তব্য কিছুই ঠিক করতে পারছিলাম না। আমাকে আজকের এবং কালকের এই দুটো দিন হয়তো পুরোটাই নিজের প্রয়োজনে লাগাতে হবে। এইসব চিন্তা করে চাকরটিকে বললাম, ভাই, আমি একটা অসুবিধেয় পড়েছি। আজ এবং কাল এই দুটো দিন তুমি একটু ছেলেদেরকে সামলাও। পরশু থেকে সব ভার আমার। সে বলল, ঠিক আছে। আপনি ভাববেন না। আমি দেখব।

দাদা যাবার খানিকক্ষণ বাদেই অহীন এলো। বলল, এক কাজ করো। তুমি কলেজে গিয়ে Scholarship-এর বিষয়টা নিয়ে খোঁজখবর করে দেখো। হয়তো এসে পড়ে আছে। একটু নরম হয়ে ক্লার্ককে বোলো, নিশ্চয়ই রেকর্ড খোঁজ করে পেয়ে যাবে। যদি পায় তবে তো সমস্যা নেই। যাই হোক, বারোটার মধ্যে সোনালি সিনেমা হলের সামনে এসো, আমরা ওখানে থাকব। দেখি বিনয়বাবু কী বলেন।

বিনয়বাবু আমাদের ও অঞ্চলে একজন মান্যমান মানুষ। যদিও তাঁর জমিদারি এবং ঠাঁটবাট সবই মামাবাড়ির দৌলতে, তবু ছোটহিস্যার জমিদার হিসেবে বাল্যাবধি আমরা তাঁকেই জেনেছি। তিনি তাঁর স্ত্রী-পুত্র ইত্যাদিদের অন্যত্র রেখে ছোটহিস্যার প্রাসাদেই থাকতেন এবং জমিদারি তথা তাঁর পিসতুতো দাদার স্ত্রী, পুত্র, কন্যাকে দেখভাল করতেন। স্থানীয় লোকেরা তাঁকে খুব ভালো মানুষ বলে জানত না। অতএব অহীনেরা সেখানে কী ব্যবস্থা করতে পারবে, সে ব্যাপারে

বিষাদবৃক্ষ ৩৩৭

আমার বিলক্ষণ সন্দেহ ছিল। শেষ পর্যন্ত আমাকে না একটা অসম্মানজনক পরিস্থিতিতে পড়তে হয়।

যা হোক দশটা বাজার আগেই আমি ব্রজমোহন কলেজে গেলাম। কলেজে তখন ক্লাস বন্ধ। শুধু ফর্ম জমা নেয়ার জন্য অফিস খোলা ছিল। খানিকক্ষণ বাদে ক্লার্ক এলে তাঁর কাছে গিয়ে বিস্তারিত সব বলার চেষ্টা করলাম। কিন্তু অচিরেই বুঝলাম তিনি আমার কথা শুনতে আদৌ আগ্রহী নন। আমি তথাপি বললাম, দেখুন নিশ্চয়ই Scholarship-এর টাকাটা এসেছে। আমি ভয়ানক বিপদে পড়েছি। ওটা না হলে যে পরীক্ষার ফর্ম ফিলাপ করতে পারব না। লোকটি কী কারণে জানি না আমার সঙ্গে অত্যন্ত যাচ্ছেতাই ব্যবহার শুরু করল। বলল, জামাকাপড়ের ছুরত দেইখ্যা তো মালুম অয়না যে কলেজে পড়ো। হ্যার উপর আবার ‘এস্কালরশিপ’? খোয়াব দ্যাখথে আছ নাহি? যাও যাও। আগে মায়নার টাহাডা লইয়া আও যাইয়া, হ্যার পর দেহুম হ্যানে। বুঝলাম আর কথা বলে কিছু লাভ হবে না। এখানে আমার এমন কেউই নেই, যে আমার পাশে অন্তত দাঁড়ায়। অগত্যা কলেজ ছেড়ে রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম। ক্লাস বন্ধ থাকায় ইউনিয়নের কেউ আসেনি, সুতরাং প্রতিবাদের কোনো সুযোগই নেই। লোকটি একটু রেকর্ডটা খুলে পর্যন্ত দেখল না।

সম্পূর্ণ উদ্ভ্রান্তের মতো হাঁটতে হাঁটতে কলেজ থেকে সোনালি হলের সামনে এসে অহীনদের পেলাম। তখন সাড়ে বারোটা বাজে। অহীন বলল, না বললেও বুঝতে পারছি সুবিধে করতে পারোনি। আসলে ক্লার্ক লোকটাকে আমার সেদিনও খুব সুবিধের মনে হয়নি। ও কিছু একটা লুকোচ্ছে। Scholarship-এর ব্যাপারে ও কিছু বদমায়েশি করে থাকলেও আশ্চর্যের কিছু নেই। যা হোক, তোমাকে বিনয়বাবু এক্ষুনি যেতে বলেছেন। উনি কাছারিঘরেই আছেন। চলে যাও। মনে হয় হয়ে যাবে। তিনি আমাদের কথা দিয়েছেন। অহীন আরও বলল, আমার মনে হয় তোমার ব্যাপারটা আমি তাঁকে ঠিক ঠিক বোঝাতে পেরেছি। উনি বললেন, এ আর এমন কী কথা, ওকে আমার সঙ্গে এক্ষুনি দেখা করতে বলো। সুতরাং তুমি আর দেরি না করে যাও। ওখান থেকে সোজা বাসায় গিয়ে খাওয়াদাওয়া করো। আমি বাসায়ই থাকব। আজ আর অফিসে যাব না।

ওরা সবাই চলে গেলে আমিও বিনয়বাবুর কাছারির দিকে যাত্রা করলাম। মাথার মধ্যে ভালোমন্দ কোনো কিছুই কাজ করছিল না। কীরকম এক অসহায় শূন্যতা যেন আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলছিল। এই সময় অশ্বিনীবাবুর কথা মনে পড়ল। যদি সময় হাতে থাকত তবে তাঁর কাছে গেলে সমস্যার অবশ্য সমাধান হয়ে যেত। কিন্তু তার আর উপায় নেই। এইভাবে চলতে চলতে একসময় বিনয়বাবুর কাছারিতে পৌছোলাম। কালো চশমা পরা, ফরসা গায়ের রং গোলগাল বিনয়বাবু ততোধিক ফরসা ধুতি-পাঞ্জাবি পরে বসে রয়েছেন। গিয়ে প্রণাম করে দাঁড়াতে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তোমার জন্যই ছেলেরা সুপারিশ করতে এসেছিল বুঝি? প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গে আমাকে আপাদমস্তক একবার দেখে নিলেন। পরে একটি দীর্ঘশ্বাস মোচন করে বললেন, অমুকের ছেলে তুমি? তোমার এই দুর্দশা। আমি নিশ্চয়ই তোমার ব্যবস্থা করব। আচ্ছা তুমি এই টাকাটা ধরো—বলে একটা কুড়ি টাকার নোট বাড়িয়ে দিলেন। বললেন, একশ কুড়ি টাকার মধ্যে কুড়ি টাকা হয়ে গেল, বাকি রইল একশ। আচ্ছা চলো আমার সাথে—বলে একটি রিকশা ডেকে তাতে আমাকে নিয়ে উঠলেন। রিকশাওয়ালাকে নির্দেশ দিলেন জনৈক উকিলবাবুর বাসায় যেতে। আমি বুঝতে পারছিলাম না তিনি ঠিক কী করতে চলেছেন। তাই একটু ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করলাম, ওখানে আমরা কেন যাচ্ছি? তিনি বললেন, বুঝলে না অত টাকা তো আমি একা দিতে পারব না, তাই সবার কাছ থেকে কিছু কিছু, মানে তোমার জন্য এ কাজ আমাকেই করতে হবে। সারা জীবনই তো দেশের কাজ করেছি। খদ্দর ছাড়া পরিনি, দিশি ছাড়া বিদেশি কিছু ব্যবহার করিনি। আমরা ছিলাম মহাত্মাজির চেলা। এখন তো দিনকাল পালটে গেছে। সে একদিন ছিল বুঝলে, বলে অনর্গল নিজ গৌরবগাথা গাইতে লাগলেন। ব্যাপারটা বুঝতে আমার সময় লাগল না যে, উনি আমাকে একজন ভিখিরির মতো ব্যবহার করে কিছু পয়সা তুলবেন এবং আমার প্রয়োজন মিটবার পর যদি বাড়তি কিছু থাকে তা নিজের পকেটে চালান করবেন। ভদ্রলোক কিন্তু অসামান্য বাগ্মী ছিলেন। সে যুগের ল’ পাস করা ধুরন্ধর মানুষ। এইসব মানুষদের আমি চিনেছিলাম জ্যাঠামশাইকে আদ্যন্ত দেখে। এঁরা স্বার্থের জন্য না পারেন এমন কোনো কর্ম নেই, বিশেষত যে সময়কার কথা আমি লিখছি, সেই সময়।

আমি চলতে চলতে একসময় তাঁকে থামিয়েই বললাম, আজ্ঞে আমি তো টাকাটা ধার হিসেবেই চেয়েছি। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শোধ দিয়ে দেব। বিনয়বাবু খুব অমায়িক হেসে বললেন, দেখো যার শোধ দেবার ক্ষমতা আছে, সে-ই ধার নেয় বা ধার চাইলে পায়। আমি খোঁজখবর করে যতদূর জেনেছি তোমার পক্ষে তো দূরস্থান, তোমার বাপ-জ্যাঠারও তো ধার শোধ করার ক্ষমতা নেই। সুতরাং এ ছাড়া আর কীভাবেই-বা টাকাটার জোগাড় হতে পারে? আমি রিকশাওয়ালাকে থামতে বললাম। সে থামলে, আমি নেমে পড়ে বললাম, মাপ করবেন, আমি ভিক্ষে করতে পারব না। আর আপনার এ টাকাটাও আপনিই রাখুন। কথা কয়টি বলে আমি এক উন্মাদের মতো ছুটতে লাগলাম। মাথার মধ্যে এক অবর্ণনীয় যন্ত্রণা এবং ক্রোধ যেন গর্জন করছিল। অশ্বিনীবাবু বলতেন, যাজ্ঞা মোঘাবরমধিগুণে নাধমে লব্ধকামা। বাবাও বলতেন। কালিদাস উদ্ধৃত করতেন তাঁরা। কিন্তু এই শ্লোক উচ্চারণের প্রকৃত ক্ষেত্র বোধহয় তাঁদের কাউকে কোনো দিন প্রত্যক্ষ করতে হয়নি।

আমি ছুটছি তো ছুটছি। আমার ফর্ম ফিলাপের প্রয়োজন নেই, পরীক্ষা আমি দেব না, আমার জীবনে মানুষ হয়ে ওঠারও কোনো প্রয়োজন নেই। জীবনবাবুর পাঠশালায় আমার যথেষ্ট শিক্ষালাভ হয়েছে। এবার সবকিছু থেকে বিদায় নেব। পড়াশোনা, সংসার, ভাইবোন, মা, বাবা, তাদের রক্ষণাবেক্ষণ কোনো কিছুই আর প্রয়োজন নেই। শুধু লেখাপড়ার জন্য এত লাঞ্ছনা আর অপমান সহ্য করার কোনও হেতু নেই। অশ্বিনীবাবু আমাকে ভুল বলেছিলেন যে, লেখাপড়ার জন্য যে কোনো লাঞ্ছনা বা অপমানই গ্রহণ করা যায়। বাস্তব ক্ষেত্রে আমি বুঝলাম, তা যায় না, আমি কোনও কারণেই নিজেকে ভিখিরি বা পরপদলেহী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে রাজি নই। অনেক শৈশবকাল থেকেই শ্রমকে পুঁজি করেছি। শুধু বংশ-কৌলীন্যের জন্য পড়াশোনাকে ভবিষ্যৎ পেশার উপকরণ করার স্বাভাবিক যে কার্যকারণ তাকে আমি আজ থেকে ত্যাগ করলাম। আমার শ্রমই আমার পুঁজি হোক, শ্রমই ইষ্টদেবতা হোক এবং সেই শ্রমের ফল আমি একাই কেন ভোগ করব না, এরকম এক স্বার্থচিন্তাও আমার মধ্যে কার্যকরী হলো অন্তত সেই সময়। শৈশবাবধি শ্রমকে আশ্রয় করে যদি এতদূর আসতে পেরে থাকি, অতঃপরের জীবনযাপনও সেই শ্রমের মাধ্যমেই করতে পারব। কিন্তু ভিক্ষা করতে পারব না।

সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত অবস্থায় যখন বাসায় ফিরলাম তখন তিনটে বেজে গিয়েছে। খিদে, ক্লান্তি বা অনুরূপ কোনো শারীর বিকার বোধ করছিলাম না তখন। জানি না ওই সময় আমাকে কেমন দেখাচ্ছিল। মনে হয় ওই সময়ে যদি কাউকে, অর্থাৎ এই লাঞ্ছনার জন্য যারা দায়ী তাদের কোনো একজনকে খুন করতে পারতাম তাহলে কিছু আরাম হতো। শরীরের সমস্ত রক্ত যেন নিজ চলাচলের পথ পরিত্যাগ করে মাথায় এসে জড়ো হয়েছিল তখন।

দাদা তখনও দুপুরের খাওয়া খেতে আসেননি। ছেলেরা কে কোথায় আছে সে বিষয়ে খোঁজ নেয়ার মতো মানসিকতা আমার ছিল না তখন। চাকরটিকে বললাম—আমি অত্যন্ত ক্লান্ত, যদি সে তাদের খাওয়াদাওয়া ইত্যাদি বিষয়টা দেখে। সে জানাল যে, তারা খাওয়াদাওয়া করে নিয়েছে। কিন্তু তাদের সংযত রাখা তার সাধ্যের অতীত। তারা এখন কে কোথায় আছে তা তার জানা নেই। সে আমার চেহারা দেখে খুবই আতভাবে জিজ্ঞেস করল, আপনাকে এরকম দেখাচ্ছে কেন? আপনার কি কিছু ঝঞ্ঝাট হয়েছে? বললাম, ভাই, আমার যা হয়েছে তা তোমাকে বলে কিছু লাভ নেই। আমার এতদিন এখানে এই কষ্টস্বীকার করে থাকা ব্যর্থ হলো। সে সব কথা শুনে খুবই দুঃখিত হল। খুবই সরলভাবে বলল, আমিও আপনার ওপর খুব অন্যায় করেছি। আমি ভেবেছিলাম আমি এ বাড়িতে যেমন, আপনিও তেমনই। এ কারণে মনে একটা ঈর্ষা ছিল। কিন্তু আহা। আপনার ভাগ্য যে এত খারাপ তা যদি জানতাম। যদি সে তা জানত, তাহলে কী হতো তা নিয়ে ভাববার মানসিকতা তখন আমার ছিল না। আগামীকালের মধ্যে ফর্ম ফিলাপ করতে পারব কি না, সেই চিন্তাই মনের মধে প্রকট ছিল তখন।

লোকটি ছেলেদের খোঁজ করে ধরে বেঁধে কোনোক্রমে খাইয়েদাইয়ে ওপরতলায় ঘুম পাড়িয়ে রাখল। একটু পরেই দাদা আসলেন। খেতে বসে দাদাকে একটু স্বাভাবিক দেখে বললাম, দাদা আমার অবস্থা তো এই। আপনি কি কিছু ব্যবস্থা করতে পারেন? দাদা বললেন, আর্যলক্ষ্মী ব্যাংকে তর জ্যাঠার কত ডিপোজিট আছে জানস? লাখ টাকার ওপর। আমার হাতে এখন এমন পয়সা নাই যে তোমারে দাতব্য করতে পারি। অ্যামনেই এই সংসার চালাইতে আমার মাগগো ফাইট্যা লহু ঝরে। দাদা খুব পরিষ্কারভাবেই তাঁর অবস্থার কথা আমায় বললেন। আবার বলি, দাদা মানুষটা লোক হিসেবে খুব খারাপ ছিলেন না। যথেষ্ট শিক্ষিত মার্জিত রুচির মানুষ তিনি হয়তো ছিলেন না। পড়াশোনার ব্যাপারেও তাঁর খুব একটা উৎসাহ ছিল না। তাঁর একটাই দোষ ছিল, অসম্ভব ক্রোধ। যা হোক তাঁর উপদেশ হলো, পড়াশোনা চুলোয় যাক, আমার প্রয়োজন একটা চাকরির। তাতে পরিবারের অবস্থা যদি কিছু পালটানো যায়। প্রসঙ্গত তিনি লঞ্চ কোম্পানিতে একটা চাকরির সম্ভাবনার কথা বললেন। বললেন, তুই যদি লঞ্চে কাম করতে চাও আমি চেষ্টা করতে পারি। বললাম, তাই দেখুন, আমার আর ভালো লাগছে না। দাদা সন্ধের সময় লঞ্চঘাটে তাঁর অফিসে একবার যেতে আদেশ করলেন। বললেন, একটু ফিটফাট হয়ে যেন যাই। ভাবলাম দেখি কী হয়। যদি কালকের মধ্যে কোনোভাবেই ফর্ম ফিলাপ না হয় তবে দাদার ব্যবস্থাই মানতে হবে। একদিক অন্তত বাঁচুক।

দাদা অফিসে চলে গেলে অহীন এলো। সে আমারই জন্য আজ অফিস কামাই করেছে। তার ঠিকে চাকরি, ‘নো ওয়র্ক নো পে।’ আমার জন্য তার একদিনের রোজ মার খেলো। তার চেহারা দেখে মনে হলো সে খুব অসুস্থ। কারণ জিজ্ঞেস করতে বলল, পরে বলছি, আগে তোমার খবর বলো। বিনয়বাবু কী বললেন? আমি সব কথা বলতে অহীন কেঁদে ফেলল। তার মতো শক্ত ছেলেকে কাঁদতে দেখে আমিও অস্থির হয়ে পড়লাম। দুই বন্ধু মিলে অনেকক্ষণ কাঁদলাম। আমার বয়স তখন ষোলো, অহীন উনিশ-কুড়ির এক যুবক। দাদার চাকরি বিষয়ক সংবাদ জানাতে সে বলল, ধরে নেও হবে না। কারণ তুমি এখন মাইনর। তবু চেষ্টা করে দেখো। আমার একটা সেটা পোশাকি শার্টপ্যান্ট আছে। কোনোমতে তাই দিয়ে চালিয়ে নাও। আমি জানতে চাইলাম, ভাই, তোমার চেহারাটা আমার কেমন যেন বোধ হচ্ছে। মনে হচ্ছে, আমার বর্তমান পরিস্থিতির দুশ্চিন্তা ছাড়াও অন্য কোনো দুরূহ সমস্যা তোমার কাঁধে চেপেছে। তুমি কিছু কিন্তু কোরো না। সব আমাকে বলো। বাড়ির সবাই ভালো আছেন তো? অহীন বলল, আমরা দুজনেই এক ভীষণ দুঃসময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। সব কথা সবসময় বলা যায় না, উচিত নয়। তুমি লঞ্চঘাটের কাজ সেরে বেল পার্কে এসো। ইলেকট্রিক অফিসের সামনে আমি থাকব। কালীদাকে চেনো তো? সেও থাকবে। একটা বিষয়ের ফয়সালা আজই করতে হবে। বেশি চিন্তা কোরো না। তবে ব্যাপারটা খুবই জরুরি। এখন তোমাকে কিছুই বলব না। তুমি আগে তোমার কাজ সেরে এসো।

কালীদা মানুষটি ভোলার। তাঁর ছোট ভাই ভুলুদা আমার খুব নিকটজন। থাকেন শহরের দুনম্বর ঝাউতলা লেনে। বাসাটি আমার দাদার শ্বশুরমশাইয়ের বাসা। আমি কখনো-সখনো সেখানে যাই। এক-আধ রাত থাকিও। ভুলুদা শহরে এসেছিলেন পড়াশোনার উদ্দেশ্যে। তা হয়নি। এখন ইলেকট্রিক্যাল করপোরেশনে একটি চাকরিতে আছেন। সেই সূত্রে কালীদা মাঝে মাঝে এই শহরে আসেন এবং আমার দাদার শ্বশুরবাড়িতেই আশ্রয় নেন। ভোলার মানুষ। তাই তাঁদের স্বরসংগতি আমাদের চাইতে আলাদা। কালীদা মানুষ খারাপ না, তবে একটু উগ্র। কথায় কথায় হাত চালানো অভ্যেস। দ্বৈপায়ন মানুষেরা এরকম নিয়মেই অভ্যস্ত। তাই তাঁর উপস্থিতিতে কোনো বিষয়ের ফয়সালা করার সংবাদে আমার উৎকণ্ঠা গভীর হলো। আমি অহীনকে অনুনয় করে বললাম, তুমি আমার সব সমস্যার কথা ভুলে যাও। শুধু বলো, কালীদাকে কেন প্রয়োজন হয়েছে? অহীন বলল, সন্ধের আগে বলা যাবে না—বলে সে চলে গেল। আমি এক অন্য অসম্ভব বিপদের গন্ধ পেলাম তার আচরণে।

সন্ধেবেলা অহীনের শার্টপ্যান্ট পরে, যেন একটু ভার-ভারিক্কি দেখায় এরকম চুলটা আঁচড়িয়ে নির্ধারিত সময়ে লঞ্চঘাটে পৌছোলাম। দাদা বললেন, সব কথা কওয়া আছে। আইজওই ইন্টারভিউ লইয়া appointment দিব। কোনো চিন্তা নাই। রেজাল্ট তো ভালো আছে। কিন্তু আমি যখন ইন্টারভিউ হলে ঢুকলাম, কর্তারা সমস্বরে বলে উঠলেন, আরে তুমি তো প্রায় একজন দুগ্ধপোষ্য শিশু। খোকা, তুমি এখানে চাকরি করবে কেন? আমার খুব আত্মসম্মানে লাগল। বললাম, দেখুন আপনাদের চাহিদা অনুযায়ী আমার রেজাল্ট ভালোই আছে। তাঁরা বললেন, তা আছে, তবে তোমার বয়সটা সমস্যা করেছে। অন্তত আরও দুবছর যোগ না হলে তুমি চাকরি পাবে না। অতএব immature বলে তাঁরা আমাকে প্রত্যাখ্যান করলেন। অস্বীকার করার উপায় নেই, ভাগ্যং ফলতি সর্বত্র। তখনও আমার গোঁফের রেখা স্পষ্ট হয়নি। চেহারায় কিশোর-কোমল ছাপ। অতএব আমাকে মনোনীত না করার জন্য কর্তৃপক্ষকে দোষ দিতে পারি না। কিন্তু দাদার মনে হলো আমি তাঁদের প্রশ্নের উত্তর ঠিক ঠিকভাবে দিতে পারিনি বলেই তাঁরা আমায় সিলেক্ট করেননি। বয়সের ব্যাপারটাকে তিনি আদৌ গুরুত্ব দিলেন না। বললেন, ক্যান? আমি কি ষোলো-সতেরো বছরে কামে ঢুকি নাই? কিন্তু আজকের নিয়ম যে কাল পালটায়, এ বিষয়ে দাদার ধারণা পরিষ্কার ছিল না।

পরদিন ফর্ম ফিলআপের শেষ দিন। দুপুর অবধি সারা শহর উদ্ভ্রান্তের মতো চষে বেড়ালাম। না, কোনো বন্ধু, আপনজন কেউ নেই এই সমস্যা থেকে আমাকে উদ্ধার করার। গতকাল সন্ধেয় বেল পার্কে অহীন এবং কালীদাকে পাইনি। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে চলে এসেছিলাম। তার সমস্যার কথাটাও মাথার মধ্যে চেপে বসেছিল। ভেবে পাচ্ছিলাম না তার এমন কী সমস্যা এ সময় হতে পারে। রাত্রে বাসায় এসে খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়েছিলাম। ওর বাসায় গিয়ে আর খোঁজ নেয়া হয়ে ওঠেনি। সম্ভাব্য-অসম্ভাব্য সব স্থানে ওই কয়টা টাকার জন্য ঘুরে বেড়ালাম। কিন্তু কোনো সুরাহা হলো না। ঘুম আসছিল না। আমার এই ছোট্ট জীবনটুকু ভালোবাসার মতো যদিও কোনো অনুষঙ্গ ছিল না, তবুও তার প্রেম যেন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো। উঠে আলো জ্বেলে একটা পদ্য মতন লিখলাম—

তবুও নিশীথ নিরন্ধ্র আঁধারে
যখন ডুবে গিয়েছে ক্ষীণ চাঁদ
তখনও আমি তোমার জন্যে বাঁচি
তোমার প্রেম ঘুচায় অবসাদ।
তুমি তো এক আদিম অনুষঙ্গ
কখনো দেখাও বিকট ভ্রুভঙ্গ
তবুও আমি তোমারি নামে বাঁচি
কালভৈরব দেখায় কত রঙ্গ

সারা রাত ধরে কেন জানি না আমাদের বড় খালপারের ওই বৃক্ষদম্পতির পরিপার্শ্ব নিয়ে স্বপ্ন দেখে গেলাম। সর্বশেষ দেখলাম, আমি যেন একটা বৃহৎ সরীসৃপ শিকড়ের ওপর ঘুমিয়ে পড়ে আছি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *