বিষাদবৃক্ষ – ৩৭

সাঁইত্রিশ

উনিশশ একষট্টি সালের মার্চ মাসে আমাদের ফাইনাল পরীক্ষার দিন ধার্য হলো। তারিখটা মনে নেই। পরীক্ষাকেন্দ্র আমাদের গ্রাম থেকে তিন মাইল দূরের বন্দর-শহর ঝালকাঠির গভর্নমেন্ট স্কুল। তিন মাইল রাস্তা হেঁটে গিয়ে রোজ পরীক্ষা দেয়া সম্ভব নয়। সেখানে কোথাও থাকতে হবে। সেসব দিনে ওখানে থাকার ব্যবস্থা করা হতো সাধারণ আত্মীয় বা পরিচিত কারও বাড়িতে। মেয়েদের জন্য বোর্ডিংয়ের ব্যবস্থা মোটামুটি একটা ছিল। ছেলেরা সাধারণ এর-ওর বাসাতেই থাকত এবং হোটেলে খেত। বাবা জ্যাঠামশাইকে এ বিষয়ে বললে তিনি জানালেন যে, সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। থাকা-খাওয়ার জায়গার অভাব নেই। বাবাও নিশ্চিন্ত হলেন। জ্যাঠামশাই আমাকে ডেকে বললেন, এ অতি আনন্দের কথা যে তোমার মতো ছেলেও ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিচ্ছে। তুমি যে এতটা এগোতে পারবে তা আমি আশা করিনি। টেস্টে শুনলাম নাকি ভালোই করেছ। বেশ, আমি তোমাকে নিয়ে যাব এবং যা ব্যবস্থা করার করব। আমার কর্তব্য আমি করব, যেমন করি। তুমি কী করবে তুমি জানো। তবে এ পরীক্ষাটা কিন্তু স্কুলের পরীক্ষা নয়। চুপচাপ শুনে যাওয়াই রীতি। তাই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম। জ্যাঠামশাই আবার বললেন, পাস করতে পারবে বলে মনে হয়?—কোনো রকমে বললাম, দেখি চেষ্টা করে। তিনি বললেন, But in the year nineteen hundred and etc. I had gone to appear in the Matriculation examination and nobody had to accompany me. But I had been honored with a first division. And you, you say that you will try—pooh! তাঁর কথার ধরনই ছিল এরকম। শুধু তিনি নন, ওই সময়ে পিছারার খালের জগতের গার্জেনদের কেউই সন্তানদের পড়াশোনা বা কোনো ব্যপারে উৎসাহব্যঞ্জক কিছু বলতেন না। জ্যাঠামশাইয়ের বিশেষতা ছিল যে, তিনি উৎসাহব্যঞ্জক কিছু বলতেনই না, উপরন্তু তীব্র বিদ্রুপে একেবারে হাড়মজ্জা জ্বালিয়ে দিতেন। কিন্তু তাঁর সহায়তা ছাড়া গতি নেই, যেহেতু আমার নিজস্ব কোনো পরিচিত লোক বন্দর-শহরে থাকলেও, জ্যাঠামশাইয়ের অগোচরে সেখানে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না।

পরীক্ষার আগের দিন সকালে একটি টিনের বাক্সে বইপত্তর এবং জামাকাপড়গুলো সাজিয়ে নিলাম। জামাকাপড় বলতে মায়ের হাতে সেলাই করা একটি মার্কিন কাপড়ের ইজের, তদনুরূপ একটি জামা এবং একটি লুঙ্গিই ছিল সম্বল। এ ছাড়া তৃতীয় বস্ত্র হিসেবে একটি গামছাও আমার ছিল না। লুঙ্গিটি পরে স্নান এবং তার সাহায্যেই গা মোছার কাজ। বাকি সময় ওই একমেবাদ্বিতীয়ম ইজের আর জামাটির ব্যবহার। অত্যন্ত ছোটবেলা থেকেই এরকম ব্যবস্থায় অভ্যস্ত। সুতরাং মনে কোনো দুঃখ বা অভাববোধ ছিল না। জীবন-সায়াহ্নে বসে যখন এই স্মৃতিচারণা করছি তখন পোশাক-আশাকের যে প্রাচুর্য, তা দেখে বরিশালীয় একটি মজার প্রবাদ মনে আসে—

মাটি খুঁটি
সোনা আধা
কাপড় কেনে গাধা।

বাস্তবিকই পরবর্তীকালে আমরা গাধার মতোই জামাকাপড় কিনেছি এবং ব্যবহার করেছি। তবে আমি কোনো দিনই ওই ইজের আর জামার কথা ভুলিনি এবং অত্যন্ত শখের বস্ত্রও প্রয়োজনে বা অপ্রয়োজনে মানুষকে দিয়ে দিতে আমার বাধেনি।

বলতে ভুলে গিয়েছি সঙ্গে একটি বিছানার পুঁটলিও নিয়েছিলাম। কিন্তু তার বিস্তৃত বিবরণ অনাবশ্যক।

বন্দর-শহরে তখনকার দিনে হোটেল বলতে বোঝাত যেখানে পয়সার বিনিময়ে ভাত খেতে পাওয়া যায়। হোটেল এবং বোর্ডিং সেখানে ছিল না। তিন মাইল রাস্তা পার হয়ে যখন গঞ্জে পৌঁছলাম, তখন বেলা প্রায় দশ-এগারো। সূর্যের অবস্থান দেখে এমতোই অনুমান। ঘড়ি বস্তুটা তখন কদাচিৎ লোকের হাতে দেখা যেত। যা হোক, জ্যেষ্ঠতাত আমাকে নিয়ে তুললেন একটি হোটেলে। হোটেল মালিক আমাদের পাশের গাঁয়ের ছেলে। সম্প্রতি এখানে একটি টিনের চালাঘরে ভাত বেচার হোটেল খুলে বসেছে। চৈত্র মাস। সুতরাং রোদের তাত খুব একটা কম নয়। তখনও আমরা বিদ্যুতের আশীর্বাদের কথা স্বপ্নেও ভাবি না। এই হোটেলে খাওয়া এবং এক কোনের মেঝেতে (মাটির) থাকার ব্যবস্থা হলো। জ্যাঠামশাই উপস্থিত পরিচিত এবং অপরিচিত জনেদের সামনে বেশ খানিকক্ষণ বাতেল্লাবাজি করলেন। মাঝে মাঝেই তাঁর ম্যাট্রিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে পাশ করার কথা এবং আমার যে আদৌ পাস করার সম্ভাবনা নেই তা বিশদ করে বলে চলে গেলেন। যাবার সময় বলে গেলেন যে, খাবারের দাম বাবদ পয়সা তিনি হোটেল মালিককে যথাসময়ে দিয়ে দেবেন। আমি যেন কোনোমতেই স্বাধীনভাবে চলাফেরা না করি, এই শহর অতি ভয়ংকর স্থান—ইত্যাদি।

কিন্তু সত্যি বলতে কি হোটেলটিকেই আমার ভীষণ স্থান বলে মনে হলো। একখানা দোচালা টিনের ঘর। তার মধ্যে অহরহ মানুষ আসছে খাচ্ছে, গল্পগুজব করছে। চারদিকে দরমার বেড়া। হাওয়াবাতাস ঢোকার পথ নেই, তার ওপর অহরহ চিৎকার—’এখানে পেটচুক্তি ওখানে পাইস।’ ‘এহানে ডাইল দে, ওহানে আর এক পেলেট ভাত’—এইসব আদেশে সে এক বীভৎস কাণ্ড।

অবস্থায় যতই দুঃস্থ থাকি, বাড়ির বিস্তৃত পরিধিতে আলো-হাওয়ার অভাব ছিল না, এত কোলাহল কোনো দিন শুনিনি। এখন এরকম একটি অবস্থায় পড়ে চারদিকে অন্ধকার দেখতে লাগলাম। তার ওপর হোটেল মালিকের ভ্রুকুটি। জ্যাঠামশাই যতক্ষণ উপস্থিত ছিলেন ততক্ষণ তার মূর্তি ছিল এক, তিনি চলে যেতে না যেতেই সে প্রচণ্ড বিরক্তি এবং ক্রোধে অন্য মূর্তি ধারণ করল। জ্যাঠামশাইকে এখানকার সকলেই ভয় করত। তার বিলক্ষণ কারণও ছিল যা আগে বেশ কয়েকবার বলেছি। তিনি লোক মোটেই সুবিধের ছিলেন না। এই হোটেল মালিকও বলাবাহুল্য, নিশ্চয়ই জ্যেষ্ঠতাতের দ্বারা কখনো না কখনো নিগৃহীত হয়ে থাকবে। এখন আমায় বাগে পেয়ে সে তার ঝাল ঝাড়তে শুরু করল। সে উপস্থিত জনেদের উদ্দেশ করে বলতে লাগল—দ্যাহছেন দেহি। এ কী উদ্বেগ অ্যা। হেনায় তো হুকুম দিয়াই খালাস। মুই এ্যারে এহন কোথায় রাহি? পোলাডায় তো আইছে পরীক্ষা দেতে। তো এহানে পড়বে ক্যামনে?—সমবেত লোকজনেরা সবাই তার কথার যুক্তি স্বীকার করল। আমি লোকটির বিরক্তি এবং ক্রোধের মধ্যে কিছু অন্যায় দেখলাম না। তা ছাড়া জ্যাঠামশাইয়ের স্বভাব তো আমি বিলক্ষণ জানি, তিনি আমার থাকা-খাওয়ার জন্য যে একে আদৌ কোনো পয়সাকড়ি দেবেন বা দিলেও কবে নাগাদ সে অঘটন ঘটবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই, কিন্তু তবুও জ্যাঠামশাইয়ের বিরুদ্ধে এরকম প্রকাশ্য সমালোচনায় আমি খুবই দুঃখ পাচ্ছিলাম এবং অস্বস্তি বোধ করছিলাম। আমার অস্বস্তি লক্ষ করে হোটেল মালিক আমাকে তার কাছে ডাকল, বলল, তুমি ভাইডি মনে কিছু করইও না। হেনারে এসব কিছু কথা কওনেরও দরকার নাই। তয় আমার অবস্থাড়া তো বোজতে পারতে আছ। যাউক, আগে তুমি খাইয়া তো লও, পরে দেহি কী করণ যায়।—লোকটি মানুষ হিসেবে খারাপ ছিল না। আমার খাওয়া শেষ হতে-না-হতে সহপাঠী এবং প্রাণের বন্ধু মানিক এসে হাজির। সে এবং আমাদের অন্যান্য আরও কয়েকজন সহপাঠী বন্দর-শহরের একটি স্কুলের একজন মাস্টারমশাইয়ের বাড়িতে থেকে পরীক্ষা দেবে, এরকম ঠিক ছিল। এই মাস্টারমশাই একসময় প্রসন্নকুমার বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন এবং ওই অঞ্চলেই তাঁর আদিবাড়ি ছিল। একসময় তিনি মিলিটারিতে চাকরি করতেন এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় বর্মাফ্রন্টের লড়াইয়ে আহত হয়ে অবসর নেন। পরবর্তীকালে শিক্ষকতাই পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। মানুষটি অসম্ভব পরোপকারী, দুঃসাহসী, সুদর্শন এবং সুশিক্ষিত। তাঁর বাড়িটি ছিল দোতলা একটি টিনের ঘর। অবস্থা আদৌ সচ্ছল ছিল না। তথাপি প্রতিবছর তাঁর নিচের তলাটি আমাদের স্কুলের ফাইনাল পরীক্ষার্থীদের জন্য ছেড়ে দিতেন। তখনকার দিনে বন্দর-শহরেও বিদ্যুৎবাতির প্রচলন বড় একটা ছিল না। খুব অবস্থাপন্নদের বাড়িতেই সে ব্যবস্থা ছিল। ছাত্ররা এই মাস্টারমশাইয়ের বাড়িতে থাকার সময় যে যার বিছানাপত্তর এবং একটি হ্যারিকেন নিয়ে যেত। খাবারদাবারের বন্দোবস্ত হোটেলে। এই মাস্টারমশাইকে আমরা ডাকতাম ডব্লু (ডব্লিউ) স্যার বলে।

মানিক আমার অবস্থা দেখে বলল, তুই তো এহানে থাকতে পারবি বলইয়া মনে হয় না। এক কাম কর, আমার লগে ডব্লু স্যারের বাসায় চল। তিনি আপত্তি করবেন না। আমি বললাম, কিন্তু হ্যারিকেন? আমার তো হ্যারিকেন নাই। ও বলল, রেক্টর স্যারের বাড়িতে আমরা এক কুপিতে যদি এতকাল পড়ইয়া আইতে পারি, এই কয়ডা দিন পারমু না? হোটেল মালিকও সেইরকমই বলল। সে বলল, তোমার ভয় নাই। তোমার জেডারে এসব আমি কমুনা। হেনায় এসব জানতে পারবেন না। এ ভালোই অইল। আমারও এট্টা দুশ্চিন্তা গেল। রোজ দুইবেলা এহানে আইয়া খাইয়া যাইও, যহন খুশি। তোমার ভাত আলাদা থাকবে। এরপর আর কথা কী? আমি তো মনে মনে তা-ই চেয়েছিলাম। একেবারে সাক্ষাৎ ভগবানের আশীর্বাদ। আমি মানিকের সঙ্গে চলে গেলাম। ডব্লু স্যারের কোনো আপত্তি হলো না। ওখানে থেকে এবং হোটেলে খেয়ে দিব্য পরীক্ষা দিতে লাগলাম।

কিন্তু আমার অদৃষ্টে বোধহয় আরও অনেক লাঞ্ছনা বাকি ছিল। পরীক্ষা শেষ হতে তখনও দুদিন বাকি। হঠাৎ ব্যাপক জ্বর সহযোগে সারা গায়ে হাম উঠল। প্রথমদিন শুধু জ্বর। ভাবলাম ঠাণ্ডা লেগে হয়েছে এমনি সেরে যাবে। কিন্তু পরের দিন গোটা শরীর হামে ভর্তি হয়ে গেল। স্যারকে দেখাতে তিনি বললেন যে, এর নাম ‘মৈষারুতি’। খুবই ছোঁয়াচে। আর একটা দিন পরে হলে সমস্যা ছিল না। জানাজানি হলে সবাই আতঙ্কিত হবে। পরীক্ষার হলে জানতে পারলে তো কথাই নাই। তিনি আমাকে ব্যাপারটা গোপন করতে বললেন এবং কোনো রকমে সেদিনকার পরীক্ষাটা দিতে বললেন। ভাগ্য ভালো ওই শেষ দিনের পরীক্ষাটা ছিল ঐচ্ছিক। না দিলেও ক্ষতি ছিল না। কিন্তু স্যার বললেন, কষ্ট সহ্য করতে শেখো। এর এমনিতে কোনো চিকিৎসা বা ওষুধপত্র নেই। তবে অন্যদের থেকে একটু আলাদা থাকতে হবে এবং ঠাণ্ডা লাগানো চলবে না। মুখের গোটা দেখে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে বলবে, ডিম খেয়ে অ্যালার্জি হয়েছে। তাঁর কথামতো পরীক্ষাটা দিলাম। তবে জ্বর এবং অসহ্য ব্যথায় সারা শরীর যেন ক্রমশ ভেঙে পড়ছিল। মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা, একটা বেহুঁশ অবস্থা নিয়ে পরীক্ষাপর্ব শেষ হলো।

পরীক্ষার শুরু থেকে শেষদিন অবধি সহপাঠীদের বাড়ি থেকে তাদের বাবা, কাকা, জ্যাঠাদের কেউ না কেউ, তাদের খোঁজখবর নিতে আসতেন, আমার কেউ আসতেন না। অবশ্য এটা যে তাঁরা অভিসন্ধি করে করতেন, তা নয়। তাঁদের এ ব্যাপারটা প্রয়োজন বলেই বোধ হতো না সেসব দিনে। আমিও এরকম আশা পোষণ করিনি কোনো দিন। তবে অস্বস্তি হতো যখন সহপাঠীরা বা তাদের গুরুজনেরা এ ব্যাপারটা নিয়েও কোনো প্রশ্ন করত তখন। তাদের বাবা, কাকা, জ্যাঠাদের সঙ্গে আমার জনেদের যে ঠিক কী কারণে তফাৎ এবং কেন তাঁরা আমাদের এইসব বিষয়ে মনোযোগী নন, তা সহপাঠীদের বোঝাবার কোনো উপায় আমার ছিল না। ব্যাপারটায় শুধু অভ্যস্তই ছিলাম, এর কারণ কর্তাদের বিকৃত আভিজাত্যবোধ না উদাসীনতা, তা আজ পর্যন্ত বুঝে উঠতে পারিনি।

পরীক্ষা শেষ হলে অসুস্থ অবস্থায়ই বাড়ি ফিরে এলাম। আমার কোনো দিনই খুব একটা রোগব্যাধি হতো না। অপুষ্টিজনিত কারণে অন্য আর পাঁচটা পাড়াগাঁয়ের ছেলেদের মতো রোগাডিংলা ছিলাম, এই যা। কিন্তু এই হাম-জ্বর আমাকে ভীষণ কাহিল করে দিল। বেশ কয়েক দিন ভোগার পর জ্বর এবং হাম ভালো হলো বটে, কিন্তু শরীরটা ভেঙেচুরে হয়ে দাঁড়াল একটা না-খেতে পাওয়া নেংটি ইঁদুরের মতো। চলতে গেলে মাথা ঘোরে। অনেকক্ষণ বসে থেকে ওঠার সময় চক্কর লাগে। চোয়ালের হনু দুটো বিশ্রীরকম উঁচু হয়ে গিয়েছে—অর্থাৎ সে এক কন্দৰ্পকান্তি অবস্থা।

পরীক্ষার পরে দীর্ঘ অবসর। শুধু ছাত্র পড়িয়ে সময় কাটে না। বাড়িতে থাকতেও মন চায় না। গ্রামে সমবয়সি কেউই নেই। পাশের মুসলমান গ্রামগুলোর ছেলেরা ফুটবল খেলতে খেলার মাঠে আসে, কিন্তু প্রায়ই সংখ্যায় কম হওয়ার জন্য খেলা হয় না। কাজেই আমাকে আড্ডামারা বা মনের খিদে মেটাতে হয় সেই কীর্তিপাশার বাজার অঞ্চলে। কিন্তু আমার বাড়ি থেকে ওখানে যেতে দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে হয়। মেঠো রাস্তা ধরে অন্ধকারে বাড়ি ফেরা, বেশ ভয়-ভয় করে। এমন জনহীন, নিঃশূন্য সব স্থান পাড়ি দিতে হয় যে, মনে হয় পৃথিবীটা এখানে এসে শেষ হয়ে গেছে, আর এরপরেই এক অতল গহ্বর, একটু অসতর্ক পা ফেললেই অস্তিত্বহীন হয়ে যাব। কী অসম্ভব নিঃসঙ্গ সেই জীবন এবং কী নিরানন্দময় যে, সে কথা বুঝিয়ে বলা দুষ্কর। নির্জনতাপ্রিয় মানুষ যারা তারাও বোধকরি এরকম একটা অবস্থা পছন্দ করবে না। এ তো ঠিক নির্জনতা নয়, এ হলো জনহীনতা। এখানে এই সেদিনও ব্যাপক জনবসতি ছিল। আজ আর নেই। সেই জনবসতি ও গেরস্থালির স্মৃতিটি মনে আছে, তার চিহ্নগুলো ছড়িয়ে আছে চারদিকে। কোথাও একটা ভাঙা ঘাটওয়ালা পুকুর। তার ঘাটের সিঁড়িতে ফাটল ধরেছে। কোথাও-বা একটা সমাধিমন্দির সারা গায়ে গলা, পাতা, ঘাস গজিয়েছে। কোথাও একটা দোলমঞ্চ বা তুলসীমঞ্চ। এরা সব আছে, কিন্তু মানুষ নেই। এ তো নির্জনতা নয়। বরং স্মৃতিগুলো যদি না থাকত, এটা যদি একটা বিশাল বনভূমি হতো তাহলে বেশ হতো। যা হোক এই করে করেই দিন কেটে গেল এবং একসময় পরীক্ষার ফল বেরুল। গ্রামে খবর আসতে দু-চার দিন দেরি হলো। কারণ খবরের কাগজ অন্তত তিন দিনের বাসি না হলে সেসব দিনে আমরা গ্রামের পোস্ট অফিসে পেতাম না। পরীক্ষার ফল তখনকার দিনে গেজেটে বের হতো। খবর নিয়ে এলো আমার আবাল্য সুহৃদ এবং সহপাঠী, আমাদের একদার নায়েবমশাইয়ের ছেলে। সে একটি গেজেট নিয়ে এক সকালে কীর্তিপাশা বাজারে হাজির। মনে পড়ে, বাজার শেষে বাড়ি ফেরার সময় তার সঙ্গে একটি ব্রিজের ওপর আমার দেখা। সে অত্যন্ত উত্তেজিত। গেজেটটি মেলে ধরে সে দেখাল, আমরা বন্ধুরা সবাই বেশ ভালোভাবে পাস করেছি। আমার ফল তো আশার অতিরিক্ত ভালো। তখনকার দিনে গ্রামগঞ্জের স্কুলে আজকালকার মতো গণ্ডায় গণ্ডায় ছাত্রছাত্রী ফার্স্ট ডিভিশন পেত না। নম্বরও এত কাড়ি-কাঁড়ি উঠত না। সে ক্ষেত্রে ফার্স্ট ডিভিশনে পাস করে একটি ন্যাশনাল স্কলারশিপ পেয়ে আমি এতই আপ্লুত হলাম যে, খবরটি আদৌ সত্য কি না বিশ্বাস করতে ভরসা হচ্ছিল না। বিগত কুড়ি বছরের মধ্যে আমাদের স্কুলে কেউ ফার্স্ট ডিভিশন পায়নি। তার ওপর ডিস্ট্রিক্টে পজিশন এবং জাতীয় বৃত্তি। নিজের বাস্তব অবস্থিতি এবং চেতনা পর্যন্ত লুপ্ত হবার মতো অবস্থা আমার তখন। সমস্ত শরীর জুড়ে দ্রিদিম্ দ্রিদিম্ শব্দে এক বাদ্য বাজছিল। কিন্তু টুনু, মানিক এরা সব সেকেন্ড ডিভিশন পাওয়ায় বড়ই দুঃখিত বোধ করলাম। তারা ফার্স্ট ডিভিশন পাবার উপযুক্ত ছিল। বিশেষ করে টুনু তো বটেই। তবে পরবর্তীকালে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাগুলোতে তার এই গ্লানি দূর হয়েছিল।

একটি কথা এইসূত্রে বলে নেয়া দরকার। টুনুরা দুই বোন যে কো-এডুকেশন স্কুলে পড়াশোনা করে, এ সংবাদ আগের স্কুলে থাকার সময়েই আমি জানতাম এবং বিষয়টি আমার কাছে খুবই আশ্চর্যের ছিল। আমাদের ওখানে পঞ্চাশের দশকের শেষ এবং ষাটের শুরুতে ব্যাপারটা খুব সহজ ছিল না। তার ওপর তারা ভদ্র হিন্দু পরিবারের মেয়ে। আমি আমার পিছারার খালের চৌহদ্দির পরিমাপে ব্যাপারটি বিচার করেছিলাম তখন। পরে যখন কীর্তিপাশা স্কুলে ভর্তি হই তখন বুঝি সেখানের বাতাবরণে কিছু ভিন্নতা ছিল। সেই ভিন্নতার কারণ এই যে, সেখানে একটি বাজার, স্কুলটি এবং একটি পোস্ট অফিস ছিল। আর আশপাশের গ্রামের অধিবাসীরা ছিল নমঃশূদ্র জাতির। কীর্তিপাশা গ্রামটিতেও বর্ণহিন্দুর সংখ্যা নিতান্ত কম ছিল না। কাছাকাছি মুসলমান গ্রামগুলোর অধিবাসীদের সঙ্গে সামগ্রিকভাবে সৌহার্দ্যও ভালোই ছিল। ফলে সংখ্যালঘুদের মনে খুব একটা ভীতি বা অকারণ আতঙ্ক ছিল না। বদমায়েশদের সংখ্যা যে একেবারে ছিল না তা নয়, তবে তারা কখনোই যা খুশি তাই করতে পারত না। এ অঞ্চলে যেহেতু এই একটি স্কুলই ছিল, তাই সম্প্রদায় এবং ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে স্কুলটিকে সবাই সযত্নে রক্ষা করতে চেষ্টা করত।

আমার সহপাঠী, সহপাঠিনীরা প্রত্যেকেই নিজের নিজের কৃতকর্মে খুশিই হলো। গেজেট পাবার দিন স্কুল ছুটি ছিল। তাই আমরা প্রক্যেক সতীর্থকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে খবর দিয়ে এসেছিলাম। পরের দিন স্কুলে সবাই উপস্থিত হলে সমবেত ছাত্র এবং শিক্ষকদের মধ্যে আনন্দের ধুম পড়ে গেল। সবার দৃষ্টিই বিশেষভাবে আমার ওপর। সে এক অদ্ভুত উত্তেজনা। মাস্টারমশাইয়েরা সবাই প্রাণভরে আমাকে আশীর্বাদ করলেন। হেডমাস্টারমশাই পকেট থেকে একটা কুড়ি টাকার নোট বের করে দপ্তরি বিরুদার হাতে দিলেন বাজার থেকে রসগোল্লা আনার জন্য। সেটা উনিশশ বাষট্টি সাল। কুড়ি টাকার তখন অনেক দাম। তখনও ষোলো আনায় এক টাকার হিসেব চলছে এবং এক আনায় একটা বেশ বড় আকারের রসগোল্লা পাওয়া যায়। তাই কুড়ি টাকার রসগোল্লায় ছাত্র, শিক্ষক এবং উপস্থিত অন্য দু-চারজনের দিব্য কুলিয়ে গেল। পরীক্ষার ফল ভালো হলে আজকের দিনেও যথেষ্ট উত্তেজনা হতো তার এর তুলনা হতেই পারে না। তখন তো এত ছাত্রও ছিল না, স্কুলও ছিল না। তা ছাড়া আমাদের ওই অজ গাঁয়ে আনন্দ, উত্তেজনার উপলক্ষ্য আজকের দিনের মতো ছিলই-বা কী। এখন তা গ্রামে থাকলেও শহরের উত্তেজনা আনন্দ সহজেই ভোগ করা যায়। সেসব দিনে তো কল্পনাই করা যেত না। একমাত্র হাডুডু, ফুটবল খেলা আর যাত্রা-রয়ানি-কীর্তন গান, এই সবই ছিল আনন্দ-উৎসবের উপলক্ষ্য। তাই ম্যাট্রিক পরীক্ষার ফলাফল ছিল আপামর জনজীবনের এক বিশেষ উত্তেজনার বিষয়, তা কোনো বাড়ির ছেলেমেয়ে যদি পরীক্ষার্থী না-ও হতো, তবুও।

মাস্টারমশাইয়েরা সেদিন সমবেতভাবে আমাদের রেক্টর স্যারকে বিশেষভাবে কৃতজ্ঞতা জানালেন। তিনি ব্যতীত যে এরকম ভালো রেজাল্ট স্কুলে হওয়া সম্ভব হতো না, সে কথা বারবার বললেন। বস্তুতই তাঁর নিঃস্বার্থ অধ্যাপনা এবং বাড়িতে ছাত্রদের স্থান দিয়ে তাদের বিশেষভাবে শিক্ষাদান ব্যতীত এরকম ভালো ফল আশাই করা যায়নি। অথচ তিনি স্কুল থেকে বা তাঁর বাড়িতে যারা বিশেষভাবে সাহায্য নিত সেইসব ছাত্রদের কাছ থেকে কোনো অর্থই গ্রহণ করতেন না। আজকের দিনে পয়সার বিনিময়েও ছাত্রছাত্রীরা তাদের শিক্ষকদের কাছ থেকে অত সহায়তা পায় কি না সন্দেহ।

পরীক্ষার ফল যেদিন গেজেট মারফত জানি, সেদিন বাড়িতে কাউকেই কিছু বলিনি। কারণ স্কুলে যতক্ষণ না প্রকৃত খবর আসে ততক্ষণ নিশ্চয়তা নেই। ভাগ্য সারাজীবন আমাকে নিয়ে নিষ্ঠুর খেলা খেলেছে। ওইটুকু বয়সের মধ্যেই অঢেল লাঞ্ছনা ভোগ করেছি বলে কোনো আকস্মিক আনন্দকেও কোনো দিন উচ্ছ্বাসভরে উপভোগ করতে পারিনি। আমি চেয়েছিলাম জ্যাঠামশাই খবরটা আনুন এবং বাড়ির সবাইকে জানান। তিনি তাঁর স্কুলের রেজাল্ট আনার জন্য সদরে গিয়েছিলেন। তাঁর স্কুল থেকে সে বছরই প্রথম পরীক্ষা, তাই হেডমাস্টারমশাই হিসেবে তাঁকেই রেজাল্ট আনতে যেতে হয়েছিল। তিনি আগের দিনই গিয়েছিলেন, কারণ আমরা যেদিন গেজেট পাই সেদিনটা ছিল ছুটির দিন। আমি শুধু মাকে বলেছিলাম যে, আমার রেজাল্ট সম্ভবত ভালো হয়েছে, এরকম শুনেছি। তবে এখনই কাউকে বলার দরকার নেই। জ্যাঠামশাই সন্ধে নাগাদ ফিরলেন এবং বাবাকে ডেকে বললেন, He has got a first division and won a scholarship. I am happy. কাছাকাছি ছিলাম। এগিয়ে গিয়ে দুজনকে প্রণাম করে বললাম, আমি সকালে গেজেট মারফত খবরটা পেয়েছি। বাবা অবাক হয়ে বললেন, কিছু বললি না তো। বললাম, মাকে বলেছি। আসলে আমার ভেতর তখন আনন্দের সঙ্গে তীব্র অভিমান কাজ করছিল। স্কুলে ভর্তি হওয়া তক, আমার যে পরিমাণ লাঞ্ছনা সহ্য করতে হয়েছিল তার উপযুক্ত একটা জবাব আমার দিতে ইচ্ছে করছিল। আমার আশাতীত কৃতকার্যতাই আমার জবাব, এরকম একটা বোধে আমি আর কিছুই বললাম না। যা হোক বাবা এবং জ্যাঠামশাই খুশিই হয়েছিলেন বোঝা গেল।

প্রকৃত খুশি এবং উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন সেদিন আমার মা। কোনো আনন্দদায়ক ঘটনা ঘটলেই মা তাঁর গুরুদেবের উদ্দেশে ভোগ নিবেদন করতেন। তাঁর গুরু ছিলেন কিরণচাঁদ দরবেশজি। বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর শিষ্য ছিলেন বলে দরবেশজি এবং আমার ঠাকুরদামশাই পরস্পর খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। এ কারণে দরবেশজি আমার মা এবং বাড়ির আরও অনেকের মন্ত্রগুরু ছিলেন। মা প্রতিদিন সকালে স্নান করে এবং সন্ধ্যায় গা ধুয়ে আমাদের বাড়ির সিংহপালঙ্কের ওপর বসে বেশ খানিকক্ষণ সাধন-ভজন, বাংলা গীতাপাঠ, দরবেশজি অনূদিত জপজী পাঠ করে তার পর গৃহকর্মে ব্যস্ত হতেন। সিংহপালঙ্কের ওপর অন্যান্য গুরুঠাকুর এবং ঠাকুর-দেবতাদের সঙ্গে দরবেশজির একখানি ছবি ছিল। সে যা হোক আমার কৃতিত্বের খবরে মা সেদিন সব ঠাকুরকে খিচুড়ি ভোগ দিলেন।

আগেই বলেছি মায়ের পড়াশোনা তেমন কিছু ছিল না। অত্যন্ত বাল্যবয়সে পিতৃহীন হলে আমার একমাত্র মামা এবং মা খুব সামান্যকালই স্কুলে পাঠাভ্যাস করতে পেরেছিলেন। মামা খুব অল্প বয়সেই পশ্চিমবঙ্গের পলতায় মহালক্ষ্মী কটনমিলে শ্রমিকের চাকরি নিতে বাধ্য হন। মাকে তাঁদের মামার বাড়িতে রাখেন। তাঁদের বাড়ি ছিল ফরিদপুরে। সেখানে মায়ের যে আদৌ কোনো সমাদর ছিল তা নয়। নিতান্ত নিরুপায় হয়েই তিনি তাঁদের গলগ্রহ হয়েছিলেন। আমার পরীক্ষার ফল বেরোবার দিন সন্ধেবেলা থেকে মা অনেক রাত পর্যন্ত গান এবং তাঁর জীবনের নানান গল্প আমাদের শোনান। সেইসব কথাই এখন বলছি।

বড় চমৎকার গানের গলা ছিল মায়ের। মায়ের মামাতো বোনেরা মাস্টার রেখে গান শিখতেন। কবি এবং সংগীতকার অতুলপ্রসাদ সেন তাঁদের কী সম্পর্কে অথবা আপন মামা ছিলেন তা আজ আর আমার মনে নেই। তবে লখনউ থেকে এদিকে এলে তিনি কখনো কখনো তাঁর এই বোনের বাড়িতে যেতেন এবং ভাগনিদের গানের খোঁজখবর করতেন। সেই সুবাদে মা-ও তাঁর ভাগনি। তখনকার দিনে দূর নিকট কোনো আত্মীয়তাই তুচ্ছ ছিল না। সে যদিও অনেক কাল আগের কথা, আমার কালেও দেখেছি মানুষ আত্মীয়তার সূত্র প্রলম্ব করতেই আনন্দিত হতো, আরাম পেত। আজকের দিনে যেমন আমরা জেঠতুতো, খুড়তুতো, মাসতুতো ইত্যাদি এবং অনেক ক্ষেত্রে সহোদর ভাই, ভগ্নীদের সঙ্গে পর্যন্ত আত্মীয়তায় থাকি না, আমাদের সময়ে জেঠিমা, কাকিমা, মাসিমাদের সঙ্গে তো বটেই, তাঁদের কুটুম্বদের সঙ্গেও বেশ হার্দিক নৈকট্য থাকত। জেঠিমা, কাকিমাদের বাপের বাড়ি আমাদের সবারই মামাবাড়ি এবং সেসব স্থানে বরিশালীয় রীতিতে বলতে গেলে বলতে হয় যে, দাদাভাইয়ের (অর্থাৎ ঠাকুরদা বা দাদামশাই) ভাইয়ের বন্ধুর ‘পোলা তো আমার ঘোনো (ঘন) আত্মীয়।’ তা সে থাক। সেসব এখন গতস্য শোচনা।

কিন্তু গল্প তা নয়। গল্প হচ্ছে মায়ের গান বিষয়ে। তাঁর কাছ থেকেই শোনা কথার স্মৃতিচারণ। মায়ের মামাতো বোনেরা যখন গান শিখতে বসতেন তখন মায়ের কর্তব্যকর্ম ছিল হারমোনিয়ামটা নামিয়ে দেয়া এবং গান শেষ হলে সেটা উঠিয়ে রাখা। ওইসব দিনে মায়ের খুব গাওয়ার ইচ্ছে হতো, বিশেষ করে অতুলপ্রসাদের টপ্পাঙ্গের গানগুলো। কিন্তু গাওয়ার উপায় তেমন ছিল না। একমাত্র যখন তাঁর মামিমা এবং মামাতো বোনেরা বাইরে কোথাও যেতেন তখন আমার মা সা এবং পা টিপে ধরে কিছু নিজের মনের মতো গাইতেন। ব্যাপারটি তাঁর মামির নজরে কোনো দিন পড়েনি। মায়ের মামাতো বোনেরা অতুলপ্রসাদ সেনের টপ্পা গানগুলোও করতেন। সেই গান শুনে শুনে মা বেশ কয়েকখানা অতুলপ্রসাদী টপ্পা এবং অন্য গান তুলে নিয়েছিলেন। এইসব গান গাওয়ার যোগ্যতা বা উপযুক্ত কণ্ঠও মায়ের বিলক্ষণ ছিল।

মায়ের যখন মন প্রফুল্ল থাকত তখন তিনি এইসব গল্প খুব করতেন। আমার রেজাল্ট বেরোবার দিন রাতে যখন মা এইসব গান-গল্প করছিলেন তখন একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনার কথা বলেন। একদিন তিনি নাকি ‘ওগো নিঠুর দরদি এ কী খেলছ অনুখন’ গানটি খুব চড়া পর্দায় আবেগের সঙ্গে করছিলেন। তাঁর মামিমা এবং মামাতো বোনেরা তখন বাড়িতে ছিলেন না। কিন্তু বিপদ ঘটল অন্যদিক থেকে। গানটি গাওয়ার মাঝপথে মা খবর পেলেন যে, গানের কবি তাঁর বোনের বাড়িতে এসে হাজির হয়েছেন। এ কথা শুনে মা ভীষণ ভয় পেয়ে তৎক্ষণাৎ গান বন্ধ করে আড়ালে লুকিয়ে পড়েন। কবি এসে ঘরে ঢুকে পরিচারিকার কাছে জানতে চান— কে গান করছিল। ইতোমধ্যে মায়ের মামিমা এবং মামাতো বোনেরা এসে হাজির। কবি তাঁর ভাগনিদের কাছ থেকে মায়ের পরিচয় জানতে পেরে তাঁকে কাছে ডাকলেন। এই অভাবিত ঘটনায় মা কাঁপতে কাঁপতে তাঁর সামনে এসে এই স্পর্ধার জন্য ক্ষমা চাইলেন এবং প্রণাম করতে গিয়ে কেঁদে ফেললেন। মা তখন অত্যন্ত অল্পবয়সি। তাঁর মামিমা তাঁকে কখনোই এইসব বিখ্যাত মানুষদের সামনে বেরোতে দিতেন না। এইসব কারণে মা খুব আতঙ্কিত ছিলেন। কী জানি অদৃষ্টে কী শাস্তি জোটে।

কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল কবি তাঁর অবস্থাটি সম্যক বুঝলেন এবং পাশে বসিয়ে সস্নেহে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি গান থামালে কেন? তোমরা গাইবে বলেই তো গানগুলো আমি লিখেছি। তা ছাড়া তুমি ভীত হচ্ছ কেন? মা বলেছিলেন, কবি তাঁর বিবাহজনিত কারণে এবং ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করার জন্য স্বপরিবারে আদৌ সমাদর পেতেন না। তাঁর এই বোনের বাড়িতে সে কারণেই তিনি কখনো কখনো আসতেন। খুব সুন্দর স্নিগ্ধ স্বভাবের মানুষ, অত্যন্ত স্নেহপ্রবণ। তাঁর কথা শুনে মা কোনোমতে বলেছিলেন, আমি তো শিখিনি কখনো, তাই ভুল—। অতুলপ্রসাদ তাঁকে অভয় দিয়ে বলেছিলেন, তুমি এখানে আমার সামনে বসে যা যা জানো কিছু করো, আমি শুনব। আর আমি যখন-যখন আসব, তখন তোমাকে কিছু শিখিয়ে দিয়ে যাব। মা বলেছিলেন, ওইরকম শান্তি আমি কোনো দিন পাইনি। তবে তাঁর কাছে শেখা আমার তেমন হয়নি, কারণ এর কিছুদিন পরই আমাকে চলে আসতে হয়েছিল। দাদা তখন চাকরি পেয়েছেন।

যা হোক, সেই দিনটি আমাদের ওই সময়কার দুঃখসর্বস্ব জীবনে একটি ব্যতিক্রমী দিন। পরের দিন ভোর থেকেই মনের মধ্যে নানা দুর্ভাবনার মেঘ জড়ো হতে শুরু করল। প্রথমেই যে দুশ্চিন্তাটি মাথায় এলো তা হলো, এরপর কী? এতদিন গাঁয়ের স্কুলে মিনিমাঙনা পড়েছি। মানুষের দয়া এবং করুণা সম্বল করে, সবার সহায়তা ভিক্ষে করে ম্যাট্রিক তো ভালোভাবে পাস করলাম। এরপর পড়াশুনো কোথায় করব? শহর ছাড়া কলেজ নেই। সেটা ১৯৬২ সাল। একমাত্র বরিশাল বিএম কলেজ এবং গ্রামীণ স্তরে চাখার ফজলুল হক কলেজ—এ ছাড়া কলেজ নেই। দুটি কলেজের দূরত্বই আমাদের বাড়ি থেক সতেরো-আঠারো মাইল। এর যে কোনোটিতে পড়তে হলে হোস্টেল বা কারও বাসায় ব্যবস্থা করে থাকতে হবে। যাদের খাওয়া জোটে না, তাদের বাড়ির ছেলের শহরের হোস্টেলে থাকার খরচ দেবে কে? তা ছাড়া বরিশাল শহরে অথবা চাখারে আমার কোনো পরিচিত আত্মজন নেই যেখানে আশ্রয় নিতে পারি। এটুকু শুধু জানতাম যে, কলেজে আমাকে মাইনে দিতে হবে না, Scholarship-এর টাকায় সেটা চলবে। কিন্তু শহরে নানান খরচের সমস্যা আছে। বইপত্র, মোটামুটি ভদ্রস্থ জামাকাপড়, বিছানাপত্ৰ কোত্থেকে জোগাড় হবে। এইসব দুশ্চিন্তায় আমার পাসের আনন্দ মুহূর্তে মিলিয়ে গেল। বাবার সঙ্গে এসব আলোচনা করার কোনো অর্থ ছিল না, তবু দু-এক কথা বললাম। তিনি বললেন, দেখি দাদা কী বলেন। সেই চিরাচরিত দাদানির্ভরতা। তবে মনে একটু আশাও হলো। আগের দিন তিনি আমার পরীক্ষার সফলতা নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর পক্ষে থেকে কিছু করাই সম্ভব। বরিশাল সদরে তাঁর ব্যাপক পরিচিতি আছে। চেনাজানা যে কোনো একটা জায়গায় রেখে ভর্তিটা যদি করিয়ে দেন, তাহলে আমি যে করে হোক চালিয়ে নিতে পারব, এ বিশ্বাসও আমার ছিল।

সেদিন সন্ধেবেলা বাবা জ্যাঠামশাইয়ের কাছে এ বিষয়ে কথাটা পাড়লেন। জ্যাঠামশাই এমনিতে আমার সঙ্গে বাক্যালাপ করতেন না। কিন্তু কী ভাগ্য! বাবার কথার উত্তরে তিনি খুব সহজ স্বাভাবিকভাবে আমাকে বললেন—আমি চাই তুমি সাইন্স নিয়ে পড়ো। You have done a very good result, you should go ahead with science. আমি তোমাকে ব্রজমোহন দত্ত কলেজে ভর্তি করাব ঠিক করেছি। থাকার ব্যবস্থাও হয়ে যাবে। Henceforth you are to think only for your studies. কোনো চিন্তা নেই। বলে কী? আমার দুকানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, অকস্মাৎ পিছারার খালের জগতের রংটাই যেন বদলে গেল। আমি এই আশ্বাসবাক্যে তাঁর বিগত দিনের সব দুর্ব্যবহার, নির্যাতনের কথা ভুলে গেলাম এবং তাঁকে বড় অমায়িক বলে মনে হতে লাগল। মা-বাবা উভয়েই খুব নিশ্চিন্ত হলেন। বাবা জ্যাঠামশাইয়ের ওপর আমার বিরাগের কথা জানতেন। সম্পর্কটা সহজ ছিল না বলে খুব দুঃখিতও ছিলেন। এখন জ্যাঠামশাই এইসব কথাবার্তা বলে চলে যেতে তিনি আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে মায়ের সঙ্গে তাঁর দাদার নানান বিবেচনা এবং গুণের কথা আলোচনা করতে লাগলেন। আমি আমার প্রাক্তন বিরাগতার কথা চিন্তা করে মনে মনে নিজেকে ধিক্কার দিতে লাগলাম।

একটা কথা সবাই বলাবলি করছিল যে, আমি Scholarship পেয়েছি, সুতরাং পড়াশোনার ব্যাপারে আমার কোনো অসুবিধে হবে না। কিন্তু যেহেতু আমি নিতান্ত গাঁইয়া বুদ্ধির ছেলে ছিলাম তাই এর অর্থ আমার কাছে পরিষ্কার ছিল না। শুধু এটুকু বুঝেছিলাম যে, আমাকে কলেজের মাইনে দিতে হবে না। এ ছাড়া এর অন্য কোনো যে তাৎপর্য আছে তা আমি জানতাম না। কারও কাছে জিজ্ঞেস করতেই লজ্জা বোধ হচ্ছিল। স্কুল কলেজে পড়াশোনা করতে গেলে প্রতিমাসে মাইনে দিতে হয় আর পরীক্ষার সময় ফি দিতে হয়, সর্বপ্রথম ভর্তির ফিও দিতে হয়—এগুলো জানা ছিল। সারা স্কুলজীবনে দুমাসের মাইনে বাবদ মোট আড়াই টাকা দিয়েছিলাম, তারপর আর দেয়ার ক্ষমতাও হয়নি, দিইওনি। অতএব, কলেজের ব্যাপারটাও যদি মিনিমাঙনা হয়ে যায় তার থেকে উত্তম আর কী হতে পারে? এই চিন্তায় মন বড় খুশি হলো। আমি শহরে থেকে কলেজে পড়ব, দেশের ঐতিহ্যপূর্ণ কলেজ—ব্রজমোহন দত্ত কলেজ। আমার মতো একটি নগণ্য ছেলে সেখানে সব বিখ্যাত অধ্যাপকদের কাছে পড়াশোনা করতে পারবে—এইসব মধুর কল্পনা আমাকে এতই উচ্ছ্বসিত আনন্দ এবং উত্তেজনায় পৌঁছে দিয়েছিল যে, প্রায় আহার-নিদ্রা পর্যন্ত বন্ধ হবার উপক্রম। এই তো আমার স্বপ্ন ছিল, সেই স্বপ্ন আজ সফল হতে চলেছে। জ্যাঠামশাইয়ের ওপরে আমার আর আদৌ কোনো ক্ষোভ থাকল না। ভাবতে লাগলাম আজ পর্যন্ত যত অসম্মান, নির্যাতন তিনি আমার ওপর করেছেন, সেসবই আমাকে মানুষ করার জন্য। অভিভাবকের কর্তব্যকর্ম হিসেবেই করেছেন। অন্তরে অন্তরে তিনি প্রকৃতই আমাকে স্নেহ করেন। তাঁকে শ্রদ্ধা করতে পারতাম না বলে মনে মনে একটা গভীর গ্লানি দীর্ঘকাল পুঞ্জীভূত ছিল। আজ সেটা একেবারেই পরিষ্কার হয়ে গেল। অন্তরে একটা নির্মল আনন্দ উপভোগ করতে লাগলাম। শ্রদ্ধাভাজনদের কোনো কারণে যদি বাধ্য হয়ে অশ্রদ্ধা করতে হয়, তার বেদনা অনেক। আমার সেই বেদনা আজ দূর হয়ে গেল। আমার মন যখন এরকম এক আবেগে পরিপূর্ণ তখন আমার ভাগ্যদেবতা বোধহয় অলক্ষে ঠোঁট টিপে হাসছিলেন।

এইখানে একটা মোদ্দাকথা বলা দরকার। আমার জীবন চিরদিন আমাকে নিয়ে এমন খেলা খেলেছে, যে খেলায় কোনো পক্ষপাতহীন রেফারি ছিল না। যে রেফারিটি ছিল, সে খেলার মধ্যে যে কোনো সময় বাঁশিটি বাজিয়ে দিয়ে খেলার সমাপ্তি ঘোষণা করত। বোধহয় সে চাইত না আমি কখনোই জিতি। আমি প্রতিবারেই একজন হতভম্ব স্ট্রাইকারের মতো গোলের দিকে ছুটতে গিয়ে ডাইনে বা বাঁয়ের পোস্টের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে বেশ কিছুকাল অচেতন হয়ে পড়ে থাকতাম। এই কথাটা কতখানি সত্য, পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ অনুসরণ করলে পাঠক সম্যক বুঝতে পারবেন।

শহরে যাবার সরঞ্জাম সংগ্রহ করাটা জরুরি হলো। বরিশাল শহরে ইতিপূর্বে মাত্র দুবার গিয়েছিলাম। একবার অত্যন্ত ছোটবেলায়, সে স্মৃতি কিছুমাত্র স্মরণ নেই। আরেকবার একটু বড় বয়সে। ছোট ভাইটা গাছ থেকে পড়ে গিয়ে হাত ভেঙে ফেলেছিল, তার চিকিৎসার জন্য। সঙ্গে পাড়ার একজন কে যেন ছিল সেও আবছা স্মৃতিমাত্র। জ্ঞানত আমার এই প্রথম শহরযাত্রা এবং বসবাস। শহরের জীবনযাপনপ্রণালি, তার অলিগলি, বিভিন্ন স্থানাদি ইতিপূর্বে আমার অভিজ্ঞতায় আদৌ ছিল না। ঝালকাঠি বন্দর-শহরের যে অভিজ্ঞতা ছিল, এই শহরটির রকমসকমও তেমনই হবে, এরকম একটা ধারণা নিয়ে আমি আবশ্যকীয় জিনিসপত্র গোছগাছ করতে শুরু করলাম। মা বলেছিলেন যে, শহরে জুতো পায়ে দেয়া নিতান্ত আবশ্যক। গ্রামে আমাদের জুতোর দরকার প্রায়শই হতো না। বাজার থেকে বারো আনায় এক জোড়া হাওয়াই চপ্পল কিনে নিলাম। কিন্তু জামাকাপড়ের সংস্থান করা নিতান্ত সহজ হলো না। মায়ের হাতে তৈরি, মার্কিন কাপড়ের একটি পাজামা ও একটি জামা আমার ছিল। অনেক কষ্ট করে মা ওইরকম আরেক প্রস্থ মার্কিনি জামা-পাজামা তৈরি করে দিলে পোশাকের সমস্যা মিটল। কোথায় থাকব-না-থাকব তার ঠিক ছিল না বলে বিছানার ব্যবস্থা করলাম না। একটা টিনের ছোট বাক্সে জামাকাপড়, একটা লুঙ্গি এবং গামছা, আর দু-একখানা পাঠ্যবিষয়বহির্ভূত বই সাজিয়ে নিলাম। এর বেশি আমার কিছু ছিলও না, বা তার জন্য কোনো অভাব বোধও করতাম না। তখনও শহরজীবনে পোশাকের পারিপাট্য এবং তার ভূমিকা বিষয়ে আমার কোনো ধারণাই ছিল না। পরবর্তীকালে দেখে এবং ঠেকে শিখলাম যে সেখানে মানুষরা খাক না খাক, পোশাকে পরিপাটি থাকে। নচেৎ শহরজীবনে তারা আদৌ কল্কে পায় না।

যা হোক, অবশেষে আমার এই আকাঙ্ক্ষিত দিনটি উপস্থিত হলো। জ্যাঠামশাই আমাকে নিয়ে বরিশালের উদ্দেশে রওনা হলেন। সময়টা ১৯৬২ সালের কোনো একটা দিন। তখনও ঝালকাঠি-বরিশাল মোটরবাস খুব একটা চালু হয়নি। কেনেস্তারা টিনে মোড়া দু-একখানা গাড়ি খুবই অনির্দিষ্টভাবে যাতায়াত করত। রাস্তাটিও খুবই করুণ। এ কারণে জ্যাঠামশাই মোটরলঞ্চেই যাওয়া ঠিক করলেন। আমাদের কাছাকাছি গাবখানের নদীর একটি ঘাট থেকে আমরা লঞ্চে উঠলাম। ঘাটটি তৈরি করিয়ে ছিলেন কীর্তিপাশার রোহিনীকুমার রায়চৌধুরী মশাই। একসময় এই এলাকাটি খুবই বর্ধিষ্ণু ছিল। খুলনাগামী স্টিমার ইত্যাদি যাত্রী এবং মালবাহী জলযানগুলো পথ-সংক্ষেপের জন্য এই নদীপথে যাতায়াত করত এবং এই ঘাটে নোঙরও করত। ঘাটটির নাম ছিল রোহিনীগঞ্জের ঘাট। ঘাটের কাছাকাছি মহাশয়দের একটি কাছারিবাড়ি ছিল খাজনাপত্র আদায়ের জন্য, আর ছিল একটি বড় হাট তথা স্থানীয় ফসলাদির বাণিজ্যকেন্দ্র। এখন অবশ্য সেসব আর কিছুই নেই। ঘাটটি বহু আগেই নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। রোহিনীগঞ্জ নামটিও খুব পুরনো লোক ছাড়া এখন আর কারও মনে নেই।

এই জলপথটিকে যদিও আমরা গাবখানের নদী বলি, আসলে এটি একটি কাটা খাল মাত্র। প্রাচীনজনেরা একে ধানসিদ্ধির খালই বলে থাকেন। একসময় একটি ছোট খাল ছিল। কবি জীবনানন্দ সম্ভবত একেই ‘ধানসিঁড়িনদী’ আখ্যা দিয়ে অমর করেছেন। বাণিজ্যিক এবং যাতায়াতের সুবিধের জন্য সম্ভবত উনিশ শতকের কোনো একটা সময় ব্রিটিশ শাসকেরা এটিকে সংস্কার করে সুগন্ধা অর্থাৎ ঝালকাঠি নদীর সঙ্গে শেখের হাটের নদীটির যোগাযোগ ঘটান। ফলে বরিশাল অঞ্চলের সঙ্গে তার পশ্চিমস্থ ভূভাগের পথ অনেকটাই সংক্ষিপ্ত হয়।

যা হোক জ্যাঠামশাইয়ের সঙ্গে লঞ্চে উঠে নদীর দুই তীরের গাছপালা, গৃহস্থালি দেখতে দেখতে চলতে লাগলাম। নদীর মাঝখান থেকে তীরের দৃশ্য বড় চমৎকার। এর আগে স্টিমার বা লঞ্চে যে চাপিনি, তা নয়। কিন্তু সেসব অতি শৈশবের ঘটনা, আবছা আবছা মনে পড়ে। এ কারণে এই লঞ্চযাত্রা আমার কাছে খুবই উপভোগ্য বোধ হতে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে এ-ও মনে হতে থাকে যে, পিছারার খালের সোঁতায় ভেসে ভেসে খালে পড়া, তারপর এই গাবখানের খালের বৃহত্তর পরিধি অতিক্রম করে ঝালকাঠি নদী অর্থাৎ সুগন্ধার বিস্তীর্ণতা পেরিয়ে কীর্তনখোলার আর প্রসারতার মধ্যে পড়াটা যেন কী এক রহস্যময়ভাবে আমার জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোত।

তখনকার দিনে আমাদের দেশে যাতায়াত সাধারণত নৌকায়ই করতাম। লঞ্চের যান্ত্রিকব্যবস্থা সে জন্য আমাকে খুবই মুগ্ধ করে তুলল। লঞ্চ যখন গাবখানের খাল অতিক্রম করে সুগন্ধায় পড়ল, তখন উত্তেজনা আরও তীব্র হলো। কী প্রকাণ্ড প্রসারতা, কী গভীর ভাবগাম্ভীর্যময় এবং অবশ্যই রহস্যময়। এর আগে সুগন্ধাকে তীর থেকে বহুবার দেখেছি। আজ তার বুকের ওপর দিয়ে লঞ্চে যাবার সময় আমার হৃদয়মন যেন এক অলৌকিক বোধে আচ্ছন্ন হয়ে গেল। একই সঙ্গে ভয় এবং আনন্দের অনুভূতি এর আগে কখনো এমনভাবে অনুভব করিনি। অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে নদীর ব্যাপ্তি ক্রমশ বেড়েই যাচ্ছিল, আর আমি মন্ত্রমুগ্ধবৎ সেই বিশালতায় নিজেকে হারিয়ে ফেলছিলাম। নদীর পার ক্রমশ দূরবর্তী হচ্ছিল। গাছপালা, বাড়িঘরগুলো দ্রুতবেগে বিপরীত দিকে হারিয়ে যাচ্ছিল, আর আমার মনে হচ্ছিল আমি যেন শৈশব, কৈশোরের পিছারার খালের জগৎ থেকে অতিদ্রুত অজানা এক জগতের দিকে ছুটে চলেছি। কোনও দিন আমি ওই জগতে আর প্রবেশ করতে পারব না। এমনকি আমার সঙ্গে আমার যে জ্যাঠামশাই যাচ্ছেন, তাঁকেও একটা সময় আমাকে অতিক্রম করে যেতে হবে, যেহেতু তাঁর গন্তব্যস্থল নির্দিষ্ট এবং প্রত্যাবর্তনের বাধ্যকতা আছে। আমি কখনো প্রত্যাবর্তন করলেও তা কেবল খানিকক্ষণের প্রয়োজন সাপেক্ষে। ওই জগতে আমি আর কোনো দিন স্থায়ী বাসিন্দা হতে পারব না। এরকম এক বোধ জন্ম নিলে আমি খুবই বিষণ্ন হয়ে পড়লাম। মা, বাবা, ভাইবোন এবং পরিচিতজনেদের থেকে বাড়ির সেই প্রাচীন অট্টালিকা, বাগানের বৃক্ষাবলি, খালপারের সেই পিতামহ-পিতামহী সদৃশ জোড়া রেনট্রির স্নেহচ্ছায়া, এমনকি পুকুর, দিঘি, ঝোপঝাড়, জঙ্গল সবকিছু থেকে আমি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম। আমার এই চলার গতি এখন থেকে বাড়তেই থাকবে। প্রিয় কোনো স্থান, ব্যক্তি, বস্তু বা ভালোবাসা কোনো কিছুই আঁকড়ে রাখতে পারব না। এই সময় আমার মনে হলো আমি বড় হয়ে গেছি। আমি এখন একজন সম্পূর্ণ একা মানুষ।

আমার এই তন্ময়তা কতক্ষণ ছিল স্মরণে নেই। একসময় যাত্রীদের মধ্যে ব্যস্ততা শুরু হলে বাস্তবে ফিরি। লঞ্চ জেটির দিকে মোড় নিয়েছে। নদীর মধ্য থেকে শহরের দিকে দৃষ্টি পড়লে তার অপূর্ব সব স্থান এবং সৌন্দর্য আমাকে মোহিত করে দিল। কীর্তনখোলা অর্ধ-চন্দ্রাকারে শহরকে বেষ্টন করে আছে। তীরবর্তী বৃক্ষাবলি এবং তাদের ফাঁকে ফাঁকে অট্টালিকাপ্রায় তথা ছোটবড় বাড়িগুলো অপূর্ব দেখাচ্ছিল। লঞ্চ এবং স্টিমারঘাটে অপেক্ষমাণ নানা ছোটবড় জলযানগুলোর মাথায় বিভিন্ন বর্ণের পতাকাগুলো পতপত করে উড়ছে। যাত্রীরা স্বাভাবিক ব্যস্ততায় ওঠানামা করছে। সবকিছু মিলিয়ে আমার একটা অদ্ভুত নতুন অনুভূতির সৃষ্টি হলো। শহরটি সত্যই অত্যন্ত সুন্দর। আমাদের সেইসব দিনে অথবা তার আগেকার দিনে যাঁরা এ শহরকে দেখেছেন, তাঁরা জানেন যে, এর ভেনিস অব বেঙ্গল নামটি মিথ্যে দেয়া হয়নি।

জ্যাঠামশাইয়ের সঙ্গে নেমে তাঁর পেছন ধরে চলতে লাগলাম। তখনও জানি না তিনি আমাকে কোথায় রাখবেন বা কী অবস্থার মধ্যে আমাকে থাকতে হবে। বাড়ি থেকে বেরোনোর পর এই দীর্ঘ পথযাত্রায় তিনি আমার সঙ্গে একটিও কথা বলেননি। এই যে অতসব নতুন স্থান, নদী ইত্যাদি পেরিয়ে এলাম, কত প্ৰশ্নই না আমার মনের মধ্যে জাগল, কিন্তু সেসব জিজ্ঞেস করার মতো সাহস আমাদের ছিল না তখনকার দিনে। সে যুগে গুরুজনেরা নিতান্তই ভয়ের বস্তু। তাঁরা যদি অনুগ্রহ করে কখনো কিছু বলেন তো বর্তে যাই। এটা অবশ্য তখনকার স্বাভাবিক রীতির মধ্যেই পড়ে। আমার ক্ষেত্রে তো বিষয়টি আরও ভীতিপ্রদ অথচ নতুন স্থান বা নদ-নদী ইত্যাদি বিষয়ে সম্যক তথ্য তত্ত্ব বলা বা সেসব বিষয়ে পরিচয় দেয়া তো গুরুজনদের আনন্দের বিষয়। কিন্তু সেসব সৌভাগ্যে অভাজনেরা বঞ্চিতই ছিল।

জ্যাঠামশাই অনেক অলিগলি, বড় রাস্তা, ছোট রাস্তা অতিক্রম করে আমাকে একটি বাড়িতে নিয়ে গেলেন। বাড়িটির গায়ের ওপর থেকে নিচে লম্বালম্বিভাবে লেখা ছিল—আর্যলক্ষ্মী ব্যাংক প্রাঃ লিঃ।’ সম্ভবত বাড়িটির কোনো একটি তলে এই ব্যাংকের অফিসটি ছিল। সিঁড়ি ভেঙে তিনতলায় উঠে আমরা একটি ঘরে ঢুকলাম, সেখানে একখানা তক্তপোষের ওপরে প্রায়বৃদ্ধ এক ভদ্রলোক বসেছিলেন। তাঁর সঙ্গে জ্যাঠামশাইয়ের আলাপচারিতায় বুঝলাম তাঁরা পরস্পরের সঙ্গে পূর্বপরিচিত। তাঁর সঙ্গে নানান বিষয়কর্মের কথাবার্তা শেষ করে, আমাকে ওখানে অপেক্ষা করতে বলে জ্যাঠামশাই কোথায চলে গেলেন। বৃদ্ধ ভদ্রলোক খানিকক্ষণ এ কথা সে কথা বলে। বললেন—তোমার জ্যাঠামশাই একটু বাদেই আসবেন। তুমি বিশ্রাম করো, আমি খানিক ঘুরে আসি। বলে তিনিও চলে গেলেন। আমি একা। ঘরে একটা বইপত্তর নেই যে, পড়ে সময় কাটাব।

একা একা ঘণ্টাখানেক সময় কাটানোর পর জ্যাঠামশাই এলেন। কিন্তু যাকে তিনি সঙ্গে করে নিয়ে এলেন, তাকে দেখে আমি বেশ ঘাবড়ে গেলাম। লোকটি আমাদের গ্রামেরই, বেশ পয়সাওলা লোকের বদ ছেলে। বিয়েটিয়ে করেনি। গ্রাম সুবাদে আমার বাবা-জ্যাঠামশাইয়ের নাতি সম্পর্ক। আমি এবং আমার পরের ভাই ছোটন ছোটবেলাকার তীব্র অভাবের দিনে যখন দুআনা এক আনা রোজে পরিচিত লোকচক্ষুর আড়ালে জন খাটতাম, তখন একদিন সে দেখে ফেলেছিল। পরে একদিন আমাদের গ্রামের পোস্ট অফিসের বারান্দায় কী একটা ছুতো করে আমাকে মেরেছিল। সম্ভবত আমাদের জনমজুর খাটার ব্যাপারটা তার পছন্দ হয়নি। কিন্তু সে আমাদের এ ধরনের কাজে নিয়োজিত থাকার কার্যকারণ বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস পর্যন্ত না করে খুব একচোট গার্জেনি মার মারলে আমি খুবই অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। তার বাবা ছিলেন একজন বিখ্যাত মদ্যপ। তিনি গত হলে তাঁর পুত্রটি পিতৃপথের পরিধিটি আরও খানিকটা বিস্তৃত করে নিয়েছিল। কিন্তু সেটাও চূড়ান্ত ছিল না, তার আরও একটি স্বভাব ছিল, সে কথা যথাসময়ে বলা যাবে।

জ্যাঠামশাই বললেন, ভালোই হলো, এখানে দাদুকে পেয়ে গেলাম। শহরে-নগরে অজানা মানুষের কাছে তোমাকে থাকতে হবে না। দাদুই তোমার দায়িত্ব নিচ্ছে। তুমি তার সঙ্গে চলে যাও। এখন থেকে শুধু পড়াশোনা ছাড়া অন্য কোনো দিকে মন দেবে না। তাহলে দাদু আমি চলি—বলে কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে কী মনে পড়ায় আবার ফিরলেন। হাতের প্যাকেট থেকে একখানা ফর্ম বের করে বললেন, ভুলেই গিয়েছিলাম। এই নাও ভর্তি হবার ফর্ম। ফিল-আপ করা আছে, আর এই ভর্তি ফি পঞ্চাশ টাকা আট আনা। ফর্মে সই করে কালই গিয়ে ভর্তি হয়ে যাও। লোকটিকে উদ্দেশ করে বললেন, তুমি তো সবই জানো। সারা জীবন শুধু বোঝা টেনেই গেলাম। সে যাক। আমার কর্তব্য আমি করলাম, এখন এরা যা করে। তবে চললাম, একটু অবনী উকিলের কাছে যেতে হবে। বলে তিনি চলে গেলেন। আমি একটা কথাও জিজ্ঞেস করতে পারলাম না, কিছু বুঝতেও পারলাম না। তবে কৃতজ্ঞ বোধ করলাম এই জন্যে যে, জ্যাঠামশাই তাঁর যথাকর্তব্য করলেন। আমি এটা আশা করিনি। মনের মধ্যে থেকে বহুদিন-পোষিত গুরুজনকে শ্রদ্ধা করতে না-পারা জনিত গ্লানিটা দূর হলো। তবে এই প্রথম এবং এই শেষ। তিনি আর কোনো দিনই এই শহরে আমার কোনো সংবাদ করেননি।

লোকটি আমার সঙ্গে কোনোরকম খারাপ ব্যবহার করল না। বলল, আমি এখানে একটা সিনেমা হলে ম্যানেজারি করি। হলটা এখন প্রায় আমারই বলা যায়। যা হোক তুই চল। তোর কোনো অসুবিধে হবে না। একটা রিকশায় চেপে তার সঙ্গে রাস্তা দিয়ে চলতে লাগলাম। সে অত্যন্ত খুশমেজাজে শহরের নানান দর্শনীয় স্থানগুলো উৎসাহের সঙ্গে দেখাতে দেখাতে চলল। অনেকক্ষণ এদিক ওদিক দেখে আমরা একটা বিশাল ঝকঝকে প্রাসাদোপম বাড়ির গেটে গিয়ে উপস্থিত হলাম। বাড়িটি ওই শহরের এক বিখ্যাত ধনী ব্যক্তির। তিনি তখন বেঁচে নেই। তাঁর দুই সংসারের পুত্র, কন্যা এবং এক স্ত্রী ওই বাড়িতে থাকতেন। লোকটি ওই মহিলার কীরকম যেন ভাই। সেই সুবাদে সিনেমা হলের ম্যানেজারি এবং ওই বাড়িতে থাকা।

সকালে মা সামান্য চিড়ে-মুড়ি কিছু খাইয়ে দিয়েছিলেন। সারাদিন আর কিছু খাওয়া হয়নি। বেলা অনেক হয়ে গিয়েছিল। বেশ খিদে তখন পেটে। হাতমুখ ধুয়ে আমরা দুজনে খেতে বসলাম। জীবনে সেই প্রথম জানলাম যে, পৃথিবীতে কিছু মানুষ টেবিল-চেয়ারে বসে খায়। শহরজীবনের আচরণ এবং উপকরণ বিষয়ে এভাবেই আমি অভিজ্ঞ হচ্ছিলাম। খাওয়া শেষ হলে আমার নতুন মুরুব্বি আমাকে নিয়ে বাড়িটির দোতলার একটি ঘরে ঢুকে বলল, এই ঘরে আমরা দুজনে থাকব। আমার ফিরতে একটু রাত হয়। তুই পড়াশোনা করে খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়বি। আমি আমার মতো আসব। তোর অসুবিধের কোনো ব্যাপার নেই।

ঘরটির সৌষ্ঠব এবং আয়োজন দেখে আমার মনে হচ্ছিল আমি স্বপ্ন দেখছি না তো। এত আরামের ব্যবস্থায় কোনো দিন থাকিনি, থাকব এমনও ভাবিনি। আর একবার মনে মনে জ্যাঠামশাইকে কৃতজ্ঞতা জানালাম এবং আমার এতকালের পুঞ্জীভূত অভিমানের জন্য অনুতপ্ত হলাম। নতুন মুরুব্বির আচরণ বেশ সদয় এবং আন্তরিক। সে আমাকে একটা বিষয়ে সতর্ক করে দিল যে, আমি যেন কোনো ক্রমেই এই বাড়ির কোনো ব্যাপারে কৌতূহলী না হই, কোনো কিছুতে যেন নাক না গলাই আর ছেলেমেয়েদের সঙ্গে যথাসম্ভব না মেলামেশা করি। একজন দায়িত্বশীল অভিভাবকের মতো সে আমাকে এই কথা বলে তার অফিসে চলে গেল। ওই দিন আর আমার করণীয় কোনো কাজ ছিল না। বেলাও শেষ। একজন চাকর এসে ঘরের লাইটগুলো জ্বালিয়ে দিয়ে গেল। টিনের বাক্সটা থেকে একখানা বই নিয়ে চেয়ারে বসে পড়তে লাগলাম। বইখানা কার লেখা আজ আর মনে নেই। তবে বিষয়বস্তু প্রাক-ইসলামি যুগের আরবদের ইতিহাস। খুবই চিত্তাকর্ষক বই। সহজ সরল ইংরেজিতে লেখা। বইটির মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় লাগছিল প্রাক-ইসলামি কিছু কবিতার উদ্ধৃতি। তার মধ্যে কিছু ছিল সম্পূর্ণ কবিতা, কিছু আংশিক। আজ ভাবতে অবাক লাগে যে, ওইরকম একটা নীরস এবং দীনতম পরিস্থিতিতেও কবিতা আমাকে অসম্ভব আকর্ষণ করত। তখন ষাটের দশকের শুরুয়াত। পৃথিবীর অন্য দেশের কথা ছেড়ে দিই, আমাদের বাংলা সাহিত্যেও কবিতার জগতে তখন বেশ বিপ্লব ঘটে গেছে। কিন্তু ওই অজ গাঁয়ে আমার মতো কাব্যবিপাসুরা তখনও মধু, হেম, নবীন এবং রবি ছাড়া কোনো বড় কবির কাব্য পাঠ করিনি, এমনকি রবীন্দ্র-পরবর্তী নতুন কাব্যধারার কবিদের নাম পর্যন্ত জানতাম না। তখনও রবীন্দ্রনাথ আমাদের কাছে শেষ কথা। বাবা একবার লিখেছিলেন—

তারপরেতে উদয় হলেন বাংলাদেশে রবি
হবু কবির আশা ভরসা
শেষ করলেন সবই।
ভূত ভবিষ্যৎ বর্তমান
এক কলমে লিখে
কেউ যে কিছু লিখবে পরে
গেছেন কি আর রেখে?

আমরাও এই ধারায়ই বিশ্বাসী ছিলাম। আরবদের প্রাক-ইসলামি যুগের ইতিহাস গ্রন্থখানায় যেসব কবিতার উদ্ধৃতি আমি পেয়েছিলাম, তার ধরন-ধারণ সম্পূর্ণ অন্যরকম এবং সে কারণেই তা আমাকে মজিয়েছিল।

বইখানা বেশ পুরনো। আমাদের পরিবারের এক শরিক, আমাদেরই সম্পর্কে কাকা হন, তাঁর ঘরে অনেক বইপত্র সংগ্রহ করে রেখেছিলেন। তিনি নাকি খুবই পড়াশুনোর ভক্ত ছিলেন। তাঁকে আমি কোনো দিন দেখিনি। তাঁরা যখন বাড়িতে ছিলেন, তখন বাড়ির এবং আমাদের এস্টেটের সুবর্ণযুগ। বাবা বলতেন, এইসব বই বিনয়ের কালেকশন। তাঁরা বাড়িঘর ছেড়ে কবে যেন বিদেশবিভুঁইয়ে। খুঁজে-পেতে, বুঝে-না-বুঝে বইখানা স্ব-অধিকারে গস্ত করে নিয়েছিলাম। এখন যখন পড়ছি, দেখছি বড় উত্তম কাজ করেছি। বিনয় কাকারা কোনো দিন আর এই বইয়ের খোঁজ করবেন না। অতএব আমি যদি তো ভোগ করি কার কীই-বা বলার থাকতে পারে? সর্বোপরি আমরা একই বাড়িরই তা সন্তান, তাঁর উত্তরপুরুষ হিসেবে তাঁর বন্ধ ঘরের দরজার খড়খড়ি ভেঙে যদি তা আমি নিয়েই নিই, কার কী বলার আছে? বই কারও বাপের নয়। যে কেনে তারও নয়। যে পড়ে তার অবশ্যই। যেমন, দুধ খেত বলে গাই কমলাকান্তের, মালিক প্রসন্ন গোয়ালিনীর নয়। কিন্তু সে যা হোক হয়ে গেছে, আমি যে এখন বইখানা পড়ছি সেটাই আসল বাস্তব এবং আনন্দের কথাও বটে। নচেৎ বইখানা যদি সের দরে বিক্রি হয়ে লঙ্কা-জিরে-হলুদের মোড়ক হতো, তাহলে কি উত্তম হতো? হতো না। কিন্তু কথা হচ্ছে যেসব মানুষদের ইসলামে শরিক করে মুহাম্মদ তাদের ওপর খরার খড়্গগ তুলে ধরলেন, তাদের গতি অতঃপর কী হলো? যেসব মানুষ এরকম একটা জীবনযাপনের আনন্দে মশগুল, অবাধ স্বাধীনতা, অবাধ পান, অবাধ যুদ্ধ এবং অবাধ নারীসম্ভোগ, সেখানে তারা কদাপি কি সীমাবদ্ধতার আরোপণে সুখী হতে পারে? সুরার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ তাদের পক্ষে খুবই ক্ষোভ এবং কষ্টের কারণ হয়েছিল। এমনকি মহম্মদের অব্যবহিত পরেও আমরা দেখি যে, এক জীবন্ত সুরাপায়ী গোষ্ঠী তৈরি হচ্ছে পয়গম্বরের পরবর্তী প্রজন্মে, যেখানে পবিত্রাত্মা আবু আইয়ুব-উল-আনসারির পুত্র পর্যন্ত একজন সভ্য। আমরা তার সুরাসংগীত শুনে তাজ্জব বনে যাই—

Hand me then my cup and let alone the talk of those who reproach. Invigorate the bones whose end is decay and decomposition.

For delay in handling me over the cup or in keeping it back is the death. But when the cup comes to me it is my very life.

সুরার ওপরে সামগ্রিক নিষেধাজ্ঞাটিকে বেশ কিছু গোষ্ঠীর আরব-মনুষ্য বড়ই অশ্রদ্ধার চক্ষে দেখেছে। কিন্তু ভিন্ন আলোচনা থাক। বিশেষত যখন সুরাপান ইসলামে হারাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *