চব্বিশ
পিছারার খালের চৌহদ্দির ক্ষুদ্রতা এবং শূন্যতা কাটিয়ে বড় খালের সোঁতায় ভাসতে ভাসতে প্রথমে তারুলি স্কুল, তারপর কীর্তিপাশা স্কুলে এসে আমার জীবন এবং মনমানসিকতার বিস্তার ঘটেছিল। পিছারার খাল এভাবেই ক্রমশ পেছনে মিলিয়ে যাচ্ছিল। আমি আস্তে আস্তে বৃহৎ থেকে বৃহত্তর স্রোতকে অবলম্বন করছিলাম। চারদিকের ব্যাপক অবক্ষয় এবং ধ্বংসের বিরুদ্ধে আমার সেই প্রাণপণ লড়াই একসময় আমাকে শিখিয়ে দেয় যে, জীবন সর্বৈব নিঃসঙ্গ নয়।
পারিবারিক নিষেধের লক্ষ্মণগণ্ডি পেরোনোর লড়াইটা জিতে গিয়ে আমার শক্তি ও সাহস অনেকটা বেড়ে গিয়েছিল বলেই ব্যক্তিকভাবে আমি এরপর একেকটা বাধার পাহাড় ডিঙোতে পারছিলাম। আমার নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস, আমার চেতনার বিভিন্ন অনুষঙ্গ, যা বাবা এবং জ্যাঠামশাইয়ের কঠিন নিষ্পেষণে শৈশবকাল থেকে চাপা পড়ে ছিল, কীর্তিপাশার স্কুলের চৌহদ্দিতে পড়ে তা মুক্তি পেল। অশ্বিনীবাবুর শিক্ষা এবং সাহচর্য এ ব্যাপারে আমার সহায়ক হয়েছিল। সাধারণ মানুষদের ঘরের সাধারণ ছেলেদের সঙ্গে মিশে সাধারণ হবার শিক্ষা পেলাম। জীবনে এটা আমার সবচেয়ে বড় লাভ। যতদিন স্কুলে ছিলাম, এখানকার সাধারণ মানুষদের খেলাধুলো, যাত্রা-থিয়েটার, পড়াশোনার পরিবেশ ইত্যাদির উত্তাপ যথেষ্ট পেয়েছি। কিন্তু পোড়া কপালে তা অধিক দিন স্থায়ী হলো না। স্বৈরাচারী শাসকদের ব্যাপক কদাচার, ভেদনীতি, জঙ্গিশাহী অবিমৃষ্যকারিতা দেশকে এক অন্ধকার গর্তের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। আমরা বড় হতে হতে এইসব নিদারুণ অবক্ষয় এবং হতাশার শিকার হচ্ছিলাম। ব্যক্তিকমুক্তি যেটুকু অর্জন করেছিলাম, সাম্প্রদায়িক কারণে তা কোনোভাবেই আমাদের মতো সংখ্যালঘু ছেলেদের রাষ্ট্রীয় মূল স্রোতে পৌঁছে দিতে পারেনি। সেখানে বাধা ছিল হিমালয়-প্রমাণ
আমাদের স্বাভাবিক বিকাশের এই বাধাটা শুধু রাষ্ট্রের তরফ থেকেই ছিল, এ কথা বললে ভুল হবে। ওখানকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অভিভাবকদের দায়ও এ ব্যাপারে যথেষ্ট ক্রিয়াশীল ছিল। কিন্তু ইতিপূর্বের আলোচনায় সে কথা যথেষ্ট বলা হয়েছে, অধিক নিষ্প্রয়োজন। মোদ্দা কথা হলো, যে আর্থব্যবস্থায় ইতিপূর্বের সমাজ বিধৃত ছিল, তা ধ্বংস হলে এবং নতুন কোনো আর্থব্যবস্থা সৃষ্টি না হলে গোটা সমাজটিই পিছারার খালটির মতো শুকিয়ে যেতে থাকে। একদার সংস্কৃতিসমৃদ্ধ এইসব গ্রামগুলোকে দিন দিন লক্ষ্মীছাড়া হতে দেখতে দেখতে বুকের মধ্যে এক সতত বিষণ্নতার বৃক্ষ যেন স্থায়ী শিকড় গেড়ে বসছিল। কীর্তিপাশা স্কুলের চৌহদ্দির উষ্ণতা সেখানে সাময়িক প্রলেপ মাত্রই ছিল। স্থায়ী আরোগ্যের ওষুধ ছিল না। বিভিন্ন ঋতুকালীন সব বর্ণাঢ্য উৎসবগুলোর দিনে অন্তরস্থ বিষাদবৃক্ষের পাতা ঝরানোর বিষণ্ণতা জন্মের মতো কায়েমি হয়ে থাকল আমাদের জীবনে।
স্থানীয় মুসলমানেরা উচ্চ-নীচ শ্রেণি নির্বিশেষে কোনো আলাদা সংস্কৃতির অধিকারী ছিল না। শুধু ধর্মীয় উৎসবই তাদের একান্ত নিজস্ব সংস্কৃতি। নিম্নবর্গীয় জনেদের লোকায়ত সংস্কৃতির ধারক উভয় সম্প্রদায়ের নিম্নবর্গীয়রাই। কিন্তু শুচিবাইগ্রস্ত কট্টর মোল্লাপন্থিরা ক্রমশ তাদের ওপর নিষ্পেষণ চালাতে থাকলে সংস্কৃতির এই ধারাটি শুকিয়ে যেতে থাকে। শৈশবে শোনা এবং দেখা জারি, সারি, মারফতি, কথকতা, রামযাত্রা, কিস্সা এবং ইত্যাকার হাজারও লোকরঞ্জক অনুষ্ঠানগুলো আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যেতে থাকে। এইসব সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে এমনকি কীর্তন, রয়ানি প্রভৃতির আসরেও মুসলমান নিম্নবর্গীয়দের ব্যাপক উপস্থিতি এবং অংশগ্রহণ লুপ্ত হতে থাকে জেনারেল প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের শাসনকালেই। কারণ মিলিটারি শাসকদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য মোল্লাতন্ত্রের হাত শক্ত করা এবং তাদের প্রতিপত্তির ক্ষেত্র বিস্তৃত করার প্রয়োজন হয়েছিল। সেই প্রয়োজনের কর্মকাণ্ডের চাপে এই আবহমান সংস্কৃতি অতি দ্রুত বিলুপ্তির পথে চলে যেতে থাকে। এই কর্মকাণ্ড অবশ্য বহুকাল আগে থেকেই শুরু হয়েছিল, কিন্তু এ দেশীয় নিম্নবর্গের মানুষেরা, হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে, তাদের সাংস্কৃতিক আত্মীয়তার শক্তির দ্বারা তা প্রতিহত করতে সক্ষম ছিল। মোল্লাতন্ত্র শুরুতে অর্থাৎ মোগল, পাঠান রাজত্বকালে যে ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেনি, জঙ্গি পাকিস্তানি আমলে তা পুরোপুরি করতে পেরেছিল। সেই আমলে ইসলামি ধর্মপ্রচারকেরা শুধু ধর্মান্তকরণের জন্যই সচেষ্ট ছিলেন এবং এ দেশীয় সমাজের বর্ণাশ্রমী নির্যাতনে ক্লিষ্ট নিম্নবর্ণকে ইসলামে দীক্ষিত করার জন্য এক অনুকূল পরিবেশ লাভ করেছিলেন। তাঁরা এর দ্বারা কোনো সাংস্কৃতিক বিভাজনে সচেষ্ট হননি। উপমহাদেশীয় স্বাধীনতা আন্দোলন এবং স্বাধীনতা-পরবর্তী সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম হলেই এই বিভাজন ক্রমশ আত্মপ্রকাশ করতে থাকে এবং ফৌজি দখলদারির পরে তথাকথিত ইসলামি সংস্কৃতি স্থাপনার ধুয়ো ধরে মোল্লাতন্ত্র এই লোকায়ত সংস্কৃতির উচ্ছেদকল্পে এক ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করে।
হিন্দু নিম্নবর্ণীয়দের দেশত্যাগ শুরু হলে এই সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে যে শূন্যতা তৈরি হয়, নিম্নবর্গীয় মুসলমানেরা হয়তো তা পূরণ করতে পারত, কিন্তু সেই সময়টাতেই মোল্লাতন্ত্র তাদের ওপর ফতোয়া জারি করে এই সংস্কৃতির মূলে কুঠারাঘাত করে। ধর্মীয় কড়াকড়ি, সামাজিক তথা রাষ্ট্রীয় রক্তচক্ষুও মোল্লাদের এই জিহাদের জন্য যথেষ্ট মনে না হওয়ায় তারা এইসব সংস্কৃতির মাধ্যমগুলোর ভেতরে অনুপ্রবেশ করে তার একটা সাম্প্রদায়িক আকৃতি দেয়। এইসব কার্যকলাপই পঞ্চাশের শেষ এবং ষাটের দশকের প্রথমার্ধে তারা সম্পন্ন করে।
লোকায়ত সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান মাধ্যম ছিল জারিগান। শুধু আমাদের অঞ্চলেই নয়, গোটা পূর্ববাংলার সব জেলাগুলোতেই জারিগানের প্রাধান্য ছিল। অতি শৈশবে দেখেছি আমাদের বাড়িতে শারদোৎসব শেষ হলে জারিগানের আসর বসত। সেখানে গায়ক এবং শ্রোতারা প্রায় সবই নিম্নবর্ণীয়/বর্গীয় হিন্দু-মুসলমান। সেই সময়ের একটি গানের কথা মনে আছে। মূল জারিগান শুরু হবার আগে প্রস্তাবনা হিসেবে সাধারণত বন্দনাগান হয়। কিন্তু যতদূর মনে আছে, এই গানটি কোনো কোনো জারিগানের আগে বন্দনার পরিবর্তে গাওয়া হতো। গানটি হচ্ছে-
হারে পিছন দিকে চাইয়া দ্যাখ রে
তর ডুইবা গেল বেলা
দিন থাকিতে ভাসাও মন তোমার
ভবপারে ভ্যালা।
সুন্দর দালান ঘর বাড়ি
হায় রে সবই ছাড়িয়া
যাইতে হইবে তোমায়
হায় রে দুনিয়া ছাড়িয়া ॥
আইছ ভবে যাইতে হবে
মরণ আপন নয়
দিন থাকিতে ও পাষাণ মন
একবার ডাক দয়াময়।
অথবা—
পরথমেতে আল্লার নামটি নিতে করলাম শুরু।
অনাথের নাথ গো আল্লা দয়া করো গুরু।
গুরু গুরু বলতে আমার এহোজনম গেল।
নিজ গুরুর সঙ্গে আহা দেখা নারে হইল।।
গুরু যেমন ভবের মাঝে আর কে এমন হবে।
গুরুর নামে কত অধম হেলায় তোইরে যাবে।
আহা গুরু কল্পতরু তুই নৌকার ব্যাপারী।
সদুদ্দুর ধরছি পাড়ি গুরু হও কাণ্ডারী ॥
কারে ডাকি দীনবন্ধু কারে ডাকি নাথ।
কেমনে পাইব আমি তার হাকিকত ॥
তুমি বিনে মা এই অধমের নাইত কোনো গতি।
আমায় জিব্বায় বইসে জোগাও কথা লক্ষ্মী সরস্বতী ॥
এইরকম সব গান গেয়ে মূল জারিতে যাওয়া হতো। সাধারণত জারি গাওয়ার নিয়ম হচ্ছে উপস্থিতমতো পদ্যাকারে কাহিনির রচন এবং বিন্যাস। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কাহিনিটি থাকে প্রচলিত কোনো উপাখ্যান, যেমন কারবালার যুদ্ধের করুণ আখ্যায়িকা, খত্নামার কাহিনি, নমরুদ বাদশার জারি, চাচা-ভাতিজার যুদ্ধ, মাদারমণির গান, লক্ষমতীর পালা এইসব। বরিশালের নিজস্ব জারি শুনেছি গুণাইবিবির গানে। এই কাহিনিগুলো সবই প্রায় করুণ রসাশ্রিত। শ্রোতারা চোখের জলে বুক ভিজিয়ে রাতের পর রাত ধরে এইসব শুনত। কিন্তু যেমন আগে বলেছি, পঞ্চাশের শেষ এবং ষাটের দশকের গোড়ার দিকে এইসব জারিগানগুলো পদ এবং কাহিনি বিন্যাসের ক্ষেত্রে কুৎসিতভাবে পরিবর্তন ঘটিয়ে মোল্লা-মুসল্লিরা এর অসাম্প্রদায়িক চরিত্রটিকে নষ্ট করে দেয়। এখানে দুয়েকটা সেরকম প্রচেষ্টার উদাহরণ দেব।
…কেহ বলে বাদশাজাদা
বলি কিছু তবে,
আরব্য শহরে একটি
জোবান পয়দা হবে।
সেই জোবান পয়দা হবে
দুরন্ত জোবান,
কলেমা ফড়ায়ে হিন্দু
করিবে মুসলমান।
দেওড়া বাইঙ্গ্যা দূর করবে
শিব ও দুর্গা কালী,
আহ্নিক পূজা ত্যাগ
আর নর বলি।
খাসি কোরবানি কইরবে
গাই করিবে জোবে,
জাত আবরু মাইরা সবের
ইজ্জত উমরাত নিবে।
হজরত মুহাম্মদ আল্লাহতায়ালার দোস্ত। পৃথিবী সৃষ্টি করার পর আল্লাহ দেখলেন কেউই মুখে আল্লাহ-রসুল উচ্চারণ করে না। এমনকি আদমও না। তারা—
না ফড়ে নবির কলেমা
না ফড়ে কোরান,
ভূত পূজা আহ্নিক যত
করে হিন্দুস্থান।
তখন আল্লাহ তাঁর দোস্তকে ডেকে বললেন-
আল্লা বলে দোস্তো তুমি
দুনিয়াতে যাও,
দশ দুনিয়ার মইদ্যে দোতো
পয়দা যাইয়া হও।
সব কাফের মারো জব্দো করো
তোড়ে হিন্দুয়ানি,
গরে গরে শুনাও দোতো
কলেমার ধ্বনি।
জারিটি মূলত খুবই সুন্দর বিন্যাসে রচিত ছিল। কিন্তু উপরিউক্ত কথাগুলো উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তার মধ্যে যে ঢোকানো হয়েছে, তার প্রমাণ গোটা জারিটি শুনলে বা পড়লে ধরা যায়। এসব জারিগান আমরা ছোটবেলায় যখন শুনেছি, তখন এই প্রক্ষিপ্ত পদগুলি গাইতে শুনিনি। পরবর্তীকালে ঢাকা বাংলা একাডেমির উদ্যোগে যখন এইসব গান জেলাওয়ারি সংগৃহীত হয়ে বই হিসেবে বের হয়, তখন দেখেছি কীভাবে সাধারণ মানুষের নিজস্ব সাংস্কৃতিকজগতে হানাদারি হয়েছে। নচেৎ যে গানের শুরুতে লোকায়ত দেবী বিপদনাশিনীর বন্দনা করে গাওয়া হয়-
মা গো দোরি পদে বিপদনাশিনী
এ্যা গো মা মা
দোরি পদে বিপদনাশিনী।
…………………………..
আমি পইড়াছি মা ভবসাগরে
পইড়াছি মা ভবসাগরে,
যা করো মা এইবার
কালের ভয়ে কাঁপে কলেবর
দিবস রজনি।—
সেই জারিতে কী করে হিন্দুয়ানি খতম করার, শিব, দুর্গা, কালী ইত্যাদি মূর্তি ভাঙার কথা থাকে?
মনে আছে একটা সময়ে বাংলা ভাষা এবং সাহিত্যকে হিন্দুয়ানিমুক্ত করার জন্য এক ব্যাপক প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিল। তখন নজরুলও রেহাই পাননি। তাঁর বিখ্যাত সেই ‘চল চল চল’ গানটির
নবজীবনের গাহিয়া গান
সজীব করিব মহাশ্মশান
–কলিটির ‘মহাশ্মশান’ পরিবর্তিত হয়ে হলো ‘গোরস্তান’। কারণ মহাশ্মশান হিন্দু শব্দবন্ধ, ওটি চলতে পারে না। কারবালার জারিগানে ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি বন্দনায় গাওয়া হচ্ছে—
দক্ষিণে বন্দনা করি দক্ষিণার সাগর
সেইখানে সদাগরি করতায় চান্দোসদাগর।
একাডেমির পুস্তকে সংগৃহীত জারিতে দেখি ‘চান্দোসদাগর’ বাদ দিয়ে ‘আরবি সদাগর’ করা হয়েছে। জারি-গায়ক, যাঁদের বয়াতি বলা হয়, তাঁরা বন্দনাগানে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের দেবদেবী, আল্লাহ, পয়গম্বর সবারই মহিমা কীর্তন করতেন। এই ধারাটি একটি প্রাচীন পরম্পরা। জারিগান ছাড়াও পূর্ববঙ্গ-গীতিকায় সর্বত্রই এই ধারা সুলতানি আমল থেকেই প্রচলিত। যেমন পির বাতাসির মুসলমান গায়েন, তাঁর গুরু জিন্দাগাজির কাছে বর প্রার্থনাকালে ‘মক্কা মদিনা বন্দুলাম কাশী গয়াথান’ ইত্যাদি গীতে হিন্দু তীর্থস্থানগুলোকে সম্মান জানাচ্ছেন, তেমনি নেজাম ডাকাইতের গীতিকার মুসলমান কবি সমস্ত লোকায়ত দেবদেবীদের প্রণাম করে গীতি আরম্ভ করেছেন এবং উপসংহারে গাইছেন ‘সীতা শন্তি (সতী) মাকে মানি, রঘুনাথ গোঁসাই।’ চৌধুরীর লড়াই গীতিকায় মুসলমান গায়েন পশ্চিমে মক্কার উদ্দেশ্যে প্রণাম জানিয়ে ‘জগন্নাথ দেউ’ সম্বন্ধে বলছেন—
বন্দি ঠাকুর জগন্নাথ
ভেদ নাই বিচার নাই বাজারে বিকায় ভাত।
চণ্ডালে রাঁধে ভাত ব্রাহ্মণেতে খায়।
এমন সুধন্য দেশ জাত নাহি যায়।
ভাত লইয়া তারা মুণ্ডে মোছে হাত
সে কারণে রাইখাছে নাম ঠাকুর জগন্নাথ।
আর একজন মুসলমান কবি লিখেছেন—
হিন্দু আর মুসলমান
একই পিণ্ডের দড়ি
কেউ বলে আল্লা-রসুল
কেউ বলে হরি।
বাংলাদেশে হিন্দু আর মুসলমানে যেরকম মেশামেশি হয়েছিল, ভারতবর্ষের আর কোথাও বোধহয় তেমনটি হয়নি। পল্লিগীতিকায় এর ভূরি ভূরি দৃষ্টান্ত আছে। সেই সমৃদ্ধ সংস্কৃতিকে, লোকায়ত স্তরে কলুষিত করেছে যারা, তারা আর যা-ই হোক বাঙালির সহৃদ নয়। উপরিউক্ত কথাগুলো বর্তমান আলেখ্যের মুখ্য আলোচনার চিষয় নয়। তথাপি উল্লেখ করলাম এ কারণে যে, আমাদের স্কুলজীবনে আমরা এইসব অনাচার ঘটতে দেখেছি, যা ক্রমশ তাবৎ লোকায়ত সংস্কৃতি তথা উভয় সম্প্রদায়ের আত্মিক সম্পর্ককে বিষাক্ত করে বাঙালির সর্বনাশ করেছে।