ছত্রিশ
টেস্টের ফল খারাপ হলো না। প্রথম না দ্বিতীয় স্থান পেয়েছিলাম, সে কথা আজ আর মনে নেই। তবে ফল আশানুরূপই হয়েছিল। আশানুরূপ বলছি এ কারণে যে, আমি বাল্যাবধি কখনো কখনো বড় আশা করতে সাহসী ছিলাম না। অতি বাল্যকাল থেকে অসম্ভব দুঃখ দারিদ্র্য এবং তজ্জনিত সংগ্রাম/সংঘাত আমাকে এমন এক দীন/অকিঞ্চিৎকর মানসিকতার অধিকারী করেছিল যে, আমি কোনো দিনই এক দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়ের মানুষ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হইনি। সংগ্রাম মানুষকে সাধারণত দৃঢ়, আত্মবিশ্বাসী এবং কঠোর বাস্তববাদী করে গড়ে তোলে। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে ঘটনাটি কখনোই তেমন হয়নি। আমি গড়ে উঠেছিলাম এমন এক বিরুদ্ধ-প্রকৃতি নিয়ে, যেখানে মানুষ ক্রমশ নিজের আত্মবিশ্বাস, সংগ্রামের অহংকার, দৃঢ়সংকল্পতা ইত্যাদি স্বাভাবিক অর্জনগুলো হারিয়ে ফেলে। এ এক বিপরীত নির্মাণ, যেখানে সে নিজেকে শুধু অন্যের করুণা, কৃপা, দায় ইত্যাদির ওপরই নির্ভরশীল ভাবে। সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত অধিকারের অহংকার বা স্পর্ধা নিয়ে মাথা উঁচু করে সমাজে দাঁড়াতে পারে না। দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকতার আধিকারিকেরা এই মানসিকতার মর্ম সম্যক বুঝবেন। এরা সবসময় জীবনসংগ্রাম অব্যাহত রেখেও নিজেদের সবার ‘আভারি’ বলে গণ্য করে। যেন— তোমাদেরই দয়ায় বেঁচে আছি হে, তোমরা করুণা করো।
সে যা হোক, টেস্টের ফল দেখে মাস্টারমশাইয়ের খুব উৎসাহ প্রদান করলেন। যে কোনো প্রয়োজনে তাঁদের সাহায্যের আশ্বাসও দিলেন। সেসব দিনে প্রাইভেট পড়ার বিশেষ চল ছিল না। শহজ-গঞ্জে যতটুকু ছিল, গ্রাম-গাঁয়ে তা-ও নয়। তবে শিক্ষকদের দরজা সবার জন্য সর্বদা খোলাই থাকত। জিজ্ঞাসুদের সহায়তা পাবার অসুবিধে তেমন ছিল না।
আমার প্রপালক-শিক্ষকমশাইয়ের কাছে আর কয়েকটা দিন কাটিয়ে কিছু বিশেষ বিশেষ বিষয় জেনেবুঝে নিলাম। তারপর তাঁর অনুমতিও নিয়ে বাড়ি চলে এলাম। কিছু পুরনো বইপত্র সংগ্রহ করে নিয়েছিলাম তাই অধ্যয়নে অসুবিধের কারণ থাকল না। অসুবিধের কারণ ছিল শুধু অঙ্কে। টেস্টে অঙ্কে তিরিশ না বত্রিশ মতো পেয়েছিলাম। টুনুর (সহপাঠিনী) অঙ্কে বিলক্ষণ মাথা—আমার নিদারুণ দৈন্য। তার সঙ্গে আমার তীব্র প্রতিযোগিতার সম্পর্ক। এতদিন যেমন-তেমন চলছিল, কিন্তু এবার তো বোর্ডের পরীক্ষা। অতএব এক ভয়ানক দুশ্চিন্তা মাথায় চেপে বসল। অন্য বিষয় নিয়ে ভাবিত ছিলাম না। ইংরেজি, বাংলা, ইতিহাস, ভূগোল এবং সংস্কৃতে আমার নম্বর ভালোই থাকত। অঙ্কই একটা বিশেষ সমস্যা হয়ে দাঁড়াল। অন্তত ষাট নম্বরও যদি না পাই তো লজ্জায় মরে যাব। আমার আগের স্কুলের সেই ব্রাহ্মণ মাস্টারমশাইকে একদিন এই সমস্যার কথা জানালাম। তিনি বললেন, পরীক্ষার তো এখনও তিনমাস বাকি। আমি কয়েকটা নিয়ম তোকে দেখিয়ে দিচ্ছি। রোজ দুপুরে দুঘণ্টা করে অভ্যেস করে যা, দেখবি ভয়ের কিছু নেই। অঙ্ক ব্যাপারটা কৌশল মাত্র। তাঁর সাহায্য নিয়ে এবং ক্রমাগত অভ্যেস করে দিন পনেরো-কুড়ির মধ্যে দেখলাম বেশ কিছু নিয়ম আমার আয়ত্ত হয়েছে এবং মনে বেশ আত্মবিশ্বাস বোধ করতে লাগলাম।
ইংরেজি এবং বাংলা, ক্লাসের অনেকের চাইতেই আমি শুদ্ধ লিখতাম। তবে ইংরেজিতে কথা বলতে গেলে জড়তা কাটাতে পারতাম না। আমাদের মাস্টারমশাইরা ভাষার ব্যাকরণগত শুদ্ধতার প্রতিই মনোযোগ দিতেন এবং তাতেই সন্তুষ্ট থাকতেন। ভাষার প্রসাদগুণ বা সাহিত্যিক সৌকর্য কীভাবে রচনায় আসতে পারে, তা নিয়ে মাথা ঘামাতেন না। তাঁরা ভাষার (কী ইংরেজি, কী বাংলা) বিবর্তনগত অগ্রগতি বিষয়ে খুব একটা ওয়াকিবহালও ছিলেন না। নিজেরাও গতানুগতিক পন্থায়ই চলতেন। উচ্চারণের শুদ্ধতা, শব্দচয়নের দক্ষতা অথবা ভাবগভী বাক্য নির্মাণের জন্য কেউই বিশেষ যত্নশীল ছিলেন না। ফলত ব্যাকরণগত শুদ্ধতাই ছিল একমাত্র মাপকাঠি, যার নিরিখে তাঁরা বলতেন—অমুক ভালো ইংরেজি বা বাংলা লেখে। বরিশালে এ নিয়ে একটি মজার গল্প আছে। ইংরেজ শাসন আমলের কোনো একটা সময়ে সদর শহরে একজন সদ্যাগত বিলিতি হাকিম নাকি তাঁর অফিসের ব্যানার্জি, মুখার্জি নামধারী বাবুদের বাক্যালাপ এবং লেখাপত্র দেখে খুব সংকটে পড়েছিলেন। তিনি তাঁর পূর্বসূরি অর্থাৎ যাঁর স্থলে তিনি দায়িত্বভার গ্রহণ করার জন্য এসেছিলেন, তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে, এই বাবুরা যে ভাষা ব্যবহার করেন তা কী ভাষা। তাঁর বোধহয় ভ্রম হয়েছিল যে, এটা ইংরেজি ভাষার কোনো উপভাষা কি না। পূর্বসূরি অভিজ্ঞের হাসি হেসে তাঁকে বললেন যে, এটা dialect নয়। প্রকৃতই ইংরেজি ভাষা। নবাগত হাকিম এ কথা শুনে যখন প্রায় ‘দশায়’ পড়ছেন তখন পূর্বসূরি সহাস্যে তাঁকে বলেছিলেন, ‘বৎস, তোমার বিচলিত হইবার কোনো হেতু নাই। বুঝিবারও না। What one Benerjee writes another Mukherjee understands আমাদের কাজ চলিয়া যাইতেছে। ইহাই যথেষ্ট জানিবা। আমরা কেহই এই ভাষা সঙ্গে করিয়া হোমে লইয়া যাইতেছি না। তুমি নিশ্চিত থাকিতে পারো।’ যা হোক, এসব কথা প্রায় চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বছর আগেকার। শুধু বরিশালই নয়, গোটা উপমহাদেশের সাধারণ শিক্ষক, ছাত্র তথা কর্মচারীরা এরকম ইংরেজিতেই অভ্যস্ত ছিলেন। এখন আধুনিক বিশ্ব জানে যে, এই উপমহাদেশীয় ইংরেজি সাহিত্যই সর্বত্র বাজার মাত করছে। আমিও সেইরকম ইংরেজিই লিখতাম এবং তা অনাদৃতও হয়নি। এ তো গেল ইংরেজির কথা। বাংলা মাতৃভাষা। তদুপরি ছোটবেলায় স্কুলে দেয়ার ব্যাপারে গার্জেনদের অনাসক্তি থাকায় এবং পরীক্ষা নামক হ্যাপা সামলাতে হয়নি বলে, বাড়ি বসেই অনেক প্রাচীন বাংলা সাহিত্য অধ্যয়ন করেছিলাম। বাড়িতে প্রাচীন সাহিত্য, পুরাণ ইত্যাদি এবং একদার বিভিন্ন বিখ্যাত পত্র-পত্রিকার বাঁধানো বহু গ্রন্থ ছিল। স্কুলে যেতে না পারার খেদে সেসব বুঝে না-বুঝে গোগ্রাসে গিলতে পেরেছিলাম। তার মধ্যে একটা বড় সংখ্যা ছিল নাটকের। আজও তার অনেক নাম মনে পড়ে। ক্ষীরোদ বিদ্যাবিনোদের নাট্যকাব্য আলিবাবা এবং জনা ইত্যাদি গিরিশ ঘোষের নানান নাটক এবং নাট্যকাব্য তথা অনুবাদ-নাটক খুব পড়েছিলাম তখন। গল্প-উপন্যাসের তো কথাই নেই। এসব কারণে বাংলা ভাষার ওপর আমার কিছু স্বাধিকার জন্মেছিল, যদিও তার ঢং প্রাচীন। আজও বাংলা বানানের প্রাচীন রীতি আমি পরিত্যাগ করতে পারিনি। আমার স্মৃতিশক্তি সেইসব দিনে খুব খারাপ ছিল না। ইতিহাসের একটি স্তাবক একবার পড়ে হুবহু বলে যেতে পারতাম। ফলে ইতিহাস, ভূগোল বা অনুরূপ অন্যান্য বিষয়গুলো নিয়ে আমি চিন্তিত ছিলাম না। ভীতি ছিল শুধু অঙ্কে, যে কথা প্রথমেই বলেছি। বেশির ভাগ ছাত্রছাত্রী এগ্রিগেটের নম্বর তুলত সাধারণত অঙ্ক, ইতিহাস, ভূগোল ইত্যাদির সাহায্যে। উর্দু, আরবি বা সংস্কৃত কখনো এ ব্যাপারে সহায়ক হতো। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে নম্বর তোলার বিষ্য দাঁড়িয়েছিল বাংলা, ইংরেজি, সংস্কৃত এবং ইতিহাস। ভূগোল বা অন্য বিজ্ঞানের বিষয়ে আমার একেবারেই আকর্ষণ ছিল না।
অপ্রাসঙ্গিক হলেও এখানে সংস্কৃত বিষয় কিছু স্মৃতিচারণ না করে পারছি না। যদিও আজ সংস্কৃত আমাকে পরিত্যাগই করেছে, কিন্তু ওইসব দিনে এই ভাষাটির প্রতি আমার প্রগাঢ় প্রেম ছিল। তবে আমার প্রপালক-অধ্যাপকের অভীপ্সা অনুযায়ী আমি যথেষ্ট পরিশ্রমী ছিলাম না বলে প্রকৃতভাবে এই ভাষা এবং সাহিত্যে আমি কিছুমাত্র অগ্রসর হতে পারিনি। তিনি আমাকে সংস্কৃত শিক্ষা দেবার জন্য চেষ্টার ত্রুটি করেননি। আমারও ভাষাটি বড়ই মধুর বোধ হতো। কিন্তু ব্যাকরণের কাঁটাতার ছিঁড়ে এগোনো বড়ই কঠিন ছিল। অধ্যাপক বলতেন, যদি একটু ধৈর্য ধরে এগোতে পারো, দেখবে কত মজা। না, আমি ধৈর্য ধরে এগোতে পারিনি। তারপর একসময় পরীক্ষা এসে গেল। আর উপায় থাকল না। তথাপি অধ্যাপক বলেছিলেন, অন্তত একটু কাব্য-নাটকগুলো পড়ে দেখো এবং বোঝার চেষ্টা করো। সেই সুবাদে কিছু কাব্য এবং নাটকের সঙ্গে পরিচিতি লাভ হয়েছিল। এ কারণে আজও গর্ব করি। মনে হয়, যারা সংস্কৃত নাটক বা কাব্য কিছুমাত্র অধ্যয়ন করেনি, তারা রসসাহিত্য বিষয়ে অনেক কিছুই জানতে বা অনুভব করতে পারল না। তারা প্রকৃতই মন্দভাগ্য। আমার গর্ব বা গৌরব এই যে, আমি যত সামান্য অধ্যয়নই এ বিষয়ে করি না কেন, আমার গুরু একজন প্রকৃত রসবেত্তা ছিলেন এবং তাঁর কাছ থেকেই এইসব রসের মাহাত্ম্য উপভোগ করার শিক্ষা আমি পেয়েছি। এ কথাও বলব যে, আমার এতাবৎকালের যাপিত জীবনে সেই রসাস্বাদন প্রায় এক অনৈসর্গিক প্রচ্ছায়া প্রদান করে চলেছে।
উজ্জয়িনীর কবির সেই মেঘ আমার পিছারার খালের আকাশে সেদিন যে স্নিগ্ধছায়া নিয়ে উপস্থিত হয়েছিল, আজও তার সেই মেদুরতা আমাকে পরিত্যাগ করেনি। এই প্রায় বৃদ্ধকালেও তাই নববর্ষাগমে অধ্যাপকের শ্লোকোচ্চারণ আমার কণ্ঠ থেকে নির্গত হয়ে মেঘকে যেন আরও রমণীয় এবং উপভোগ্য করে তোলে—
‘জাতং বংশে ভুবনবিদিতে পুষ্করাবর্তকানাং—’
যদিও আকাশের এই মেঘ আদৌ পুষ্করাবর্ত মেঘ নয়। সে এক নিতান্ত ছোটলোক নিম্নচাপীয় ঘনঘটা, তথাপি এই শ্লোকের মাহাত্ম্যে তা আর বিচারে থাকে না। আর স্মৃতির রসায়নে অধ্যাপকের মুখখানি উজ্জয়িনীর কবির মুখের সঙ্গে একাকার হয়ে যায়।