বিষাদবৃক্ষ – ২১

একুশ

আবার আমাকে একটু পেছনের বার্তা বলতে হবে। আসলে এরকম রচনার খেই রাখা আমার মতো বেহিসেবি মানুষের পক্ষে সম্ভব হয় না। তাই লেখাতে বিষয় বড় খাপছাড়া হয়ে যায়। আমার বন্ধু এবং সহপাঠী দুলালের বাড়িটা আমাদের ওই স্কুলের একেবারেই কাছে ছিল। একটা কাঠের সাঁকো পার হয়ে ওপারে গেলেই ওদের চৌহদ্দি। ওরা তখন ওখানে বেশ অবস্থাপন্ন পরিবার। সাঁকো থেকে নামলেই ওদের বেশ বড় একটা বৈঠকখানা ঘর। সেখানেই ইউনিয়ন কাউন্সিলের অফিস। দুলালের চাচা সৈজদ্দি শিকদার কাউন্সিলের চেয়ারম্যান। আগে বলা হতো ইউনিয়ন বোর্ড। আইয়ুব খান সাহেব ক্ষমতা দখলের পর বুনিয়াদি গণতন্ত্র চালু করলে সবগুলো বোর্ডের নাম কাউন্সিল এবং প্রেসিডেন্টদের পদবি চেয়ারম্যান হয়। বোধহয় খান সাহেব দেখে একজনের বেশি প্রেসিডেন্ট রাখা উচিত মনে করেননি। সৈজদ্দি চাচা চেয়ারম্যান হলেও আসল চাবিকাঠি ছিল আমার সেই জ্যাঠামশাইয়ের হাতেই। তালুকদারির ক্ষমতা চলে গেলেও এই গ্রামীণ রাজনৈতিক ক্ষমতাটি তিনি কোনো দিনই হাতছাড়া করেননি, যদিও নিজে কখনোই পদাধিকারে থাকেননি।

শুনেছি এবং কিছুটা দেখেওছি যে, ওই মাতব্বরি করার ক্ষমতাটির জন্য তিনি দীর্ঘ চৌদ্দ বছর মামলা লড়েছিলেন একজন মুসলমান তালুকদারের সঙ্গে। তাঁর নাম ছিল কুট্টি খান। খুবই সম্ভ্রান্ত পরিবারের লোক ছিলেন তিনি। আমার বাবার সঙ্গে তাঁর বিশেষ বন্ধুত্ব ছিল। কিন্তু ইউনিয়ন বোর্ড নিয়ে রেষারেষিতে তিনি আর জ্যাঠামশাই ছিলেন পরস্পরের জান কা দুশমন। নিষ্পত্তি হওয়ার আগেই কুট্টি খান সাহেব ইন্তেকাল ফরমালে জ্যাঠামশাই আখেরি লড়াই জিতে গিয়ে আজ একে কাল তাকে প্রেসিডেন্ট করে কাজ চালাচ্ছিলেন। বর্তমানে সৈজদ্দি চাচা চেয়ারম্যান। ইউনিয়নের কাজকর্ম বলতে যা হতো, তার ব্যাপক বর্ণনা দেবার দরকার নেই। কাজের মধ্যে ছিল শুধু দুর্ভিক্ষ বা দুর্যোগের সময় যে যৎসামান্য রিলিফের সামগ্রী আসত, তা নিয়ে ধান্দবাজি করা।

সৈজদ্দি চাচার চেয়ারম্যান থাকার সময় জ্যাঠামশাই আমাদের ওই স্কুলে কিছুদিন হেডমাস্টারি করছিলেন। তখন প্রবল ফৌজি শাসনের সময়। সবে ক্ষমতায় এসেছেন তাঁরা। দেশ থেকে দুর্নীতি এবং অরাজকতা তথা সরকারি অর্থের নয়ছয় হওয়া বন্ধ করতে ফৌজিরা যত্রতত্র হানা দিচ্ছে। হিসেবপত্তর দেখছে। গরমিল বোধ হলে দনাদ্দন পেটাচ্ছে বা কোর্ট মার্শাল করে জেলে ঢুকিয়ে দিচ্ছে আমাদের ওখানে গঞ্জ থেকে গাঁ অবধি সর্বত্র তখন এক কম্পমান অবস্থা। আজ এ কোম্পানিতে ছাপামারি হচ্ছে তো কাল অমুক ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যানকে কান ধরে ওঠবস করাচ্ছে। সে এক দেখার মতো কাণ্ড। কিছু মানুষ ভাবতে শুরু করল, এবার দেশের নিশ্চয় উন্নতি হবে। কেননা তাদের বিশ্বাস মিলিটারিরা কখনো আমলাদের মতো অসৎ হয় না। তারা যা করবে দেশের স্বার্থেই করবে। যেহেতু দেশে এই প্রথম সামরিক শাসন, তাই গ্রামীণ সাধারণ মানুষ পদস্থ লোকদের নাকানি চোবানি খাওয়া দেখে খুবই আহ্লাদিত হয়েছিল। সামরিক শাসন আসলে যে কী বস্তু, তা বুঝতে তাদের বেশ কিছুকাল সময় লেগেছিল, শহরের মানুষদের কথা বলতে পারব না, কেননা সেসব খবর পিছারার খালের মাঠপ্রান্তরে খুব কমই পাওয়া যেত সেসব দিনে। এ শুধু আমার অঞ্চলের কথা।

এরকম সময় একদিন স্কুলে গিয়ে দেখি একদল ফৌজি এসেছে। তারা ইউনিয়ন কাউন্সিলের অফিসে বসে হিসেবপত্তর দেখছে। আশপাশে গাঁয়ের লোকেদের ভিড়। তারা সবাই তটস্থ। বেশির ভাগ মানুষই এই প্রথম ফৌজিদের কাছাকাছি থেকে দেখছে। ফর্সা লাল লাল চেহারার জোয়ান সব। পরনে জলপাইরঙের উর্দি, কাঁধে অদ্ভুত ধরনের রাইফেল, গাঁক গাঁক করে উর্দুতে কথা বলছে, সে এক কাণ্ড। স্বয়ং চেয়ারম্যান সাহেব ঘরের এক কোনে দাঁড়িয়ে দুই হাঁটুর কম্পনজনিত তাল বাজাচ্ছেন।

ক্লাসের ছেলেরা সবাই আমাকে বলতে লাগল, আইজ তোর জ্যাডার শ্যাষ। অনেক অপকিত্তি করছে। আইজ হ্যার ছাড়ন নাই। এয়ার নাম মিলিটারি হ। জ্যাঠামশাই যে নানাবিধ অপকিত্তির আধার, সে বিষয়ে আমার কিছুমাত্র সন্দেহ না থাকলেও, এদের বার্তালাপ আমার খুবই খারাপ লাগছিল। জ্যাঠামশাই তখন আমাদের হেডমাস্টার হলেও তিনি যে অন্য আরেকটি দূরবর্তী গ্রামের স্কুলেরও কর্ণধার একই সঙ্গে, সে তথ্য আমার জানা ছিল। কোথাও তিনি নিয়মিত কর্তব্য করতেন না, বা করা সম্ভবও ছিল না। এও তাঁর একটি অপকিত্তির নমুনা। আমাদের স্কুলে যেদিন আসতেন, স্কুল এবং কাউন্সিলের কাজ একসঙ্গে করে যেতেন। আবার কিছুদিন বেপাত্তা থাকতেন। এদিনটিতেও তাঁর আসার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না, যদিও হিসেবমতো আসার কথা ছিল তাঁর। ফলত সবচেয়ে মুসিবত হলো সৈজদ্দি চাচার। তিনি সাধারণ অল্পশিক্ষিত গ্রামীণ গেরস্ত মানুষ। জ্যাঠামশাই তাঁকে তালেগোলে চেয়ারম্যান করে বসিয়েছেন। বুনিয়াদি গণতন্ত্রের নিয়মমাফিক নির্বাচন তখনও হয়নি। তিনি শুধু প্রেসিডেন্ট থেকে চেয়ারম্যান নামটা পেয়েছেন। এখন ফৌজিরা যা ধুন্ধুমার লাগিয়ে দিয়েছে তাতে চাচার অবস্থা বড়ই লবেজান। চাচা না পারছেন এদের সামলাতে, না বুঝছেন এদের নির্দেশাবলি। উর্দুতে বাতচিত করছে ফৌজিরা, যার এক বর্ণও বোধগম্য হচ্ছে না কারও। গ্রামের অন্যান্য মুরুব্বি-মহাজনরা উপস্থিত আছেন বটে, তবে তাঁদের অবস্থাও তদনুরূপ। সে এক অনাছিষ্টি কাণ্ড। তারা বাংলা বোঝে না। এঁরা উর্দু বোঝেন না। একমাত্র হুজুর-স্যার অর্থাৎ মৌলবি সাহেব উর্দু আরবি জবানে পোক্ত, এমতো এক বিশ্বাসে তাঁকে ঠেলে দেয়া হলো দোভাষির কাজে। তিনি মানুষটি খুব শান্ত, উর্দু আরবিও যে তিনি কিছুই জানেন না, তাও নয়। তবে তাঁর একটাই অসুবিধে, তিনি নোয়াখালি জেলার মনুষ্য এবং চাকরিসূত্রে বরিশালের এই অজ গাঁয়ে এসে পড়েছেন। তাঁর বাংলা, উর্দু এবং আরবি তিনটি জবানই এক উচ্চারণের। ‘ফ’ এবং ‘হ’-এর ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা হেতু তাঁর উচ্চারিত শব্দাবলি কোনো পক্ষেরই বোধ্য হচ্ছিল না। আবার ‘রাষ্ট্রভাষা উর্দু চাই’-এর মতো এক ‘আনাডা’ দাবি রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমে তখনও থাকায় ফৌজিরা এক বর্ণও বাংলা শিক্ষা করা প্রয়োজন বোধ করেনি, আঞ্চলিক উপভাষা তো দূরস্থান।

এরকম এক প্রায় কেয়ামতি সংকট-সময়ে দেখা গেল প্রায় সাড়ে ছফুট লম্বা, রোদে পোড়া তামাটে বর্ণ এবং অত্যন্ত ছোট ছোট করে ছাঁটা কাঁচাপাকা চুল মাথায় একজন মনুষ্য আসছেন। তাঁর পরিধানে অত্যন্ত নোংরা প্রায় তেল চিটচিটে ধুতি এবং পাঞ্জাবি, হাতে একটি গলা-বেঁকানো লাঠি। পোশাকে খুব শৌখিন না হলেও জ্যাঠামশাই বরাবর খুবই ধোপদুরস্ত জামাকাপড় পরতেন। এরকম পোশাকে এবং তৎসহ একটি লাঠি হাতে তাঁকে আমি অন্তত কোনো দিন দেখিনি। তখনই বুঝলাম এটি তাঁর চিরাচরিত স্বভাবেরই প্রকাশ। আগে অনেকবারই তাঁর ঈদৃশ উদ্ভট আচরণের গল্পকথা আমার শোনা ছিল। নিজেকে অত্যন্ত দীনভাবে প্রতিপক্ষের সামনে হাজির করে একসময় স্বমূর্তি ধারণ করা তাঁর বরাবরের রণকৌশল। বলাবাহুল্য এইসব রণে তিনিই বরাবর জয়ী হতেন।

তিনি সাঁকো পেরিয়ে আসার সময় বন্ধুরা আবার আমায় বলল, দ্যাখ আইজ তোর জ্যাডার কী দশা হয়। কিন্তু আমি যথেষ্ট ভীত হলেও দেখলাম, জ্যাঠামশাইয়ের কিছুমাত্র দশা সেদিন হলো না। অবাক বিস্ময়ে দেখলাম, কীভাবে তিনি এই অবস্থার মোকাবিলা করলেন। স্মৃতি যতদূর সচল, মনে করতে পারছি যে ওই অফিসে ঢুকেই প্রথমে তিনি সৈজদ্দি চাচাকে খুঁজলেন। অতগুলো হুমদো হুমদো ফৌজিদের তিনি যেন আমলই দিলেন না। চাচা জ্যাঠামশাইয়ের আগমনে খানিক সাহস পেয়ে থাকবেন। তিনি কাছে এসে দাঁড়ালে জ্যাঠামশাই বললেন, সৈজদ্দি, তুমি ওহানে খাড়ইয়া আছ ক্যান? তোমার চেয়ার তো ওইডা। বলে মেজর সাহেব যে চেয়ারটায় উপবিষ্ট, সেটাকে ইঙ্গিত করলেন এবং পরিষ্কার উচ্চারণে তাঁকে বললেন, If you do not mind gentleman that chair is ment for the president, I mean the chairman of this council. Let me introduce him, Mr. Saijaddin Shikdar the duly elected chairman of our union council and I am his humble advisor, Mr. Sengupta. মেজর থতমত খেয়ে চেয়ারটি ছেড়ে দিলে জ্যাঠামশাই বললেন, সৈজদ্দি আর দুইডা চেয়ার বলো। চেয়ার এলে তাঁরা পাশাপাশি বসলেন সবাই। এবার জ্যাঠামশাই মেজরের পরিচয় জানতে চাইলেন এবং তৎসহ এই অফিস পরিদর্শনের জন্য তাঁর অধিকারপত্র। মেজর খুশিমনে তাঁর পরিচয় জানালেন, কিন্তু পরিদর্শনের কোনো অধিকারপত্র দিতে পারলেন না। বললেন যে, মার্শাল প্রেসিডেন্ট একটা জেনারেল সার্কুলার-এর মাধ্যমে সব মেজরদের এই অধিকার প্রদান করেছেন। জ্যাঠামশাই বললেন, It is good that his excelency has taken such a decision, but I dare say, it is irregular that you don’t have a copy of that circular at your disposal. Afterall this is your official visit. মেজর একটু তাজ্জব বনে গিয়ে ব্যাপারটা স্বীকার করে নিলেন এবং জানালেন যে, অত্যন্ত ব্যস্ততাবশত তিনি কপিটি আনেননি। জ্যাঠামশাই It’s all right, it’s all right, Never mind ইত্যাদি বললেও জানিয়ে দিলেন যে, সে ক্ষেত্রে মেজরের পরিদর্শনটা খানিকটা অসমাপ্ত রাখতে হবে। কারণ তিনি চান এরকম একটি মহান কার্যক্রমে যেন কোনো ত্রুটি না থাকে। Official decorum and sancitity of the union council must be maintained. তিনি মেজরকে কয়েক প্রস্থ ধন্যবাদ দিয়ে বললেন যে, শুধু ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টগুলো ছাড়া বাকি সবরকম বিষয় পরিদর্শনে কোনো অসুবিধে নেই, বরং ভালোই হলো যে এই সুবাদে মেজরের আরেকবার শুভাগমন এই কাউন্সিল অফিসে ঘটবে অচিরেই।

এইসব কথাবার্তা চলছে এমন সময় একটি অঘটন ঘটল। একজন ফৌজির ভাষা বুঝতে না পেরে জনৈক চৌকিদার একটু ইতস্তত আচরণ করছিল। ফৌজিটি এ কারণে বিরক্ত হয়ে তাকে একটি চড় মেরে বসল। জ্যাঠামশাই সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে মেজর সাহেবের কাছে জানতে চান—Do you approve of this type of impertinence of a subordinate? মেজর সাহেব ফৌজি মানুষ। জ্যাঠামশাইয়ের এ তাবৎ তালেবরিতে একটু বিগড়েই ছিলেন, এখন এরকম একটা স্পর্ধাসূচক প্রশ্নে ক্ষেপে গিয়ে পালটা প্রশ্ন করলেন : Who is the subordinate? He is a Lance Nayek. জ্যেষ্ঠতাত তীব্র ব্যঙ্গে প্রত্যুত্তর করলেন, Sorry, I thought a major is a major. But now I see that even a Lance Nayek has the right to defy his major and can exercise his own unjustified whimsicality. এবং মেজর বুঝলেন যে, তাঁর প্রতিপক্ষের বেশভূষা যা-ই হোক, তিনি সাতিশয় ধড়িবাজ। ফৌজি কানুনের ব্যাপার-স্যাপারও বিলক্ষণ তার মগজে আছে। একজন মেজরের সামনে যে সাধারণ একজন ল্যান্স নায়েক-এর এরকম আচরণ ফৌজি কানুনসম্মত নয়, আর তা যে মেজরেরই অসম্মান, জ্যাঠামশাই অত্যন্ত সরলভাবে তাঁকে তা বুঝিয়ে দিলেন। মেজর বুঝলেনও কিন্তু জ্যাঠামশাইয়ের পরবর্তী প্রস্তাবটি মানা তাঁর পক্ষে কিছু আপত্তিকর মনে হলো। তিনি চাইলেন, ল্যান্স নায়েকটি চৌকিদারের কাছে এই অপরাধের জন্য ক্ষমা চাইবে। এই নিয়ে চাপান-উতোর এবং উত্তপ্ততা বাড়তে থাকে। মেজরের বক্তব্য যে, এইসব আদমিরা এক বর্ণ উর্দু বোঝে না, পাঞ্জাবি, সিন্ধিও বোঝে না। এদের নিয়ে কাজ করা খুবই ঝকমারি। জ্যাঠামশাইয়ের যুক্তি, একটা মাল্টিল্যাঙ্গুয়াল স্টেটের শাসকদের এমন কথা বলা উচিত নয়। তদুপরি বিগত ভাষা আন্দোলনের পর এই কয়েক বছরের মধ্যেই রাষ্ট্রভাষা বাংলা এবং উর্দু দুটোই হবে, এই নীতি সরকারিভাবে ঘোষিত হয়েছে। এক্ষণে মার্শাল প্রেসিডেন্টের শত্রুরা সব স্থানে ওত পেতে আছে তাঁর ত্রুটি ধরার জন্য। এসব ব্যাপার নিয়ে তারা নানান প্রচার চালাতে সুবিধে পাবে। বিশেষত, জেনারেল প্রেসিডেন্ট স্বয়ং বুনিয়াদি গণতন্ত্র বিষয়ে উদ্যোগী। ইউনিয়ন কাউন্সিল বুনিয়াদি গণতন্ত্রের সর্বনিম্ন ধাপ। সেখানে যদি শাসকরা এরকম আচরণ করেন তবে জেনারেল প্রেসিডেন্টের উদ্দেশ্য পণ্ড হবে। খুবই ধীরস্থিরভাবে এবং সুন্দর ভাষায় জ্যাঠামশাই এসব ব্যাপারের তাৎপর্য এবং কিতাবের ভাষার ব্যাখ্যা করে মেজরকে বোঝালেন। মেজরও তখন বাধ্য হয়ে ল্যান্স নায়েককে ডেকে ভর্ৎসনা করে বললেন যে, সাধারণ কর্মচারী বা সাধারণ কোনো মানুষের সঙ্গে আচার-আচরণে অতঃপর যেন কিছুমাত্র বাড়াবাড়ি করা না হয়। ল্যান্স নায়েক অনিচ্ছা সত্ত্বেও চৌকিদারের হাত ধরে ‘মাফি’ ‘কৈবাত নেহি’ বলে ব্যাপারটা মিটিয়ে নেয়। সেদিনের মতো মেজরের পরিদর্শন সেখানেই শেষ। হিসেবপত্রের বিষয়ে জ্যাঠামশাই মেজরকে ওয়াদা করলেন যে, সে বিষয়ে তিনি যথাস্থানে হিসেব দাখিল করবেন। তা ছাড়া তিনি ঠাট্টা করে মেজরকে এও বললেন যে, At least a major should not act as an ordinary accountant or a petty clerk. It does not befit him. He has much more responsibility to shoulder at this crucial hour of the country. মেজর জ্যাঠামশাইকে ‘শুকরিয়া’, ‘আলবিদা’ বলে ফৌজি স্পিড বোটে চাপলেন। ঘোর গর্জন করে বোট বড় খালের উদ্দেশ্যে ছুটল। তাঁরা সব ঢাকা যাবেন, প্রাদেশিক রাজধানীতে। সেখানে তাঁদের আসল রাজ্যপট। কিন্তু বুনিয়াদি গণতন্ত্রের বুনিয়াদের স্তরে জ্যাঠামশাইদের প্রবল প্রতাপ তখনও।

স্পিড বোটের শব্দ মিলিয়ে গেলে জ্যাঠামশাই ধীরে সুস্থে উঠে দাঁড়িয়ে চারদিকে একবার তাকালেন। গ্রামের সাধারণ মানুষ এবং মুরুব্বি-মহাজনেরা তখনও ভিড় করে সেখানে দাঁড়িয়ে। খুবই শান্তভাবে জ্যাঠামশাই তাঁদের বললেন, এবার আপনেরা বাড়ি যায়েন, আমিও উডি। সৈজদ্দি, কেরানিবাবুরে কও ফাইলপত্তর গুছগাছ করইয়া আলমারিতে উড়াইয়া রাহুক। কামকাজ এট্টু গুছাইয়া রাখতে অইবে। হিসাবডা যেন কাইল থিকাই ঠিক করইয়া রাহে। সবাই তখন অবাক বিস্ময়ে আমার জ্যেষ্ঠতাতের মহিমা দেখছিল। জ্যাঠামশাই চাচাকে আবার বললেন, সৈজদ্দি, ছোবল মারতে যদি না পারো, অন্তত ফোঁস করইও। এরা কিন্তু শক্তের ভক্ত, নরমের যোম। হ্যারা তোমার কথা কিছু বুজুক, না বুজুক তোমারে য্যামন তড়পাইবে, তুমি হেয়ার একশ গুণ বেশি তড়পাবা তোমার কেরানিবাবু, চকিদার আর দফাদারগো উপার। ওই রহম কোনায় খাড়ইয়া আডু বাজাবা না। এ্যারা কৈলম আসলেই কাচাখাউগ্যা। তয় আইজ চলি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *