দুই
মানুষের শিকড়বাকড় নিয়ে মানুষকে যেন খোঁজখবর করতেই হয়। পিছারার খালটিই যে আমার বা আমার মতো মানুষের শিকড়ে বরাবর জল সিঞ্চন করে গেছে সে কথা বুঝতে পারি যখন সেই স্রোতঃস্বিনীর স্মৃতি প্রতিনিয়ত আমাকে ধ্বস্ত করে চলে। পূর্বোক্ত সব বিচার সত্ত্বেও বড় খাল আর পিছারার খাল আর তার তীরস্থ দুই মহাবৃক্ষ—এরাই আমার স্মৃতির তাবৎ অনুকণাসহ এক অনিবার্য, সতত চৈতন্যময় এবং অসম্ভব মেদুরপ্রবাহ, যা আমাকে শয়নে, জাগরণে, স্বপ্নে অথবা বিশম্ভে কখনোই ত্যাগ করে না। পিছারার খাল আমাকে যেন ক্রমশ এক বড় খালে নিয়ে ফেলে এবং বড় খাল, অনেক নাকের জল, চোখের জল করে একসময় এক অনিবার্য নদীর রহস্যময়তায় আমাকে পৌঁছে দেয়। সেখানে, আমার তখনকার আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী এক স্বপ্নসম্ভব যান্ত্রিক জলযানের আসার কথা থাকে, যে আমাকে গর্ভস্থ করে যন্ত্রণাময় এই অভিশপ্ত বদ্ধতা থেকে মুক্ত করে নিয়ে যাবে এমন এক ভূখণ্ডে যেখানে আমার কোনোরকম অসম্মান থাকবে না। আমি একজন মুক্তপ্রাণ, সহজ মানুষ হব। কিন্তু সেই জলযান এলেও, তার গর্ভস্থ আমি ভূমিষ্ঠ হই অন্য এক অসম্মানের ঘাটে, যেখানে কোনো মানুষই কাউকে চেনে না। কিন্তু সে তো অনেক পরের কথা।
কিন্তু এই খালের মাহাত্ম্য এমন যে–সে না থাকলে, জোয়ারের জলের যে এক অসীম রহস্য আছে, হাজারো বার্তা আছে এবং তা যে আমাদের মতো অজ গ্রামীণ শিশুদের শরীর ও মনে এক জাদু আচ্ছন্নতার আবেশ সৃষ্টি করে তা জানার অন্য কোনো উপায় তখনকার মতন প্রায় আদিমজগতে থাকে না। এই খালেই তো সুদূর দক্ষিণ অঞ্চল থেকে, সুন্দরবনের গভীর অরণ্য থেকে, ঘাসি নৌকোয় নানান শস্যসম্ভার নিয়ে ওই সব মানুষ আসত, যাদের নাম রহমান সর্দার, ছমির্ধা, গগন বাঘমারা বা এরকম আরও কত অদ্ভুত সব মানুষ। তারা ভিন্ন পৃথিবীর। তারা অতি সহজ সরল আবার অতি ভয়ালও। পিছারার খালের সুবাদে তাদের সঙ্গে আমাদের পরিচয়। তারা যে কত সংবাদ আমাদের বলত, তার কি কিছু শেষ আছে? আমাদের ওই সবুজ গ্রহখণ্ডটিতে তখন বহির্জগতের খবর আদৌ বিশেষ পৌঁছত না। পোস্ট অফিস একটা ছিল বলে, কখনো কখনো সাত দিনের একটি বাসি সস্তা খবরের কাগজ হাতে আসত। তাতে তখন কোরিয়ার যুদ্ধ, হিটলারের শেষ তথ্য বা লিয়াকত আলি খানের বাতকর্ম বিষয়ক কিছু খবর থাকত। আমাদের বড় বৈঠকখানায় বাড়ির বড়বাবু দরাজকণ্ঠে তা পাঠ করে গ্রামের সব মানুষদের মোহিত করে দিতেন। তাঁরা মাঝে মাঝেই এসে বড়বাবুকে শুধোতেন, বাবু কাগজে ল্যাখছে কী? মেজাজ অনুযায়ী জবাব পেতেন তাঁরা। ল্যাখছে? ল্যাখছে খুব খারাপ। বেয়াকে সাবধান হও। খুব খারাপ দিন আইতে আছে।—এরকমভাবে কখনো তাঁদের সংবাদতৃষ্ণা মেটানো, মেজাজ ভালো থাকলে কিছু পড়ে শোনানো। ব্যস, জগতের সংবাদের সঙ্গে তোমার ইতি।
কোরিয়ার যুদ্ধ তখনও মেটেনি। মাঝে মাঝেই আকাশপথে শ্রেণিবদ্ধ মার্কিনি যুদ্ধবিমানগুলোকে পরিক্রমা করতে দেখতাম আমরা, বাড়ির খোলা ছাদের ওপর দাঁড়িয়ে। তারা সংবাদের আভাসই শুধু দিত, কোনো সঠিক বার্তা বলত না। বড়বাবু গাঁয়ের লোকেদের বার্তা দিতেন, ‘বোজলানি, অবস্থা খুব সঙ্গীন।’ এমত সময় একদিন বাসি কাগজের খবর, ‘জমিদারি প্রথা বিলুপ্তিকরণ আইন অচিরেই চালু হইতেছে।’ জনৈক মিঞাসাহেব এই খবরের নির্যাস নিয়ে বড়বাবুর দরবারে হাজির। তাঁর জিজ্ঞাসা, বড়বাবু বড়বাবু, খবরের কাগজে কয় কী?’ বড়বাবুর চটজলদি জবাব, ‘কয় তো খুব খারাপ।’
: হেয়া ক্যামন?
: কাগজে কয় পাকিস্তানে ‘দারি’ রাখা চলবে না।
: অ্যাঁ? অ্যাতো মেন্নত করইয়া পাকিস্তান হাসেল অইল আর মোরা দাড়ি রাখথে পারমু না?
এখন ‘দাড়ি’ আর ‘দারি’র উচ্চারণ পার্থক্য এ অঞ্চলে সম্ভব হয় না। বড়বাবু তাই খেলিয়ে যান—’না, দারি আর রাহন যাইবে না, এরহমই ল্যাখছে।’ মিঞা তখন দিশাহারা। তাঁর বক্তব্য,–’তয় এ পাকিস্তান লইয়া মোরা কী করমু?’ জ্যাঠামশাই বলেন, “হে কতা আমি কমু? জিগাও তোমাগো মুরুব্বিগো। আয়চ্ছা কও দেহি এই যে পাকিস্তান পাইলা হেথে তোমাগো কতহানি মুশকিল আসান অইলে? কদম, তুমিই কও, তুমি তো লিগের একজন মাতব্বর এহানে।
কদম মাথার জিন্নাটুপিটি খুলে খানিকক্ষণ টাক চুলকে নেয়। বলে, আজাদি তো পাইলাম। এহন কেরমে কেরমে হগ্গলই অইবে।
: অইবে?
: অইবে না ক্যান? এহন আমাগো পোলাপানেরা সরকারি চাকরি আশন পাইবে, ডাক্তার ইনজিয়ার অইবে। নাকি কয়েন?
বড়বাবু বলেন, শোনতে খারাপ শোনায় না, তয় যবে বিবি ডাঙ্গর অইবে, তবে মিঞায় গোড় লইবে, আমার হইছে হেই চিন্তা। যা অউক, তোমরা পাকিস্তান যহন পাইছ, ফাউকাও। তয়, আমি ভালো ঠেকি না।
মধ্যস্বত্বভোগীদের, বিশেষত আমাদের পরিবারের বা তার থেকে আরও ক্ষুদ্র ভগ্নাংশে যেসব মধ্যস্বত্বভোগী আছে তাদের সমূহ সংকট। তাদের মধ্যস্বত্বের খাজনার পরিমাণের ব্যাপারটা অঙ্কে আসে না। কিন্তু খাসজমির উপজ তাদের বাঁচিয়ে রাখে। পুরুষানুক্রমে অন্য কোনো আর্থিক ক্রম তাদের নেই। এই খাসজমি যদি তারা নিজেরা চাষ করত তবুও কথা ছিল। কিন্তু তা কী করে হবে? তারা যে জমিদার। জমিদার জমি চষে না। প্রজাপত্তনির প্রজারাই তা চষে। জমিদার ফসলের ভাগ পায়। এই ব্যবস্থার জন্য যখন প্রজাপত্তনি, মধ্যস্বত্ব যায়, তখন খাসজমিও যাবার রাস্তা ধরে। কেননা যে জমিদার বা তালুকদার খাজনারই আধিকারিক নয়, তার আবার খাসের ফসলের অধিকার কী? সে অধিকারও তার কাজে কাজেই যেন লোপ পায়। এ ক্ষেত্রে জনবল একটা নিয়ামক ব্যাপার এবং প্রজা না থাকলে তা সম্ভব হয় না।
যে মধ্যস্বত্বভোগীর বার্ষিক প্রজাপত্তনির আয় মাত্র হাজার বারোশ টাকা, সেও খাসজমি শাসন করত প্রায় দেড়শ থেকে দুশ বিঘা। ফলত, সেও কার্যত একটা তালুকদার। কিন্তু মধ্যস্বত্ববিলোপ আইনে সসেমিরা। এ কারণে এই আইন পাস হলে ধস নামে এইসব ছোট এবং মাঝারি মাপের মধ্যস্বত্বভোগীদের সমাজে। তাঁরা তো বড়দের মতো কোনো আগাম ব্যবস্থা রাখেনি। অথচ সম্বচ্ছরের কৃৎকরণ, ঠাট-বাট, তাদের অনুকরণেই জারি রেখেছে। দোল, দুগ্গোচ্ছব, মাতৃদায়, পিতৃদায়ে দীয়তাং ভুজ্যতাং-এর ব্যাপারটা যেমন আছে, তেমনই তাঁদের সংসারে পোষ্য আছে বিধবা পিসি, মাসি, বোন ভাদ্দর বউ এবং তাদের অনাথ পুষিপোনারা। তাদের পালন-পোষণের দায়, পিতৃঋণ এবং বিগত কর্তাদের ইদিক-সিদিকের বাবদ যে অসুমার হামুখ রয়েছে তা বন্ধ করার আয়োজন, তার উপায় কী হয়? তা রাষ্ট্রও দেখে না, সমাজও দেখে না। সমাজ তো তখন দেশভাগের কোঁতকা খেয়ে সূক্ষ্মশরীর ব্রহ্মস্বরূপ, আছেন কি নেই বোঝা দায়। কিন্তু কৃৎকর্ম না করলে তিনি বড় জাগ্রত হয়ে ধিক্কার দেন।
আবার এই আইনের বলে যে এ দেশীয় সামন্ততন্ত্র বিলুপ্ত হলো তাও নয়। তার খোলসটা শুধু পালটাল। ফলত মধ্যস্বত্বলোপী আইন সাধারণের আর্থিক আরোগ্যে যতটা না কার্যশীল হলো, একশ্রেণির এবং অবশ্যই এক বিশেষ সম্প্রদায়ের ক্লেশ বৃদ্ধি করে অনেক বেশি সমস্যার সৃষ্টি করল। সেই সমস্যা মোকাবিলার সামর্থ্য তো এইসব ছোট মাঝারি মাপের মধ্যস্বত্বভোগীদের ছিলই না, এখন গোটা দেশের সংখ্যালঘুদেরও তা বিপর্যন্ত করে ছাড়ল।