বিষাদবৃক্ষ – ১১

এগারো

পিসিমাবুড়ি, নগেনমশাইয়ের স্ত্রী, যাঁরা গ্রামসুদ্ধ বর্গবর্ণ নির্বিশেষের পিসিমা এবং জেঠিমা, তাঁরা যতদিন এখানে ছিলেন, পিছারার খালের বহতা ছিল বড় চমৎকার। আমার স্মৃতিতে এই সময়টি এখনও বড় আশ্লেষে আমাকে জড়ায়। যাঁরা যা-ই বলুন, এই সময়টিকে আমি ঠিক মধ্যযুগীয় অবস্থার তলানি বলে ভাবতে পারি না। আসলে, মানুষের সামাজিক ক্রমান্বয়কে আদি, মধ্য, অধুনা এ রকম বিভাগে ভাগ করে তার ভালোমন্দের বা অগ্রগতির তুল্যমূল্য করা আমার পছন্দ নয়। আমার শৈশবের এই সময়টিকে শুধু নস্টালজিক কারণে আমি ভালোবাসি, এ কথা যদি কেউ বলেন আমি বলব, তা ভুল। বস্তুত এ সময়ে আমি কোনো সামাজিক নৈরাজ্য অনুভব করতাম না। ওই পিসিমাবুড়ি বা জেঠিমারা সমাজটিকে তখনও নৈরাজ্যের হাতে ছেড়ে দেননি। তাঁদের নানা ব্রতকথা, নানা পার্বণ, লোকাচারি নানা ক্রিয়াকলাপ নিয়ে সমাজকে সদা উৎসবমুখর রাখতেন। নানান ব্রত, পার্বণ, পুজো ইত্যাদির শেষে পিসিমাবুড়ি আর জেঠিমারা সর্বশেষ এক আশার বাণী বলতেন—’এ বত্ত যে শোনে যে করে, অপুত্রার পুত্র হয়, নির্ধনের ধন হয়, অকুমারীর বিয়া হয়, যে যা কামনা করে সে কামনা সিদ্ধ অয়।’ এই আকাঙ্ক্ষার বাণীর মধ্যে নৈরাজ্য স্থান পেত না। আমরাও সরল বিশ্বাসে এসব গ্রহণ করে ভাবতাম, সবার সব ভালো হবে, সবার মঙ্গল হবে, কল্যাণ হবে। এর মধ্যে ছিল এক অদ্ভুত জীবনবোধ, যা নৈরাজ্যের হাহাকারে পীড়িত নয়। আমি একটু ব্যাপকতায় এই জীবনচর্যাকে বলব।

তখন আমার মতো বয়সিদের কৈশোর, শৈশবের নিষ্পাপতা অপসৃত হয়ে এক নতুন উদ্‌গম সবে শুরু হচ্ছে। পিসিমাবুড়ি এবং জেঠিমায়েরা হয়তো শেষবারের মতো ‘কাঁকড়ার বত্তের’ উপকরণ, ‘উদ্‌উয়া’ চাউলকলা, তালের বড়া ইত্যাদি নিয়ে পিছারার খালের পাশের কোনো এক শস্যক্ষেত্রে ব্রত উদ্‌্যাপনে যাচ্ছেন। তখন ভাদ্রমাস, আউশ পেকেছে, ‘আমন রোওয়া’। রোওয়া অর্থে বিছান থেকে গোছ করে যা চারা হিসেবে পোঁতা হয়েছে মাঠে। বিছান থেকে গোছ তোলার পর যেগুলো বিছানের মাঠে থাকে তারা মাইজলা ভাঙা, সেও ধানেরই খেত। এরকমই রোওয়া বা মাইজলা ভাঙার কোনো ক্ষেত্রের শস্যশাবকদের মাঝে খানিকটা জায়গা পরিষ্কার করে নিয়ে কাঁকড়ার ব্রতের স্থান হয়। পুরুত ঠাকুর কিছু মন্ত্রোচ্চারণে ক্ষেত্রপাল দেবের পুজো করলে পিসিমারা ব্রতকথাটি বলেন। তাদের ব্রতকথায় একটি সাধারণ আরম্ভনা ছিল, বরাবর দেখেছি। বাওন আর বাওনজি, মাগেন যাচেন খায়েন ইত্যাদি। এ ব্রতেও বাওন আর বাওনজির গল্প। কেমন করে তাঁরা তাঁদের সমুদয় দুঃখ, অভাব ইত্যাদি অতিক্রম করে বিপুল সম্পদ লাভ করলেন। কী করে তাঁদের ওলান শুকিয়ে যাওয়া গাই-মোষেদের থানে দুগ্ধসঞ্চার হলো, ফালডা দেয়া পুহইরে জলে মাছে কেলি করতে লাগল, অথবা গেরস্ত তার হেরে যাওয়া মামলায় জিতে গিয়ে জমিন জায়দাদ সব ফিরে পেয়ে শত্তুরের মাথায় পাও উড়াইয়া দিল—এইসব কথা তাঁরা ব্রতের শেষে ব্রতচারীদের উদ্দেশে বলে যেতেন। তারপর সেই আশা-আকাঙ্ক্ষার বাণী উচ্চারণ। এরপর আমরা ব্রতচারী পোলাপানেরা ভদউয়া ইত্যাদি সুভোজ্য প্রসাদপ্রাপ্ত হয়ে বুড়ির সঙ্গে গলা মিলিয়ে বলতাম, বলভাই কাখড়ার পিরতে হরি হরিবল। পিরতে অর্থে প্রীতে। একসময়, আবাদের শুরুয়াতে বোধহয়, এ স্থানে কাঁকড়া, কুমির এরা ধানের খুব ক্ষতি করত। তাই এই পূজা বা ব্রতের প্ৰচলন।

পিসিমাবুড়ি অথবা জেঠিমা, যতদূর মনে আছে, তাঁদের প্রতাপ যতদিন কার্যকরী ছিল, এইসব ব্রতপার্বণ তাঁরা ধরে রেখেছিলেন। গ্রামের সব মেয়ে-বউদের দিয়ে এইসব ব্রতপার্বণ, লোকাচারি অনুষ্ঠান তাঁরা করাতেন। সব অনুষ্ঠানগুলোতে ব্রাহ্মণদের যে অবশ্য করণীয় কৃত্য কিছু ছিল তা নয়। এইসব অনুষ্ঠানের হয়তো কোনো শাস্ত্রীয় মন্ত্রও ব্রাহ্মণদের নিত্যকর্ম পদ্ধতির গ্রন্থে ছিল না। কিন্তু বুড়িরা জানতেন ব্রাহ্মণ ছাড়া পূজা বিহিত নয়। বুড়িপিসিমা এবং জেঠি এ কারণে নগেনজ্যাঠার দরবারে হাজির হতেন। পিসিমাবুড়ি বলতেন, ও ভাইপো, ও ভাইপো, ঠাহুরে কয় কী?

: কী কয়?

: কয় বোলে কুমইর পূজা, কাখড়া পূজা এইসব পূজাআচ্ছার নাকি মোন্তর নাই। এয়া কি ঠিক? জ্যাঠা বলতেন, তোমরা যহন এ পূজাগুলো করইয়া আইতে আছ তহন তো এডা কোনো কতা অইতে পারে না। আসলে অরা মন্তর জানে না। অরা এট্টা আসল মোন্তরই শেহে নায়।

: হে মন্তরডা কী? এ কথা জানতে চান পুরোহিত হরিঠাকুর।

: ক্যান? সব্বোযজ্ঞেশ্বরো হরি। অর্থাৎ কিনা তুমি যে কামই করো হেয়া যজ্ঞ আর হেয়ার যজ্ঞেশ্বর স্বয়ং হরিই। এইডাই মোন্তর, বোজলা কি না?—এরপর হরিঠাকুর যদি না বোঝে, তবে সমূহ বিভ্রাট। কেননা, নগেনজ্যাঠা সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত। জ্যাঠা বলতেন, এই মোন্তরের লগে কইতে অইবে, তস্মিন তুষ্টে জগৎ তুষ্ট ইত্যাদি। বোঝলা? না বোঝলানা? হরিঠাকুর বলতেন, একছের বুঝছি। আহা কী কতা? সব্ব যজ্ঞেশ্বরো হরি। এ্যা কী কতা। আহা, তস্মিন তুষ্টে জগৎ তুষ্ট। এ্যা, আহা কী কতা!

অতএব পুরুত ঠাকুর মন্ত্র পড়তেন, ওঁ নমঃ কাখড়ায় নমঃ ওঁ নমঃ কুম্বীরায় নমঃ ওঁ নমঃ দক্ষিণরায়ায় নমঃ ইত্যাদি যে পূজার যা হয়, খানিকক্ষণ বিড়বিড় করে পরে খুব উদ্দাত্ত উচ্চারণে বলতেন,

ওঁ ব্রহ্মণ্যদেবায় গোব্রাক্ষণ হিতায় চ।
জগদ্ধিতায় কৃষ্ণায় গোবিন্দায় নমঃ নমঃ ॥
ওঁ পাপোহং পাপকর্মাহং পাপাত্মা পাপসম্ভব।
ত্রাহিমাং পুণ্ডরীকাক্ষ্যং
সর্ব যজ্ঞেশ্বরো হরি–

এ মন্ত্রের অনুস্বর-বিসর্গাদি যথাযথ প্রযুক্ত কি না জানি না। হরিঠাকুর যেমন উচ্চারণে বলতেন, তেমনটিই বলে দিলাম। শাস্ত্রজ্ঞ পাঠককুল অপরাধ নেবেন না। এ মন্ত্র পাঠের সঙ্গে সঙ্গে পিসিমাবুড়ি এবং জেঠিমারা বলতেন, বেয়াকে হোগাভুত অইয়া স্যাবা দেও। হাতের দুব্বা সামনে ফ্যালাও। আমাদের তথাকরণ অচিরাৎ, কেননা ভদউয়া ইত্যাদির সুঘ্রাণে আমাদের নোলা তখন প্রায় নির্লজ্জতার সীমান্তে এসে উপস্থিত হয়েছে।

পুরুতঠাকুর তথা এইসব অং বং ছাড়াও বুড়িদের আরও অনেক আচার-অনুষ্ঠান ছিল। একান্ত নিজস্ব ঢঙে বাড়িতে মেয়ে-বউদের নিয়ে বুড়িপিসিমাদের বিচিত্র ব্রতপার্বণের রকমারি জগৎ ছিল। সেখানে আপদনাশিনী, বিপদনাশিনী, আকুলাই, নিরাকুলাই, মঙ্গলচণ্ডী, গোকর্ণ এবং নাম ভুলে গেছি এরকম কত যে অনুষ্ঠান ছিল তার আর শেষ নেই। সারা বছর ধরেই আজ এটা, কাল ওটা, চলছে তো চলছেই। বুড়িপিসিমার সিংহ-পালঙ্কে এদের কেউ আশ্রয়ী হতে পারতেন না। কারণ, সেখানে আলাদা সব জাগ্রতরা স্থায়ী দখলদারি নিয়ে বর্তমান। এঁরাই মাঝে মাঝে তাঁকে ‘সপ্পনে’ দর্শন দিয়ে নানান সমস্যার সমাধান জানাতেন, আবার কখনো ভালোমন্দ খাওয়ার আবদার ধরতেন। ছোট ছোট লেপ-তোশকে আসীন থেকে জাগেশ নামধারী নুড়ি পাথরগুলো হরহামেশা বুড়িকে ‘সপ্পনে’ উত্যক্ত করত। কখনো তাদের ক্ষীর খেতে সাধ হতো। কখনো খিচুড়ি ভোগ, আবার কখনো ফলফলাদি। এঁদের কারওই সামান্য আয়োজনে মন ভরত না। এঁরা ছিলেন সব ভদ্রলোক ঠাকুর। পালঙ্ক থেকে নামার নামটি করতেন না কখনো। অন্যরা বাইরের। সবাই ‘কাঁচাখাউগ্যা’। তবে জাগেশদের সঙ্গে বুড়ির নাতিনাতনিদের একটা বিশেষ একাত্মতা ছিল মনে হয়। সেটা ভালোমন্দ খাবার সংক্রান্ত। জাগেশরা এ ক্ষেত্রে বোধহয় নিমিত্তমাত্র।

আপদনাশিনীর ব্রতটি বড় আকর্ষক ছিল আমাদের। এ ব্রতে চাল, কলা, মুগ, কলাই, নারকেল, গুড় ইত্যাদি প্রসাদের উপকরণ। তবে ভদউয়া নয়। কারণ এ ব্রতে ভাজাপোড়া কিছু চলবে না। দেবী নিতান্ত কাঁচাখাউগ্যা। আমিষ্য বা ভাজাপোড়া কিছু তাঁকে দেয়া যাবে না। এটাই আইশ্যা। ভদউয়া যদিও প্রসাদ হিসেবে আমাদের কাছে খুবই সুখাদ্য ছিল, কিন্তু যেহেতু তার প্রস্তুতপ্রণালি চালভাজা বা মৌলখা অর্থাৎ খইয়ের ভগ্নাংশ ভিজিয়ে গুড় কলা নারকোল সহযোগে, তাই তা ভাজাপোড়া।

একটি ঘট পেতে, সিন্দুরের পুত্তলিকা এঁকে তার ওপর আম বা কাঁঠাল শরাৎ (ত্রি বা পঞ্চ পত্র) দিয়ে বসানো হতো। পাশে ধূপদীপ পুষ্প ইত্যাদির সরঞ্জাম। সামনে ব্যাপক জায়গা জুড়ে পাথরের থালা তামার পরাত বা কাঠের বারকোষে প্রসাদ বা পেসাদ নামক ভোজ্যাবলি। আমরা লিঙ্গ নির্বিশেষে বুড়িপিসিমার আদেশমতো দূর্বা হাতে বত্তের কথা শুনতে বসে যেতাম। ব্রতকথাটি ছিল এক মজার রূপকথা। কথাটি বলতেন পিসিমাবুড়ি। তার বয়ানেই বলছি—

এক বাওন আর বাওনজি। বাওনজির নাম কিলিকিলি বাওনজি। হ্যারা মাগেন যাচেন খায়েন। ঘরে-বাইরে দুইজোন। পোলা নাই মাইয়া নাই। ল্যাঙ্গে ঠ্যাঙ্গে কেউ নাই। নিত্য তিরিশ দিন বেয়ান বেয়ান বাওন যায় মাগতে। যিদিন কিছু পায়, হিদিন খায়, যিদিন পায় না, হিদিন ফালডা দিয়া থাকে। দুই ঘড়ি জল খাইয়া মধ্য খাড়ালে চিত অইয়া থাহে, পোড়া চোক্ষে ঘুমও আয় না। ঘরের চালে ছোন নাই, বেড়ায় হোগল নাই। ঘর, বাইর সোমান। প্যাডের জ্বালা প্যাডে থাহে। চালের ফুডা দিয়া তারা নক্ষত্তর চান্দ উহি মারে। বাউনি কয়—বাওন মোগো বড় দুঃখ। বাওনা কয় বাউনি চান্দের গতি বাওদিগে। মনে অয় সুদিন আইতে বিলম্ব নাই। এইসব কথা-পইদ্য অইতে অইতে দুইজোনের চোক্ষে ঘুমের কাজল লাগল।

রাইত তহন কত কেডা জানে? ভুদভুদুম ভুদভুদুম করইয়া ডাহে। এই সোমায় ঝাপের উপার শব্দ অয়। বাউনি জিগায় কেডা? ঝাপ লাড়ো কেডা? উত্তর আয়—

—কিলিকিলি বাউনজি, ঝাপ খোলো।

–কেডা।

–ঝাপ খোলো, ডর নাই, মুই।

কিলিকিলি ঝাপ খোলে। দ্যাহে এউক্যা রাঙ্গা টুকটুকইয়া বউ। লাল পাইড়ের সাদা খোল শাড়ি পরা। মুহের ওপর চান্দের আলো পিছলাইয়া পড়ে য্যান। আর হেই জোছছোনায় দ্যাহা যায় দ্যাবচোক্ষু, জোড়া ভুরু, কপালের মধ্যহানে এটা বড় সিন্দুরের ফোডা ডগমগ করে। কিলিকিলি জিগায়, তুমি কেডা? হেনায় কয়েন, মুই বড় আপদে পড়ছি। মোরে আইজগার রাইতটুকু এট্টু থাকতে দেবা?

–হেয়া দিমুনা ক্যান? থাকপা, হেথে আফইত্য কী? কিন্তু তুমি কেডা?

–কাইল কমু হ্যানে। হুমু কোথায়?

–হোও যাইয়া হাইতনায়। মানা করছে কেডা?

তো হে মাগি যাইয়া হাইতনার পাশে একখান ছেড়া হোগলা পাতইয়া ফলি কাইত দিলে। কিলিকিলি আবার হ্যার জাগামতন চিত।

খানিক বাদে বাউনি শোনে বউডা কইতে আছে—কিলিকিলি বাওনজি মোর বড় বাইজ্য পাইছে, মুই হাগুম।

-–হাগ যাইয়া ছাইচে। তো হে মাতারি ছাইচে যাইয়া বাজ্য করইয়া আইলে। আবার এট্টু পরেই ওড়ে, কয়-

–কিলিকিলি বাওনজি আমি বাইজ্য করুম।

–কর যাইয়া খাড়ালে। তো হে মাগি ঘরের খাড়ালে যাইয়া বাইজ্য করলে। এইরকম এট্টু শোয় আর ওড়ে। ওডে আর কয় বাইজ্য করুম। বাওনজির রাগ ঢিল নাই। হে কইয়া যায়, হাগো যাইয়া ওশ্যায়, হাগো যাইয়া ঢেঁকিঘরে—এইরহম। তো হারা রাইত ধরইয়া মাগি সাইদ্যের হাগা হাগলে।

রাইত পোয়াইয়া পুব আকাশ ফস্সা অয়। বাওনা জাগে, কয়—ডাকে পাখি না ছাড়ে বাসা। হেয়ার নাম ছিরি উষা। বাউনি রাইত শ্যাষ ওডো। বাউনি য্যান কহন এট্টু মাছপোড়া ঘুম দেছেলে, ধড়মড় করইয়া উডইয়া বইলে। বাওনা কয়, কাইল হারা রাত্তির ক্যার লগে বগর বগর করলা। ঘুমের মইদ্যে শোনলাম য্যান, কেডা খালি বাইজ্য করার কতা কইলে। বাউনি কয়, চুপ চুপ, বউডা হোনলে লজ্জা পাইবে। হে আছে হাইতনায় হুইয়া।

–হে কেডা?

—জানি না। তয় আইজ কইবে।

কিন্তু হাইতনায় আইয়া হেরা কেউরেই দেখে না। বাউনি জিগায়, ও বউ তুমি গেলা কই? কোনো উত্তর নাই। তহন বাউনি ভাবে হারা রাত্তির ধরইয়া এত হাগন হাগলে যে মাগি হে গেলে কই?—বাওনা বলে, এয়া বুঝি হপ্পন। তহন কেরমে কেরমে সুজা ঠাহুর ওডেন। বেয়াক পরিষ্কার অয়। কিন্তু হে মাগি কই? হ্যারে কেউ দেহে না। বাওনা কয় ওয়া হপ্পন। বাউনি যায় খাড়ালে, দ্যাহে হেহানে থুপথুপ সোনা, ছাইচে যাইয়া দ্যাহে থুপথুপ সোনা। ঢেঁকিঘরে, এহানে ওহানে বেয়াক জাগায়ই খালি থুপথুপ সোনা দ্যাহে হেরা। বাউনি দ্যাহে, হ্যার বাড়ির যেহানেই যায় ল্যাঙ্গে সোনা ঠ্যাঙ্গে সোনা বেয়াক জাগায় সোনার ছড়াছড়ি। সব বাইজ্য সোনা অইয়া রইছে। বাওনা ব্যাপারডা বোজলে। বাউনিরে কয়,—

–বাউনিলো বাউনি, বোজ্জোনি কেডা আইছেলেন?

–হেয়া আর বুজুম না। বিপদনাশিনী মায় আইয়া মোর বেয়াক দুঃক দূর করইয়া গেলেন।

হেইদিন থিহা বাওনা আর বাওনির দুঃক শ্যাষ। বাজা গাইডা রাইত দুফইরে ম্যাৎ ম্যাৎ করাইয়া ডাক ছাড়লে, আর পাল খাওয়ানোর লগেলগে পোয়াতি। ঘরের সামনার হুগনা পুহইরডায় জলে মাছে কেলি করে, গোলায় ধান ভাইঙ্গা পড়তে আছে, আর হেই ধানের ‘ক্যারা পোকার’ যন্তনায় বাড়িতে টেহা দায়। ক্রেমে ক্রেমে, এর পরথিকা বাজা বাউনি ফি বচ্ছর পোয়াতি অইয়াই যাইতে লাগলে। তহন হ্যারগো ল্যাঙ্গে পোলা ঠ্যাঙ্গে পোলা। এইক্কা হাপুর দিতে না দিতে অন্যউগ্‌গা বাউনির ছাচে। এইরকমভাবে বিপদনাশিনী দেবী বাওন-বাউনির দুঃক নাশ করলেন। হ্যারগো ধনেপুত্রে লক্ষ্মীলাভ অইল।

ব্রতকথা শেষ হলে ওই একইভাবে বুড়িপিসিমা তার মন্ত্র বলতেন, এই কথা যে শোনে যে পড়ে ইত্যাদি এবং হাতের দূর্বা সামনের ঘটের ওপর ছুড়ে দিয়ে বেয়াকের হোগাভুত অইয়া স্যাবা দেওন। ততক্ষণে মা-জেঠিমাদের কেউ কেউ গুড়, কলা, বাতাসা, নারকেল সহযোগে ভেজা মুগ, ভেজা কলাই বা ভেজা চাল মাখতে শুরু করতেন। দরদালানে ততক্ষণে চপলা দাসী, আমোদিনী দিদিমা বা সোনালক্ষ্মী দিদিরা কলার পাত পাততে শুরু করে দিয়েছেন। বুড়িপিসিমা বলতেন, ‘উপোসইয়াগো আগে দেও।’ উপোসইয়া বলতে অবশ্যই আমরা। ব্রতধারী-ব্রতধারিণীরা উপোসি থাকবে এমনই বিধি। কথাটি হয়তো তিনি ব্যঙ্গার্থেই বলতেন, তবে আমরা তখন প্রকৃতই উপোসি। এ প্রসাদ আমাদের কাছে বড় অমৃতবত বোধ হতো তখন।

পিছারার খালের জগৎ ছেড়ে ভিন্ন পৃথিবীতে যখন, তখনও ওই বুড়িপিসিমা, নগেনজ্যাঠা, জেঠিমা বা ডাক্তারবাড়ির সোমত্ত মেয়েগুলো এবং পিছারার খালধারের তাবৎ অনুষঙ্গগুলো আমাকে রেহাই দেয় না। যেখানেই যাই, পিছারার খালের স্রোতের শব্দ একটা একটানা সুরের মতো বুকের মধ্যে বাজতেই থাকে। বান্ধবজনেরা তাদের নাগরিক বোধে আমার স্পর্শকাতরতা, ভাবপ্রবণতা নিয়ে নানা নিন্দামন্দ করে। সত্যই আমি বড় আবেগতাড়িত। আমি ভাবি, আমার তো এই সম্বল। আমি যদি আমার বুড়িপিসিমার চালকলা মাখা হাতখানার সুঘ্রাণ কোথাও পাই আর তা যদি আমাকে দুকুড়ি-তিনকুড়ি বছরের ওপারে এক সবুজ সতেজ উদ্যানে পৌঁছে দেয় তো দিক না, তাতে কার কী ক্ষতি?

গভীর রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে এখনও মনে হয়, ওই পিছারার খালের সোঁতা বেয়ে বড় খালের দিকে এগোচ্ছি। সারা শরীর কাদাজলে নিমগ্ন। কোমরের কাছের বস্ত্রখণ্ড বা গামছার কোঁচড়ে ‘ঘুসা’ চিংড়ি নিয়ে এগিয়েই যাচ্ছি বড় খালের দিকে, হাতে ‘হোচা’ বা ‘খুঞ্চই’। পিছারার খাল। বাস্তবে সে খাল কবে শুকিয়ে মাঠ হয়ে গেছে, কিন্তু আমার শিকড়ে যেন আজও তার ধারা বহমান। তার প্রতিটি খাঁজে আমার হাত হাতড়ে বেড়ায় স্বপ্নের চিংড়ির খোঁজে।

বাস্তবে আর কোনোদিন পিছারার খালধারের সেইসব উৎসবে ফিরতে পারব না জানি। তবু ওই স্থান, তার প্রতিটি উৎসব অনুক্রম, বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা, কিলিকিলি বাওনজি, শীতলা, মনসা বা কালীখোলায় মায়ের গলায় গাওয়া রামপ্রসাদী গান, কীর্তন রয়ানি মালসীর অনন্ত আয়োজন—সেসব যে কী আকুলতা আজও আমার। মানুষের জীবনের ধ্রুপদী অনুষঙ্গগুলো যখন ধরা-ছোঁয়ার বাইরের বস্তু হয়ে যায়, তখন মানুষের কীই-বা উপায় থাকে?

আবার এর সবটাই ধ্রুবপদ কি না তাও তো জানি না। উৎসবের স্মৃতি, ভালোবাসার, প্রাচুর্যের এবং সামাজিক সুস্থিতিজনিত আনন্দের স্মৃতিগুলো যদি জীবনের ধ্রুবপদ হয়, তবে তখনকার বীভৎসতা, ধ্বংস, অবিশ্বাস এবং রক্তের স্মৃতিও কি ধ্রুবপদ নয়? কী এক গূঢ় কার্যকারণে যেন তখনকার অতিবীভৎস ঘটনাও নস্টালজিয়ার মাহাত্ম্যে ধ্রুবপদ হতে চায়। এমনকি সে সময়কার নানাবিধ অসম্মানকর সামাজিক আচরণ, যা তখন প্রতিমুহূর্তে দংশন করে বলত, এ দেশটা তোমাদের আর এখন নয়। তোমরা এবার চলে যাও এখান থেকে—সেসবও আজ ধ্রুবপদ বলেই যেন মনে হয়। যেন সেসবও স্বাভাবিক নির্বন্ধেই এসেছিল। সেসব আসার কার্যকারণ ছিল বলেই।

বাপ-পিতামো এই ভূমির আবাদকালে যে সহজতায় আবাদকারী মানুষদের মধ্যে একাত্ম ছিলেন, একসময় সেই অবস্থান থেকে সরে গিয়ে, তারা আবাদি ভূমির মালিক হলেন। ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছোনোর পর তারা যে সামাজিক অন্যায় পুরুষানুক্রমে আবাদকারীদের বংশধরদের ওপর করেছেন, আমরা ওই পিছারার খালের সোঁতা বিলুপ্ত হবার সময় থেকে তার ফল ভোগ করেছি। এরকম দায়ভাগ আমাদের হয়তো আরও বহু যুগ যুগ ধরে বহন করতে হবে।

পূর্বপুরুষদের কথা ছেড়েই দিই, আমি নিজেই কি স্বয়ং আমাদের কর্তাদের অনেক অন্যায় আচরণ, অন্যায় কর্মের অনুষ্ঠান হতে দেখিনি? সেইসব অন্যায়ের পরম্পরা তো আমাদেরকেও অবশ্যই বহন করতে হবে। তার অংশী যে আমি নিজেও, তা জ্ঞানে হোক অথবা অজ্ঞানে। অজ্ঞানকৃত অন্যায়, অন্যায় নয় এ কথা তো কোনো শাস্ত্রকার বা পণ্ডিত বলেননি। এ ক্ষেত্রে পরম্পরালব্ধ আচরণের দায় আমরা বহন করছি, যা সাম্প্রদায়িকতা নামক এক পিশাচযজ্ঞের ফল হিসেবে সম্প্রদায়গতভাবে আমাদের ওই পিছারার খালের চৌহদ্দি থেকে উচ্ছেদ করে এক অনির্দেশ্য ভবিষ্যে নিক্ষেপ করল। এ বিচার মুসলমানসমাজ, যারা আমাদের ওখানকার নিম্নবর্গী, বিশেষত, তারা তুলতেই পারে। যে বুড়িপিসিমার ব্রতকথা নিয়ে আমার এই সাতকাহন বাক্‌বিন্যাস, তিনি কি প্রতিনিয়ত এদেরকে জাত তুলে শাপশাপান্ত-বাপবাপান্ত করেননি? তিনি কি এদের সামান্য ত্রুটিকে উপলক্ষ্য করে বলতেন না—এ তোগো জাতের দোষ। এ কারণে এ অনাচারের দায়ভাগ আমাদের বহন যে করতে হবে, তা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু তাতেই-বা পিসিমার ব্যক্তিক দায় কী?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *