বিষাদবৃক্ষ – ৩২

বত্রিশ

একসময় মানুষের বাঁচা বা মরার অধিকার সবই জমিদার তালুকদার বা তাঁদের নায়েব-গোমস্তাদের মুখের কথার ওপরই নির্ভর করত। এ কিছু নতুন কথা নয়, তবুও প্রসঙ্গক্রমে বলতে হচ্ছে। নায়েবমশাই, তাঁর জমানায় এ অঞ্চলে অসংখ্য ঘটনা ঘটিয়েছেন, যে কারণ সাধারণ চাষি প্রজাদের ভিটেছাড়া, গ্রামছাড়া হতে হয়েছে। মানুষ খুন হয়েছে সাধারণ পশুর মতো। নারী লুণ্ঠিত হয়েছে অকাতরে। আমি এমনও শুনেছি যে, নায়েবমশাইয়ের বাঁধা মেয়েমানুষ থাকা সত্ত্বেও তাঁর মাঝে মাঝেই স্বাদ পালটাবার ইচ্ছে হতো এবং পাইক লেঠেলরা সে ব্যাপারে তাঁকে আদৌ হতাশ করত না।

ছনুমিরধা বলে এক আধপাগলা কিন্তু অসম্ভব ন্যাওটা ‘মিরধা’ আমাদের তালুকদারি চলে যাওয়ার পরও বহুকাল বাড়িতে আসত। তালুকদারি বিলোপের বিষয়ে কেউ কিছু বললে সে খুব মুখ-খারাপ করে ‘দক্ষিণী খামার’ দিত। কিছুতেই বিশ্বাস করত না যে এখন আমরা তার মালিক নই। যখনই আসত, কাঁধে করে হয় একটা অতিকায় চিতল মাছ বা অনুরূপ কিছু নিয়ে আসত। অতদূরের পথ পাড়ি দিয়ে আসতে আসতে সেসব হয়তো পচে গোবর হয়ে যেত। কিন্তু বারণ করলে শুনত না। তার ধারণা ছিল, মালিকের কাছে খালি হাতে যাওয়া গুনাহ।

তার কাছে নায়েবমশাইয়ের বাড়ির ঘটনা ঘটার পর শুনেছি যে, ব্যাপারটি আফসোস এবং দুঃখজনক হলেও ‘নাইবের এডা পাওনা’। সে বলেছিল, ‘ভাইডি এয়া হ্যার পাপের শাস্তি। হে যে ক্যাতো বিধবার সব্বনাশ করছে হেয়াগো মুই জানি। মুই যে মেরধা।’ কিন্তু পাপের শাস্তির এই ধারাটি ব্যাখ্য করা বড় সহজ নয়। বিশেষত নায়েবমশাইয়ের বাড়ির ঘটনাটি কোনো বদলা নেয়ার ঘটনা নয়। তবু ছনুর বিচারেও বোধহয় কোনো কার্যকারণ ছিল, যা অস্বীকার করা যায় না।

এ প্রসঙ্গে আরেকজন মানুষের কথা বিশেষ করে মনে পড়ে। তার নাম আহমেদ মোল্লা। পাশের এক মুসলমান গাঁয়ের মানুষ। পেশায় এককালে ছিল ডাকাত। সবাই তাকে আহমেদ ডাকাত বা ডাকাত মোল্লা বলেই ডাকত। এ কথায় কে কী ভাববে জানি না, তবে আমাদের জেলায় একদল মানুষ ডাকাতি ব্যাপারটাকে পেশা হিসেবেই গ্রহণ করেছিল, তা বহুকাল আগে থেকেই। ডাকাতি, নগ্‌দিগিরি, লাঠিয়ালি বা এরকম সব ভয়ংকর কাজকে আমাদের এখানকার মানুষেরা বর্গ-বর্ণ নির্বিশেষে খুব একটা নিন্দনীয় পেশা হিসেবে দেখত না। এ সব তাদের কাছে খুবই সহজ স্বাভাবিক আর আট-দশটা সাধারণ পেশার মতোই। এ কথা সবাই জানেন যে এই ভূভাগ বা তার অন্তর্গত অঞ্চলসমূহে প্রকৃতি অতি ভয়াল এবং নিষ্ঠুর। এখানে বসতির শুরু থেকেই তাদের একদিকে মোকাবিলা করতে হয়েছে অতিশয় হিংস্র জন্তু, সাপ, বাঘ, কুমির ইত্যাদির সঙ্গে, অপরদিকে প্রকৃতির সঙ্গে, যে প্রকৃতি কখনো বন্যা কখনো সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস, কখনো-বা ঝড়ের তাণ্ডবে তাদের জীবন ছিন্নভিন্ন করার প্রয়াস পেত, করতও। কিন্তু যারা এখানে প্রথম বসত করতে এসেছিল, তারা এইসব ভয়ালতার বিষয়ে শুরুয়াতেই ওয়াকিবহাল ছিল বলে তাদের লড়াই হামেহাল জারি রেখেছিল। কারণ তারা জানত যে, এখানেই তাদের বসত গড়তে হবে, যেহেতু এখানে জমি উর্বরা এবং নদীখালসমূহ মৎস্যের খনিবিশেষ।

প্রথমে এসেছিল কৈবর্ত-ধীবরজাতীয় মানুষেরা। তারা এই নবীন ভূমিতে দেখেছিল অসুমার খাল, নদী এবং জলাভূমি, যাদের বুকের মধ্যে ঘুরে বেড়ায় সব বিচিত্র ছোট, বড় এবং অতিকায় মাছেরা। চন্দ্রদ্বীপ অঞ্চল তখন সমৃদ্ধ জনপদ। নৌকাযোগে এক-দেড় দিনে সেখানের গিরদে বন্দরে মৎস্য নিয়ে পাড়ি দেয়া যায়। কিন্তু সমস্যা ছিল ভূমিতে বসবাস করার। কারণ সে স্থান তখন সুন্দরী অরণ্যের, গোল হোগলের নিভৃত অন্তঃপুর। সেখানের রাজাধিরাজ দক্ষিণ রায়। ডাঙায় তিনি এবং তাঁর সাকরেদরা, জলে কুমির-কামট। ধীবরকৈবর্তেরা প্রথমে তাদের রমণীদের আনেনি। নিজেরা থাকত নৌকোয়। মাছ মারার জন্য অনুষঙ্গ ছাড়াও তারা নৌকোতে রাখত ভল্লা, রামদা, ল্যাজা, সড়কি, গুলিবাঁশ এবং জালের লোহার কাঠি, আর অন্যান্য নানান মারণযন্ত্র। বন্য পশু ছাড়াও তাদের লড়তে হতো মগ, পর্তুগিজদের সঙ্গে। তারা মোহনায়-মোহনায়, ঝোপঝাড়ের আশপাশে তাদের ‘পিনিস’ নিয়ে অপেক্ষা করে থাকত ওত পেতে, কখন এইসব মানুষদের নৌকো তারা লুট করবে, তাদের বন্দি করে নিয়ে যাবে তমলুকের, পিপলির বা চাটগাঁর দাসবাজারে, কিংবা সাগরের মাঝদরিয়ায়, যেখানে এদের বিক্রি করে দেবে বিদেশি দাসব্যবসায়ীদের কাছে। তাই এইসব প্রতিকূলতার সঙ্গে সংগ্রাম করতে গিয়ে এই মাছ মারা মানুষেরা আস্তে আস্তে এ অঞ্চলে স্থায়ী বসতির কথা ভাবে, আর একসময় তা শুরুও হয়ে যায়।

সে এক দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস। মানুষ তা কোনোভাবেই ধরে রাখেনি, সবার তা মনেও নেই। যাদের কাছে তা জানতে পারি, তারা শুধু ওইসব অসামান্য লডুয়ে মানুষদের অধস্তনদের কেউ কেউ। আমাদের আহমেদ মোল্লা ছিল সেরকমই এক মানুষ। পরম্পরাগত জীবনে তাই ডাকাতির পেশা তার বা তার মতো মানুষদের ক্ষেত্রে কিছু অভাবনীয় নয়। তার পূর্বপুরুষেরা এভাবেই জালিয়া থেকে হালিয়া হয়ে বসত গড়তে শুরু করেছিল এখানে। কিন্তু সে আবাদ তেমন ব্যাপক নয়। ব্যাপক আবাদ শুরু হয় যখন গ্রামপত্তন শুরু করে তখন। এখন বিচার্য এই যে, উচ্চবর্ণীয়রা নবাব-রাজাদের খেয়ালি পাট্টার জোরে যে দলখদারি করে সেটা ডাকাতি, না এইসব মানুষেরা প্রথমাবধি যে লড়াইয়ের মাধ্যমে তাদের দখল জারি রাখতে চায় সেটা ডাকাতি। এ প্রশ্নের উত্তর ইতিহাস একেক সময় একেকভাবে দিয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে উত্তরটি বোধহয় খুব সরল নয়। বিভিন্ন পারিবারিক ইতিকথার শ্রুতি এবং স্মৃতি অনুযায়ী এ স্থানের আবাদকারী এবং যাঁরা আবাদ করিয়েছেন, তাঁদের প্রতিষ্ঠা প্রায় সমসাময়িক। ব্যাপারটা এমন ঘটেনি যে এখানকার আদি চণ্ডভণ্ড মলঙ্গী, ধীবরকৈবর্ত বা হালিয়াকৈবর্তরা সব বন আবাদ করে ফসলি জমির ব্যবস্থাদি এবং নিজস্ব গৃহস্থালি স্থাপনা করার পর উচ্চবর্ণীয়রা এসে তা দখল করে রাজপাট বসায়। সেরকম ঘটনাও বেশ কিছু আছে এবং তা অবশ্যই ডাকাতিরই নামান্তর। আবার বেশ কিছু উদ্যোগী পরিশ্রমী মানুষও যে এইসব আদি মানুষদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে প্রতিকূল শক্তির সঙ্গে লড়াই করে একসময় প্রাধান্য পেয়েছেন এ কথাও মিথ্যে নয়। আমি নিজেই এই দুই ধরনের ভূস্বামীদের এ অঞ্চলে দেখেছি এবং সামন্তপ্রথার লোপ হলেও এই জাতীয় ভুস্বামীদের কোনো কোনো পরিবার এখনও এ অঞ্চলে বেশ ক্ষমতাশালী। দু-একটি হিন্দু পরিবারও এখনও এখানে বেশ দাপটের সঙ্গে যে আছেন, পরবর্তীকালে তা-ও আমার অভিজ্ঞতা হয়েছে। তবে ভূস্বামী মাত্রেই ডাকাত অবশ্য ছিলেন এবং আহমেদ মোল্লাদের মতো ডাকাতদের সৃষ্টিও তাঁদেরই অবদান।

কিন্তু যে আশ্চর্য ব্যাপারটি আমার নজরে পড়েছে, তা হলো, শোষক-শোষিতের সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও এক ব্যাপক কামারাদারির পরম্পরায় তাঁরা খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন। এই সম্পর্কটির বিষয়ে কোনো তাত্ত্বিক আলোচনায় না গিয়ে আহমেদ মোল্লার কাহিনিটি বলাই বোধহয় যথেষ্ট হবে। তবে এই কামরাদারির বিষয়ে একটি অনুমানের কথা বলে নিই। আমার ধারণা, স্থানীয় ভয়াল প্রকৃতি এবং বহিরাগত মগ, পর্তুগিজাদি দস্যুদের বিরুদ্ধে একত্রে লড়াইয়ের দীর্ঘকালীন অভ্যেসের জন্যই বোধহয় এই কমারাদারিটি তৈরি হয়েছিল। এখানের অধিবাসীরা, বর্গ-বর্ণ নির্বিশেষেই এক অসামান্য উর্বর ভূমির প্রসাদ লাভ করেছিল, যেখানে ফসল ফলাবার জন্য ভূমিতে বলিষ্ঠ কৃষকদের পদচারণই যথেষ্ট। কঠিন লৌহময় হলশীর্ষের প্রয়োজন এই ভূমির কদাপি ছিল না। কিন্তু ভূমি হাসিল করার এবং তাকে সতত শাসনে রাখার সংগ্রাম, প্রতিনিয়ত এঁদের করতে হয়েছে। সে-সংগ্রাম, যা প্রকৃতি এবং লুণ্ঠনকারী বহিঃশত্রুর বিরুদ্ধে সমবেত অধিবাসীগণের, পরে কালের গতিতে তা ভূমির বহুমাত্রিক উপস্বত্বতায় এক জটিলতম বহুমুখী সংগ্রামে পর্যবসিত হয় এবং ফলে আহমেদ মোল্লাদের মতো মরসুমি ডাকাতদের উদ্ভব ঘটে।

আবার এখানকার ভূমিপুত্রদের স্বভাবপ্রকৃতির রুক্ষতার কারণও বোধহয় এটাই। এত সংগ্রাম করে যে জমি তারা হাসিল করেছে এবং যে জমির প্রসবক্ষমতা এমন অনবদ্য, তার প্রতি এই মানুষদের মমতা অবশ্যই যে মাত্রাতিরিক্ত হবে, তা কিছু আশ্চর্য নয়। ফলত তারা বর্গ বর্ণক্রমেই একটু অতিমাত্রায় উচ্ছ্বাস আর আবেগপ্রবণ, আবার রুক্ষতায়ও তা হঠাৎ-ওঠা সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসের মতোই। সামান্য এদিক-ওদিক হলেই যেমন ফয়সালার অস্ত্র নিমেষে ঝলসে ওঠে, তেমনি শুধু মুখের কিছু মিষ্ট কথায় ভালোবাসার বন্যা নামে দুচোখ বেয়ে আনন্দাশ্রুর ধারায়। সবটাই এখানে সরাসরির ব্যাপার, প্যাচঘোচের বালাই নেই। একটা লঙ্কা গাছ ছাগলে খেলে যেমন ছাগলের মালিক খুন হয়ে যেতে পারে, তেমনি একখানা গোটা ফলন্ত মাঠের ফসল-লুটকারী যদি এসে জমির মালিকের কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চায়, তখন অপরাধী এবং সেই খেতের মালিক দুজনেই পাল্লা দিয়ে পরস্পরের গুণকীর্তন করে। এ বলে, মুই দুষী, ও বলে, মুই।

তা এই হলো এখানের মাটির দোষ বা গুণ, যে যেমন মনে করে। যস্মিন দেশে যদাচার। যে কথা আগেই বলেছি এই আহমেদ মোল্লাদের ডাকাত হওয়ার প্রসঙ্গে যে, ভূস্বামীরাই তাদের একসময় ডাকাতে পরিণত হতে বাধ্য করেছে। কিন্তু তা আবাদের যুগের বহু পরের কথা। আহমেদ মোল্লারা ডাকাত হয় তাদের পরদাদাদের হাসিলি জমি হারাবার পর। আমার এই এলাকার তাবৎ ইতিহাসই হচ্ছে জমি-ডাকাতির ইতিহাস। জমির ক্রমান্বয়ী বিকাশের মাধ্যমে উন্নততর বা কাঙ্ক্ষিত কোনো সামাজিক বিন্যাস পিছারার খালের ভূখণ্ডে ঘটেনি। ফলে আহমেদ মোল্লাদের মতো ডাকাতরা যেমন একসময় সামাজিকভাবেই এসেছে, তেমনই এসেছে নায়েবমশাইয়ের বাড়িতে যারা ডাকাতি করেছিল, কৌশলী ডাকাত, তারাও। কিন্তু আহমেদ মোল্লার মতো ডাকাতরা আমাদের যত কাছের মানুষ ছিল পরবর্তীরা ছিল ততটাই দূরের।

মোল্লাদের ডাকাতি ছিল মৌসুমি বা মরসুমি ডাকাতি। যখন মাঠে কাজ আছে বা অন্য রুজি-রোজগারের ব্যবস্থা আছে, তখন যে ডাকাতি করে সে ‘একছের লক্ষ্মীছাড়া’। মোল্লারা তখনকার দিনে ডাকাতি করত অনটনের টোটায়, যখন পেটের নাড়ি ‘গুটলি’ পাকিয়ে ‘হা অন্ন’ ‘যো অন্ন’ করত, তখন। ওই সময় মালিকদের গোলায় ধান পচে, আর সাহা, সাউদ, মহাজনেরা ‘সুদের ট্যাহা ছ্যাপ দিয়া গুনইয়া’ সিন্দুকে তোলে। সেই সময়ই তো খেতমজুর, দিনমজুর, ভূমিহীন আহমেদ মোল্লারা রামদা, সড়কি, ল্যাজা নিয়ে ডাকাতি করতে বেরোত সেইসব বাড়িতে, যেখানে মানুষের খাদ্য মুনাফার খাতিরে পচে এবং যার উৎপাদক এই আহমেদ মোল্লাদের মতো ডাকাতরাই। তাই এই ডাকাতির কারণ সংখ্যালঘু খ্যাদানো, লোভ বা মাৎসর্য নয়, এর কারণ ক্ষুধা। ফলত, এই ডাকাতির একটা নীতিনিয়ম ছিল। তারা সাধারণ মেয়েদের ইজ্জত নিয়ে নষ্টামি করত না। যদি দলের মধ্যে কেউ তেমন করার চেষ্টা করত তবে তার শাস্তি তারা দলের সরদারদের হাতেই চূড়ান্তভাবে পেত। এরা অকারণে মারদাঙ্গা করত না, বাধা পেলে করত। তখন দু-একটা খুনখারাপি হয়েও যেত। তা এসব খুন আমাদের জেলার চরিত্রানুযায়ী খুব একটা উল্লেখযোগ্য বিষয় নয়। ডাকাতি ছাড়াও জমিজমার হাঙ্গামায় খুন ছিল খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। খুন হলে তারা ধরাও পড়ত এবং নির্ধারিত সাজাও ভোগ করত। সেও হিসেবের মধ্যেই ছিল। তবে মোল্লার হাতের খুনের কিনারা কোনো দিনই হয়নি, এরকম শুনেছি। তার খুনের ব্যাপার নিয়ে মামলা হলে দেখা যেত আহমেদ ঘটনার দিন সদর হাসপাতালে তার বহুদিনের পুরনো পিত্তশূল বা অম্লশূলের বেদনার জন্য চিকিৎসাধীন। সদর হাসপাতালের বড় ডাক্তারের কাগজপত্তর সে তখন দাখিল করত আদালতে।

মোল্লার গল্পটি যে কারণে বলা, তা হলো, আগে যে কৌশলী ডাকাতির কথা বলেছি তার সঙ্গে এর মৌলিক পার্থক্যটি জানানো। মোল্লা বছরের মধ্যে বেশ কিছু সময় জেলে থাকত। বাকি সময়টা, অন্য দশজন সাধারণের মতো চাষি গেরস্তি, উৎসব পার্বণে কাটত তার। ছেলেপুলে ছিল এক দঙ্গল। বিবি দুখানা। নিত্য তিরিশ দিন অভাব লেগেই থাকত। তবে আমাদের আঞ্চলিক বিচারানুযায়ী বললে বলতে হয়—’মানুডা ডাহাইত আছেলে ঠিকই, তয় হ্যার পেরানডা আলহে সাইদ্যের ভালো।’ সে ছিল খুবই বুঝদার ডাকাত। কারণ সে নিজের বা আশপাশ হিন্দু-মুসলমান গ্রামে কখনোই ডাকাতি করত না। তার কাজকারবার, ব্যাপারাদি ছিল সাধারণ ব্যতিরেকে এবং দূর তিরন্দাজি ধাঁচের, তবে মুশকিল হতো যদি অন্য কোনো দলের নিশানা তার আশপাশ গাঁয়ের ওপর পড়ত তখনই। তখন সে নিজে তদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে ব্যাপারটা নিষ্পত্তি করার প্রচেষ্টা চালাত, অথবা নির্দিষ্ট অসৎ লোকের বাড়ি চিহ্নিত করে সেখানে নির্দিষ্ট নিয়মে তাদের কাজ করতে বলত। কিন্তু এরকম প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে সে গাঁয়ে ঢোকার পথে সদলে দাঁড়িয়ে থেকে মহড়া নিত প্রতিপক্ষের। এ কারণেই বেশি সংঘর্ষের মধ্যে যেতে হতো তাকে এবং লাশ পড়ত অনিবার্যভাবেই। ফল জেলবাস। খুব কঠিন শাস্তি দেয়া যেত না তাকে, কারণ প্রমাণাভাব, যেমন আগেই বলেছি।

একবার এরকম এক মৌসুমে সে যখন তার বাৎসরিক নিয়মের জেল খাটছে, তার একটি ছেলের কলেরা হয়। এ সব রোগে সে যুগে গ্রামে যা ব্যবস্থা নেয়া হতো তাই হলো। হোমিওপ্যাথিক ওষুধ অথবা পিরের জলপড়া। উভয়েরই অর্থমূল্য কম এবং সহজে আয়ত্ত বিধায় মানুষ ওই পন্থায়ই যেত। মোল্লার ছেলেটি মরেই যেত যদি বাবা এবং তাঁর সাকরেদ নারায়ণ ঠাকুর উদ্যোগী হয়ে তাকে গঞ্জের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে উপযুক্ত চিকিৎসা না করাতেন। কিছুকাল আগেও কলেরা শুরু হলে আমাদের ওখানে পাড়া-কে-পাড়া উজাড় হয়ে যেতে দেখেছি। গঞ্জেও তখন তেমন কিছু ব্যবস্থা ছিল না। এই সমস্যাটায় কিছু ব্যবস্থাদি হচ্ছিল। এ কারণে ছেলেটা বেঁচে গেল।

আমাদের ছোটবেলা থেকে দেখেছি সমাজে যারা আহমেদ মোল্লার মতো স্বভাবের মানুষ, তাদের প্রতি বাবা, নারায়ণ ঠাকুর ইত্যাদিরা এক ধরনের দুর্বলতা পোষণ করতেন। এইসব মানুষ সম্ভবত তাঁদের দুঃসাহসিক জীবনযাপনের জন্যই তাঁদের স্নেহ-ভালোবাসার আধিকারিক হতো। কিন্তু সবাই আহমেদ মোল্লার মতো মানুষ ছিল না। তারা এই স্নেহ-ভালোবাসার সুযোগ নানানভাবে গ্রহণ করত। কখনো-বা বলেও বেড়াত যে, অমুকবাবু তমুক গ্রামে ডাকাতি করার সময় তার বা তাদের সঙ্গে ছিলেন। অথবা তাঁর নির্দেশেই এরকম একটি ডাকাতির কাজ করতে তারা বাধ্য হয়েছে। এমনকি পুলিশি জেরার সময় পর্যন্ত তারা বাবার মতো মানুষের বিরুদ্ধে পর্যন্ত এরকম জবানবন্দি দিয়েছে। বাবার ঘরেই জানালা ভেঙে ঢুকে তাঁর পাঞ্জাবি থেকে সোনার বোতাম বা অন্যান্য সামগ্রী চুরি করতে দ্বিধা করেনি। এ কারণে বাবাকে বিপদে পড়তে না হলেও অনেক সময়ই অত্যন্ত অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়তে হয়েছে। বিপদ না ঘটার কারণ অবশ্যই সামাজিক প্রতিপত্তি।

তবে আহমেদ মোল্লা এ ধরনের আচরণ কোনো দিনই করেনি। বাবার সঙ্গে তার অত্যন্ত সদ্‌ভাব ছিল। তাঁকে অসম্ভব মানতও সে। অনেকবারই তাকে বলতে শুনেছি—য্যারা নেক ইমানদার মানু, ভালো ছাড়া কহনো খারাপ কাম করে না, মোনাফেকি, বেএনছাপি করে না, হ্যারগো তো বেয়াকেই ভালো পায়। লেকিন, মোর ল্যাগানদোজোখি কিরার লইগ্যা ভাবে কেডা, অ্যাঁ? মোরেও যে ভালো পায় হে মানুষডার দিল আল্লাহ কী দিয়া বানাইছে, অ্যাঁ?—কিন্তু তথাপি আহমেদ তার ‘ডাকাতি ব্যাপার’ অর্থাৎ ব্যবসা তখনও ছাড়তে পারেনি। বাবা, নারায়ণ ঠাকুর তাকে এ নিয়ে অনেক বললেও সে পেরে ওঠেনি; পেরে ওঠা সম্ভবও বোধকরি ছিল না। চাষের কাজ যে কটা দিন সে করতে সুযোগ পেত, সেই রোজগারে অতগুলো সন্তান এবং দু-দুখানা বিবিকে ভাতকাপড় দেয়া সম্ভব ছিল না। তা ছাড়া সে কাজ করত পরের জমিতে আধিয়ার হিসেবে। নিজের হাল-গরু-জমি কিছুই ছিল না। যেটুকু গতরের জোরে করতে পারত, তার আধা ভাগের বেশির ভাগ চলে যেত হাল, বলদ, কামলা এবং তার জেলখাটাকালীন অনুপস্থিতিজনিত কারণে বাড়তি কামলার হিসেব মেটাতে। আমাদের জেলায়, বিশেষত আমাদের ওই পিছারার খালের চৌহদ্দিতে মেয়েলোকের খেতে কাজ করার রীতি নেই। যদিও তাবৎ কৃষিজগতে, রাঢ়ে বঙ্গে বা সারা বিশ্বে ‘মাগি এবং মিনসে’গণকে ‘রোয়া’র সময় ‘বিছান’সমেত ব্যস্ত দেখা যায় ‘রোপার’ কাজে-কামে, হাঁটু-কাপড়ে পাছা-উঁচা অবস্থায়। কিন্তু তা নিম্নতট দক্ষিণ-পূর্ববঙ্গের এই অঞ্চলটিতে নয়। আমাদের চাষিবউরা মরদদের সঙ্গে ‘বেলাহাজি’ভাবে ‘হোগা’ উঁচু করে কোনো দিনই রোপা রোয়নি। কারণ তাদের মরদেরা ব্যাপারটি আদৌ পছন্দ করেনি আবাদের প্রথম থেকেই। পাঠক, বোধকরি খেয়ালে রেখেছেন, এ অঞ্চলে বসতি স্থাপনকালে পুরুষেরা যে প্রথমে মেয়েদের নিয়ে আসেনি, সে কথাটি আমি বলেই রেখেছিলাম। তো, এরকম একটি সৃষ্টিছাড়া নিয়ম সে কারণেই অভ্যাসে এসে গিয়ে থাকবে। সে যা হোক এ কারণে মোল্লার বিবিরাও চাষের কাজ করে কোনো দিন সংসারের উপকারে আসতে পারেনি। তবে তারা যে একেবারে বসে খেত তাও নয়। ধানকুড়োনো, ধানভানা, চিড়েকোটা, মুড়ি-খই ভাজা ইত্যাদি আর্থ কর্ম তারা নিয়তই করত। কিন্তু তথাপি কি মোল্লার ডাকাতি ছেড়ে দেয়া সম্ভব ছিল? তা ছাড়া এসব ‘ব্যাপারীগিরির’ অন্য হাজার ফ্যাকড়া থাকে। এই ব্যাপারীরা সবাই এ কথা জানে যে এই ব্যাপারীগিরিতে ঢোকা যত সহজ, ‘ছাড়ন তত’ সহজ নয়। তুমি ছাড়লেও, দলের লোক তোমাকে ছাড়বে না; ছাড়বে না যারা তোমার এ কর্মের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় পাহারাদার তারাও। কারণ——তুই যদি এ কাম না করবি, মোগো চলে ক্যামনে’? অর্থাৎ “তুই বা তোরা এ কাম করবি, জেলও খাডবি, আবার ছাড়াও পাবি। হে কারণ চিন্তা নাই। মোরা তো আছিই।’ কিন্তু ‘তুমি ব্যাপারী হবা, ব্যাপার করবা না। এ দেউলা এই ব্যাপারে নাই।’ পেটের দায়ে এই ব্যাপারের ব্যাপারী হয়েছিল যারা একদা, তারা তখন কি এ কথা ভেবেছিল? কিন্তু ভাবেনি বলে, ‘ব্যাপারের’ কায়দা-কানুন পালটানো যাবে ইচ্ছেমতো এমন স্বাধীনতা ১৪ আগস্ট ১৯৪৭ সালের মধ্যরাত্রে কি কেউ বলে দিয়েছিল? দেয়নি। আহমেদ মোল্লাও সে কারণে, বাবা বা নারায়ণ ঠাকুরের নিয়ত সুপরামর্শ সত্ত্বেও এই ‘ব্যাপার’ ছাড়তে পারেনি।

‘ব্যাপার’ এবং ‘ব্যাপারী’ কথাগুলো এতক্ষণ যে অর্থে ব্যবহার করেছি, তার সামান্য টীকা প্রয়োজন। আমাদের অঞ্চলে ‘ব্যাপার’ অর্থে ‘ঘটনা’ নয়। ব্যাপার মানে ব্যবসা। ডাকাতি একসময় আমাদের ওই জগতে এক ধরনের ব্যবসায়ই ছিল। যারা ব্যবসা করে তারা ব্যবসায়ী বা ব্যাপারী। ডাকাতি যেহেতু একটি ব্যবসা বা ‘ব্যাপার’ তাই, যারা ডাকাতি পেশায় আছে তারাও ব্যাপারী। আমি তাদের পারস্পরিক পেশার উল্লেখের সময় এই শব্দটির ব্যবহারই জেনেছি। তারা সংক্ষেপে এই শব্দটিরই ব্যবহার করত। যেমন কেউ যদি জানতে চাইত, ‘অমুকে কী করে?” উত্তর হতো—’হে তো ব্যাপারী।’ অর্থাৎ সে ডাকাত।

ব্যাপারের পেশা পরিত্যাগ করে স্বাভাবিক গেরস্তজীবনে ফেরা বড় সহজকর্ম ছিল না সেকালে। একালেও যে তা খুব সহজবোধ্য তাও বোধকরি কেউ বলবেন না। কিন্তু আহমেদ মোল্লাকে ‘ব্যাপারের কাম’ ছাড়তে হয়েছিল। তার মতো মানুষের বোধহয় এই ‘কাম’ ছেড়ে দেয়া ছাড়া মানসিকভাবে আর কোনো উপায় ছিল না। আগেই বলেছি, আমার ওই অঞ্চলের লোকদের বিশ্বাস ছিল যে, আহমেদ মোল্লা ‘ডাকাইত অইলেও মানুডা ভালো’, তাই সে যখন দেখল যে তার ‘পোলাডা’ দুজন বিধর্মীর বদৌলতে ‘জানে বাচইয়া গেলে’, তখন তাঁরা দুজন তার কাছে ‘গুরুর গুরু’, পিরের পির’ ‘আল্লাহর ফেরেস্তা’, তার মতো মানুষের জীবনে আল্লাহর এমন কুদরত কায়েম হতে পারে, এ কথা বিশ্বাস করা তার পক্ষে অসম্ভব। সে জেলে বসে বাবা এবং নারায়ণ ঠাকুরের সেই প্রচেষ্টার কথা শুনেছিল যে, তাঁদের চেষ্টায়ই তার ছেলে বেঁচে গেছিল। কিছুদিন বাদেই সে ছাড়া পেয়েছিল এবং বাবার পায়ের কাছে বসে কসম খেয়ে বলেছিল, মুই আল্লা মাবুদ জানি না, আগম নিগম কোরান হাদিছ মোর মাতায় থাউক। মুই খালি জানি আল্লায় মাইনষের রূপ ধরইয়া মোর ছাওয়ালডারে বাঁচাইলে। তো মুই কই, আল্লাহপাক স্বয়ং মাইনষের রূপ ধরইয়া মাইনষের মইদ্যেই থাহেন।—মোল্লা কসম খেয়ে বলেছিল যে, জীবনে সে আর ডাকাতি করবে না, এমনকি উপোস করে যদি মরেও যায়, তবু না। এ বৃত্তান্ত আমার একেবারেই বাল্যবয়সের। পরবর্তীকালে যে মোল্লাকে আমি দেখেছি সে প্রকৃতই একজন আলাদা মানুষ। সে যে একদা একজন দুর্ধর্ষ খুনি ডাকাত ছিল, তখন তাকে দেখলে কেউ তা বলতে পারত না।

যে কথা আগে বলছিলাম, আহমেদ কখনোই বাবার স্নেহের সুযোগ নিত না। তার পরিচিত কোনো ব্যাপারী যদি সেরকম সুযোগ নিত তবে সে ভীষণ কাণ্ড করত। এরকম একটি কাণ্ডের গল্প শুনেছিলাম। আমাদের বাড়ির সেই যে ফটিকের কথা আগে বলেছি, তার বড় ভাই ‘লাড়ইয়া’ ছিল মোল্লার দলের একজন ব্যাপারী। তবে সে খুনখারাপির মধ্যে বোধহয় থাকত না। এরা দুভাই ছোটবেলা থেকেই হাত সাফাইয়ে বেশ দড় ছিল। ফটিক শেষ পর্যন্ত ছিঁচকে চোরই থেকে গেছে। কিন্তু লাড়ইয়া আহমেদ মোল্লার সাগরেদি করে কালেদিনে বেশ নামকরা ব্যাপারী হয়ে উঠেছিল। সে যা হোক, ছোট বয়সে মাতৃহীন হওয়ায় এরা আমার মায়ের তত্ত্ব-তালাশে থাকত। বাবাও এদের খুব স্নেহ করতেন। তা একবার নাকি এক দশধারার মামলায় সে পুলিশকে জানায় যে, বাবার নির্দেশেই তাকে ডাকাতিটি করতে হয়েছিল। কিন্তু পরস্পরবিরোধী বক্তব্যে অভিযোগটি সে প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি এবং ফলত কিছুদিন জেল খাটে। বেরিয়ে এসে বাবার পা ধরে ক্ষমাটমা চেয়ে সে যখন নিশ্চিন্ত তখন একদিন তার ওস্তাদ আহমেদ মোল্লার হাতে সে বেদম মার খেয়ে দেশছাড়া হয়। মোল্লা তার ওই বদমায়েশিটা জানতে পেরেছিল। দীর্ঘকাল আমাদের অঞ্চলের কেউ আর লাড়ইয়ার দেখা পায়নি। তবে একবার পুজোর সময় আমরা তাকে দেখেছিলাম। মোল্লার হাতে মার খেয়ে সে পালিয়ে গিয়েছিল নাকি পশ্চিমবঙ্গে। সেখানেও নানান দুঃসাহসিক ব্যাপারাদি করে জেল-টেল খেটে যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করে। বহু বছর পর যখন সে আমাদের পিছারার খালের জগতে এলো, ততদিনে সবার রাগ ধুয়ে জলে। প্রায় নায়কের মর্যাদায় সবাই তাকে নিল সেদিন। মজার ব্যাপার এই যে, পশ্চিমবঙ্গে তার ব্যাপারাদির গল্প সে নিজেই বলেছিল। মনে আছে, একটা আধুলি, সোনার আংটি একটা, একগাছা হার এইসব হঠাৎ করে গিলে ফেলে আবার উগরে বার করে দিয়ে সে সবাইকে তাজ্জব করে দিচ্ছিল। এ ধরনের চোরাইমাল গায়েব করার জন্য সে নাকি সীসের বল দিয়ে কীভাবে গলায় একটা পকেটমতো তৈরি করে নিয়েছিল অভ্যেস করে করে।

আহমেদ মোল্লাকে ডাকাত হিসেবে জেনেছি গল্পকথায়। জ্ঞান হবার পর তাকে দেখেছি মানুষের একনিষ্ঠ একজন সেবক হিসেবেই। বাবার কাছে কসম খাওয়ার পর মোল্লা তার দল ভেঙে দিয়েছিল। দলের সবাই হয়তো ব্যাপারের কাজ ছাড়েনি, কিন্তু মোল্লা কাঁচা সবজির ব্যবসা শুরু করেছিল তার নতুন পেশা হিসেবে। এ ছাড়া খাল বিল নদীতে জাল বেয়ে মাছ ধরত সে। সেটাও তার জীবিকার অঙ্গ হয়ে গিয়েছিল। একদা সে ডাকাত ছিল বটে, কিন্তু সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি তার আদৌ ছিল না। বরঞ্চ কোনোরকম গণ্ডগোলের আঁচ পেলে সে তার পুরনো সাগরেদদের নিয়ে আমাদের এলাকাগুলোতে টহলদারি করত রাতেবিরেতে। সব মানুষের সঙ্গেই ছিল তার সুন্দর সম্পর্ক। মাঝে মাঝে আমাদের কর্তাদের কাছে এসে যখন বসত, আফসোস করত তার অন্ধকারজীবনের নানান কৃতকর্মের জন্য।

তার সঙ্গে সেসব দিনে, শীত বা বসন্তের রাতে, জ্যোৎস্নাপক্ষ থাকলে, সুপারিকাঠের ডিঙিতে বড় খাল পেরিয়ে, গাবখানের নদীতে ঝাঁকিজাল নিয়ে মাছ ধরতে যেতাম। বড় খাল পেরোনোর সময় যখন বৈঠা হাতে মোল্লা ডিঙির পাছায় বসে এক হাতে বৈঠা চালাত, আর হাতে ডাবা হুকোটা নিয়ে গুড়ুক গুড়ুক করে টান মেরে তার ফেলে আসা জীবনের নানান রোমাঞ্চকর কাহিনি বলত, আমরা বড় শিহরিত হতাম। তারই কীর্তিকাহিনি বলত সে, কিন্তু আমরা তার বলার ভঙ্গিতে গল্পের স্বাদ পেতাম। বেশ চমৎকার একটি ধরন ছিল তার কথনের। কখনো কখনো গান গেয়ে উঠত, যদিও গানের গলা ছিল না তার। গলা না থাকলেও একটা ভাবে আবেগ থাকত তার গানে—যেটা, আমাদের ওই এলাকার বেশির ভাগ চাষি বা সাধারণ মানুষ মাত্রেরই একটা চমৎকার সম্পদই বলা যায়। তবে তার গলার খামতি পুষিয়ে দিত নাগর আলি ভাই। সে তখন আমাদের বাড়ির রাখাল, পাহারাদার ‘তথা’ অনেক কিছু। মাছধরা পর্বে তার উপস্থিতিও আমার এক চমৎকার স্মৃতি। গল্প করতে করতে মোল্লা হঠাৎ গেয়ে উঠত—সে গানের কলি বড় হাহাকারের—

কত আশায় ভাসাইলাম রে এএএ–
আহা এমোর সাধের তরিখান।
কূলে না পৌঁছিলাম রে বন্দু–
তাই কান্দে এ পরান

নাগর আলি ভাই সঙ্গে সঙ্গেই দোহার দিত এবং একসময় সে-ই মূল গায়ক হয়ে গেয়ে যেত—

কী কারণে, কে-বা করে এ এ রে এএএ—
আনছান এ ইনছান
আহা, কূলের তালাশ
দ্যাও মোর বন্দু গো
কান্দে এ পরান।

মানুষের জীবন কী কারণে, কে যে এমন ‘আনছান’ করে দেয় এবং সময় কেন যে তাকে দগ্ধায়, তার হদিস কে-বা জানে, আর কেই-বা দিতে পারে।

জেবন এমনই এক রঙ্গ
তারে কহনও দেখি নিষ্ঠাচারে
কহনও তার তিরভঙ্গ,
তার কহন পিরিত কহন সোহাগ
কহন যে তার ভাবের উদ্বাগ
হে কতাডা জানলে বোধায়
শেতল অইত এ অঙ্গ।
শ্যাখ নাগরালি কয়
কীসের থিহা কীবা অয়
হে কতা কেউ কইত যদি
ছাড়তাম না হে মধুর সঙ্গ।

–এরকম এক বিন্যাসে নাগর আলি ভাই মোল্লার গানের বিস্তৃতি ঘটাত। অল্পশিক্ষিত অথবা অশিক্ষিত বলে যাদের আমরা বারবার তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে এসেছি তারা কিন্তু মাটির গুণে হোক বা যে কোনো কারণে এমতো দার্শনিকভাবে ভাবিত এবং ব্যক্ত হয়, এ আমার একান্ত অভিজ্ঞতা।

ডিঙি যখন বড় খাল ছেড়ে গাঙের জলে পড়ত তখন মোল্লা বলত, বাজানেরা তোমরা কেউ একজোন এহন পাছায় বও, একজন যাও গলুইয়ে। নাওহান য্যান কাইত্তার না অয়। নাও কাইত তো বেয়াক কাইত। তোমরা আর য্যারা য্যারা নাওয়ে আছ, হগ্গলের মৌয়াত। তয়, হে কারণ ভাবইয়া লাভ নাই। হায়াত থাকলে বাচপা, মৌয়াত আইলে মরবা। মরণ বাচন খোদার নাচন। তয়, পাছায় যে থাহে হ্যারও কিছু মেন্নত থাহা জায়েজ। হ্যার হজাগ থাহন আবইশ্যক।—এইসব কথা হতে হতে খ্যাপলা জালের ‘খ্যাও’ এবং নৌকোর মধ্যে মাছেদের দাপাদাপি শুরু হতো। তাদের রুপোলি শরীরে চাঁদের আলো ঠিকরে পড়ত। নৌকো বাইবার ঝকমারির মধ্যে নাগর আলি ভাই থাকত না। তার কাজ শুধু গান আর কেচ্ছাকথন। মাঝে মাঝে মোল্লার ধরতাই। সেসব কথা ভাবলে আজও বড় মোহময় মনে হয় জীবনকে। মনে হয়, অনেক মহান মানুষের জীবনের থেকেও আমার সেই সময়কার জীবন সার্থক। আমি হয়তো সেই সার্থকতার আনন্দের কথাগুলো সঠিকভাবে পরিবশেন করতে পারছি না, কিন্তু সে এক অনবদ্য জীবন আমি যাপন করেছি, যা সবার ভাগ্যে ঘটে না।

মাঝরাতে, মাছ ধরা শেষ হলে মোল্লা ঘাটে এসে নৌকো বেঁধে আমাদের বাড়ির দরজায় পৌঁছে দিয়ে তবে ফিরে যেত। এমনকি নাগর আলি ভাইয়ের সঙ্গে পাঠিয়েও সে ‘নিশ্চিন্দি’ থাকত না। বাবাকে ডেকে বলে যেত, লইয়া গেছেলাম, ফেরত দিয়া গেলাম। গোসা টোসা যা করবেন আমার ওপর। পোলার কোনো দোষ নাই। মাছ কাইল বেয়ানে দিয়া যামু, চিন্তা নাই।—এসব ব্যাপারে বাবা আমাকে কোনো দিন শাসন করেননি।

উনিশশ ঊনষাট কি ষাট সালের কোনো একটা সময়। যখন মার্শাল প্রেসিডেন্ট কায়েমি হয়ে তখতে এবং আমার ওই পিছারার খালের ক্ষীণ অবশিষ্ট গৃহস্থবাড়িগুলোর উচ্ছেদের জন্য যখন প্রাগুক্ত কায়দায় ডাকাতির দু-একটা ঘটনা ঘটে গেছে, আর মোল্লা তার প্রাক্তন সাগরেদদের নিয়ে এইসব ঘটনার প্রতিরোধে খবরদারি করতে শুরু করেছে, তখন একদিন সকালে ঘুম ভাঙার মুহূর্তে জানলাম গত রাতে মোল্লা খুন হয়েছে। তার লাশ পড়ে আছে বড় খালের কিনারে এক হোগলা ঝোপের মধ্যে। জায়গাটা দাদিআম্মা যে ছৈলাগাছের আড়াল থেকে ছাবি ফেলে চিংড়ি মাছ ধরতেন তার ঠিক উলটো পারে। মনে আছে আমাদের পিছারার খালের জগতের তাবৎ মনুষ্য সেখানে জমায়েত হয়েছিল তাকে শেষবারের মতো দেখার জন্যই হয়তো। অথবা গ্রামীণ জীবনের স্বাভাবিক কৌতূহলবশতই কি না আজ আর মনে নেই। শুধু মনে আছে, অসম্ভব রকমের ক্ষতবিক্ষত অবস্থায়, রক্তে, কাদায়, জলে মাখামাখি হয়ে মোল্লার দেহটি অসহায় পড়ে ছিল সেই হোগলা ঝোপের কিনারে সম্পূর্ণ উলঙ্গাবস্থায়। মানুষটা যখন গর্হিত জীবন যাপন করত, তার এরকম পরিণতি হয়নি। যদি হতো, তার একটা কার্যকারণ পাওয়া যেত। যখন সে সব আপত্তিকর, অসামাজিক কর্ম পরিত্যাগ করে বেশ কিছুকাল ধরে এক সুস্থ সামাজিক জীবন যাপনে মগ্ন, তখন তাকে খুন হতে হলো। বেশির ভাগ মানুষ জানতেই পারল না মোল্লা খুন হলো কেন? তবে আমি তো তা জেনেছিলাম।

বেশির ভাগ মানুষ না জানলেও আমি জেনেছিলাম এই হত্যার কার্যকারণ। কেননা এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিল আমার এক বাল্যবন্ধু, যার নাম অমল। বসু তাদের উপাধি। আমাদের পিছারার খালের ঠিক বিপরীতে তাদের গেরস্থালি। তাদের বাড়ি নয়, তার মামাবাড়ির গেরস্থালি ছিল সেটি। তার মা অল্প বয়সে তাকেই সম্বল করে বিধবা হয়ে তার বাবার বাড়িতেই স্থায়ী হলে ওটাই তাদের বাড়ি বলে আমরা জানতাম। সে যা হোক, অমল ছিল আমার সমবয়সি এবং বন্ধু। সে দেখে ফেলেছিল কীভাবে মোল্লা খুন হয়। সেদিন সে গঞ্জে গিয়েছিল তার মামার কাছে। মামা কাজ করতেন শক্তি ঔষধালয়ে। ফিরতে একটু রাত হয়ে গিয়েছিল। তবে আমরা ওরকম হামেশাই সেসব দিনে চলাফেরা করতাম। নদীর পারের রাস্তা ধরে আমাদের বড় খালের মুখ অবধি এসে, বাঁ হাতে রাস্তা নিতে হয় গ্রামে আসার সময়। আমাদের বড় খালটাও তখন বাঁহাতি। ডান দিকের দু-একটি গ্রাম পেরোলেই আমার দাদিআম্মার গ্রাম তারুলি। বাঁ হাতের সাঁকো বা ‘চার’ পেরোলেই নৈকাঠির হাট যার পেছনের গ্রামটির নামও নৈকাঠি। তারুলি গ্রামটা বেশ বড়। আমাদের গ্রাম এবং নৈকাঠির উলটোপারের গোটা এলাকাই প্রায় তারুলির মধ্যে পড়ে। অমল আসছিল তারুলির দিকের ডানহাতি রাস্তা ধরে। মেটে জ্যোৎস্নায় পরিচিত রাস্তায় চলতে অসুবিধা হয় না। কখনো কখনো মেঘ সরে গেলে কাছে-দূরের অনেকটাই পরিষ্কার দেখাও যায়। দাদিআম্মার বাড়ির সামনের ছৈলা ঝোপের কাছাকাছি এসে অমল ‘আল্লাহ’–বলে একটা আর্তনাদ শুনেছিল এবং স্বাভাবিক সতর্কতাবশত ছৈলা ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে পড়েছিল। সেখান থেকেই সে দেখতে পায় কয়েকজন মানুষ একটা ডিঙি নৌকোর মধ্যে একজনকে কুপিয়ে যাচ্ছে। আর্তনাদটা প্রথম আঘাতের পরই থেমে যায়। অমল দেখেছিল, ওই লোকগুলো, তারপর, চ্যাংদোলা করে দেহটা হোগলা ঝোপের মধ্যে ছুড়ে ফেলে ডিঙিটা তারুলির কিনারে ভিড়িয়ে উঁচুপারের ওপরে উঠে পড়ে। তারা চারদিক ভালো করে নজর করে নিশ্চিন্ত হয় যে, কেউ তাদের দেখেনি, তারপর ধীরে সুস্থে আবার নৌকোয় উঠে উত্তরমুখী চলতে থাকে। তখন ভাটার টান। নৌকোর গতি ধীর । খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে অমল যখন বাড়ির রাস্তা ধরে, তখন তার পা চলছে না। শরীর এবং অন্তরাত্মা ভয়ে আতঙ্কে হিম হয়ে আছে। ও দেখেছিল নৌকোয় যারা যাচ্ছে তাদের মধ্যে একজন তার চেনা। সে জব্বর। বাউলকান্দা গ্রামের একজন নামজাদা মানুষের মেজ ছেলে সে, যে মানুষটি পঞ্চাশ-একান্নর দাঙ্গার সময় এক হাজার দাঙ্গাবিরোধী ভলেন্টিয়ারের সরদার ছিলেন। জব্বার সেরকম মান্যবান ব্যক্তির পুত্র হয়েও ছিল একটা দুর্ধর্ষ ডাকাত, খুনি এবং লম্পট।

অমল পরের দিনই এ কথা বাবার কাছে বললে বাবা তাকে এবং আমাকে সাবধান করে দিয়ে বলেছিলেন, খবরদার এ কথা আর কাউরে কইও না। তোমরা কিন্তু কিছু দ্যাহ নায়, জানোও না। আমরা ভেবেছিলাম এ কথা শুনে বাবা হয়তো কিছু একটা করবেন। কিন্তু তাঁর কথা শুনে এবং পরিস্থিতির গুরুত্ব আঁচ করতে পেরে আমাদের বুকের রক্ত হিম হয়ে গিয়েছিল। বাবারা নিশ্চয়ই তখন অন্য কোনো বিভীষিকার পূর্বাভাস অনুমান করেছিলেন। আমরাও, তখন আমাদের যা বয়স, তদনুযায়ী আঁচ করতে পারছিলাম অনেক কিছুই। খেলার মাঠে, স্কুলে, মাছ ধরার সময় বা খালে ঝাঁপানোর মুহূর্তে নিশ্চয়ই আমরা টের পাচ্ছিলাম যে, সংখ্যাগুরুদের মধ্যে ক্ষমতাশালী গোষ্ঠীরা আমাদের অবাঞ্ছিত মনে করছে এবং এবারকার উচ্ছেদের ধরনধারণ, কৌশল আগেকার চাইতে আলাদা এবং এর প্রভাব পঞ্চাশ-একান্নর চাইতে অনেক বেশি স্থায়ী হবে। কারণ এবার সাধারণ বর্ণহিন্দু ছেড়ে নিম্নবর্ণীয় মানুষদের পালা, যারা পাকিস্তানকে স্বাগত জানিয়ে মুসলিম লিগকে সমর্থন করেছিল একসময়। উচ্চবর্ণীয় হিন্দু সমাজের শোষণ তথা জাতিবিদ্বেষের প্রকোপে পতিত নমঃশূদ্র ইত্যাদি তফসিলিজাতীয় মানুষেরা খুব স্বাভাবিক কারণেই হয়তো মুসলিম লিগের তৎকালীন আশ্বাসনে নিজেদের উদ্ধারের সম্ভাবনা দেখতে পেয়েছিল। কিন্তু একসময় সাম্প্রদায়িক ভিন্নতার বর্বর পশুটা সেইসব সম্ভাবনাকে তছনছ করে দিয়ে তার নখদন্ত ব্যাদান করে তাকে আক্রমণ করে বসল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *