কুড়ি
মিঞাদের স্কুলে পড়াশোনা করার ব্যাপারটা জ্যাঠামশাই আদৌ পছন্দ করলেন না। কিন্তু সংসারের কর্তা হিসেবে অন্য কোনো ব্যবস্থাও তিনি করেননি। বাবা আজীবন, দাদা যা করেন এমতো বিশ্বাসে আচ্ছন্ন। তাঁর ধারণা জ্যাঠামশাই অবশ্যই একটা অসাধ্যসাধন করবেন একসময়ে। কিন্তু তা আর কখনোই ঘটে না। যা ঘটে, তা নিতান্তই স্কুলস্বার্থের ব্যাপার। এ কারণে এ সময় যেসব ঘটনাগুলো ঘটতে থাকে, তা বাবার চিরপোষিত বিশ্বাসের ভিত থেকে একটি একটি করে ইট খসাতে থাকে। এবং তিনি ক্রমশ নিজেকে এক চোরাবালির ওপর অসহায় নিরালম্ব অবস্থায় আবিষ্কার করতে থাকেন। এরকম একটা সময়েই একদিন একটা থলেতে সের পাঁচেক চাল আমাদের ঘরের সামনে রেখে জ্যাঠামশাই বাবাকে বলেছিলেন, ‘আইজ থিকা আমরা পিথগান্ন অইলাম। আমার আর এতবড় সংসার টানবার মতো সামর্থ্য নাই।’ বাবার ক্ষেত্রে এই ধাক্কাটা ছিল চরম। তিনি কোনোক্রমে জিজ্ঞেস করেছিলেন : এই কি আমার সর্বশেষ প্রাপ্য। আমি তো স্টেটের অর্ধেক ভাগের মালিক আছিলাম। জ্যাঠামশাই একটু হেসে বললেন—এ কথা তো তোমারে আগেও কইছি। মাইয়াগো বিয়ায় সব শ্যাষ। এহন নিজেগো খাওন নিজেগোই রোজগার করণ লাগবে। দ্যাখলাই তো, বাসনপত্তরগুলাও বিক্কিরি শ্যাষ। তথাপি বাবা প্রশ্ন তুলেছিলেন, যদিও খুবই ক্ষীণভাবে, – সিন্দুকের চাবি কোথায়? আকবরি মোহর, গিনি, গয়নাপত্তর আর পুরান চান্দির টাকার থলিডা, হেসব কিছু আছে না নাই? জ্যাঠামশাই বলেছিলেন, তুমি কি খালি সপ্পন দ্যাহ? এতকাল এতবড় সংসারডা কীভাবে চালাইলাম, হ্যার খোজও লও নায় কোনো দিন। এহনও এইসব জিগাও? সিন্দুকের চাবি আছে, খুলইয়া দ্যাহ, কিছুই পাবা না। হেয়ার যা করার পিসিমায়ই করইয়া গেছেন, আমি সব জানিও না।
পরে জেনেছি, আমাদের বাড়ির মধ্যের ঘরের যেখানে বিশাল বর্মিসেগুনের সিংহপালঙ্কখানা পাতা ছিল, যার ওপর ঠাকুর্দামশাইয়ের গুরু, গুরুকল্প তথা গুরুভ্রাতাদের ফটো, ছবি এবং অন্য অনেক দেবদেবীর প্রতিকৃতিসমূহ ছিল, তারই পেছনে ছিল সিন্দুকটা।
তা একদিন সেই মরচে-পড়া সিন্দুক খোলা হয়। বাবা খুবই হতাশ হয়ে দেখলেন সেখানে খান দুই-তিন রুপোর বাসনপত্র ছাড়া আর কিছুই নেই। অথচ ওই সিন্দুকে নাকি বেশ কিছু আকবরি মোহর, গিনিসোনার বাসনপত্র এবং এ বাড়ির প্রাক্তন বধূদের গহনা ইত্যাদি ছিল, যার ওজন খুব কম করে হলেও বর্তমান হিসেবে দু-আড়াই কেজির মতো হবে। তার কিছুই সেখানে ছিল না তখন। এর পর বাবা ভেঙে পড়েন। কেননা এতটা বিশ্বাসভঙ্গের জন্য তিনি প্রস্তুত ছিলেন না বোধহয়। এই বিপুল সম্পদের কোনো হিসেবই বাবা পাননি। যেমন খাসজমির হিসেব পাননি, যেমন তালুকদারি থাকাকালীন খাজনা আদায় উশুলের হিসেব পাননি, তেমনই এই এজমালি সম্পদের হিসেবও পাননি। কিন্তু আশ্চর্য এই, তথাপি তিনি তাঁর জ্যেষ্ঠের ওপর সম্পূর্ণ বিশ্বাস কোনো দিনই হারাননি, যদিও এই জ্যেষ্ঠ তাঁর সহোদর নন, খুড়তুতো জ্যেষ্ঠ। এ বিষয়ে আর অধিক কথন করব না। আমি একটা সময় এই স্টেটের নগদ টাকা এবং অলংকারগুলোর সর্বশেষ পরিণতি জেনেছিলাম।
কিন্তু এইসব পারিবারিক তথা ব্যক্তিগত তথ্যাদির জন্য এ আলেখ্য রচনা করতে বসিনি। এ সূত্রে শুধু এটুকুই সারকথা যে, মিঞাদের স্কুলে আমার পড়াশোনা করার ব্যাপারে জ্যাঠামশাইয়ের যতই আপত্তি তথা বিদ্বেষ থাকুক, পেটের ভাত জোটাতে তাঁরা দুভাই-ই একসময় এরকম সব স্কুলেই শিক্ষকতা অবলম্বন করেন। তখন আমাদের অঞ্চলে চরম শিক্ষকাভাব। কারণ পেশাগতভাবে যাঁরা শিক্ষকতা করতেন, তাঁদের অধিকাংশই দেশছাড়া। মুসলমান সমাজে উপযুক্ত শিক্ষকের উপস্থিতি তখনও আদৌ নেই বললেই চলে। সেখানে আরবি-উর্দু পড়ানোর জন্য তালেব এলেমধারী কিছু শিক্ষক হয়তো আছেন। কিন্তু অন্যান্য বিষয়ে পড়ানোর মতো শিক্ষকের প্রকৃতই অসদ্ভাব। আমার বাবা-জ্যাঠামশাই বা তাঁদের পর্যায়ের মানুষেরা যে স্কুলে ছাত্র পড়ানোর বিষয়ে খুব একটা আদর্শ শিক্ষক, এমন নয়। কেননা তাঁদের কিছু ডিগ্রি থাকলেও শিক্ষকতা কোনোকালেই তাঁদের কৃৎকর্ম ছিল না। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল যে, তাঁদের ওই ডিগ্রিটাই একটা শর্ত হয়ে দাঁড়াল। অতএব এঁরা দুই ভাই-ই শিক্ষকতাকে পেশা করলেন, তখন অবশ্য জ্যাঠামশাই ‘মিঞাগো ইস্কুলে পড়ামু না’ এমতো বায়না ধরলেন না, যে বায়নাটা আমার ক্ষেত্রে ‘মিঞাগো ইস্কুলে পড়ার’ বিষয়ে তাঁর ছিল। কেননা এখানে তাঁর মবলগ দুপয়সা রোজগারপাতি হওয়ার নির্বন্ধ ছিল।
বাবা কিছুদিন পাশের মুসলমান গ্রামটিতে একটি মাইনর স্কুলের শিক্ষক হন। মাইনে তিরিশ টাকা। এই স্কুল বাবার কিছু গুণমুগ্ধ বন্ধুস্থানীয় ব্যক্তিরা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। স্কুল ব্যাপারটি এ ক্ষেত্রে গৌণ। মুখ্য উদ্দেশ্য বাবার তৎকালীন অবস্থায় কিছু সহায়তা করা। এরকম স্কুল ওই সময়ে আমাদের ওখানে সাধারণত ফসল কাটার পর হামেশা গজিয়ে উঠত এবং মাস দু-তিন চলার পর চাষের সময় ঘনিয়ে এলে আবার বন্ধ হয়ে যেত। এ ক্ষেত্রেও তাই-ই ঘটল এবং বাবা পুনরায় অজগর বৃত্তি অবলম্বন করে পালঙ্কের ওপর নিশ্চল হলেন। আমি তখন ওই ‘মিঞাদেরই’ স্কুলে ক্লাস এইটে পড়ি। অবসর কাটে ছাত্র পড়িয়ে। আমার ছাত্র পড়ানোর ইতিহাস নিজের ছাত্র হওয়ার থেকেও প্রাচীন। ছাত্র হওয়ার আগেই আমি শিক্ষকতাকে পেশা করতে বাধ্য হয়েছিলাম। এই সময়টায় আমাদের পারিবারিক অবস্থা বড় করুণ ছিল। আমি আর আমার পরের নাবালক ভাইটা, ছোটন, তখন অক্লান্ত পরিশ্রম করতাম। কখনো এক আনা, দুআনা রোজে অন্য গ্রামে গিয়ে মজুর খাটতাম, যেখানে কেউ আমাদের চেনে না। কখনো নিজেদের বাড়ির নারকোল, সুপুরি বা এটা-ওটা কুড়িয়ে হাটে-বাজারে বিক্রি করে সংসারের চাহিদা মেটাতাম। আশ্বিন-কার্তিক মাসে সুপুরি কুড়োনো আমাদের ওখানে একটা অর্থকরী কাজ ছিল। গ্রামের বেশ কিছু লোক সুপুরির রাখি করত। কখনো তাদের কাছে, কখনো-বা হাটে কুড়োনো সুপুরি বা নিজেদের গাছ থেকেই চুরি করে বিক্রি করে চাল, ডাল, তরকারির সংস্থান করতাম আমরা। এই কাজগুলো ছিল নিতান্ত নিম্নবিত্তদের আর্থিক কাজ। আমি আর ছোটন ভোররাতে কেউ জাগার আগেই সুপুরি, নারকোল, তাল এইসব কুড়োতে বেরিয়ে পড়তাম। রাতে সুপুরি বাগিচাগুলোতে বাদুড়েরা পাকা সুপুরির রস খেতে বসত। তাদের কল্যাণেই ভোরবেলা ওইসব বাদুড়ে চোষা সুপুরিগুলো বাগিচার তলা থেকে আমরা কুড়িয়ে নিতে পারতাম। এগুলো ছাতের ওপর শুকিয়ে নিয়ে বস্তা ভরে রেখে দিতাম। গাছের তলায় যথেষ্ট না পেলেই আমরা গাছে উঠে চুরি করতাম। অবশ্য নিজেদের গাছের ফল এভাবে গ্রহণ করাকে চুরি করা বলে কি না, সে নিয়ে বিতর্ক হতে পারে, তবে জ্যাঠামশাই এই কাজকে চুরিই বলতেন এবং সে অর্থে আমি আর ছোটন ওই বয়সেই বেশ পাকা চোর হয়ে উঠেছিলাম। সুপুরি আমাদের অন্ন জোগাত, আর তাল নারকোলের ব্যবহার ছিল অন্য। সুপুরির মূল্যে যা চাল ডাল আসত, তার ঘাটতি মেটাতে গুড়, তাল এবং নারকোল সহযোগে মা যে চমৎকার তালক্ষীরটি বানাতেন, তা হজমে কষ্টসাধ্য হলেও পেটে থাকত অষ্টপ্রহর। পেট ভরানোর জন্য এমতো আহার্য দক্ষিণ পূর্ববঙ্গে আর খুব বেশি একটা ছিল না। যে ‘ছাতার হুডুম’ পশ্চিমবঙ্গে এসে মুড়ি হয়েছে, সেই মুড়ির অনুষঙ্গ হিসেবে এই তালক্ষীর যে কী পর্যন্ত অগ্নিমান্দ্যের সহায়ক, তা ভোক্তারা ছাড়া আর কেউ কোনো দিন জানবে বলে বোধ হয় না। কারও সন্দেহ থাকলে সাতসকালে এক থালা এবং বিকেল পাঁচটায় এক থালা, একটু জোগাড়যন্ত্র করে খেয়ে দেখতে পারেন। এ যেন খিদেয় পাপ, পাপে অম্বল এবং অম্বলে স্বস্তি।
আমাদের ওখানে শ্রাবণ-ভাদ্দর দুই মাস অভাবের কাল ছিল সেসব দিনে। চাষিরা, জেলেরা বা খেটেখাওয়া মানুষেরা বলত—শাওন টোটা, ভাদর টোটা। টোটার কালে সবার পেটেই চোঁচা। ‘কাম কাজ নাই, তাই পেটেও দানা নাই। ‘ তখন ‘হুডুম’ আর ‘তালক্ষীরের’ কদর। কদর আরও অনেক কিছুর, যেমন শাকের মধ্যে বনজ মালঞ্চ শাক, গুড়িকচুর শাক (বিজয়া দশমীর পরে হলে, মা দুগ্গা নাকি তার মধ্যে ‘ঘেরতো’ অর্থাৎ ঘৃত ঢেলে দিয়ে যান)। কলমি শাক, পাটপাতা ‘চাটকাটা’ শাক, শাপলা, ছাঁচি কুমড়োর শাক এবং আরও অনন্ত শাকের নাম করা যায়, যারা শুধু একটু নুন সহযোগে সিদ্ধ হয়ে পেটে যাবে। তরকারি বলতে তখন সাদা রঙের মিষ্টি আলু (পাঠক বিস্মরণ হননি, দ্রব্যটি আমাদের দক্ষিণের মহাল থেকে একসময় প্রচুর আসত), গিমি কুমড়ো (আগের বন্ধনীতে যা বলা হলো, প্রযোজ্য), ‘র্যাহা’ অর্থাৎ রেখা বা চিচিঙ্গা, যা উচ্চবর্ণীয় বিধবারা খেতেন না, কারণ শাস্ত্রোক্ত নাম গোশৃঙ্গ, ঝিঙ্গা, বিশালাকার শসা (অধুনাকার কচি, ছাল ছাড়িয়ে নুন মাখিয়ে ট্রেনে যেতে যেতে খাওয়ার শসা নয়) এবং পেঁপে বা ‘পোম্বা’। তখন অন্ন বলতে মোটা লাল আউশ চাল, জয়না চাল এবং খেসারির ডাল, তাও যাদের জুটত। না জুটলে প্রাতরাশে তালক্ষীর হুড়ুম, ডিনারেও। দুপুরের খাওয়ায় ভাতের অনুপস্থিতি হলেই আমরা খুব বিষণ্ন হতাম। নাই ঘরে খাই বেশি। ফলে সারাক্ষণই যেন ক্ষুধার্ত থাকতাম। কিন্তু সেটা মানসিক খিদে। প্রাতরাশের হুড়ুম আর তালক্ষীর হজম হতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল। তালক্ষীরখেকোদের একটা বিশেষ ধরনের অম্বল হতো যার ফলে দুপুরের খাওয়ার প্রায় প্রয়োজনই থাকত না। তবে ওই যে বললাম, মানসিক খিদে, সেটা গরম ভাতের গন্ধে আপ্লুত না হলে মিটত না। কিন্তু তাল কিছু বচ্ছরকালের ফল নয়। তার ঋতুকাল নির্দিষ্ট। সুতরাং অন্য ঋতুতে কাঁচাপাকা বেলও বেশি ক্ষুধানাশকারী। এসব দ্রব্যের অসদ্ভাব ঘটলে লাউয়ের সময় লাউ, কুমড়োর সময় কুমড়ো ইত্যাদি নুন সহযোগে সিদ্ধ হয়ে অন্নের বিকল্প। এ একেবারে শাস্ত্রবাক্যের আক্ষরিক প্রয়োগ, জীব দিয়েছেন যিনি আহার দেবেন তিনি। তা অবশ্য বনে-জঙ্গলে, আগানে-বাগানে নানান আহারের বন্দোবস্ত তিনি করে রেখেছেন। তোলো আর খাও। আমাদের ওই বয়সটা ছিল প্রায় মানবসমাজের শৈশবকালের ‘ফুড গ্যাদারার্স দের সমধর্মী। শজারু শিকার করো, ডাহুক, পায়রা, হরিয়াল, বক ইত্যাকার প্রাণীদের ধরো আর খাও। বিলক্ষণ পুষ্টিকর প্রোটিন। এ ছাড়া ‘দুর’, ‘কাডউয়া’, ‘কাছিম’-এর মাংসও স্বাদে গন্ধে দেবভোগ্য প্রায়। তবে তার সংস্থান করা খুব একটা সহজ কর্ম নয়। এ ছাড়া আছে ফলপাকড়া। যদিও স্বাদে তা হয় টক, নয় ‘কষ্টা’। সুমিষ্ট ফল বনবাদাড়ে বড় একটা হয় না। কিন্তু টক বা কষ্টা বলে কি আমরা তার ব্যবহার করতাম না? অধুনাকার গ্রামগাঁয়ের ছেলেমেয়েরাও অত সব ফলের নাম বলতে পারবে না। কাঁটাবহরী বা বৈঁচি, ‘আমজাম’ নামে ছোট ছোট মেরুন রঙের এক ধরনের ফল, গাব, কাউ, ডৌয়া, কামরাঙা, করমচা, তেঁতুল, চুকইর, পায়লা, ফলসা, ঢ্যাফল, বিলিতি গাব, আঁশফল, বেতফল, জামরুল, বাতাবি লেবু বা ‘জম্বুরা’ এবং এরকম অজস্র ফল আমরা খেতাম।
এতসব দ্রব্য থাকা সত্ত্বেও মাঝে মাঝেই উপোস দিতে হতো। বর্ষাকালে আমাদের ওই অঞ্চল প্রায় গোটা পৃথিবী থেকেই যেন বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত। মাঠঘাট, পুকুর, নদী, বিল সব জলে একাকার থইথই। যাতায়াত করা দুঃসাধ্য। এবাড়ি ওবাড়ি বা বাজার-হাট করতে যাওয়ার উপায় একমাত্র কলার ভুরা বা সুপুরি গাছের ডিঙি। একবার বৃষ্টি নামল তো দিনের পর দিন ঝরেই যেত সমানে। আগান-বাগানের ছাইছাতা কুড়িয়ে আনার তো প্রশ্নই ওঠে না তখন। এই সময়টায় চালের অভাবটাও প্রকট হতো। কেউ ধারকর্জও দিতে চাইত না। আমাদের একসময়কার খানাবাড়ির ধোপা, নাপিত প্রজাদের অবস্থা তখন আমাদের তুলনায় ঢের ভালো। পেটের তাড়নায় তাদের কাছেও চাল ধার করতে যেতে হতো। ব্যাপারটা এতই গ্লানিকর ছিল যে, তার চাইতে মরে যাওয়াও শ্রেয় মনে হতো। তারা ধার হয়তো দিত, কিন্তু বড় অকরুণ ব্যবহার করত। তার সম্যক কারণও যে ছিল না, তা নয়। ধার শোধ করার সংগতি প্রায়শই হয়ে উঠত না। এ অবস্থায় নিত্য ধার আর কে দেয়? বাইরের দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া এবং ভেতরে অন্নাভাবের তাড়নায় কী বিষণ্ণই যে লাগত তখন। মনে হতো, পৃথিবীতে আমাদের করুণা করার জন্য কেউ নেই। আমি অন্তত পরপর তিন দিন কোনো অন্নজাতীয় খাদ্য না খেয়ে স্কুলে গিয়েছি। এতে আমার খুব একটা কষ্ট হতো না। যদিও দাদিআম্মার বাড়িতে নিজের পেটের অন্ন জোটানো আমার পক্ষে আদৌ কঠিন ছিল না, কিন্তু বাড়িতে অভুক্তপ্রায় ভাইবোনগুলোর কথা ভেবে নিজের পেট ভরাবার কথা ভাবতে পারতাম না। ওরা তখন এত ছোট যে, সংসারের অবস্থার বিষয় কোনো কাণ্ডজ্ঞানও ওদের হওয়ার বয়স হয়নি তখনও।
এই সময়টার অভিজ্ঞতা আমার এবং ছোটনের জীবনের চরমতম অভিজ্ঞতা। তখন অভাব কী আর তার মোকাবিলা করার কত ফিকির আছে অথবা বেঁচে থাকা আর বাঁচিয়ে রাখার যুদ্ধ কাকে বলে, তা একেবারে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলাম। বাড়িতে আমাদের অংশে আমরা বাবা-মাসহ নজন প্রাণী। তাদের সবার অন্ন, বস্ত্র এবং জ্বালানির প্রয়োজন আমাকে আর ছোটনকে বহন করতে হতো তখন। বাবা ওই মাস দু-তিনের মাস্টারি করে যে বসে গেলেন, তারপর আর কিছু কাজকর্ম জোটাতে পারছিলেন না। সে সময় কখনো কখনো গাছপালা বিক্রি করে বা বাড়ির গোয়ালঘর, ঢেঁকিঘর বা গোলাঘরের টিন, কাঠ, তক্তা এইসব বিক্রি করে জ্যাঠামশাই কিছু টাকাপয়সা দিলে তা দিয়ে কিছুদিন চলত। কিন্তু নিয়মিত রোজগারের ধান্দা আমাকে আর ছোটনকেই করতে হতো। জ্যাঠামশাইয়ের সংসার ছোট, তা ছাড়া তিনি একটি স্কুলের হেডমাস্টারি পেয়ে গিয়েছিলেন বলে তাঁদের বিশেষ অসচ্ছলতা ছিল না। তাঁর রোজগারপাতির অন্যবিধ ফিকিরও ছিল। বাবা স্বভাবতই কর্মবিমুখ ছিলেন, আর গ্রামীণ ধান্দাবাজির ফন্দিফিকিরও তাঁর জানা ছিল না। যে সময়টার কথা বলছি, তখন একটা প্রকাণ্ড নৈরাশ্য তাঁকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল।
আমাদের অঞ্চলের যেসব পরিবার আমাদের সমশ্রেণির, তাদের সবার অবস্থাই কমবেশি আমাদের মতোই ছিল। তাদের তক্ষুনি পশ্চিমবঙ্গে চলে যাবার মতো মানসিক বা আর্থিক প্রস্তুতি ছিল না। অথচ ওখানে বিগতকালে তারা যে আর্থব্যবস্থাপনায় গৃহস্থ ছিল, সেই ব্যবস্থাটিও সম্পূর্ণত বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিল। এরা অধিকাংশই ছিল মধ্যস্বত্বের বিভিন্ন স্তরের মানুষ, মূলত ভূমিনির্ভর, তৎসহ কিছু অনুষঙ্গিক পেশা। মধ্যস্বত্ব লোপ আইন জারি হলে এই পরিকাঠামোটি পুরোপুরি ভেঙে পড়েছিল। যাঁরা শিক্ষকতা করতেন, তাঁরা কর্মহীন হলেন, কারণ স্কুলগুলো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। যাঁরা চিকিৎসক ছিলেন, তাঁদের বাঁধা রোগীপত্তরেরা দেশত্যাগ করে চলে গেছে। সাধারণ হিন্দু-মুসলমান যারা রোগী হিসেবে আছে, তাদের পয়সা খরচ করে চিকিৎসা করানোর সংগতি নেই। যেসব পরিবার একান্নবর্তী ছিল, যাদের প্রধান উপার্জনক্ষম ব্যক্তিরা, যারা উকিল, মোক্তার, পেশকার, সেরেস্তাদার বা ডাক্তার ছিল, তারা এখন নিঃসম্বল। কেননা তদানীন্তন রীতি অনুযায়ী এইসব সংসার চলত বিশেষের আয়ে অশেষের পোষণ এই পদ্ধতিতে। বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এইসব আয়কারী ব্যক্তিরা নিজ নিজ স্ত্রী-পুত্রসহ পশ্চিমবঙ্গে পাড়ি দিলে পোষ্যবর্গ শুধু সামান্য জমি এবং বাড়িটিই অবলম্বন করে থেকে যায়। তারা কোনো দিনই উপার্জনের জন্য মস্তিষ্কের চর্চা করার কথা ভাবেনি, ভাবার প্রয়োজনও ছিল না। এখন অকস্মাৎ উপোসের মুখে পড়ে প্রথমেই সহজ রাস্তা গ্রহণ করেছিল তারা। প্রথমে জমিটুকু বিক্রি হয়ে যায়, তারপর ভিটে এবং ঘরবাড়ি। এর পরের চিত্র আরও করুণ। গ্রামের পরিত্যক্ত কোনো দালানবাড়ির ছাতের নিচে থেকে উজ্জীবন যাপন। এই শ্রেণির মানুষেরা যে কী পর্যন্ত হতভাগ্য জীবনযাপন করেছে, খুব কম লোকই তা জানে। মানুষ শুধু এদের পরাশ্রয়ী, পরান্নপালিত অকর্মণ হিসেবেই জেনেছে। কিন্তু যে সমাজ একদিন তাদের নিজস্ব প্রয়োজনেই সৃষ্টি করেছিল, যে সমাজ তার সচ্ছলতার দিনে এইসব মানুষগুলোর পরিষেবা, উৎসবে, শ্মশানে, রাষ্ট্রবিপ্লবকালে এবং গ্রামীণজগতের নিরন্তর একঘেয়েমি দূর করার জন্য বিনামূল্যে গ্রহণ করেছে, সেই সমাজ এদের নির্মমভাবে শুধু ভাগ্যের হাতে ছুড়ে দিয়ে দায়মুক্ত হলো। তাদের এই করুণ পরিণতি জন্য কেউ একটা দীর্ঘনিঃশ্বাসও পরিত্যাগ করল না। দেশভাগের অব্যবহিত পরবর্তী দাঙ্গা ইত্যাদি কারণে যারা দেশত্যাগে বাধ্য হয়ে বিভিন্ন ক্যাম্পে উদ্বাস্তু আশ্রয়ে হাজারও লাঞ্ছনা ভোগ করেছেন, তাঁরা ব্যাপক মানুষের সহানুভূতি, সহায়তা ইত্যাদি প্রাপ্ত হয়ে একটা সময়ে অন্তত মাথার ওপর টালি বা টিনের ছাউনি এবং পায়ের তলায় একটু মাটি পেয়েছেন। কিন্তু যাদের কথা বলছি, তারা কিছুই পায়নি, এমনকি মানুষের স্বাভাবিক সহানুভূতিটুকুও নয়। আমি নিজের এই সামান্য জীবনের অভিজ্ঞতায়ই এদের বেশির ভাগকে ভিক্ষেজীবী হিসেবে প্রত্যক্ষ করেছি। তাদের এই সময়কার হতাশার বীজে উদ্ভূত সন্তানদের চোর, ডাকাত অথবা উঞ্ছবৃত্তিধারী হতে দেখেছি। অথচ তাদের এরকম জীবনযাপন করার কথা ছিল না। তাদের পুনর্বাসন কীভাবে হলে ভালো হতো জানি না, তবে কোনোরকম পুনর্বাসনই তো তাদের হয়নি। ঠিক অনুরূপভাবেই পুনর্বাসন হয়নি সেইসব মানুষদের, যারা মধ্যস্বত্বভোগী ভদ্র হিন্দু গেরস্তদের একদার সমাজবিন্যাসে এই গ্রামীণ বিশ্বে নট্ট, মালি, ভুঁইমালী, পুরোহিত, কুমোর, মিরধা, পাঁঠা সরকার, ‘বউরূপী’ এবং অনুরূপ অসংখ্য পেশাধারী ছোট গোষ্ঠীয়। তারা তাদের পেশাগত কর্ম ছাড়া রাষ্ট্রব্যবস্থায় একমাত্র ধোপা, নাপিত, কামার, তাঁতি এবং জেলে নিকিরিরা ছাড়া এদের সবার অন্নই বন্ধ হয়ে গেল। এরা কোনোকালেই খুব একটা জমিনির্ভর ছিল না। মধ্যস্বত্বভোগীদের ক্রিয়াকর্ম যজ্ঞাদিতে এটা ওটা করা তথা জাত ব্যবসাকেই অবলম্বন করে তাদের ভবনদী পরিক্রমা। তা হয়তো প্রয়োজনানুগ ছিল না। কিন্তু নির্দিষ্ট একটা আয়ের পথ তো সেটা ছিল। দেশভাগকারী, মধ্যস্বত্বলোপকারী নেতৃবর্গ এই সামাজিক পরিকাঠামোটিকে আদৌ পরিবর্তন না করে স্থিতাবস্থাটাকে ভেঙে দিলেন। এদের কারও কথাই ভাবলেন না তাঁরা।
রচনার শুরুতে আমাদের নগেন ডাক্তারমশাইয়ের নিজের হাতে তৈরি যে ডাক্তারজ্যাঠার কথা বলেছি, তাঁর পরিণতির কথাটিই উদাহরণ হিসেবে বলি। আমাদের বাড়ির সরাসরি পুবদিকের বড় খালটির সঙ্গে যে লোহার ব্রিজটি আমাদের গাঁয়ে ঢোকার একমাত্র সংযোগ, তার ওপর একদিন আনমনা দাঁড়িয়েছিলাম। তখন দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল। এই সময় ডাক্তারজ্যাঠার সঙ্গে দেখা। অনেক দিন যোগাযোগ নেই। শুনেছিলাম খুবই দুস্থ অবস্থায় আছেন। কিন্তু তাঁকে যে অবস্থায় সেদিন দেখলাম, অতটার জন্য তৈরি ছিলাম না। তিনি তখন খালের পুবপারের মুসলমানদের গ্রামগুলোয় ভিক্ষে করে ফিরছেন। পরনে শতচ্ছিন্ন একটি পিরান আর লুঙ্গি। চেহারা দুর্ভিক্ষপীড়িত। মুখে খোঁচা খোঁচা সাদা দাড়ি। কাঁধে একটি কাঁথার থলি। ডাক্তারবাবু ভিক্ষে করে ফিরছেন। আমার দিকে তাকিয়ে একটু ম্লান হেসে শুধু বললেন, ‘ধরা পড়ইয়া গেলাম। আমি যে আইজ-কাইল ভিক্ষা করি, হেয়া এখনও গেরামে কেউ জানে না। তুমি দেইখ্যা ফ্যালাইলা। ক্যাওরে কও বোচন? বেয়াকে জানে আমি চিকিচ্ছা করতে যাই।’ বলে থলের মুখটা খুলে দেখালেন, বললেন, ‘এই দ্যাহ আমার ভিজিটের পয়সা।’ থলের মধ্যে কিছু খুদ মেলানো চাল, তাও বিভিন্ন জাতির এবং খেসারি, মুসুরি ইত্যাদি ডাল। সব মিলেমিশে সে এক করুণ ছবি। ডাক্তারজ্যাঠা বললেন, ‘প্যাডে অনন্ত খিদা, বোজলা? মনে অয় এই ব্রেহ্মাণ্ডডারে যদি একপাশ দিয়া কামড়াইয়া খাইতে শুরু করি, তয় হয়তো খ্যানেক তৃপ্তি পামু।’ আমার দুচোখ ফেটে জল পড়ছিল। এই মানুষটিকেই না আমি একসময় দোর্দণ্ডপ্রতাপ একজন পেট্রিয়ার্ক হিসেবে দেখেছি, যাঁর অসামান্য হাতযশ ছিল ডাক্তার হিসেবে এবং যিনি অতবড় একটা পরিবারকে স্বচ্ছন্দে পালন করতেন। এরকম আরও অনেককেই আমি দেখেছি। কিন্তু তাঁরা সবাই হারিয়ে গেছেন। মরে হেজে মাটিতে মিশে গেছেন।
আমার বয়স তখন তেরো, ছোটনের এগারো। ওই বয়সেই আমরা দুজনায় ‘দা’, কুড়ুল, খন্তা, কাস্তের ব্যবহার শিখে গিয়েছিলাম। এসব যন্ত্রের ব্যবহার শিখে নেয়া কিছু দোষের নয়। তবে আমরা যে পুরুষানুক্রমে অন্য ধাচে গড়ে উঠেছি, সেখানে যে এইসব যন্ত্রপাতির ব্যবহার একসময় হারাম হয়ে গিয়েছিল, তাই না এই দুর্ভোগ। কিন্তু সেসবের হারাম হওয়ার জন্য আমি বা ছোটন কি ব্যক্তিগতভাবে দায়ী? দেশভাগ হয়ে স্বাধীনতা এসেছে। সেই থেকে গৃহহীন হতে শুরু হয়েছে কোটি কোটি মানুষ। তারা বিদেশবিভুঁইয়ে কাঁহা কাঁহা মুলুকে গিয়ে আশ্রয়প্রার্থী হয়েছে তার ঠিকানা নেই। তারা সবাই ঠিকানা হারিয়ে ফেলেছে। আবার আমাদের মতো যারা, তারা ঠিকানায় থেকেও পরবাসী হয়ে উজীবনে বেঁচে থাকতে চেষ্টা পাচ্ছে প্রাণ হাতে নিয়ে। সে প্রাণ যেন যে কোনো সময় তাদের একদার বন্ধু অথচ আজকের শত্রুদের হাতে তুলে দিতে বাধ্য। স্বাধীনতার দাম কি এর চাইতে অধিক? এইসব মানুষের অর্থাৎ আমরা যারা তখন এই পরিবস্থায় নিরুপায় হয়ে নিরাপত্তা খুঁজি, তাদের কাছে এই স্বাধীনতার কীই-বা অর্থ!
বস্তুত আমাদের ওই পিছারার খালের সোঁতার আশপাশের গাঁও গ্রামগুলোতে স্বাধীনতা একটা তাৎক্ষণিক উৎসবমাত্রই ছিল। তার অন্য কোনো প্রেক্ষিত সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্তদের মধ্যে আমি জ্ঞানত দেখিনি। গ্রামীণ প্রেক্ষাপটে হয়তো ব্যাপারটা এরকমই হয়। শহরে-নগরে ব্যাপারটা আলাদা। তার রূপকল্প এই স্বাধীনতার প্রায় কুড়ি বছর পরে এক বন্ধুর লেখা একটা কবিতায় দেখেছিলাম—যার শিরোনাম “না”।
ক্লান্ত চোখে ক্লান্ত চোখের পাতা
তারও চেয়ে ক্লান্ত আমার পা
যেথায় দেখি সাধের আসন পাতা
‘একটু বসি’ জবাব আসে, “না”।
-আখতারুজ্জামান ইলিয়াস
এই প্রতিজ্ঞায় আমার পিছারার খালের জগতেরও। কিন্তু তার প্রকাশভঙ্গি আলাদা। সেখানের কবি তখন হাটের কিনারে তার পুথি বিক্রি করে ওই পুথিরই পদ গেয়ে-
শোনেন শোনেন আছেন যত হিন্দু মুছলমান
নেক নেক্কর ইমানদারির হইল অবসান।
বন্ধুর ঘরে বন্ধুর আর বওয়ার দলুজ নাই,
হিন্দু মোছলেম জুদা অইল আখেরে সবাই।
হাটুরে লোকেরা এইসব বই কিনে নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে গাইতে গাইতে ফেরে। কিন্তু তাতে গোটা দেশের বিবেক চৈতন্যে কিছুই স্পন্দন জাগে না। শুধু যারা গান বাঁধে আর যারা তার গ্রাহক তারাই বিষণ্ণ হয়, ধ্বস্ত হয়।
সে সময় আমাদের বাড়ির রাখাল নাগর আলি মাঝে মাঝেই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠত আর গালাগালি দিত। কাকে কে জানে? আজাদির ‘মা-মাসি’ করত লোকটা। বলত, ‘বালের আজাদি। প্যাডে নাই ভাত, ল্যাঙ্গে নাই কাপড়, মোরা স্বাদীন দ্যাশের নাগর।’ তখনকার পরিবস্থায় কথাগুলো আমাদের কাছে আদৌ মিথ্যে বোধ হতো না। নাগর আলি ভাই আমাকে ‘ন্যাভাই’ বলে ডাকত। ওটা আমাদের ওখানকার সাধারণ মুসলমানদের একটা আদরের ডাক। গান বাঁধতে পারত নাগর আলি। আর তার ‘খামার’ ছিল বড় চোস্ত। সে রাগলেও খামার দিত, খুশি হলেও। জাত রাখাল। আমাদের ওখানকার এক বনেদি পরিবার চাটুজ্জেবাড়িতে তার শৈশব-কৈশোর এবং প্রথম যৌবন কাটে। সে সময়কার গল্প বলত সে। সে বাড়িতে ছিল অনেক উঠতি বয়সি মেয়ে। তাদের শরীর-স্বাস্থ্যের ব্যাপক বর্ণনা দেয়া তার একটা অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। আমরাও তাকে ন্যাভাই ডাকতাম। নাগর আলির বিয়েথা হয়নি। যখন সে চাটুজ্জেবাড়ির মেয়েদের গল্প আমাদের শোনাত, তখন তার দাড়ি চুল সাদা। কিন্তু বাক্যবচন রসবর্ষী। বয়সের দোহাই দিয়ে সে বেমক্কা ভারভারিক্কি কথা গল্প করত না। ফলে আমরা ছিলাম তার অসম্ভব ন্যাওটা। লোকটা একটু খ্যাপাটে হলেও বড় ভালো মানুষ ছিল। যখন-তখন গান গাইত, যা তার নিজেরই বাঁধা পদ। তার নমুনা আরও কিছু বলি—
সাগরালির ভাই নাগরালি কয়
হোনো মোর বচন।
পরানের দুঃকেরও কতা করি নিবেদন।
সুন্দার সুন্দার ছেমরিগুলান
সহালে দুফরে
কী চোমোৎকার খেলা করত
বড় দিঘির পারে। আহা,
সেই দিঘিতে পানি নাই
নোলখাগড়ার বোন
সেই বোনেতে বসত করেন ব্যাগ্র মহাজন।
হে কারণে দিঘির মাঝে গতায়তি নাই।
পশ্চিমপারের বোনে যাইয়া
পলাপলি খেলাই—
তো নাগর আলি দিঘির পশ্চিমপারের বনে গিয়ে তাদের সঙ্গে ‘পলাপলি’ বা লুকোচুরি খেলত। আজ আর সেরকম লুকোচুরি এইসব গ্রামের ছেলেমেয়েরা খেলে না। কেননা নাগর আলি নিজেই একসময় এই খেলার অহিতাচার দেখেছে। একটা সময় যখন সবকিছু সমে ছিল, তখন এই পলাপলি খেলায় কোনো দোষ আশ্রয় করেনি। কিন্তু নাগর আলি দেখেছিল যে, পাকিস্তান প্রাপ্তির পর এই খেলা তার সহজতা হারিয়ে ফেলছিল। যখন থেকে গ্রামগুলো শূন্য হচ্ছিল আর মানুষের মনে বিভীষিকার সঞ্চার হচ্ছিল, তখন থেকেই এইসব খেলার মধ্যে কদর্যতার স্ফুরণ দেখা যাচ্ছিল। আমাদের এই সুন্দর গ্রামীণ জীবনের সরল, নিষ্পাপ কৈশোর এক হতাশার আবর্তে তাৎক্ষণিক সুখভোগের কদর্যতায় ডুবে যাচ্ছিল। নাগর আলির গানে এই পরিবর্তন ধরা পড়েছে। অবশ্য আমরা যখন তার কাছ থেকে এসব কাহিনি কীর্তন শুনি, তখন এর তাৎপর্য না বুঝে শুধু যৌনতার আনন্দেই তা আস্বাদ করেছি। পরে বুঝেছি ওই রাখালের গান বড় ব্যথার। সে গাইত—
আহা, অবশেষে আজাদ আইল
হইল পাকিস্তান।
মোরা বেয়াক জুদা অইলাম
মুশকিলের আসান।
হিন্দু হিন্দুস্থান পাইল
মোসলেম পাক জমিন
(তমো,) খুনের মইদ্যে রইয়া গেল
আঘারউয়া বদ জিন।
হেই জিনের বদ খাইসলতে মোরা
কী-বা পাইলাম মন
হিন্দু মুছলমান হইলাম
জিন্দিগির দুশমন
নাগর আলির অক্ষরজ্ঞান ছিল, কিছু পুথিপত্তরও পড়া ছিল তার। এ কারণে তার এই রচনাশৈলী জায়েজ। কেউ হয়তো প্রশ্ন করতেই পারেন, একজন জাত-রাখাল এই পদ ক্যামনে বানায়? তো বলি, হ্যাঁ, এরাই বানায় বলে আমরা জানি এবং বানাই। নচেৎ আমাদের আর ‘কোন ছাতার’ দৌলত আছে যে হক কথার কথন শোনাই?
আমার, ছোটনের এবং ওখানকার পিছারার খালের এদিক ওদিকের ঝরতিপড়তি ছাওয়ালপানদের শিক্ষণজগৎ এই নাগর আলিরাই তো। তাই যেমনটি শিখেছি, তেমনটি বলাই ঠিক। তালেব এলেম, পণ্ডিতিতে পোক্ত যাঁরা, যাঁরা শহর-নগরের সাত-সতেরো হ্যাকোরবাজির সুলুকসন্ধান রাখেন, যাঁরা বহির্বিশ্বের হরেক খবরের নকশিকাঁথায় শুয়ে মবলগ ‘খাব’ দেখেন যে, এ হলে ওই হতো, ও হলে তা, তাঁদের কথা আলাদা। আমাদের ওই সময়ে বহির্বিশ্বের খবরাখবর আমরা জানতাম কচু। আমরা শুধু জানতাম, কোথাও যেতে না পারার অসহায়তা এবং মুসলিম লিগের উদারতা অথবা বিদ্বেষ। এ কথা কেউ মানবেন কি না জানি না। তবে যখনকার কথা বলছি, তখন মুসলিম লিগের মধ্যে উদার গণতন্ত্রীদের একটা উপদল ছিল এবং তাঁরা হিন্দুদের দেশ ছাড়ার ব্যাপারটা পছন্দ করেননি। কিন্তু তাঁরা কোনো দিনই প্রাধান্য পাননি। একসময় অন্য দলে ভিড়ে গিয়ে নিজেদের বিবেকের দংশন প্রশমনে চেষ্টিত হয়েছেন, কেঁদেছেন এমনও দেখেছি।
কিন্তু ওসব গুরুগম্ভীর বিষয় থাক। যে কথা বলছিলাম, তা ওই সময়কার মানসিকতা, যা আমাদের বাবা-জ্যাঠামশাই পিছারার খালের জগতের অন্যান্য মানুষদের মধ্যে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। আমি এবং ছোটন বা আমাদের বয়সিদের পরিশ্রমের ফল ভোগ করতেন আমাদের বাবা-জ্যাঠারাও। কিন্তু তার জন্য তাঁদের আমাদের প্রতি কোনো কৃতজ্ঞতা, অনুকম্পা বা সহানুভূতি ছিল না। আমরা যারা সদ্য এই ধরনের কায়িক শ্রমের জীবনে এসেছি, তারা তো দেখতে পাচ্ছিলাম যে, নিম্নবর্গীয় এবং বর্ণীয় হিন্দু-মুসলমান বাবা-জ্যাঠারা তাঁদের সন্তানদের শ্রমকে কত সম্ভ্রমের চোখে দেখেন। সেখানে তাঁদের পারস্পরিক সম্পর্ক সমানে সমানে। তাঁদের পরম্পরাগত জীবনচর্যায় যেহেতু এই অভ্যেস তৈরি, সে কারণেই তাঁরা এরকম একটা সম্পর্কে হয়তো পৌঁছোতে পেরেছেন। এটা ক্রমশ তাঁদের সঙ্গে মিলেমিশে আমরা বুঝতে পারছিলাম এবং হাজার কষ্ট ও অভাব-অনটনের তাড়না ভোগ করেও একটা উত্তরণ ঘটছিল আমাদের। আমাদের বাবা-জ্যাঠাদের সে ক্ষেত্রে মানসিকতা ছিল যেন আমরা তাঁদের বেঠ-বেগারি প্রজা, যাদের শ্রমের ফসলের ওপর তাঁদের পুরুষানুক্রমের অধিকার আছে। আমরাও বেশ কিছুকাল এরকম বিশ্বাসেই বিশ্বস্ত ছিলাম। সামান্যতম ত্রুটি-বিচ্যুতিতে তাই তাঁদের নির্মম প্রহার আমাদের সহ্য করতে হতো। কিন্তু সাধারণ নিম্নবর্ণীয়দের সঙ্গে একযোগে কাজকর্ম করতে করতে ছোটন, আমি এবং অন্যান্যরা কর্তাদের এই অমানুষিক আচরণের বিরুদ্ধে বিলক্ষণ ক্রোধপোষণ করতে শুরু করেছিলাম, যদিও তার প্রকাশ ঘটেছে আরও অনেক পরে।
অন্নকষ্ট যদিও-বা নিয়ত অভ্যস্ততায় সহ্য হতো, বস্ত্রের অভাব সহ্য হতো না। মায়ের সর্বমোট দুখানা শাড়ি এবং দুখানাই ছেঁড়া। সেলাই করে করে তাদের অবস্থা দাঁড়িয়েছিল প্রায় কাঁথার মতন। কিন্তু নতুন একখানা কেনার কোনো উপায় ছিল না। এই সময় অবস্থার চাপে পড়েই বোধহয় বাবা তাঁর হতাশা আর আলস্য কাটিয়ে ক্রমশ একটু উদ্যোগী হতে থাকেন। বাড়িতে দু-চারটি ছাত্র পড়ানো, হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা করা বা অনুরূপ টুকটাক রোজগেরে কাজ শুরু করেন। কিন্তু তা নেহাতই যৎসামান্য ক্লাস এইটে উঠে স্কুল মারফতই পাঠ্য বইগুলো অনুদান হিসেবে পেয়েছিলাম। হাতেম মাঝি স্যার আমাকে পুত্রবৎ স্নেহ করতেন। তিনিই সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। কিন্তু কী এক কারণে যেন এই স্কুলের চাকরি তিনি ছেড়ে দেন এবং অন্য একজন শিক্ষক তাঁর জায়গায় যোগদান করেন। এই ভদ্রলোকই প্রথম বিএ পাস শিক্ষক এই স্কুলের। মাঝি স্যার যাবার সময় আমাকে ডেকে বলেছিলেন, ‘বাজান, আমি জানি তোমরা খুবই কষ্টের মধ্যে আছ। আল্লাতায়লার ধারে দোয়া মাঙি, তোমাগো যেন সুদিন আয়। তয় ল্যাহাপড়াড়া ছাড়ইও না।’ নতুন হেডস্যারকে বলে দিয়েছিলেন, ‘এই ছ্যামড়ার দিকে এট্টু নজর রাখবেন মাস্টার ছাব। অর মাথাডা খারাপ না।’—নতুন হেডস্যারও মাঝিস্যারের মতোই আমাকে সস্নেহে গ্রহণ করেছিলেন।
তখন ক্লাস এইটে আমার প্রায় ছমাস অতিক্রান্ত হয়েছে। বইগুলো সবই পড়ে ফেলেছি। ওগুলোর আর দরকার নেই ভেবে অন্য একটা স্কুলের একটি ছাত্রের কাছে দশ টাকা হ্যাঁচকা দরে বিক্রি করে দিলাম। সেই টাকায় মায়ের জন্য একখানা সাধারণ লালপাড় কোড়া মিলের শাড়ি কিনে আনলাম। শাড়িখানা মাকে এনে দিতেই মা যেন কেমন হয়ে গেলেন। তাঁর বোধহয় ধারণা হয়েছিল যে, আমি চুরি-চামারি কিছু করে কাপড়খানা এনেছি। পরে সব বৃত্তান্ত শুনে কাপড়খানা বুকে জড়িয়ে ধরে ছুটে পাশের ঘরে চলে গেলেন। সেখানে বাবা পালঙ্কের ওপর যেমন চুপচাপ বসে থাকতেন, বসেছিলেন। মায়ের আচরণ আমি বুঝতে পারছিলাম না। ও ঘরে যাবার সাহসও হয়নি আমার। কারণ বাবা যদি আমার এই কাজটিকে
পাকামো বলে ভাবেন এবং বকেন? পাশের ঘর থেকে একসময় মায়ের কান্নার শব্দ পেলাম এবং সেই সঙ্গে বাবার আবেগরুদ্ধ কণ্ঠের আভাসও। খানিকক্ষণ বাদে বাবা আমায় ডাকলেন। গিয়ে দেখি মা পালঙ্কের নিচে এক কিনার ঘেঁষে সেই কাপড়খানা বুকে জাপটে বসে আছেন। কাছে গিয়ে দাঁড়াতে বাবা তাঁর ডান হাতখানা আমার মাথার ওপরে রেখে চোখবুজে কোনো রকমে উচ্চারণ করলেন, পুত্রাৎ শিষ্যাৎ পরাজয়েৎ। তাঁর চোখের কোল বেয়ে জল পড়ছিল। আবেগপ্রবণ মানুষ, তাঁর চোখের জল কারণে-অকারণে দেখতে অভ্যস্ত ছিলাম। কিন্তু এ দিনকার এই ব্যবহারটি আমার জ্ঞানত প্রথম। এতকাল তাঁর কাছ থেকে শুধু দূর দূর, ছি ছি, প্রহার, গঞ্জনা এবং ব্যঙ্গ ছাড়া আর কিছুই পাইনি। ওই দিনের ঘটনার পর থেকে বাবা আর কোনো দিনই আমাকে অনাদর করেননি।
এর কয়েক দিন পর বাবা কীর্তিপাশার প্রসন্নকুমার বিদ্যালয়ে একটি শিক্ষকতার কাজ পান। মাইনে চল্লিশ টাকা মাসে। তখনকার সময়ের প্রয়োজনানুযায়ী আমাদের একটা প্রধান সমস্যা মিটল। মোটা ভাত-কাপড়ের সমস্যার সমাধান এভাবে হলে আমার আর ছোটনের পরিশ্রম খানিকটা লাঘব হলো।
বাবা তখন প্রায় পঁয়তাল্লিশ পার করেছেন। ইতিপূর্বে তাঁর রোজগেরে জীবন বলতে কিছুই ছিল না। মধ্যস্বত্বভোগীদের সে যুগে গতর খাটিয়ে বা মগজ খাটিয়ে কিছু রোজগার করার প্রয়োজনও ছিল না। বাবার পরিশ্রম বলতে যেটুকু একদা হয়েছিল, তা শুধু ফুটবল খেলা আর থিয়েটার করার মধ্যে সীমিত। তাও বোধকরি পঁয়ত্রিশ পেরোতে না পেরোতেই শেষ। তারপর বেশ কিছুকাল সামন্তপরম্পরায় বাক্তাল্লাবাজি এবং শখের পদ্য লেখা আর আশপাশবাড়ির একে-ওকে সময়ে-অসময়ে তা শোনানো। তখনও তালুকদারির উপজ তথা অপজ আসছে। পিছারার খালে ঘাসি নৌকো ভিড়ছে, লোকেরা ছোটবাবুর নানা গুণগানে বেশক মশগুল। বাবাকে আমি এই স্কুলের সময়টি থেকেই জেনেছি। তাঁর পরিশ্রমী জীবন ইতিপূর্বে কখনো দেখিনি। শুনেছি জিমন্যাস্টিকে তাঁর দক্ষতার কথা, ফুটবল খেলার কথা এবং থিয়েটারে নবীন রাজা নবাব বা যুবরাজের অভিনয়ে পারদর্শিতার কথা। ক্ষুদ্র এলাকায় তার প্রচার এবং মহিমা অসামান্য। প্রসন্নকুমার বিদ্যালয়ে কর্মগ্রহণের আগে এইসব বিষয়ে নানা কিংবদন্তি এবং বাখোয়াজি ছাড়া তাঁর দক্ষতা বিষয়ে আমার অন্য কোনো বাস্তব অভিজ্ঞতা ছিল না। সে সময়ে আঞ্চলিক লোকেরা যেমন বাখোয়াজি করত তাঁর নানান গুণকীর্তি নিয়ে, তিনি নিজেও অলস আলোচনায় তাঁর যৌবনকালের বাহাদুরির সাতকাহন বলতেন। তাঁকে বুঝলাম এবং জানলাম কীর্তিপাশা প্রসন্নকুমার বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা গ্রহণ করার পর।
আগেই বলেছি এতকাল বাবা আমাদের কোনো বিষয়েই দায়িত্বশীল ছিলেন না। পুরনো অভ্যেসেই তাঁর দিন কাটছিল। তাঁর চরিত্রে একটি স্বাভাবিক প্রবণতাই আমার পছন্দের ছিল যে, তিনি সাধারণ মানুষদের সঙ্গে সহজে মিশবার মানসিকতার অধিকারী ছিলেন। সেই মেলামেশার মধ্যে যে সামন্ত মনোভাব ছিল না এ কথা বলব না, তবে একটা হার্দিক নৈকট্য সবসময়ই তাঁর ব্যবহারে লক্ষ করেছি। এ কারণে সবাই তাঁকে ভালোও বাসত।
এই স্কুলে যোগদান করার পর থেকে বাবার জীবনে একটা ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছিল। বাবা তাঁর দীর্ঘ-পোষিত অলসজীবন থেকে বেরিয়ে এলেন এবং পরিশ্রমী হলেন। বাবার পরিশ্রমী হওয়ার ব্যাপারটা খুব সহজ নয়। বিশেষত যখন তাঁর বয়ঃক্রম পঁয়তাল্লিশ অতিক্রান্ত প্রায়। এতকাল যিনি একটি নিটোল অলস আর শৌখিনজীবনে অভ্যস্ত, তাঁর এ সময়ে পরিশ্রমী জীবনযাপন শুরু করা এক অসামান্য ঘটনা। এ কথা মানতে হবে। কিন্তু অবস্থার গতিকে তা হলো। বাবা দীর্ঘ দেড়-দুই মাইল রাস্তা পায়ে হেঁটে প্রতিদিনই স্কুলে যেতে শুরু করলেন। আগে জ্বর এবং অন্যান্য ব্যাধি তাঁর নিত্যসঙ্গী ছিল। একনাগাড়ে ছমাস, আট মাস ভোগা তাঁর পক্ষে কিছু আশ্চর্য ব্যাপার ছিল না। তখন প্রায়ই তিনি বিছানায়ই পায়খানা-পেচ্ছাপ করে কাটিয়েছেন। রোগ তাঁর পেছন ছাড়ছিলই না। এখন সেসব কিছুই আর থাকল না। তিনি যেন এক নতুন জীবন পেলেন। একসময় সমাজ, পরিজন এবং সবকিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে পালঙ্ক আশ্রয় করেছিলেন। কোনো দায় বা দায়িত্বের কথা ভাবতেনও না। এবার শ্রমের জগতে নেমে এসে তাঁর প্রভূত উপকার হলো। এমনকি শিক্ষকতা করা ছাড়াও স্কুলের নানান কর্মকাণ্ডের দিকেও ঝুঁকে পড়লেন তিনি। ছাত্রছাত্রীদের আবৃত্তি শেখানো, জিমন্যাস্টিক, লাঠিখেলা, বর্শা ছোঁড়া শেখানো থেকে নাটক করা ইত্যাদি ব্যাপারে বেশ দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে লাগলেন তিনি। এ সব বিষয়ে তাঁর সম্যক পারদর্শিতার খবর আগে শুধু জনশ্ৰুতি হিসেবেই শুনেছি। তাঁর শরীরস্বাস্থ্য স্বাভাবিকক্রমে বেশ ভালোই ছিল, শুধু দীর্ঘকাল এক অকর্মার জীবনযাপন করে নানান রোগ বাসা বেঁধেছিল তাঁর দেহে। এখন মানুষের সঙ্গে নিয়ত মেলামেশা করে এবং খানিকটা আর্থিক দুশ্চিন্তামুক্ত হয়ে স্ফূর্তির উদ্ভব ঘটতে থাকলে তিনি বড় সুন্দরভাবে বাঁচতে শুরু করলেন। এভাবে তাঁকে কোনো দিন আনন্দে থাকতে দেখিনি বলে আমাদেরও খুব সুখবোধ হতে লাগল এই সময়। তাঁর গুণপনার কিছু বাস্তব দৃষ্টান্ত দেখে মনে হলো, না, আমাদের বাবা একেবারে ‘অকম্মার ঢেঁকি’ নন, যেমন তাঁর সম্বন্ধে বাড়ির জ্যেষ্ঠরা হামেশা বলে থাকেন।
বাবার কণ্ঠস্বর খুব আভিজাত্যপূর্ণ ছিল। আবৃত্তি বা নাটক অভিনয়ের সময় আমরা তা দেখেছি। তবে পরে বুঝেছি তাঁর ঢংটি শিশির ভাদুড়ী মশাইয়ের। তিনি বাবার কলেজজীবনের আদর্শও ছিলেন। তবে জিমন্যাস্টিক, লাঠিখেলায় তাঁর দক্ষতা আমি দেখেছি। আমি তাঁকে তুখোড় লাঠিবাজদের সঙ্গে স্পর্ধা করে খেলায় নামতেও এই সময় দেখেছিলাম। তাতে মনে হয়েছে মানুষটা কিছু কিছু বিদ্যে বেশ ভালোভাবেই অধ্যয়ন করছিলেন। অভাব ছিল শুধু অনুশীলনের। স্কুলের বাৎসরিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার প্রশিক্ষণকালে তাঁর বর্ণাক্ষেপণ, ভার উত্তোলন, চক্রক্ষেপণ ইত্যাদির প্রকৌশল দেখে তাজ্জব বনে গেছি। প্রায় পেশাদারি দক্ষতায় তিনি সেসব করতেন এবং ছাত্রছাত্রীদের শেখাতেন। অথচ এতসব ধন নিয়ে তিনি কিনা দীর্ঘকাল এক শয্যাশায়ী মনুষ্য হয়ে থাকলেন।
শব্দের উচ্চারণ তা সে ইংরাজি, বাংলা বা সংস্কৃত যে ভাষাই হোক না কেন, তিনি শুদ্ধতার বিষয়ে সবিশেষ আগ্রহী ছিলেন। অশুদ্ধ উচ্চারণ তাঁর রুচিবিরুদ্ধ ছিল। স্কুলের যে কোনো অনুষ্ঠানের শুরুয়াতে তিনি খুব উদাত্ত আবৃত্তিতে বেদমন্ত্র পাঠ করতেন—’সংগচ্ছধ্বম্ সংবোদোদ্ধম সংবোমনাম্ সিজানতাম’। এরপরে মৌলবি স্যারকে বলতেন, হুজুর, এবার আপনের আয়াতও কিছু তেলওয়াত করেন, আমরা শুনি। মৌলবি স্যার, আনুনাসিক উচ্চারণে, বিসমিল্লাহির রাহমানের রাহিম। আউজুবিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজিম—ইত্যাদি আয়াত উচ্চারণ করতেন। তখন জমায়েতে এক অদ্ভুত শান্ততা বিরাজ করত।
তখনও আমি বাবার স্কুলে ভর্তি হইনি। মাঝে মাঝে বাজারে যাবার পথে দাঁড়িয়ে সেইসব দেখতাম। বাবা প্রসন্নকুমার বিদ্যালয়ে যোগদান করেই সিদ্ধান্ত নিলেন যে, আমাকে ওখানেই নিয়ে যাবেন। কিন্তু তখন বার্ষিক পরীক্ষার দু-এক মাস মাত্র বাকি। এ সময়ে যাওয়া যায় না। এখানে আমিই ছিলাম একমাত্র হিন্দু ছাত্র, আর মাস্টারমশাই একমাত্র হিন্দু শিক্ষক। আমরা কেউই খুব একটা ধর্মীয় জীবনযাপন করতাম না। মাস্টারমশাই রোজগারের জন্য কিছু যজমানি পুজোপাঠ করতেন। সেখানে তাঁর অবলম্বন ছিল একখানা পুরোহিত দর্পণ বা নিত্যকর্ম পদ্ধতি। তাই খুলে তিনি দোল, দুগোচ্ছব, শান্তি স্বস্ত্যয়ন, কাঁকড়ার ব্রত বা বারো বাঘের কুমির পুজো সবই করতেন।
আমার পারিবারিক পরিমণ্ডলে ধর্মীয় ব্যাপারটা একটু গোলমেলে ছিল। সে একটা জগাখিচুড়ি ব্যাপার। প্রাচীনপরম্পরায় আমাদের পরিবারের শাক্তগোষ্ঠী হওয়াই তথ্যসম্মত। সে তথ্য বাবার কাছে শোনা গল্পেও আমি জেনেছি। বড় খালের উলটোপারের এক গ্রাম, নাম তারপাশা। সেখানে একসময় নাকি সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতদের ব্যাপক বসতি ছিল। আবার দু-একজন তন্ত্রসাধকও সেখানে বসতি করতেন। আমাদের কুলগুরুর গৃহ ছিল ওই গ্রামে। বাবা বলতেন, আমাগো কুলগুরুদেব দিগ্বিজয় ভট্টাচার্যমশাই একমাত্তর কালীপুজোর দিনই এ বাড়ি আইতেন, এ রহম দ্যাখছি। তেনায় রুদ্রবীণা বাজাইয়া কালীকেত্তন করতেন মোণ্ডোপের সিঁড়ির উপার বইয়া। নরকরোটিতে করইয়া কারণবারি পান করতেন। আমার খাসচাকর মঙ্গর পাঁড়ে ঝালকাডির ম্যাথরবাড়ির থিহা মদ আনাইয়া দেতে। তেনায় হেয়া শোধন করইয়া ওই করোটিতেই পান করতেন। আর থাকত এট্টা আস্থা মড়ার মাতার কঙ্কাল। হেডারে মোণ্ডোপের মইদ্যে দেবীর পদতলে রাইখ্যা এক গেলাস কারণ ঢালইয়া দেতেন মুহের মইদ্যে। এ মুণ্ড হেই কারণ যে শোঁ শোঁ আওয়াজ করইয়া পান করতে হেয়া তো আমরা দেখছিই।
এসব গল্পে আমাদের খুব শিহরণ হতো। জানতে চাইতাম দিগ্বিজয় ভট্টাজ্জি রুদ্রবীণা বাজিয়ে কালীপুজোর রাতে কী গান গাইতেন। বাবা বলতেন, হে এক বিত্তান্ত। রুদ্রবীণা যে সে বাজাইতে পারে না। শিক্ষা লাগে। দিগ্বিজয় ঠাহুর এসব ব্যাপারে আছিলেন সিদ্ধপুরুষ। হেনার শেখনের কিছু বাকি ছিল না। রুদ্রবীণা বাজাইয়া হেনায় গাইতেন শ্যামাসংগীত—’নাচে উলঙ্গী নানা রঙ্গে। তার ভ্রুভঙ্গে স্থির নিখিল ভুবন। কোলে স্রোতস্বিনী—তরঙ্গে জাগে শ্মশান মশান। জাগে নব রূপ প্রকৃতি অঙ্গে।’ আমরা তখন কল্পনেত্রে এক কাপালিককেই যেন দেখতাম, যিনি পঞ্চমকারে কালীসাধনা করছেন, নরকরোটিতে কারণ পান করছেন। আমার জ্ঞানত, জ্যাঠামশাইকে এই শাক্তধারার শেষ প্রতিভূ দেখেছি। বাবা ইত্যাদিরা অজপা মন্ত্রের অসাম্প্রদায়িক ভক্ত। তবে এই অসাম্প্রদায়িকতা কোনো ব্যাপক অর্থে নয়। গোঁসাইজি বোধহয় তাঁর অনুগামীদের নিয়ে একটি পৃথক সম্প্রদায়ের সৃজন চাননি। তাঁর প্রাক্তন ব্রাহ্মজীবনে সম্প্রদায়গত নানান বিষয়ে বিতণ্ডা তাঁকে একটা সময় পীড়িত করলে তিনি সনাতন ধর্মের মূল ধারায় ফিরে আসেন। তথাপি তাঁকে নিয়ে একটা সম্প্রদায়ের সৃজন হয়ই। ব্রাহ্মণ্য আচরণের অস্পৃশ্যতাজাতীয় অনাচার সেখানেও ক্রমশ শিকড় গাড়ে। আমাদের বাড়ির ‘গোঁসাইগণের’ ধর্মকর্ম বিষয়ে যে আচার-আচরণ দেখেছি, তা ছিল কিছু গ্রন্থ পাঠ এবং ধ্যান করা। সকাল ও সন্ধেয় ধ্যান অথবা রেচক, কুম্ভক, প্রাণায়ামাদি কিছু প্রক্রিয়াকরণ, আর নানান গ্রন্থপাঠ। ধ্যানে তাঁরা বীজমন্ত্র চিন্তা করতেন শুধু, জপ করতেন না। ধ্যানমুদ্রা এবং আসনেরও একটি পদ্ধতি ছিল। দুহাতের অনামিকার সপ্তম কড়ে উভয় বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ স্পর্শন এবং আসনপিঁড়ি হয়ে বসে শিরদাঁড়া সোজা রেখে মুদিত নেত্রে বীজমন্ত্র চিন্তন। মাকেও এরকম করতে দেখেছি। মা বীজমন্ত্রটি কী তা আমাকে কোনো দিন বলেননি। সেই মন্ত্রটির নাকি উচ্চারণ নিষিদ্ধ। জিজ্ঞেস করেছি, এসব করে কী হয়? মা বলেছেন, চিত্ত শান্ত হয়। হয়তো হয়, হয়তো সেই হওয়াটা নেহাতই মনের বুঝ। তো সে যা হোক, অসীম দরিদ্রাবস্থা, পারিবারিক নানান উত্থানপতন, বিদেশে নিরুপায় সন্তানদের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের জন্য দুশ্চিন্তা ইত্যাকার হাজার সন্তাপে আমি তাঁদের শান্তচিত্তই দেখেছি বরাবর। বাবা এবং মা উভয়েই তাঁদের চরম সংকটের মুহূর্তে ‘তোমারই ইচ্ছা হউক পূর্ণ করুণাময় স্বামী, দাও দুঃখ যত পারো সকলই সহিব আমি’—এরকম এক উচ্চারণে খুবই শান্ত চিত্তে সব গ্রহণ করতেন। তাঁদের আত্মনিবেদনের এবং তন্নিহিত বিশ্বাসের ভূমিটি ছিল বেশ পোক্ত। যুক্তি বা বিচার সেখানে তাঁদের বিশেষ কোনো দ্বন্দ্বে পীড়িত করতে পারত না। কারণ যুগটা আমাদের পিছারার খালের সোঁতার আশপাশে বহির্বিশ্বের মতো ততটা যুক্তিবিচারমার্গী তখনও হয়ে ওঠেনি।
অতএব এরকম এক পরিবেশে মানুষ হয়ে আমার নির্দিষ্ট কোনো ধর্মমত বা পথ গড়ে ওঠেনি। মাস্টারমশাইও কোনো বিশেষ ধর্মীয় নিগড়ে আবদ্ধ ছিলেন না। আমাদের ধর্মাচার ছিল একান্তই উৎসবসাপেক্ষ। মনসা, দুর্গা, শ্যামা ইত্যাকার পূজা উপলক্ষ্যে। বলির পাঁঠার মাংসের প্রতি আমাদের লক্ষ্য যতটা ছিল, পূজাজনিত পুণ্যের দিকে তার শতাংশের একাংশও নয়। এটা আমাদের ধর্মাচারে শাক্তধারার অব্যবহিত আচারগত পরম্পরা বললেও ভুল হয় না। ফলত তারুলি গ্রামের সেই স্কুলে মাস্টারমশাই এবং আমার ধর্মাচার পালন করা বড় কষ্টকর হয়। সাম্প্রদায়িক হিসেবে ঘোষিত এ রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের নাগরিকগণের সংখ্যাগুরু মুসলমান সমাজ। অতএব রাষ্ট্রীয় ধর্ম ইসলাম। তবে এই রাষ্ট্র ঘোষিতভাবে সংখ্যালঘুকে তাদের ধর্মাচরণে বাধা দিতে চায় না, বরং উৎসাহিত করে যেন তারা তাদের ধর্মানুযায়ী জীবনযাপন করে। কারণ, অন্যথায় বহির্বিশ্বে বদনাম হয়। রাষ্ট্র চায় হিন্দু হিন্দুই থাকুক, মুসলমান মুসলমান। সমবেতভাবে এরা যেন অন্য কিছু হতে না চায়, না পারে, অন্তত অসাম্প্রদায়িক মানুষ যেন হতে না চায়। এমনকি, আমি এরকমও দেখেছি যে, একদা যেমন দাঙ্গা ইত্যাদির সময় হিন্দুর মুখে গোমাংস ঠুসে দিয়ে, কলমা পড়িয়ে তাদের মুসলমান করা হতো, এ সময়ে সে পদ্ধতিও গ্রহণ করা হচ্ছে না। উপরন্তু হিন্দুরা মুসলমানি আচরণে, গোমাংস ভক্ষণে বা মুসলমানি পরবাদিতে যোগদান করুক—তারা তা-ও চাইত না। তারা তাদের মতো থাকুক, আমরা আমাদের মতো। অর্থাৎ ভেদটা বজায় থেকেই যাক। আমরাও তাদের হিন্দুয়ানিতে যাব না, তারাও যেন আমাদের মুলমানিতে না আসে, এরকম একটা বিচার তখন। এ বিচার শুধু মৌলবাদি মুসলমানদের নয়, সনাতনপন্থি হিন্দুদেরও। হিন্দুরা, যাদের ওখানে থেকে যেতেই হবে, কিছুতেই ভূমি ত্যাগ করা চলবে না, তাদের মানসিকতায় এই ধারাটি একসময় বেশ খাপ খেয়ে যায়। তারা ভাবে যদি থাকতেই হয় এখানে, তবে পিতৃপুরুষের ধারাটা অন্তত বজায় থাকুক। কিন্তু সে ধারাটিও ব্যাপক স্ফূর্তি পায় না। না পাওয়ার কার্যকারণ অনেক। তার বিস্তৃতিতে না গিয়ে শুধু একটা কথাই বলি, সব দ্বন্দ্বের মূলাধার জমি। মানুষের মধ্যে যতসব দ্বন্দ্ব বিরাজমান, তার মূল বিষয়বস্তু হচ্ছে জমি, জমির মালিকানা। এমনকি, এরকমও মাঝে মাঝেই আমার মনে হয়েছে যে, স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্যকলহের কারণও যেন জমিই।
এ কারণে এই রাষ্ট্রের শুরুয়াতে সাম্প্রদায়িক ঝঞ্ঝাটের যে প্রকরণ ছিল, পরে তা পালটায়। আগে ধর্মান্তরকরণের একটা প্রবণতা ব্যাপক ছিল। কোনো হিন্দু ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান হলে তার আত্মরক্ষার সমস্যা মিটে যেত। তখন দাঙ্গাবাজ যারা, তারা ধর্মীয় উন্মাদনায় যতটা উন্মত্ত ছিল, ভূমিগ্রাসের প্রতি ততটা ছিল না। প্রতিহিংসা এবং তাৎক্ষণিক লুণ্ঠন, ধর্ষণজনিত প্রাপ্তিই ছিল সে সময়কার সম্প্রদায়গত বিদ্বেষের হেতু। পরে রাষ্ট্র স্থিতিশীল হলে এবং রাষ্ট্রপুরুষেরা ধর্ম ও রাজনীতির মিশ্রণে যে জাদুবল সম্প্রদায়গতভাবে লাভ করা যায়, সে বিষয়ে বিজ্ঞ হলে এই ধারাটি পরিবর্তিত হয়। তখন কুচক্রীরা সংখ্যালঘুদের তাড়িয়ে ভূমি লুণ্ঠনে যতটা আগ্রহী হয়, তাদের ধর্মান্তরিতকরণ বা নিকেশকরণে ততটা আগ্রহী থাকে না। এ বিষয়ে ধান্ধাবাজ কুচক্রী এবং সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্নদের আচরিত কৌশল বিষয়ে পরে বিস্তারিত আলোচনা করব। এখন মাস্টারমশাই এবং আমার ধর্মীয় আচরণজনিত সংকটের কথায় ফিরে যাই।
পাকিস্তান তখনও নিতান্ত শিশুরাষ্ট্র, সাতিশয় নাজুক অবস্থা তার। কেউ কেউ বলতেন যে, প্রায় ‘এতিম’। কিন্তু সে নেহায়েতই ফালতু কথা। তার মাথার ওপর তখন দুই মুরুব্বি, ‘আরশে’ আল্লাহপাক, আর দুনিয়ায় আমেরিকা। এর চাইতে বড় মুরুব্বি আর কী হতে পারে। যতই ইসলামি, শরিয়তিব্যবস্থার রাষ্ট্র হোক, তাওরাত, ইঞ্জিল শরিফ কোরানের সঙ্গে ওল্ড বা নিউ টেস্টামেন্টের যতই বিরোধ থাকুক আর ‘প্যান ইসলামিজম’ যা-ই ফতোয়া দিক, মুরুব্বি হিসেবে মার্কিন মাথার ওপরে থাকলে, আর যাই হোক তাকে ‘এতিম’ বলা ‘গুনাহ’। ঐশী গ্রন্থে এ কথা বড় হরফে লেখা আছে ‘জান বাঁচান ফরজ।’ সে যা হোক, মরুব্বিদের আদেশক্রমেই রাষ্ট্রীয় শিক্ষাব্যবস্থায় ধর্মীয় কারিক্রম বাধ্যতামূলক। মার্কিন সাহেবদের তখন এই শিশুরাষ্ট্রটিকে ‘ওম’ দিতে দেখেছি প্রায় পক্ষীমায়ের মতো। তখন তাঁরা গামবুট পরে আমাদের ওই অজ স্থানেরও প্রায় অস্থান-কুস্থানে ‘লৌড়’ লাগাতেন, আমাদের অন্ধকার হইতে আলোতে অথবা দারিদ্র হইতে সচ্ছলতায় পৌঁছে দেবার মহান ব্ৰত পালন করার জন্য। তাঁরা চাইতেন, আমরা নবীন রাষ্ট্রের নবীনরা যেন ধর্মবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে জাতির অর্থাৎ ইসলামের খিদমতগার হই। অহো! ক্রুসেড এবং জিহাদের সময়ে আত্মত্যাগী মার্টার এবং শহিদগণ তোমরা ভূমধ্যস্থ শয়নে পার্শ্ব পরিবর্তন করো। রাষ্ট্রস্বার্থে সব ঐশী গ্রন্থের সমাহার হচ্ছে।
সে যা হোক, মুসলমান ছাত্ররা তাদের ধর্মীয় কার্যক্রমে খুবই নিষ্ঠাবান ছিল। প্রতিদিন জলপানের বিরতির সময় তারা নামাজ আদায়ে বাধ্য হতো রাষ্ট্রীয় নির্দেশেই। এ ব্যাপারে কেউ যদি অনুপস্থিত থাকত, তাকে রীতিমতো বেত খেতে হতো, পড়া না পারার মতোই। মাথায় সাদা টুপি এবং গোড়ালির উঁচুতে লুঙ্গি বা পাজামা তুলে তারা যখন ‘আউজুবিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজিম’ ইত্যাদি উচ্চারণ করত, আমার আর মাস্টারমশাইয়ের তখন বড় দৈন্যদশা। তখন হেডমাস্টার সাহেবের নির্দেশে মাস্টারমশাই যেমন খুশি বলতেন, আমিও আবৃত্তি করে যেতাম। তবে তিনি এবং আমি দুজনেই জানতাম আমরা কোনো ধর্মীয় মন্ত্র উচ্চারণ করছি না। হিন্দু ধর্মের ব্যাপারটা ঠিক অন্য ধর্মের মতো নয়।
অন্যান্য শিক্ষক সাহেবরা জানতে চাইতেন আমাদের ঐশী গ্রন্থ কী। আমি জানতাম আমাদের কোনও ঐশী গ্রন্থ নেই। তৌরাত, ইঞ্জিল শরিফ, কোরান শরিফ বা বাইবেলের মতো হিন্দুদের কোনো একক ধর্মগ্রন্থ নেই, যাকে অনুসরণ করে হিন্দুরা একটিমাত্র নির্দিষ্ট সম্প্রদায় গঠন করতে পারে বা নিজেদের একটা জাতি হিসেবে দাবি করতে পারে। হিন্দুত্ব ব্যাপারটার কোনো শাস্ত্রোক্ত সংজ্ঞা নেই। হিন্দুদের ধর্মপালনের হাজারও নিয়ম নিগড় আছে। মনু, পরাশর, বৃহস্পতি ইত্যাকার ঋষিমশাইদের রচিত সেসব নিয়মের শতমূল ধারা, সহস্রমূল বিস্তৃতি। কিন্তু সকলের জন্য একটি নির্দিষ্ট ঐশী গ্রন্থ নেই। মাস্টার সাহেবদের ধারণা গীতা, বেদ এইসব আমাদের ঐশী গ্রন্থ। তাঁদের এ ধারণার হেতুও আছে। কেননা গীতায় ‘ভগবানুবাচ’ আছে, বেদকে অপৌরুষেয় এবং ঈশ্বরের বাণী—এমতো বলা হয়ে থাকে। কিন্তু যাঁরা এইসব গ্রন্থ পাঠ করেছেন, তাঁরা জানেন যে এই ধারণার আদৌ কোনো ভিত্তিই নেই। গীতা, বেদ ইত্যাদি সব গ্রন্থই মনুষ্যের রচনা এবং সে সংবাদ ওইসব গ্রন্থেই পাওয়া যায়। বেদের অপৌরুষেয়তার প্রচার বোধহয় ইসলাম আগমনের পরবর্তীকালের রচনা। কোরান আল্লাহতায়ালার রচিত বাণী এবং ঈশ্বরের বাণী এরকম এক দাবির প্রতিস্পর্ধা হিসেবেই বেদকে একসময় ব্রাহ্মণেরা অপৌরুষেয় বলে ঘোষণা করে থাকবেন। এটা আমার ধারণা।
এইসব ধর্মীয়করণ-কারণ হয়ে গেলে বৈকালিক ক্লাস শুরু হতো। যতদিন মাঝিস্যার স্কুলে ছিলেন, তিনি আমাদের ক্লাস এইটেই ইংরেজি এবং ইতিহাস পড়াতেন। কখনো কখনো বাংলা ক্লাসও নিতেন। মাঝিস্যার শিক্ষাগত যোগ্যতায় সাধারণ একজন ম্যাট্রিকুলেট ছিলেন, কিন্তু তাঁর পড়ানোর পদ্ধতি আমাদের মতো গ্রামীণ নিম্নমানের ছাত্রদের পক্ষে বড়ই উপযোগী ছিল। ইংরেজি গ্রামার পড়ানোর একটি সম্পূর্ণ নিজস্ব ধরন ছিল তাঁর। তিনি বাংলার মাধ্যমে ইংরেজি গ্রামার পড়াতেন। হাতে কোনো বইপুস্তক রাখতেন না। ক্লাসে ঢুকে বলতেন, খাতা-পেন্সিল লও, মেলা কথা কবা না। যার যা জিগাবার ল্যাহা শেষ অইলে অথবা ছুটির পর জিগাবা, কথার মইদ্যে কথা কবা না। তারপর টেন্স, সিনট্যাক্স, শব্দ, বাক্য ইত্যাদি বিষয়ে গড়গড় করে বলে যেতেন আমরা লিখে নিতাম। আমাদের যেটুকু ইংরেজি বিদ্যে রপ্ত হয়েছিল, তা যে একান্তই মাঝিস্যারের অবদান, এ কথা এ বয়সেও বিস্মৃত হইনি।
ক্লাস এইট থেকে বার্ষিক পরীক্ষা দিয়ে যখন নাইনে উঠি, তখন দেখা গেল ইতিপূর্বের ফার্স্টবয়কে প্রায় একশ নম্বরে পেছনে ফেলে আমি প্রথম হয়েছি। সে দ্বিতীয় এবং সে হচ্ছে সেই দুলাল। আমাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা হাড্ডাহাড্ডি হলেও আজও আমরা অভিন্নহৃদয় বন্ধু।