বিষাদবৃক্ষ – ৩৪

চৌত্রিশ

তৎকালীন আমার এই হতভাগ্য মাটির আর একটি ঘটনার উল্লেখ করব এবং পাঠক-সাধারণের জ্ঞাতার্থে দলিল রাখব, কীভাবে আমার সেই চমৎকার ভূখণ্ডে মানুষেরা মানুষের দ্বারাই চূড়ান্ত অবনমিত এবং অপমানিত হয়ে প্রায় শূন্যে বিলীন হয়ে গেল। অবক্ষয়েরও বোধকরি কিছু নিয়ম থাকে। তারও আর্থসমাজ তথা প্রাকৃতিক কিছু নির্বন্ধ থাকে, সে সূত্র ধরে সন্ধিৎসুজনেরা সেই অবক্ষয়ের কার্যকারণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত করতে পারেন। কিন্তু এই স্থানের অবক্ষয় এবং তজ্জনিত সন্তাপের কার্যকারণ সূত্র এত জটিল যে খুব সাধারণ রেখায় তাকে অবয়বে আনা যায় না। এই অবক্ষয়ের কোনো বিধ্বংসী মাতৃবর্ণও নেই, নেই কোনো ধ্রুপদী সুর। কিংবা কোনো স্বাভাবিক গ্রামীণ লোকপরম্পরায় ছন্দে বা পটের চিত্রেও তা এতাবৎ কোনো পটুয়া, ভাটিয়াল অথবা ভাওয়াইয়া রমণী বা পুরুষ এর কোনো রোদসী চিত্র বা সুর সৃষ্টি করেছেন, এরকম অভিজ্ঞতাও আমার নেই। এ এক অভিশাপমুখর সময় সম্ভবত, যখন লোকশিল্পীরা পর্যন্ত এর চিত্র, সুর, কথকতা বা কোনো কিছুই ধরে রাখার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন না, অথবা তার ফুরসতও পান না। বোধহয় তখন একদিকে লোভের লুণ্ঠন, আরেকদিকে আতঙ্কের পলায়নই শুধু ছবি। কিন্তু হায়! এরকম ছবিতে কি কোনো শিল্পী মাতৃবর্ণ দেখে? অথবা কোনো লোকশিল্পী কি কোনো সুরের বুনোট করতে পারে? এ যে স্বদেহ কয়ন করে পায়ের আঙুল থেকে শুরু করে স্বদেহ ভক্ষণের চিত্র। এ নিয়ে কিছু সৃজন করা তো—অবক্ষয় নিয়ে নির্মাণ। অবক্ষয়ের রূপকল্প কি জীবনধর্মী শিল্পীরা করতে পারেন?

যেমন এখন এই সময়কার যে ঘটনাটির বিবরণ দেব, শিল্পরসিক সজ্জনেরা বলুন এর সুর বা চিত্র সৃজন করা কি একজন শিল্পীর পক্ষে সম্ভব? না, তা আদৌ করা সংগত। সে শিল্প তো রসগ্রাহীকে ক্রমশ এর ঊষর প্রান্তরের তীব্র যন্ত্রণায় দগ্ধাবে। — তথাপি এ বোধহয় আমাদের ভবিতব্য এবং তাকে আমাদের গ্রহণও করতে হবে। শিল্পীর যেমন এ ক্ষেত্রে অব্যাহতি নেই, তেমনি আমরাও, যারা শ্রোতা বা দর্শক, তারাও এই যন্ত্রণাকে এড়াতে পারি না।

ডাক্তারবাড়ির কথা শুরুয়াতে অনেকই বলেছি। কিন্তু সে বাড়ির মেয়েদের বিষয় যা-ই কিছু আলোচনা করে থাকি না কেন, তারা যে একেবারে স্বৈরিণী জীবনে চলে গিয়েছিল, এ কথা নিশ্চয়ই বলিনি। তাদের ওই শহর থেকে আসা তথাকথিত মামাদের বিষয়ে ব্যাপারটি ছিল পারিবারিক প্রয়োজন এবং তাদের যৌবনিক প্রদাহজনিত সমস্যা। পারিবারিক প্রয়োজনের ক্ষেত্রটি তৈরির দায় তাদের ছিল না অবশ্যই। সে ক্ষেত্রে সে দায় তাদের অভিভাবক-অভিভাবিকাদের, যৌবনিক প্রদাহের দায়ে, এসব ক্ষেত্রে ঠিক কাকে যে দায়ী করা সমীচীন তা জানি না। কিন্তু এখন যে কাহিনির বিন্যাস করতে যাচ্ছি তার সঙ্গে যে রাষ্ট্রিক ব্যবস্থাপনার যোগাযোগ ঘনিষ্ঠ, এ কথা সকলেই মানবেন। কারণ এইসব লোচ্চা, লম্পট এবং লুম্পেনদের সে সময় রাষ্ট্রই ছেড়ে দিয়েছিল সংখ্যালঘুদের অবশিষ্টতম মানুষদের উচ্ছেদকল্পে। এটা ছিল একটা জঘন্যতম সময়।

আমাদের খানাবাড়ির চৌহদ্দিতে যে ধোপার বাড়িটি ছিল, সেখানে আশপাশ জনেদের বেশ একটা আড্ডার ব্যবস্থা ছিল। ওই বাড়ির ধোপানিবুড়ি ছিল এলাকার ধাইমা। তার চিড়ে, মুড়ি, ছোলা, বাদামভাজার ব্যবসাও ছিল। আর ছিল দুধের ব্যবসা। ফলে ওখানে সবসময়ই বেশ জনসমাগম ঘটত। দুপুরের দিকে সাধারণ মেয়ে বউয়েরা, কামকাজ শেষ হলে ধোপানির সামনের দলুজে গল্পগাছা, লুডো, বাঘবন্দি খেলায় সময় কাটাত।

ওই সময় পুরুষরা সেখানে যেত না সাধারণত। ব্যাপারটা প্রায় একটা অলিখিত নিয়মের মতোই ছিল বহুকাল ধরে। ওপারের তারুলি এবং আমাদের এপারের পাশের গ্রাম নৈকাঠির মুসলমান ছেলেমেয়েরাও সেখানে প্রায়ই আসত। ধোপানি ছিল খুব খরজিহ রমণী এবং তার এখানে কোনোরকম চঞ্চলতা প্রকাশ করতে কেউ সাহস পেত না।

ডাক্তারবাবুর এক মেয়ে যাকে আমরা কুট্টিদি বলে ডাকতাম, যে একদিন এরকম এক দুপুরবেলায় ধোপানির বড় বউয়ের সঙ্গে দলুজে পাতা চাটাইয়ের ওপর বসে লুডো খেলছিল। ধোপানি আমাদের বড় দিঘিটির শানবাঁধানো ঘাটলায় বোধহয় ধান শুকোতে গিয়ে থাকবে। আমি মুড়ি না কী আনতে গিয়েছি, কুট্টিদিদের লুডো খেলতে দেখে আমিও বসে গেলাম। আমরা যখন খেলায় বুঁদ, তখন সেখানে পাশের গ্রামের মালেক আসে হঠাৎ। সে মোটামুটি অবস্থাপন্ন বাড়ির ছেলে। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়েছে। পরিচয়ে তালুকদার, তবে এই তালুকদারি যতটা পদবি ততটা শব্দার্থগত নয়। এরকম তালুকদার তখন আমাদের ওখানে আনায়-গণ্ডায় তৈরি হচ্ছিল। প্রকৃত তালুকদারির সঙ্গে এই পদবির বিশেষ কোনো সম্পর্ক ছিল না। কেউ কোনো উপায়ে খানিকটা সম্পন্ন হলেই গাঁয়ের লোকেরা তাকে তালুকদার বলত। সে যা হোক, মালেক ওই সময়কার নিয়ম অনুযায়ী বেশ তালেবর। তার সম্পর্কে নানান কানাঘুষো শোনা ছিল আমাদের। তার হাবভাবে আমাদের উভয় সমাজের মেয়েরাই বেশ সন্ত্রস্ত থাকত। মালেক আসতে তাই কুট্টিদি এবং ধোপাবউ দুজনেই একটু আড়ষ্ট হয়ে পড়ে। দলুজের সামনের অংশে একটা ঢেঁকি পাতা ছিল। সে সেটার ওপর এসে বসে খুবই অন্তরঙ্গের মতো জিজ্ঞেস করে ধোপাদিদি নাই? গেছে কৈ?—–ধোপাবউ কোনো রকমে জানায় যে, সে ঘাটলায় ধান শুকোতে গেছে। এ কথার পর ধোপানির সঙ্গে প্রয়োজন থাকলে তার সেই ঘাটলায় যাওয়াই সংগত। কিন্তু সে হঠাৎ ঢেঁকি থেকে নেমে চাটাইয়ে বসে এবং—’ও তোমরা বুজি লুডু খ্যালতে আছ? মোরও লুডু খেলা খুব ভালো লাগে। হেই ছোডবেলা এ্যারগো বাড়িতে কত খেলছি।’—বলে কুট্টিদিকে ইঙ্গিত করে। ধোপাবউ — মুই এট্টু ঘাড়ের থিহা আই, বলে আড়ালে চলে যায়। তখন আরও বিব্রত অবস্থা। কুট্টিদি আর আমি না পারছি খেলতে, না পারছি উঠে যেতে। অথচ মালেক তখন কুট্টিদির সঙ্গে খেজুর আলাপ করেই যাচ্ছে। যেন সে কুট্টিদির কত আপনজন।——ডাক্তারবাবু আছেন ক্যামন? হেনারে অনেক দিন দেহি না।’—’বড় বুইনের বিয়াড়া তোমরা কৈলম ভালো দেও নায়। বিপনা দাস হ্যার থিহা কোমছে কোম পোনারো বছরের বড়। এরহম বুড়া জামাই লইয়া হে করবে কী?’—এইসব কথাবার্তা এবং ইঙ্গিতপূর্ণ চোখটিপুনি। আবার এই কথার সূত্র ধরেই—’তোমারও তো বিয়াডা এহন দেয়া লাগে। ডাক্তারবাবু যে কী করেন বুজি না। দিনকালের যা অবস্তা, এ্যারপর তুমি যুদি বেজাতের লগে বাইর আইয়া যাও, তহন কি তোমারে দোষ দেয়া যাইবে? তোমারও তো এট্টা ঐ যারে কয় শরীল অর্থাৎ কিনা শরীলের উশুল মাশুল আছে।’—কুট্টিদি প্রথম দু-একটা প্রশ্নের হুঁ-হাঁ গোছের উত্তর দিয়ে উঠে পড়ার চেষ্টা দেখে। কেননা মালেক ক্রমশ অদম্য হয়ে উঠতে থাকে। কিন্তু তাতেও পরিত্রাণ নেই।—’কী? বাড়ি যাবা? লই মুইও ওই দিগেই যামু ঠিক করছি। এক লগেই যাই। আরে শরমাও ক্যান? মোরা বেজাত বলইয়া কি একলগে দুই পাও হাঁটতেও পারুম না? কী যে চুতমারানইয়া সোমাজ তোমাগো!’—বলে সে উঠে দাঁড়ায়। আমি বাল্যাবধি এই ধরনের মানুষের হারামজাদাপনার কাণ্ড দেখতে অভ্যস্ত। ওই ঘটনার সময় খুব ছোটও নই, অন্তত মানসিক দিক দিয়ে। মালেক উঠে তার সঙ্গে চলতে শুরু করে। ধোপার বাড়ি থেকে কুট্টিদিদের বাড়ি যাবার পথ খুব কম নয়। তা ছাড়া সে পথ নির্জন এবং জংলা। মাঝে মাঝে আম, জাম, তেঁতুল বা বট-অশ্বত্থের ব্যাপক বাগান এবং ছাড়া-ভিটা। সেখানে কুট্টিদির মতো একজন সুগঠিত যুবতীকে একা অরক্ষণীয়া পেলে ভোগ করার আকাঙ্ক্ষা শুধু মালেক গুণ্ডা কেন অনেক সচ্চরিত্র যুবকেরও হতে পারে। অবস্থার গতিকে আমি হতভম্ব। কুট্টিদি তখন দৃষ্টিপথের মধ্যে এবং প্রায় ছুটছে। মালেক তার পিছে। যেন বাঘ তাড়া করছে হরিণীকে। ‘অপণা মাংসে হরিণা বৈরী।’ হরিণীর মাংসই তার শত্রু। ধোপাবউয়ের হঠাৎ আবির্ভাবে আমার হতভম্বতা কাটে। সে বলে, ভাই, তুমি লগে লগে যাও। আইজ না জানি কী কাণ্ড ঘটে। মালেকইয়া কৈলম একছের মালউয়া। অর কোনো বিশ্বাস নাই কিন্তু।—আমি একটু পা চালিয়েই চলছিলাম। কিন্তু আমার কাছে এটা পরিষ্কার ছিল না যে, কোনও অঘটন ঘটলে আমি মালেকের সাথে কীভাবে লড়ব। আমাকে দেখে মালেক বলে, বড়গো ব্যাপারের মইদ্যে ছোডরা ক্যান? তুমি বাড়ি যাও। অর লাগে মোর ম্যালা কথা আছে।—আমি শুধু এটুকু বলতে পেরেছিলাম — কুট্টিদির লগে তোমার কোনো কতা নাই। দ্যাহ না, হে ক্যামন ডড় পাইয়া দৌড়াইতে আছে। তুমি হ্যার লগে কতা কবা না, কইয়া দিলাম হ। সে অদম্য, বলে—কমু না ক্যা? হ্যার লগে মোর ভাব। তুই লগে লগে আও ক্যা? তোর ঠেহাডা কী? এই বলে সে ছুটে এসে আমাকে বেধড়ক কিলঘুসি মারতে শুরু করে। আমি হঠাৎ আক্রান্ত হয়ে হতচকিত বনে যাই। কুট্টিদি ছুটতে থাকে। মালেক চেঁচিয়ে বলে—আইজ পার পাইলেও আমি তোমারে উডামু, এডা জানইয়া রাহ। আইজ এই মালাউনের পোয়রে এট্টু দেইখ্যা লই।—এইসব কথার সঙ্গে সঙ্গে আমার ওপর তার আক্রমণ তীব্র হলে আমি পরিত্রাণ খুঁজি। আশপাশে কেউ নেই। এই হুড়াহুড়ির সময় একখণ্ড বাঁশের টুকরো আমার সামনে পড়ে। একতরফা মার খেয়ে এবং কুট্টিদির ওই অসহায়তা দেখে তখন আমার মাথায় খুন চেপে গিয়েছিল। ওই বাঁশের টুকরোটা হাতে পেয়ে আমি মালেককে অন্ধের মতো আক্রমণ করেছিলাম। একটা আঘাত তার পা লক্ষ করে চালালে সে বসে পড়ে। বোঝা যায় তার খুবই লেগেছে। এই সুযোগে আরও গোটা দুই ঘা মেরে ছুটে পালিয়ে যাই। কুট্টিদি ততক্ষণে তাদের বাড়ি পৌঁছে গেছে।

ব্যাপারটা মারামারি পর্যায়ে চলে না গেলে হয়তো কাউকে বলতাম না। কুট্টিদিও খুবই স্বাভাবিক কারণে আমাকে চুপ থাকতে বলেছিল। কিন্তু আমি যেহেতু মার খেয়ে পালটা মেরে বসেছিলাম, এ কারণে বড়দের ঘটনাটা জানানো প্রয়োজন ছিল। আমি ঘটনাটা প্রথমে আমাদের প্রতিবেশী এবং জ্ঞাতি কোবরেজ কাকা এবং তারপর ধোপাঝিকে বললাম। ধোপানিকে আমরা ধোপাঝি বলেই ডাকতাম।

কোবরেজ কাকা একজন বেশ অকুতোভয় মানুষ ছিলেন। তাঁর এই অকুতোভয়তার প্রথম কারণ তাঁর পেশা এবং দ্বিতীয় মস্তিষ্কে সূক্ষ্ম বোধের অভাব। পেশায় যেহেতু কবিরাজ এবং আমাদের ওখানে পাস করা ডাক্তার যেহেতু আদৌ ছিল না, সে কারণে আমাদের উভয় সম্প্রদায়ের কেউই ডাক্তার-কোবরেজদের ঘাঁটানো সুবুদ্ধির বলে বিবেচনা করত না। তা ছাড়া কোবরেজ কাকা প্রায়শই সামাজিক দুর্নীতি আর ধোকাবাজির বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করতেন। যাত্রা-থিয়েটার করার দিকে কাকার খুব ঝোঁক ছিল এবং নিজেকে একজন অসামান্য অভিনেতা মনে করতেন। রোগা লম্বা চেহারার এই কোবরেজ কাকা, আমাদের ছোটবেলায় খুবই আকর্ষণীয় ছিলেন সবার কাছে। সবচেয়ে মজার ছিল নাটকীয় ঢঙে তাঁর স্বগতোক্তিগুলো। মাঝে মাঝেই শুনতাম তিনি বলে যেতেন, আমার লগে চালাকি চলবে না। আমি জাতবৈদ্য, কবিরাজ, রোগী দেহাইতে আবানা, অষুদের বদলে বিষ দিয়া দিমু হ্যানে, দোয়াদশ দণ্ডকাল তড়পাইতে তড়পাইতে মরবে। মোর একগাছ লোমও ছেড়তে পারবে না কেউ, হ।—কাকা বলতেন, কেনই-বা বলতেন ঠিক বোঝা যেত না। তবে তাঁর যে অদম্য সাহস ছিল তার তুলনা নেই। দাঙ্গা-ফ্যাসাদ, চুরি-ডাকাতি বিষয়ে তাঁর কোনো চিন্তা বা দুর্ভাবনা ছিল না। দাঙ্গার ভীতি যখন তুঙ্গে তখনও তাঁর বক্তব্য—আউক না কাটতে, একছের পার পাইয়া যাইবে, হেয়া পারবে না। মরতেই যদি অয় এক-আদটারে মারইয়াই মরুম।—দেশ ছাড়ার কথা কেউ বললে খুব ক্ষেপে যেতেন। বলতেন, ক্যান? দ্যাশটা ক্যাওর বাপের একলার? যেসব মানুষ সোজা সরল বুদ্ধির, আমার মনে হয় তাঁরা একটু বেশি স্পর্শকাতর হন। তাঁদেরই নানান কারণে নানান মর্মবেদনা বেশি ভোগ করতে হয়। কোবরেজ কাকা একটু ছিটেলও ছিলেন।

কবিরাজি ব্যবসায়ে তাঁর পসার ছিল না, কিন্তু হাতযশ ছিল। অবস্থাপন্নরা তাঁকে খুব একটা ডাকতেন না, কিন্তু গরিব-গুর্বোরা হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে তাঁর ওপর খুবই নির্ভর করত। তিনিও এইসব মানুষদের রোগব্যাধি, বিপদ-আপদে ছুটে যেতেন। এ কারণে তাঁর একটা প্রতিপত্তি ছিল তাদের মধ্যে। আমার জ্যাঠামশাইকে তিনি শত্রু মনে করতেন, কিন্তু বাবাকে খুব ভক্তি করতেন। তবে আড়ালে যা-ই বলুন, জ্যাঠামশাইকে সামনাসামনি কখনোই কিছু বলতেন না।

আমি তাঁর কাছে গিয়ে কুট্টিদির ঘটনাটি বলতে কাকা ভয়ানক উত্তেজিত হয়ে পড়েন। ইতোমধ্যে সম্ভবত ছেলের বউয়ের কাছ থেকে কিছু শুনে ধোপাঝি সেখানেই এসে পড়েছে। কাকার সঙ্গে তার এসব গূঢ় বিষয়ে প্রয়োজনে আলোচনা হতো। এখন ধোপাঝিকে দেখে কাকা আগুন। বললেন, আমি মালেকইয়ার রক্ত দশশন করুম এ কথা তোরে কইয়া দিলাম ‘ছুডি’। ও হালার পো হালায় ভাবছে কী, অ্যাঁ? অমরা মরইয়া গেছি?—ধোপাঝি অর্থাৎ ‘ছুড়ি’ বা ছোটি আমাকে দেখিয়ে বলল যে, আমার ওপর মালেকের আক্রোশ পড়তে পারে কারণ সে দেখেছে মালেক খোঁড়াতে খোঁড়াতে গেছে। আমার কপালের সামনেটা বেশ ফুটে উঠেছিল। কাকা বললেন, ও তো আত্মরক্ষা করছে। ওরে মালেকইয়া মারলে ক্যান?— ধোপাঝি বলল—কতা হয়ত্য, তয় এ ব্যাপারে ছোড়বাবুর লগে বন্দেজ না করইয়া কিছু কওন ঠিক ন। লয়েন মোরা হ্যার লগে এট্টু বন্দেজ করইয়া দেহি।

কোবরেজ কাকা বাবার নিতান্ত ন্যাওটা, এ কথা আগেই বলেছি। তিনি তৎক্ষণাৎ রাজি হলেন যে, হ্যাঁ এটা একটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার এবং বাবার সঙ্গে এ বিষয়ে পরামর্শ করা কর্তব্য। বাবা অবশ্য তাঁর চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে ততক্ষণে ধারণা করে নিয়েছেন যে, কিছু একটা বিপত্তি ঘটেছে। ‘নইলে পাগল চেচায় ক্যান?’ কাকা ধোপানিকে নিয়ে আমাদের বাড়ির দিকে রওনা দিলে আমি স্বাভাবিক ভীতিবশত আড়ালে চলে গেলাম। কাকা বলতে বলতে চললেন, বোজলানি ছুডি, ওই শাস্তরে যে কইছে, হে কতা একশ ভাগ হয়ত্য—কী? না—

শ্যাহের লগে করবা দোস্তি
মুগইর রাখফা মদ্যস্তি
যদি শ্যাখ রোহে
মুগইর মরবা কোহে।—

পশ্চিমবঙ্গানুবাদে অবশ্যই সব ‘হ’গুলো ‘খ’ হবে। কাকা বলতে বলতে যাচ্ছিলেন, মেয়াগো দ্যাশে থাকতে অইলে এ মন্তর ছাড়া উপায় নাই। হালারা আসলেই হুদা শ্যাখ। আমি বাবার সামনাসামনি গেলাম না। কাকা আর ধোপাঝি বাবার সামনে হাজির। বাবা দরদালানে একটা চৌকির ওপর যেমন বসে থাকতেন, বসে ছিলেন। দুজনকে দেখে বললেন, কিছু এটা ঘটছে বোজতে পারছি। কিন্তু তুই চেচাইতে আছিলি ক্যান? কাকা বললেন, চেচামু না, আপনে কয়েন কী? মালেকইয়া হালার পো হালায় কুট্টিমনুরে টালায়। আর হ্যার পিরতিবাদ করতে যাইয়া আমাগো পোলায় মাইর খায়? এ্যাতো বড় সাহস! কাকা সাতিশয় ক্রুদ্ধ। বাবা তাঁকে আর কিছু জিজ্ঞেস না করে ধোপাঝিকে বিস্তারিত বলতে বলেন। ধোপাঝি বাবাকে গোটা ব্যাপার খুলে বললে বাবা কোবরেজ কাকাকে জিজ্ঞেস করেন, তুই করতেডা চাও কী?

–মালেকইয়ারে পিডামু।

–হেথে লাভ? তুই আইজ হ্যারে পিডাবি, হে কাইল তোরে পিডাইবে। কুট্টিমনুর কথাডা চিন্তা করছ? এই মাইরপিটে হ্যার সোমস্যাডা কী অইবে? তুই এট্টা আস্থা পাড়া।

–তয় করণ কী?

—করণ, মাইর খাওয়ানো। মালেকইয়ারে হ্যার জাতের মাইনষের হাতে ছ্যাঁচা দেওন লাগবে। বোজজো। চেচাবি না, কায়দায় চলার সোমায় এহন। চেচাইলে এই বুড়া বয়সে আমার হাতেই মাইর খাবি। কাকা এবার একটু দমিত। কারণ বাবার কথার ওপর তিনি কথা বলেন না। ধোপাঝি ছোটবাবুর রীতকানুন জানে। সে বলে, ছোডোবাবুর বুদ্ধিই ঠিক, আর হে বেবস্তা মুই-ই করমু হ্যানে। এন্তাজ আর নুরুলেরে কমু হ্যানে ওপারের কয়েকজনেরে লইয়া য্যান মালেকইয়ারে খাসি বানাইয়া দে। এ কথা অতি ভয়ংকর। এরকম প্রতিশোধ শুধু আমার এই চন্দ্রদ্বীপ অঞ্চলের সেলিমাবাদ পরগনায়ই স্বাভাবিক। বাবা জানেন ধোপাঝি এ কাজ করাতে অবশ্য সক্ষম, কেননা এন্তাজদ্দি এবং নুরুল, এই দুই বাপ-ব্যাটাকে সে যা করতে বলবে তারা তা করবে। তার সবিশেষ কার্যকারণও আছে। এন্তাজ তার ‘হাতউয়া’ আর নুরুল এন্তাজের পোলা। দুজনেই ‘কাজইয়ায়’ বেশ দড়। তাই বাবা সাত তাড়াতাড়ি—না না না অতডা না। তুই আগে আমার পরামর্শডা শোন, তারপর কী করতে অইবে ঠিক করবি। তারপর তিনজনে কীসব পরামর্শ হয় গোপনে, যা আড়ালে থেকে আমি ঠিক শুনতে পাই না। তবে বুঝতে পারি মালেকের অদৃষ্টে আমার প্রহারই শেষ প্রহার নয়। তার কপালে একটু অধিক ‘মাইর’ অপেক্ষা করে আছে এবং সেটা অকস্মাৎ আসবে তার জাতভাইদের তরফ থেকেই। এর বেশ কয়েক দিন পর শোনা গেল, গঞ্জ থেকে ফেরার পথে মালেককে কে বা কারা যেন তার বাড়িতে অচেতন অবস্থায় পৌঁছে দিয়ে গেছে। তারা বাড়ির লোকদের বলেছে যে ‘খালপারে পড়ইয়া আছেলে, বাড়ি দিয়া গেলাম।’ মালেকের ডান পাখানা সারা জীবনের মতো অকেজো করে দিয়েছিল তার আক্রমণকারীরা। পরে বুঝেছি, তালুকদারি বুদ্ধির এই প্যাচটা বাবার মাথায়ও খেলত। তবে জ্যাঠামশাইয়ের মতো এটা তাঁর পছন্দের বস্তু ছিল না। নুরুল বলেছিল, বোজলা কিনা আঘারউয়া ষাড় আর মালউয়া মদ্দেগো ওষুদ এটাই, বাশের চাচ দিয়া আড়ইয়া বিচি দুইডা তোলাইয়া দেয়া। তয় ছোড়বাবুর নিষেদ, হে কারণ খালি ঠ্যাংডাই ল্যাড়া করইয়া দিলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *