বিষাদবৃক্ষ – ৪৩

তেতাল্লিশ

পরদিন সকালে অহীনের বাসায় গিয়ে দেখলাম সে অফিসে যায়নি। অত্যন্ত বিধ্বস্ত চেহারা। চোখমুখ দেখলে বোধহয় সারা রাত ঘুমোয়নি। আমার দুরবস্থায় সে অত্যন্ত কাতর ছিল বটে, কিন্তু তাকে দেখে মনে হলো আরও কিছু মারাত্মক ঘটনা ঘটেছে, না হলে এতটা বিধ্বস্ত তাকে দেখাবে কেন? তা ছাড়া সে এবং কালীদা কাল বেলপার্কে যায়নি কেন তাও একটা চিন্তার ব্যাপার। অহীন চুপচাপ বসে ছিল। আমাকে ঘরে ঢুকতে দেখে বলল, ‘আমি বাধ্য হয়ে কাল যেতে পারিনি। কালীদাকে নিয়ে অন্যত্র যেতে হয়েছিল। সে কথা পরে বলছি। তোমার চাকরির খবর নিশ্চয়ই নৈরাশ্যজনক? সব বললাম। সে বলল, আমি অনুমান করেছিলাম। যা হোক, এদিকে আমি চূড়ান্ত বিপদে পড়েছি। কাল বাড়ি থেকে সংবাদ এসেছে, মাধুরী, আমার বোন, অন্তঃসত্ত্বা। ও অত্যন্ত কষ্টের সঙ্গে কথাগুলো উচ্চারণ করল। আমার পায়ের নিচে পৃথিবীটা যেন দুলে উঠল। কোনো কথাই মুখে জোগাচ্ছিল না। কোনোরকম চিন্তাও করতে পারছিলাম না। তখনকার দিনে এ এমন একটা সমস্যা যে, আমার তখনকার সমস্যা এর কাছে কিছুই নয়। মাধুরীর তখন বয়স বছর পনেরো। তখনকার দিনে গর্ভপাতের ব্যবস্থা না আইনসিদ্ধ, না সরল। পুরো ঘটনাটা শুনে আমি তাজ্জব বনে গেলাম। লোকটিকে আমি চিনি। আমাদের এক মাস্টারমশাইয়ের ছেলে। শহরে তার জেঠতুতো দাদার বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করতে এসেছিল। তার দিদিও কাছাকাছি থাকত। পড়াশোনা অনেক দিন ছেড়ে দিয়েছে। কী একটা চাকরি করে। কালীদা এবং অহীন কাল তার দিদির কাছেই গিয়েছিল। ঘটনার নায়ক ব্যাপারটা আগেই জেনে সপ্তাহখানেক আগে অফিসে ছুটি নিয়ে গ্রামের বাড়িতে গা-ঢাকা দিয়েছে। অহীন এবং কালীদা দিদিকে অনুরোধ জানিয়েছিল, যাতে তার ভাই মাধুরীকে বিয়ে করে একটা সম্মানজনক নিষ্পত্তি করে। দিদি রাজি হয়নি, কারণ তারা ব্রাহ্মণ এবং অহীনেরা কায়স্থ। সে অহীনকে পরামর্শ দিয়েছে যেন গোপন গর্ভপাত করিয়ে ব্যাপারটার সমাধান করা হয়। সে ক্ষেত্রে পয়সাকড়ি যা লাগবে তার ব্যবস্থা করা যাবে।

বিষয়টার আকস্মিকতা, অহীনের অসহায়তা, দিদির নির্লজ্জ আচরণ এবং ছেলেটার কাপুরুষতায় একেবারে দিশেহারা বোধ করতে লাগলাম। অহীনকে জিজ্ঞেস করলাম, সে কী করতে চায়। সে বলল, ভাবতে পারছি না। তুমি বাসায় গিয়ে খেয়েদেয়ে এসো, তারপর কালীদার সঙ্গে আলোচনা করে দেখি।

মনে একরাশ দুঃখ এবং দুশ্চিন্তা নিয়ে বাসার দিকে রওনা হলাম। বেলা প্রায় আড়াইটে তিনটে বাজে। পরীক্ষা দেয়া যে হবে না, সে বিষয়ে আর কোনো সন্দেহ ছিল না। এখন অহীনের বিপদে কী করা যায় সেটাই বড় দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াল। বাসার কাছাকাছি এসেছি। গলিতে ঢোকার মুখেই এক তীব্র আর্তনাদ এবং তার সঙ্গে ততোধিক চিৎকারে তর্জন-গর্জন শুনতে পেলাম, দ্রুত ঘরে ঢুকতেই বুঝতে পারলাম দাদা তাঁর দ্বিতীয় পুত্রটিকে অমানুষিক প্রহার করছেন। দোতলার কাঠের মেঝেতে দুমদাম দাপাদাপির শব্দ, চিৎকার এবং গালিগালাজে বাড়ির সামনে আশপাশে পড়শিরা সব জড়ো হয়ে প্রমাদ গুনছে। ছেলেটা একটা জানোয়ারের মতো চেঁচিয়ে যাচ্ছে। মারের বিরাম নেই। বড় ছেলেটি এ-সময় স্কুলে থাকে। ছোটগুলো ভয়ে আশপাশের বাড়িগুলোতে লুকিয়ে থাকবে। চাকরটারও পাত্তা নেই। ছেলেটার কান্না এবং চিৎকার সহ্য করতে না পেরে দোতলায় উঠলাম গিয়ে দেখি তিনি ছেলেটাকে মেরে একেবারে রক্তাক্ত করে ফেলেছেন। মার তখনও চলছে। আমি ছুটে গিয়ে ছেলেটাকে আড়াল করে দাঁড়ালে দাদা খুব তীব্র স্বরে বললেন, আমি যদি ওকে তক্ষুনি ছেড়ে না দিই এবং নিজের ভালো চাই তবে যেন সরে যাই নচেৎ সাংঘাতিক অবস্থা ঘটবে। তিনি কোনো দিন আমায় এরকমভাবে কথা বলেননি। তিনি বদরাগী। রাগলে জ্ঞান থাকে না সে কথা শুনেছি, কিন্তু তার নমুনা যে এই এরকম, ধারণা ছিল না। তিনি ক্রুদ্ধভাবে আমাকে আরও অনেক কিছুই বললেন। আমাকে পালন পোষণ করা তাঁর পক্ষে আর সম্ভব হবে না এবং আমি যেন অচিরেই ওখান থেকে বিদায় হই—এসবও তিনি বললেন। আমি তাঁর কথায় কান না দিয়ে মিনতি করে বললাম যে, ছেলেটাকে এবার ছেড়ে দেয়া হোক। ছেলেটা কোনো রকমে তার বাবার কবল থেকে মুক্ত হয়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল। সে তখন শারীরিক আক্ষেপ এবং বেদনায় কাঁপছে। আমি তাকে নিয়ে নিচে নামার জন্য এগোতে দাদা উন্মত্তের মতো আমাকে ছেলেটার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে বেধড়ক কিল, চড়, লাথির বৃষ্টি বইয়ে দিতে লাগলেন, তার সঙ্গে সমানে গালিগালাজ এবং কটূক্তি। তিনি তখন যেসব কথা বলছিলেন তা ঠিক রাগের মুহূর্তের প্রলাপ মাত্র নয়। কথাগুলো পূর্বচিন্তিত। তিনি আমাকে তাঁর অনুধ্বংসকারী একটা পরগাছা, নিমকহারাম, অপদার্থ এবং অকর্মণ্য বলে গাল পাড়তে লাগলেন এবং তৎসহ প্রহার। সর্বশেষ যে কাজটি তিনি করলেন, তার তুল্য লাঞ্ছনা এবং আঘাত জীবনে আর পাইনি। মারতে মারতে সিঁড়ির মুখের কাছে এনে একটা প্রচণ্ড লাথি মেরে বললেন, যা তোর মুখ যেন এই বাসায় আর না দেখি। আমি লাথির আঘাতে সিঁড়ির বিপরীত দিকের টিনের বেড়ার ওপর আছড়ে পড়লাম। খানিক নিচের একটা কাঠের আড়ার সঙ্গে থুতনির সাহায্যে খানিকটা দোল খেয়ে, প্রায় দশ-পনেরো ফুট নিচের শানের মেঝেতে দড়াম করে পড়ে গেলাম। যতটুকু মনে আছে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আমি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। মাথার পেছন দিকে জোর আঘাত লেগেছিল। তারপর কী হলো না হলো, তা আর আমার মনে নেই।

শানের মেঝেতে কতক্ষণ অজ্ঞান হয়েছিলাম জানি না। জ্ঞান হলে দেখি আমি অহীনের কোলের ওপর মাথা দিয়ে শুয়ে আছি। তখনও ভূশয্যায় শায়িত। একমাত্র রাঁধুনি চাকরটি আর মাসিমা ছাড়া ঘরে আর কেউ তখন ছিল না। চাকরটি বোধহয় অহীনের নির্দেশমতো কখনো ঠাণ্ডা জল কখনো-বা গরম জল এনে দিচ্ছিল। মার আমি জীবনে ঘরে-পরে অনেক খেয়েছি, তবে জ্ঞান হারাবার অভিজ্ঞতা এই প্রথম।

চেতনা পুরোপুরি ফিরে আসতে যে কথাটি প্রথম কানে গেল তা মাসিমার উক্তি। তিনি মাথা কুটে বলে যাচ্ছিলেন, হে বাবা ষড়ানন, হে বাবা কার্তিক, তুমি আমার এই ছেলেটাকে বাঁচিয়ে দাও বাবা, ওকে সুস্থ করে দিয়ো। ষড়ানন বা কার্তিক বারবনিতাদের দেবতা। আমি উঠে বসলে অহীন বলল, তোমার নিশ্চয়ই খাওয়াদাওয়া কিছু হয়নি? চাকরটি বলল, না, তার আর সুযোগ হয়নি। সেই সকালে সামান্য চা রুটি খেয়ে বেরিয়েছিলেন, তারপর বাসায় ফিরেই তো এই হুজ্জোত। সে আমাকে অনুরোধ করে বলল, আপনি একটু হাতমুখ ধুয়ে কিছু খেয়ে নিন। আমার সারা শরীর ব্যথায় অসাড়, মাথাটা অসম্ভব ভারী বোধ হচ্ছে। যেন একটা বিশাল ওজনের পাথর কেউ ঝুলিয়ে দিয়েছে। খাওয়ার ইচ্ছে বা ক্ষুধাবোধ কিছুই নেই। অহীনকে সে কথা বলতে বলল, মাথার পেছনে আঘাত লেগেছে, সুতরাং এবং ভারী কিছু খাওয়া উচিত হবে না। কোনো বমির ভাব নেই তো? সেরকম কিছু বোধ করছিলাম না। অহীনকে জিজ্ঞেস করলাম, বেলা তো শেষ হতে চলল, কালীদার কাছে যাবার ছিল না? সে বলল, হ্যাঁ, কিন্তু তুমি কি যেতে পারবে? আমি বললাম, পারতে হবেই। তুমি একটু বসো। আমি আমার বইপত্রগুলো গুছিয়ে নিই। এখানে আর নয়। আজ রাতটা অন্যত্র থাকব। কাল দেখি কী করা যায়। অহীন বলল, আমিও তা-ই ভাবছিলাম। এরপর এখানে থাকার কথা ভাবা যায় না। বেলা শেষ হয়ে গিয়েছিল। মাসিমা চোখের জল মুছতে মুছতে চলে গেলেন। আমি হাতে মুখে জল দিয়ে, বইপত্তর গুছিয়ে নিলাম। চাকরটির কাছে জানলাম ছেলেদের সে পাশের বাড়ির এক ভদ্রমহিলার কাছে রেখে এসেছে। দাদার কীরকম যেন আত্মীয়া। দোতলায় গিয়ে একটি চিরকুটে লিখলাম, বউদি অনিবার্য কারণে আমাকে চলে যেতে হচ্ছে। আপনি যে দায়িত্ব আমাকে দিয়ে গিয়েছেন, তা পালন করতে না পারায় ক্ষমাপ্রার্থী। চিরকুটটি তার হারমোনিয়ামের ওপর রাখা একখানি স্বরলিপির বইয়ের মধ্যে এমনভাবে রাখলাম যেন সহজেই নজরে পড়ে। মহিলা নতুবা আমার সহসা অন্তর্ধানের কার্যকারণ খুঁজে পাবেন না, নিচে এসে টিনের সুটকেসটি হাতে নিয়ে চাকরটিকে বললাম, দাদা ফিরলে বোলো আমি চলে গেছি। চাকরটি প্রকৃতই খুব দুঃখিত হলো। অহীনের সঙ্গে আমি রাস্তায় নেমে এলাম।

রাস্তায় চলতে চলতে অহীনকে জিজ্ঞেস করলাম, আমার তো শিক্ষাদীক্ষা এবং মানুষ হবার ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধিলাভ হয়েছে, তোমার বর্তমান সমস্যার কী সমাধান চিন্তা করেছ? অহীন বলল, চিন্তা করে কিছুই কূল পাচ্ছি না ভাই। তাই একটা জিনিসই শুধু ভাবছি আর আতঙ্কিত হচ্ছি, মাধুরী হঠাৎ কোনো অঘটন না ঘটিয়ে ফেলে। সবচেয়ে আফসোসের বিষয় কী জানো, লোকটাকে আমিই বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলাম। একসময়ে প্রায় ঘরের ছেলের মতো হয়ে গিয়েছিল। এরকম একটা বিশ্বাসঘাতকতার কাজ যে করবে, স্বপ্নেও ভাবিনি। কিন্তু এখন সেসব কথা ভেবে লাভ নেই। দেখি কালীদা কী বলে।

আমি বুঝতে পারছিলাম, কালীদা কোনো সমাধান বাতলাতে পারবে না। সে বড়জোর মারধর দেবার কথা বলতে পারে। কিন্তু তাতে কেলেঙ্কারি বাড়বে বই কমবে না। প্রচলিত প্রথা, এ ক্ষেত্রে ধরেবেঁধে জবরদস্তি বিয়ে দিয়ে দেয়া, তাতে ইজ্জত খানিকটা বাঁচলেও আখেরে ভালো হয় না। তখনকার সমাজে এবং আইনে গর্ভপাত করানো নিন্দনীয় এবং অন্যায়। এ এক বিষম সমস্যা। কালীদার সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত হলো লোকটিকে তার বাড়ি গিয়ে ধরতে হবে এবং তাকে এই ঘটনার সম্পূর্ণ দায়িত্ব নেয়ার জন্য চাপ দিতে হবে। এই মর্মে তার দিদির বাসায় কথা বলতে গিয়ে জানা গেল লোকটি বাড়ি যায়নি, সে গেছে চাঁদপুরে। কায়দাকানুন করে এখানকার অফিস থেকে সে বদলি করিয়ে নিয়েছে। অতএব সে ধরাছোঁয়ার বাইরে ঠিক না হলেও আমাদের পক্ষে তার নাগাল পাওয়া শক্ত। সুতরাং গর্ভপাত করানো ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর নেই। খরচের দায়িত্ব অবশ্য দিদি স্বীকার করে নিলেন। অসম্মানের চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে আমাদেরও এরকম সিদ্ধান্তই নিতে হলো।

রাতটা কালীদার সঙ্গে কাটালাম। শরীর অত্যন্ত অসুস্থ। সর্বাঙ্গে ব্যথা। মনে গভীর হতাশা এবং বিষণ্ণতা। অহীন এবং কালীদা পরামর্শ দিল আমি যেন পরদিনই বাড়ি চলে যাই। কেননা শহরে থেকে অসুস্থ হয়ে পড়লে দেখার কেউ নেই। তা ছাড়া অনির্দিষ্টকাল থাকার মতো কোনো জায়গাও নেই। আমিও ভেবে দেখলাম শহরে থাকার আর কোনো অর্থও হয় না। পড়াশোনাই যখন হবে না, তখন এখানে লাথি ঝাঁটা খেয়ে থাকার প্রয়োজন কী? বরং বাড়ি গিয়ে আবার টিউশনি, এটা-ওটা করে সংসারের যদি কিছু সাহায্য করতে পারি, তাতে ভাইবোনগুলোর খানিকটা সুবিধে হবে। অহীনের বর্তমান সমস্যা যত জটিলই হোক, আমার সেখানে কিছুই করার সামর্থ্য নেই। তবুও তাকে এই অবস্থায় রেখে চলে যাওয়া নিতান্তই স্বার্থপরের কাজ বলে আমার মনে হলো। অহীনকে সে কথা বলতে সে বলল, তুমি যদি সুস্থ থাকতে তাহলে দু-চার দিন থেকে যেতে বলতাম এবং তাতে আমিও খানিকটা মানসিক বল পেতাম। কিন্তু তুমি আদৌ সুস্থ নও। আমার মনে হয় তোমার সুস্থ হতে বেশ কয়েক দিন সময় লাগবে। বরং সুস্থ হয়ে একবার এসো।

যে অহীন তার অপরিসীম দারিদ্র্যের মধ্যে থেকেও আমার জন্য প্রাণপাত করেছে, তার এই চরম বিপদের সময় ছেড়ে আসতে হবে ভেবে গ্লানির আর শেষ রইল না। কিন্তু উপায়ও কিছু নেই। অহীনকে বললাম, ভাই, যা-ই ঘটুক একটি চিঠি দিয়ে সব খবরাখবর জানিও। আর কিছু করতে পারি বা না-পারি, অন্তত তোমার দুঃখের সমব্যথী হতে তো পারব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *