আট
পিছারার খাল এবং সর্বংসহিষ্ণু ওই কুলপতি বৃক্ষদম্পতির এলাকার সেই সময়টিতে দাঙ্গায় সমূলে বিনাশ হওয়ার চাইতেও ভয়াবহ ছিল যুবতী মেয়েদের লুণ্ঠিত বা ধর্ষিতা হওয়ার আশঙ্কা। তখন গোটা দেশেই ধর্ষণ, লুণ্ঠন ইত্যাকার অনৈতিক কাজগুলো যেন খুব সাধারণ স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। আবার অন্যদিকে যে কোনো প্রকার যৌন আচরণই তখন বলাৎকার হিসেবে গৃহীত হচ্ছিল, যদি তার পাত্রী হিন্দু এবং পাত্র মুসলমানসমাজের হতো। এ বিষয়ে একটি চূড়ান্ত অভিজ্ঞতার কাহিনি বলব। তখনও আমি বয়ঃসন্ধির কাছাকাছিও পৌঁছাইনি। একটি নিছক সাধারণ যৌনতার ঘটনাকে, হয়তো তাকে প্রেমই বলা যায়, আমি দেখেছি ধর্ষণ হিসেবে আখ্যায়িত হতে। ঘটনাটি আদৌ ধর্ষণ ছিল না। ছিল আপসের। তখন আমার যা বয়স, তাতে স্বাভাবিক যৌনতা, ধর্ষণ, প্রেম ইত্যাদি বিষয়ে আলাদা আলাদা পরিষ্কার ধারণা ছিল না। একটা স্থুল ধারণাই শুধু এ বিষয়ে আমার ছিল, যা বাড়ির পুরনো চাকরবাকর বা গ্রামের কোনো উঠতি মুখফোঁড় দাদার কাছ থেকে রপ্ত।
ভদ্র গৃহস্থেরা গ্রাম ছাড়লেও পিছারার খালের চৌহদ্দির অপবর্গী, অপবর্ণীয়রা তখনও দেশ ছাড়ার কথা ভাবছিল না। তখনও যুগিপাড়া, নাপিতপাড়া, ধোপা, কামার, কুমোর এবং নমশূদ্রেরা গ্রাম ছাড়তে শুরু করেনি। আমাদের তথাকথিত ‘ভদ্দরলোকদের’ ভিটেতে সাঁজ-সবেরে শেয়াল ডাকলেও ওদের এলাকাগুলো বেশ সরগরম ছিল। তারা তাদের জাতকর্ম বেশ চালিয়ে যাচ্ছিল। তখনও পানবরজগুলো পাটকাঠির ঘেরাটোপে পানপাতার সবুজ বহতা বজায় রাখছিল। যুগিরা হলুদ, নীল, লাল এবং ফলসা শাড়ি বুনোনে ব্যস্ত থাকত। কামারশালায় দিনরাত হাপরের শব্দ এবং ‘নেহাইএর’ তপ্ত লোহার পাতের উপর হাতুড়ির দমাদ্দম আঘাতের শব্দ আমরা বাড়ি থেকেই শুনতে পেতাম। আমাদের ‘ভদ্দরলোকদের’ বাড়িগুলো শূন্য হলেও ওদের অঞ্চলে তার কোনোই প্রভাব তখনও দেখা যায়নি। তারা তখনও বেশ দিব্য গ্রামীণ সুখেই গেরস্থালির রস উপভোগ করছিল। সারাদিনমান পরিশ্রম করে সন্ধেবেলায় খোল, কর্তাল, বাঁশি নিয়ে তাদের কীর্তনের দল গেয়ে চলছিল তাদের আবহমানের পদাবলি —
গৌর একবার এসো হে
তুমি আসিলে আনন্দ হবে
নিরানন্দ দূরে যাবে—
গৌর একবার এসো হে
তারা গৌরাঙ্গভক্ত ছিল সবাই। সহজ সরল সাধারণ মানুষ তারা। গৌর, নিতাই, শচীমাতা এবং বিষ্ণুপ্রিয়াকে ইষ্ট হিসেবে নিয়ে বহুকাল ধরে তাদের এই ধারা তারা বজায় রেখে চলেছে। এর সাথে সমান্তরালে চলেছে সব লোকায়ত দেবদেবীর পূজা। এরা সবাই মূলত সংকীর্তনের ভক্ত, তাই গৌর, নিতাই, অদ্বৈত, শ্রীবাসাদির অনুগামী। সারাদিন কাজকাম, সন্ধেবেলা হরিনাম। আমি নিজেও বনমালী যুগির কাঁপানো কণ্ঠের সেই কীর্তন ভুলতে পারি না—
সংকীর্তনের শিরোমণি
দ্বিজমণি দ্বিজ রাজ্যে হে
এ ছাড়া তারা আরও এক কীর্তনের আসর করত এ সময়। সেই আসরের নাম ‘তেন্নাথের মেলা’। এই আসরের নাম মেলা, শুধু কীর্তন নয়। গরিবগুর্বোদের অসহায়তার কথা ভেবেই যেন কোন সুজন এই সরল মেলা-কীর্তনটির সৃজন করেছিলেন। আমাদের বাল্যকালের ওই সময় এর বেশ ব্যাপক প্রচলন হয়েছিল। এই উৎসবে খরচ মাত্র তিন পয়সা। প্রায় ব্রতকথার মতোই এই অনুষ্ঠান। ‘তেন্নাথ বা ত্রিনাথ’। ‘বেম্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বরের’ সম্মিলিত রূপ। তাঁর কৃপায় ‘হারাইয়া যাওয়া গাই’ ফেরত পাওয়া যায়। ‘বাঁজা গরু ডাকে’ এবং গর্ভিণী হয় এবং আরও সব অসম্ভব-অসম্ভব কাণ্ড ঘটে, যা কৃষি এবং পশুপালনকারী মনুষ্যদের সমস্যাবিষয়ক। এই তেন্নাথ গোঁসাইয়ের মহিমা একটা সময় থেকে এদের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করলে দাঙ্গার পরবর্তীকালে এখানকার অবশিষ্ট মধ্যবিত্তরাও তাঁর আশ্রয় গ্রহণ করে। বাড়িতে ‘মানত’ করা হতো ‘তেন্নাথের’ মেলার। বনমালী, লালু, যদুনাথ ইত্যাদিরা তাদের সংকীর্তনের দল নিয়ে এসে তখন তিন পয়সার পালা’ গেয়ে যেত। এক পয়সার পানসুপারি, এক পয়সার বাতাসা আর এক পয়সার গাঁজা—এই হলো পূজার উপকরণ। বনমালী দেবনাথ গাইত—
আমার ঠাহুর তেন্নাথ গোঁসাই
কিছুই না সে চায়
এক পয়সার গাজা পাইলে
ডুগডুগি বাজায়।
এইরকম সহজ কীর্তনপ্রাণ মানুষ ছিল এরা। এই কীর্তনীয়াদেরই একজনের মেয়ে পুতুল, অল্পবয়সি বিধবা যুবতী। তার মেয়ে কুসুমের বয়সও তখন তেরো-চৌদ্দ। মা-মেয়ে দুজনকেই তখন মনে হতো দুই বোন। পুতুল অকালে বিধবা হয়ে মেয়ে নিয়ে বাপের বাড়ি, যেমন সাধারণত হয়ে থাকে। আমাদের বড় খালের যেখানটি থেকে পিছারার খালটির শুরু বা শেষ, তার বেশ কিছু উজানি বহতা পেরিয়ে এগোলে ডানদিকে হিন্দুদের, তো বাঁদিকে মুসলমানদের গাঁ। জানি না, এই উজানি খালটি কোনো এক সময়–হিন্দু-মুসলমানদের আলাদা স্থায়িত্বে স্থাপনের জন্য কাটা হয়েছিল কি না। অথবা প্রাকৃতিকভাবে তৈরি এই খালটিকে এই উভয় সমাজ সীমান্তচিহ্ন হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করেছিল।
পুতুলের গ্রাম যুগিপাড়াটি কিন্তু মূল খালের ডানদিকের হিন্দুদের এলাকায় নয়। সেটি খালের একটি বাঁকে এসে বাঁদিকেই পড়েছে। যুগিদের একফালি মহল্লা পিছারার খালের সাম্প্রদায়িক চিহ্নটিকে যেন বিদ্রুপ করেই তাদের পাড়াটিকে বাঁদিকের ওই স্থানটিতে আটকে রেখেছে। অনধিক শদেড়েক গেরস্থালি নিয়ে এই যুগিপাড়া। তাদের কাজকাম কাপড় বোনা, প্রতিদিন সকাল-সন্ধেয় তাদের ঠকাসঠক ঠকাসঠক শব্দ আমাদের বাড়ির ছাতের ওপর থেকেও শুনতে পাওয়া যেত। কখনো পাড়াবেরুনি পারুলি দাসী, কখনো-বা ধরনী বুড়ি, ছোট ধোপানির সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে তাদের টানাপোড়েন’ ‘রঙ্গোলা’ অথবা ‘ষাট চল্লিশের কাজ দেখতাম। তাদের কেউ-বা নাথ, কেউ-বা দেবনাথ—এইসব পদবির। এই যুগি বা যোগীদের সঙ্গে, নাথ যোগীদের কোনো সম্পর্ক আছে কি না তখন তা বিচার করিনি। বোধকরি ছিল। কেননা, তাদের সমাজ, সামাজিকতা ভিন্ন ধরনের ছিল, আর নামের সঙ্গে উপাধিগুলো ছিল নাথ বা দেবনাথ। দেবনাথ হলো তারাই, যারা পৈতে নিত এবং আমরা তাদের যুগির বাওন’ বলতাম। তাদের পারেরই একদল লোক ছিল জোলা। তারাও কাপড় বুনত। রঙ্গোলা করত। তাদের বাড়ির তাঁতের ঠকাসঠক শব্দও আমরা শুনতে পেতাম। সে শব্দ যুগিবাড়ির শব্দের সঙ্গে মিশেই এসে পৌঁছত আমাদের ছাতে। এরা মাত্র কয়েক পুরুষ আগেকার তাঁতি ইত্যাকার জাতির ধর্মান্তরিত মুসলমান। তখনও গোপনে তাদের ‘বুতপরস্তি’ চলে। নামের পদবিগুলোও পালটায়নি। কেউ মল্লিক, কেউ বিশ্বাস, কেউ মণ্ডল বা শিকদার। সবই পেশাদারি নবাবদত্ত পদবি। জাত বোঝার উপায় নেই পদবি দেখে। তবে সবারই মূলাধার অপবর্ণীয় হিন্দু সম্প্রদায়। পুতুল এদেরই মেয়ে। হিন্দুসমাজের। কাসেমও এদেরই ছেলে। মুসলমান সম্প্রদায়ের। এই কাসেম এবং পুতুলের মধ্যেই প্ৰেম।
পিছারার কাসেমদের বাড়ি আর পুতুলদের বাড়ির মাঝে একটি ছোট নালাখাল, খালটির সঙ্গে এসে মিশেছে সেটি। কাসেমদের পদবি মল্লিক। এই কাসেম একদা পুতুলকে নিয়ে ভেগে যায়। পুতুল তখন বত্রিশ-তেত্রিশ বছরের যুবতী বিধবা। এই নিয়ে গোলযোগ। কাসেম পুতুলরে বাইর হরইয়া নেছে। কিন্তু এ ব্যাপারে পুতুলের যে ইচ্ছার আদৌ অভাব ছিল না, সে কথা কেউই বিচার করল না। তারা কিছুদিন শহর-গঞ্জে কাটিয়ে দরিদ্রতা নিবন্ধন বহুকালের পরিত্যক্ত দত্তবাড়ির ভূতুড়ে গৃহে এসে হাজির হয়। না পুতুল তার সমাজে যেতে পারে, না কাসেম। পুতুলের সমাজের বিচার সে ‘কাঁচাবাড়ি’ হয়েও মুসলমানের ছেলের সঙ্গে ‘বাইর অইয়া গেছে’ অথবা হ্যারে ফুসলাইয়া নেছে, আর কাসেমের সমাজের বিচার, ‘হে কলমা না পড়াইয়া এট্টা নাপাক হিন্দু বেওয়ার লগে জেনা করছে।’ এ ক্ষেত্রে কাসেম যদি পুতুলকে কলেমা পড়িয়ে শুদ্ধ করে নিয়ে ভোগ করত, তাতে তাদের কোনোই গুনা হতো না, বরং এক মহাপুণ্যের কাজ হতো এবং এরকম ‘হাদিস’ অবশ্য আছে যে পুরোপুরি ‘সাদি’ না করেও আওরতদের গ্রহণ করা যায় কিছু বিশেষ প্রকরণে পশুকে যেমন ‘হালাল’ করে ভক্ষণ করা ‘জায়েজ’, তেমনি আওরতদেরও হালাল করে নেয়া প্রতিটি মোমেন মুসলমানের ‘পাক-কর্তব্য’। কাসেমের সমাজের বিচারে পুতুল হালাল নয়। হারাম। তাকে হালাল করতে হলে কলেমা পড়িয়ে অর্থাৎ ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মদ উর রসুলুল্লা’ ইত্যাদি মন্ত্র পাঠ করিয়ে নিতে হবে, নচেৎ তার সহিত সহবাস করা নাপাক। কিন্তু যৌন-বুভুক্ষা ‘কলেমা’ বা ‘যদিদং হৃদয়ং তব’ ইত্যাদি মন্ত্রের জন্য থোড়িই অপেক্ষা করতে পারে। বিশেষত যখন সেখানেও নানা ‘ফ্যাকড়া’র মোকাবিলা করতে হয়। এ কারণে উভয় সম্প্রদায়েই এক ব্যাপক গোলযোগের সূত্রপাত হয়। দত্তদের পুরনো পোড়োবাড়িতে বসবাসকালে তাদের অবস্থা দাঁড়ায় অতি করুণ। তাদের তখন অন্ন জোটে না। উভয় সমাজই তাদের প্রত্যাখ্যান করেছে। দিনমজুর কাসেম খেতে-খামারে কাজ পায় না। কোনো গৃহস্থই কাজ দেয় না বলে সে প্রায় ‘একঘরে’ হয়ে আছে। কাসেম খেটে-খাওয়া মানুষ, সা-জোয়ান চেহারার মস্ত মরদ। পুতুল ছিপছিপে চেহারার বছর বত্রিশের আচুক্কা সুন্দরী যুবতী। ‘আচুক্কা’ সুন্দরী বলতে আমাদের ওখানে যাদের বোঝানো হতো তারা শাস্ত্রসম্মত এমনকি দেশাচারসম্মত সুন্দরীও নয়। শাস্ত্রসম্মত সুন্দরীদের কথা বাদ দিই। এখানে তার প্রয়োজন নেই। কিন্তু দেশাচারসম্মত সুন্দরীদের কথাটি না বললে আচুক্কা সুন্দরীর ব্যাপারটি বোঝা যাবে না। দেশাচারসম্মত সুন্দরীরা হবে ‘ফসা ধলা, গড়ন পেডন গোলগাল লগতইয়া। মাথায় থাকপে আষারইয়া ম্যাগের ল্যাহান ক্যাশ, যা পাছা বাইয়া ঠ্যাঙ্গের লোছ অর্থাৎ গোছ ছাড়াইয়া লামে। হ্যারা লাল পাড়ইয়া শাড়ি পরা, সব্বদা লক্ষ্মী লক্ষ্মী ভাব।’ ‘আচুক্কারা’ তা নয়। ‘হ্যারগো চৌউক্কের ভাবই আলাক, চ্যাহারায় ছ্যামড়া চ্যাতানইয়া ম্যাকমেকি। হ্যারগো দ্যাখলেই বেয়াকের মুহের থিহা নজর আগে পড়ে বুহে। সামনা দিয়া হাডইয়া যাওনের সোমায়, হ্যারগো পাছালাড়া দ্যাখলে পুরুষ তো পুরুষ, তোলানইয়া খাসি বলদাড়াও ফাত ফাত করইয়া দিগ্গ শোয়াষ ছাড়ে।’ ইংরেজিতে এই বর্ণনা বা ব্যাখ্যা হয়তো একটি বাক্যে বা শব্দেই হতো। শব্দটি ‘সেক্সি’। এরা ছিল প্রকৃতই ‘সেক্সি’ চেহারার।
পুতুলের প্রসঙ্গে এতসব সাতকাহন এলো। এদের দেহের গড়ন এবং গতরের ‘লগইত’ দেখেই আমাদের দেশের মহিলারা ধারণা করতেন যে, এরা সাধারণত অধিক ‘ম্যাকমেকি যুক্তা’ হবে। পুতুল যে তার ম্যাকমেকির জন্যই অথবা দারিদ্র্যের কারণে কাসেমের মতো এক হামউয়া জুয়ান শ্যাহের লগে বাইর অইয়া গেলে এ-কথার প্রচারও চাপা পড়ে গেল। শুধু সবাই জানল, ‘মুসলমান যুবক কর্তৃক’, অসহায়া হিন্দু যুবতী বিধবার শ্লীলতাহানি। পুতুলের দারিদ্র্য বা অসহায় যৌবনের পরিত্রাণ বিষয়টি কোনো সমাজেরই স্বীকৃতি পেল না।
এ বিষয়ে সর্বাধিক ক্ষিপ্ত ছিল কাসেমের বাপ। তার ক্ষিপ্ততার কারণ ভিন্ন। তার ছেলে কোন হিন্দু মাগির সঙ্গে ‘জেনা’ করেছে, তা তার প্রতিপাদ্য বিষয় নয়। বাপ-বেটা উভয়েই একই জীবিকার মানুষ। হিন্দু গেরস্তবাড়িতে কাঠকাটা, বাগান দেখভাল করা, নারকেল, সুপারি পাড়া, চাষের কাজ ইত্যাদি ব্যাপারে জীবিকা অর্জন করত তারা। এই ঘটনায় হিন্দুবাড়ির কাজকাম তারা আর পাচ্ছিল না। তার বাপের রাগ সে কারণে। এদিকে পুতুল আর কাসেমের অন্ন জোটা ভার। কাসেম তখন তার প্রেমের দায় শোধ করছে। তারা তখন থোড়-কচু এডা-ওড়া খেয়ে দিন গুজরান করছে। এর মধ্যে একদিন বাপ সেই দত্তদের হানাবাড়িতে চড়াও হয়ে ধুন্ধুমার কাণ্ড বাধিয়ে বসে। পুতুল ছিল একা। কাসেম গেছে খাদ্যের সন্ধানে এদিক-ওদিক কোথাও। পুতুল সামনের বয়ে যাওয়া খাল থেকে জল তুলতে গেছে। এ বাড়ির সামনের খাল হলেও এটিই আমার সেই পিছারার খাল। এমতো সময় এপারে পুতুল আর ওপারে কাসেমের বাপ। মল্লিক রোগা ঢ্যাঙাঢ্যাঙা চেহারা হলেও হাঁক ছাড়ে আলি আলি বলে। গলায় বেদম জোর। সে হাঁক পাড়ে, মাগি তোর এত খাউজ কীয়ের অ্যাঁ? তার হাতে একখানা কুড়ুল, যা তার নিত্যদিনের রোজগারের হাতিয়ার। মল্লিক হঠাৎ খালপারে পুতুলকে দেখে ভীষণ খেপে যায়। কারণ বেশ কিছুদিন ধরে তার কামধান্দা কিছুই জোটেনি। সবাই বলে, না মল্লিক, তোমাগে আর কাম দিতে পারলাম না। সবাই তাকেও অবিশ্বাস করতে শুরু করেছে। যেন সেও তার ছেলের মতো একটা কাণ্ড ইচ্ছে করলেই করতে পারে। মল্লিক বলে, মাগি এই কুড়ুইল দিয়া তোর ম্যাকমেকির ফলনাতা হরমু, বোজজো? তোর ম্যাকমেকির গোড়ায় মুই ঢেহির মুষল দিয়া ধান ভানমু। তোর এ্যাত্তো খাউজ যে মোর পোলারে বিভুলা করো?
এসব ভাষা আমাদের অঞ্চলে আকছার ব্যবহার হতো তখন। কেউ কিছু মনে করত না। তো এইসব চেঁচামেচি-হুড়াঙ্গামায় আশপাশ গ্রামের সব মানুষজন এসে হাজির। মনে আছে, ওই ভিড়ের মধ্যে পুতুলের মেয়ে কুসুমও ছিল। সে বড় করুণ চোখে তার মাকে দেখছিল। এ কথাও এখনও ভুলিনি। তার চোখে ভয় এবং ঘৃণা। বয়স আমার তখন যা-ই হোক, আমি অনেক কিছুই তখন বুঝতে আরম্ভ করেছি। খালের উভয় পারের মুরুব্বিরা, হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে ওই দত্তদের বাড়ির সামনেই এক সালিশির ব্যবস্থা করলেন। এরা অবশ্য কেউই উচ্চবর্ণীয় সমাজের নন। যাঁরা যুগিসমাজের তাঁরা বলছেন, মোগো মাইয়াডারে বাইর করইয়া নেছে তোমাগো পোলায়। মুসলমানরা বলছেন, হুইজ যদি হোগা লাড়া দে হেলে হুতা হান্দে ক্যামেন?’ এমন এক বিন্যাসে সভার আলোচনা শুরু হয়। মল্লিকের পক্ষে যারা, তারা পুতুলের দোষ বর্ণায় আর পুতুলের স্বজাতিরা বলে, ‘মোগো রাঁড়ি মাইয়াডারে কাসেমইয়া বাইর করইয়া নেছে।’ এইসব গণ্ডগোলে সালিশি যখন প্ৰায় চৌপাট তখন কোনো এক অন্ধকার প্রান্ত থেকে যেন পুতুল বেরিয়ে আসে। তার পরনে কালো নরুণ পাড় আধাচ্ছিন্ন ধুতি, যা গরিব বিধবারাই শুধু আমাদের ওখানে পরত। হাতে দুগাছা পেতলের চুড়ি। অনাহার অনিদ্রা এবং দুশ্চিন্তায় জীর্ণশীর্ণ শরীর। এখন তাকে আচুক্কা কেন, কোনো সুন্দরীই বলা চলে না। সে খুবই সসংকোচে সামনে আসে এবং বলে, ‘আফনেরা এহানে য্যারা য্যারা আছেন, বেয়াকের ধারে কই, মোরে আর মোর ওই মাইয়াডারে দুগ্গা ভাত দেওয়ার কেউ আছেন এহানে? মোগো ভাত জোড়ে না। মোর বাপ-জ্যাডারাও এহানে হাজির। হ্যারাও মোগো দুমুইড খাওন দেতে পারে না। হ্যারগো নিজেগোই জোড়ে না তো দেবে ক্যামনে?’ নিতান্ত অসহায়ার মতোই সে সভার সামনে দাঁড়িয়ে সেদিন তার আর্জি পেশ করেছিল। আমার স্মরণ আছে, দত্তবাড়ির বেলগাছটার তলায় দাঁড়িয়ে আমি এই করুণ দৃশ্য দেখছিলাম। আমার সঙ্গে আরও অনেক ছেলেপুলে রগড় দেখতে গিয়েছিল সেখানে। কিন্তু আমার কাছে শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা আর রগড় থাকেনি। পুতুল বলে যাচ্ছিল, ‘দেবেন কেউ মোগো, দোবেলা দুগ্গা ভাত?’ দুই সমাজের কোনো মুরুব্বিই এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি সেদিন। শুধু ছিলা-ছেঁড়া ধনুকের মতো সোজা মরদ সেই কাসেম বলেছিল, ‘মুই দিমু। লও, তুমি আর তোমার মাইয়ারে লইয়া মুই গঞ্জে যাইয়া থাহুম, তোমার মাইয়া মোরও মাইয়া ইনসাল্লা। গঞ্জে মোগো ভাতকাপুরের অবাব অইবে না।’ কিন্তু মেয়ে কুসুম বলে, মুই যামু না। শ্যাহের ভাত মুই খামু না। এ্যারা মোর কেউ না, কেউ না। মুই মরুম মরুম, মোর কেউ নাই কিচ্ছু নাই’–এইসব বলতে বলতে সে কোথায় উধাও হয়ে যায়। পুতুলের উদ্যতপ্রশ্ন মুখ তার বুকের কাছে নুয়ে পড়ে
ওই বয়সেও একটা বিষয় আমার মতো বয়সিদের কাছেও পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে, পুতুল শুধু পিরিতের জন্যই কাসেমের সঙ্গে বেরিয়ে যায়নি। তার এবং তার মেয়ের ক্ষুধা একটা বড় সমস্যা ছিল তার কাছে। মেয়েটা কিন্তু মায়ের এই ব্যাপারটাকে মেনে নিতে পারল না। কেননা সামাজিক যে শিক্ষায় সে তখন গড়ে উঠছে, সেখানে ‘শ্যাহেদের’ সবকিছুই খারাপ। উপরন্তু এই তাঁতি যুগিদের বা অন্যান্য অপবর্ণীয় মনুষ্যদের সমাজ একই দৃষ্টিতে দেখে। কিছুই ভেদাচার করে না। সে কারণেই বোধকরি যুগিরা জোলাদের একেবারেই সহ্য করতে পারে না, কেননা তারা জাতিত্যাগী হয়ে মুসলমান হয়েছে। সেটা মূল সমাজের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা। এখানে একটা অভিমানের ব্যাপার আছে। সমাজতাত্ত্বিকেরা ভালো বুঝবেন। কিন্তু আমি ব্যাপারটা এরকমই দেখেছি। এটা নিকিরি এবং জিওলি বা জেলেদের মধ্যেও আছে। তারা যেন পরস্পরকে কিছুতেই সহ্য করতে পারে না। আবার যদি কখনো কার্যকারণ জেনে পরস্পরের সঙ্গে মিলমিশ হয়ে যায়, তখন তারা অন্য মানুষ হয়ে যায়। তখন তারা একজোট হয়ে কাজিয়া করে। শোষকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে।
এরপরে ওই সালিশির সূত্র ধরেই একদিন পুতুল আর তার মেয়ে আমাদের এলাকা ছেড়ে উধাও হয়ে যায়। শুনেছি তার কে এক খুড়শ্বশুর তাকে নবদ্বীপের কোনো এক বাবাজির চরণাশ্রিতা করে দিয়ে এসেছিল। এভাবেই কুসুমের সমস্যার বোধহয় সমাধান হয়েছিল। অথবা এসব ক্ষেত্রে অনুরূপ মেয়েদের যা পরিণতি হয়, তাই-ই হয়েছিল।
পুতুলের বা তার মেরে পরে কী হয়েছিল কোনোদিন আর জানতে পারিনি। তবে কাসেম যে তাকে বের করে নিয়ে ভোগ করেছিল, এ জ্বালা তাঁতিপাড়ার মানুষদের এক মানসিক সমস্যা এবং অবিশ্বাস বাড়িয়ে তুলেছিল এবং এ প্রদাহ বহুকাল বহতায় ছিল। যদিও সবাই বুঝেছিল যে, পুতুল স্বেচ্ছায়ই কাসেমের সঙ্গে গেছে, কিন্তু উচ্চনীচ বর্ণ নির্বিশেষে সাধারণ সিদ্ধান্ত দাঁড়িয়েছিল এই যে, ও জাতের বিশ্বাস নেই। তাদের শাস্ত্র, সমাজ সবকিছুই হিন্দুদের আগে তেতো খায়, শেষে মিষ্টি, আর তাদের নিয়ম আগে মিষ্টি, পরে তেতো। হিন্দুরা কলাপাতের সামনের দিকে ভাত রেখে খায়, ওরা খায় উলটোদিকে রেখে। তারা মামাতো, খুড়তুতো ইত্যাদি সম্পর্কের মধ্যে সাদি নিকা করে, সে এক অতি কু-আচার। এইরকম নানা ধরনের কথা তখন খুব শুনতে পেতাম। আগেও যে এসব মন্তব্য শুনিনি তা নয়, তবে এখন তার সঙ্গে যুক্ত হলো পুতুলের ঘটনার মতো ঘটনা। অতএব জাত ধর্ম আর থাকে না।
ধবলী এবং পুতুলের ঘটনার মধ্যে তফাত থাকলেও এরকম আরও কিছু ঘটনা ক্রমশ ঘটতে থাকলে আমার পিছারার খালপারের অপবর্ণীয় মানুষেরাও যেন তাদের দেশ, ভূমি এবং এতকালের আশ্রয়ের বিষয় আস্থাহীন হয়ে পড়ে। তারা এক অনির্দেশ যাত্রায় ক্রমশ উদ্যোগী হতে থাকে। এর আগের প্রবতায় গ্রামগুলো বনেদি পরিবারগুলোকে হারাচ্ছিল, এখন সাধারণ মানুষগুলো পর্যন্ত বাস্তুত্যাগ করতে শুরু করল। একটি ঘটনায় এই গ্রামগুলোতে একটা ভীষণ আতঙ্কের সৃষ্টি হলো। যদিও এই ঘটনাটিই ওই আতঙ্কের জন্য একমাত্র দায়ী নয়। এ ঘটনাটি ছিল নিতান্তই এক বোঝার ভুল। কিন্তু যে সময়ের কথা বলছি, তখন এই ভুল বোঝানোও একটা কায়দা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যেহেতু তাতেই লাভ। তাতেই ভূমিসম্পত্তি অর্জন করার পথ সহজ হয়। যাহোক, ঘটনাটি বলি।