বিষাদবৃক্ষ – ২২

বাইশ

আমাদের বাবু প্রসন্নকুমার বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, আমাকে ওই স্কুলে নিয়ে যাবেন। এই সিদ্ধান্তের পেছনে জ্যাঠামশাইয়ের পরামর্শ বা নির্দেশ ছিল। বাবার মনোগত ইচ্ছাও অনুরূপই ছিল। কিন্তু দুজনের এরূপ ইচ্ছার কারণ ভিন্ন ছিল। জ্যাঠামশাই আমার বর্তমান স্কুলে ভর্তি হওয়া আদৌ সমর্থন করেননি। এমনকি যে কদিন তিনি ওই স্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছেন (খুব বেশি দিন অবশ্য করেননি), তার মধ্যে না আমার সঙ্গে স্কুলে তিনি একটি কথা বলেছেন, না ক্লাস নেবার সময় আমাকে কোনো প্ৰশ্ন করেছেন। তাঁর শিক্ষকতার মান খুব উচ্চস্তরের যে ছিল না, তা তাঁর চাইতে অনেক কম ডিগ্রিওয়ালা হাতেম মাঝিস্যারের পড়ানোর সঙ্গে তুলনা করেই আমি বুঝতে পেরেছি। জ্যাঠামশাই তখনকার দিনের বিএ পাস এবং তাঁর বরাবরের দাবি তিনি খুবই উত্তম ছাত্র ছিলেন। গ্রাম-গাঁয়ে তখনকার দিনে বিএ পাস মানুষ এখনকার মতো আণ্ডায়-গণ্ডায় মিলত না। ফলে জ্যাঠামশাইয়ের একজন উচ্চশিক্ষিত মানুষ হিসেবে শুধু পিছারার খালের জগতেই নয়, তার চৌহদ্দির বাইরে সদর অবধি সুনাম ছিল। তদুপরি তিনি আইন বিষয়েও কিছুকাল পড়াশোনা করেছিলেন। তবে এসব ব্যাপারের সঙ্গে শিক্ষকতার সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ঠ নয় বলে আমরা তাঁর শিক্ষণে কিছুমাত্রই যে উপকৃত হইনি, এ কথা বললে সত্যের অপলাপ হয় না। পক্ষান্তরে শুধু ম্যাট্রিক পাস, নাকি এন্ট্রান্স পাসই বলব, মাঝিস্যার তাঁর দীর্ঘকালীন শিক্ষকজীবনের অভিজ্ঞতায় আমাদের যতটা শেখাতে বা তৈরি করতে পেরেছিলেন, তার সুফল সারাজীবন ভোগ করেছি।

এই রচনা যাঁরা পাঠ করবেন, তাঁরা হয়তো জ্যাঠামশাই বিষয়ে আমাকে খুবই একদেশদর্শী হিসেবে ভাবতে পারেন। কেননা আমি তাঁর বিষয়ে কোনো কিছুই ভালো বলছি না। শুধুই তাঁর দোষত্রুটি বিষয়েই আলোচনা করছি। কিন্তু সত্যের খাতিরে আমায় এসব কথা বলতেই হচ্ছে। কারণ জ্যাঠামশাই ওই সময়কার হিন্দু মধ্যস্বত্বভোগী উচ্চবর্ণীয় মানুষদের একজন প্রকৃষ্ট প্রতিনিধিমূলক চরিত্র।

আমার এই স্কুলে পড়াশোনা করার বিষয়ে তাঁর আপত্তির প্রধান কারণ এই যে, স্কুলটি মুসলমান গ্রামে এবং সেখানে শিক্ষকরাও অধিকাংশই মুসলমান। ঐতিহাসিক এবং সামাজিক বিচারে, ওই সময়ে ভালো মুসলমান শিক্ষক সত্যিই যে অপ্রতুল ছিল, সে কথা মিথ্যে নয়। কারণ দীর্ঘকালব্যাপী বঙ্গীয় শিক্ষক, উকিল, মোক্তার, ডাক্তার এবং হাকিম বলতে অবশ্যই মধ্যবিত্ত হিন্দু সমাজের মানুষই ছিল। দেশভাগের পর এঁরা যখন পূর্ববাংলার মাটি ছেড়ে সংগত এবং কখনো-বা অসংগত কারণে পশ্চিমবাংলায় পাড়ি দেন, তখন নবগঠিত রাষ্ট্র পাকিস্তানের সমূহ সমস্যা। তখন অকস্মাৎ এক ব্যাপক শূন্যতার সৃষ্টি হয়। হিন্দু ডাক্তার, উকিল, মোক্তার, শিক্ষক যাঁরা একাধারে হিন্দু মধ্যস্বত্বভোগী এবং সাধারণ মুসলমান, নমঃশূদ্র, কৈবর্ত ইত্যাদি চাষি বা সাধারণ পেশার মানুষদের শোষক, আবার তেমনই তাঁদের পরিষেবার মাধ্যমে এঁদের সংরক্ষকও। পাকিস্তান কায়েম হবার সঙ্গে সঙ্গেই, দাঙ্গা এবং তার আতঙ্কজনিত কারণে, যাঁদের পশ্চিমবাংলায় কিছু সহায়সম্পদ ছিল, তাঁরা চটজলদি সেখানে পাড়ি দেন। এঁরা কিন্তু ঠিক উদ্বাস্তু হিসেবে সেখানে যাননি। তাঁদের ব্যবস্থা সেখানে করাই ছিল। তাই পরবর্তীকালে এঁদের অনুপস্থিতি শিক্ষাক্ষেত্রে, চিকিৎসাক্ষেত্রে এবং কোর্টকাছারি, অফিস-আদালত ইত্যাদির পরিষেবার ক্ষেত্রে যে ব্যাপক শূন্যতার সৃষ্টি করে, সামান্যসংখ্যক তৎ তৎ পেশা অবলম্বনকারী মুসলমানেরা তা ভরাট করতে পারেননি। ভূমিলোভী যাঁরা, তাঁরা হয়তো কিছু তাৎক্ষণিক লাভের মুখ দেখে এই মাৎস্যন্যায়ে উৎসাহী হয়েছিলেন, কিন্তু ব্যাপক মুসলমান সমাজ অন্তত সেই সময়ে এই এক্সোডাস যে চাননি, এমন আমার মনে হয়েছে।

আমার জ্যাঠামশাই ছিলেন সেই শ্রেণির প্রতিভূ, যে শ্রেণির উপস্থিতি প্রকৃতপক্ষে, ওখানকার সাধারণ মানুষের আদপেই কোনো উপকারে আসার কথা নয়। মুসলমানদের, নমঃশূদ্র বা অন্ত্যজদের প্রতি তাঁর ঘৃণা এবং বিদ্বেষ অত্যন্ত উগ্র। তিনি প্রাচীন সামন্তদের ন্যায় আচরণে তাঁর এই মনোভাব কখনো গোপন করতেন না। তালুকদারি প্রথা লুপ্ত হলে তাঁর বৈঠকখানা বা দরবার-গৃহের তাবৎ সরঞ্জাম অন্দরমহলে পাচার করে সামান্য কখানা বেঞ্চিমাত্র সেখানে রাখেন, কেননা, যদি কোনো মুসলমান তাঁর বৈঠকখানায় এসে চেয়ারে বসার স্পর্ধা জানায়! তাঁর অহমিকা এই পর্যায়েরই ছিল। অথচ এই মুসলমান সমাজের লোকের সঙ্গেই তাঁর কাজকারবার ছিল ব্যাপক। তাঁর পরিবারের কোনো সন্তান মুসলমানের কাছে শিক্ষালাভ করুক, এটা তাঁর সম্পূর্ণতই আদর্শবিরোধী। বরং সে মূর্খ হয়ে থাকুক, তাতে কিছুই আসে যায় না তাঁর। ব্যাপারটা অনেকটা ইংরেজি শিক্ষা প্রচলনের প্রারম্ভিক যুগের মুসলমান বুদ্ধিজীবীদের ধারাবাহী, যাঁরা ফারসি শিক্ষা ছেড়ে ইংরেজি বিদ্যের ধারেকাছে যাবেন না বলে ধনুর্ভঙ্গ পণ করেছিলেন, তাঁদের মতো। তবে এমতো সামন্ত-আচার যে ধোপে টেকে না, তা তাঁর জীবৎকালেই তিনিও দেখেছেন, আমরা তো দেখেছিই।

তথাপি শেষ কামড় দিতে জ্যাঠামশাই ছাড়েননি। আমাকে ওই স্কুল থেকে প্রসন্নকুমার বিদ্যালয়ে পাঠানোর জন্য তাঁর যা যা করণীয়, সবই তিনি করলেন। এ ক্ষেত্রে পরিস্থিতি তাঁর সহায়ক ছিল। প্রসন্নকুমার উচ্চ ইংরাজি বিদ্যালয় আমাদের ওই এলাকার সর্বপ্রাচীন বিদ্যালয়। স্থানটি এবং স্কুলটি হিন্দুপ্রধান তখনও। এই স্কুলটির স্থাপয়িতা স্বনামখ্যাত রোহিনীকুমার রায়চৌধুরী তদানীন্তন রীতি অনুযায়ী পিতৃনামে স্কুলটির পরিবর্ধন করেন। ইতিপূর্বে এটি একটি মাইনর স্কুল হিসেবেই ছিল। সুপ্রসিদ্ধ ‘বালা’ নামক ইতিহাস গ্রন্থটির রচয়িতা ছিলেন রোহিনীকুমার। আমাদের ও-দিগরে এত বড় স্কুল আর ছিল না। অবস্থাপন্ন তালুকদার বা অর্থশালী মুসলমানেরা যে এরকম স্কুল ইত্যাদি তৈরি করেছেন, ইতিপূর্বে তা আমরা দেখিনি। পাকিস্তান কায়েম হবার পর, যখন হিন্দু শিক্ষকরা প্রায় সবাই এ দেশ ত্যাগ করে পশ্চিমবঙ্গে পাড়ি দিলেন, তখন অবস্থাপন্ন বা তালুকদার মুসলমানদের টনক নড়ল যে একটা শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে এবং এই শূন্যতার ফলাফল তাঁদের ক্ষেত্রে অতি ভয়াবহ। কেননা তাঁদের সন্তানেরাই এখন স্কুল-কলেজের পড়ুয়া। ইতিপূর্বে যে কারণে তাঁরা হিন্দুদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করতেন, এখন তার অন্য দিকটাও তাঁদের কাছে প্রতিভাত হলো। তাঁরা আশা করেছিলেন যে, পাকিস্তান কায়েম হলে তাঁদের ছেলেপুলেরাই এই শূন্যস্থানটি রাতারাতি পূর্ণ করে ফেলবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় কার্যকালে বিষয়টি অত সরল হলো না। বিশেষত গ্রামের স্কুলগুলোতে এই ব্যাপক ভদ্র হিন্দুর দেশত্যাগে একটা বীভৎস ধস নামল। একের পর এক স্কুল-শিক্ষক এবং ছাত্রের অভাবে বন্ধ হয়ে যেতে লাগল। আমাদের গ্রামগুলোতে যেমন দেখেছি, আট-দশটা গ্রাম বা গোটা ইউনিয়ন জুড়ে হয়তো একটা বা দুটো বড় স্কুল তখন ছিল। এই স্কুলগুলো সাধারণত কোনো হিন্দুপ্রধান গ্রামেই অবস্থিত হতো, কারণ সেগুলোর প্রতিষ্ঠাতা হয় কোনো হিন্দু জমিদার বা তালুকদার, নয়তো কোনো সফল ব্যবসায়ী হিন্দু বণিক তাঁদের মা, বাপ বা বিগতা ধর্মপত্নীর নামে স্থাপিত করেছেন। আমাদের পিছারার খালের বা বড় খালের সন্নিহিত অঞ্চলের গ্রামগুলোতে হাতগুনতি যে কজন সম্পন্ন মুসলমান তালুকদার বা ব্যবসায়ী ছিলেন, তাঁদের সন্তানরাও যেহেতু এইসব স্কুলেরই ছাত্র হতো, তাই তাঁরা তাঁদের গ্রামগুলোতে কোনো বড় স্কুল স্থাপনার প্রয়োজন বোধ করেননি। বরং তাঁরা আরবি, উর্দুশিক্ষার জন্য ছোট ছোট মাদরাসা বা মক্তব খোলার ব্যবস্থা বহুকালাবধি চালিয়ে গেছেন। রইসি মুসলমানদের ঈদৃশ ব্যবস্থাপনার মধ্যে এক স্বার্থবোধ অবশ্য কাজ করেছিল। সাধারণ চাষি গৃহস্থ এবং ইসলামে নিষ্ঠাবান গ্রামীণ কৃষককুল এই শিক্ষাকেই চূড়ান্ত মানলে তাঁদের অর্থাৎ মুসলমান তালুকদার, জোতদার বা ব্যবসায়ীদের খিদমতগারির জন্য অফুরন্ত মেহনতকারীর অভাব হবে না। হিন্দুদের স্বার্থচিন্তাও অনুরূপই ছিল। কিন্তু তাঁরা জানতেন সাধারণ মুসলমান অর্থাৎ যারা তাদের আধিয়ার, বর্গাদার, বেঠবেগারি খাটনেওয়ালা, রাখাল, মাহিন্দার বা ভাতুয়া, তারা কোনো দিনই তাদের সন্তানদের স্কুলে পড়াতে পারবে না। কারণ সে ক্ষেত্রে রইসিদের খিদমতগারির সমূহ অসুবিধে। কিন্তু পাকিস্তান কায়েমের সময় এবং তার পরবর্তী বেশ কিছুকাল ধরে যখন রাষ্ট্র নেহাত শিশু, মুসলিম লিগ নাড়া দিয়ে গেছে যে, ইসলামের ভিত্তিই হচ্ছে সাম্যের ভিত্তি। সেখানে সবাই সমান। আমির গরিবে কিংবা জাতপাতে কোনো ভেদাভেদ নেই। সবার সমান অধিকার। হাদিস শরিফে এ কথা স্পষ্ট বলা হয়েছে যে, শ্রমিকের গায়ের ঘাম শুকোবার আগেই তার মজুরি যেন দিয়ে দেয়া হয়। এরকম সব উত্তম কথা সে সময় আমরা অনেক শুনেছি। কিন্তু এমনও দেখেছি যে, আমাদের পিছারার খালের উলটোপারে যেদিকে মুসলমান গ্রাম, সেখানের জনৈক তালুকদার তাঁর আপন ভাগ্নেকে ‘বান্দির বাচ্ছা’ বলে গাল পাড়ছেন। কেন? না তার মা অর্থাৎ ওই তালুকদারের বোন ‘বেওয়া’ অবস্থায় তার বাড়িতে (অর্থাৎ ভাইয়ের বাড়িতে) দাসীবৃত্তি করে তার সন্তানকে বড় করছে। আর সে যখন তার ন্যায্য হিসেব দাবি করছে তখন তাকে বলা হচ্ছে বান্দির বাচ্ছা।

এই শূন্যতা যখন ব্যাপক, তখনই সম্পন্ন মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষেরা তাঁদের এলাকায় স্কুল স্থাপনে উদ্যোগী হলেন। উচ্ছন্নে যাওয়া হিন্দু গ্রামে স্কুলগুলোর সম্পদ যখন চোর-ডাকাতে লুট করে নিয়ে যায়, তখন মুসলমান গ্রামগুলোতে নতুন করে স্কুল তৈরির প্রচেষ্টা চলে। অন্যথায় তাঁদের সন্তানদেরই শিক্ষা-দীক্ষার পথ রুদ্ধ। মুসলমান জোতদারেরা অথবা বৃহৎ ও মাঝারি চাষিরা এইসব স্কুল স্থাপনের জন্য তখন উদ্যোগেী। তখন একদিকে হিন্দুদের ছেড়ে আসা স্কুল, বাড়িঘর, বাগান-বিলাস সব চাষের জমিতে রূপান্তরিত হতে থাকে, আরেক দিকে নতুন স্কুল গড়ার, খেলার মাঠ গড়ার বা ইতিপূর্বে যেসব বৈভব তাঁরা হিন্দুপ্রধান গ্রামগুলোতে দেখেছিলেন, তার অনুকৃতির প্রচেষ্টা চলতে থাকে। কিন্তু আখেরে কিছুই বিশেষ দাঁড়ায় না। কারণ এই গঠনে না থাকে তাদের কোনো পরম্পরা, না যুগানুযায়ী প্রয়োজনের কোনো নতুনত্ব। এ শুধুই পুরাতনের অনুকৃতির প্রচেষ্টা হিসেবে দুদিন বাঁচে এবং তারপর মরে যায়।

তাদের এরকম প্রচেষ্টার সময়েই আমার বাবা এবং জ্যাঠামশাইয়ের মতন অশিক্ষক মানুষেরা শিক্ষকতাকে পেশা করার সুযোগ পান। তখনও মুসলমান সমাজ থেকে এইসব স্কুলের জন্য শিক্ষক পাওয়া ওই এলাকায় সম্ভব ছিল না, যে কথা আগেই বলেছি। কখনো শহরের কলেজ থেকে ছুটিতে আসা ছাত্র বা ফাইনাল পরীক্ষা শেষ করে অবসর কাটানো কোনো গ্রামীণ যুবক অথবা কোনোক্রমে টেনেটুনে ম্যাট্রিক-উত্তীর্ণ বা অনুত্তীর্ণ গ্রামীণ বেকার কোনো যুবক এইসব স্কুলে শিক্ষকতা করে সাময়িকভাবে। তাদের কোনো শিক্ষকতাজনিত যোগ্যতা আদৌ থাকে না। কিন্তু উপায় নেই। দেশে তখন শিক্ষক বলতে প্রায় নেই। প্রসন্নকুমার বিদ্যালয়েও অবস্থা এ সময় এমন কিছু ভালো নয়। এই স্কুলেল একমাত্র রেক্টর স্যার ছাড়া অন্যান্য শিক্ষকদের মধ্যে ডিগ্রিধারী ছিলেন শুধু হেডমাস্টারমশাই। তিনিই শুধু একমাত্র গ্র্যাজুয়েট। বাকি সব ম্যাট্রিকুলেট। হেডমাস্টারমশাই সে যুগের বিএবিএড ছিলেন। কিন্তু গুরুভক্তি মাথায় রেখেই বলি, তিনিও খুব উত্তম শিক্ষক ছিলেন না। অন্যান্যদের তো কথাই নেই। রেক্টর স্যার অর্থাৎ অশ্বিনীবাবুই ছিলেন একজন প্রকৃত শিক্ষক এবং আমৃত্যু তিনি তা-ই থেকে গেছেন। তবে সব মাস্টারমশাইরাই যথেষ্ট আন্তরিক এবং পরিশ্রমী ছিলেন আমাদের শিক্ষাদান বিষয়ে। বাবাও প্রসন্নকুমার বিদ্যালয়ে এরকমই একজন শিক্ষক হলেন। তিনি বাংলা ভাষায় পদ্য লিখতে পারতেন এবং প্রাচীন বাংলাসাহিত্যে তাঁর পড়াশোনাও ভালোই ছিল। কিন্তু তিনিও ভালো শিক্ষক ছিলেন না। অবশ্য ক্রীড়া-প্রশিক্ষণে তাঁর দক্ষতা উত্তম ছিল।

প্রসন্নকুমার উচ্চ ইংরাজি বিদ্যালয় নামের এই স্কুলটি আমাদের অঞ্চলের সব থেকে প্রাচীন বিদ্যালয়। আগেই বলেছি রোহিনী রায়চৌধুরী মশাই খুবই বিদ্যোৎসাহী এবং সজ্জন ব্যক্তি ছিলেন। কীর্তিপাশা গ্রামটি তাঁদের নিজমৌজা বিধায় তার উন্নতিকল্পে তিনি প্রভূত প্রচেষ্টা করেছিলেন। এই স্কুলের উন্নতি ব্যতিরেকেও তিনি পার্শ্ববর্তী গ্রামের টোল, মক্তব, মাদরাসা ইত্যাদির উন্নতিক্রমে ব্যাপক কাজকর্ম এবং সাহায্যাদি করেছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, মহাশয় অতি স্বল্পায়ু জীবনযাপন করেছেন। মাত্র সাঁইত্রিশ-আটত্রিশ বছর বয়ঃক্রমকালে মৃত্যু তাঁকে ছিনিয়ে নেয়। তাঁর রচিত অনেক গ্রন্থই আমরা বাল্যে পাঠ করেছি। ‘বালা’ তাঁর ইতিহাস বিষয়ে একখানি আকর গ্রন্থ। এ ছাড়া তিনি বেশ কয়েকখানা গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তার মধ্যে ‘আমার পূর্বপুরুষ’, ‘চণ্ডবিক্রম’, ‘নরেন্দ্র নন্দিনী’, ‘হেমলতা’, ‘চিতোর উদ্ধার’, ‘কনকলতা’ এবং সম্ভবত ‘মায়াবিনী’ নামক গ্রন্থগুলোর কথা মনে করতে পারছি।

এই প্রসন্নকুমার বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার লোভ আমার নিজেরও কিছু কম ছিল না। আমার বাবাও এই স্কুলেরই ছাত্র ছিলেন একদা। এখন শিক্ষক। কিন্তু ক্লাস সেভেন এবং এইটে যাঁরা বিনা খরচায় আমাকে পড়াশোনা করার সুযোগ দিলেন, তাঁরা আমাকে সহজে ছাড়তে চাইলেন না। চাওয়ার কারণও ছিল না। এই সময়টায় স্কুলে ছাত্র জোটানো একটা সমস্যার ব্যাপার ছিল। বিশেষত, মোটামুটি ভালো ছাত্র জোটানো তো আরও কষ্টকর। এই স্কুলটি এখানকার মুসলমান সাধারণ সমাজ সামান্য দু-একজন সম্পন্ন অবস্থার গৃহস্থের সাহায্যে বহু যত্নে ও তিতিক্ষায় স্থাপনা করেছিলেন। স্বাধীনতা লাভের বেশ কিছুকাল পরে তাঁদের এই প্রচেষ্টা সার্থক হয়েছিল। আমার স্মৃতিতে এখনও অম্লান হয়ে আছে যে, ওই তারুলি গ্রাম এবং তার চৌহদ্দিতে যত এরকম অজগ্রাম আছে, সেসব স্থানের সাধারণ মুসলমান চাষিরা কী অসামান্য আকাঙ্ক্ষায় এবং প্রচেষ্টায় এই স্কুলটি বাঁচিয়ে রাখতে প্রয়াসী ছিলেন। আমাদের এলাকার প্রাক্তন স্কুলটি যদিও তখন তার ইমারত এবং সরঞ্জামসহ ভূতুড়ে বাড়ি হয়ে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলছে, তথাপি প্রশাসন তাকে উজ্জীবিত করার কোনো প্রচেষ্টায় যায়নি বলে এই কৃচ্ছ্রসাধনে নতুন স্কুলটির স্থাপনা। সরকারের তরফ থেকে উদ্যোগ নিয়ে যদি ওখানেই কার্যক্রমের বিন্যাস হতো এবং আশপাশের পরিত্যক্ত হিন্দু বাড়িগুলোকে অধিগ্রহণ করে দূরবর্তী ছাত্রদের জন্য ছাত্রাবাস নির্মাণ করা হতো, তবে খুবই সামান্য অর্থপ্রয়োগে এক অসামান্য ব্যবস্থার উপায় হতো। কিন্তু তা হলো না। স্কুল স্থাপনাকারীরা চাইলেন যে, তাঁদের স্থাপিত স্কুল তাদের গ্রামেই হোক, হিন্দুদের গ্রামে নয়, এমনকি তাদের স্থাপিত স্কুলবাড়িতেও নয়। ফলত হিন্দুদের স্থাপিত স্কুলের দরজা কপাট, বেঞ্চি, আলমারি এবং বইপত্তর কিছু বিত্তবান ধান্দাবাজ মুসলমানের লুটের সামগ্রী হয়ে তাদের আর্থিক লাভের সহায়তা করল এবং নতুন স্কুল স্থাপনার জন্য অনাবশ্যক অঢেল সামাজিক অর্থ-শ্রাদ্ধের প্রয়োজন হলো।

সে যা-ই হোক। এই স্কুলটি আমাকে ছাড়তে রাজি হলো না। আমি তখন তাঁদের স্কুলের সেরা ছাত্র। অতএব স্কুলের স্বার্থেই তাঁরা আমার অন্যত্র যাবার বিষয়ে স্বাভাবিকভাবেই ক্ষুব্ধ হলেন। আগেই বলেছি এই সময় ছাত্র সংগ্রহ করা খুব সহজসাধ্য ছিল না। পিছারার খালের পৃথিবীতে ব্যাপক জনতা ছিল সাধারণ মুসলমান চাষিরা। স্কুল চলত মধ্যবিত্ত হিন্দু এবং সামান্যসংখ্যক উচ্চ এবং মাঝারি মুসলমান কৃষকদের ঘর থেকে আসা ছাত্রদের নিয়ে। মধ্যবিত্ত হিন্দু পরিবার উৎসৃষ্ট হওয়ায় ছাত্র প্রায় নেই। সাধারণ চাষিরা তাঁদের সন্তানদের লেখাপড়ার বিষয়ে যথেষ্ট আগ্রহী হলেও মাঠের কাজের সঙ্গে তার সমন্বয় করে উঠতে পারতেন না। আবার স্কুলে যদি নির্ধারিত সংখ্যক ছাত্র না থাকে, তবে শিক্ষা বিভাগ স্কুলের অ্যাফিলিয়েশান নাকচ করে দিতেন। আমাদের এই স্কুলটির অ্যাফিলিয়েশান জোগাড় করার কথা মনে আছে। স্কুলে উপযুক্ত সংখ্যক ছাত্র ছিল না। ইতোমধ্যে স্বয়ং ডিআই সাহেবের পরিদর্শনের দিন ধার্য হলো। শিক্ষকসাহেবরা এবং স্বয়ং সেক্রেটারি খুবই চিন্তান্বিত হয়ে পড়লেন। তবে ভরসা একটাই ছিল যে, ডিআই সাহেব ওই গ্রামেরই ছেলে এবং সেক্রেটারি তাঁর আপন চাচা, উপরন্তু তাঁর পিতাও স্কুল কমিটির একজন মেম্বার। এ কারণে ডিআই তাঁর আগমনের পূর্বাহ্নেই খবর পাঠালেন, যে করে হোক ক্লাস ভর্তি রাখতে হবে। ছাত্র কম থাকে তো মাঠ থেকে ধরে এনে সাজিয়ে-গুছিয়ে বসিয়ে দাও। তো মুরুব্বিরা এই দায়িত্ব আমাদের ওপর ন্যস্ত করলেন। আমরাও খেতখামারে কর্মরত সালাম, হালিম, গেদু, গোলাম, হরমুজইয়া ইত্যাদিদের তোয়াজ করে এনে যথাসময়ে হাজির করলাম। এ কারণে তাদের একবেলার খেতের কাজ পণ্ড হলো। তবে লাভ হলো এই যে, স্কুলটি অ্যাফিলিয়েশান পেল। কিন্তু ওই দিনের সেই বিপুল ছাত্রমণ্ডলীর খোঁজ পরে আমরা আর রাখিনি। এভাবে যে স্কুলটি তৈরি হলো তার সেরা ছাত্রটি অন্য স্কুলে চলে যাবে, তাঁদের এতদিনের আকাঙ্ক্ষার এবং প্রচেষ্টার সুফল অন্যের জন্য সুনাম আনবে। এ এক অবশ্যই নিমকহারামি। এখন ক্লাস নাইন এবং দেখতে দেখতেই দুটো বছর কেটে যাবে। যদি আমি একটা ভালো প্রথম বিভাগ পাই, তবে স্কুলের ছাত্রসংখ্যা হু হু করে বেড়ে যাবে। মাস্টারসাহেবদের সুখ্যাত হবে। আমরা এই স্কুলের প্রথম ফসল। তাঁরা আমার এবং দুলালের জন্য বিশেষভাবে আশান্বিত।

কিন্তু তা হলো না। আমাকে যেতেই হলো। প্রসন্নকুমার বিদ্যালয়ের ওপর আমার লোভ থাকলেও এভাবে চলে যাওয়ার ব্যাপারটা আমারও ঠিক ভালো লাগেনি। কিন্তু জ্যাঠামশাইয়ের চক্রান্ত জয়ী হলো। কারণ একে তো ‘মোছলমানেগো ইস্কুলে’ আমার শিক্ষালাভ তাঁর পছন্দ ছিল না, তার ওপর তাঁকে বাধ্য হয়ে ওই স্কুলের হেডমাস্টারি ছাড়তে হয়েছিল, যেহেতু তাঁর দুটি স্কুলে একসঙ্গে হেডমস্টারি করা স্কুল-কমিটি সংগত কারণেই মেনে নিতে পারেনি।

তবে এই স্কুলে যে কিছু কিছু কারণে আমর দমবন্ধ হয়ে আসছিল, তা-ও কিছু মিথ্যে নয়। আমি যে একটা বনেদি বাড়ির ছেলে হয়েও বিনা বেতনে, তাঁদের অনুগ্রহে পড়াশোনা করতে পারছি, এ কথাটা স্কুলের কর্তারা এবং সহপাঠীরা কখনোই আমাকে ভুলতে দিত না। আবার আমি যে একজন কুফরি, পুতুল-উপাসক মালাউন—এই অভিধাও আমার অবশ্য প্রাপ্য ছিল। মাস্টারসাহেবরা অহরহ ‘বুতপরস্তি’ এবং ইসলামি আচরণের তুলনামূলক আলোচনা দ্বারা আমাকে অপ্রস্তুত করতেন। তখন আমার বয়স যা-ই হোক, সামাজিক ভিন্নতা বিষয়ে কাণ্ডজ্ঞান খুব একটা কম ছিল না। মাস্টারসাহেবদের এই তুলনামূলক আলোচনা আমাকে খুবই পীড়া দিত। আমি বলতে পারতাম যে, ‘বুতপরস্তি’ ব্যাপারটা সাধারণ মুসলমান সমাজে আদৌ অনুপস্থিত নয়। খাদ্যাখাদ্যের হালাল-হারাম বিষয়ক বিচারও সাধারণ্যে খুব একটা অবশ্য-পালনীয় পর্যায়ে নেই। কিন্তু এসব বলার মতো সাহস আমার ছিল না। নিজের কারণে না হলেও বে-শরিয়াত সেইসব মানুষদের, যাদের অন্য অনেক গুণের জন্য আমি আত্মীয় মনে করতাম, তাদের বিপদের আশঙ্কা ছিল। আমাদের কিষান নাগর আলির কথা তো বলতেই পারতাম। কিন্তু তার ‘হারাম গোস্ত’ খাওয়ার বিষয়ে তথ্য প্রমাণ নিয়ে যদি প্রকাশ্যে আমি হাজির হতাম, তবে বেচারা নাগর হয়তো খুন হয়ে যেত। এরকম একটা বাতাবরণ তখন ছিল।

এইসব কারণে বাবার স্কুলে যাবার একটা আকাঙ্ক্ষা আমার মধ্যে ছিল। সেই স্কুলটি হিন্দুপ্রধান। সেখানে আমাকে এ ধরনের বিড়ম্বনায় পড়তে হবে না। নিজেকে অচ্ছুৎ মনে হবে না, বা সবার অনুগ্রহে আমার বিদ্যাভ্যাস করতে হচ্ছে, এরকম এক হীনম্মন্যতা আমার থাকবে না, এইসব চিন্তা আমার মাথায় ছিল। কিন্তু তথাপি বলি, এইসব সমস্যার মোকাবিলা করতে হলেও আমাকে যে ওই স্কুলের মাস্টারসাহেবরা এবং ছাত্রবন্ধুরা ভালোবাসতেন না, তা নয়। তাঁরা সবাই আমাকে খুবই যত্ন করতেন। এমনকি যে দুলালের সঙ্গে আমার প্রচণ্ড প্রতিযোগিতা, যে আমি ওই স্কুল ছেড়ে চলে গেলে একেশ্বর হয়ে বিরাজ করবে এমনটিই স্থির ছিল, সে পর্যন্ত আমার চলে আসার ব্যাপারে চোখের জলে জানিয়েছিল, ‘তুই যাইস না।’ কিন্তু আমি চলে এসেছিলাম। আমাকে আসতেই হয়েছিল।

এই স্কুল আমাকে অনেক দিয়েছিল। যে লাঞ্ছনাটুকু তখন রাষ্ট্রবিধানে সংখ্যালঘুদের পাওনা ছিল, তা হয়তো আমাকে ভোগ করতে হয়েছে। কিন্তু আজ এই প্রৌঢ়কালেও সে জন্য কারও ওপর কোনো নালিশ বা বিদ্বেষ নেই। তাঁদের ভালোবাসার কথাটুকুই শুধু মনে আছে। অন্য কিছু নয়। তা ছাড়া, আজকের বিচারে বুঝি, তখন আমি এবং আমার পারিপার্শ্বিক হিন্দুজনেরাও খুবই সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন ছিলাম। আর এ কথাও সবাই জানেন যে, সংখ্যালঘুদের সাধারণ ধর্মই হচ্ছে উৎকট সাম্প্রদায়িক মানসিকতায় ভোগা। কিন্তু আমার হিন্দুজনোচিত জাতিবিদ্বেষ এবং ছুঁৎমার্গের অন্ত্যেষ্টিও এখানেই শুরু হয়েছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *