বিষাদবৃক্ষ – ১

এক

বাড়ির পেছন দিকের শেষ প্রান্ত থেকে যে সরু খালটি বয়ে যেত, তার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ছিল একান্ত শারীরিক। দুপাশে বাড়িঘর গেরস্থালি আগান-বাগানের মাঝখান দিয়ে তার গতি লীন হতো গিয়ে বড় খালে। বড় খালটিও ওরকমভাবেই গিয়ে পড়ত এক নদীতে। সেই নদীতে জাহাজ, স্টিমার চলত। বড় খালে বিশমণি পঁচিশমণি নৌকো চলত; জাহাজ, স্টিমার কিছু আসত না। আর পেছনের খালে চলত শুধু ডিঙি নৌকো। কিন্তু তথাপি এই খাল আমাদের বড় আত্মীয় ছিল। আমরা বলতাম ‘পিছারার খাল’।

পিছাবার খালটি আমাদের বাড়ির সীমান্ত-চিহ্নের গড়খাল। আমাদের ভাষায় গড়খাই, অর্থাৎ কিনা পরিখা। না, আমাদের বাড়িটি কোনো রাজবাড়ি নয় যে তার পরিখা থাকবে। তবে আকার-আয়তন এবং আয়োজনে এক সময়কার রাজকীয় মহিমার ঘোষক অবশ্য। বংশলতিকায়ও একটি কিংবদন্তি আছে এরকম যে, কে এক রাজা হর্ষসেন নাকি আমাদের বীজপুরুষ। সে মরুক গে। পিছারার খালটি বাল্যে আমাদের খুবই প্রিয় ছিল। দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামার আগেই বড় খালের জল হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ত এই গড়খালে। তখন আমরা, এ বাড়ির ‘ছাওয়াল পানরা’, উদোম উলঙ্গ হয়ে সেই থইথই জোয়ারের ঘোলাটে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে হুটোপুটি করতাম। সে সময় তর্জনকারী গার্জেনরা দিবানিদ্রায় মগ্ন থাকতেন। তাই জলক্রীড়ায় বিশেষ বিঘ্ন হতো না আমাদের। আমাদের হুটোপুটির জন্য ছোট ছোট মাছেরা, কুঁচো চিংড়ি, ডোগরি, মলান্তি, কর্কিনা বা ভাঁটারা লাফালাফি করত। জোয়ারের জলের সঙ্গে তারাও ঢুকে পড়ে স্রোতের বিপরীতে এগোতে চেষ্টা করত।

তবে গার্জেনরা যে আমাদের একেবারে ‘ধম্মের ষাঁড়’ করে ছেড়ে দিতেন তা নয়। একজন পালনদার আমাদের সদা সতর্ক চোখে রাখার জন্য এবং অতিরিক্ত উদ্দণ্ডপনা সংহত করার জন্য থাকতই। সেই মানুষটির নাম জানকীনাথ। গৌরবর্ণ, বেঁটেখাটো চেহারা, কুচকুচে কালো কোঁকড়ানো চুল এবং একজোড়া পাকানো গোঁফের অধিকারী জানকীনাথ পুজো-পার্বণে বাড়ির ‘মণ্ডবী’গিরি করত। পুজোর আয়োজন করা, পাঁঠা বলি দেয়া, ধূপতিনৃত্য এইসব করত সে। অন্য সময়ে আমাদের দঙ্গলকে সংযত রাখা ছিল তার দায়িত্ব। অসামান্য গল্প করতে পারত জানকীনাথ। আমরা ডাকতাম জান্দা বলে।

গড়খাইটির পরিসর কম ছিল, কিন্তু গভীরতা খুব একটা কম ছিল না। দৈর্ঘ্যেও চারটি, বা বলা চলে পাঁচটিই গ্রাম জুড়ে তার দৌড়াদৌড়ি ছিল। এমনিতে ছোট ডিঙি নৌকোই চলত বেশি, কিন্তু প্রয়োজনে বড় আট-দশমণি নৌকোও পিছারার খাল অবধি এসে যেত অবাধে। দক্ষিণের ‘মহাল’ থেকে যখন এইসব মালবাহী নৌকোগুলো ধানমান, কলা-কচু, মিষ্টি আলু, গিমি কুমড়োর পসরা নিয়ে বড় খালে এসে ঢুকত, তখন জান্দা তার মধ্যে অপেক্ষাকৃত ছোটগুলোকে রাস্তা দেখিয়ে পিছারার খালে ঢোকাত। গড়খাই-এর এই ঘাট থেকেই কামলা, লস্কর, মাহিন্দরেরা সেইসব সামগ্রী গোলাঘরে এনে তুলত। এগুলো ছিল আমাদের বিশাল পরিবারের সম্বচ্ছরের আহার্য। গিমি কুমড়োকে আমাদের ওখানে বলা হতো ‘যোমচাইলতা’। আস্বাদে অতি কৃৎসিত প্রায় অভোজ্য এই সব্জিটি বিশালকায় মিষ্টি আলু সহযোগে নৈমিত্তিক আহারের প্রধান অবলম্বন ছিল সেসব দিনে আমাদের। এর সঙ্গে আর একটি শস্যও আসত। তা হলো ‘খেসারির ডাইল’। ভালো জিনিস বলতে আসত খেজুর গুড়ের নাগরি, নারকেল ইত্যাদি। আখের গুড়ও আসত প্রচুর। জমিদারির উপজ শস্যসামগ্রী। অতএব এর সবই শ্রদ্ধেয় ভোজ্য, এরকম এক বিশ্বাস বোধ করি কর্তাদের ছিল, আর আমরাও ওই খাদ্য খেয়ে দিব্য ডাঙর হচ্ছিলাম।

পিছারার খালটি গ্রামের পশ্চিম দিকের একটা বড় খাল থেকে বেরিয়ে পুব দিকের বড় খালে মিশেছিল। আমাদের দিক থেকে উজানে পশ্চিমের দিকে এই ছোট খালের পথ ধরে এগোলে একটা ছোট সুন্দর বাগান ছিল। সেখানে অনেক ফুল আর ফলের আয়োজনের সঙ্গে একটি লোভনীয় কামরাঙার গাছও ছিল, যার ফল দারুণ মিষ্টি। ওই বাগানের মালিক নগেন ডাক্তারমশাই তাঁর প্রাতঃ এবং বৈকালিক কৃত্যাদি ওই গাছটার তলায় বসেই সারতেন। আমরা পিঠোপিঠি তিন ভাই আমাদের সীমানার একটা বাঁশঝাড়ের আড়ালে দাঁড়িয়ে পরম আহ্লাদে তাঁর কৃত্যের তাবৎ প্রয়াস দেখতাম। তিনি অবশ্য আমাদের দেখতে পেতেন না। আমরা তিনজন বড়শি নিয়ে ওই দুটি সময়েই ওখানে চিংড়ি মাছ ধরার জন্য যেতাম।

তখনকার দিনে ওইসব অঞ্চলে পায়খানাঘর বলে কিছু ছিল না। একমাত্র আমাদের বাড়িতেই পুরুষ এবং মহিলাদের জন্য আলাদা-আলাদা পায়খানাঘরের ব্যবস্থা ছিল। অন্যান্য বাড়িতে ছিল পায়খানা-গাছ। অর্থাৎ তাদের ইত্যাদি করণের জন্য কোনো খাল বা বেড়ের ওপর একটা আড়াআড়ি গাছের ডাল থাকলেই হলো। মহিলাদের আব্রুর জন্য সুপারিপাতার ঘেরাটোপ। নগেনমশাইয়ের কোনো আব্রুর প্রয়োজন হতো না। তাঁর বয়স তখন সপ্ততি অতিক্রান্ত প্রায়, অতএব তিনি তখন দ্বিতীয় শৈশবে। এ সময়ে মনুষ্যের গোপন বা লজ্জাবিষয়ক কিছুই বোধে থাকে না।

পিছারার খালের মহিমা অনেক। যখনকার কথা বলছি, তখন পঞ্চাশের কাল। সদ্য ‘আণ্ডাফাটা’ রাষ্ট্রটি অথবা বলা ভালো রাষ্ট্র দুটি, নেহাত নাবালক। আণ্ডাফাটা কথাটি বললাম বটে, তবে এই রাষ্ট্র দুটি আদৌ অণ্ডজ নয়। জরায়ুজই। এ কারণেই পাঁচ-ছয় বছর বয়স হওয়া সত্ত্বেও তাদের নাড়িকাটার রক্ত বন্ধ হচ্ছিল না। সর্বকালীন রক্ত বন্ধের জন্য নানান জড়িবুটি ব্যবহার করা হয়েছিল বটে, কিন্তু উভয় শিশুরই নাড়িতে সময়ে অসময়ে ঘা বিষিয়ে উঠে রক্ত পুঁজ নিঃসৃত হতে শুরু করে, যা অদ্যাবধি বন্ধ হয়নি। সাল পঞ্চাশ-একান্নর সময়ে, এরকম এক ব্যাপক রক্তপাতে উভয় রাষ্ট্রের পথ-ঘাট-মাঠ বড় পিচ্ছিল হয়। পেছনের পরিখা যে পলায়নের উত্তম বন্দোবস্ত, সে তত্ত্ব সেন রাজকুলজ লক্ষ্মণ সেনদেবের সময় থেকেই আমরা জানি। মানে কিনা, ‘পাছ দুয়ার দিয়া পলাইয়া যাওনের লাইগ্যাই’ রাজা, জমিদার, তালুকদারেরা একটি পিছারার খাল রাখতেন। শত্রুর আসার পথ সামনের দিক দিয়েই হয়। অতএব পিছারার পলায়ন পথ মজবুত চাই, তা জলপথ হোক বা স্থলপথ। এর আরও একটি হেতু এই যে ‘যদি বাড়ির মাইয়া লোকগো কোনো কারণে কোথাও যাওন লাগে তো হেয়া’ লোকচক্ষুর আড়ালে আব্রু রেখেই ওই পিছারার খালে লাগানো ডিঙি বা কোষা, কিংবা সামর্থ্যানুযায়ী অনুরূপ জলযানে চড়েই তো যেতে হবে। আমাদের খালটির ক্ষেত্রে এই হেতুই প্রধান।

আমাদের মা, জেঠিমারা বাপের বাড়ি যাবার সময় ওই পিছারার খাল থেকেই নৌকোয় উঠতেন। তখন সে এক কাণ্ড। অমুকবাবুর বউ বাপের বাড়ি যাবেন। সে কি সামান্য কথা? সে এক যাত্রা বটে। এমনিতে অমুকবাবুরা বউদের তত্ত্ব-তালাশ ‘ঘণ্টা’ করতেন। কিন্তু বউ বাপের বাড়ি যাবেন, সে এক আভিজাত্যের প্রশ্ন। সে বিষয়ে আয়োজন রাজকীয় না হলে চলবে কেন? দেশে গাঁয়ে তো তাহলে সম্মান থাকে না। একটি এরকম ‘যাওনের’ কথা স্মৃতিতে আছে। তখন আমার বয়স বড়জোর পাঁচ-ছয়। আমার দুই মামাতো দাদার বিয়ে। বাড়িসুদ্ধ নেমন্তন্ন। চাকর-বাওন, অতিথ অইব্যাগত এবং পুরোইত বেয়াকের যাওন চাই। এমত বিধি। অতএব সাজ সাজ রব। আমার মা নয়াবউ বা সোনাবউ। তিনি বাপের বাড়ি যাবেন। তাঁর দুই ভাইপোর বিয়ে। আমাদের দেশের কথায়—’জোড়া বিয়া’। কিন্তু সঙ্গে যায় কে? বাবা যেতে পারেন না। কেন কিনা ‘সামান্য ইস্তিরির ভাইপোয়াগো বিয়া”, এ ক্ষেত্রে ছোটবাবুর ‘যাওন’ খুবই দৃষ্টিকটু। তবে এতটা পথ, নৌকোয় যাওয়া,—একজন তো চাই। অতএব জানকীনাথ চরণদার। সঙ্গে একজন থাকলে আর কথা কী? বিপদে আপদে ‘ওই তো’ আছে। বাবুর যাওয়ার দরকার নেই। আর ছোটবাবুর ‘যাওন’ বেশক অসৈরণও। মাইনষে কইবে কী? মাইনষে এসব ক্ষেত্রে আড়ালে ‘মাইগ্যারুদা’ অর্থাৎ ‘মাউগ যার আরাধ্যা’ বলে সাধারণত রগড় করে। তায় এই স্ত্রী দ্বিতীয় পক্ষ। সে এক বিতিকিচ্ছিরি ব্যাপার হবে।

তো নয়াবউ তাঁর ভাইপোদের বিয়েতে যাবেন বাপের বাড়ি, সে এক উৎসব। তাঁর সঙ্গে এটা ওটা পাঠাতে হবে। কুটুমবাড়ির নানা তত্ত্বতাবাস। এত বড় বাড়ির বউ, কেউ কিছু ‘তিরুডি’ না ধরে। যাত্রামঙ্গল হয় দিনক্ষণ তিথি নক্ষত্র দেখে। তারপর নয়াবউ তাঁর পুষিপোনা, কাখেরডি কোলেরডি সমেত পিছারার খালের ঘাটের থেকে নৌকোয় চাপেন। যেন তাঁর ‘ছুরাত’ ইতরজনের নজরে না আসে। সে এক সময় গেছে। বাড়ির আভিজাত্য তখন তিনতলার ছাদ ছাড়িয়েও প্রায় বারো হাত উঁচু। সে কারণে যাত্রাকালে পুরোহিত মন্ত্র হাঁকেন–ধেনুর্বৎস্যা প্রযুক্তা পুষ্পমালা পতাকা, তার পরেই যাত্রা শুরু হয়।

সেইসব দিন গত হলে একটা সময় আসে যখন ‘ভদ্দরলোক’ হিন্দুর ‘মাইয়া মাইনষের বেয়াক ছুরাত, বেয়াকের দ্যাহা শ্যাষ’। তখন দাঙ্গার কাল, হোগাউদ্‌লা মাথায় ঘোমডার সময়। কিন্তু আমাদের বাড়ি তো বড়বাড়ি, জমিদারবাড়ি। গ্রাম-গাঁয়ের মানুষেরা বলে জমিদার। তখনও ঠাটবাট, সোয়া হাত জুতা ইত্যাকার অনুষঙ্গ লোপ পায়নি পুরোটা। তখন যদি সোনাবউ, বড়বউ বা কোনো মহিলার বহির্গমন প্রয়োজন হয় তবে তাদের ‘ছুরাত’ সাধারণ্যে প্রকাশ সংগত হয় না। কেন?—না, ‘ছোডোলোকেরা য্যান হ্যারগো ছুরাত না দ্যাহে’ এরকম একটা মানসিকতা।

এইসব কথাই পিছারার খালের কথা। কিন্তু সে কথা এতই পুরনো আর বাসি হয়ে গেছে যে তাতে কারওরই আর প্রয়োজন নেই। এখন সে পিছারার খালও নেই, খালের ঘাটও নেই। নেই সেই বউরাও, যারা ওই ঘাট থেকে নৌকোয় চড়ে নৌকোর ছাউনির ফোকর দিয়ে খালের দুধারের আশশেওড়া, নলখাগড়া, হোগলা, ছৈলা ইত্যাকার উদ্ভিজ্জ দেখতে দেখতে বড় খালে গিয়ে পড়ত। বড় খালে পড়ে তাদের বিস্তৃতি হতো। সেই বড় খালের পারে ছিল এক জোড়া রেনট্রি। যাদের কথা ক্রমান্বয়েই আসতে থাকবে। এই খাল এবং এই বৃক্ষ নিয়েই তো এই আলেখ্য।

কিন্তু সেইসব বউয়েরা আজ আর নেই। জীবন সেখানে কেবল কিছু অসমাপ্ত স্বপ্নের ছাই ছড়িয়ে রেখেছে। এমনকি তাদের অস্থিকণাও সেখানে নেই। থাকবে কী করে? তাদের দেহ কি সেই ভূমিতে সৎকার হয়েছে? তারা কোথায় কোন বিদেশ বিভুঁইয়ের রেললাইনের পাশে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা কোন কুঁড়েঘরে অথবা কোনো বস্তির কোন অন্ধকার ঘরে, কিংবা দণ্ডকারণ্য বা আন্দামানের কোন অপরিচিত আকাশের নিচে অপরিচিত ভূমিতে তাদের দেহশেষ মিলিয়ে গেছে তার কি কোনো খোঁজ আছে? অথচ এইসব সোনা, ছোট বা বড়, মেজ, সেজ, ন’বউদের তো কথা ছিল চন্দনকাঠের চিতেয় চড়ে ‘সগে’ যাবার। কপালের নির্বন্ধ সেই সৌভাগ্য থেকে ‘ভাগ্যিমানী’ বউগুলোকে বঞ্চিত করলে তাদের অস্থি আর কোথায়ই-বা পাওয়া যাবে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *