বিষাদবৃক্ষ – ১৯

উনিশ

দাদিআম্মার প্রচেষ্টায়ই একসময় আমি স্কুলে ভর্তি হতে পারি। সন্তানদের পড়াশোনা করানো যে অভিভাবকদের একটা বিশেষ দায়িত্ব তা শুধু আমার বাবা-জ্যাঠামশাই নন, পিছারার খালের আশপাশের বেবাক হিন্দু অভিভাবকরাই তখন বিস্তৃত হয়েছেন। যাঁদের কিছু সহায়সম্পদ ছিল, তাঁরা গয়ং গচ্ছ করে হলেও তাঁদের ছেলেদের স্কুলে পাঠাতেন। মেয়েদের নয়। কেননা একে তারা মেয়ে, তদুপরি স্কুল তিন ক্রোশ দূরের পথ। স্কুলের কাছাকাছি যাঁরা থাকতেন, তাঁরা কেউ কেউ পাঠাতেন তাদের। বিষয়টা নির্ভর করত তাঁদের সামর্থ্যের ওপরও। তবে এ সময় একটা ব্যাপার দেখেছি যে, মুসলমান সাধারণ চাষি গেরস্তদের মধ্যে লেখাপড়া শেখার একটা তীব্র আকর্ষণ সৃষ্টি হয়েছিল। এর কারণ অবশ্যই সাময়িকভাবে তাদের আর্থিক উন্নতির মধ্যে নিহিত ছিল, যে আর্থিক উন্নতি চলে যাওয়া হিন্দুদের সম্পত্তি থেকেই তারা অর্জন করেছিল। তখন আমাদের এলাকার বড় স্কুলটি বন্ধ হয়ে গেছে। বক্সিমশাই দেশছাড়া। এই সময়টায় মুসলমান গ্রামগুলোতে স্কুল প্রতিষ্ঠার একটা হিড়িক পড়ে যায়। কিন্তু সর্বাঙ্গসুন্দর, সর্ব আয়োজনে সমৃদ্ধ আমাদের রাজমোহন ইনস্টিটিউশনটি তার বিস্তীর্ণ এলাকা নিয়ে, একটি মজে যাওয়া প্রাচীন দিঘির কিনারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ক্ষয় পেতে থাকে। তার জানালা কপাট, টেবিল চেয়ার, ব্ল্যাকবোর্ড, বেঞ্চি, আলমারি এবং সমগ্র বইপত্তর অরক্ষণীয় যুবতীদের মতোই লুট হতে থাকে। কেউ কেউ তা সংরক্ষণের প্রচেষ্টা চালায় বটে, কিন্তু যেখানে জনবসতি নেই, গ্রামগুলো শূন্য, সেখানে কীভাবেই-বা এর সংরক্ষণ সম্ভব হয়? এর চাইতে যদি মুসলমানসমাজ উপযুক্ত নেতৃত্বে এইসব দখল করে স্কুল, ছাত্রাবাসের প্রচেষ্টা করতেন, তবে চিত্রটি অন্যরকম হতো।

.

আজ ভাবতে অদ্ভুত লাগে, এই স্কুলেই আমি পাঠশালা বিভাগে প্রথম স্কুলজীবনের আস্বাদ পাই। পিছারার খালটির ধার ধরে অনেকটা মেঠো পথ। এবাড়ির পেছন ওবাড়ির ফুলবাগানের পাশের রাস্তা, এই সাঁকো, ওই কাঠের ব্রিজ পেরিয়ে ঘন বৃক্ষশ্রেণির মাঝের রাস্তাটি ধরে আমরা শ্লেট, আদর্শলিপি অথবা তালপাতা, ভুসোকালির দোয়াত আর কঞ্চি আর ‘খাগের কলম নিয়ে ঘাড় কাত করে পাঠশালায় যেতাম। আমাদের পাঠশালার গুরুমশাইয়ের নাম ছিল ধলুমশাই। নামকরা কীর্তনীয়া। তাঁর বড় ভাইও একজন গুরুমশাই ছিলেন, নাম কালুমশাই। কালুমশাই ছিলেন গোলগাল তৈলচিক্কন দেহ, মাথায় কোঁকড়ানো বাউরি চুল, গলায় তুলসীর মালা। তিনি আমাদের গুরুমশাই ছিলেন না। তিনিও কীর্তন গাইতেন, কিন্তু তাঁর দল ছিল না। তিনি ‘মা-দাদা’ সম্প্রদায়ের শিষ্য ছিলেন, যাঁরা স্ত্রী-পুরুষে একে অন্যকে মা এবং দাদা বলে সম্বোধন করতেন। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেও এই সম্বোধন প্রচলিত ছিল। আমাদের ওখানের অনেক জমিদারবাবুও এই সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন। কীর্তন করার সময় তাঁরা একে অন্যকে সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করতেন তা দেখেছি। এ নিয়ে আমাদের পিছারার খালের সাধারণ মনুষ্যরা নানান রঙ্গও করত। সহধর্মিণীকে মা বলে এবং স্বামীকে দাদা বলে তাঁরা যে রকমভাবে বিভোর হয়ে পরস্পরকে সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত করতেন তা এক দেখার ব্যাপার ছিল। যা হোক, ধলুমশাই শুধু কীর্তন গাইতেন আর গুরুমশাইগিরি করতেন। তাঁরও গলায় ছিল তুলসীর মালা, বর্ণ-শুভ্র অর্থাৎ ‘ধলা’। পদাবলি গাইতেন তিনি। তাঁর কীর্তনের দলকে সবাই খুব খাতির করত। স্কুলটি বন্ধ হয়ে গেলে মশায় শুধু পদাবলি কীর্তনকেই পেশা করে নেন। আজও তাঁর নিমাইসন্ন্যাস, নৌকাবিলাস, মাথুর এবং অক্রুর সংবাদ পালা গাওয়ার স্মৃতি অম্লান হয়ে আছে। এখনও চোখ বুজলেই তাঁর মূর্তিটি মনে পড়ে। মশাই খানিকক্ষণ বসে বসে আহুম উহুম করে একসময় কাঁধের গৈরিক উত্তরীয়খানা সুন্দর বিন্যাসে দুদিকে লম্বিত করে উঠে দাঁড়িয়ে গাইতে শুরু করতেন

আহা চাঁচর কেশের চিকন চূড়া
সে কেন বুকের মাঝে।
বঁধু সিঁদুরেরও দাগ আছে সৰ্বগায়
মোরা হলে মরি লাজে ॥

এ বাণী কলঙ্কভঞ্জন না মানভঞ্জনের সে কথা আজ আর মনে নেই। তবে ‘মশাই’ বড় মধুর গাইতেন এইসব পদ। তিনি আরও গাইতেন এবং নাচতেনও এইসব পদ গেয়ে, যেমন—

কুটিল নয়নে কহিছে সুন্দরী
অধিক করিয়া ত্বরা।
তখন কহে চণ্ডীদাস আপন স্বভাব
ছাড়িতে না পারে চোরা।

এরকম এক পরিবেশে শৈশব শুরু হয়ে যখন ‘নারায়ে তকবির আল্লাহু আকবর’-এর মতন অন্য এক কীর্তনের সুর ভয়াবহ দাঙ্গার বাণী হয়ে কানে পৌছোল, তখন ধলুমশাইয়ের সুললিত উচ্চারণের এই বাণীগুলো—

পিরীত পিরীতি      সবজনে কহে
পিরীতি সহজ কথা।
বিরিখের ফল       নহে গো পিরীতি
নাহি মিলে যথা তথা-      ইত্যাদি

ধূল্যবলুণ্ঠিত বলে বোধ হতে থাকল।

নারায়ে তকবির আল্লাহু আকবর এবং মুসলিম লিগ জিন্দাবাদ, পাকিস্তান জিন্দাবাদ এইসব ধ্বনি শুনলেই তখন দাঙ্গার আতঙ্ক আমাদের মনের মধ্যে বিস্তৃতি পেত। একদল ‘আল্লাহু আকবর’ আর অন্য দল ‘হরহর মহাদেব’ বলেই আজও দাঙ্গা করে, কিন্তু কবীরের দোঁহা, চণ্ডীদাসের পদাবলি বা লালনের মরমিয়া সংগীত ইত্যাকার তাবৎ বৈভব উভয় দলই এখনও চোখের জলে বুক ভাসিয়ে শোনে। এ এক প্রগাঢ় বিস্ময়।

স্কুলের কথা বলতে গিয়ে এত আশপাশ-কথা গাইলাম। মূল কথায় ফিরি। দাদিআম্মা আমার পড়াশোনার বিষয়ে বড়ই পীড়াপীড়ি শুরু করলেন। আমি একদিন পাশের গাঁয়ের এক মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে দেখা করি। দাদিআম্মাদের গ্রামে একটি নতুন স্কুল খোলা হয়েছে। তিনি সেখানকার একমাত্র হিন্দু শিক্ষক। তখনও স্কুলে একজন সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত রাখার রীতি প্রচলিত ছিল। মৌলবি তো একজন থাকতেনই। সে কারণে এবং জাত্যংশে ব্রাহ্মণ বিধায় মহাশয় ওই স্কুলের পণ্ডিত। কিন্তু সংস্কৃত কখনোই তাঁর বিষয় ছিল না। একমাত্র পুরোহিত দর্পণ বা নিত্যকর্ম পদ্ধতি পর্যন্তই তাঁর গতায়াত ছিল, কারণ পৌরোহিত্য ব্যবসায়ের তাঁর আহারাদির আহরণ প্রধানত চলে এসেছে। ম্যাট্রিক পাস। কিন্তু ইংরেজি বাংলা ইত্যাদি নিচু শ্রেণির ছাত্রদের শিক্ষা দেবার যোগ্যতা অবশ্য তাঁর ছিল। এ কারণে কখনো কখনো তিনি পাঠশালা খুলে বসতেন এবং আমরা প্রায় শূন্য গাঁয়ের অবশিষ্ট হিন্দু বালক, বালিকারা তাঁর কাছে গাণ্ডা বাঁধাতাম। তবে সে পাঠশালার আয়ু আদৌ দীর্ঘ হতো না। তাঁর নাম পাঁচুঠাকুর। সম্ভবত ওই নাম-মাহাত্ম্যেই পাঠশালাটি বড় ঝটিতি ‘পেঁচোয় পাওয়া’ রোগে মরে যেত।

মাস্টারমশাই দাদিআম্মার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। কী যেন এক গূঢ় কারণে তাঁর কুটিরে প্রায়শই তিনি যেতেন। এই গূঢ় কারণটি একসময় আমার কাছে প্রকাশ পায় এক অসাধারণ ঘটনায়। একদিন আমার তখনকার স্বাভাবিক নিয়মমতো দাদিআম্মার বাড়িতে দুপুরে খাওয়ার সময় গিয়ে দেখি ব্রাহ্মণটি যবনীগৃহে ফলারে রত। মহাশয়ের পাঠশালায় ইতিপূর্বে শিক্ষার্থী ছিলাম বলে সেইক্ষণে তাঁর এবং আমার সাতিশয় অস্বস্তিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়। দাদিআম্মা অবশ্য আমাকে কায়দা করে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে গিয়ে ব্রাহ্মণের ফলারের অস্বস্তি তখনকার মতো মিটিয়ে দেন, কিন্তু আমরা পরস্পর পরস্পরের কাছে ধরা পড়েই যাই। আর সে কারণে আমার সমস্যার সমাধান বেশ খানিকটা সহজই হয়। দাদিআম্মার কথামতো স্কুলে ভর্তি হবার ব্যাপারে যখন তাঁর বাড়িতে যাই তখন পরস্পরের মধ্যে একটা অলিখিত চুক্তি থাকেই যে, আমরা কেউই কারও যাবনিক অনাচার বিষয়ে স্বসমাজে কিছু বলব না। মিথ্যে বলব না, মাস্টারমশাই তাঁর কথা রক্ষা করেছিলেন অক্ষরে অক্ষরে। অর্থাৎ গ্রামীণ স্বাভাবিক নিয়মে আমার জ্যাঠামশাই বা বাবার কানে মদীয় যাবনিক খাদ্য গ্রহণাদির বিষয়ে কখনো কিছু বলেননি। আমিও ওই ব্রাহ্মণের ফলারজনিত গূঢ়কর্ম বিষয়ে এই কেতাব লেখার আগে পর্যন্ত সাধারণ্যে বাঙ্ময় হইনি। বিষয়টি গুরুত্বহীন হয়ে যাওয়ায় এতকাল পরে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ হলো। তবে মহাশয়ের ওপর কিছু কিঞ্চিৎ দরকষাকষি যে সে সময় করিনি, সে কথা হলপ করে বলতে পারব না। কিন্তু তা খুব একটা নৈতিক কর্ম ছিল না বলে বিশদে যাচ্ছি না।

দাদিআম্মার সঙ্গে তাঁর যে গূঢ় ব্যবস্থাপনাটি ছিল এবং যে কারণে এই ব্রাহ্মণ তাঁর কুটিরে প্রায়শই ফলার করতেন এবং দক্ষিণাটি গ্রহণান্তর স্বস্তিবচন উচ্চারণ করে সিধেটি ঝোলায় পুরতেন তার তাৎপর্য কী? সেটিও একসময় আমার কাছে প্রকাশ পেল। কীর্তিনারায়ণের সংস্কার দাদিআম্মার রক্তে তখনও বহমান। যৎকিঞ্চিৎ হলেও তিনি এই ব্রাহ্মণকে কিছু ‘সিধা’ দিতেন। ব্রাহ্মণও প্রকৃত ইতিহাসটি জানতেন বলে তা গ্রহণে দ্বিধা করতেন না। এ ক্ষেত্রে অভাবজনিত লোভ এবং পরম্পরার প্রকোপ উভয়ই কার্যশীল ছিল।

.

অতএব, এইসব কার্যকারণে আমার ওই স্কুলে যাওয়ার পথে আর কোনো বাধা থাকে না। স্কুলটি তখন সবেমাত্র ভূমিষ্ঠ হয়েছে। ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা নিতান্তই অপ্রতুল। মুসলমান-প্রধান গ্রাম, অতএব ছাত্ররা ফসল কাটার পর সংখ্যায় যত থাকে চাষের মরশুমে তত থাকে না।

সে সময়ে আমার অভিভাবকেরা সবে তালুকদারি হারিয়ে এটা-ওটা বিক্রি করে খাচ্ছেন এবং এক অবশ্যম্ভাবী চোরাবালির গভীরে নিমজ্জিত হচ্ছেন। আমি তখন মোটামুটি বুঝতে শেখা এক কিশোর। কিছু বাংলা, কিছু ইংরেজি এবং সামান্য কিছু গণিত নিজের চেষ্টায় আয়ত্ত করেছি। তাতে খুব জোর ক্লাস সেভেনে ভর্তি হওয়া যায়। বাড়িতে প্রচুর বই ছিল। ছোটবেলা থেকে খাপছাড়া পড়াশোনা এবং স্কুলের নিয়মে না থাকার জন্য ওইসব বই ছিল আমার সঙ্গী। কিন্তু ওইসব বইয়ের মধ্যে বেশিরভাগই ছিল ধর্মগ্রন্থ আর নাটক-নভেল। সবই বয়স্কদের পাঠ্য। আমার তখন স্বাভাবিক স্কুলীয় ধারায় পড়াশোনা করতে না পারার গ্লানি আর অশান্তি এতই প্রকট যে, ওইসব পুরাণ, ধর্মগ্রন্থ এবং নাটক-নভেলগুলো গোগ্রাসে গেলা ছাড়া অন্য কোনো উপায়ই ছিল না।

বলা বাহুল্য এসবের অধিকাংশই বুঝতাম না। গল্পের আকর্ষণে পড়ে যেতাম শুধু। আবার এর মধ্যে কিছু কিছু বই পড়া বিষয়ে বাবার নিষেধও ছিল। ক্ষীরোদ বিদ্যাবিনোদের নাট্যকাব্য, গিরিশ গ্রন্থাবলি, নারায়ণচন্দ্রের গ্রন্থাবলি, অমর গ্রন্থাবলি, ভাগবত, কালি সিংগির মহাভারত, বাঁধানো ‘প্রবাসী’, ভারতবর্ষ, বঙ্গবাণী এবং ইত্যাকার তাবৎ গ্রন্থ, যা আমার—ওই বাড়িতে তখনও যথেষ্ট মজুত ছিল—তা পড়া চলবে না এরকম একটা নিষেধাজ্ঞা আমার ওপর ছিল। খুব সংগত কারণেই আমি তা মানতে পারতাম না এবং লুকিয়ে লুকিয়ে পড়তাম। দরদালানের এক কোনে বসে এইসব নিষিদ্ধ গ্রন্থ পাঠকালে যদি হঠাৎ বাবার আবির্ভাব ঘটত আমি চটজলদি বইখানা পাছার তলায় চালান করে দিয়ে তার ওপর বসে থাকতাম। এরকম বেশ কয়েকবার হয়েছে যে, পিতৃদেব সন্দেহক্রমে আমাকে উঠে দাঁড়াতে আদেশ দিতেন এবং আমি বমাল ধরা পড়ে গিয়ে তাঁর কাষ্ঠপাদুকার যথেচ্ছ প্রহার অঙ্গে ধারণ করেছি। তাতে যে আমার ঈদৃশ কুকর্ম আদৌ বন্ধ হতো, তা নয়। বাবা যে কী কারণে আমাকে ওইসব গ্রন্থ পাঠ করতে নিষেধ করতেন তাও বুঝতে পারতাম। তখন আমার যা বয়স, সে বয়সে মহাভারত, ভাগবতের মতো গ্রন্থ পাঠ করার আকাঙ্ক্ষা একটা কারণেই ঘটে, তা হচ্ছে যৌনতা সম্বন্ধীয় বিবরণ, যা ওইসব গ্রন্থে ব্যাপক লভ্য। সত্যি বলতে কি ভাগবতবর্ণিত রাজা পুরঞ্জয়ের স্ত্রীচিন্তনবিষয়ক আলেখ্য, তাঁর স্ত্রীত্ব প্রাপ্তি অথবা মহাভারতে ঈদৃশ নানান আখ্যায়িকাংশই আমি খুব মনোযোগ সহকারে পড়তাম। তবে সেটাই এইসব পড়ার একমাত্র কারণ ছিল না। প্রাচীন সাহিত্য এবং পুরাণাদি পাঠ এখনও আমার একটা নেশা বটে।

আগেও বলেছি যে, আশপাশ গ্রামের ছেলেরা যখন স্কুল-মাদরাসায় যেত, আমার অসম্ভব হিংসা হতো, অপমানবোধ হতো। সবাই স্কুলে যায়, আমি যেতে পারি না, সবাই কেমন রাত জেগে বা ভোর রাতে উঠে পড়ে, আমি পড়তে পারি না। ওদের জীবন কেমন সুখময়, আমার জীবনে সুখ নেই, সদাসর্বদা এই ছিল আমার কষ্ট। নিজের চেষ্টায় কোনো একটা কিছু লিখে যদি বাবাকে দেখাতে যেতাম, বাবা প্রথমে অত্যন্ত উদাসীন ভাব দেখাতেন, পরে লেখাটির বিষয়ে এমন সব মন্তব্য করতেন যে আর দ্বিতীয়বার তাঁকে কিছু দেখাবার আগ্রহ থাকত না। যেমন ইংরেজির লেখায় কিছু ভুল থাকলে বলতেন, এটা গরু চরানো বা হালচাষ করা নয়, এসব যত্ন করে শিখতে হয়। গরু চরানোটা তখন আমার কর্তব্যকর্ম ছিল। যদিও হালচাষটা রপ্ত হয়নি। তবে এইসব কাজকে বাবা বা জ্যাঠামশাইয়েরা হীন কর্ম বলে ব্যঙ্গ করলেও তার অধ্যয়নও যে যত্ন করেই করতে হয় এবং তা যে ইংরেজি শেখার চাইতে আদৌ সহজ নয়, সে জ্ঞান আমার হয়েছিল। হালচাষ না করলেও কৃষিবিষয়ক অনেক কাজই আমি এবং আমার পরের ভাইটা বেশ যত্ন এবং পরিশ্রম করে শিখেছিলাম বলে অভাবের দিনগুলোতে সবাই কিছু খেতে পেতাম।

বাবার এই ধরনের বাক্যবাণে খুবই হতোদ্যম হয়ে ভাবতাম, আমার এরকম দুর্দশা কেন? আমাকে কেউ কিছু শেখায় না কেন? কিন্তু সব অবহেলা তুচ্ছ করে একসময় নিজে নিজেই ইংরেজি ভাষাটা খানিক রপ্ত করতে পেরেছিলাম।

.

মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে দাদিআম্মাদের গ্রামের স্কুলে ভর্তি হতে যাওয়ার আগের দিন সন্ধ্যায় মাকে একা কথাটা জানালাম। বাবা বা জ্যাঠামশাইকে কিছু বললাম না। মা বলেছিলেন, মাস্টারমশাইয়ের লগে যাবি হেথে আপত্তির কিছু থাকতে পারে না। তয় ভাসুর ঠাকুর যদি রাইগ্যা যায়েন—। আমি বললাম, বাবার মতামতটাই এখন আমার দরকার। জ্যাঠামশাইয়ের মতামত বা রাগারাগি নিয়ে আমি আর ভাবি না। মা বাবাকে বলেছিলেন, বাবা অমত করেননি, শুধু বলেছিলেন, কিন্তু আমার যে পয়সা নাই। মাস্টারমশাই বলেছিলেন, “ঠিক আছে দেখি কী করণ যায়। আসলে পোলাডার এহন স্কুলে যাওন আবইশ্যক।’ আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। কারণ বাবা মত দেবেন এরকম বিশ্বাসও আমার ছিল না।

দুরুদুরু বক্ষে পরের দিন মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে স্কুলে গিয়ে হাজির হলাম। যাবার পথে দাদিআম্মাকে প্রণাম করে গেলাম। তিনি গায়-মাথায় হাত বুলিয়ে হাজার দোয়াদরুদ আশীর্বাদ জানালেন। আমার পরনে ছিল কোরা মার্কিন কাপড়ের দড়িভরা ইজের এবং সেই কাপড়েরই একটি জামা বা পিরান। মায়ের হাতে তৈরি। ‘হেম’ সেলাই দিয়ে। জুতো পায়ে দেয়া আমাদের গাঁয়ের বাড়িতে রীতি নয়, তা ছাড়া আমার তা ছিলই না। শুধু বাড়ির মধ্যে খড়ম পরা বিধি। আমরা ডাঙরকাল অবধি উপানহ বিযুক্ত। এরকম এক দীন বেশে কার্তিক মাসের এক এক পূর্বাহে মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে যখন স্কুলে পৌঁছোলাম তখন সেখানে পাঠ আরম্ভ হওয়ার আগের অনুষ্ঠান জাতীয় সংগীত শুরু হয়ে গেছে। ছাত্রছাত্রীরা সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে গাইছে—

পাকিস্তান জিন্দাবাদ, পাকিস্তান জিন্দাবাদ
পাকিস্তান জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ।
পূরব বাংলার শ্যামলিমায়
পঞ্চনদীর তীরে অরুণিমায়
ধূসর সিন্ধু মরু সাহারায়
ঝান্ডা জাগে যে আজাদ।

তার মধ্যে ‘প্রাচ্য প্রতীচ্যের মিলন গাহি, যমুনা বহে যে উজান।’—এইসব পদও ছিল।

এরকম অভিজ্ঞতা আমার কাছে সম্পূর্ণ নতুন। আমি মুগ্ধ চোখে এবং শ্রবণে এই অপূর্ব অনুষ্ঠানটি অন্তর দিয়ে গ্রহণ করেছিলাম। মাস্টারমশাই ফিসফিস করে কানের কাছে বলছিলেন, শ্যাহেগো দ্যাশ, এহানে থাকতে অইলে এইসব কৈলম করণ লাগবে, বোজছো?—কিন্তু ব্যাপারটি আমার এত ভালো লাগছিল যে, মাস্টারমশাইয়ের কথা আমার মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করল না। বরং এই ভেবে আমি উত্তেজিত বোধ করছিলাম যে, এখন থেকে আমিও রোজ এরকম একটি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে পারব। এই গানটি কে রচনা করেছিলেন তা আজ আর মনে নেই। তবে এই গানের কবি পূর্ব পাকিস্তান কথাটির ব্যবহার না করে ‘পূরব বাংলা’ কথাটি ব্যবহার করেছিলেন এবং হিন্দু-মুসলিমের মিলনের বাণীও এর মধ্যে ছিল। কী কারণে জানি না বছর দু-তিনের মধ্যে গানটি পাকিস্তানে পরিত্যক্ত হলো এবং তার স্থলে এলো একটি উর্দু জাতীয় সংগীত। জেনারেল প্রেসিডেন্ট মহ. আইয়ুব খান সাহেবের হুকুমে সেটিই বাধ্যতামূলক হলো। আমরাও তার অর্থ, সুর কিছুই না জেনে-বুঝে গাইতে শুরু করলাম—

‘পাকসার জমিন সাদবাদ
কিসওয়ারে হসিন সাদবাদ
কওমে মুলকে সুলতানাত
পায়েন্দাতা বিন্দাবাদ
সাদবাদ মঞ্জিলে মোরাদ।
পরছামে সিতারা হেলাল
রাহেব্বারে তরাক্কি ও কামাল
তু নিশানে আজমে অলিমান
আরজে পাকিস্তান
সয়ায়ে খুদায়ে জুল জালাল।

একটা সময় অবশ্য তার সুরের হদিশও হলো, কিন্তু প্রথম সংগীতটি ছাত্রদের হৃদয় এতই বেশি অধিকার করে বসেছিল যে, স্কুলে বাধ্যতামূলকভাবে নিয়মরক্ষা করা ছাড়া দ্বিতীয় সংগীতটির কোনো আবেদন বা প্রভাবই থাকল না। কিন্তু প্রথমোক্ত সংগীতটি বহুকাল আমরা ঘাটে মাঠে বাটে গিয়ে বেড়াতাম। তার মধ্যে আমরা যে প্রাণের ছোঁয়া পেয়েছিলাম, পাকসার জমিন সাদবাদ-এর মধ্যে তা পাইনি, যদিও একসময় তার অর্থটি আমাদের বোঝানোও হয়েছিল। ফলত, এই দুটি জাতীয় সংগীত নিয়ে একসময় ছাত্রসমাজ বনাম ফৌজি সরকারের মধ্যে এক দ্বন্দ্বযুদ্ধ বেঁধে যায়। তখন কিছুদিনের জন্য দুটি গানই জাতীয় সংগীত হিসেবে মর্যাদা পায় বটে কিন্তু একসময় ‘পাকসার জমিন’ই স্থায়ী হয় এবং আমাদের ওই প্রিয় গানটি বিস্মৃতিতে বিলীন হয়ে যায়।

স্কুলের হেডস্যারের নাম হাতেম মাঝি। সাদা কুর্তা, সাদা লুঙ্গি, সাদা প্রলম্বিত দাড়ি, বর্ণ উজ্জ্বল গৌর। ‘মাঝি’ উপাধির পক্ষে আদৌ মানানসই নয়। শান্ত সৌম্যভাব। মাস্টারমশাই আমাকে তাঁর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলে আমি জনাবকে প্রণাম করলাম। তিনি বললেন, তোমার আব্বাজানরে আমি জানি। একসময় আমরা পরস্পর বন্ধুমানুষ আছিলাম। অনেক দিন দেহাসাক্ষাৎ নাই। তেনায় আছেন কেমন? বললাম যে, তিনি জানেন, আপনি এখানে আছেন। আমাকে বলেও দিয়েছেন যে, ওঁকে আমার কথা বলিস। স্যার বললেন, এ কারণেই তোমার পেনাম আমি লইলাম। তয় জানবা, এছলামে সিজদা একমাত্তর আল্লারে ছাড়া আর ক্যাওরে করন যায় না। আমি তখনও ইসলামের রীতকানুন বিশেষ কিছুই জানি না। তাই জিজ্ঞেস করলাম—গুরুরেও না?—স্যার বললেন, পবিত্র কোরান শরিফে আল্লাহতালা স্বয়ং আমাগো নবিরে ফরমাইছেন, লা হুকমা ইল্লাহ লিল্লাহ। অর্থাৎ আল্লাহর শরিক নাই। তিনি লা শরিক। গুরু বা ওস্তাদ তেনার শরিক অইতে পারেন না। আমরা বেয়াকেই তেনার বান্দা। বান্দাগো মইদ্যে উঁচা-নিচা থাহন গুনাহ। হে কারণ এক বান্দা অইন্য বান্দার এবাদত করতে পারে না। আমি তখন, আমার বয়স সামান্য হলেও, নিজস্ব শিক্ষাবলে তাঁকে আবার বলি, স্যার, আমার বাবায় রোজ সকালবেলায় যে মন্তর কয়েন, হেই মন্তরই আমি এতকাল জানইয়া আইছি। আমার বিশ্বাস আর শিক্ষা হেই মন্তরেই আছে। হেনায় রোজ ভোরবেলা উডইয়া আওড়ায়েন—

অজ্ঞান তিমিরন্ধস্য জ্ঞানাঞ্জশলাকয়া
চক্ষুরুম্মিলিতং যেন তস্মৈ শ্রীগুরবে নমঃ।
অখণ্ডমণ্ডলাকারং ব্যাপ্তং যেন চরাচরম
তদ্‌পদম দর্শিতম যেন তস্মৈ শ্রীগুরবে নমঃ ॥

-আমার মায় বা বাবায় একমাত্তর হেনাগো গুরু ছাড়া আর ক্যাওরে মান্যতা দেন না। তয় গুরুস্থানীয় বেয়াকেরেই স্যাবা দেন।

স্যার বললেন, হে কারণেই তোমার পেনাম আমি লইলাম। জানি না, এডাও এট্টা গুনাহ করলাম কিনা। তয় তুমি মোছলমানের পোলা অইলে এ পেনাম আমি লইতাম না। ক্যান? না—এছলামে এমতো বিধি নাই। আমরা আমাগো নবি হজরত মুহাম্মদ (দ.)-রেও পায়ে হাত দিয়া পেনাম করতে পারি না। ক্যান? না হেনায় নবি অইলেও আদমজাত। আল্লা না। তেনারে বা অন্য ওস্তাদ-স্থানীয় পির-দরবেশগো আমরা আডু ছুঁইয়া তসলিম করতে পারি, পেন্নাম করতে পারি না। স্যারকে আমার আরও অনেক কিছুই বলার ছিল। আমি বলতে পারতাম, দেখুন, আমার বাবা নানান মন্ত্রোচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে ‘তস্মৈ শ্রীগুরবে নমঃ’ এই বাক্যাংশটি উচ্চারণ করে থাকেন। তিনি বলেন –

তোর অতীতগুরু পতিতগুরু
গুরু অগণন
গুরু বলে কারে প্রণাম করবি মন?

সে অর্থে প্রতিটি বস্তুকে, ব্যক্তিকে, স্থান, কাল, পাত্রকে এমনকি প্রতিটি রজঃকণাকে আমাদের প্রতিনিয়ত প্রণাম জানাতেই হয়। কেননা আমরা প্রতিটি পদার্থেই ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ করতে চাই। তাঁকে তাঁর সৃষ্ট জগৎ থেকে আলাদা করে ভাবতে পারি না। তিনিই তো এসবের মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করছেন। অবশ্যই এই ব্যাখ্যা অথবা চিন্তন আমার সেই সময়কার পারিবারিক প্রভাবের ফল। কিন্তু স্যারের বক্তব্য সম্পূর্ণতই এই বোধের বাইরের এক চিন্তন, যার সঙ্গে আমার সম্পর্কের সবেমাত্র শুরু। ইসলামিক আচার-আচরণের তখনও কিছুই জানি না।

আমি সেসব কিছুই তাঁকে বললাম না। শুধু বললাম যে, আমি এছলামে শরিক হইনি। আমি জেনেছি গুরু নররূপী ঈশ্বর। আপনি এক্ষণে আমার গুরু। আমি আপনাকে ‘সেজদা’ করবই। আপনি দয়া করে তা কবুল করুন এবং আমাকে দোয়া করুন। স্যার তখন চোখ বুজে আমার কথা শুনছিলেন। তাঁর দুচোখের কোল বেয়ে কী কারণে জানি না অশ্রুপাত হচ্ছিল। বোধকরি তাঁর আচার ও ধর্মীয় বিশ্বাসের সঙ্গে আমার অনুষ্ঠেয় আচারের ভিন্নতা তাঁকে এক দার্শনিক সংকটে ফেলেছিল। তথাপি সেই বৃদ্ধ আমার সর্বশরীরে তাঁর করস্পর্শ সঞ্চালনে আমাকে আশীর্বাদ করে বলেছিলেন, তোমার তালেব এলেম পোক্ত অউক। তুমি আল্লাহপাকের নেকনজর লাভ করো। তোমার বালামুসিবত দূর হউক। এবং এভাবেই আমি ওই স্কুলে গৃহীত হলাম। সকলেই আমাকে খুবই স্নেহের সঙ্গে গ্রহণ করলেন।

তখন বাৎসরিক পরীক্ষার আর এক মাস বাকি। নভেম্বর মাস। ডিসেম্বরে ফাইনাল পরীক্ষা। তখনকার দিনে নিয়ম এরকমই ছিল। ফাইনাল পরীক্ষার এক মাস আগে স্কুলের খাতায় আমার নাম তোলা হলো। ভর্তির জন্য আমার অভিভাবকদের কোনো টাকাপয়সার লেনদেনে পড়তে হলো না। এ ব্যবস্থা একমাত্র সে যুগেই সম্ভব ছিল। ক্লাস সেভেন। এক মাস বাদে পরীক্ষা। আমার বই, খাতাপত্তর কিছু নেই। অথচ আমি পরীক্ষা দেব। আমার বাবা-জ্যাঠামশাইয়ের কাছে আমার কোনো প্রত্যাশা নেই। অতএব এক অমানুষিক পরিশ্রম করে আমাকে পরীক্ষা দিতে হলো। বইপত্র কীভাবে সংগ্রহ করেছিলাম তার অনুপুঙ্খ আজ আর স্মরণে নেই। পরীক্ষায় তথাপি তৃতীয় স্থানাধিকারী হলাম। বাড়িতে এসে প্ৰায় বুক ফুলিয়ে বাবাকে বলেছিলাম, আমি থার্ড হয়েছি। বাবা বললেন, ক্লাসে বুঝি তিনজন ছাত্র?

জ্যাঠামশাই দরদালানে আনমনা পায়চারি করছিলেন। তিনি তাঁর ভাইয়ের কাছে জানতে চাইলেন, ও কি ওই মিঞাগো ইস্কুলে শ্যাষ পর্যন্ত ভর্তি অইলে? ও তো একছের গোল্লায় যাওনের রাস্তা লইছে দেহি। তুমি তো ওরে কিছুই শাসন করো না। ও কিন্তু এ বাড়ির মান-ইজ্জতটাও রাকবে না। বাবা কিছু উত্তর করলেন না। জ্যাঠামশাই বলতে লাগলেন, ল্যাহাপড়া সবাইর অয় না। যারগো হওনের হ্যারগো তো ব্যবস্থা করইয়াই দিছি। হ্যারা হিন্দুস্থানের শিক্ষাদীক্ষা পাইতাছে, কইলকাতার স্কুলে। হ্যারা কিছু করলেও করতে পারে। তয় এহানে, এই মেঞাগো দ্যাশে যে শিক্ষাদীক্ষার কিছু থাকতে পারে এমন আমি বুঝি না। বাবা খুবই শান্তভাবে বললেন, আসলে ওর সমস্যাডা আমরা তো সমাধান করি নাই। হে কারণে ওর এট্টা অভিমান আছে। আর এই স্কুলের ব্যাপারটায় আমি আপত্তি করি নাই, কারণ এডা ওর নিজের চেষ্টায়ই ও করছে। জ্যাঠামশাই ঘোষণা করলেন যে, এ ধরনের স্বাধীন সিদ্ধান্ত যারা নেয়, তারা আখেরে শুধু পারিবারিক আভিজাত্যকেই কলুষিত করে এবং আমি যে একদা একটি প্রকৃত কালাপাহাড়ই হব এ বিষয়ে তাঁর কোনো সন্দেহই নেই।

আবার সেই আভিজাত্য। এই আভিজাত্য যে শেষ পর্যন্ত কোথায় আমাদের দাঁড় করাবে, কে জানে? অথচ আভিজাত্যের এই আধিকারিকরা এ সময় তাদের ঘটিবাটি বিক্রির পয়সায় অন্ন সংগ্রহ করছেন। জ্যাঠামশাই আভিজাত্যের ব্যাপক প্রবক্তা হয়েও টাকা ধার করছেন একদার খানাবাড়ির প্রজাদের কাছ থেকেও। মুনিষ-মাহিন্দরদের কাছ থেকে ঠিক টাকাকড়িতে ধার করছেন না বটে, তবে তাদের সেবার মূল্য দিচ্ছেন না এবং সে-কারণে কারা প্রায় সামনাসামনি যদৃচ্ছ খিস্তিখামার করে যাচ্ছে। তথাপি নাকি আমি ‘শ্যাহেগো ইস্কুলে’ পড়াশোনা করতে গিয়ে বাড়ির আভিজাত্য খর্ব করেছি। এ আভিজাত্যের ‘খুরে’ দণ্ডবৎ করা ছাড়া আমার আর কোনো উপায় ছিল না।

এই স্কুলে ভর্তি হবার আগে আমাকে কী কী করতে হতো সেসব ইতিপূর্বে বলেছি। সেসব কারণে আভিজাত্য খর্ব হলো না, হলো কখন? না, যখন আমি একটু স্বাধীনভাবে পড়াশোনা করার দিকে ঝুঁকলাম। কেন? না, ওইসব স্থান অতি তুচ্ছ মানুষদের দ্বারা পরিচালিত, তারা শিক্ষাদীক্ষা বিষয়ে আদৌ কোনো ধ্যান-ধারণার অধিকারী নয়। তারা কীভাবে আমাদের শিক্ষা দেবে? বিশেষত তারা যে ‘মোছলমান’, ‘মেয়া’ ‘শেখ। এই ব্যাখ্যান সম্পূর্ণতই জ্যাঠামশাই এবং তাঁর স্বভাবসম্পন্ন মানুষদের মানসিকতা অনুযায়ী। এ বিষয়ে কিছু অতিরঞ্জন নেই।

জ্যাঠামশাই, যখন আমাদের তালুক-মুলুক ইত্যাদি ছিল, তখন বাড়ির চাকরবাকরদের দিয়ে আমাকে শাসন করাতেন। এখন তারা আর নেই। তথাপি একমাত্র চাকর ফটিকদাস অনন্যোপায় হয়ে থেকে গেছে এবং তার স্ত্রী-পুত্র নিয়ে সে এ বাড়িতেই স্থায়ী সদস্য। এখন জ্যাঠামশাই তাকেই ব্যবহার করেন আমাকে অপদস্থ করার জন্য। এ মানসিকতার কী যে তাৎপর্য, তা আমার বুদ্ধিতে ধরা পড়ে না। জ্যাঠামশাই তাকে সাক্ষী মেনে বলেন, আচ্ছা ফটিক, তুমিই কও, এডার কি কিছু হওয়ার? এডা তো অট্টা আস্থা বলদ না কী? ফটিক ফ্যাকফ্যাক করে খানিকটা হেসে বলে, বড়বাবু কি মিথ্যা কইতে পারেন? ওডা হাচাই বলদা। এসব বার্তালাপ আমার বাবার সাক্ষাতেই হতো। কিন্তু বাবা কিছুই প্রত্যুত্তর করতেন না। তিনি যেন তাঁর জ্যেষ্ঠের আচরণে কোনো আপত্তিকর কিছুই দেখতে পেতেন না। এ কারণে তাঁর কোনো প্রতিবাদও ছিল না। কিন্তু এখন তো আমি কিছু বড় হয়েছি। ক্লাস সেভেন থেকে এইটে উঠেছি ক্লাসে তৃতীয় হয়ে। এখনও যদি এই লাঞ্ছনা আমাকে সহ্য করতে হয়, এই আচরণ প্রাপ্য হয়, তবে বেঁচে থাকার সার্থকতা কী? বাবাকে এ কথা জানালে তিনি বলেছিলেন, যিশু তার নিজের ক্রুশ নিজেই বহন করেছিলেন। আমি তোমার দুঃখ দূর করতে পারব না। I have carried my cross all through my life, perhapes, you too have to carry it. আমি বলি, যা-ই সামনে আসুক তাকে গ্রহণ করো। কেননা গ্রহণ না করলেও তার প্রকোপ তোমার ওপর বর্তাবেই, তেমনই আমার ধারণা। আর সেই প্রকোপ তোমাকে সহ্যও করতে হবে, কেননা, না করে কোনো পরিত্রাণ নেই। বাবা এভাবে আমাকে কোনো দিনই কিছু বলেননি। তাঁর এই কথার মধ্যে যে এক অসহায়তা, নিরাশ্রয়তার সুর শুনলাম, তা আমাকে কোনো উজ্জীবনে উদ্দীপ্ত করল না। বরঞ্চ আমি নিজেকে জীবনের ক্রমান্বয়ী দুর্ভোগ সহ্য করার নিরুপায় এক মাধ্যম হিসেবে নিজের ভবিষ্য পরিক্রমণকেই প্রত্যক্ষ করলাম যেন। অন্তত এরকম একটা অনুভূতি আমার হয়েছিল সেদিন। আমি এইসব কথা শুনে মাথা নিচু করে অপরাধীর মতো ঘর থেকে বেরিয়ে সোজা পিছারার খালপারে গিয়েছিলাম। আশ্চর্য, তখন আমার ওই খালটার কথাই প্রথমে মনে হয়েছিল, যেখানে একদা আমার মায়েরা শান্তির অবগাহন খুঁজতেন। কিন্তু গিয়ে দেখলাম, খালটা একটা শুকনো নালার মতো পড়ে আছে। তাকে একলাফে ডিঙিয়েও যাওয়া যায়। ভেবে দেখলাম ইতোমধ্যে বেশ কিছু বছর পেরিয়ে গেছে, আমি এই খালটির পারে আসিনি। মনে অসম্ভব খোদ আর নৈরাশ্য নিয়ে আমি তার ‘রেত’ ধরে চলতে লাগলাম। দুপাশে অসুমার জঙ্গল। আশশ্যাওড়া, বনবাঁডালি, বনকচুর ঝোপ, আর দুই পারের হিজল, চালতা, জাম, ডৌয়া, করমচার ভিড়। খালের দুই পারের ভুঁইমালীবাড়ি, দাসের বাড়ি, দত্তবাড়ি, মণ্ডলবাড়ির ঘরের পোতাগুলো সব চিতার মতো পড়ে আছে। এরা সব যে কোথায় গেল, তাও আমার জানা নেই। ভুঁইমালীরা আমাদের খানাবাড়ির প্রজা ছিল। সেই বাড়িতে তাদের এক জামাই এসে খুব জমিয়ে থাকত। একটা সময় ছিল, যখন জামাই ভুঁইমালী তার শ্বশুরবাড়িতে এলে তার ব্যাগ থেকে ক্লারিওনেট বের করে সময়ানুগ রাগ বাজাত। মানুষটি বড় চমৎকার স্বভাবের ছিল। ক্লারিওনেট বাজানোটা তার পেশা এবং শখ তো ছিলই, সে তার হদ্দমুদ্দ জানতও। এসব তথ্য আমরা পেতাম আমাদের অন্ধ জ্যাঠামশাইয়ের কাছ থেকে। তিনি বলতেন, জামাই ভুঁইমালী এবার কিন্তু কল্যাণে ধরল। আহা! অন্ধ জ্যাঠামশাই আমাদের বাড়ির এক শরিকও বটেন, অথবা তাঁকে আশ্রিত বললেও ভুল হয় না। কিন্তু সে কথা একটু বিশদে বলা প্রয়োজন।

.

যতদূর স্মৃতি সচল, ছবি দেখি, অন্ধ জ্যাঠামশাই তবলা বাজাচ্ছেন। একজন গানের মাস্টারমশাই আমাদের বাড়িতে দিদিদের গান শেখাচ্ছেন। সারেগামাপাধানিসার সঙ্গে ইংরেজি স্বরলিপির অনুশীলনও হচ্ছে, ‘ডুলেনা মান্ডে গাড়ো আ’। ধ্বনিটিই উদ্ধৃত করলাম স্মৃতি অনুযায়ী, অর্থ জানি না। অন্ধ জ্যাঠামশাই তালে তালে তাল দিতেন। ছোট বৈঠকখানা থেকে অন্দরে আসার পথে মাথাটি নেড়ে নেড়ে তালের সমীক্ষা করতেন। কখনো-বা গাইতেন—’রইব না আর ধুলায় পড়ে পাপে মোহে ম্লান হয়ে, পাপে মোহে ম্লান’।

জামাই ভুঁইমালী কতদিন যে তার ক্লারিওনেটটা বাজায়নি, তা-ও মনে নেই। এখন পিছারার খালের ‘রেত’ ধরে যেতে যেতে আমি সেই স্মৃতিতে আলোড়িত হই উলটোপারের দত্তবাড়িটা হানাবাড়ি হলেও এখনও তার ইট-কাঠ পাথর বজায় রেখেছে। পিছারার খালের সোঁতাটা ভুঁইমালীবাড়ি, দত্তবাড়ি পেরিয়ে বাঁহাতি যে বাঁড়ুজ্জেদের ভিটেগুলোর সুলুকসন্ধান দেয়, তাঁরাও তখন আর দেশে নেই। তাঁরা কবে গেলেন? কোথায় গেলেন? কেন গেলেন?

খালের ‘রেত’ ধরে যেতে যেতে এইসব নজরে আসে আর ভাবি, হায়! নির্বেদ ক্রমশ তীব্র হলে জঙ্গলও একসময় নিবিড় হয় এবং অলৌকিকভাবে খালপারে বাঁধা একটি বাছুরের গলার দড়ি আমাকে আকর্ষণ করে। আমি বাছুরটিকে মুক্ত করে দড়িগাছা সংগ্রহ করি। দত্তদের একতলা হানাবাড়িটার লাগোয়া বাগানটা এখন জঙ্গলই জঙ্গল। ডানদিকে একটি হিজল তার ডালপালা ছড়িয়ে। আমি দড়িগাছা হাতে নিয়ে হিজলের একটা ডালের ওপর উঠে দাঁড়াই। ঝুলে পড়ার তাবৎ প্রক্রিয়া শেষ হলে শেষবারের মতো গাছটাকে আনুপূর্ব দেখি। হিজলের শোভা বর্ষায় যাঁরা না দেখেছেন, তাঁরা বর্ণনায় ব্যাপারটা বুঝবেন না। বর্ষার শুরুতে যখন ওর গা বেয়ে ফুলের ছড়িগুলো ঝুলতে থাকে, তখন প্রকৃতি বড় মোহময়ী হয়। অনেক দিন এদিকে আসা হয়নি বলে এ শোভার কথা ভুলেই গিয়েছি। এখন অঘ্রান মাস। এখন হিজলের গায়ে কোনো ফুল নেই। তবুও তার শরীর এমনই ছন্দোময় যে, তার ডালে আর খানিকক্ষণের মধ্যে যে কাজটি আমি করতে যাচ্ছি, তা একান্তই প্রকৃতিবিদ্বেষী। যে ডালটির ওপর এখন দাঁড়িয়ে, তা পিছারার খালের ওপর ঝুঁকে আছে। সোঁতা এখন অতি ক্ষীণ, এমনকি তার জলে হিজলের প্রচ্ছায়াও দেখা যাচ্ছে না। অঘ্রানের হিম তার ফুল নিঃশেষ করেছে। রিক্ত ডালটি তাই যথেচ্ছ সোচ্চারে যেন আমাকে বারণ করতে পারছে না, বলতে পারছে না, এ কাজ কোরো না। কিন্তু আত্মনিধন তথাপি বাধাপ্রাপ্ত হলো। আমি কিছু কচিকণ্ঠের কলকাকলি শুনতে পেলাম। এই কণ্ঠসমূহ একটি শব্দোচ্চারণে পিছারার খালের সোঁতা ধরে আসছিল। শব্দটি—দাদা, তুই কই? ও দাদা, তুই আমারে কোলে নে। আমি হাঁটতে পারি না। আমার হাত থেকে ঘাতক দড়িগাছার অতঃপর পড়ে গিয়ে দোল খাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। আমার অনুজ-অনুজারা আমার খোঁজে বেরিয়ে পড়েছে। তার মধ্যে যার গলা আমাকে দড়িটা ছেড়ে দিতে বাধ্য করে সেটাই তখন সবচেয়ে কচি বোন আমার। তার একদণ্ডও আমার কোল ছাড়া চলে না। তার আগেরটা ভাই। সবচেয়ে ছোট ভাই আমাদের, সেটাও তেমন বড় নয় তখন। আমি ওই দড়িটায় দোল খেয়ে গাছটি থেকে নেমে আসি এবং ওদের আওয়াজ শুনে খানিক পিছিয়ে এসে দুজনকে দুকাঁধে নিয়ে বলি, চল বাড়ি যাই।—ওই মুহূর্তে আমার খেয়াল হয়েছিল যে, আমার এরকমভাবে মরাটা খুব স্বার্থপর মরা হবে। আমি যদি এখন মরি, প্রাকৃত বিশ্বে তার কিছুমাত্র প্রভাব থাকবে না। কিন্তু এই শিশুগুলো, যারা এখন অবুঝ, যাদের জন্য আমার তাবৎ চিন্তাচিন্তন, তারা অন্নহীন, আশ্রয়হীন হবে। বাবা এদের জন্য কিছুই করতে পারবেন না, শুধু হা-হুতাশ করবেন। এরা সবাই তখন অন্নাভাবেই মরে যাবে। আমি যদি মরি, আমি বেঁচে গেলাম। কিন্তু এদের কী হবে? কাঁধের ওপর থেকে ছোট বোনটা শুধু অনুযোগ জানিয়ে যাচ্ছিল, ও দাদা, তুই কোথায় যাইছিলি? আমারে না লইয়া ক্যান যাইছিলি? ও তখনও ভালো করে কথা বলতে শেখেনি। ভাবলাম, আমি কি এরকম একটা স্বার্থপর মরা মরতে পারি? এ কারণেই আমার মরা হল না। মনে মনে বুঝে নিলাম আত্মস্বার্থীয় কোনো কিছুই আমার জন্য নয়, এমনকি আত্মস্বার্থে মৃত্যুও আমার স্বধর্ম নয়। আজ মনে হয়, ওই মুহূর্ত থেকেই ভবিষ্যতের জীবনযাপনপ্রণালির একটা সুনির্দিষ্ট ছক তৈরি হয়ে গিয়েছিল। পরবর্তীকালে দেখেছি, আমি কিছুতেই এই ছকের বাইরে কোনো বৃহত্তর কর্মকাণ্ডে নিজেকে বেশি দিন নিয়োজিত রাখতে পারিনি। এমনকি ছয়ের দশকের শেষকাল থেকে সাতের দশকের মধ্যকাল পর্যন্ত যে রাষ্ট্রবিপ্লবের আবর্তে নিজেকে নানাভাবে জড়িয়ে ফেলেছিলাম, তা-ও আমাকে পুরোপুরি তন্নিষ্ঠ করতে পারেনি। সমাজবিপ্লব প্রচেষ্টার সেই ক্রান্তিকালে আমার যে দোদুল্যমানতা ছিল, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। পরে বুঝেছি যে, একজন পেশাদার বিপ্লবী হবার যোগ্যতা চরিত্রগতভাবে আমার ছিল না। আমি শুধু এই কর্মে ব্রতী মানুষদের প্রতি ভালোবাসায় আপ্লুত হয়ে কিছু সহায়তা করার মতো মানসিকতায়ই অবস্থান করেছিলাম। বস্তুত আমার চরিত্রে স্বাভাবিকভাবেই ভালোবাসার এবং আবেগপ্রবণতার মাত্রাটা অধিক। কোনোরকমভাবেই আমি ঘৃণা বা ক্রোধকে অধিকক্ষণ ধারণ করতে পারি না, তা মহান কারণেই হোক অথবা তুচ্ছ কারণে। ফলত শত্রু-মিত্র বিভাজনের বিচারে আমি কখনোই একবগ্‌গা হতে পারিনি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *