হরিনাথ দে’র স্মরণে

হরিনাথ দে’র স্মরণে

বহু ভাষা শিখতে পারলে বহু সাহিত্যের সঙ্গে পরিচয় হয়। তার মারফতে অনেক সভ্যতা, বিস্তর সংস্কৃতির সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপিত হয়– এসব কথা ছেলেবেলা থেকেই শুনে আসছি।

উপস্থিত দেখতে পাচ্ছি, বাঙালি ছেলেকে বাধ্য হয়ে অন্তত তিনটে ভাষা শিখতে হয়– বাঙলা, ইংরেজি এবং সংস্কৃত (কিংবা আরবি অথবা ফারসি)। হয়তো তাকে হিন্দিও শিখতে হচ্ছে, কিংবা অদূরভবিষ্যতে শিখতে হবে। এ অবস্থায় আমি যদি প্রস্তাব করি, আরও গুটি দুই শিখলে হয় না? তা হলে ছেলেদের হাতে আমার প্রাণ বিপন্ন হবার সমূহ সম্ভাবনা বাঙলা দেশে না থাকলেও এ খবরটি আমি বিলক্ষণ রাখি। বিশেষত এই পুজোর বাজারে– মানুষ যখন বলির পাঁঠার সন্ধানে থাকে।

তাই হট্টগোল আরম্ভ হওয়ার পূর্বেই আমি নিবেদন করছি, এ প্রস্তাবটি শুধু তাদেরই জন্য, যারা বুঝে গিয়েছে যে সংস্কৃতে তারা বিদ্যাসাগর হতে পারবে না, ওটাকে নিতান্ত পরীক্ষা পাসের জন্য যেটুকু সম্মান দিতে হয় তাই দেবে, বাঙলা মাতৃভাষা, এবং ইংরেজির চর্চা ততটুকুই করবে যতটুকু পাসের পর চাকরির জন্য নিতান্তই প্রয়োজন। এই সংজ্ঞা থেকেই সুচতুর পাঠক বুঝে যাবেন যে, আমি মোটামুটি থার্ড ইয়ার ফোর্থ ইয়ার ছেলেদের কথাই ভাবছি। অর্থাৎ এরা ক্লাসে (সেভেন-এটে) যেরকম পড়ি-মরি হয়ে তিনটে ভাষার পিছনে ছুটত এখন আর তা করে না। বিশেষত গোটা পাঁচেক ইয়ার্লি আর খান-দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা পাস করে এরা ভাষা না শিখে কী করে তার পরীক্ষা পাস করতে হয় সে ‘বিদ্যায়’ বিলক্ষণ রপ্ত হয়ে গিয়েছে।

এতখানি বলার পরও যদি কেউ লেমনেডের বোতল খোঁজে তবে আমার দ্বিতীয় নিবেদন, গোটা দুই ভাষা শিখলে চাকরি জোটার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। হল? এখন তবে আশা করতে পারি, পাঠক বোতলটি আমার মাথায় ফাটিয়ে সেটার ভিতরকার জিনিস বরফের সঙ্গে মিশিয়ে আমাকে খাওয়াবার চেষ্টা করবেন।

দয়া করে সেটিও করবেন না। কারণ আমি যে প্রস্তাব করতে যাচ্ছি সেটা লটারির টিকিট কাটার চেয়ে মাত্র এক চুল ভালো– এই যা। ইংরেজিতে একেই বলে ‘চেজিং দি ওয়াইল্ড গিজ’–কিন্তু চাকরির বাজারে বাঙালির ছেলের সামনে যখন কোনও ‘গুজ’ই নেই তখন আশা করিতে পারি সে ঘরের না খেয়ে বনের হাঁস তাড়া করতে আপত্তি করবে না। বুঝিয়ে বলি।

স্বাধীনতা লাভের পূর্বে ভাষা শেখার কোনও অর্থকরী মূল্য এদেশের ছিল না। স্বরাজ লাভের পর অবস্থাটা বদলেছে। আমরা নানা দেশে আমাদের রাজপ্রতিনিধি, রাজদূত, হাইকমিশনার, কন্সাল-জেনারেল, কন্সল, ট্রেড-কমিশনার এবং তাদের দতরের জন্য কাউনসেলর, প্রথম-দ্বিতীয়-তৃতীয় সেক্রেটারি, মিলিটারি আতাশে, ট্রেড আতাশে, প্রেস আতাশে, কেরানি, দোভাষী ইত্যাদি পাঠাচ্ছি এবং দিল্লির পরদেশি দফতর বা ফরেন অফিসেও ভাষা জাননে-ওলা লোকের প্রয়োজন হয়। তাছাড়া বেতার-কেন্দ্র ফরাসি, ইরানি, ফারসি, কাবুল-ফারসি, আরবি, পশতু, সুহেলি, গুর্খালি, বর্মি, ইন্দোনেশি ও চীনা ভাষায়-ও প্রোগ্রাম দেন। আমাদের ফৌজি স্কুলেও অনেক ভাষা শেখানো হয়।

এই তিনটি প্রতিষ্ঠানে যে গণ্ডায় গণ্ডায় চাকরি খালি পড়েছে তা নয়, তবু আমার ব্যক্তিগত ধারণা উপযুক্ত ভাষাজ্ঞান থাকলে যোগ্য লোককে এ তিনটি প্রতিষ্ঠান খাতির করবে। আর পূর্বেই নিবেদন করেছি, আমার এ প্রস্তাব তাদেরই জন্য, যারা চাকরির বাজারে একটুখানি রিস্ক, রতিভর ঝুঁকি নিতে রাজি আছে।

আমি যে খবরটি দিলুম সেটি কিছুমাত্র নতুন নয়। কারণ প্রায়ই বেকার ছেলেরা এসে আমাকে অনুরোধ জানায় তাদের ফ্রেঞ্চ-জর্মন শিখিয়ে দিতে। (এখানেই লক্ষ করে রাখুন। ‘ফ্রেজ-জর্মনই’ বলে, অন্য কোনও ভাষার নাম তোলে না) আমার সময়ের অভাব, দ্বিতীয়ত আমি বাঙালিটাই ভালো করে জানিনে– কাজেই ফরাসি-জর্মনের কথাই ওঠে না, তাই তাদের কিঞ্চিৎ সদুপদেশ দিয়ে বিদেয় দিই।

এদের প্রশ্ন করে দেখলুম, এরা জানে না (ক) কোন ভাষার চাহিদা বাজারে কতখানি, (খ) কোন ভাষা শক্ত আর কোনটা নরম, (গ) ভাষা শিখতে হয় কী করে এবং আরও অনেক কিছুই জানে না।

আমি দোষ দিচ্ছিনে। জানবার সুযোগ দিলে তো তারা জানবে। আর যদি জানতই তবে আজ আমি এ বিষয়ে লিখতে যাব কেন?

আমাকে এক উত্তম ব্যবসায়ী বলেছিল, ‘জিনিস বেচা সোজা, কেনা শক্ত।’ আমি তো তাজ্জব। বলে কী? তখন বুঝিয়ে বলল, ‘বাজারে ঠিক যে জিনিসের চাহিদা তাই দিয়ে যদি আমি আমার দোকান সাজিয়ে রাখি তবে সন্ধে হতে না-হতেই দোকান সাফ হয়ে যাবে। তাই বললুম, বেচা সহজ। কিন্তু আড়তদারদের কাছ থেকে যদি বে-আক্কেলের মতো বে-চাহিদার মাল কিনি তবে সেগুলো দোকানে পচবে, দোকান উঠে যাওয়ার পরও। তাই বললুম, “কেনা শক্ত”।’

এস্থলেও সেই নীতি প্রযোজ্য। অর্থাৎ প্রথম দেখতে হবে, আপনি কী মাল কিনবেন, অর্থাৎ কোন ভাষা শিখবেন।

সবাই বলে ‘ফেঞ্চ-জর্মন’। এ যেন কথার কথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফ্রেঞ্চ ভুবনবিখ্যাত ভাষা। এককালে ফ্রেঞ্চ না জেনে কূটনীতি মহলে যাওয়া বিনা পৈতেয় ব্রাহ্মণভোজে যাওয়ার মতো ছিল। এখনও পৃথিবীর যেকোনো দেশের পাসপোর্টে দেখতে পাবেন দুটি ভাষাতে সবকিছু ছাপা, প্রথমটি তার আপন ভাষা এবং দ্বিতীয়টি ফরাসি। কিন্তু এসব হচ্ছে উনবিংশ শতকের কথা। আপনি যদি সেই শতকের চাহিদা মেটাতে চান, তবে মেটান। আপনি যদি এক শ বছরের পুরনো বিজ্ঞাপন মাফিক চাকরির জন্য দরখাস্ত চান তো করুন।

তাই প্রথম দেখতে হবে : এখন, এই মুহূর্তে চাহিদা কী এবং চাহিদার গতিটি কোন দিকে, অর্থাৎ আপনি ভাষাটা শিখে দু তিন বছরে যখন বাজারে নামবেন তখন চাহিদাটা কী হবে?

ভাষার প্রাধান্য তার লোকসংখ্যা থেকে বিচার করা ভুল। দৃষ্টান্তস্বরূপ চীনা ভাষা নিন। ইংরেজি, রাশান, চীনা এ তিন ভাষায় কথা বলে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি লোক একথা সত্য, কিন্তু চীনা ভাষায় লোক-সংখ্যা যত বেশিই হোক না কেন, তারা সবাই মাত্র একটি রাষ্ট্রের অধিবাসী! কাজেই ওই রাষ্ট্রে আমাদের থাকবে মাত্র একটি এম্বেসি। পক্ষান্তরে জর্মন ভাষার অবস্থা বিবেচনা করুন। জর্মন বলা হয় জর্মন রাষ্ট্রে (উপস্থিত সেটিও আবার দুই রাষ্ট্রে বিভক্ত), অস্ট্রিয়া রাষ্ট্রে এবং সুইজারল্যান্ডে। এই তিন দেশে আমাদের তিনটি রাজদূতাবাস আছে। তাছাড়া জর্মন বলা হয়, উত্তর ইটালির টিরোল, ফ্রান্সের আলসেস লরেন ও বেলজিয়ামের অয়পেন অঞ্চলে। এসব অঞ্চলে যদি কখনও রাজনৈতিক গোলমাল আরম্ভ হয়। এবং আপনাকে তার রিপোর্ট লিখতে সেখানে যেতে হয় তবে জর্মন ছাড়া এক পা-ও এগুতে পারবেন না। এবং সর্বশেষ কথা : জর্মনি, অস্ট্রিয়া, সুইজারল্যান্ড বেচে তৈরি মাল, ভারত বিক্রি করে কাঁচা মাল। এসব দেশের সঙ্গে আমাদের ব্যবসা দ্রুতগতিতে বাড়তেই থাকবে; বিস্তর কনসুলেট ও ট্রেড-কমিশন ক্রমে ক্রমে ওসব জায়গায় আমাদের খুলতে হবে।(১) কিন্তু চীন ও ভারত সমগোত্রীয়, দু জনেই বেচে কাঁচামাল, অতএব ‘বৈবাহিক’ বৈষয়িক কাজ আমাদের চলে না।

আমরা যে স্বার্থ নিয়ে এ আলোচনা করছি তার দৃষ্টিবিন্দু থেকে দেখতে গেলে রাষ্ট্রীয় শক্তি ও ভাষার গুরুত্ব বিচার অবান্তর। সোভিয়েট রাশা বিরাট রাষ্ট্র কিন্তু ওই দেশে আছে এবং বহুকাল ধরে থাকবে আমাদের একটি মাত্র রাজদূতাবাস। রাশা আবার মারাত্মক রকমের কেন্দ্ৰপ্রাণ রাষ্ট্র-মস্কোর নাম বদলে তাকে ‘সেন্টার’ নাম দেবার প্রস্তাব ওই কারণেই একবার। হয়েছিল– তাই তার উপরাষ্ট্র যথা, তুর্কোমানিস্তান উজবেকিস্তানে যে আমাদের রাজদূত আস্তানা গাড়বেন তার আশু সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছিনে। অবশ্যই উত্তম সাহিত্যরস আস্বাদনের জন্য রাশানের মতো ভাষা পৃথিবীতে বিরল।

পক্ষান্তরে রাষ্ট্রশক্তি হিসেবে আরবরা আজ পৃথিবীতে উঁচু আসনে বসে না। তার প্রধান কারণ, তারা নানা রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এবং ঠিক ওই কারণেই আমাদের দৃষ্টিবিন্দু। থেকে তাদের প্রাধান্য বেড়ে গেল। উপস্থিত আরব জাতি এই কটি রাষ্ট্রে বিভক্ত :-ইরাক, সিরিয়া (শ্যাম), লেবানন, হাদ্ৰামুৎ, ট্রানসজর্ডন, সউদি আরব, ইয়েমেন, মিশর, সুদান, টুনিসিয়া, আলজিরিয়া, মরক্কো, লিবিয়া। তাছাড়া কুয়েত, বাহরেইন, ওমান ইত্যাদি। এদের সবকটি স্বাধীন নয়, কিন্তু ভগবানের আশীর্বাদে আমরা যেদিন অ্যাংলো-আমেরিকান আড়কাটির হাত থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে আড়তদারের কাছ থেকে সোজা পেট্রল কেনবার দুই নম্বরের স্বরাজ’ পাব সেদিন আরবের আনাচে-কানাচেও আমাদের কনসুলেট বসাতে হবে। উপস্থিত, আমার যতদূর জানা, মিশর, সউদি আরব, ইরাকে আমাদের রাজদূতাবাস আছে। এদের সংখ্যা বাড়বে বই কমবে না।

কিন্তু রাষ্ট্রগুলোর এসব ‘মেল’ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মেলাতে গেলে আমরা পুজোর বাজার পেরিয়ে শ্যামাপুজোয় পৌঁছে যাব। তাই সংক্ষেপে বলি, আমার মনে হয় আমাদের স্বার্থের জন্য উপস্থিত স্প্যানিশ-ই সবচেয়ে প্রয়োজনীয়। আপনি বলবেন, ওইটুকু দেশ স্পেন– তার ‘ভাঙা নৌকায়’ আমাদের কতখানি ‘সোনার ধান’ ধরবে।

আমি স্পেনের কথা আদপেই ভাবছি না। আমি ভাবছি দক্ষিণ আমেরিকার কথা। সেখানে ডজনখানেক সম্পূর্ণ স্বাধীন রাষ্ট্র। তাদের ভাষা স্প্যানিশ হিস্পানি। ওদের গুটিকয়েকে আমাদের রাজদূতরা বেশ কিছুকাল হল ডেরা গেড়ে বসেছেন। আমার বিশ্বাস সবকটাতে না হোক, বাকি অনেকগুলোতেই ক্রমে ক্রমে আমাদের রাজদূতাবাস বসবে। অতএব আমার সলা যদি নেন তবে স্প্যানিশ শিখুন।

ব্যবসা-বাণিজ্য সম্বন্ধে অধমের জ্ঞান অতিশয় অপ্রচুর। তবু বলব, ব্যবসা-বাণিজ্য ক্রমে ক্রমে এদেরই সঙ্গে আমাদের বাড়বে। সংক্ষেপে তার কারণটা বলি– আমেরিকা, ইয়োরোপ এবং রাশা তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য, বলতে গেলে তাদের সম্পূর্ণ অর্থনীতি যুদ্ধ প্রস্তুতির চতুর্দিকে এমনি কেন্দ্রীভূত করেছে যে তারা কিনতে চায় যুদ্ধের জন্য তাদের যেসব মালের দরকার এবং বেচতে চায় যুদ্ধের জন্য যার প্রয়োজন নেই। আর যুদ্ধ যদি লেগে যায় তবে আপনার অর্ডারগুলো তারা শিকেয় তুলে রাখবে, আপনার কাঁচামাল বন্দরে বন্দরে পচবে। দক্ষিণ আমেরিকা এসব আওতার বাইরে। ওদের সঙ্গে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য বেড়েই যাবে– আমাদের তৃতীয় ‘স্বরাজ’ লাভের পর। দশটা রাজদূতাবাস যদি তিন শটা চাকরি দিতে পারে তবে ব্যবসা-বাণিজ্য দেবে তিন হাজার কিংবা ত্রিশ হাজার। আর চাকরি ছেড়ে দিয়ে যদি ভাষায় জোরে ব্যবসা চালান তবে তো আর কথাই নেই।

এস্থলে আরেকটি তত্ত্ব এবং তথ্যপূর্ণ ইঙ্গিত দিই। ভাষা শেখার সময় গোড়ার দিকে সমগোত্রের ভাষা শিখে তাড়াতাড়ি ভাষার সংখ্যা বাড়িয়ে দেবেন। উদাহরণস্থলে বলি আপনি বাঙালি, আজ যদি আপনাকে নিছক ভাষার সংখ্যাই দেখাতে হয় তবে আপনার পক্ষে বুদ্ধিমানের কাজ হবে অসমিয়া এবং উড়িয়া নিয়ে। এ দুটি ভাষা বাঙলার এত কাছাকাছি যে আপনাকে বেগ পেতে হবে অতি কম। তার পর শিখবেন, হিন্দি, গুজরাটি, মারাঠি, গুরুমুখী, ঠিক ওইরকমই পর্তুগিজ, ইটালিয়ান ও ফ্রেঞ্চ ভাষা স্পেনিশ ভাষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। আপনার বাঙলা জানা থাকলে অসমিয়া শিখতে কতদিন লাগার কথা? না হয় তারই ডবল ধরুন স্পেনিশ শেখা হয়ে গেলে পর্তুগিজ, কিংবা ফরাসিস শিখতে। ঠিক সেইরকম জর্মন ফ্লেমিশ এবং ডাচ পড়ে অন্য গোত্রে। একদা ব্রাসেলস্ শহরে আমি একখানা ফ্লেমিশ খবরের কাগজ কিনে পড়ে দেখি মোটামুটি বক্তব্যটা ধরে ফেলতে পেরেছি- অল্পস্বল্প যা জর্মন জানি তার-ই কৃপায়। এতে আশ্চর্য হবার কিছুই নেই। আপনি অসমিয়া শিশুশিক্ষা কখনও পড়েননি। একখানা অসমিয়া বই নিন। দেখবেন বারো আনা পরিমাণ অনায়াসে বুঝতে পারছেন। কিংবা বেতারে যখন ‘অসমীয়া বাতরি’ শোনেন তখন কি তার মোটামুটি অর্থ ধরতে পারেন না?

তাই এই অনুচ্ছেদের গোড়াতে ভাষার সংখ্যাবৃদ্ধির যেকথা তুলেছিলুম সেটাতে ফিরে যাই। অর্থাৎ শুরুর সাহায্যে যদি বিদ্যায়তনে আপনি স্পেনিশ আরম্ভ করেন তবে মাস দুই যেতে-না-যেতেই বাড়িতে, কারও সাহায্য ছাড়া পর্তুগিজ কিংবা ফরাসি আরম্ভ করে দেবেন। ব্যাকরণখানার দু দশপাতা ওলটাতে-পালটাতেই দেখবেন একসঙ্গে দুটো ভাষা আয়ত্ত করা কিছুমাত্র কঠিন কর্ম নয়। গোড়ার দিকে কিছুটা গুবলেট হয়ে যাবে সন্দ নেই। কিন্তু কিছুদিন পরে যদি সেটা কাটিয়ে না উঠতে পারেন তবে বুঝবেন ওইদিকে ভগবান আপনার প্রতি সদয় নয়, তখন না হয় লেগে যাবেন মানুষ মারার ব্যবসাতে– যাকে অজ্ঞজন বলে ডাক্তারি, কিংবা রেলকলিশনের পরিপাটি ব্যবস্থা করাতে– যাকে অজ্ঞজন নাম দিয়েছে ইঞ্জিনিয়ারি। কিন্তু নিবেদন, আমার দৃঢ় বিশ্বাস ম্যাট্রিক বড় কঠিন পরীক্ষা। আপনি যদি সেটা পাস করে থাকতে পারেন তবে গোটাতিনেক ভাষা শিখতে পারবেন না কেন?

গোত্রবিচারে ফিরে যাই।

১. লাতিন গোত্র স্পেনিশ, ফরাসিস, পর্তুগিজ, ইটালিয়ান।

২. জর্মন গোত্র– জর্মন, ডাচ, ফ্লেমিশ।

৩. তুর্কি গোত্র তুর্কি (ওসমানলি তুর্কি, অর্থাৎ টার্কির ভাষা– তুর্কমানিস্থানের ভাষা, জগতাই তুর্কি। প্রথমটা মুস্তফা কামালের মাতৃভাষা, দ্বিতীয়টা বাবুর বাদশার)

৪. হাঙ্গেরিয়ান ও ফিনিশ কিন্তু এক হলেও শাখাতে বর্ণ-বৈষম্য প্রচুর।

 ৫. রাশান গোত্র– রাশান, পোলিশ, ল্যাটাভিয়ান, স্লোভাক ইত্যাদি।

৬. ইরানি গোত্র–ইরানি ফারসি ও কাবুলি ফারসি পার্থক্য সামান্য।

৭. আরবি গোত্র– আরবি, হিব্রু, ইডিশ (অধুনা প্যালেস্টাইনে প্রচলিত প্রাচীন হিব্রুর অর্বাচীন রাষ্ট্রভাষা), আহমেরিক (আবিসিনিয়ান ভাষা)।

৮. চীনা গোত্র– চীনা, জাপানি, কোরিয়ান ইত্যাদি।

৯. এছাড়া টিবেটো-বর্মন গোত্রের বর্মি ইত্যাদি। মালয়, থাই, ইন্ডোনেশিয়ন ইত্যাদি।

অজানাতে এবং জানাতে ছোট এবং বড় কোনও কোনও ভাষা বাদ পড়ে গেল। তাই নিয়ে শোক করবেন না। উপস্থিত এগুলো শিখে নিন। তা হলে অন্যগুলোর খবর আপনার থেকেই জানা হয়ে যাবে।

এর ভিতর সহজ ১ এবং ৬নং গোত্রের ভাষা, তার চেয়ে কঠিন ২ এবং ৩নং গোত্রের ভাষা, তার চেয়ে কঠিন ৫ নম্বরের গোত্র, তার চেয়েও কঠিন ৭নং, পারতপক্ষে ৮ নম্বরের পাড়া মাড়াবেন না (অবশ্য জাপানি তেমন শক্ত নয়), ৪ আর ৯ নম্বরের খবর জানিনে, তবে খুব শক্ত হওয়ার কথা নয়।

দুই গোত্রের দুটো ভাষা একসঙ্গে শেখা যে খুব কঠিন তা নয়, তবে তার জন্য সপ্রতিষ্ঠান ও সগুরু প্রয়োজন। এই দুইটির বড়ই অভাব– এই দুঃসংবাদটি যতক্ষণ পারি চেপে গিয়েছিলুম; আর পারা গেল না। কিন্তু তার সঙ্গে সঙ্গে এই সুসমাচারটিও বিতরণ করছি যে ভারতবর্ষের কোথাও এমন সুব্যবস্থা নেই যে তার পাল্লায় পড়ে আপনি হেরে যাবেন। এই যে আমাদের রাজধানী দিল্লি শহর, সেখানকার লোক কেন্দ্রের নোকরি বাবদে হামেহাল তেজনজর ওকিবহাল সেখানে যে দু একটি প্রতিষ্ঠান আছে সেগুলো অতিশয় রদ্দি অথচ টাকা লুটছে এন্তের। ছেলেবেলা থেকে শুনে আসছি, কলকাতায় নাকি গোটাদুৰ্ত্তিন প্রতিষ্ঠান আছে সেখানে বিদেশি ভাষা শেখানো হয়। খোঁজ করলে দেখবেন, খুড়ো-জ্যেঠার আমল থেকে বাড়িতে দু চারখানা মার্লবর পড়ে আছে, কিন্তু ইংরেজি ছাড়া কোনও বিদেশি ভাষা কেউ শেখেননি। আমিও ভূ-ভারতে এমন প্রাণীর সংস্পর্শে আসিনি যিনি ওইসব প্রতিষ্ঠানের কল্যাণে কলকাতাতে বসে কোনও বিদেশি ভাষা শিখেছেন। তবে ইদানীং অবস্থা একটু ভালো হয়েছে।

অধমের শেষ সাবধানবাণী : সবকটা আণ্ডা একই ঝুড়িতে রাখবেন না– কুল্যে শির্নি একই দরগায় উজোড় করে দেবেন না। তার সরল অর্থ বিএ, এমএ পাস অবহেলা করে হঠাৎ তেরিয়া হয়ে বিদেশি ভাষার পশ্চাদ্ধাবন করবেন না। এসব পড়াশুনো বিএ, এমএ, পড়ার সঙ্গে সঙ্গে চালাবেন– আড্ডাটা সিকিটাক কমিয়ে দিয়ে ফুটবল দেখাটা একটু মুলতবি রেখে দিয়ে। একদম ছেড়ে দিতে বলব কেন, তওবা, তা হলে আপনার বাঙালিত্বই যে উপে যাবে। ভাষা শিখে পরীক্ষা দিয়ে যদি সেদিকে নোকরি না জোটে তবে বিএ, এমএ পাস করে যা করতেন তাই করবেন। তা হলে অন্তত আমার গলায় গামছার ফাঁস লাগিয়ে বলতে পারবেন না, ‘তবে রে–, তোর কথায় না– ইত্যাদি।’

————

১. এখানে এম্বেসি, হাই-কমিশন, লিগেশন ইত্যাদির পার্থক্য সম্বন্ধে সামান্য কিছু বলে দেওয়া ভালো। এই তিনটিই রাজনৈতিক যোগাযোগ এবং কূটনৈতিক কাজকর্ম চালায়। এম্বেসি এবং হাই-কমিশন পদমর্যাদায় একই- ব্রিটিশ ক্রাউনের আওতায় থাকলে এম্বেসির নাম হাইকমিশন, লিগেশন পদমর্যাদায় ছোট। কনসুলেটের কাজ ব্যবসা-বাণিজ্য সংক্রান্ত। ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রয়োজনমতো একাধিক কনসুলেট থাকতে পারে কিন্তু একাধিক এম্বেসি হয় না এবং সে স্থানে কনসুলেট-জেনারেলও থাকে। ট্রেড-কমিশন কনসুলেটের চেয়ে জাতে ছোট্ট অনেকটা এক্সপেরিমেন্টাল পোস্ট-অফিসের মতো। ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়লে তার পদবৃদ্ধি হয়। কোনো কোনো দেশে আমাদের কনসুলেট না থাকলে, সেখানকার এম্বেসি-হাই-কমিশন-লিগেশন ওই কাজও করে থাকে। এইসব তাবৎ প্রতিষ্ঠান আমাদের ফরেন অফিসের ভাবেতে থাকে।