বন

বন

পশ্চিম জর্মনির রাজধানী বনবাসী হতে চলেছেন শুনে পাঠক যেন বিচলিত না হন। এ ‘বনে’র উচ্চারণ ‘ঘরে’র মতো। বাংলা উচ্চারণের অলিখিত আইন অনুযায়ী ‘ন’ অথবা ‘ণ’ পরে থাকিলে একমাত্রিক শব্দে ‘অ’-কারটি ‘ও-কারে পরিণত হয়। যথা– মন, বন, উচ্চারিত হয় মোন, বোন, ইত্যাদি রূপে। কিন্তু এই জর্মন Bonn শব্দের উচ্চারণে ‘ব’য়ের স্বরবর্ণটি ‘ঘরে’র অ-কারের মতো উচ্চারিত হয়। তাই পরাধীন জর্মনি আজ বনে রাজধানী পেয়ে যেন ঘর পেয়েছে একথা অনায়াসে বলা যায়।

কাগজে বেরিয়েছে বনের লোকসংখ্যা এক লক্ষ। আমাদের দেশে যেমন বলা হয়, পাঁচ বৎসর লালন করবে, দশ বৎসর তাড়না করবে এবং ষোড়শবর্ষে পদার্পণ করলে পুত্রের সঙ্গে মিত্রের ন্যায় আচরণ করবে; জর্মনিতে ঠিক তেমনি আইন, কোনও শহরের লোকসংখ্যা যদি এক লক্ষে পৌঁছে যায় তবে তিনি সাবালক হয়ে গেলেন, তাঁকে তখন ‘গ্রোস-স্টাট’ বা বিরাট নগররূপে আদর-কদর করে বার্লিন মুনিক কলোন হামবুর্গের সঙ্গে একাসনে বসাতে হবে। অর্থাৎ মার্কিন-ইংরেজ কর্তাদের মতে বন বিরাট নগর এবং জর্মনির রাজধানী, তারা বিরাট নগরেই স্থাপনা করেছেন।

কিন্তু এই কেঁদে ককিয়ে টায়ে-টায়ে এক-লক্ষী শহরেই রাজধানী কেন করতে হল? আমি বন শহরে বহু কর্মক্লান্ত দিবস এবং ততোধিক বিদ্রি যামিনী যাপন করেছি। বনের হাড়হদ্দ আমি বিলক্ষণ জানি। তার লোকসংখ্যা কী কৌশলে ১৯৩৮ সালে এক লক্ষ করা হয়েছিল সে-ও আমার অজানা নয়। এক-লক্ষী হয়ে সাবালকত্ব পাবার জন্য বন কায়দা করে পাশের একখানা গ্রামকে আদমশুমারির সময় আপন কণ্ঠে জড়িয়ে নিয়েছিল– যদিও সে গ্রামটি বনের উপকণ্ঠে অবস্থিত নয়, দুয়ের মাঝখানে বিস্তর যব-গমের তেপান্তরী ক্ষেত।

আসল তত্ত্ব হচ্ছে বন রুশ সীমান্ত থেকে অনেক দূরে। মার্কিন-ইংরেজ ধরে নিয়েছে আসছে লড়াইয়ে জর্মনি রুশের বিরুদ্ধে লড়বে এবং তখন রাজধানী যদি রুশ সীমান্তের কাছে থাকে, তবে তাতে মেলা অসুবিধা– প্যারিস ফ্রান্সের উত্তর সীমান্তে থাকায় তাকে যেমন প্রতিবারেই মার খেতে হয়, বেড়ালের মতো রাজধানীর বাচ্চা নিয়ে কখনও লিয়ো কখনও ভিশিময় ঘুরে বেড়াতে হয়।

কিন্তু বনে রাজধানী নির্মাণে আরেকটি মারাত্মক তথ্য আবিষ্কৃত হয়ে গেল। বেলজিয়ম যেরকম প্রতিবার জর্মনিকে ঠেকাতে গিয়ে বেধড়ক মার খেয়েছে, এবার জর্মনি রুশকে ঠেকাতে গিয়ে সেইরকম ধারাই মার খাবে। বার্লিন গেছে, ফ্রাঙ্কফুর্ট যাবে, বনও বাঁচবে না।

কিন্তু থাক এসব রসকষহীন রাজনীতি চর্চা। বরঞ্চ এস সহৃদয় পাঠক, তোমাকে বনের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই।

এপারে বন, ওপারে ‘সিবেন গেবির্গে’ অর্থাৎ সপ্তশ্রীলাচল। মাঝখানে রাইন নদী। সে নদীর বুকের উপর দিয়ে জাহাজ চড়ার জন্য প্রতি বৎসর লক্ষ লক্ষ লোক তামাম ইউরোপ-আমেরিকা থেকে জড়ো হয়। নদীটি এঁকেবেঁকে গিয়েছে। দু দিকে সমতল জমির উপর গম-যবের ক্ষেত, মাঝে মাঝে ছবির মতো ঝকঝকে তকতকে ছোট্ট ছোট্ট ঘরবাড়ি সমতল জমির পিছনে দু সারি পাহাড় নদীর সঙ্গে সঙ্গে এঁকেবেঁকে চলে গিয়েছে– মেঘমাশ্লিষ্টসানুং।

আর বন শহরের ভিতরটাও বড় মনোরম। বার্লিনের মতো চওড়া রাস্তা নেই, পাঁচতলা বাড়িও নেই। মোটরের গাঁক-গাকও নেই। আছে কাশী-আগ্রার মতো ছোট ছোট গলিঘুচি, ছোট্ট ছোট্ট বাড়ি-ঘর-দোর, ঘুমন্ত কাফে, অর্ধজাগ্রত রেস্তোরাঁ। আর বিশাল বিরাট বিপুল কলেবর আধখানা শহর জুড়ে ভুবনবিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়েই জর্মনিতে প্রথম সংস্কৃত চর্চা আরম্ভ হয়। হেরমান য়াকোবি এখানেই অধ্যাপক ছিলেন। তাঁর শিষ্য কির্ফেল এখনও সেখানে সংস্কৃত পড়ান। পুরাণ সম্বন্ধে তাঁর মোটা কেতাবখানার তর্জমা ইংরেজিতে এখনও হয়নি। কির্ফেলের সতীর্থ অধ্যাপক লশ উপনিষদ নিয়ে বছর বিশেক ধরে পড়ে আছেন। তার সুহৃদ রুবেনসের শরীরে ঈষৎ ইহুদি রক্ত ছিল বলে তিনি জর্মনি ছাড়তে বাধ্য হন। উপস্থিত তিনি তুর্কির আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত পড়ান। বহুকাল ধরে রামায়ণখানা কামড়ে ধরে পড়ে আছেন– প্রামাণিক পুস্তক লেখবার বাসনায়।(১)

আর রাইনের ওয়াইনের প্রশংসা করার দায় তো আমার ওপর নয়। ফ্রান্সের বর্দো বার্গেন্ডির সঙ্গে সে কাঁধ মিলিয়ে চলে।

আমি যখন প্রথমদিন আমার অধ্যাপকের সঙ্গে লেখাপড়া সম্বন্ধে আলোচনা করতে গেলুম, তখন তিনি ভুরিভুরি খাঁটি তত্ত্বকথা বলার পর বললেন :

‘এখানে ফুল প্রচুর পরিমাণে ফোটে, তরুণীরা সহৃদয়া এবং ওয়াইন সস্তা। বুঝতে পারছেন, আজ পর্যন্ত আমার কোনও শিষ্যেরই বদনাম হয়নি যে নিছক পড়াশুনো করে সে স্বাস্থ্যভঙ্গ করেছে। আপনিই-বা কেন করতে যাবেন?’

রাজধানী ঠিক মোকামেই থানা গাড়ল ॥

———-

১. হালে খবর পেয়েছি তিনি রুশদেশে গিয়ে সেখান থেকে রামায়ণের প্রামাণিক পাঠ প্রকাশ করেছেন।